Friday, January 3, 2014

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী


বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃত মোনাজাতউদ্দিন। আজ রবিবার চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক। মূলত তার আগ্রহের জায়গা ছিল অনুসন্ধানী সংবাদ এবং তার ফলোআপ ।  ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ফেরি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যবরণ করেন।

মোনাজাতউদ্দিন-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে। পিতা আলিমউদ্দিন আহমদ , মাতা মতিজাননেছা। পিতা আলিমউদ্দিন ছিলেন চাকুরিজীবি। তিনি রংপুর পৌরসভার উর্ধ্ব-করণিক, রংপুর পুলিশ দপ্তরে প্রধান-করণিক এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।

আলিমউদ্দিন ‘আম্বিয়া চরিত’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। অপ্রকাশিত ‘আধুনিক যোদ্ধা’ নামে একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও রচনা করেছিলেন।

মোনাজাতউদ্দিনের পড়াশোনা শুরু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। রংপুরের কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজে থেকে মানবিক শাখায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কারমাইকেল কলেজে বি.এ পড়াকালীন হঠাৎ করেই পিতার মৃত্যুতে পরিবারের দায়-দায়িত্ব নিতে হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

চাকুরি নেন নিশাতগঞ্জ সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। কিছুদিন পরে সেই চাকুরি ছেড়ে দিয়ে পিডিবি অফিসে একজন একাউনটেন্ট হিসেবে যোগ দেন । কিন্তু এই চাকুরিতে তাঁর মন বসেনি। তিনি কিছুকাল কাজ করেন রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ক্যাটালগার হিসেবে। হাতের লেখা সুন্দরের কারণে এই কাজটি তিনি অনায়াসেই পরিছন্নভাবে করতে পারতেন।

পারিবারিক কারণে বিভিন্ন স্থানে কাজ করলেও প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাশ করেন ।

মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ছাত্র অবস্থাতেই। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।

পরে ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। এর আগে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায়ও কাজ করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রকাশ করেন ‘দৈনিক রংপুর’। শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এই পত্রিকাটি বের করার চিন্তা করেন। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক-প্রকাশক।

এর অর্থ যোগাতেন একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী। বাহ্যিকভাবে সেই ব্যবসায়ী সৎ মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন অসৎ ব্যবসায়ী। যে কারণে তাঁর সঙ্গে মোনাজাতউদ্দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটে। অবধারিতভাবেই এই পত্রিকাটির করুণ মৃত্যু হয়।

তখন ঢাকায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ । তাই বাধ্য হয়ে মোনাজাতউদ্দিনকে জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকুরি নেন।

১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। তারপর থেকে একটানা প্রায় বিশ বছর সেখানেই কাজ করেছেন । ‘সংবাদ’ই ছিল তাঁর ঠিকানা।

বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকন্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন।

ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

৩০ ডিসেম্বর তাঁকে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোনাজাতউদ্দিন প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার।

রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।

যদিও চারুশিল্পে তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন ।

মোনাজাতউদ্দিন তাঁর কর্ম জীবনের সাধনা ও স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে রংপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক সংবর্ধণা, ১৯৮৪ সালে পান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, আলোর সন্ধানে পত্রিকা তাঁকে ১৯৮৫ সালে সংবর্ধণা দেয়, ১৯৮৬ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়া কর্তৃক সম্মাননা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপস্ পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সংবাদপত্রে প্রভূত অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার পান, রংপুর পদাতিক গোষ্ঠী তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধণা দেয় ১৯৮৮ সালে, বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে, একই সালে লেখনির মাধ্যমে প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রত্যক্ষ ও জনপ্রিয় করার দুরূহ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সমাজ ও প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা ‘কারিগর’ সম্মাননা পান, ১৯৯৫ সালে মর্যাদাশালী অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন, রংপুরের নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৯৬ সালে, ১৯৯৬ সালে তিনি লালমনিরহাট ফাউন্ডেশন ও উন্নয়ন সমিতি স্বর্ণপদক পান, ঢাকাস্থ রংপুর জেলা সমিতি তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধিত করে ১৯৯৫ সালে, ১৯৯৭ সালে পান রংপুর জেলা প্রসাশন কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধণা।

১৯৯৭ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক।

খুলনায় তাঁকে রুমা স্মৃতি পদক প্রদান করা হয় ১৯৯৮ সালে। এছাড়া ওয়াশিংটনের পদ্মার ঢেউ বাংলা সম্প্রচার কেন্দ্র সম্মননা প্রদান করা হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তবে মোনাজাতউদ্দিন এই পুরস্কারের চাইতেও বড় পুরস্কার মনে করতেন মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধা ও ভালবাসাকে, যা তিনি অকুন্ঠই পেয়েছেন।

