Friday, September 20, 2013

আমার বাবা কর্নেল তাহের : জয়া তাহের


আমাকে যখনই কেউ জিজ্ঞাসা করেন, কর্নেল তাহেরের মেয়ে হিসেবে আপনার অনুভূতি কি? আমার চোখের সামনে এক নিমেষেই ভেসে ওঠে ৪০ বছরের অসংখ্য স্মৃতি। আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। কিছুই আর বলা হয়ে ওঠে না। এ অনুভূতি এক লাইনে বলবার নয়।

আমি ফিরে যাই, আমাদের সেই নারায়ণগঞ্জের বাসায়। শীতলক্ষ্যা নদীর পাশে বড় দোতলা বাড়ি। দোতলায় নদীর দিকে মুখ করে ছিলো পাশাপাশি দু’টি রুম। একটিতে আম্মা যিশু ও মিশুকে (আমার দুভাই) নিয়ে ঘুমাতেন। আর আরেকটিতে আমি বাবার সঙ্গে ঘুমাতাম। আমি সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গেই দেখতে পেতাম, নীল আকাশ।

ঘর থেকে বের হলেই ছিল ঝুলন্ত বারান্দা। বাবা গাড়িতে করে এলেই আমি দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম।
সময়টা ছিল ১৯৭৪ সাল। আমি তখন ছিলাম ৪ বছরের। যিশু ২ বছর ও মিশু ৯ মাস।

মাঝে মাঝে রাতের বেলা বাবা-মা বাড়ির লনে ঘুরে বেড়াতেন। আর আমি তাদের পাশে পাশে ঘুরতাম। নিচতলায় ছিলো বসার ঘর আর ডাইনিং রুম। বসার রুমে ছিল সারি সারি বই। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড থেকে আমার ইউসুফ চাচা তার ছেলে শ্রাবণকে নিয়ে বেড়াতে আসতেন। বাবা একপা নিয়েই দৌড়ে আমাদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন।

একদিন খাবার টেবিলে বাবা বললেন, ‘দেখো তো তোমার জন্য নিচে কি অপেক্ষা করছে?’ আমি খাবার টেবিলের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে দেখি, একটা বিড়াল। বিড়ালটা বহুদিন আমার সঙ্গে ছিলো। আমরা প্রায়ই ঢাকায় যেতাম। আমি প্রতিবার গাড়িতে বমি করতে করতে ফেরত আসতাম। বাবা বলতেন, ‘কবে যে আমার মেয়েটা ঠিক হবে........’

বাসার পাশেই ছিল বড় পাট গুদাম। যেখানে বানর থাকতো। বানররা কলা খেতে প্রায়ই আমাদের বাগানে চলে আসতো। আমাদের বাসায় কাজ করতো মনিকা নামের একজন মেয়ে। আমাকে একা পেলেই খুব সাজাতো। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো তখন।

তারপর হঠাৎ একদিন বাবা বাসায় আসা বন্ধ করলেন। তার কিছুদিন পরই এক জিপ ভর্তি মানুষ রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করতে করতে বাড়ির চারপাশে টহল দিতে শুরু করে। তারও কিছুদিন পর আমাদেরকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আম্মা একটা স্যুটকেসে আমাদের সবকিছু নিয়ে কিশোরগঞ্জে নানার বাসায় চলে আসেন।

সবার কাছ থেকে জানতে পারি, বাবা জেলে। তারও অনেক মাস পরে হঠাৎ করে আমাদেরকে জেলখানায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে বলা হলো। আম্মা যিশু আর আমাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। মিশু খুব ছোট বলে নানুর কাছে রয়ে গেল। জেলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে আমার খুব লজ্জা করছিলো বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাবা আমাকে আর যিশুকে কলা খেতে দিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।

১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোর রাতে বাবার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আমাদের একটা হেলিকপ্টার দিয়ে পাঠানো হয় আমাদের গ্র্রামের বাড়ি কাজলায়। সংগে ছিলো দাদুমনি, জলি ফুফু, আম্মা, আম্মার কোলে যিশু, ছোট মামা, বড় চাচা, চাচী। যে কাপড় দিয়ে বাবাকে ঢাকা ছিলো তা পুরোপুরি বাবার শরীর ঢাকতে পারছিল না। চুল আর পা বেরিয়ে ছিলো। আমি হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে ছোট হতে যাওয়া মানুষগুলোকে দেখছিলাম। সেই আমার প্রথম হেলিকপ্টারে চড়া।

কাজলায় স্কুল মাঠে বাবাকে নামানো হয়। আমরা অপেক্ষা করি আমাদের আরেক মুইনুদ্দিন দাদার শ্যামগঞ্জের বাসায়। দুপুর বেলা বাবাকে গোসল করানোর পর ছোট মামা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে উঁচু করে বাবার মুখ দেখান। আমি দেখতে পাই শান্ত একটা মুখ। আমার তারপরও বিশ্বাস হয়নি, বাবা মারা গেছেন। কল্পনা করেছি কতবার, বোধহয় ওটা সাজানো কোনো ডামি ছিলো। বাবাকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি হয়তোবা কোথাও হাঁটছি, আমাকে পেছন থেকে চমকে দিয়ে ফিরে আসবেন বাবা।

সেই কাজলায় রয়ে গেলাম আমরা একমাস। প্রতিদিন আমরা কবরে যেতাম। কবরের পাশে ঘাঁটি গেড়ে ছিল একদল সশস্ত্র পুলিশ। তারা কবরটা একমাস ধরে পাহারা দিয়েছিলেন। আজ ভাবলেও তা হাসি পায়।

সেখান থেকে আমরা চলে আসি কিশোরগঞ্জে। নানা ছিলেন কিশোরগঞ্জের নামকরা ডাক্তার। তার কিছুদিন পরে আমরা ঢাকায় আসি। উঠি মোহাম্মদপুরে বড় চাচার বাসায়। আম্মা চাকরিতে যোগ দেন। তার কয়েক মাস পরে মোহাম্মদপুরে একটি সরকারি কোয়ার্টার পান আম্মা। দুই রুমের একটি ড্যাম্প পরা বাসাটার আশেপাশে ছিল বস্তি। যার থেকে অনবরত ভাবে ভেসে আসতো গালিগালাজ। আম্মা প্রতিদিন হেঁটে গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতেন।

আমাকে ভর্তি করানো হয় কাছের একটি স্কুলে। মিশু রয়ে যায় নানুর কাছে। আরও পরে যিশুকে পাঠানো হয় হোস্টেলে। আমাদের একটি সাজানো সংসার যেন এক নিমিষেই এক কালবৈশাখী ঝড়ে ভেঙে খান খান হয়ে যায়।

যিশু যেদিন প্রথম হোস্টেলে যায়, আম্মা কেঁদেছিলেন আকুল হয়ে। জলি ফুফু ও ডলি ফুফু তাদের স্কলারশিপের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন যিশুর জন্য নতুন জামা, জুতা। যিশুর পড়াশোনার দায়িত্বভার নিয়েছিলেন আমার লন্ডনে বসবাসরত বড় মামা। আমাদের পুরো পরিবারের কারোরই তেমন কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। কিন্তু এক বিশাল বন্ধনে আমরা ছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ।

প্রতি বছর আমরা যখন কিশোরগঞ্জে যেতাম, আম্মা মিশুকে নিয়ে শুতে চাইতেন। আস্তে আস্তে বলতেন, আমাকে মা বলো, মিশু কিছুতেই বলতো না। মিশু তখন নানুকে মা ভাবতো। তারপর বছর গড়িয়ে মিশুও আমাদের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসে, যখন তার বয়স ৫ বছর। আম্মার সামান্য বেতনটুকুই ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল।

