Wednesday, June 17, 2015

একজন সাংবাদিককেও বেকার করেননি বঙ্গবন্ধু : তথাকথিত সংবাদপত্রের কালো দিবস প্রসঙ্গ

আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া,বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন ২০১৫

১৬ জুন। এই দিনটি আসলেই মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধী রাজনীতির আজ্ঞাবহ একটি ক্ষুদ্র চিহ্নিত মহল ঘটা করে কালো দিবস পালন করে। এবারো ব্যতিক্রম হয়নি। তাদের ভাষায়, এই দিন নাকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চারটি পত্রিকা বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে হাজার হাজার সাংবাদিকদের বেকার করেছিলেন। যা একটি ডাহা মিথ্যাচার। জাতির পিতার মৃত্যুর পর তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের যে নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল এই তথাকথিত কালো দিবসটি ছিল তার অন্যতম। তৎকালীন বিএফইউজের সভাপতি আহম্মদ হুমায়ুন ও ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিবাহিনীর সহযোগী আনোয়ার জাহিদ ছিল এই কালো দিবস ঘোষণার অন্যতম হোতা। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে সামরিক সন্ত্রাসকে খুশি করে নিজেদের আখের গোছানোই ছিল এই অপতৎপরতার মূল লক্ষ্য। তবে আমার সান্ত¡না দেশের সিংহভাগ সাংবাদিক এই অপকৌশলকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন, তারা বরং ২১ জুন দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতন দিবস পালন করেন যেদিন বিএনপির লেলিয়ে দেয়া পুলিশবাহিনী জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢুকে নির্বিচারে শ্বেত সন্ত্রাস কায়েম করে এবং সাংবাদিকদের নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ অর্ধশত সংবাদকর্মীকে মারাত্মক জখম করে।
শুধু এই ক্ষুদ্র স্বার্থন্বেষী মহলই নয়, এই বিষয়টি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত চক্র সেই ১৯৭৫-এর পর থেকেই মিথ্যাচারে লিপ্ত এবং বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কালিমা লেপনের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। জাতীয় সংসদের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন হঠাৎ করে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেন। সরাসরি সংসদের ফ্লোর থেকে সাংবাদিক গ্যালারির প্রতি দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, এখন যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের বয়স ৩১/৩২ বছরের বেশি নয়, আপনারা অনেকেই ইতিহাস জানেন না। আজ আপনারা এখানে বসে সাংবাদিকতা করতে পারতেন না, কারণ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে আর বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এসে পত্রিকাগুলো মুক্ত করেন। এরপর বিএনপি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করে। আপনারা ভুলে গেছেন শেখ মুজিব প্রায় ৭-৮ হাজার সাংবাদিককে বেকার করেছিলেন। আর বর্তমানে দেশের সাংবাদিকের সংখ্যা ৩০-৩২ হাজার। এ কৃতিত্ব বিএনপি ও শহীদ জিয়ার। বঙ্গবন্ধু চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বেকার করে পথে বসিয়েছিলেন। না। বিষয়টি এমন সরলীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। এটা কোনো মতেই তৎকালীন যা ঘটেছিল তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ নয়। এটা ডাঁহা মিথ্যাচার।
বঙ্গবন্ধুর সময়কার যে সব সাংবাদিক এখনো বেঁচে আছেন কিংবা বহুদিন বেঁচে ছিলেন তাদের স্নেহছায়ায় বসে যখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ শুনতাম তখন চোখ অশ্রæসজল হয়ে উঠতো। কোনো কোনো সিনিয়র রিপোর্টারের মুখে শুনেছি বঙ্গবন্ধু নিজের প্লেট থেকে নিজ হাতে মেখে সাংবাদিকদের খাইয়ে দিতেন। কারণ কোনো কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ভোজপূর্বে এমন বিশৃঙ্খলা হতো যে, কর্মরত সাংবাদিকদের ভিড় অতিক্রম করতে কষ্ট হতো এবং অনেক সময় পেটে নিদারুণ ক্ষুধার আগুন নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রেরণ করার দায়িত্ব পালন করতে হতো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ট্যুরে গেলে সাংবাদিকদের ঘুমানোর উপযুক্ত স্থান নির্ধারণের আগে নিজে ঘুমাতে যেতেন না। এমনকি স্বাধীনতার পর বিপন্ন বাংলাদেশে যখন ব্যাংকে একটি কানাকড়িও নেই, সেই সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে ডেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে বিশাল অর ঋণ দেয়ার জন্য লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠান দুটির একটি হলো ‘ইত্তেফাক’ অন্যটি ‘সংবাদ’। অতএব, বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্র বন্ধ করে সাংবাদিকদের পথে বসিয়েছিলেন এমন বক্তব্য কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তবে যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা সত্যনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করলেই প্রমাণিত হবে তিনি সংবাদপত্র বন্ধ করেননি এবং একজন সাংবাদিককেও বেকার করেননি।
