Wednesday, April 23, 2014

জামায়াতীদের সফল বিলাত অভিযান- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

ছোটবেলায় আমরা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ইতিহাস পড়েছি। অনুমান করছি, আর কিছুকাল পরেই ব্রিটেনের স্কুলে শিক্ষার্থীরা জামায়াতীদের সফল ব্রিটেন অভিযানের কাহিনী পড়তে পারবে। আলেকজান্ডার ভারতের বিশাল এলাকা দখল করেছিলেন বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জামায়াতীরা ব্রিটেন দখল করতে চলেছে কেবলমাত্র স্কুল-কলেজে অনুপ্রবেশ দ্বারা। বার্মিংহাম, ব্রাডফোর্ড, ম্যানচেস্টার শহরে ইতোমধ্যেই তারা বহু স্কুলকে কার্যত জামায়াতী মাদ্রাসায় পরিণত করেছে এবং লন্ডনের বাঙালীঅধ্যুষিত ইস্টএন্ডসহ অন্যান্য শহরেও তাদের অভিযান শুরু হয়েছে। এমনকি সরকারী অনুদানে পরিচালিত অসংখ্য স্টেট স্কুলও তারা দখল করে নিয়েছে।
লন্ডনের ইস্টএন্ডে মূলত বাঙালী, সোমালিয়ান-মুসলমান ইত্যাদি এমনকি কম্যুনিটি বাস করে। এই অঞ্চলটি গত দশ বছরে জামায়াতীদের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ এখন এই টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকাকে ঠাট্টা করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব টাওয়ার হ্যামলেটস’ আখ্যা দিয়েছেন। টাওয়ার হ্যামলেটস বায়ার বর্তমান নির্বাচিত মেয়র এককালে ব্রিটিশ লেবার পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মেয়র পদের নির্বাচনে তিনি লেবার পার্টির মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান এবং জনরব তিনি ইস্ট লন্ডন মসজিদ এবং এই মসজিদকেন্দ্রিক শক্তিশালী জামায়াতী-সমর্থনে নির্বাচিত হন।
মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে তিনি টাওয়ার হ্যামলেটসের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছেন। যে পূর্ব লন্ডন ছিল আশির ও নব্বইয়ের দশকে বর্ণবাদবিরোধী ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটি, সেই টাওয়ার হ্যামলেটস এখন জঙ্গী জামায়াতীদের সব চাইতে শক্তিশালী আস্তানা। সেক্যুলার বাঙালীদের সংখ্যা এবং তাদের প্রভাব এই বারায় দ্রুত কমে গেছে এবং শহীদ আলতাফ আলী পার্কে স্থাপিত একুশের ভাষা শহীদ মিনার পর্যন্ত মাঝে মাঝে জামায়াতীরা দখল করে মিনারের অসম্মান ঘটাতেও কসুর করেনি। ইতোমধ্যে পবিত্র কাবা শরিফের ইমামও এসে বাঙালী মেয়রের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। 
এটা বাঙালী, সোমালিয়ান প্রভৃতি মুসলমান ভোটাদের মধ্যে মেয়রের ইমেজ বাড়াতেও যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে।
টাওয়ার হ্যামলেটসে আবার কাউন্সিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই। বর্তমান মেয়র আবার প্রার্থী হয়েছেন। ইতোমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ হলো, তিনি কাউন্সিলের আর্থিক অনুদান বরাদ্দ করার ব্যাপারে নানা ছদ্মনামে গজিয়ে ওঠা নানা মৌলবাদী সংগঠনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অধিকাংশকে কোন গুরুত্ব দেননি। এছাড়াও রয়েছে নানা আর্থিক অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ। ফলে এই অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা হয়েছে, অডিটর নিযুক্ত হয়েছে। মেয়র নির্বাচনের আগে বর্তমান মেয়রের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব করা হয়েছে।
এই অবস্থাটাকেও বর্তমান মেয়র নিজের অনুকূলে টেনে নিয়েছেন। তাঁর প্রোপাগান্ডায় শিবির থেকে তাঁকে এখন একাধারে বাঙালীর স্বার্থরক্ষক ও মুসলমানদের স্বার্থরক্ষক হিসেবে খাড়া করা হয়েছে। বলা হচ্ছে ব্রিটেনের হোয়াইট এস্টাবলিশমেন্ট টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালীর কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারায় বাঙালী মেয়র যাতে আবার নির্বাচিত না হন, সেজন্য এই অপবাদ ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ টাওয়ার হ্যামলেটসের আসন্ন নির্বাচনে বাঙালী কার্ড, ইসলামের কার্ড এবং সাদাদের বিরোধিতা- এই তিনটা কার্ড তিনি একই সঙ্গে খেলছেন। অনেকে বলছেন, তিনি লন্ডনের বাংলা কাগজগুলোর অধিকাংশকে কব্জা করে ফেলেছেন। তারা এখন ফলাও করে তার কথাই লিখছে। কী কৌশলে তিনি এই কাগজগুলো কব্জা করেছেন, সে সম্পর্কে অনেকে ইঙ্গিতে কথা বলছেন। হয়ত সময়মতো মুখ খুলবেন।
এই ‘বাঙালী-স্বার্থ’ ও ‘মুসলমানের স্বার্থের’ রক্ষক হিসেবে বর্ণিত টাওয়ার হ্যামলেটসের বাঙালী মেয়র সম্পর্কে লন্ডনের আওয়ামী লীগসহ সেক্যুলার রাজনীতিক মহলেও একটা মোহ তৈরি হয়েছে। এই মোহ সহজে ভাঙ্গা যাবে তা মনে হয় না। সেক্যুলারিস্ট বাঙালী মহলেই বর্তমান মেয়র সম্পর্কে এই মোহ থাকার ফলে লেবার পার্টির মেয়র প্রার্থী জন বিগস যদি অবাঙালী, অমুসলমান এবং সাদা- এই কারণে হেরে যান, তাহলে আমি বিস্মিত হব না। কিন্তু আমার ধারণা জন বিগস যদি এই মেয়র নির্বাচনে না জেতেন, তাহলে পূর্ব লন্ডনে বাঙালী ও অন্যান্য এথনিক কম্যুনিটির প্রগতিশীল ও সেক্যুলার অংশের অবস্থান দুর্বল হবে এবং ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে ধর্মান্ধতার রাজনীতির ঘাঁটি আরও শক্ত হবে। শুধু লন্ডনে নয়, ব্রিটেনের অন্যান্য শহরেও দ্রুত এদের প্রভাব ছাড়াবে। যা পরিণামে ব্রিটেনের গোটা গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এটা গেল ব্রিটেনে জামায়াতী অভিযানের সাফল্যের একটা চিত্র। অপর চিত্রটি আরও ভয়াবহ। দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটেনে বসবাসকারী সেক্যুলার বাঙালীরা ব্রিটিশ সরকারের কাছে ব্রিটেনে মসজিদ ও স্কুলগুলোকে কেন্দ্র করে মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। এমনকি বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও ঘাতকদের কেউ কেউ (চৌধুরী মইনউদ্দীনসহ) লন্ডনে আশ্রয় নিয়ে মসজিদ ও নানা ধরনের তথাকথিত ইসলামী সংগঠনের নামে মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন মুসলিম দেশের অঢেল অর্থ সাহায্যে (এমনকি ব্রিটেনে তাদের অধিকৃত অথবা প্রভাবিত বারা কাউন্সিলের অর্থ সাহায্য অপব্যবহার করে) এই মৌলবাদী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে, ক্যাডার তৈরি করছে তারা তা ব্রিটিশ সরকারের গোচরীভূত করেছে। ব্রিটেনের লেবার অথবা টোরি কোন সরকারই সে ব্যাপারে নজর দেয়া এতদিন প্রয়োজন বোধ করেনি।