ওই সময় জাসদের অধিকাংশ নেতাকর্মীসহ আমাদের সব চাচারা জেলে ছিলেন। আমাদের বাসার সামনে একটা সাদা গাড়ি সারাদিন বসে থাকতো। পরে জেনেছি, তারা ছিলেন স্পাই। আমাদের সব গতিবিধি লক্ষ্য করতেন। আমাদের বাসায় কেউ আসতে পারতেন না। যারা আসতেন তারাও লুকিয়ে আসতেন।

আমরা জেলখানায় ইউসুফ চাচা, বেলাল চাচা, মনু চাচা ও অন্যান্য নেতাকর্মীদের দেখতে যেতাম। আমি প্রতিবার মন খারাপ করে যেতাম। মনে হতো, যদি বাবা থাকতেন। হতোই বা সারা জীবন জেলে, তাওতো দেখা হতো। আমার তখন বোঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর চাচারা ও অন্যান্য নেতাকর্মীরা জেল থেকে ছাড়া পেতে শুরু করেন। জাসদ তখন বিরাট এক শক্তি। আমাদের ছোট বাড়িটায় মানুষ গম গম করতো। কত ধরনের মানুষ যে আসতো তখন। তাদের সবার স্বপ্ন ছিলো একই। এক সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা যেখানে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার খুব বেশি ভাল লাগতো তাদেরকে। তারা যে স্বপ্নের কথা বলতেন, তা আমি মনোমুগ্ধের মতন শুনতাম। তারা বেশির ভাগ ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট- বুয়েট, মেডিকেল বা ইউনির্ভাসিটির ছাত্র-ছাত্রী। তারা ছিলেন টগবগে সাহসী কিছু তরুণ-তরুণ । সে সময় তাদেরকে একটি শুকনো বিস্কিট আর চা ছাড়া আমাদের দেবার আর কিছুই ছিল না।
আমার খুব বেশি মায়া লাগতো। আম্মার কাছে শুনতাম, তাদের বেশির ভাগই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে। একটা নষ্ট সমাজ বদলে দেবার স্বপ্নে তারা সকল কিছু ছেড়ে এসেছিলেন। হাজারো মানুষের মশাল মিছিল হতো তখন।

বেলাল চাচা আমাদের শিখিয়ে ছিলো একটা গান-
‘বন্ধু, বলতে পারো, সামনের পৃথিবীটা কার
শ্রমিক না মজুর, না সর্বহারার
আজকে এসেছে দিন একভাবে
আসবে আবার দিন নতুন করে
সেদিন আবার নতুন করে বিচার হবে
বন্ধু..................’

নিশ্চয় বেলাল চাচার কোনো অবসরে মনে পড়বে সেসব কথা। আমরা কাজলায় রাতের বেলায় আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে সুর করে সেই গান গাইতাম।

মনে হয় এইতো সেদিন, রমনার বটমূলে নেমেছিলো হাজারো মানুষের ঢল। আমরা পৌঁছা মাত্র মেজর জলিলচাচা মঞ্চ থেকে ফুল নিয়ে আমার হাতে দিলেন। ‘কর্ণেল তাহের লাল সালাম’ এর প্রতিধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রলম্বিত হয়ে উঠত যেন। আমি সেদিন তাদের প্রত্যেকের চোখের তারায় দেখেছিলাম কর্নেল তাহেরকে।

তারপর কি হলো! যেসব নেতা একদিন স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা, ভাই, বোন কারো কথা চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্বে, তাদের অনেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, ক্ষমতা, লোভ, লালসার কাছে বিক্রি হতে থাকলেন! আন্দোলন পড়লো মুখ থুবড়ে। যে নেতারা একদিন মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তাদের অনেকেই মাঝপথে যেন সেটাই ভুলে গেলেন!

আর শত শত কর্মী যারা বিশ্বাস করেছিলেন, তাদের নেতাদের কথা- তাদের কেউ কেউ হতাশার গভীরে নিমজ্জিত হয়ে অন্ধকার জগতে চলে গেলেন। কেউ কেউ পাড়ি জমালেন বিদেশে। কেউ কেউ, নীতি আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সেই নেতাদেরই তোষামোদ করে টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কেউ কেউ ভাঙ্গা মন নিয়ে আবারো ঘরে ফিরে গেলেন।

তাদের সেই ভাঙ্গা মন আর কোনো দিন জোড়া লাগেনি। আর দুই একজনকে আমি হঠাৎ হঠাৎ দেখি- তাদের চশমা হয়েছে ভারি, চুলে পাক ধরেছে। তারা মানাতে পারেননি কোনো কিছুর সঙ্গেই। বড় একা.......

যে কর্নেল তাহের মৃত্যুর আগে তার শেষ চিঠিতে লিখে গেছেন, ছোট ছোট উলঙ্গ শিশুদের নিরাপদ বাসস্থানের কথা, তাদের জীবনেও কোনো পরিবর্তন আসেনি। ছোট ছোট শিশুরা আজও রাস্তায়।

আর আমি- বহু বছর এক তীব্র রাগ, হতাশা, ঘৃণা বুকে পুষে ছিলাম। আম্মা যখন দেশ বদলের আশার কথা বলতেন, তাকে তীব্র অপমানে বিদ্ধ করতে আমার এক বিন্দু বাঁধতো না। পালিয়েছি আমি সকল কিছু থেকে। রাজনৈতিক খবরে আমার ছিল উদাসীনতা। হঠাৎ করে কি ভেবে যেন কর্নেল তাহের সংসদের নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করি। আসা শুরু হয় শত শত চিঠি। প্রতিদিন.......

অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, চিঠির লেখকদের বেশিরভাগই এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণী। তারা জানতে চান কর্নেল তাহেরকে। তারা সচেতন বুদ্ধিমান বলিষ্ঠ নাগরিক। তাদেরকে মিথ্যা দিয়ে ভোলানো এতো সহজ নয়। নেতা চিনতে তাদের কোনো ভুল হয় না।

সেদিন রমনার বটমূলে হাজারো মানুষের ঢলে আমি কর্নেল তাহেরের মুখ দেখেছিলাম। আমি আজ আর কর্নেল তাহেরকে তাদের মাঝে দেখতে পাই না। কর্নেল তাহের তাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু আগে। ছড়িয়ে গেছে গোটা দেশময়।

আজো তাই নতুন যুগের তরুণেরা মনে করেন, বলিভিয়ার চে’ গুয়েভারা যেন বাংলাদেশের কর্ণেল তাহের। তাদের বুকে দেখি, কর্নেল তাহেরের সম্বলিত টি-শার্ট। তারা জেনে গেছেন, বাংলার ইতিহাসে ক্ষুদিরাম-সূর্য সেনের মতো কর্নেল তাহেরও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি। তাদের বুকে গেঁথে গেছে তাহেরের শেষ চিঠির কয়েকটি শব্দ-

‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোনো সম্পদ নেই’
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Thursday, September 19, 2013

বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ, এখানে কেউ ফতোয়া দেবেন না মমতাজ লতিফ