মোনাজাতউদ্দিন নাসিমা আক্তার ইতির সাথে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মোনাজাতউদ্দিন ও নাসিমা আক্তার ইতি’র দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মাহফুজা মাহমুদ চৈতি ও হোসনাতুল ফেরদৌস দুই বোন। দুজনেই ডাক্তার। একমাত্র ছেলে আবু ওবায়েদ জাফর সাদিক সুবর্ণ (১৯৭৪-১৯৯৭) ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় আত্মহত্যা করে।

মোনাজাতউদ্দিন তাঁর সংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। এসব নিয়ে বইও হয়েছে। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। যা পাঠক সমাজকে মোহতায় আবিষ্ট করে রাখে এখনো।

তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’: ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’।

এছাড়াও মাসিক মোহাম্মদি, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। নাটকের একমাত্র প্রকাশিত বই ‘রাজা কাহিনী’। 
এছাড়া তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন।

***
তথ্যসূত্র: বাংলা একাডেমী প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থ- ‘মোনাজাতউদ্দিন’ , লেখক- মোহাম্মদ জয়নুদ্দিন।

‘জয় বাংলা’ বলব ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলব না এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু : মুহম্মদ শফিকুর রহমান

জানতাম বাঙালী কৃতজ্ঞ জাতি। সে তার উপকারীকে মনে রাখে। জন্মদাতা পিতাকে তো ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। এখন দিন পাল্টে গেছে। বরং উপকারীকে বাঘে খায়, ক্ষতিকারক পুরস্কৃত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলতেন যত অপকর্ম শিক্ষিত সাদা কাপড়অলারাই করে। আমাদের শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, আমরা এখন সাদা কাপড় পরি। তার মানে অপকর্ম করা লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। 

১৬ ডিসেম্বর ২০১৩। মহান বিজয় দিবস। আমাদের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায় মহান মক্তিযুদ্ধের ৪৩তম বিজয়ের দিন। আবেগাপ্লুত হবার দিন। একদিকে ৩০ লাখ শহীদ ও ৬ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের বেদনা, আরেকদিকে হানাদার পাকি-মিলিটারি জান্তাকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের আনন্দ-এমনি আনন্দ-বেদনা-মিশ্রিত মহাকালের পথে যাত্রা শুরুর দিন এই ১৬ ডিসেম্বর। আমরা যারা এ পুরো প্রক্রিয়ার বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত হবার সুযোগ পেয়েছি, গণঅভ্যুত্থানে, মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের কাছে মহাকাল যাত্রার আবেগ-অনুভূতি এক রকম, পরবর্তী প্রজন্ম যারা কেবল বয়সের কারণে জড়িত হতে পারেনি, তাদের আবেগানুভূতি অন্য রকম। রাজাকাররা তো রাজাকারই।