১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বঙ্গবন্ধু সরকার নিউজপেপার ডিক্লিয়ারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স নামে যে আইন পাস করে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল তৎকালীন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ইতিহাসের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। অনেকেই বলে বেড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধু সরকার একদলীয় বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) শাসন কায়েম করেছিল। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ রেখে অন্য সব দলের রাজনীতি বন্ধ করে দিলে একদলীয় শাসন বলা যেতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মূলত বাকশাল নামের একটি জাতীয় প্লাটফর্ম তৈরি করে তার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন এটি একেবারেই একটি সাময়িক ব্যবস্থা। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল লুটেরা ও ধনিক-বণিক নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমুখী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন। এ জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশিত পদক্ষেপ ছিল একটি অর্থবহ গণমাধ্যম গড়ে তোলা, যা সাধারণ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবে।
কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু নিউজ পেপার এনামেন্ট অর্ডিনেন্সটি জারি করেছিলেন? এ ব্যাপারে দৈনিক দিনকালের উপসম্পাদকীয় পাতায় জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় নিবেদিত সাংবাদিকদের নেতা এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের এককালের প্রেস উপদেষ্টা রিয়াজউদ্দিন আহমদ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সংবাদপত্রের কালো দিবস পটভূমি ও ঘটনাপঞ্জি শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখার জন্য রিয়াজউদ্দিন সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যতদূর সম্ভব লেখক তার নিবন্ধে কোনো প্রকার মিথ্যাচার করেননি। তবে চতুর বণিকের মতো তিনি যা করেছেন তা হলো সত্য প্রকাশ না করা। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি প্রায় সত্যের কাছাকাছি এসেও শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে গেছেন। অথচ সত্য লিখলে তার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে করি না। বরং একজন সাংবাদিক হিসেবে জাতির কাছে তার যতটুকু দায়বদ্ধতা আছে তা কিছুটা হলেও পূরণ হতো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে জঘন্য মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে তার কিছুটা হলেও লাঘব হতো। অন্যদিকে যে সব ধড়িবাজ লোক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পোশাক জড়িয়ে বর্তমানে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন তাদের মুখোশ কিছুটা হলেও জাতির কাছে উন্মোচিত হতো। তবে এমন কাজটি রিয়াজ সাহেব কেনই বা করতে যাবেন?
রিয়াজউদ্দিন তার নিবন্ধে তৎকালীন পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে। জুন মাসে অকস্মাৎ বন্যা দেখা দেয় অতিবৃষ্টির কারণে। ফলে ফসল মার খায়। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে প্রচুর বন্যা দেখা দেয় অতিবৃষ্টির কারণে। ফলে ফসল মার খায়। এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে প্রচুর বন্যা। দেশে খাদ্যাভাব, মানুষের কাজ নেই, দ্রব্যমূল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তিনি আরো লিখেছেন, ১৯৭৮-এর শেষ দিকে দেশে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্যাভাবে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে শুরু করে। কঙ্কালসার মানুষে শহর ভর্তি। শোনা গেল একটি খাদ্যশস্য ভর্তি জাহাজ মধ্য সমুদ্র থেকে অন্য একটি দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাহাজটি আসছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিউবার কাছে পাট বিক্রি করার অপরাধে এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তি। রিয়াজউদ্দিন আরো লিখেছেন, এ দুর্ভিক্ষের খবর সংবাদপত্রগুলো নির্ভয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে ছাপতে শুরু করে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক বাংলা মানুষ মানুষের বমি খাচ্ছে এমন ছবি ছেপেছে। ইত্তেফাকে ছাপা হয় বাসন্তি নামে এক মহিলার ছবি, কাপড়ের অভাবে যে মাছ ধরার জাল জড়িয়ে আব্রু রক্ষার চেষ্টা করেছিল। (যদিও পরবর্তী সময়ে জানা যায়, এটি ছিল একটি বানোয়াট ছবি)। এরপর তিনি আবার লিখেছেন, সোভিয়েত বিরোধী আন্তর্জাতিক মহল দুর্ভিক্ষের পর থেকে শেখ মুজিবের বিপক্ষে কাজ শুরু করে। দেশের ভেতর জাসদ, সর্বহারা পার্টি, হক-তোহা সাহেবরা গোপনে সরকারের ওপর প্রচণ্ড মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। সরকারও মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় রাজনৈতিক হত্যা, সঙ্গত কারণেই শাসক দলের লোকই মারা গেল বেশি।