কী যে হলো, হঠাৎ একদল হুজুর সংবাদ সম্মেলন করে ‘ফতোয়া’ জারি করে বসলেন। কই এর আগে কোন মৌলানা দলকে তো কখনই ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যাকারী, বাঙালী নারীর ধর্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা বা ডাক্তার, প্রকৌশলী, সেনা, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত হত্যাকা-ের হোতাদের বিরুদ্ধে ‘তারা কাফের, তারা জেনাকারী, হত্যাকারী হিসেবে যে স্বাধীনতার তারা বিরুদ্ধাচারণ করেছে, সেই স্বাধীন দেশে তাদের ঠাঁই হবে না,’ বলে এমন কোন ফতোয়া দিতে শুনিনি। তারা তো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় অপরাধীÑ ফতোয়া যদি কেউ দিতে উদ্বুদ্ধ হতেন, তবে এদের ফতোয়া দিয়ে রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের দাবি করতেন। মাঝখান থেকে তসলিমা নাসরিন বা দাউদ হায়দারকে তালেবানপন্থী একদল কট্টর জঙ্গীবাদী মোল্লা দেশছাড়া করেছিল যে দেশের স্বাধীনতায় ওই মোল্লার দলের কোন অবদান ছিল না। তরিকত ফাউন্ডেশন যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের সংবিধানবিরোধী অবস্থান ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম নিষিদ্ধের জন্য রিট পিটিশন করে হাইকোর্টের কাছ থেকে একটি কাক্সিক্ষত ঐতিহাসিক রায় জনগণকে উপহার দিয়েছে, এজন্য তাঁরা ধন্যবাদার্হ।
কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, মুসলিম দেশগুলোতে বা ভারতেও মুসলিম নারীরাই মুসলিম পুরুষের অন্যায় ফতোয়ার শিকার হয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, এই মৌলানারা কোন নারীর সন্তান, কোন নারীর কাছ থেকে তাঁরা বিবাহিত জীবনের আনন্দ লাভ করেছেন, কেউ বা প্রেম লাভ করেছেন, তাঁদের সবারই আছে পুত্র ও কন্যা, বোন, খালা, চাচি, ফুফু। নয় কি? তারপরও দেখা গেল, শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষিতা নারীটি তার স্বামীর (স্বামীর মতে) সঙ্গে থাকতে চাইলেও ফতোয়াবাজ মৌলানারা শ্বশুরের সঙ্গে থাকার আদেশ দেয়। রাজিব গান্ধীর উদ্যোগে মুসলিম নারীদের সমঅধিকারের আইনটি দিল্লীভিত্তিক মুসলিম মৌলানাদের দলের প্রবল বাধার কারণে সংসদে পাস হতে পারেনি। শ্বশুর দ্বারা পুত্রবধূ ধর্ষণের চেষ্টা বা ধর্ষণ, এমনকি এ কাজে শাশুড়ি বাধ্য হয়ে স্বামীর হুকুম পালনে সহায়তা করেছেÑএমন অসংখ্য উদাহরণ পর্দার অন্তরালে সঞ্চিত আছে-এ কথা মৌলানারাসহ জনগণ ভালভাবেই জানেন।
এ গেল এক ধরনের নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ফতোয়ার ব্যবহার। ফতোয়ার দ্বিতীয় অপব্যবহার অতি উচ্চমাত্রায় হচ্ছেÑএটি হলো, ‘হিল্লা বিয়ে’ ও ‘তালাক’ হওয়া সম্পর্কিত। এ আলোচনায় যাওয়ার আগে আমি দেশের সব বড় আলেম-মৌলানাদের কাছে একটি প্রশ্ন করব, এই একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে খ্রিস্টান, ভারতে হিন্দু নারীরা ‘তালাক’-এর ক্ষেত্রে কোন রকম ‘হিল্লা বিয়ে’ নামের সম্পূর্ণ অমানবিক ঘৃণ্য নারীর জন্য দ্বিতীয় প্রকৃতির ধর্ষণের ব্যবস্থা করে যেসব মৌলানা, তাদের বিরুদ্ধে আপনারা কখনও ফতোয়া দিয়েছেন কি? অথবা তাদেরকে বিচারে সোপর্দ করেছেন কি? জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন নাহার ফতোয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন, যেটি খুব সম্ভব আপীল বিভাগে এখনও আটকে আছে। মৌলানাদের নিজ কন্যাদের ও বোনদের আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের পুরুষের ইচ্ছায় বিবাহিতা নারীকেও অন্য পুরুষের কাছে ‘আইনী’ভাবে ধর্ষিতা হবার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত অপরাধমূলক ফাক-ফোঁকরগুলো বন্ধ করতে এগিয়ে আসতে হবে। এটা বলাবাহুল্য। গ্রামেগঞ্জে এই ‘তালাক’ নিয়ে ‘হিল্লা’ বিয়ের মাধ্যমে ধর্ষণ হচ্ছে, তা বন্ধ করা মৌলবী-মোল্লাদের একটি অন্যতম দায়িত্ব। তাঁরা সে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন এবং অন্তত, কন্যা ও বোনদের নারী নির্যাতক ফতোয়াবাজদের হাত থেকে রক্ষা করবেন, অন্যকিছু করার আগে এটাই তাঁদের জন্য কর্তব্য হিসেবে অগ্রগণ্য।
এছাড়াও মৌলানাদের একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরুর দ্বারা নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ এর শিকার হওয়া, তাদের বসত-জমি-জীবিকা দখল হওয়া থেকে রক্ষা এবং সর্বোপরি তাদের প্রাণের নিরাপত্তা প্রদান যে সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব, এই তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা, পাড়া-মহল্লায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। ইসলামের নবী সঠিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সংখ্যাগুরুর হাতে ‘আল্লাহর আমানত’ হিসেবে গণ্য করতে বলেছেন। তাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সংখ্যাগুরুর হাতেই, এ কথা মৌলানাদের উপলব্ধি করতে হবে এবং একই সাথে ইসলাম ধর্মের এ মহৎ সুশিক্ষার পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। মৌলানা সাহেবরা দেশের সংখ্যালঘুর, হিন্দু আদিবাসী ভূমিগ্রাসকারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া নয়, সামাজিক বয়কট, তাদের বিচারে সোপর্দ করতে এগিয়ে আসবেন, এটিই জনগণের প্রত্যাশা।
মৌলানা সাহেবরা কোথায় আমেরিকায় বাংলাদেশের একজন ব্যক্তি ওই দেশের একটি অঙ্গরাষ্ট্রের আইনী অধিকার সমকামী বিবাহ সম্পর্কে তাঁর ‘ব্যক্তিগত মত’ প্রকাশ করেছেন বলে তাঁকে ‘দেশ ছাড়া’ করবার ফতোয়া দেবার প্রয়োজন ছিল না। মানবাধিকারে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে উচ্চ স্থান দেয়া হয়। একটা কথা না বললে এ বিষয়টা পরিষ্কার হবে না। পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্ম ব্যক্তির চর্চার বিষয় কিন্তু রাষ্ট্র সব ধর্মের এবং আস্তিক-নাস্তিক সবার জন্য অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করে। যদিও আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোতে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কোন ধারা যুক্ত নেই। সত্যি বলতে, ওদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার চর্চার ব্যাপক বিস্তৃতির সুযোগে আমাদের দেশের বা এশিয়া, আফ্রিকার সন্ত্রাসী, খুনী, জঙ্গী জেহাদীরা পশ্চিমা দেশেই ঠাঁই গেড়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী, তাদের সন্তানরা ’৭১-এ অনেক যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সন্তানেরা তো পশ্চিমা দেশেই বসবাস করছে। জঙ্গী জেহাদীরা মালয়েশিয়াতেও বসবাস করছে যাদের অনেকেরই টার্গেট ওখান থেকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেয়া। এই জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ বেশি জরুরী।
আমাদের তদানীন্তন শাসকদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ময়মনসিংহে সে সময়ে সিনেমা হলে জঙ্গীদের বোমা হামলা, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের ওপর হাওয়াভবনে পরিকল্পিত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত গ্রেনেড হামলাকে পর্যন্ত অবিশ্বাস্য জেনেও আওয়ামী লীগের দ্বারাই সেসব সংঘটিত বলে যে মিথ্যা ভিত্তিক অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি করেছিল, সেই মিথ্যা পশ্চিমারা বলে না। কিন্তু তাদের কোন মিত্রকে যদি কখনোও আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল, নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে দেখে, তাহলে যুদ্ধাস্ত্র যাদের ব্যবসার প্রথম পণ্য, সেই পশ্চিমারা তাকে কিভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাদ্দাম ও গাদ্দাফী। এমন কি আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করার জন্য তারা জন্ম দিয়েছিল ও বিকশিত করেছিল সস্ত্রাস, জঙ্গী দল আল কায়েদা, তালেবান ও লাদেনকে! সে অবমুক্ত দৈত্যকে আবার পরে তাদেরই হত্যা করতে হয়েছে ও হচ্ছে! দুনিয়ার তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ-সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পশ্চিমারা এক পুতুল খেলায় রত, যে খেলায় কোন একভাবে দরিদ্র দেশগুলোকেও খেলতে হচ্ছে! তবে পশ্চিমা সাধারণ নাগরিকরা যুদ্ধ ও এসবের বিরুদ্ধবাদী এবং ওদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রীতি এসবের প্রতি গভীর আস্থা না থাকলে আজ আমাদের লেখক তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার, সালমান রুশদীরা প্রাণে বাঁচতে পারত না। খেয়াল করে দেখুন, এই মুরতাদ, কাফের নাম দিয়ে মুসলমান উগ্র জেহাদী মৌলানারাই তাদের কতল করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে-যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ! মসুলমান ছাড়া অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় সারা দুনিয়ায় কোন কবি লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীকে কত্্ল্যোগ্য দাবি করেনি! এমন কি এখনকার জঙ্গী, ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিত তরুণরাও মুক্তিযুদ্ধপন্থী এখন প্রগতিশীল ব্লগারদের কতল্যোগ্য ঘোষণা করছে, কত্লও করছে!
’৭১-সালের রাজাকার গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীদের উত্তরসূরী বর্তমান যুগের ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিতদের মধ্যেও যদি জঙ্গী খুনী জন্ম নিতে পারে, মাদ্রাসায় তো কিছু সংখ্যক জন্ম নিচ্ছেই-তাহলে মৌলানারা এই জল্লাদ-সৃষ্টিকারী মসুলিম মৌলানাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সংশোধনমূলক প্রচার কর্মকা- শুরু করবেন।- এটাই অনেক বেশি কাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয়। পশ্চিমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করার ফলে একজন শিশুকে মা-বাবা জন্মদান করে তবে মালিক হতে পারে না, সে নির্যাতিত হলে পুলিশ ঐ মা, বাবা রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক সন্তানের দেখভালের উপযুক্ত নয় গণ্য করে শিশুকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যায়!
সবশেষে ছোট্ট করে বলতে চাই- সমকামিতা-দোষে দুষ্ট পৃথিবীর সব দেশের সব সমাজ। আমাদের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এসবের হোস্টেল, আরও নানা স্থানকে সমকামিতার কেন্দ্রস্থল বলে চুপিসারে মানুষ সমালোচনা করে। পশ্চিমারা ওটাকে ব্যক্তির নিজস্ব অভিরুচি হিসেবে মান্য করে, সেটাকে গোপন বিষয়ে পরিণত না করতে বিবাহের আইন পাস করেছে আমেরিকার কোন কোন অঙ্গরাষ্ট্র। কে কোথায় এ বিষয়ে একমত পোষণ করল তাতে আপনাদের–আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। আর যদি আপনারা সত্যিই ধর্ষক, সমকামী, বহু বিবাহকারী, যৌতুকদাবিকারী, নারী হত্যাকারী এবং প্রগতিশীল তরুণ-তরুণী হত্যাকারীদের দেশছাড়া করার ঘোষণা দিয়ে দাবি আদায়ের আইনসম্মত কর্মসূচী গ্রহণ করেন, তাহলে সত্যিই দেশ ও জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নে আপনাদের মৌলানাদের বিপুল ভূমিকা শ্রদ্ধা অর্জন করবে।

