Monday, December 30, 2013

স্মরণ ॥ বিচারপতি কেএম সোবহান এবং খালেদা জিয়ার ২৯ ডিসেম্বর অভিযাত্রা : শাহরিয়ার কবির


’৭১-এর গণ-হত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতে ইসলামীর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের চলমান আন্দোলনের পুরোগামী নেতা ছিলেন বিচারপতি কেএম সোবহান। আজ ৩১ ডিসেম্বর (২০১৩) তাঁর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। আমৃত্যু তিনি সক্রিয় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়বার এ আন্দোলনে।
২২ বছর আগে ১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর ’৭১-এর শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে দলের আমির ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী। গোলাম আযম ১৯৭১ সালেও জামায়াতের আমির ছিলেন এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে যেমন সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন তেমনি নিজেও ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘শান্তি কমিটি’ প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা মিছিল করে গোলাম আযমের কুশপুতুল দাহ করেছেন। সংসদের ভেতরে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অন্যান্য দলের সাংসদরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ এরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী ৭২টি রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি।’ জাহানারা ইমাম এ সমন্বয় কমিটিরও আহ্বায়ক ছিলেন, যে সংগঠনের উদ্যোগে ’৯২-এর ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়েছিল। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের সকল বাধা অগ্রাহ্য করে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঁচ লাখেরও অধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের অভূতপূর্ব কর্মসূচী সফল হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের আন্দোলন সারাদেশে এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে বাঙালী অধ্যুষিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। নাগরিক সমাজের দাবি পরিণত হয়েছিল জাতীয় আন্দোলনে। গণআদালতের প্রথম বার্ষিকীতে কবি সুফিয়া কামালকে চেয়ারপার্সন করে অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের যাবতীয় অপরাধের তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করা হয় বরেণ্য আইনজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে। ১২ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশনের অন্যতম ছিলেন বিচারপতি কেএম সোবহান, যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রাজপথের আন্দোলনেও সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে জামায়াত জানিয়ে দিয়েছিল তারা বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান কিছুই মানে না। নির্মূল কমিটি এ কারণে ২৯ ডিসেম্বর ‘ঘৃণা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে ২০০১ সাল পর্যন্ত, যতদিন গোলাম আযম জামায়াতের আমির ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমাদের আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’সহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ৭১টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত ঘোষণায় স্বাক্ষর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন জরুরী এবং কী ভাবে হবে সে বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করেছেন এবং দ্রুত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২৯ ডিসেম্বর এ ঘোষণা প্রদানের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল ঘৃণা দিবসের কারণে। জাতিকে আমরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি ১৯৯১-এর ২৯ ডিসেম্বর জামায়াত কী ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণা প্রদানের আগে দীর্ঘ দুই মাস অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় আমাদের বৈঠক হয়েছে। তখন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা মেনে নিলেও নিজেরা বিচারের উদ্যোগ গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন। জামায়াত যথারীতি বিচারের বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। আমাদের সমমনাদের কেউ কেউ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের কথা বলছিলেন, কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রচলিত আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। আমাদের ঘোষণায় এসব বিভ্রান্তি দূর করে ১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’-এর অধীনে কী ভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যায় সে বিষয়ে সরকার ও দেশবাসীকে স্বচ্ছ ধারণা দিতে চেয়েছিলাম। এ জটিল ও অস্বচ্ছ আইনী বিষয়টিকে স্বচ্ছতা প্রদানের ক্ষেত্রে যাঁর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি তিনি বিচারপতি কেএম সোবহান।
২০০৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ধানমন্ডির বিলিয়া মিলনায়তনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ৭১ সংগঠনের এ ঘোষণা প্রদান করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করুন।’ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও বিচারপতি কেএম সোবহান। প্রধান অতিথি ছিলেন সদ্য গঠিত ‘সেক্টস কমান্ডার্স ফোরাম’-এর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) একে খন্দকার বীরোত্তম। নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও এ ঘোষণা প্রদানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহিলা পরিষদের সভাপতি হেনা দাস, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান কর্নেল (অব) শওকত আলীসহ নাগরিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