জাতির জনক কেবলমাত্র দেশের মানচিত্র, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা বদলানোর জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি। কিংবা দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যও তিনি তার গোটা যৌবনকাল কারাগারে কাটাননি। এটা চাইলে তিনি গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। এ কথা অবশ্য সবার জানা। রিয়াজউদ্দিন সাহেবের লেখাকেই যদি বস্তুনিষ্ঠ ধরা হয়, তবে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে দেশের এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে বাঁচানোর জন্য সামাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন করা ছাড়া অন্য কোনো পথ বঙ্গবন্ধুর জন্য খোলা ছিল না। এ কারণেই তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এবার সংবাদপত্র বাতিলের বিষয়টিতে আসা যাক। জনাব রিয়াজউদ্দিন এক স্থানে লিখেছেন, এমন সময় আমরা সংবাদপত্রের সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাদের দেশের দুরবস্থার কথা বলেন। এরপর রিয়াজউদ্দিন তার নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু সেদিন জাতিসংঘ ও ইরাকসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে সব কথা বলেন, তার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। কিন্তু সুচতুরভাবে এড়িয়ে গেছেন সেদিন সাংবাদিকদের জন্য এবং সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী কথা হয়েছিল। তবে আমরা অনেকেই জানি সেদিন কী কী বিষয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রিয়াজউদ্দিন সাহেব ছাড়াও সেদিন বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতাদের মধ্যে নির্মল সেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানীসহ অন্য নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নেতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, সারা দেশে তোদের (আদর করে করে বঙ্গবন্ধু এভাবেই সম্বোধন করতেন) মোট সাংবাদিক সংখ্যা কত? নেতারা বলেছিলেন ৭-৮শ’র মতো। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার তো কমপক্ষে সারা দেশে ৮-১০ হাজার সাংবাদিক দরকার হবে এবং প্রতিটি সাংবাদিককে হতে হবে চিত্তবিত্তে, জ্ঞান গরিমায় উদ্ভাসিত। শিক্ষিত, মার্জিত, মননশীল ও সুকুমার বৃত্তিতে যারা শ্রেষ্ঠ তারাই থাকবে এ মহান পেশায়। এ কথা শুনে সাংবাদিক নেতারা আবেগাপ্লুত চিত্তে বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে বললেন, আমি চাই দেশে থাকবে প্রচুর সংখ্যক অর্থবহ সংবাদপত্র। উদাহরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ইত্তেফাকে প্রকাশিত দেশ-বিদেশের সংবাদ পড়ে আমার দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয় না। তোমাদের ঢাকা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজে আমার বিশাল বাংলার গাঁও-গ্রামের কোনো খবর থাকে না। শোন, আমি ইতোমধ্যেই তোদের পেশার সিনিয়র লোকদের সঙ্গে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি আমূল বিপ্লব সাধন করতে চাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে আমার সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো হবে-
এক. দেশে নির্দিষ্ট সংখ্যক জাতীয় দৈনিক থাকবে বাংলা ও ইংরেজিতে। এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা, যাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতি পাবে সঠিক পথনির্দেশক। দেশের সব পেশা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে থাকবে তাদের অবারিত প্রবেশাধিকার। দুই. প্রতিটি পেশার জন্য থাকবে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় দৈনিক। যেমন শ্রমিকদের জন্য শ্রমবার্তা, কৃষকদের জন্য কৃষিবার্তা, মহিলাদের জন্য মহিলাবার্তা, যুবকদের জন্য যুববার্তা, ছাত্রদের জন্য ছাত্রবার্তা, শিশুদের জন্য শিশুবার্তা প্রভৃতি। এ সব পত্রিকায় সংক্ষেপে জাতীয় বিশ্ব সংবাদ ছাপার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পেশার সব প্রকার সমস্যা ও সম্ভাবনার আলোচনা থাকবে এসব পত্রিকায়। তিন. তোরা জানিস সংবাদ হলো পচনশীল দ্রব্য। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে সংগঠিত সংবাদ শহর বন্দর পেরিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসতে আসতে পচন ধরে যায়, খবরের পাপড়ি ঝরে যায়, কলি যায় শুকিয়ে। তারপর পত্রিকা অফিসে যখন পৌঁছে তখন এডিটর সাহেব পাঠিয়ে দেন সংবাদ ডেস্কে। পান চিবাতে চিবাতে মফস্বল অডিটর সাহেব সেই শুকনো কলি ফেলে দেন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। আর যদি কখনো ছাপা হয় বড় জোর দুই তিন লাইন। গত আগস্টে শৈলক‚পায় স্বামীর প্রহারে স্ত্রীর মৃত্যু অথবা ভাণ্ডারিয়ায় স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গৃহবধূর আত্মহত্যা। কিন্তু আর কোনো সংবাদ নেই। আমি চাই দেশের ৬২টি জেলার সবকটিতে দৈনিক পত্রিকা থাকবে। বরিশাল বার্তা, চট্টগ্রাম বার্তা, রাজশাহী বার্তা, বগুড়া বার্তা, দিনাজপুর বার্তা প্রভৃতি। চার. প্রতিটি জেলার নিজস্ব দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও থাকবে জাতীয় আদলে প্রত্যেক শ্রেণি ও পেশার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকবে আকর্ষণীয় বেতন ভাতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ. তাদের সঙ্গে এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কোন কোন বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকা জাতীয় দৈনিক হিসেবে থাকবে। একই সঙ্গে সংবাদ সংস্থা সম্পর্কেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ছয়. নির্বাচিত পত্রিকা এবং সংবাদ সংস্থা ছাড়া অন্য সব পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থা আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে সেখানে কর্মরত সব সাংবাদিক ও অন্য কর্মচারী নিয়মিত বেতন পাবেন। এ জন্য সাংবাদিক কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে মাসের প্রথম দিন বেতন ভাতা নিয়ে আসবেন। সাত. চাকরিহীন সাংবাদিকদের নাম তালিকাভুক্ত এবং তাদের বেতন ভাতা নির্ধারণ করার জন্য তোদের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করা হবে।
উল্লেখ্য, রিয়াজ উদ্দিনের প্রবন্ধের ভাষায়, আমরা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, ভয় নেই, যে সব কাগজ থাকবে না সে সব কাগজের সাংবাদিকরা সরকারি চাকরি পাবে। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ট্রেজারি থেকে ভাতা দেয়া হবে। একই নিবন্ধের অন্যত্র রিয়াজ ভাই লিখেছেন, ১৬ জুন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলো। ঘোষণার নাম নিউজ পেপার ডিক্লিয়ারেশন এনালমেন্ট অর্ডিনেন্স। এর আওতায় দেশে মাত্র ৪টি পত্রিকা থাকলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে ইত্তেফাক, অবজারভার, দৈনিক বাংলা আর বাংলাদেশ টাইম। যে সব কাগজ বন্ধ হলো সেগুলোর সব সাংবাদিক কর্মচারীদের চাকরি সরকারের হাতে ন্যস্ত হলো। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ভাতা দেয়ার বিধান রাখা হয়। সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য গিয়াস কামাল চৌধুরী, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মো. খালেদ এবং আরো কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রধান ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী। এবার আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিক নেতাদের আলোচনায় ফিরে আসি। সাংবাদিকদের বাঁচা-মরার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছিল তার কথা বলতে গিয়ে রিয়াজ সাহেব শুধু ফিদেল ক্যাস্ট্রো, সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন সে কথা বলেই প্রসঙ্গটির ইতি টানেন। তিনি বেমালুম চেপে যান বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার কথা। সংবাদপত্রের সঙ্গে সঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনেও যে বিপুল সংখ্যক মেধাবী সাংবাদিকের প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে ইউনিয়ন নেতারা আশ্বস্ত করেছিলেন এবং এই বলে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে যে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে সেখানে পূর্ণাঙ্গ স্নাতক ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স এবং প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু, বিদেশে বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবাদিক সৃষ্টি করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু নেতাদের এ সব সুপারিশ ত্বরিত বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। বিশেষ করে সাংবাদিক নেতারা তৎকালীন সংবাদপত্র শিল্পে বিরাজমান করুণ অবস্থা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, হাতেগোনা ২/৪টি সংবাদপত্র ছাড়া কোথাও নিয়মিত বেতন ভাতা প্রদান করা হয় না। আলু-পটলের ব্যবসায়ী বিভিন্ন ধান্ধায় সংবাদপত্র প্রকাশ করে ব্লু্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। অথচ সাংবাদিকদের একটি আইডি কার্ড ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয় না। অনেক গ্রামীণ সাংবাদিক কেবল কলাটা-মুলাটা নিয়ে এ মহান পেশায় টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু দেশের সব শ্রেণির সংবাদপত্র সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা এক বিরাট বিপ্লব সাধন করবে বলে সাংবাদিক নেতারা মত প্রকাশ করেন। এতে দেশের মেধাবী মুখের সন্ধান পাওয়া যাবে পত্রিকা অফিসগুলোতে। এ পরিকল্পনার জন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানান। তারা এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালে যোগদানের আকাক্সক্ষাও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে গিয়াস কামাল চৌধুরী, রিয়াজ উদ্দিনসহ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক বাকশালে যোগদানের জন্য আবেদন করেন।
আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি থাকার সুবাদে আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই। একদিন তার বাসায় নৈশভোজের দাওয়াতে গিয়ে দেখি আমাদের প্রিয় ফয়েজ ভাই (ফয়েজ আহমদ) ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের এককালীন তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। কথায় কথায় সেদিন বন্ধ হওয়া পত্রিকার সাংবাদিক-কর্মচারীদের তালিকাসহ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনায় আসে। অধ্যাপক খালেদ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমরা এ তালিকা প্রস্তুতির প্রশ্নে কোনো প্রকার মতপার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনায় আনিনি। তদুপরি যারা মাত্র ৮০ থেকে ১১০ টাকা মাইনে পেতেন (অনিয়মিত), তালিকা প্রস্তুতকালে তাদের বেতন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা লেখা হয়েছিল। গিয়াস কামালসহ আমরা সবাই একমত হলাম যে, টাকাটা যখন বঙ্গবন্ধুর উদারতায় ট্রেজারি থেকে দেয়া হবে তখন থাক না একটু বেশি অঙ্কের হিসাব। যাই হোক সেই প্রস্তুত করা তালিকা হিসেবে দেশের সব সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও কর্মচারী সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাল রাতের দিন পর্যন্ত দেশের সব সংবাদপত্রসেবী এ বেতন ভাতা ভোগ করেছেন।
সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য গিয়াস কামাল চৌধুরীর মুখে শুনেছিলাম যে, তারা একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলেছিলেন, দেশ সদ্য স্বাধীন, অর্থনৈতিক সংকট, অভাব-অনটনে আপনার সরকার জর্জরিত, এ সময় কাজ না করে প্রতি মাসে ট্রেজারি থেকে বেতন আনতে অনেক সাংবাদিকের মনে হোঁচট লাগে, আপনি আমাদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করুন। বঙ্গবন্ধু সেদিন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ডেকে তাদের সামনেই নির্দেশ দিয়ে দিলেন- সব অফিসের শূন্যপদে সাংবাদিক নিয়োগ দাও। তাই হয়েছিলও। সদ্য স্বাধীন দেশে খাদ্য, শিপিং, ওয়াপদা, কাস্টমসহ বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে সাংবাদিকদের আত্মীকরণ করা হয়েছিল। কেবল বঙ্গবন্ধুর মতো একজন রাষ্ট্রপ্রধানই বলতে পেরেছিলেন, একজন সাংবাদিকও বেকার থাকবে না। যতদিন চাকরি না হয় ট্রেজারি থেকে বেতন নিয়ে আসবে। পৃথিবীর কোনো ধনতান্ত্রিক, সামাজতান্ত্রিক কিংবা অন্য কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান দেশের একটি গোটা পেশাজীবী সম্প্রদায়কে এভাবে ট্রেজারি থেকে বিনা কাজে বিনা চাকরিতে বেতন নিয়ে আসতে বলতে পারেননি। এই দুঃসাহস কেবল বঙ্গবন্ধু দেখাতে পেরেছিলেন। আর আজ কতিপয় ধান্ধাবাজ এ বলে মেকি ইতিহাস তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু সব সংবাদপত্র বন্ধ করে সব সাংবাদিককে বেকার করেছিলেন। মিথ্যাচারের অভিযোগে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতেই হবে এবং সেদিন খুবই নিকটবর্তী।
আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া : সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাসস।

সুশাসন ছিল ব্রিটিশ আমলে ও সামরিক শাসনকালে ॥ নির্বাচিত সরকার তা ধ্বংস করেছে’ ?

নিউইয়র্কে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নয়া তত্ত্ব
তারিখ: ১০/০৬/২০১৫

আবদুল মালেক
উত্তর আমেরিকা বিশেষ করে নিউইয়র্ক নগরের বাংলাদেশী কমিউনিটি বছরজুড়ে মেতে থাকে নানা উৎসব-আনন্দে। আর নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ থেকে আগত সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র শিল্পীরা তাতে সঞ্চার করেছেন নতুনপ্রাণ। এছাড়া অনেক প্রবাসী আছেন যারা শুধু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানাদির মুগ্ধ দর্শক হতে রাজি নন। সেইসঙ্গে তৃপ্ত হতে চান দেশের সম্মানিত প-িত মানুষের দর্শন লাভে ও তাদের মূল্যবান জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শ্রবণ করে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিধ অনুষ্ঠান বা সম্মেলনে প্রায়ই লেখক, সাহিত্যিক ও গুণীজনদের শুভ পদার্পণ ঘটে থাকে।
 বিশ্বায়নের এই কালে বাংলাদেশও হাতের নাগালেই এসে গেছে। দুপুর ১২টা-১টার মধ্যে অনলাইনে আগাম দেশের খবরের কাগজ হাজির। রসগোল্লা আর ইলিশ মিলছে হয়ত কারও এলাকার মোড়ের দোকানেই। টিভির বাংলাদেশী চ্যানেলে অধিকাংশ বাংলাভাষী মানুষের গৃহে সকাল-সন্ধ্যা গান-নাটক-খবর চলছে। সেখানে নানা অনুষ্ঠান উপভোগের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই নামী-দামী ব্যক্তিদের দেখা ও বক্তব্য শোনার সুযোগ পাই। কিন্তু চর্মচক্ষুতে সেলিব্রেটিদের দেখা পাওয়া ও স্বকর্ণে তাদের বক্তব্য শুনতে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে সেই সৌভাগ্য লাভ করতে গিয়ে কখনও দুর্ভাগ্যকেও বরণ করতে হয় বৈকি!