Wednesday, September 18, 2013

অগ্নিবীণার দুর্দম বাদক- বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক তোমাদের কপালে জোটেনি-কোটি জনগণের লক্ষ সালাম:হাসান মাহমুদ


একাত্তরের মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণে ছিন্নভিন্ন পূর্ব পাকিস্তান, ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা-গণধর্ষণে রক্তে আর্তনাদে ভেসে যাচ্ছে দেশ। বহু মাইল স্রেফ পায়ে হেঁটে সীমানা পেরোচ্ছে লক্ষ লক্ষ আতংকিত গ্রামবাসী বুড়ো বাবা-মা’কে নিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে। গ্রামবাংলার ধুলিধুসরিত পথে হাতে মাথায় ঘটি-বাটি নিয়ে গরু-ছাগলের রশি ধরে হাজার হাজার পথযাত্রীর ভীড়ে রাস্তায় বৃদ্ধার মৃত্যু রাস্তায় জন্মানো বাচ্চা। কে বিশ্বাস করবে সেই দাবানলের মধ্যে একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শরণার্থী শিবিরে এক কাপড়ে উপস্থিত এক পাঞ্জাবী তরুণ! চারদিকে তুমুল হৈ হৈ, ছুটে এসেছে ভারতীয় সৈন্যেরা। কি? না, আমার বাড়ী লাহোর কিন্তু আমি শরণার্থী, আমাকে খেতে দাও থাকতে দাও। ভাঙ্গা-বাংলায় কথা বলছে সে।

‘‘তারপরে কেটে গেছে কত শত কাল, তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল’’।
সাঁইত্রিশ বছর আগে ঘটনার ঘনঘটায় উন্মত্ত জীবন আজ গল্প হয়ে গেছে। বয়সের সব ঝড় বোধহয় এভাবেই থেমে যায় একদিন।

কটা বেড়াল-চোখ কাঁচা সোনা রঙ্গের সুঠাম সুদর্শন তরুণ আনোয়ার শাহেদ খান। যেন সিনেমার নায়ক। সাতষট্টি সালে ইÏটারউইং স্কলারশীপ নিয়ে লাহোর থেকে ফিজিক্স-এ অনার্স পড়তে এসেছিল, থাকত ফজলুল হক হলে। আমি তখন বায়োকেমিষ্ট্রিতে - ওই ফজলুল হক হলেই। কি করে যেন বন্ধুত্ব হল নিবিড়, নিবিড় থেকে নিবিড়তর। খেয়াল করতাম আমার কাছে কাছে থেকে অনুসন্ধিৎসু চোখে সে নিরীক্ষণ করছে আমাদের ওপরে পশ্চিমের নিপীড়ন আর শোষণ। আমি তখন ছাত্রলীগের চির-দুর্ভেদ্য দূর্গ ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং হল-সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক, উন্মত্ত দিন কাটছে রাস্তায় শ্লোগানে মিছিলে, বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইতিহাস। কাছে থেকে থেকে দেখে দেখে আনোয়ার বুঝতে পারছে কেন আমাদের ছয় দফা, কেন ওদের এত উন্নতি আর আমাদের এত অবনতি। তার শের-শায়েরীর কাব্যিক মন ঠিকই ধরেছে ইসলামের নামে পাকিস্তানী রাজনীতির বিভৎস ঠকবাজী। তারপর সত্তরের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে এল বিসুভিয়াসের বিস্ফোরণে। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে আমি আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্ট আমার সাথে উপস্থিত থেকে আনোয়ার স্বচক্ষে দেখল জনতার ভৈরব গর্জন। মৃদু হেসে পরিহাস করে বলল - ‘‘আব হাম্‌ আপকো অওর রোক্‌ নেহি সাক্‌তে’’ - আর আমরা আপনাদের ঠেকাতে পারব না।