দিনভর প্রেসক্লাব, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফিরলাম, বিষণœ মন নিয়ে। আগে প্রতিটি বিজয় দিবসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতাম। জিয়া-এরশাদের মিলিটারি শাসনের মধ্যেও। একবার তো এরশাদের মিলিটারির পিটুনি থেকে বেঁচে গেছি কেবল সাংবাদিক পরিচয়ে। তবে সেবার স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দের ওপর বাঙালী মিলিটারির নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছি। সঙ্গে ছিল সংবাদের রিপোর্টার (লন্ডন প্রবাসী) আবু মূসা হাসান।
১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তার আগে বছরের গোড়ার দিকে স্বাধীনতা দিবসের মাত্র দু’দিন আগে ২৪ ডিসেম্বর এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ক্যুর মাধ্যমে। রক্তপাতহীন ক্যু। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সাত্তার সাহেব সহজেই এরশাদ সাহেবকে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন (পরবর্তীতে দুই মিলিটারি কর্নেল জাফর ইমাম ও জেনারেল মাজেদুল হকের কাছে দলের চেয়ারপার্সনের ক্ষমতাটিও খালেদা জিয়াকে দিয়েছিলেনÑ সেটিও ছিল আরেক রক্তপাতহীন ক্যু)। সেবার (১৯৮২) জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্মৃতিসৌধ এলাকা ছেড়ে যাবার পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, মুহম্মদ নাসিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আরও অনেকে (সবার নাম এ মুূহূর্তে মনে পড়ছে না)। তারা একযোগে সেøাগান দিতে শুরু করেন ‘সামরিক শাসন-মানি না, মানব না’ ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন সরে যেতে থাকলেন। গেলেন না কেবল নেতৃবৃন্দ। তাঁরা তখনও সেøাগান দিচ্ছিলেন। এ সময় আমাদের পরিচিত একজন এএসপি বা এসবি (নাম মনে নেই) কাছে এসে আমাদের অদূরে তার পাশে দাঁড়াতে বললেন। প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি। বুঝলাম পরে-যে দৃশ্য ছিল বেদনাদায়ক। দেখলাম একদল তরুণ, হাতে রাবারের রড, হকিস্টিক, ইলেকট্রিক তার পাকানো রড ইত্যাদি নিয়ে দৌড়ে স্মৃতিসৌধের গেটের দিকে আসছে এবং এসেই নেতৃবৃন্দকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে? অমানুষিক নির্যাতন। মুহম্মদ নাসিমের সাদা পাঞ্জাবির নিচে পিঠে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে, আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দেখলাম শুধু। এসপি বললেন-কোন মন্তব্য করবেন না, ওরা ডিজিডিএফআই-এর লোক। রড হাতে এক তরুণ আমাদের সামনে এসে কর্কশ কণ্ঠে বলল- দডযড় ধৎব ুড়ঁ’? এএসপি সাহেব নিজের পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দু’জনেরও পরিচয় দিলেন সাংবাদিক বলে। বললেন আমরা ডিউটি করছি। দডযধঃ ফঁঃু’ বলে দু’জন সিপাইকে ডেকে বললেন এঁদের বাইরে রেখে এসো। সিপাই দু’জন আর্মি কম্বেট ইউনিফরম পরা। তারা আমাকে ও হাসানকে বললেন, ‘স্যার আপনারা বোধ হয় অফিসার? ওরাও বড় অফিসার তাই না? ওদের ছবি খবরের কাগজে দেখেছি। দেখলেন আমাদের অফিসাররা ওদের কিভাবে মারল, এটা কি ঠিক করেছে? এরপর তারা দু’জন আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমরাও ঢাকাগামী বাস পেয়ে উঠে বসি। তারপরও বহুবার সাভার স্মৃতিসৌধে গেছি। গত কয়েক বছর ধরে আর যাওয়া হয়নি। এবারও না। তবে আগেই বলেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সৃষ্ট বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে যেয়ে হোঁচট খেয়েছি। কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা?

বাড়ি ফিরেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রাইটিং প্যাড টেনে লিখতে শুরু করলাম, এগোলো না। জাতি হিসেবে আমরা কি তবে অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছি? বাঙালী কৃতজ্ঞ জাতি- তা কি তবে ঘুছে গেছে? ভাবলাম কারও সঙ্গে শেয়ার করে মনটা হাল্কা করব। সেলফোন তুলে বন্ধু স্থপতি বদরুল হায়দারকে ডায়াল করলাম। বদরুলও আমার সঙ্গে একমত-আমরা কি তবে অকৃতজ্ঞ জাতি? বদরুলের সঙ্গে কথা শেষ করে ফোন রাখতেই বেজে উঠল। এবার অপরপ্রান্তে এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, মাঝে মধ্যে মালেক ভাইর বাসায় (আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়। আবদুস সালাম ছাত্রজীবনে ক্যাম্পাসে ছাত্রনেতা ছিলেন। টেলিফোন তুলেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন- আমরা কি তবে সত্যি সত্যি অকৃতজ্ঞ?

এবারের ১৬ ডিসেম্বর দেশে তিনটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে গেল। দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো। তিনটি বিশেষ ঘটনার কারণে। নতুন প্রেক্ষিতের কারণে অন্য রকম মাত্রা পেয়েছিল :

এক. বাঙালী জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আপন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনেক ঘটনাবহুল স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইমরান-লাকি-মারুফ রসুলদের গণজাগরণ মঞ্চের বিজয় উদ্যাপন সমাবেশে লাখো মানুষের অংশগ্রহণ এবং তাদের আহ্বানে দেশব্যাপী কোটি বাঙালীর একসঙ্গে দাঁড়িয়ে এককণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন। একই মঞ্চ থেকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-এর ডাকে একইভাবে কোটি কণ্ঠে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ গ্রহণ। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং শপথ বাক্য পাঠের সময় (পাঠ করেন ফোরাম চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ. কে. খন্দকার) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত টেলিভিশন বেতারের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছে, শপথ বাক্য পাঠ করেছে।
দুই. দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হলো ২৭,১৩৭ জনের হাতে লাল-সবুজ কার্ড, নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় পতাকার রূপ নেয়, যা ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাতীয় পতাকা। এটি গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ স্থান লাভ করেছে।
তিন. তৃতীয় ঘটনাটি হলো মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর। এ সেই মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লা যে শত শত লোককে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, মেহেরুন্নিসা নামে একজন কবিকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে, আলবদর বাহিনী গঠিত হলে তাতে যোগ দিয়ে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তার ফাঁসি কার্যকরও হলো ১৩ ডিসেম্বর রাত ১০টা ০১ মিনিটে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের একদিন আগে ও বিজয় দিবসের তিন দিন আগে। 