এতদিনে এই সরকারের টনক নড়েছে। সরকার টের পেয়েছে। এই উগ্রপন্থীরা ব্রিটেনের বড় বড় শহরে প্রচুর অর্থবৃষ্টি দ্বারা, নিজস্ব লোকদের স্কুলের গবর্নিং বডি বা পরিচালকম-লীতে ঢুকিয়ে শুধু প্রাইভেট স্কুল নয়, সরকারী স্কুলগুলোতে নামে না হয় কাজে জামায়াতী মাদ্রাসায় পরিণত করা শুরু করেছে এবং শিক্ষার আধুনিক কারিকুলাম বদলে ফেলে সেখানে ইসলামী শিক্ষার নামে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা কচি-শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে ভবিষ্যতের জঙ্গী তৈরি করার চেষ্টা করছে। 

এটা প্রথম ধরা পড়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে এবং সানডে টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টিংয়ের ফলে। পত্রিকাটির খবরে জানা যায়, ব্রিটেনের প্রথম ফ্রি মুসলিম স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ডার্বি শহরে। স্কুলটির নাম ‘আল মদীনা স্কুল।’ সরকারী অনুদান পাওয়ার লোভে এই স্কুলে আধুনিক শিক্ষাদান করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের হেড ও ডেপুটি হেড টিচারকে নানা অজুহাতে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। অতঃপর বলা হয় স্কুলের অমুসলিম নারী স্টাফকেও হিজাব পরতে হবে, নইলে চাকরি ছাড়তে হবে। ছাত্রছাত্রীদের একত্রে ক্লাসে বসা বন্ধ করা হয়। স্কুল ইনস্পেক্টরগণ অভিযোগ পেয়ে এই স্কুলে তদন্ত চালাতে গিয়ে দেখেন, তাতে ন্যাশনাল কারিকুলামের কোন শিক্ষাদানের পরিবর্তে ইসলামী শরাশরিয়তের শিক্ষাদানই বেশি। এমনকি এই স্কুলে রূপকথা পাঠ করা এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনাও নিষিদ্ধ করা হয়।
ব্রিটিশ শিক্ষা দফতর বার বার স্কুলটিকে সতর্ক করার পরেও তারা তাতে কর্ণপাত না করায় আল মদীনার সেকেন্ডারি স্কুলটিকে সরকারী নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে দেখা গেল এটা শুধু একটা স্কুলের সমস্যা নয়। সমস্যাটি অনেক বড় আকারের। লন্ডনসহ বহু শহরের স্কুলে সমস্যাটি ছড়িয়েছে। সানডে টাইমসে বলা হলো- ‘A much bigger Problem, also exposed in recent months lies, with the take over of secular schools by Islamic hardliners. It is feared many schools are effiectively becoming state funded madrasalies.’ (সম্প্রতি আরও বড় সমস্যা ধরা পড়ে, যে সমস্যা হলো ইসলামিক হার্ডলাইনারদের দ্বারা বহু সেক্যুলার স্কুল দখল হয়ে যাওয়া। আশঙ্কা করা হচ্ছে বহু স্কুল সরকারী অর্থে চালিত মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে)।
বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, ব্রাডফোর্ড থেকে চাঞ্চল্যকর খবর আসতে থাকে যে, ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্টরা স্কুলগুলো দখল করে ফেলছে। যেহেতু পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী জনসংখ্যা এই শহরগুলোতে অধিক, ফলে স্কুলের গবর্নিং বডিগুলোতে ঢুকে তারা ব্রিটেনের আধুনিক ও সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। আল মদীনা স্কুলের মতো এসব স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য পৃথক ক্লাস, ছাত্রীদের জন্য পর্দাপ্রথা বাধ্যতামূলক করা, অমুসলিম শিক্ষকদের বিতাড়ন এবং ক্রিসমাসের মতো অমুসলিম ধর্মীয় উৎসবগুলো পালনও বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়।
ফলে ব্রিটেনের অমুসলিম অধিবাসী (যারা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ) এবং আধুনিকমনা সেক্যুলার বাঙালীদের মধ্যেও শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল সানডে টাইমসের প্রধান সম্পাদকীয়র হেডিং ‘Keep Islamism out of the classroom.’ (ইসলামিজমকে ক্লাসরুমের বাইরে রাখ)। এই সম্পাদকীয়তে পত্রিকাটি বলেছে, ‘Schools should be places of learning and understanding, of preparing young people for life in britain today. We will all suffer if schools become a breeding grond for religious intolerence and radicalism and where the education provided for pupils is poor.’ (স্কুলগুলো হবে আজকের ব্রিটেনে জীবনধারণের উপযোগী করার জন্য তরুণদের শিক্ষা ও উপলব্ধি দেয়ার স্থান। তার বদলে স্কুলগুলো যদি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার সূতিকাগার হয় এবং শিক্ষাদানের মান হয় অত্যন্ত নিম্নস্তরের, তাহলে আমাদের সকলেরই শঙ্কিত হওয়ার কথা।)
ব্রিটেনের কাগজগুলোতে লেখালেখির ফলে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের চৈতন্যোদয় হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী মাইকেল গোভ ডজন ডজন ইনস্পেক্টর পাঠাতে শুরু করেছেন বিভিন্ন স্কুলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। শিক্ষাঙ্গনে ইসলামিক হার্ডলাইনাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ এবং তাদের ব্যাপক তৎপরতা সম্পর্কে তদন্তের জন্য তদন্তকারীরা মাঠে নেমেছেন। ব্রিটিশ শিক্ষা কর্তৃপক্ষ বার্মিংহামের পনেরোটি স্কুলে ইতোমধ্যেই তদন্ত শেষ করেছেন। তাদের রিপোর্ট ইস্টারের ছুটির পরই বের হবে। শিক্ষা কর্তৃপক্ষ প্রাইমারী স্কুলগুলোতেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে বেশি শঙ্কিত। তাদের মনে করেন শিশুদের মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কাজটি প্রাথমিক শিক্ষা স্তরেই শুরু করা হয়। এই শিশুদেরই পরবর্তী জীবনে জঙ্গী ও জেহাদিস্টে পরিণত করা অত্যন্ত সহজ হয়। 
পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে ১০ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য শিক্ষামন্ত্রী গোভের কাছে চিঠি লিখে শিক্ষাঙ্গনে মৌলবাদীদের আধিপত্য বিস্তার রোধ করার জন্য সরকার কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা জানতে চেয়েছেন। বার্মিংহাম থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য লিয়াম বায়রন এক বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁর এলাকায় স্কুলগুলোতে ইসলামিক হার্ডলাইনারদের তৎপরতা সম্পর্কে শুধু খ্রীস্টান অভিভাবকদের কাছ থেকে নয়, অসংখ্য মুসলিম অভিভাবক ও পিতামাতার কাছ থেকে অভিযোগ পাচ্ছেন। এই সমস্যাটি একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। 