তারপর সে স্বচক্ষে দেখল পঁচিশে মার্চের তান্ডব, জানল গণহত্যা, গণধর্ষণ। সময়ের জঠরে তখন জন্ম-যন্ত্রণায় নড়ে উঠছে পাকিস্তানের মাটিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য ভ্রূণ। পঁচিশে মার্চে বাজপাখীর আক্রমণে মুরগীর বাচ্চার মতন জাতি ছিটকে গেল চতুর্দিকে। সবাই ছুটল গ্রাম-জননীর সুবিশাল আশ্রয়ে, জননীও আগ্রহী হাত বাড়িয়ে কোটি সন্তানকে তুলে নিল তার কোলে। কিন্তু আনোয়ার যাবে কোথায়? এখানে তো ওর কেউ নেই, দেশটা ওর চেনাও নেই। কেউ কেউ বলল আর্মির ব্যারাকে যেতে - ওটাই ওর নিরাপদ জায়গা। কিন্তু প্রাণের নিরাপত্তার চেয়েও সৈন্যদের প্রতি ঘৃণা তখন তার অনেক বেশী। আরেক বন্ধুর বাবা তখন রাজশাহীতে চাকরী করেন, সিলেটে বাড়ী। তার সাথে কোনমতে রাজশাহী পৌঁছুল আনোয়ার, তারপরে ঘাতক সৈন্যদলের ধাক্কায় সবাই সীমানা পেরিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদে শরণার্থী শিবির। মে মাসে সেনাপ্রহরায় রাজশাহী ফেরা, সেনাপ্রহরায় ঢাকা এবং পরের মাসে সটান লাহোরে বাবা-মায়ের কোলে।

তারপর সে আমাদের পক্ষে হাতে তুলে নিল তার যুদ্ধের অস্ত্র, কলম। ইতিহাসে এই একটা অস্ত্র অসাধ্যসাধন করেছে বারবার। অত্যাচারীরা যে অস্ত্রকে সবচেয়ে বেশী ভয় করেছে তা হল এই, - কলম। আমাদের জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় শুরু হল পাকিস্তানেও। ‘‘পদ্মা সুরখ হ্যায়’’ (রক্তাক্ত পদ্মা) নামে পশ্চিমা প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের পঁচিশ বছরের ঠকবাজী ও একাত্তরের গণহত্যা-গণধর্ষণের ওপর আনোয়ারের চাক্ষুষ নিবন্ধ ছাপা হচ্ছ্রে প্রতিদিন একসাথে লাহোরের দৈনিক মুসাওয়াত ও করাচীর দৈনিক ডন’-এর গুজরাটি সংস্করণে, ক্রমাগত তিরিশ দিন। হৈ হৈ পড়ে গেল দেশে। জামাতিরা ওকে কতল করার খোলাখুলি ঘোষণা দিয়ে দিল - সগর্জনে ছুটল ওকে কতল করতে। ছুটে এল সামরিক সরকারের পুলিশ আর গোয়েন্দা, নিজদেশে পরবাসী আনোয়ার লুকিয়ে গেল আন্ডারগ্রাউন্ড।

আমাদের তবু দেশ ছিল গ্রাম ছিল, স্বাধীন বাংলা সরকার ছিল বেতার ছিল, চারদিকে সংগ্রামী জাতি আর মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি ছিল, আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল, শেষ সম্বল হিসেবে ভারতে আশ্রয় ছিল, ওর কি ছিল চতুর্দিকে অগণিত শত্রু ছাড়া? আকস্মিক আক্রান্ত হয়ে আমাদের তো যুদ্ধ ছাড়া উপায় ছিলনা, কিন্তু ওকে তো কেউ বাধ্য করেনি স্বজাতিরই বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে নামতে! এমনকি আমাদের সাথে ওর তো যোগাযোগও ছিলনা! তবু লড়ল আনোয়ার, পাকিস্তানের বুকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিঃসঙ্গ একা। হিংস্র সরকারের গণহত্যা-গণধর্ষণ তুলে ধরা, বাবা-মা ভাইবোন থেকে দুরে - চাকরী নেই উপার্জন নেই খাবার নেই থাকার জায়গা নেই - একে আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?

এ হল লাহোর। আর করাচীর মখ্‌দুম?

একাত্তরের প্রথম দিকে জাহিদ মখদুম করাচীর প্রাণবন্ত তুখোড় ছাত্রনেতা। নির্বাচনে আমাদের বিজয়ের বিরুদ্ধে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র টের পেয়েই সে ছাত্রসমাজকে নিয়ে যুদ্ধে নামল। মিটিং মিছিলের শ্লোগান, দেয়ালে দেয়ালে হাজারো পোষ্টার, সংসদের সামনে বিক্ষোভ, চীৎকারে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে তুলল করাচী। একের পর এক বিদ্রোহী নিবন্ধ লিখতে লাগল সিন্ধী দৈনিক ‘‘ইবারত’’-এ। দেশ-শাসন করার জন্য তোমাদের সৈন্যদলে নেয়া হয়নি, জনগণের পয়সায় হাতে অস্ত্র দেয়া হয় নি। নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তান জিতেছে, লক্ষ্মী ছেলের মতো তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাও। প্রমাদ গুনল ভুট্টো, প্রমাদ গুনল সরকার। এদিকে শুরু হয়ে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আক্রমণ, ধীরে ধীরে কাদায় পড়ছে নাপাক বাহিনী। ওদিকে সমন জারী হল গ্রেপ্তারের, পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল মখদুম। তারপর লারকানা, জেকোবাবাদ, শুক্কুর আর হায়দ্রাবাদ কারাগারে তার শরীরের ওপর নেমে এল কেয়ামত। স্বীকার করো তুমি ভারতের গুপ্তচর, টাকাপয়সার লেনদেন আছে। স্বীকার করো তোমার সাথে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন যোগসুত্র আছে। লোহার রডের প্রহার, ইলেক্ট্রিক শক্‌, অন্ধকার সলিটারি কনফাইনমেÏেট ঘুমহীন, কখনো খাবারহীন পানিহীন বন্দী জাহিদ মখদুম। কতোদিন? মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাসের পরেও কিছুদিন। অথচ ‘‘ভুল করেছি’’-র মুচলেকা সই করলেই তাকে ছেড়ে দেয়া হত - তার উঁচু সে মাথা সে কখনো নোয়ায় নি।

একেও আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?