এই পুরো ঘটনাবলীতে ভিন্নমাত্রা ভিন্ন আবেগ যোগ হলেও সর্বত্র একটি ঘাটতি থেকে গেল সব ক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ সেøাগানটি উচ্চারিত হলেও কোথাও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারিত হয়নি। অথচ ‘জয় জনতা’ ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’ এসব সেøাগানও শোনা যায়। এর নাম কি তবে নিরপেক্ষতা? অথচ ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ এই দুই সেøাগান দু’টি একটি আরেকটি ছাড়া আধুরা, অসম্পূর্ণ। সেøাগান দুটির একটি ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস এবারের বিজয় দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সঙ্গে জড়িত।
বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নামও এই নাম ছিল না। ছিল না স্বাধীনতা স্তম্ভ, ছিল না গগণচুম্বী গ্লাস টাওয়ার এবং তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এই নাম এই অবয়বে গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বাঙালী জাতির ইতিহাসের কয়েকটি বিশাল ঘটনা এবং যে ঘটনাগুলো গড়ে ওঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে তাঁর নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে।
পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল রেসকোর্স। এখানে ঘোড় দৌড়ের জুয়া খেলা হতো। অর্থাৎ ঘোড়ার দৌড়ের ওপর বাজি ধরা হতো। যার ঘোড়া প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হতো সে বা সেই সব লোক কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যে বিশাল অঙ্কের টাকার মালিক হয়ে যেত। যাদের বাজির ঘোড়া হেরে যেত তারা একইভাবে কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যে ফকির হয়ে যেত। এমন গল্পও শোনা গেছে, এই রেস খেলায় হারতে হারতে কেউ বউকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে (যদিও এ কথার কোন তথ্যভিত্তিক প্রমাণ নেই)।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশ থেকে মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড় দৌড় ইত্যাদি অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে দেন। মানবতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত-মুসলিম লীগ-নেজামে ইসলামীও নিষিদ্ধ করেছিলেন। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স-এর নাম পাল্টে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করেন। জাতির দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মিলিটারি জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে একদিকে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ..... রাহিম’ সংযোজন করেন, পাশাপাশি পুনরায় মদ-জুয়া-হাউজি চালু করলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম পাল্টাবার ধৃষ্টতা দেখাননি। এখানে রেসকোর্স তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে সংঘটিত কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করছি।
তবে শিশুপার্ক বানিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা বঙ্গবন্ধুর নাম আড়াল করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু উপাধি

এই সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখানে সমবেত বাঙালী তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব লাহোরে সর্বদলীয় বৈঠকে বাঙালী জাতির পক্ষে ‘বাঙালীর মুক্তি সনদ’ ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। এক কথায় বলতে গেলে এই ৬ দফা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং তা থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীর সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও স্বপ্নের আপন জাতি রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬ দফা দেয়ার পর তৎকালীন পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক আইয়ুব প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে এবং পরে একে একে সকল প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে ফাঁসিতে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। গোটা বাংলাদেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ডাকসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং ৬ দফার আলোকে ছাত্রদের ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন তখন ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক চলতে থাকে। সারা বাংলায় সৃষ্টি হয় এক সাহসী গণঅভ্যুত্থান। বাঙালীর প্রতিবাদের ভাষা বুঝতে পারে আইয়ুবের মিলিটারি প্রশাসন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সংবর্ধনা এবং সংবর্ধনাও হয় এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্সে)। সংবর্ধনায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ১০ লাখ মানুষের ২০ লাখ উত্থিত হাত তা সমর্থন করে। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হন ‘বঙ্গবন্ধু’। সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ এক সেøাগানে পরিণত হয়।

৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কথা নতুন করে বিস্তারিত বলার আছে বলে মনে করি না। কেবল এটুকুই বলব, ৭ মার্চের ভাষণটিও বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। এই ভাষণ বিশ্বের ২/৩টি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের একটি। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অডিও-ভিডিও-সিডি বা মাইকে গত ৪৩ বছরে যতবার বাজানো হয়েছে বিশ্বে এর কোন দ্বিতীয় নজির নেই। একাত্তরের মার্চ মাসব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ডাকে ইতিহাসের এক তাক লাগানো নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলনের মাঝে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা, কিভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করতে হবে তারও রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা ছিল।