৭১ সংগঠনের এ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘ সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা ও জামায়াতী বুদ্ধিজীবী ও সাবেক আমলা শাহ আবদুল হান্নান বলেছেনÑ ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে কোন যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি, দেশে কোন স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী নেই। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের লম্পট ও চোর আখ্যায়িত করে তারা যেসব বক্তব্য প্রদান করেছেনÑ সারাদেশ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। জামায়াত নেতাদের এসব চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, তারা এখনও ’৭১-এর অবস্থান থেকে সরে আসেননি, বাংলাদেশকে এখনও তারা পাকিস্তান মনে করেন। ’৭১-এ তারা যে ভাষায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিষোদগার করতেন এখনও তারা তাই করছেন।
’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান অমান্য করা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপহাস করা, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান লাঞ্ছিত করা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করা। আমাদের ইতিহাসে এবং সংবিধানে স্বাধীনতার যুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের কথা বলা হয়েছে, কোথাও বলা হয়নি তখন গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম লাইনেই বলা হয়েছে, আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি বাংলাদেশের সংবিধান মানতে অস্বীকার করে তার বিচার হওয়া উচিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে।’
ঘোষণায় এরপর জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য প্রমাণ উত্থাপন করে বলা হয় বঙ্গবন্ধুর সরকার কী ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছিলেন এবং জেনারেল জিয়া দালাল আইন বাতিল করে কী ভাবে সে বিচার বন্ধ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যেসব সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা কেউ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, এটা জাতির জন্য নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে অতীতে কোন সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়নি বলে বিচার তামাদি হয়ে গেছে কিংবা যুদ্ধাপরাধী বলে বাংলাদেশে কেউ নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনও তামাদি হয় না। ৬০-৬৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য খুঁজে বের করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর জামায়াতের শীর্ষ নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাই তখন তাদের গ্রেফতার ও বিচার সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল এবং সংবিধান সংশোধন করে তাদের দেশে ফেরার পথ সুগম করেছেন। এখন যেহেতু তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সংবিধানকে উপহাস করে বক্তৃতা বিবৃতি অব্যাহত রেখেছেন তাদের বিচার করা অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে জরুরী হয়ে উঠেছে।
‘৩১ অক্টোবর (’০৭) সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনভিপ্রেত।’ ১ নবেম্বর সকল দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর এ মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জামায়াত নেতাদের ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গোটা জাতি আবার ফুঁসে উঠেছে, যেমনটি আমরা দেখেছিলাম ’৯২-এ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূচনাপর্বে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিও আবার সর্বমহলে উচ্চারিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যুদ্ধাপরাধী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধিত না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনরোষে ভীত হয়ে জামায়াত নেতারা উন্মাদের মতো আচরণ করছেন।
‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারাদেশ যখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে তখন এ বিচার কী ভাবে হবে এ নিয়ে সুধীমহলেও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রতিদিন এ বিষয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন, ভাষ্য, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে, যেখানে অসাবধানবশত কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথাও বলা হচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত মন্তব্যে এবং বিভিন্ন টেলিভিশনের ‘টকশো’তে কোন কোন আইনজীবীও বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দুইভাবে শুরু হতে পারেÑ প্রথমতঃ সরকার বাদী হয়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু করতে পারেন, দ্বিতীয়তঃ বিদ্যমান ভুক্তভোগী বা সংক্ষুব্ধ কেউ তথ্যপ্রমাণ থাকলে আদালতেও যেতে পারেন। শেষোক্ত বক্তব্য আইনের দৃষ্টিতে সঠিক হলেও রাজনৈতিক বা অপরাধের গুরুত্বের বিবেচনায় যথাযথ নয় এবং তা প্রকৃত বিচারের অন্তরায়।