সম্প্রতি (২২-২৪ মে) মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত নিউইয়র্কে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা হয়ে গেল। উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সবাই জানেন, তিনি সুদীর্ঘ সময় ধরে বই পড়া এবং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষ গড়ার প্রশংসনীয় একটি আন্দোলন করে যাচ্ছেন। অধ্যাপক সায়ীদ ছাড়া বইমেলার সুযোগ্য প্রধান অতিথি আর কেইবা হতে পারেন!
প্রবাসের অনুষ্ঠানে সাধারণত আলোচনাগুলো দুপুরে সেমিনার কক্ষের একান্তে এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষ বিকেলের মঞ্চে হয়ে থাকে। এরপরই যাকে বলে উৎসবের প্রাইম টাইম। ওই সময়টিতে নাটক, সঙ্গীত ও নৃত্য ইত্যাদি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপভোগ করে মানুষ। দেশ থেকে আগত প্রকাশনা সংস্থার স্টল থেকে বইপত্র, সঙ্গে নানাবিধ দেশী পণ্য কিনে, ঝালমুড়ি-চা-সিঙ্গাড়া খেয়ে সন্ধ্যার পর শিশুদের হাত ধরে তখনই হলে প্রবেশ করে পরিবারগুলো।
 কিন্তু এ বছর আলোচনার প্রধান বক্তা অধ্যাপক আবু সায়ীদ, সঙ্গে প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও কলকাতা থেকে আগত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো সম্মানীয় বক্তাদের কারণেই হয়ত কর্তৃপক্ষ প্রাইম টাইমের বিনোদনমূলক সময়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছিলেন তাঁদের। তাছাড়া প্রধান বক্তা কেবল একজন সুবক্তাই শুধু নন, মানুষ গড়ার কারিগরও বটে। মানব হৃদয়ের অন্ধকার দূর করার ব্রত নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীনভাবে। কিন্তু তাঁর দু’দিনব্যাপী বক্তব্য (প্রথম দিন বক্তৃতা ও দ্বিতীয় দিন প্রশ্নের উত্তর) শোনার সৌভাগ্যটি যে পরিণত হবে দুর্ভাগ্যে সেটি আমি ও অনেক প্রবাসী কল্পনাও করিনি।


 অবশ্য ইদানীং দেশের খবরের কাগজে তাঁর রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু কথা নজর কাড়ছিল। কিন্তু তিনি যে হাটুরে রাজনীতিকদের ভাষায় আমাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন সেটা ছিল ভাবনার অতীত। তিনি বললেন, বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়টি পার করছে। জাতীয় জীবনে আমাদের অবস্থা এখন মাৎস্যান্যায়ের মতো বড় মাছ ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলছে। অধ্যাপক আবু সায়ীদ বক্তব্য রাখছিলেন বাংলাদেশের সুশাসন প্রসঙ্গে।
 যদিও দেশে তাঁর সঙ্গে কখনও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি, কিন্তু প্রবাসে এসে নব্বই দশকের মাঝামাঝি ডালাসে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে বেশ কিছু বিদগ্ধজন ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একই মঞ্চে। বাইরেও হয়েছে নানা আলাপ-আলোচনা, কথা-গল্প, হাসি। পরবর্তীতে সাংবাদিকতার সুবাদেও নিউইয়র্কে অনেকবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে, কথা হয়েছে। সেসব দিনে তাঁর চমৎকার সান্নিধ্যের কথা এখনও মনে পড়ে।
 কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তিনি যখন বললেন, বাংলা নামক দেশটিতে নাকি কখনই কোন সুশাসন ছিল না, কেবলব্রিটিশ রাজত্বের দিনগুলো ছাড়া, তখন হতচকিত না হয়ে উপায় ছিল না। গল্পচ্ছলে অধ্যাপক সায়ীদ বললেন, সে আমলে বাংলার বনে-জঙ্গলে যদি একটা ভূতও কোন মানুষকে তাড়া করত, আর সে যদি ছুটতে ছুটতে ব্রিটিশ রাজের তৈরি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠতে পারত, তবে পালানোর পথ পেত না সে ভূত। কারণ রাস্তায় ছিল ব্রিটিশের থানা পুলিশ! এরপর অবশ্য সকৌতুকে বললেন, যদিও পুলিশ কর্তাদের একটু ঘুষ-টুস খাবার সুযোগ তারা করে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক আবু সায়ীদের মতো মানুষের মুখে এই নব ইতিহাস রচনা স্বকর্ণে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। নিউইয়র্কের প্রতিটি সাপ্তাহিকীতে তাঁর বক্তৃতার এমন গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো কমবেশি খবর হয়েছে।