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে রাত দেড়টায়। এর পর পরই পাকি মিলিটারি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় তিনি “যার যার আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার এবং সর্বশেষ পাকি হানাদার আর্মিটিও বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন”। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বাঙালী যে যেভাবে পেরেছে যুদ্ধে গেছেন, ভারতে যেয়ে ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে এসে যুদ্ধে শামিল হয়েছেন এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয়ের পেছনে আত্মত্যাগও ছিল সীমাহীন। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ এবং ৬ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। তার মধ্যে পৌনে ৩ লাখকে ধর্ষণ করে করে হত্যা করা হয়েছিল।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করেছিল।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বিশ্ববিবেকের চাপে এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগারে দুইবার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হয়, কবরও খোড়া হয়েছিল, কিন্তু পারেনি (বাঙালী জাতির লজ্জা পাকিস্তান যা করতে সাহস পায়নি বাঙালীর কুলাঙ্গার সন্তান খুনী মোশতাক-জিয়া তা করেছিলেন)।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে প্রথমে লন্ডনে গেলে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান। সেখান থেকে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করলে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি (ভরাহ গিরি ভেংকট গিরি) ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। সেখানে মিসেস গান্ধীর (ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী) সঙ্গে ৪০ মিনিট একান্ত বৈঠক করেন (এই বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু ভারতীয় সৈন্য বাংলার মাটি থেকে নিয়ে যাবার অঙ্গীকার আদায় করেন)। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে সরাসরি এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে যুদ্ধ জয়ের জন্যে জাতিকে অভিনন্দন জানান এবং আল্লাহ পাকের শোকরিয়া আদায় করেন।
সেদিন বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত যেন গোটা বাংলাদেশ ভেঙ্গে পড়েছিল। কত লোক হয়েছিল তার তুলনাও কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সাড়ে ৬ বছর প্রবাসী জীবন শেষে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গেই হতে পারে। সেদিনও সারাদেশ যেন ভেঙ্গে পড়েছিল রাজধানীতে।

ইন্দিরা মঞ্চ

বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁকেও সংবর্ধনা দেয়া হয় এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। এ উপলক্ষে যে সংবর্ধনা মঞ্চটি করা হয়েছিল তার নামও দেয়া হয়েছিল ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। এখানে একটা কথা বলে রাখিÑ ১৯৭১ সালে মিসেস গান্ধী যেভাবে যুদ্ধ জয়ে সহযোগিতা করেছেন, যে যুদ্ধে ভারতের ১৭ হাজার সৈন্যও শহীদ হয়েছিল এবং যেভাবে এক কোটি শরণার্থীকে মাতৃস্নেহে দীর্ঘ ৯ মাস লালন করেছেন তার তুলনাও কেবল তিনিই। যে কারণে ইন্দিরা গান্ধী চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

শিখা চিরন্তন

মিলিটারি জিয়া ছিলেন চরম আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী। তিনি প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর দাফন না করার চক্রান্ত করেন। তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে বঙ্গবন্ধুর নাম জিয়া তা মুছে দেয়ার জন্য শিশুপার্ক নির্মাণ করেন। যেমন তার স্ত্রী আজ গোপালগঞ্জের নাম মুছে দিতে চান। শিশুপার্ক যেহেতু বাচ্চাদের বিনোদনের ব্যাপার সেহেতু স্পর্শকাতর-এই সুযোগটিই জিয়া নিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালী জাতি ১৯৯৬ ও ২০০৮-এ ভোট দিয়ে জিয়ার সেই চক্রান্ত নস্যাত করার ম্যান্ডেট দেয় শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাও জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনেন।
আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ। এখানে রয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস; শিখা চিরন্তন এবং গগণচুম্বী স্বাধীনতা (গ্লাস) টাওয়ার। আর এই শিখা চিরন্তনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে যোগ দেন বিশ্ব বরেণ্য নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত ও সুলেমান ডেমিরেল। তাঁরা শিখা চিরন্তন প্রজ্বলন ও স্বাধীনতা টাওয়ারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে অংশ নেন।

গণআদালত

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য শুরু হয়। ৩৮ হাজার গ্রেফতার হয় এবং তন্মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধের চার্জ আনা হয় এবং তন্মধ্যে ৬ শতাধিকের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদী সাজা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া বিচার বন্ধ করে দেন এবং আটক ও সাজ্জাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেন।
আজ সেই কালো দিন (৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫) যেদিন মিলিটারি জিয়া যুদ্ধাপরাধী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ৬৩ জেলা ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। বিচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তারপর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল, জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী, প্রধান কবি শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসানো হয় এবং তাতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আযমের ফাঁসির (প্রতীকী) রায় দেয়া হয়। এই পুরো তৎপরতার পেছনে ছিলেন সেদিনের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা, যার নেতৃত্বে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে।
এসব ঘটনা উল্লেখ করলাম কেবল তরুণ প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য। ইতিহাস লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কথা হলো বাঙালী জাতির হাজার বছর ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে, বহুবার জিতেও ধরে রাখতে পারেনি। সে সব সংগ্রাম ছিল বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম। একটি মাত্র মানুষ একটি মাত্র বজ্রকণ্ঠ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসে সকল বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম এক মোহনায় প্রবাহিত করিয়ে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং তা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই।