ব্রাডফোর্ডের এক মুসলিম অভিভাবককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি কেন স্কুলে ইসলামী শিক্ষাদান সম্পর্কে চিন্তিত? জবাবে তিনি বলেন, ‘উন্নতমানের ইসলামী শিক্ষা দান করা হলে চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু স্কুলগুলোতে ইসলামী শিক্ষার নামে যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তা জামায়াতী শিক্ষা। আধুনিক যুগের সঙ্গে যে শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই, এই শিক্ষা ইসলামের মূলনীতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের সন্ত্রাসী অথবা তথাকথিত জেহাদিস্ট তৈরি করা যাবে, তারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ও মানবিক চেতনায় সমৃদ্ধ হবে না।’ এই ভয় এখন ব্রিটেনের বহু স্কুলের মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের বহু অভিভাবকের মনেও ছড়িয়ে পড়েছে। 
লন্ডনের একটি দৈনিকে একজন প্রতিবেদক লিখেছেন, ব্রিটেন ও আমেরিকা যখন ওয়ার অন টেররিজমের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অন্য দেশে যুদ্ধ চালাচ্ছে, নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, তখন এই দুই দেশের পেটের ভেতরেই সরকারী অর্থেই যে জঙ্গীবাদের চাষ হচ্ছে এবং জঙ্গীদের জন্মদান চলছে সেদিকে কারও দৃষ্টি নেই। মনে হয়, মানুষ যেমন ঠেকে শিখে, তেমনি ইউরোপ-আমেরিকাতেও শিক্ষা এবং নানা সামাজিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মৌলবাদী দানবের আত্মবিকাশের কৌশলটির দিকে এতদিনে সরকারী পর্যায়ে চৈতন্য সৃষ্টি হয়েছে। 
ব্রিটেনের মতো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও স্কুলগুলোতেও ইসলামী শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার নামে ধর্মান্ধতা ও সন্ত্রাসের ঘাঁটি বিস্তার লাভ করছে। সরকার তা ঠেকাবে কিভাবে? এই ব্যাপারে আমাদেরও সতর্ক হওয়ার ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসেছে। 
[লন্ডন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০১৪]

মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসা ॥ নেপোয় মারে দই- মুনতাসীর মামুন

‘নেপোয় মারে দই’ নামে একটি প্রবচন আছে বাংলা ভাষায়। এ কথাটি যে কত সত্য তা যতই বয়স হচ্ছে ততই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিচার বিশ্লেষণের চেয়ে বড় কিছু নেই। সরকারী-বেসরকারী অনেক কর্মকা-ের শুরুটা সিভিল সমাজের প্রতিনিধিরাই করে দেন। এর ভিতটি যখন মজবুত হয়ে ওঠে তখন তাতে আধিপত্য বিস্তারে হস্তক্ষেপ শুরু হয় আমলাতন্ত্র থেকে, কাজটি যখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে তখন জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদদের আগমন হয়, সরটা টুপ করে তাঁরা খেয়ে ফেলে সটকে পড়েন।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নিয়ে যেসব প্রতিবেদন খবরের কাগজে আসছে তা দেখে শুধু লজ্জা নয়, বিষাদগ্রস্তও হয়ে পড়ছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো ব্যবসা শুরু হয়েছে ১৯৭২ থেকে এখনও তা অব্যাহত। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা না হলে আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এত চিৎকার করতে হতো না। এসব ব্যবসা-বাণিজ্যের খবর যে আমরা জানি না তা নয়, জানি কিন্তু এসব ছাপিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নিয়ে চুরি। মানুষ কতটা নীতি বিবর্জিত, নির্লজ্জ বা এক কথায় অমানুষ হয়ে গেছে; এ ঘটনা তার প্রমাণ।
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীরা যেভাবে সহায়তা ও সমর্থন যুগিয়েছিল তা বিরল। এ নিয়ে একটি বইও লিখেছি। যার নাম তের নম্বর সেক্টর। মুক্তিযুদ্ধে আমরা সাধারণত ১১টি সেক্টরের কথাই জানি। যুদ্ধ জয়ের জন্য এই ১১টি সেক্টর গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু শুধু ১১টি সেক্টরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করলে যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আরও দুটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়। তার একটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থাকে ১২ নম্বর সেক্টর অভিধায় ভূষিত করা যায়। অপরটি হলো সারাবিশ্বের সিভিল সমাজ যাকে বলেছি ১৩ নম্বর সেক্টর। যেমন আমেরিকার সরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কিন্তু সাধারণ মানুষ শুধু যে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছে তা নয় এর পক্ষে কাজও করেছেন।
১৯৭২ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার মাঝে মাঝে ১৩ নং সেক্টরের কাউকে কাউকে সম্মানিত করেছেন কিন্তু সবাইকে নয়। এ প্রসঙ্গে ফরাসী বুদ্ধিজীবী আন্দ্রে মালারোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সামগ্রিকভাবে একটি পরিকল্পনার অধীনে এসব ব্যক্তি বা সংস্থাকে সম্মান জানানোর বিষয়টি বহুদিন রাজনীতিবিদদের মনে হয়নি।
আমরা অনেকেই এ নিয়ে লেখালেখি করেছি। আমি নিজেও বিভিন্ন সময় লিখে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে আশান্বিত হয়েছিলাম যে, এক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া হবে কিন্তু নানা কারণে তা হয়নি। ২০০৮ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে আশান্বিত হয়ে উঠি এবং এ বিষয়ে আবারও এই জনকণ্ঠে নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখি।