 সত্যি বলতে কি, আমি একজন বিজ্ঞ মানুষের মুখনিসৃত এমন বক্তৃতার সুরে বারংবার হতভম্ব হয়ে পড়ছিলাম। তাহলে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে ইতিহাস লেখাপড়া করেছিলাম তার পাতায় পাতায় কি সবই ভুল! দুনিয়াজুড়ে ব্রিটিশ রাজের অত্যাচার ও লুটতরাজের কথা তো দেশে দেশে ইতিহাসের অধ্যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় তরুণ ব্যারিস্টার গান্ধীকে শুধু ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরার যাত্রী হওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠি পেটার কাহিনী তো আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইতেই ছিল। অসংখ্য নির্যাতন-নিপীড়নের আরও অনেক ইতিহাস নিশ্চয়ই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুস্তকাদিতেও আছে। নেই কি জালিয়ানওয়ালাবাগে সমবেত নিরীহ মানুষের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের বর্বর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নাইটহুড' উপাধি ত্যাগ করার ইতিহাস? সে সময় নীলকর সাহেবদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কাহিনী, যা দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীল দর্পণ’ নাটকে বর্ণনা করেছেন, সে নাটকের বইটিও কেন্দ্রে আছে বলে বিশ্বাস করি। আজ অবধি কোন ব্রিটিশ দালালও এসব মিথ্যে বলে দাবি করেনি। পুস্তকের সঙ্গে পুস্তক পাঠের জন্য আন্দোলনকারী শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদের এই মতামত কি এখানে সাংঘর্ষিক হচ্ছে না?

ব্রিটিশ জমানারই মানুষ আমাদের পিতা-প্রপিতামহ তাদের সময়ের পুলিশকুলের অত্যাচার সম্পর্কে যে বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমাদের কাছে দিয়ে গেছেন সেটা তো প্রবাদ বাক্যেই স্থান পেয়েছে! তাদের কাছ থেকেই শুনেছি, মাথায় লাল রঙের পাগড়ি পরতেন বলে তখন আমজনতার কাছে পুলিশের নাম ছিল লালপাগড়ি। বলাবাহুল্য, তারা ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে আসতেন আসামির সন্ধানে। কোন গ্রামের কোন দূর প্রান্তে ঘোড়ার খুরের শব্দের সঙ্গে লাল রং দেখা গেলেই প্রাণভয়ে নির্বিচারে মানুষ পালিয়ে শূন্য করত গ্রামের পর গ্রাম। কারণ দোষী হোক বা নির্দোষ হোক গ্রামবাসী কাউকে পাওয়া মাত্রই শুরু হতো বেদম প্রহার। হান্টার দিয়ে কমপক্ষে আঠারোটা ঘা না মেরে পুলিশ ছেড়ে দিত না। ওই সময়েই সে প্রবাদটা তৈরি হয়েছিল, যা আজও প্রচলিত ‘পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা!’
অধ্যাপক সাহেব কণ্ঠে মুগ্ধতা এনে নাটকীয়ভাবে আরও যোগ করলেন, কি সুসভ্য এই ব্রিটিশ জাতি, কি অতুলনীয়, কত প্রাচীন তাদের সভ্যতা! এই বক্তব্যের উত্তরে আমার বলতে ইচ্ছে করেছিল, বটেইতো বটেইতো- বিশ্বজুড়ে তারাই তো সত্যিকারভাবে মানবসভ্যতার ধারক এবং বাহক! কিন্তু ওই পুস্তকগুলোই বাঁধিয়েছে যত গোল। কারণ সেখানেই তো লেখা রয়েছে সুদূর আফ্রিকা থেকে কিভাবে জন্তুর মতো খাঁচায় পুরে কালো মানুষদের ধরে এনেছিল ব্রিটিশ বেনিয়া দল। জাহাজে করে দেশে দেশে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে কিভাবে ফুলে ফুলে বিকশিত হয়েছিল ব্রিটিশ অর্থনীতি তথা সিভিলাইজেসন! অধিকৃত দেশগুলোর যেখানে যত সম্পদ ছিল সবই লুট করে নিয়ে গেছে তারা। ভারতবর্ষ থেকে কোহিনূর মুকুট, ময়ূর সিংহাসনসহ যাবতীয় হীরামণিক্য আজও ভোগ করে চলেছে ব্রিটিশ রাজবংশ। তাদের হাতে মেসোপটেমিয়ার সুপ্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস আর লুটপাটের ঘটনা তো ঘটে গেল আমার-আপনার চোখের সামনেই। ক্যাকটাসের ফুলের মতো ব্রিটিশ জাতির নিঃসন্দেহে অনেক নয়নমনোহর দিক আছে। কিন্তু ফুলের নিচে ভয়ঙ্কর কাঁটাগুলো দুনিয়া এড়াবে কিভাবে?