ইতিহাসের সেই মহানায়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালী জাতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। তারই পদভারে আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালীর বিজয় উদযাপিত হবে, আমাদের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান  ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হবে, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারিত হবে না, এ ক্ষেত্রে কেবল এ টুকুই বলব ‘এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু’।

Monday, December 30, 2013

স্মরণ ॥ বিচারপতি কেএম সোবহান এবং খালেদা জিয়ার ২৯ ডিসেম্বর অভিযাত্রা : শাহরিয়ার কবির


’৭১-এর গণ-হত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতে ইসলামীর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের চলমান আন্দোলনের পুরোগামী নেতা ছিলেন বিচারপতি কেএম সোবহান। আজ ৩১ ডিসেম্বর (২০১৩) তাঁর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। আমৃত্যু তিনি সক্রিয় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়বার এ আন্দোলনে।
২২ বছর আগে ১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর ’৭১-এর শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে দলের আমির ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী। গোলাম আযম ১৯৭১ সালেও জামায়াতের আমির ছিলেন এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে যেমন সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন তেমনি নিজেও ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘শান্তি কমিটি’ প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা মিছিল করে গোলাম আযমের কুশপুতুল দাহ করেছেন। সংসদের ভেতরে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অন্যান্য দলের সাংসদরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ এরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী ৭২টি রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি।’ জাহানারা ইমাম এ সমন্বয় কমিটিরও আহ্বায়ক ছিলেন, যে সংগঠনের উদ্যোগে ’৯২-এর ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়েছিল। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের সকল বাধা অগ্রাহ্য করে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঁচ লাখেরও অধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের অভূতপূর্ব কর্মসূচী সফল হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের আন্দোলন সারাদেশে এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে বাঙালী অধ্যুষিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। নাগরিক সমাজের দাবি পরিণত হয়েছিল জাতীয় আন্দোলনে। গণআদালতের প্রথম বার্ষিকীতে কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারপার্সন করে অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের যাবতীয় অপরাধের তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করা হয় বরেণ্য আইনজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে। ১২ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশনের অন্যতম ছিলেন বিচারপতি কেএম সোবহান, যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রাজপথের আন্দোলনেও সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে জামায়াত জানিয়ে দিয়েছিল তারা বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান কিছুই মানে না। নির্মূল কমিটি এ কারণে ২৯ ডিসেম্বর ‘ঘৃণা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে ২০০১ সাল পর্যন্ত, যতদিন গোলাম আযম জামায়াতের আমির ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমাদের আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’সহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ৭১টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত ঘোষণায় স্বাক্ষর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন জরুরী এবং কী ভাবে হবে সে বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করেছেন এবং দ্রুত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২৯ ডিসেম্বর এ ঘোষণা প্রদানের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল ঘৃণা দিবসের কারণে। জাতিকে আমরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি ১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর জামায়াত কী ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণা প্রদানের আগে দীর্ঘ দুই মাস অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় আমাদের বৈঠক হয়েছে। তখন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা মেনে নিলেও নিজেরা বিচারের উদ্যোগ গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন। জামায়াত যথারীতি বিচারের বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। আমাদের সমমনাদের কেউ কেউ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের কথা বলছিলেন, কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রচলিত আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। আমাদের ঘোষণায় এসব বিভ্রান্তি দূর করে ১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’-এর অধীনে কী ভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যায় সে বিষয়ে সরকার ও দেশবাসীকে স্বচ্ছ ধারণা দিতে চেয়েছিলাম। এ জটিল ও অস্বচ্ছ আইনী বিষয়টিকে স্বচ্ছতা প্রদানের ক্ষেত্রে যাঁর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি তিনি বিচারপতি কেএম সোবহান।
২০০৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ধানমন্ডির বিলিয়া মিলনায়তনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ৭১ সংগঠনের এ ঘোষণা প্রদান করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করুন।’ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও বিচারপতি কেএম সোবহান। প্রধান অতিথি ছিলেন সদ্য গঠিত ‘সেক্টস কমান্ডার্স ফোরাম’-এর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) একে খন্দকার বীরোত্তম। নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও এ ঘোষণা প্রদানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহিলা পরিষদের সভাপতি হেনা দাস, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান কর্নেল (অব) শওকত আলীসহ নাগরিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