প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার সপ্তাহখানেক পর একদিন আওয়ামী লীগ নেতা নূহ আলম লেনিন ও সংসদ সদস্য জনাব আবুল কালাম আজাদ (রংপুর) এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরা জানালেন প্রস্তাবটি তাদের ভাল লেগেছে এবং জনাব আজাদ তা সংসদে উপস্থাপন করতে চান। সুতরাং প্রস্তাবের একটি খসড়া করে দিলে ভাল হয়। খসড়া করে দেয়ার পর তাঁরা সেটি প্রস্তাবনা আকারে তৈরি করে নেন। আমার ভাল লেগেছিল যে, একজন সংসদ সদস্য প্রবন্ধটি পড়ে মনে করেছেন এ ধরনের একটি প্রস্তাব তৈরি করে দিলে ভাল হয়। তারপর একদিন সংসদে প্রস্তাবটি উত্থাপিত হলে, সংসদ সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে তা গ্রহণ করেন। সেদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থকরা যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন।
এরপর এদেশে যা হয় তাই হলো। সিদ্ধান্ত প্রস্তাব হলো সংসদে এটুকুই। অনেক দিন পর শাহরিয়ার কবির এবং আমি কী একটি কাজে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ক্যাপ্টেন (অব) তাজের কাছে। ফেরার পথে সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্তের ঘরে গেলাম। উজ্জ্বল এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। হঠাৎ আমার সেই প্রস্তাবের কথা মনে হলো। উজ্জ্বলকে বললাম, সংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। সুতরাং তিনি যেন একটি প্রস্তাব তৈরি করে মন্ত্রীর কাছে পাঠান। উজ্জ্বল সানন্দে রাজি হলেন। পরে আমরা মন্ত্রীকেও জানালাম ও তাকেই সভাপতি করে ছোট কমিটি গঠন করতে বললাম। মন্ত্রী জানালেন, ছোট কমিটি তিনি করে দেবেন কারণ, কাজের জন্য সেটিই ভাল তবে কমিটির সভাপতি তিনি হতে চান না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও সাংগঠনিক ও অন্য দিক থেকে তার কনিষ্ঠ কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে জ্যৈষ্ঠ। তবে, খরচাপাতি সব মন্ত্রণালয়ের।
প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাবের অনুমোদন দিলে কমিটি হলো। খুব সম্ভব সাত সদস্যের কমিটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে বিস্তৃত করে প্রায় ১৫-২০ জনের করলেন। কমিটি প্রথমেই ইন্ধিরা গান্ধীকে সম্মাননা দেয়ার প্রস্তাব করে। এবং শাহরিয়ার জোরালোভাবে বলেন, তাকে যেই পদকটি দেয়া হবে তা যেন সবার থেকে আলাদা হয় এবং সোনার হয়। এ প্রস্তাব তখন অনুমোদিত হলেও অনুভব করছিলাম। কমিটির অনেকেরই এ বিষয়ে দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাবই অনুমোদন করেন, মানপত্রের নক্সা কেমন হবে তাও বলে দেন। আরেকটি যথাযথ সিদ্ধান্ত তিনি দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে যে সম্মাননা দেয়া হবে তা আর কাউকে দেয়া হবে না। অন্যান্য সম্মাননা দু’ভাগে ভাগ হবে। রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধানরা পাবেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা (বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার অব অনার) এবং অন্যান্যদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার)। এই বিষয়টি কমিটির সদস্যরা তেমনভাবে চিন্তা করেননি। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, একই দিনে ঢাকা এবং কয়েকটি দেশের রাজধানীতে এটি দেয়া হোক। যারা নামী তাদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হোক। তাহলে খরচ কমবে প্রচারও জোরালো হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রস্তাবটি গ্রহণ করেননি। তার পর নামের তালিকা। বিষয়টি ছিল জটিল। কোন দেশে জানা গেলেও তাদের অবস্থান সম্পর্কে কারও কোন ধারণা ছিল না। ৪২ বছর তো কম কথা নয়। নামের তালিকা প্রণয়নে ও তাদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন শাহরিয়ার করিব, সৈয়দ সাজ্জাদ জহির বীরপ্রতীক ও মফিদুল হক। (অধ্যাপক অজয় রায় ও অন্যান্যরা বিভিন্ন সময় নাম প্রস্তাব করেছেন)। তবে, যিনি এসব বিষয়ে সমন্বয় করে সবসময় কাজ করেছেন তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব মোস্তফা কামাল। আমি কয়েকবার মোস্তফা কামালকে (তখন অতিরিক্ত সচিব) কমিটির সদস্যের মর্যাদার প্রস্তাব করেছিলাম। সংসদ সদস্য জনাব আজাদকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি প্রস্তাবের কথাও বলেছিলাম কিন্ত, এ ব্যাপারে কর্র্তৃপক্ষের কোন আগ্রহ দেখিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুবই ব্যস্ত থাকতেন। যখন সময় পেতেন তখন বৈঠক হতো। একটা সময় এলো যখন মানপত্র (বা ক্রেস্ট) তৈরি করতে হবে, সয়ম নেই, পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নেই। তিনি যখন একদিন বৈঠক দিলেন তখন ঠিক হলো, দ্রুত সব তৈরি করে দিতে হবে সময় নেই। তখন শিল্পী হাশেম খান জানালেন, তাঁর এক ছাত্র এ ধরনের কাজ করেন। তাঁকে তিনি অনুরোধ করতে পারেন। তবে, দ্রুত সে কাজ করে দিলে তো কাজটি সে পাবার আশা করবে। সবাই জানালেন, সেটিই স্বাভাবিক। হাশেম খান দু’একদিনের মধ্যে খেটেখুটে সব নক্সা করে তাঁর ছাত্রকে ডেকে একটি মডেল তৈরি করে দিতে বললেন। আমরা তখন বলেছিলাম, যেহেতু এটি ইন্দিরা গান্ধীকে দেয়া হবে সেজন্য স্বর্ণ যেন আনবিক কমিশন থেকে পরীক্ষা করানো হয়। হাশেম ভাইয়ের প্রাক্তন ছাত্র (যিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ ধরনের কাজ করে দেন) মডেল তৈরি করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করলেন, কমিটিও। কাজটি দেয়ার সময় হলে, খুব সম্ভব মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি প্রস্তাব করলেন- এসব কাজ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় করবে। কারণ, এসব অর্ডার দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা আছে। আমরা এক অর্থে বহিরাগত, তাই চুপই ছিলাম। এরপর যে ৩৩৮টি ক্রেস্ট তৈরি হয়েছে তার দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ই নিয়েছে। আমরা যেহেতু বাঙালী, মাথার পিছে একটি অস্বস্তি কাজ করছিল এ প্রস্তাবে কিন্তু এতদিন পর এ ধরনের একটি প্রস্তাব বাস্তবায়িত হচ্ছে বিধায় এসব নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। 
কয়েক দফায় এসব সম্মাননা দেয়া হয়েছে এবং তা সরকারের, দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বিদেশে অনেকে বলেছেন, বাঙালী যুদ্ধ করতে জানে, বন্ধুদের ভালবাসতে ও সম্মান করতেও জানে। আর শেখ হাসিনা হলে এটি হতো। আমরাও তাই বিশ্বাস করি। 