শুধু ওরাই নয়, খুঁজলে কাশ্মীরের হাশিম আর আশরাফ, করাচীর গোলাম মুহাম্মদ ল’ুন কিংবা মকবুল বাট-এর মতো অনেক নামই পাওয়া যাবে। একাত্তরে আমাদের সমর্থন করে চাকরী হারিয়েছেন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা শাফা’য়াত হাসনায়েন। স্বাধীনতার পরে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তী পুরুষ ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ - ক্ষমা চেয়ে গেছেন। ওদের লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ অনেকবারই ক্ষমা চেয়েছে আমাদের কাছে। সেদিনও চাইলেন টরেন্টো আন্তর্জাতিক শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে ক্যানাডা লেখক-সংস্থার কর্তাব্যক্তি মুনীর সামী। বললেন,‘‘যে দানবের হাত পা’ ভেঙ্গে তোমরা বেরিয়ে গেছ সেই একই দানবের যাঁতাকলে আমরা এখনও পিষ্ট হচ্ছি। জানিনা পাকিস্তানের কপালে কি আছে’’।

‘‘মানুষের মন চায় মানুষেরই মন’’ - কবিগুরু। তাইতো আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে এতো দেয়া নেয়া, তাইতো বম্বের সিনেমায় অভিনয় করেন পাকিস্তানী সালমা আগা, ‘‘শত্রুর দেশে’’ কনসার্ট করেন মেহদি হাসান আর তাঁর সম্পর্কে সে দেশের উচ্চতমা পদ্মশ্রী বলেন - ‘‘উন্‌কা গলে মে ভগওয়ান ঝরতা হ্যায়’’ (‘‘উনার কন্ঠে স্রষ্টা উৎসারিত হন’’ - লতা মুঙ্গেশকর) ।
তাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন গানে গানে টাকা তোলেন, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণাসভা বসে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা’র ম্যানেজার অডারল্যান্ড সাহেবের বাসায়। তাইতো বাংলার গায়ক সুমন চ্যাটার্জী সুদুর নিকারাগুয়া’র স্যান্দিনিস্তা গণযুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নেয় এস-এল-আর হাতে, রবিশংকরের সেতারে ক্যারিবিয়ান পল্লীসংগীত আর পশ্চিমা কর্ড, হলিউডের ছবিতে জাকির হূসেন আর মেঘ রাগিনীর সা-রে-মা-পা-ণি-র্সা আর চীনা ভাষায় গেয়ে ওঠেন বাঙ্গালীনি সাবিনা ইয়াসমিন। আশ্চর্য্য নয় ? এত আগুনের মধ্যেও পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইসরাইলী ডিরেক্টর অ্যামস্‌ গিতাই-এর ছবিতে অভিনয় করেন পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্যালেষ্টাইনী অভিনেতা ইউসুফ আবু ওয়ার্দা, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনের নাট্যকর্মীরা একসাথে নাটক করেন। তাইতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম ‘‘বৌদি’’ আর হিন্দু ‘‘মায়ের সম্মান রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে হিন্দু আর মুসলিম যুবক ইতিহাসে রেখে যায় মহামিলনের আর্ত আহ্বান।

এরই নাম মানবতার শক্তি, সংস্কৃতির শক্তি। তাই তো ইতিহাসের প্রতিটি বার্লিন-প্রাচীর এত ভঙ্গুর, এত ক্ষণস্থায়ী। এপারে এক ফোঁটা রক্তের পাশাপাশি ওপারে এক ফোঁটা অশ্রু গড়ায় এটা ইতিহাসের সত্য - তা সে বার্লিনই হোক, ইংল্যান্ড -আয়ার্ল্যান্ড হোক, বিভক্ত বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীরই হোক, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনই হোক বা পাকিস্তান-বাংলাদেশই হোক। পিন্ডির অলিগলির ঠেলাগাড়ীতে ফল-সব্জী নিয়ে যে ঘর্মাক্ত লোকটা হাঁক দিয়ে বিক্রী করে বেড়ায় সে আমাদের শত্রু নয়। কোহাটের পাহাড়ে যে লোকটা পাথর ভাঙ্গে, যে নারীরা বাচ্চার হাত ধরে ঝিলাম-চেনাব-বিয়াস-সিন্ধু থেকে কাঁখে কলসীভরা পানি টানে তারা আমাদের শত্রু নয়। পাকিস্তানের মসজিদে নামাজে ব্রাশ ফায়ারে যারা রক্তাক্ত মরে পড়ে থাকে তাদের সাথে আমাদের নয়শ’ কুড়িটি বধ্যভুমির তফাৎ সামান্যই। আমাদের সবার শত্রু এক, এবং তারা কারা তা আমরা ভালো করেই জানি। এবং একাত্তরে তাদের পদলেহী ‘‘হাস্যমুখে দাস্যসুখে বিনীত জোড়কর, প্রভুর পদে সোহাগমদে দোদুল কলেবর’’ (কবিগুরু) বাংলাদেশী পিশাচরা কারা তা এদিকে আমরাও জানি ওদিকে আনোয়ার-মখদুমরাও জানে।

এ দানবকে পরাস্ত করা কঠিন, হিমালয়-বিজয় বা উত্তাল সমুদ্র-বিজয়ের মতই কঠিন। সুদুর নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি’র সাথে সুদুর নেপালের তেনজিং নোরপে’র মিলন ছাড়া এ দুর্গম হিমালয়-বিজয় অসম্ভব। সুদুর পর্তুগালের ভাস্কো-ডা গামা’র সাথে সুদুর ইয়েমেনী সমুদ্র-বিশারদ আবদুল মজিদের মিলন ছাড়া এ দুর্দান্ত সমুদ্র-বিজয় অসম্ভব। আজ যখন দানবের হাতে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মানবের সংগ্রামও তাই আন্তর্জাতিক না হয়ে উপায় নেই। তাই যখন আমাদের সাথে পাকিস্তানেও দাবী ওঠে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই তখন মনে পড়ে সেই একাত্তরেই কয়েকজন পাকিস্তানী বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল ওই পাকিস্তানের মাটিতেও, - ক’জন জানে!

অগ্নিবীণার দুর্দম বাদক! অসাধ্যসাধনের অদম্য সাধক!! বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক তোমাদের কপালে জোটেনি কিন্তু কোটি জনগণের তরফ থেকে তোমাদের লক্ষ সালাম।

Monday, September 16, 2013

প্রাণের পরে চলে গেলো ফারিহা- বসন্তের বাতাস টুকুর মতো -- সুমি খান



 রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে  সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন
 আকাশের এক  ধ্রুবতারার নাম ফারিহা জাহান !মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্বজন পরিবার বন্ধুদের  শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশে হারিয়ে গেলো গত ৩ মে, ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়!
ফারিহার মা দিবা স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙ্গে পড়েছে খুব। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দশ মাস দশ দিন যে কষ্ট পায় একজন মা, ১৭ বছরের হতেই মেয়েটা চলে গেলে কী থাকে আর মায়ের স্বান্তনা??



৩ মে  ২০১৪, বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ ঝড় এলো আকাশ কাঁপিয়ে।পাশের বাড়ির খেলার সাথী  ফারিহাকে ডাকতে এলেই ছাদে ছুটে যায় ফারিহা। প্রচন্ড ধুলিঝড়...কৈশোরের অনাবিল আনন্দের বানের তোড়ে মৃত্যুবাণ ছিল কি সেই ঝড়? 

দু'দিন ধরে এজমার টানে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেদিন শ্বাসের কষ্টটা একটু কম মনে হওয়াতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো কিশোরী মেয়েটা।এরপর আবার বাড়ীতে ঢুকে কী মনে করে ময়দা দিয়ে ঝাল পিঠা বানিয়ে বাবা- মা,দাদী, ছোট বোন ফাইরুজ - সবাইকে খাওয়ালো।কেউ বুঝতে পারলো না দ্বিতীয় বারের মতো ডাষ্ট ইনহেইল করে সর্বনাশ ডেকে আনলো মেয়েটা! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করলো মেয়েটা। ইনহেলার, নেবুলাইজার কোন কাজই করলো না, শ্বাসনালীতে পানি জমে গেছে ইতিমধ্যে। 
বাঁচার আকুতিতে অসহায় আমাদের ফারিহা চিৎকার করে বাড়ির এই কামরা থেকে ঐ কামরা...ডাইনিং থেকে ড্রইং রুমের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত আছড়ে পড়লো,"আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমি কি বাঁচবো না? আমি বাঁচতে চাই..."!