৭১ সংগঠনের এ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘ সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা ও জামায়াতী বুদ্ধিজীবী ও সাবেক আমলা শাহ আবদুল হান্নান বলেছেনÑ ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে কোন যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি, দেশে কোন স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী নেই। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের লম্পট ও চোর আখ্যায়িত করে তারা যেসব বক্তব্য প্রদান করেছেনÑ সারাদেশ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। জামায়াত নেতাদের এসব চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, তারা এখনও ’৭১-এর অবস্থান থেকে সরে আসেননি, বাংলাদেশকে এখনও তারা পাকিস্তান মনে করেন। ’৭১-এ তারা যে ভাষায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিষোদগার করতেন এখনও তারা তাই করছেন।
’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান অমান্য করা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপহাস করা, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান লাঞ্ছিত করা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করা। আমাদের ইতিহাসে এবং সংবিধানে স্বাধীনতার যুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের কথা বলা হয়েছে, কোথাও বলা হয়নি তখন গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম লাইনেই বলা হয়েছে, আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি বাংলাদেশের সংবিধান মানতে অস্বীকার করে তার বিচার হওয়া উচিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে।’
ঘোষণায় এরপর জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য প্রমাণ উত্থাপন করে বলা হয় বঙ্গবন্ধুর সরকার কী ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছিলেন এবং জেনারেল জিয়া দালাল আইন বাতিল করে কী ভাবে সে বিচার বন্ধ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যেসব সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা কেউ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, এটা জাতির জন্য নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে অতীতে কোন সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়নি বলে বিচার তামাদি হয়ে গেছে কিংবা যুদ্ধাপরাধী বলে বাংলাদেশে কেউ নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনও তামাদি হয় না। ৬০-৬৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য খুঁজে বের করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর জামায়াতের শীর্ষ নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাই তখন তাদের গ্রেফতার ও বিচার সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল এবং সংবিধান সংশোধন করে তাদের দেশে ফেরার পথ সুগম করেছেন। এখন যেহেতু তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সংবিধানকে উপহাস করে বক্তৃতা বিবৃতি অব্যাহত রেখেছেন তাদের বিচার করা অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে জরুরী হয়ে উঠেছে।
‘৩১ অক্টোবর (’০৭) সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনভিপ্রেত।’ ১ নবেম্বর সকল দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর এ মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জামায়াত নেতাদের ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গোটা জাতি আবার ফুঁসে উঠেছে, যেমনটি আমরা দেখেছিলাম ’৯২-এ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূচনাপর্বে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিও আবার সর্বমহলে উচ্চারিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যুদ্ধাপরাধী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধিত না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনরোষে ভীত হয়ে জামায়াত নেতারা উন্মাদের মতো আচরণ করছেন।
‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারাদেশ যখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে তখন এ বিচার কী ভাবে হবে এ নিয়ে সুধীমহলেও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রতিদিন এ বিষয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন, ভাষ্য, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে, যেখানে অসাবধানবশত কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথাও বলা হচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত মন্তব্যে এবং বিভিন্ন টেলিভিশনের ‘টকশো’তে কোন কোন আইনজীবীও বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দুইভাবে শুরু হতে পারেÑ প্রথমতঃ সরকার বাদী হয়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু করতে পারেন, দ্বিতীয়তঃ বিদ্যমান ভুক্তভোগী বা সংক্ষুব্ধ কেউ তথ্যপ্রমাণ থাকলে আদালতেও যেতে পারেন। শেষোক্ত বক্তব্য আইনের দৃষ্টিতে সঠিক হলেও রাজনৈতিক বা অপরাধের গুরুত্বের বিবেচনায় যথাযথ নয় এবং তা প্রকৃত বিচারের অন্তরায়।
‘যুদ্ধের সময় সংঘটিত ‘গণহত্যা’, ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ প্রভৃতি সাধারণ অপরাধ বা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে অপরাধ নয়। এ অপরাধসমূহের চূড়ান্ত ভিকটিম হচ্ছে রাষ্ট্র, সরকার ও জনসাধারণ। গণহত্যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর আংশিক অথবা সম্পূর্ণ নির্মূলন। যুদ্ধের সময় ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্যাতন বা হত্যা হচ্ছে জাতি/সম্প্রদায়/গোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণের অন্তর্গত। একইভাবে জনপদ ধ্বংস, ব্যাপক হত্যা সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা বিপুলসংখ্যক মানুষকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করা ইত্যাদি সব কিছু যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্গত। ব্যক্তি আপাত ভিকটিম হলেও চূড়ান্ত ভিকটিম হচ্ছে জাতি ও গোষ্ঠী এবং সেই জাতি ও গোষ্ঠীর যদি কোন সরকার বা রাষ্ট্র থাকে তা-ও। ’৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর এবং ১০ এপ্রিল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদনের পর থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থা, পাকিস্তানী সংবিধান এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বাতিল হয়ে গেছে। এ কারণেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তার যে প্রতিনিধিরা ২৬ মার্চের পর বাংলাদেশে অবস্থান করছিল তারা দখলদার/হানাদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। এ দখলদার বাহিনীকে এদেশীয় যারা সাহায্য সহযোগিতা করেছে তারা দালাল বা কোলাবরেটর হিসেবে পরিচিত। যেকোন যুদ্ধে কোলাবরেটরদের কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করা হয়। জামায়াতে ইসলামী শুধু কোলাবরেটর ছিল না, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অংশ ছিল; তাদের দুজন নেতা মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ’৭১-এ তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।