এখন গত সপ্তাহে প্রথম আলো ও দৈনিক জনকণ্ঠে সংবাদ পড়ে দুঃখ, লজ্জাই শুধু নয়, হতবাকও হয়ে গেলাম। প্রথম আলোয় মন্ত্রণালয়ের কয়েকজনের নাম দেয়া হয়েছে যারা গোটা প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে জানা যায় দুই শীর্ষ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় হিসাবরক্ষক জামান এ চুরির প্রক্রিয়ায় জড়িত। এরা শুধু সোনা চুরিই নয় ‘বিদেশ থেকে সম্মাননা নিতে আসা ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া, থাকা খাওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে কমিশন নেয়া হয়েছে।’ [জনকণ্ঠ ৭.৪.১৪]
ওই প্রতিবেদনে জানা গেছে- ‘শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে সহকারী হিসাবরক্ষক জামান এতে ভেজাল দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করে। এর পর থেকে পর্যায়ক্রমে ক্রেস্টে ভেজালের পরিমাণ বাড়তে থাকে। পরে ক্রেস্ট তৈরির কাজগুলো দেয়া হয়েছে ‘ল্যাংড়া’ নামে পরিচিত ওই শীর্ষ কর্মকর্তার পছন্দের প্রতিষ্ঠান এমিকনকে। এমিকনের পক্ষে তখন যোগাযোগ রক্ষা করতেন নাজিম নামে এক ব্যক্তি [ঐ]
আরও জানা যায়Ñ ‘বিদেশীদের সম্মাননা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা আছে, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সঙ্কর ধাতু পাওয়া গেছে। কিন্তু বিলে দেখা গেছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি ক্রেস্টের জন্য অন্যান্য খরচের সঙ্গে দুই ভরির বেশি (২৩ দশমিক ৫ গ্রাম) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি বিলে লেখা গ্রাম, কিন্তু দাম ভরির) রুপার দাম পরিশোধ করা হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়া এ ক্রেস্ট কেনা হয়েছিল। ৩৩৮টির মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে এমিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।’ [ঐ]
অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীকে দেয়া ক্রেস্ট ছাড়া ৩৩৮টিতে চুরি হয়েছে। অর্থাৎ ৪০৫৬ আনা প্রায় ২৫৩ ভরি সোনা চুরি গেছে। প্রায় ১১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে রুপার দাম যোগ করলে কত দাঁড়ায়? আর ভ্রমণ ও থাকার বন্দোবস্তে অন্যান্য কমিশন!
এই চুরি করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অধিকারীরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সময় দিতে পারতেন না। তিনি কোন কো-চেয়ারম্যানও কমিটিতে রাখেননি। ফলে, তিনি না থাকলে কমিটি কোন কাজ করতে পারত না। মোস্তফা কামালকে কমিটিতে না রাখায় তিনিও কিছু করতে পারতেন না। আর তৎকালীন সচিব মিজারুল কায়েসও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতোই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সময় দিতে পারতেন না। ফলে সব কাজ শেষ মুহূতে তড়িঘড়ি করে করতে হতো। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সুযোগ পেয়েছিলেন এ কথা বলার যে, সময় কম, দ্রুত কাজ করাতে হবে। টেন্ডার বা ক্রয় কমিটির প্রক্রিয়ায় গেলে কাজ হবে না। সুতরাং, বিষয়টি এক ধরনের বৈধতা পেয়েছিল। আর প্রতিবেদনে উল্লিখিত চারজন ছাড়া মন্ত্রণালয়ের কেউ বিষয়টি জানতেন না, এটি মেনে নেয়া কঠিন। যেখানে, কার বাড়িতে কী রান্না হয় তার খবরও আমরা রাখি। 
পুরো ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, কীভাবে কারা কাজ করে, কারা ফায়দা লুটে তা বোঝাবার জন্য। কমিটির সব সদস্য না হোক একটি অংশ যেভাবে কাজ করেছেন, সম্মানি বাবদ মাত্র কয়েক লাখ টাকা দিলেও তাদের সাশ্রয় হতো। আনন্দিত হতেন। উল্লেখ্য, প্রথমে সভার সদস্যদের কোন সম্মানি দেয়ারও বন্দোবস্ত ছিল না। কয়েকবার এ নিয়ে কথা ওঠায় যেন অনেকটা বাধ্য হয়েই সভায় উপস্থিত সদস্যদের সামান্য সম্মানির ব্যবস্থা করা হয়। যেমন, মহিউদ্দিন আহমদ ও হাশেম খান থাকতেন উত্তরায়। অনেকদিন গাড়ির অভাবে গাড়ি ভাড়া করে বা অন্যের গাড়ি ধার করে এসেছেন। অথচ, পুরো প্রক্রিয়ার অধিকাংশ কাজ করে দিয়েছে কমিটি। এমনও হয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লোক নেই [ইচ্ছাও নেই], আমি ও সাজ্জাদ জহির বা শাহরিয়ার মোস্তফা কামালের রুমে বসে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনকে জানিয়েছি। নিজেদের দূতাবাসে যোগাযোগ করেছি। এমনও হয়েছে, অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তাঁরা বলেছেন, চিঠি পাননি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি পররাষ্ট্রমন্ত্রী না থাকায় চিঠি সই করতে পারেননি। তিনি এলে সই করবেন তারপর দূতাবাসে তা যাবে এবং তাঁরা আমন্ত্রিতের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। 
সম্মাননার সোনা চুরির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী ক্ষোভ জানিয়েছেন। প্রথম আলো সম্পাদকীয়তে লিখেছেÑ
সোমবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোর কাছে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতেও স্পষ্ট হয় যে সরকার বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। মন্ত্রী বলেছেন, এমন স্পর্শকাতর বিষয়, যেখানে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জড়িত, সে বিষয়ে এমন অনিয়ম অবিশ্বাস্য। আমরা বলব, এক্ষেত্রে ‘অনিয়ম’ একটি কোমল শব্দ, যা হয়েছে তা লজ্জাজনক অপরাধ। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়াই ৩৩৮টি ক্রেস্ট কেনা হয়েছে। ৬০টি ক্রেস্ট কোন প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছে, তা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়নি। অবশিষ্ট সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে এমিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কী পরিচয় এ প্রতিষ্ঠানের? কী করে সেটি এ কাজ পেয়েছিল? প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ ভরি স্বর্ণ কোথা থেকে পেল, সে ব্যাপারেও রাখঢাক করছে। শুধু তাই নয়, ক্রেস্টের ওজনেও জালিয়াতি করে সরকারের কাছ থেকে বেশি দামে আদায় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। [৯-৪-১৪]