খবর পেয়ে গলির মুখ থেকে ছুটে ঘরে ফিরে এলো অসহায় পিতা!  পিতা মাতা , আদরের ছোটবোন, দাদীমা, খেলার সাথী  সবার সামনেই  মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ঘরের দরজায় পড়ে গেলো ফারিহা।

আবার উঠে প্রিয়তম বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পড়ে বললো, "আব্বু আমাকে বাঁচাও, আব্বু আমি বাঁচতে চাই, আব্বু, আমি বাঁচতে চাই!!"  সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর ডাকে নিমেষে ছুটে এলো বন্ধু ডাক্তার মঈনুদ্দীন।কোলে করে গাড়িতে উঠানো হলো, গলি পেরুতেই সদরঘাট পোষ্ট অফিস। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি.! 

ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন  ফারিহার দাদীমা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা  শওকত আরা জাফর।  তার চোখের দৃষ্টি ছিল পৌত্রী  ফারিহা। রাতে  দাদিমার গায়ে কাঁথা তুলে দেয়া , সকালে তাকে  পত্রিকা পড়ে শোনানো, খাওয়ার সময় বা কোথাও বেড়াতে গেলে  নজরদারী করা -সবকিছু যেন ফারিহার করতে হবে। আজ এ শূন্যতা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে দাদীমার বুকে!

আদরের ছোট বোন  ফাইরুজ ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া বাইরের জগত তার খুব চেনা নেই ! সারা দিন খুনসুটি করা একমাত্র বোনের আকস্মিক প্রয়াণে নির্বাক নিস্তব্ধ ফাইরুজ!  ৩ মে দুপুরে ও একই রকমের টপস পরে ছবি তুলে ফারিহা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শূন্য করে চলে গেলো বোন টি!! ফাইরুজের  নিদ্রাহারা রাতের প্রহর কেটে যায়, খেতে বসলে মুরগীর মাংস দেখলেই বুকে মোচড় দেয়, আদরের বোনটি মুরগীর মাংস ছাড়া খেতেই চাইতো না। ফারিহার স্মৃতিতাড়িত ফাইরুজ আর খেতে পারে না! কী করে চলে গেলো আদরের বোন টি!! কী করে খাবো আমি!

 অবিরল অশ্রুধারায়  ভেসে মায়ের মনে পড়ে  আদরের কন্যাটি দু'দিন আগে ৩০এপ্রিল মায়ের জন্মদিন পালন করেছে ! রাত প্রথম প্রহর -১২ টা ১ মিনিটে ফারিহা 'হ্যাপী বার্থডে টু ইউ' গানটা ছেড়ে মাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। দুপুরে   শওকত আরা জাফর অনেক কিছু রান্না করলেন একমাত্র পুত্রবধুর জন্মদিন উপলক্ষে । ।ফারিহা বললো, " দাদী, আজকে তোমার রান্না অনেক মজা হয়েছে! আম্মু,  দ্যাখো, দাদি তোমার জন্মদিনে কী মজা করে রান্না করেছে!"
 এসব বলে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সন্তান হারা মা দিবা!...একটা ডিপিএস ম্যাচিউরড হয়েছে ১২ বছরে, দিবার স্বপ্ন ছিল, ফারিহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এই টাকায় করবে!!দিবার সবকিছুতে নমিনি করেছিলো ফারিহাকে! প্রথম সন্তান, সবাইকে দেখে শুনে রাখবে-এমন স্বপ্নে ! সব আজ ধুলায় হয়েছে ধুলি!! কী স্বান্তনা আছে সন্তানহারা এই মায়ের??

রবীন্দ্রসঙ্গীতশিখতো  ফারিহা। দাদিমা বললেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতো গাইতে!
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ- এই বানী চিরন্তন হয়ে গেঁথে ছিলো ফারিহার মনে। আর তাই এইটুকু বয়সেই সবার একজন করে গড়ে তুলেছিলো নিজেকে! 

শুধু কি পরিবারে? প্রতিবেশী , শিক্ষক সবার কাছেই ফারিহা ছিল একান্ত স্বজন! ফ্ল্যাট সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ে  ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীদের অন্তর দিয়ে র্হাদিক বন্ধনে আত্মার আত্মীয় করে নেবার অসাধারণ বিশালত্ব ছিল ফারিহা নামের কিশোরীটির অন্তরে!! যা  আত্মকেন্দ্রীকতার এই নষ্ট সময়ে সত্যিই বিরল! 

চট্টগ্রামের সদরঘাট পোষ্ট অফিস গলি  সনাতন ধর্মবলম্বীদের আদি এলাকা।  সাম্প্রতিক সময়েও তরুণ দের মাঝে এলাকায় অসাম্প্রদায়িক বন্ধন ধরে রেখেছিলো যারা , তাদের মধ্যে ফারিহা ছিল সবার আগে। প্রতিটা পূজা পার্বনে ফারিহার সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রাখতো প্রতিবেশীদের!! তাদের আত্মার আত্মীয় ছিল যেন  চঞ্চলা হরিনী এই কিশোরী।  কলা পাতায় করে দেয়া পূজার প্রসাদ তার ভীষণ প্রিয় ছিল। 

পাঁচিলের ওপারে সঙ্গীতা বিশ্বাস পলিরা সপরিবারে থাকে। এই দুই পরিবার গত চার দশকের ও বেশি একসাথে আছেন। হিন্দু-মুসলিম অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চার দশকে এসেও অটুট থাকার প্রধান সূত্র ছিল ফারিহা। ফারিহার বাবার সহপাঠী পলিকে  পাঁচিলের এপার থেকে চিৎকার করে  ডেকে বলতো, "পলি ফুপু, নিরামিষ রেঁধেছো, আমাকে দিও কিন্তু!" পলির ফিজিওথেরাপিষ্ট ছিল ফারিহা। পলিকে প্রতিদিন চলে আসতে হতো। ফারিহার টেবিলে বসে ফারিহার হাতে ফিজিওথেরাপী নিতে হতো। একদিন ফারিহার মা দিবা বললো, আজকে আমি দিই থেরাপী। সেদিন প্রচন্ড হাতে ব্যথা হয় দিবার। মায়ের মন, ফারিহা কে বলে, " আমার একদিনেই হাতে কী প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে, ফারিহা, তুমি প্রতিদিন এভাবে পলিকে  থেরাপি দিওনা, তোমার অনেক কষ্ট হয়!"  ফারিহা হেসে জবাব দেয়, " না, আম্মু, পলি ফুপুর হাতে অনেক ব্যথা। আমি থেরাপি দিলে ব্যথাটা ভালো হয়ে যাবে। সদরঘাট পোষ্ট অফিসের সামনে , গলির ভেতর কালো ব্যানার আর  ফারিহার জন্যে শোক চোখে পড়ার মতো ! মনে করিয়ে দেয় , মানুষের প্রাণের পরে চলে গেলো যে, বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ...সে যে চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা!   

 ৫ মে তার একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো।কথা ছিলো  পরীক্ষা শেষ করে ফারিহা চিরাচরিত নিয়মে আনন্দে মেতে উঠবে। ২য় বর্ষে ক্লাস শুরু করার মানসিক প্রস্ততি নেবে।ওসবের কিছুই হলো না।পরীক্ষার কক্ষে তার আসনটি শূণ্য পড়ে থাকলো।ফারিহার সহপাঠীরা তার জন্য কলেজ ক্যাম্পাসে ঝুলালো কালোরঙ ব্যানার। মৃত্যুর কাছে আমরা কত অসহায়।
প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা চোখের পলকে প্রাণহীন নীরব শবদেহে পরিণত হবার রূঢ় বাস্তবতা  এলাকার যারা তার আত্মার আত্মীয় ছিল- শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ !! এদের কেউ  মেনে নিতে পারছেন না -ফারিহা আর কখনো খেলতে আসবে না, পূজা দেখতে আসবে না!  প্রতিবেশীদের   কাছে তার প্রিয় খাবার খেতে আসবে না!! !!