বন্দনার পর্ব শেষ করে অধ্যাপক সাহেব এরপর শুরু করলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে, ‘ইংরেজ শাসনের অনেক ভাল দিক ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা সুশাসনের বেশ কিছু ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে যায়। ব্রিটিশরা যেটুকু সুশাসনের ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সেটুকু ধ্বংস করে দিয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে চলছে মোড়লি শাসন। এই পদ্ধতিতে দেশ চালাতে গিয়ে আমরা ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া সুশাসনের ব্যবস্থাগুলোও ধ্বংস করে দিয়েছি।’


জানার ইচ্ছা জাগে, পাকিস্তান সময়েও কি সেই ব্যবস্থা অক্ষত ছিল? আইয়ুব-ইয়াহিয়ার খানের সামরিক শাসন আমলেও? আর মোড়লি ব্যাপারটার মাথামুন্ডু আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সাংবাদিকতা পড়া বিদ্যায় কিছুতেই কুলিয়ে উঠছে না। আমরা জানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত সরকারের নেতৃত্বে। সেসব প্রতিনিধি তথা মোড়লই তো জাতীয় সংসদে বসে রচনা করলেন দেশ শাসনের জন্য পবিত্র সংবিধান। এরপর রচিত নয়া সংবিধানের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে। অবশ্য জ্ঞানী শিক্ষাবিদ প্রশ্নোত্তরে বলেই দিয়েছেন, ‘দেশ ধ্বংসের মূল কারণ আমাদের ওই সংবিধান এবং দুই দল।’ শেষে যদিও একটি প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা করলেন, ‘সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট না দেয়ার ধারাটি পরবর্তীকালে সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে,'এটাই দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’


তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা রয়েছি স্বৈরশাসনের মধ্যে। নব্বই সালের পর যে নির্বাচিত স্বৈরশাসনের মধ্যে প্রবেশ করেছি এটা সামরিক স্বৈরশাসনের চেয়ে আরও ভয়াবহ।’ তিনি উষ্মার সঙ্গে বারবার বলেন, ‘একবার এ দল আসে, আরেকবার ও দল, হয় হাসিনা, নয় খালেদা।’
তিনি নিশ্চয়ই বোঝাতে চাইলেন, ’৭৫ থেকে নব্বই পর্যন্ত অভ্যুত্থান, নির্মম হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে জিয়া থেকে এরশাদ নামে যে সব শাসকের আবির্ভাব, গণতন্ত্রের চাইতে তাদের পদ্ধতি উত্তম! তাহলে সেই বন্দুকের নলই কি ক্ষমতার একমাত্র উৎস হবে দেশে।


 সেদিন অধ্যাপকের কাছ থেকে সুশাসন সম্পর্কে এমন সম্যক জ্ঞানলাভ করার পরও অদ্যাবধি কেন যেন আমার অজ্ঞানতা ঘোচেনি। সুশাসনের তত্ত্ব বা থিওরি কখনও সাধারণ মানুষও জানতে চায় না। একদিন এই ভূখন্ডের অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষের দুয়ারে দুয়ারে চাওয়া ছিল লবণ দিয়ে একমুঠো ভাত। সেই কোন্ যুগে ঈশ্বরী পাটনী যে দেবীকে নদী পার করিয়ে দেয়ার আশীর্বাদ হিসেবে প্রার্থনা করেছিল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ যুগ-যুগান্তরব্যাপী এমনকি ব্রিটিশের মহাসুশাসনকালীনও সে স্বপ্নপূরণ ছিল কল্পনাবিলাস। বরং সেই ব্রিটিশ আমলের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের কাহিনী দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে ফিরেছে বারবার। অথচ আর কি আশ্চর্য, দরিদ্র শিশুর দুধ-ভাত খাওয়ার সেই আশীর্বাদ আজ গ্রামগঞ্জের দিকে দিকে। ক’দিন আগেই দেশের সংবাদপত্রে পড়লাম মঙ্গার জন্য বিখ্যাত রংপুরের গঙ্গাচড়া দিয়ে যেতে যেতে এক সাংবাদিক দেখছেন চারদিকে মাঠে মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে শত শত গরু-ছাগল। একদা হতদরিদ্র সুশীলার শিশুসহ গ্রামের অন্য শিশুরা স্বপ্নের দুধ-ভাত খেয়ে ভরে উঠছে স্বাস্থ্যে-আনন্দে! শিশুদের খাইয়ে অবশিষ্ট দুধ বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছে বহু নারী। এরকম আরও ভিন্ন ভিন্ন অভাবিত ঘটনাগুলো যখন ঘটে চলছে দেশের সর্বত্র অধ্যাপক আবু সায়ীদ সাহেবের ভাষায় ‘বাংলাদেশ তখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়টি পার করছে।’