এসব ক্ষোভ সব সময়ই প্রকাশ করা হয়। কমিটিও হয়। কাজ কিছুই হয় না। যদি এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে সত্য উদঘাটন করে দোষীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও শাস্তি দেয়া হতো তাহলে এই সব ক্ষোভে একটা যৌক্তিকতা পেত। যারা প্রায় কুড়ি টাকা চুরি করেছে তারা যদি কয়েক কোটি টাকা বিলোয় তা হলে সবাই এ ঘটনা ভুলে যাবে। যারা এই ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে অন্তত তাদের গ্রেফতার করে প্রারম্ভিক কাজ শুরু করা যেত। কারণ, তাদের অপরাধ প্রমাণিত।
মুক্তিযুদ্ধ কী ভাবে ব্যবসা হয়ে গেল তার আরেকটি উদাহরণ দিই। মন্ত্রণালয় মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ২০০/৩০০ বই কিনে বিতরণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য জায়গায়, খুবই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু, প্রকাশককে এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত দুইজনকে একটি বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয় বিশেষ করে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীর ‘প্রিয়ভাজন’ বলে পরিচিত কর্মকর্তাকে। এসব ক্ষেত্রে তার কথাই ছিল শেষ কথা। একজন প্রকাশক প্রতি বইয়ে ১০ ভাগ লাভ করে কিনা সন্দেহ। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও প্রকাশকের লাভের অংশটা ঐ দুই ব্যক্তিকে দিতে হতো। আমি দায়িত্বহীনভাবে এই উক্তি করছি না। জেনেশুনেই করছি। ফলে, ভাল বইয়ের প্রকাশক আর মন্ত্রণালয়ে বই দিতে আগ্রহী নয়। এমনিতে মুক্তিযুদ্ধের বই প্রকাশিত হয় কম। এবং কপির সংখ্যা ৫০০-এর বেশি নয়। সেখান থেকেও কমিশন! মনে হয় এই চক্র পিঁপড়ে টিপেও নির্যাস বের করতে পারবে। সব মন্ত্রণালয়েই কমবেশি এ ধরনের চক্র থাকতে পারে। মন্ত্রী বা সচিব কখনই তা স্বীকার করবেন না। আমরা যারা ভুক্তভোগী তারা বিষয়টি জানি। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে আমরা আলাদাভাবে মর্যাদা দিই, বিবেচনা করি। সেখানেই যদি এরকম হয় তা হলে বলতে হয়, এ দেশের মানুষের নৈতিক ভিত্তিটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের আরেকটি কেলেঙ্কারি মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র। যখন এই সনদপত্র আবার নতুন করে দেয়া শুরু হলো তখন থেকেই শুনে আসছিলাম এ ধরনের কেলেঙ্কারি হচ্ছে অর্থাৎ সনদ বিক্রি হচ্ছে। একটি রিপোর্টে জানা যায়, এই চক্রই নাকি জড়িত ছিল এসব বিক্রিবাটার সঙ্গে। “এ সময় অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের কাছে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। এর অধিকাংশ কর্মকর্তা ছিলেন হয় প্রকৌশলী, না হয় সাব-রেজিস্ট্রার, না হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণকারী পদে কর্মরত কর্মকর্তারা। এদের কাছে একটি সার্টিফিকেট ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করারও নজির আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর পর এটি শুরু হয়। এ সব ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদেশ জারির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট প্রদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেন”[ঐ]।
১৯৭২ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ সনদ দেয়া শুরু হয় তখনই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। রাজাকারদের তালিকা না করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলো। সনদপ্রাপ্তদের জাগতিক সুবিধা দেয়া হলো। ফলে, প্রতিটি সরকার এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুনভাবে সনদ দেয়া শুরু করল। কোন সরকারই রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করেনি, আমরা করেছি। প্রতিটি সরকারের আমলেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করেছে নিজ স্বার্থে।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ বসবাস করেন গ্রামাঞ্চলে। তাঁদের কয়জন সনদ পেয়েছেন? এবং যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা সরকারের কী সুবিধা পেয়েছেন মাঝে মাঝে ভাতা ছাড়া? শহরাঞ্চলের চাকরিজীবীদের মধ্যেই আগ্রহ বেশি সনদ পাওয়ার। চাকরি সুবিধা ছাড়া পুত্রদের ক্ষেত্রেও সুবিধা প্রযোজ্য হয়। এটি কোন দেশে হয় না। সংবিধানের মূল স্পিরিটের সঙ্গেও এর সাযুজ্য নেই। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সবার চাকরিজীবন শেষ হওয়ার পথে। সুতরাং সনদ দিয়ে কী হবে? মুক্তিযোদ্ধাদের কোটাও এক বিশেষ স্বার্থ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন ধরনের কোটা অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্বার্থের বাইরে দাঁড়িয়ে সব বিষয় নতুন বিবেচনা করা দরকার। সরকারও যদি মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ না বাড়াত তা হলে এবারও সনদ নিয়ে কেলেঙ্কারি হতো না। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা তাঁরা বলেন, সনদের জন্য তাঁরা যুদ্ধ করেননি। সুতরাং এসব সনদ দেয়া বন্ধ করে দিলে ক্ষতি কী? এতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হলো বলার অবকাশ নেই।
সনদপ্রাপ্ত প্রচুর মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করছেন। রাজনৈতিক স্বার্থ এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ এসে মিলেছে এক মোহনায়। এই স্বার্থ ভাঙ্গা জরুরী কিন্তু কষ্টকর। বর্তমান সরকার ভুয়া সনদপত্র শনাক্ত করুন, ভাল কথা, কিন্তু নতুন সনদ দিয়ে আবারও কেলেঙ্কারির সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই। কারণ এই সব কেলেঙ্কারি সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কথাও বলতে হয়। গত নির্বাচনে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী প্রভাব খাটিয়ে নিজের পছন্দমতো সংসদ করেছেন –একথা সরকার ছাড়া সবাই জানতেন। এবং গত সঙ্কটের সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নিশ্চুপ ছিল। সংসদের আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কয়েকদিন আগে দেখলাম সংসদের বর্তমান নেতৃত্ব ও প্রাক্তন মন্ত্রী পরস্পরের বিরুদ্ধে বলছেন। এ দ্বন্দ্ব নিশ্চয় আদর্শগত নয়। আর এক দশকের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের জেনারেশনের অনেকে চলে যাবেন, মুক্তিযোদ্ধারাও, তখন কি সংসদ রাখা হবে? রাখা হলে কেন রাখা হবে? এসব প্রশ্নও বিবেচনা করার সময় এসেছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নিয়ে খানিকটা বলি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে এখানে স্তম্ভ নির্মাণের কথা বলেছিলেন, যা কারো মনে ছিল না জিয়াউর রহমান ছাড়া। সে কারণে, তিনি এখানে শিশুপার্ক তৈরি করেছিলেন। পরলোকগত গিয়াস কামাল চৌধুরী আসল কথাটি বলেছিলেন। পাকিস্তানীরা যে এখানে আত্মসমর্পণ করেছিল তা যেন নতুন প্রজন্ম ভুলে যায় সে কারণেই পরিকল্পনা করে শিশুপার্ক নির্মাণ করা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিরোধী দলের নেত্রী। তার মূল বক্তৃতার খসড়া করে দেয়ার ভার ছিল আমার ওপর। জনাব কিবরিয়া জোর করে আমার ওপর তা চাপিয়েছিলেন। খসড়া তৈরি করার সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে এবং খসড়ায় লিখি ক্ষমতায় গেলে বিরোধীদলীয় নেত্রী সেখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ করবেন। নানা হাতে খসড়ার পরিবর্তন হলেও শেখ হাসিনা এই প্রস্তাবটি বাদ দেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমরা যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম। যাক, আর কিছু না হোক স্বাধীনতা স্তম্ভ হবে। হাশেম খান, রবিউল হুসাইন ও আমি যাঁরা বঙ্গবন্ধু জাদুঘর নির্মাণে অংশীদার ছিলাম তাঁরাই উৎসাহী ছিলাম। আমাদের বয়সও এখন থেকে ছিল কম এবং সে আমলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সিভিল সমাজের ভাল যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাদের অনেক প্রস্তাব শুনতেন। যেটি ভাল মনে করতেন তা কার্যকর করতেন। আজকের ধানম-ি লেকের যে রূপান্তর সেটি কিন্তু শেখ হাসিনারই যা আমরা ভুলে যাই। যা হোক। প্রধানমন্ত্রীকে তাগাদা দেয়ার পর সত্যি সত্যিই ড. সৈয়দ আবদুস সামাদকে প্রধান করে একটি জাতীয় কমিটি করা হলো যেখানে আমলাতন্ত্রের ভিড় ছিল, যাঁরা উদ্যোগী ছিলেন তাঁদের কয়েকজন ছিলেন, আমি ছাড়া। এতে হাশেম খান, রবিউল হুসাইন প্রমুখ খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ঐ কমিটির ধারণা ছিল না কাজটি কী। খুব সম্ভব সংস্কৃতি ও পূর্ত মন্ত্রণালয় যুক্ত ছিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে, পূর্র্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেই একটি বাস্তবায়ন কমিটি করা হয়। সেখানে জামিলুর রেজা চৌধুরী, মজহারুল ইসলাম, হাশেম খান, রবিউল হুসাইন ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। সেখানেও আমি না থাকায় অন্যান্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে আমাকে কো-অপ্ট করা হয়। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর আমরা এ ক’জনই এটি গড়ে তুলি। প্রথমে স্থপতি নির্বাচন। যে সব নকশা আমরা পেয়েছিলাম তার কোনটিই জুরিদের পছন্দ হয়নি। পরে হাশেম ভাই বর্তমান নকশাটির কনসেন্ট পছন্দ করে বললেন, স্থপতিরা রাজি থাকলে এখানে যাঁরা অভিজ্ঞ আছেন তাঁদের সহায়তায় এটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে পারে। পরে বর্তমান নকশাটি মনোনীত করা হয় এবং পুরো সোহরাওয়ার্দী ময়দান ঘিরে একটি পরিকল্পনা করা হয়। এর নিসর্গ পরিকল্পনা থেকে কারা এটি পরিচালনা করবে সব কিছুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
এই নকশার মূল আকর্ষণ ছিল কাঁচের স্তম্ভ ও দেয়াল এবং ভূগর্ভস্থ ফোয়ারা ইত্যাদি। হাশেম ভাই এবং আমার প্রস্তাব ছিল দেয়ালে টেরাকোটার কাজ যা আমাদের শিল্পের বৈশিষ্ট্য। কমিটি রাজি হলে হাশেম খানকে প্রধান করে আরেকটি উপ-কমিটি করা হয়। এখানে কী থাকবে সেটি আমি পরিকল্পনা করি। এ জন্য শিল্পীরা ও হাশেম খান যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিলেন। এক পর্যায়ে, এর দায়িত্বে নিযুক্ত প্রকৌশলী কমিশন চাইলে শিল্পীরা কাজ বন্ধ করে দেন। সেই সময় কাজ দ্রুতই এগুচ্ছিল কিন্তু পরে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঝামেলায় কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে।
কাঁচের স্তম্ভের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তা জোড়া লাগানো হবে না। এ নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক, আলোচনা হয়েছে। একসময় ঠিক হলো বিষয়টি পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষ টিম যাবে বিদেশে। সোহেল আহমেদ ছিলেন তখন পূর্ত সচিব। তাঁর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়ের লোকজনকে নিয়ে কমিটি হলো যাঁরা বিদেশ যাবেন। বাদ গেলেন যাঁরা বিশেষজ্ঞ যেমন হাশেম খান বা রবিউল হুসাইন। শেষ মুহূর্তে আমাদের প্রতিবাদে রবিউল হুসাইনকে নেয়া হলো। উল্লেখ্য, এই দেখে প্রস্তাবে ভূমিকা রেখেছিলেন হাশেম খান, রবিউল হুসাইন ও আমি। কারণ, এতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দরকার ছিল। যা হোক, আমলা কমিটি বাজার-টাজার করে ফিরে এসে জানাল কিছু করার নেই।
একসময় সরকার বদল হলো। স্বাধীনতা স্তম্ভ শিকেয় উঠল। নতুন কমিটি হলো। তারা সেই দেয়ালে জিয়াউর রহমানের অবয়ব লাগালেন। সংসদে আমাকে এবং হাশেম খানকে নিয়ে অভিযোগ করা হলো আমরা টাকাপয়সা নয়ছয় করেছি বলে। সাংসদদের জ্ঞানের পরিধি এমনই ছিল যে তাঁরা জানতেন না টাকাপয়সার ব্যাপারটা দেখার কর্তৃত্বটাই আমাদের ছিল না। দীর্ঘ একযুগ পর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে আবার উদ্যোগ নেয়া হলো স্বাধীনতা স্তম্ভ গড়ার। এর মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বিশেষ করে মজহারুল ইসলামের। জামিলুর রেজা চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হলো। পুরনো কমিটির আমরা তিনজনও রইলাম। ভেবেছিলাম, আমাদের বন্ধু তাজ যখন মন্ত্রণালয়ের প্রধান তখন স্বচ্ছন্দে দ্রুত কাজ করতে পারব।
এরি মধ্যে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ও আমার একটি রিট হাইকোর্টে গৃহীত হলো। বিচারপতি খায়রুল হক রায় দিলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুধু স্বাধীনতা স্তম্ভ থাকবে আর কিছু নয়। এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে তা চিহ্নিত করতে হবে।এর অন্য অর্থ শিশুপার্ক, পুলিশ ফাঁড়ি ইত্যাদি সরাতে হবে। জিয়াউর রহমানের কলঙ্ক এতদিনে অপসৃত হবে এ ভেবে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম।