প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে সময়মতো জরুরী চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এই কিশোরীকে। বাঁচবার আকুল আকুতিতে পিতার বুকে আছড়ে পড়েছিলো ফারিহা! অসহায় পিতা  নিকটস্থ  হাসপাতালে ছুটে গেলেও  তাৎক্ষণিকভাবে  অক্সিজেন এবং জরুরী চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হন। মৃত্যুর অমোঘ নিয়তি কেড়ে নেয় দিবা-পাপ্পুর বুকের ধন , তাদের প্রথম সন্তান ফারিহাকে। ফারিহার মা দিবা এবং বাবা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর বুকে পাথর সমান এ ভার বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু । ফারিহার প্রাণ ছিল তার দাদীমা শওকত আরা জাফর । অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত আরা জাফর কোন ভাবেই ভুলতে পারেন না প্রিয়তম নাতনীর বাঁচার আকুতি !, তার দুই কন্যা নুসরাত জাহান রুমা এবং ইসরাত জাহান কণাও  প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত!

 ফারিহার বালিশ, জামা কাপড় নিয়ে  অবিরল অশ্রুধারায় নির্ঘুম প্রহর কাটছে তার মা  দিবার। কী স্বান্তনা আছে , যা দিয়ে মায়ের শূন্য বুকে ফিরিয়ে আনা যায়, এমন প্রানবন্ত সন্তানকে?

স্বজনদের বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের। 

 রবীন্দ্রনাথের জীবনে পর পর ১৩ স্বজন কে হারাতে হয় !  কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি।যাকে স্বজন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার। 

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তার খেলার সাথী ছিলেন। 

  পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায়  যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷   প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।

১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার মৃনালিনী দেবী  মৃত্যু বরণ করেন। স্ত্রীর  মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দুমাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্যতার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি। স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ বয়স তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷ 

স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ছাদে চলে গেলেন, নিষেধ করে গেলেন যেন কেউ তাঁর কাছে না যায়৷ মৃণালিনীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত হলো ‘স্মরণ' কবিতাগুচ্ছ৷ ভাষায় আড়ম্বর নেই, উপমা অলংকারের আয়োজন নেই, জীবনের টুকরো টুকরো ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তাঁর প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘স্মরণ'-এর অনেকগুলো কবিতায়৷ ‘যুগল মিলন' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘মিলন সম্পূর্ণ হল তোমা সনে, এ বিচ্ছেদ বেদনার নিবিড় বন্ধনে৷''

রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে, তিন মেয়ে – মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ৷ মাধুরীলতার ডাক নাম বেলা, রেনুকার ডাক নাম রাণী৷ স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি মাধুরীলতা ও রেনুকার বিয়ে দেন, তাদের অল্প বয়সে৷ বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তাররা রোগ পরীক্ষা করে রায় দিলেন – যক্ষ্মা৷ ডাক্তারদের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে হাওয়াবদল করলেন দু'বার৷

 অসুস্থ রেণুকাকে শোনানোর জন্য লিখলেন ‘শিশু' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ৷ অবশেষে  মাত্র বারো বছর বয়সে চলে গেলো রেণুকা; মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দশ মাসের মধ্যে৷ 

১৯০৫-এ পরিণত বয়সে মৃত্যু হলো পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের৷ 

এর মাত্র দু'বছর পর রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র এগারো বছর বয়সি শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যুবরণ করলো । মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হলো শমীন্দ্রনাথ৷ খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে মুঙ্গেরে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলো শমীন্দ্রনাথ।

 রবীন্দ্রনাথ তখনো পথে। বলে দিলেন তার জন্যে অপেক্ষা না করে শমীন্দ্রনাথকে দাহ করে ফেলতে। আদরের ছেলে কে শেষ দেখা ও দেখতে পারলেন না কবিগুরু।

 রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘...শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে৷' সে সময়ে রচিত হলো তার অমর সৃষ্টি ," আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে !

আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীঁরণে ।।

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে-

এই নিরালায় রব আপন কোণে

যাব না এই মাতাল সমীরণে ।।

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।।

বড়ো মেয়ে মাধুরীলতার সংসার জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের ছিলো না৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটাও এক বেদনাত্মক অধ্যায়৷ জামাতা শরতের অন্যায় গর্হিত আচরণ আর মাধুরীলতার প্রতি চরম নির্যাতন সইতে না পারলে ও অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ কিছুই করতে পারেন নি।
জামাতার সাথে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছেছিলো৷ মেয়ের বাড়িতে তাঁর যাওয়া আসাও তেমন ছিলো না৷ কন্যার কষ্ট সইতে না পেরে বলতেন." ছোটকালে মাধুরীলতার কঠিন অসুখ হয়েছিলো, সেদিন সে মরে যেতো যদি, আমাকে তার এমন কঠিন সময় দেখতে হতো না।"

একদিন হঠাৎ খবর এলো মাধুরীলতা অসুস্থ৷ রাজরোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত মাধুরীলতা । শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রোজই মেয়েকে দেখতে যান৷  জামাতার চরম অপমান জনক আচরণ নীরবে সয়ে গেছেন বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!  লেখিকা হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন, ‘‘অতি আদরের মেয়ে বেলা মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন তার কন্যা বেলা (মাধুরীলতা) র সাথে। শ্বশুর মশাইকে দেখে  শরৎ  টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত৷ পা নাবাতো না পর্যন্ত – এমনি করে অপমান করত৷ উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন...৷''মাধুরীলতার মৃত্যু হলো বত্রিশ বছর বয়সে৷

 রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘‘সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ – যখন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যা হবার তা হয়ে গেছে৷ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্রার বৈঠক ছিল৷ বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন৷ তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে সদালাপ করছেন৷''

১৯২৩-এ মৃত্যু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৯২৫ সালে মারা যান  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,  ১৯২৬-এ দ্বিজেন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ দিদি স্বর্ণকুমারী মুত্যুবরণ করেন ৷ 

১৯৩২-এ একাত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন কন্যা মীরার পুত্র কুড়ি বছর বয়সি আদরের নাতি নীতিন্দ্রনাথকে৷ উচ্চতর শিক্ষার জন্য নীতিন্দ্রনাথ গিয়েছিলো জার্মানিতে৷ টেলিগ্রামে নীতুর মৃত্যু সংবাদ এলো৷  শান্তিনিকেতনে তখন 'বর্ষা মঙ্গল' উৎসবের আয়োজন চলছে৷

আয়োজন বন্ধ হলো না৷ রবীন্দ্রনাথ মীরাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নীতুকে খুব ভালবাসতুম, ... অনেকে বললে, এবার বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে৷  আমি বললুম, সে হতেই পারে না; আমার শোকের দায় আমিই নেব৷''

শোকের দায় আবার নিতে হলো রবীন্দ্রনাথকে , তার মৃত্যুর এক বছর আগে৷ আরেক প্রিয় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর সংবাদ পেলেন মংপু-তে বসে৷ জন্মদিনের আয়োজন চলছিলো তখন৷ ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখলেন, ‘‘তোরা বোধহয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি বেশি ভালোবেসেছিলুম৷'' কবিতা লিখলেন সুরেনের স্মৃতিতে, ‘‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ...''

রবীন্দ্রনাথ একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এ ভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না৷''