’৭১-এ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে সহযোগিতা ও প্ররোচিত করার পাশাপাশি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের অপরাধ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি, কারণ তারা এদেশের নাগরিক। জামায়াতের আলবদররা লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, ডা. আলীম চৌধুরী ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো শ’ শ’ বরেণ্য ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে ধরে বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করেছে। জামায়াতের ঘাতক খালেক মজুমদার, আশরাফউজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনউদ্দীনদের সঙ্গে শহীদুল্লা কায়সার বা মুনীর চৌধুরীদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন বলেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। আলবদরের নেতারা পাকিস্তানী জেনারেলদের সঙ্গে বসে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করে হত্যা করেছে, যা ছিল গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্গত। ঘাতকরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এ কারণেই এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে নয় রাষ্ট্রকে বাদী হতে হবে। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ট্রাইব্যুনালে যাবেন সাক্ষী হিসেবে। ১৯৭৩-এর ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্টে সরকারকেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা এবং বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষনেতার ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে সারাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে দাঁড়ানো অনভিপ্রেত, যখন সেনাপ্রধান বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া প্রয়োজন তখন এ সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা বলছেন অতীতে কোন সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, কেন বর্তমান সরকারকে তা করতে হবে, এ সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে ঘোষিত সময়ের ভেতর নির্বাচন সম্পন্ন করা।
‘এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছেÑ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকার যেসব রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারই অন্তর্গত। এ সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজনের প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার উদ্যোগ নিয়ে এ সরকার শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের ভোটাধিকার বাতিলের দাবি শুধু রাজনৈতিক দল বা নির্মূল কমিটির নয়, সর্বস্তরের জনগণ আজ এ দাবিতে সোচ্চার।’
৭১ সংগঠনের এ ঘোষণার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিবেচনা করে ২৯ ডিসেম্বর তারিখটি আমরা বেছে নিয়েছিলাম। কাকতালীয়ভাবে এর এক বছর পর ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে প্রধানতঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারের জন্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন চতুর্থাংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছে। পাঁচ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ২৯ ডিসেম্বর তারিখটি নির্বাচন করেছেন ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’র জন্য। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতাদের ভেতর অনেক ‘বীরোত্তম’, ‘বীরবিক্রম’, ‘বীরপ্রতীক’ মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন। তাদের অনেকে এখন বেঁচে নেই। যাঁরা আছেন তারা কোণঠাসা হয়ে গেছেন খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার কারণে। বিএনপির ক্ষমতাধর প্রবাসী নেতা খালেদা তনয় তারেক মনে করেন জামায়াত ও বিএনপি সহোদর ভ্রাতা। এ কারণে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাসহ জামায়াতের সকল অপরাধ ও সহিংসতার দায় স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। জামায়াতের যাবতীয় এজেন্ডা কার্যকরের দায়িত্ব এখন বিএনপি বহন করছে। যার ফলে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সভা সমাবেশ এবং সরকারের গণবিরোধী, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার যেকোনও দলের বা ব্যক্তির সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার। কিন্তু সে অধিকার অন্যের অধিকার হরণ করে, মানুষের জীবনজীবিকা বিপন্ন করে ভোগ করা যায় না। বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য যত কর্মসূচীই দিক না কেন মানুষ তাতে সাড়া দিচ্ছে না। এ কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচীর নামে সাধারণ মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়, সরকারী-বেসরকারী সম্পদ ধ্বংসসহ জননিরাপত্তা বিপর্যস্ত করা হয়, আঘাত করা হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ভিত্তিমূলে। জামায়াতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ও প্রতিহিংসার রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে এ সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকবে।
মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের চলমান আন্দোলনে বিচারপতি কেএম সোবহানের অবদান সব সময়ে উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো পথ প্রদর্শন করবে।

৩০ ডিসেম্বর ২০১৩