কাহিনী ছোট করি, স্তম্ভটির নামকরণ করেছিলেন হাশেম খান ‘আলোর স্তম্ভ’। শেখ হাসিনা তা অনুমোদন করেছিলেন এবং আলোর স্তম্ভ কেমন হবে সে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। সে কাগজটি আমার কাছে আছে। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছিলেন দেশী ফার্ম দিয়ে কাজ করাতে হবে। এবার আলোর স্তম্ভের তৈরির জন্য যে নকশা দেয়া হলো তাতে অনেক শর্ত লঙ্ঘিত হওয়ায় আমরা তা স্থগিত করি। প্রধান প্রকৌশলী ও মন্ত্রীর পছন্দের যে নির্মাণ সংস্থার কাজ ছিল সেটিতেও আমাদের আপত্তি ছিল। আমরা তাদের মডেল তৈরি করতে বলেছিলাম। এবং বলেছিলাম, তা পছন্দ না হলে দেশের গ্রানাইট দিয়ে স্তম্ভ হবে কারণ তা মজবুত হবে, রক্ষণাবেক্ষণও সহজ হবে এবং প্রধানমন্ত্রী যে আলোর শিখা চেয়েছিলেন তা সংস্থাপন সহজ হবে। টাওয়ারে ওঠার লিফট সংযোজন করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকে আমরা সম্মান করতে চেয়েছিলাম। এ নিয়ে যখন একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে তখন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রী আমাদের সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ তুলে আপত্তিকর মন্তব্য করেন এবং তা পত্রিকায় ছাপা হয়। গত ৪০ বছর আমাদের সম্পর্কে বিএনপি- জামায়াতও এ রকম অবমাননাকর মন্তব্য করেনি। আমি ক্যাপ্টেন তাজকে বলি তা প্রত্যাহার করতে। মন্ত্রী রাজি হননি। কারণ, ভেবেচিন্তেই তিনি মন্তব্যটি করেছিলেন। এ কারণে আমরা পদত্যাগ করি। আওয়ামী লীগের অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আমাদের পদত্যাগে কিন্তু ব্যাপারটা কখনও তাঁরা জানতে চাননি। কারণ তাজ তখন মন্ত্রী। পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে। এখন হলে সবাই আমাদের পক্ষে নানা কথা বলতেন। শুনেছি প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করেছেন যা কখনও তিনি আমাদের সম্পর্কে করেননি। যতটুকু জানি তাঁকে বলা হয়েছিল পদত্যাগের কারণ নাকি ছিল আমাদের কার নাম আগে-পরে যাবে সে নিয়ে নাকি আমাদের ক্ষোভ ছিল। তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রীও তা সমর্থন করেছিলেন। বিষয়টি ছিল বানোয়াট। কিন্তু যে প্রধানমন্ত্রীর জন্য জামিলুর রেজা চৌধুরী হাশেম খানÑআমরা একযুগ কাজ করলাম তিনি কখনও আমাদের ডেকে জানতে চাননি মূল বিষয়টি কী। মূল বিষয়টি কী ছিল সেটি পাঠকরা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন। ২শ’ ৫০ কোটি টাকার কাজ। এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত । সেই প্রকৌশলী ও মন্ত্রীর পছন্দের ফার্ম কাজ পেল। খুব সম্ভব ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে [ আমার ভুল হতে পারে তবে ২০০ কোটির ওপর তাতে সন্দেহ নেই]। এবার স্থপতিরাও রাজি, আগে তারা এ ব্যাপারে সব সময় আপত্তি জানিয়েছেন। খুব সম্ভব এক ঢিলে ফার্মের সহায়তায় কাজটি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এতে অবশ্য খুশি যদিও তাঁর আগের ইচ্ছানুযায়ী কাজটি হয়নি। কিন্তু মনে রাখতে হবে টাকার অঙ্কটা। নেপোরা টাকা অর্জনে কী করতে পারে এটি তার এক উদাহরণ।
সরকার এখন জনসভার স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যা বাঞ্ছনীয় নয়। মহাপরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। হাইকোর্টের আদেশ মান্য করা হয়নি। সরকার না মানলে হাইকোর্টের করার কিছু নেই। আমরা না মানলে খবর আছে। শুধু তাই নয় জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা বলবৎ থাকায় নিশ্চয় সরকার খুশি। তা হলে, প্রশ্ন জাগে এখন জিয়াকে নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে তাতে তাঁরা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন না কেন? এলাকাটি এখন নেশাখোর ভবঘুরে পতিতাদের স্থানে পরিণত হয়েছে।
একটি সুন্দর পরিকল্পনা কীভাবে অসুন্দরে পরিণত হতে পারে তার উদাহরণ স্বাধীনতা স্তম্ভ। মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে ব্যবসা হতে পারে বা ব্যবসা করা হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। এই স্তম্ভে কী ভাবে কতো খরচ হলো জানতে চাইলে কি মন্ত্রণালয় সদুত্তর দিতে পারবে?
এভাবে শুধু ইচ্ছে নিয়ে আমরা সব সময়ই কাজ করতে চেয়েছি, কাজ করেছি। যখন কাজটি শেষ পর্যায়ে আসে এবং টাকার প্রশ্ন আসে তখনই আমাদের কোন না কোনভাবে অপদস্থ করা হয়েছে। অথচ সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, এর নেতারা বা মন্ত্রীরা তাঁর ধারক-বাহক। টাকা খাওয়ার ব্যাপারে দেখি সবাই ঐকমত্য পোষণ করে।
এসব বিষয় বিস্তারিত কখনও লিখিনি। আজ খানিকটা লিখলাম। কেননা, নিজের দেশের মন্ত্রী- আমলারা মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি করে পয়সা বানাচ্ছে, খাচ্ছে ঠিক আছে। কিন্তু সারাবিশ্বে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে গর্ব করি তার বারোটা বাজানো হলো! কয়েকটি ব্যক্তি সবসময় এ কাজ করে। মন্ত্রীরা তাঁদের বিশ্বাস করেন। প্রধানমন্ত্রী স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মন্ত্রীদের বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাঁরা ইচ্ছে পূরণের কাজটা করে দেয় তাদের কখনও বিশ্বাস করেন না এটাই আশ্চর্য! এভাবে বারেবারে নেপোয় মারে দই।
এ কারণেই আমরা যারা দীর্ঘদিন ওসব কাজ করে আসছি তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। যাদের জন্য করি তারা যখন অপদস্থ করে আমাদের এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অপদস্থকারীদের নিকটজন ভাবেন তখন এসব থেকে দূরে থাকাই ভাল। তবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসাও বোধহয় আর বেশিদিন করা যাবে না। মানুষ এখন অনেক সচেতন, অনেক ভয়হীন। এমন একটা দিন আসবে, এবং তা খুব বেশি দূরে নয় যখন মুক্তিযোদ্ধা ব্যবসায়ীরা রাস্তায় প্রহৃত হবেন, ঘর ছেড়ে বেরুতে পারবেন না।
১৩, ১৪ এপ্রিল, দৈনিক জনকন্ঠ