‘যুদ্ধের সময় সংঘটিত ‘গণহত্যা’, ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ প্রভৃতি সাধারণ অপরাধ বা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে অপরাধ নয়। এ অপরাধসমূহের চূড়ান্ত ভিকটিম হচ্ছে রাষ্ট্র, সরকার ও জনসাধারণ। গণহত্যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর আংশিক অথবা সম্পূর্ণ নির্মূলন। যুদ্ধের সময় ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্যাতন বা হত্যা হচ্ছে জাতি/সম্প্রদায়/গোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণের অন্তর্গত। একইভাবে জনপদ ধ্বংস, ব্যাপক হত্যা সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা বিপুলসংখ্যক মানুষকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করা ইত্যাদি সব কিছু যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্গত। ব্যক্তি আপাত ভিকটিম হলেও চূড়ান্ত ভিকটিম হচ্ছে জাতি ও গোষ্ঠী এবং সেই জাতি ও গোষ্ঠীর যদি কোন সরকার বা রাষ্ট্র থাকে তা-ও। ’৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর এবং ১০ এপ্রিল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদনের পর থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থা, পাকিস্তানী সংবিধান এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বাতিল হয়ে গেছে। এ কারণেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তার যে প্রতিনিধিরা ২৬ মার্চের পর বাংলাদেশে অবস্থান করছিল তারা দখলদার/হানাদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। এ দখলদার বাহিনীকে এদেশীয় যারা সাহায্য সহযোগিতা করেছে তারা দালাল বা কোলাবরেটর হিসেবে পরিচিত। যেকোন যুদ্ধে কোলাবরেটরদের কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করা হয়। জামায়াতে ইসলামী শুধু কোলাবরেটর ছিল না, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অংশ ছিল; তাদের দুজন নেতা মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ’৭১-এ তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।
’৭১-এ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে সহযোগিতা ও প্ররোচিত করার পাশাপাশি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের অপরাধ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি, কারণ তারা এদেশের নাগরিক। জামায়াতের আলবদররা লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, ডা. আলীম চৌধুরী ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো শ’ শ’ বরেণ্য ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে ধরে বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করেছে। জামায়াতের ঘাতক খালেক মজুমদার, আশরাফউজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনউদ্দীনদের সঙ্গে শহীদুল্লা কায়সার বা মুনীর চৌধুরীদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন বলেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। আলবদরের নেতারা পাকিস্তানী জেনারেলদের সঙ্গে বসে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করে হত্যা করেছে, যা ছিল গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অন্তর্গত। ঘাতকরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এ কারণেই এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে নয় রাষ্ট্রকে বাদী হতে হবে। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ট্রাইব্যুনালে যাবেন সাক্ষী হিসেবে। ১৯৭৩-এর ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্টে সরকারকেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা এবং বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষনেতার ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে সারাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে দাঁড়ানো অনভিপ্রেত, যখন সেনাপ্রধান বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া প্রয়োজন তখন এ সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা বলছেন অতীতে কোন সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, কেন বর্তমান সরকারকে তা করতে হবে, এ সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে ঘোষিত সময়ের ভেতর নির্বাচন সম্পন্ন করা।
‘এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছেÑ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকার যেসব রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারই অন্তর্গত। এ সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজনের প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার উদ্যোগ নিয়ে এ সরকার শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের ভোটাধিকার বাতিলের দাবি শুধু রাজনৈতিক দল বা নির্মূল কমিটির নয়, সর্বস্তরের জনগণ আজ এ দাবিতে সোচ্চার।’
৭১ সংগঠনের এ ঘোষণার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিবেচনা করে ২৯ ডিসেম্বর তারিখটি আমরা বেছে নিয়েছিলাম। কাকতালীয়ভাবে এর এক বছর পর ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে প্রধানতঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারের জন্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন চতুর্থাংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছে। পাঁচ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ২৯ ডিসেম্বর তারিখটি নির্বাচন করেছেন ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’র জন্য। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতাদের ভেতর অনেক ‘বীরোত্তম’, ‘বীরবিক্রম’, ‘বীরপ্রতীক’ মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন। তাদের অনেকে এখন বেঁচে নেই। যাঁরা আছেন তারা কোণঠাসা হয়ে গেছেন খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার কারণে। বিএনপির ক্ষমতাধর প্রবাসী নেতা খালেদা তনয় তারেক মনে করেন জামায়াত ও বিএনপি সহোদর ভ্রাতা। এ কারণে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাসহ জামায়াতের সকল অপরাধ ও সহিংসতার দায় স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। জামায়াতের যাবতীয় এজেন্ডা কার্যকরের দায়িত্ব এখন বিএনপি বহন করছে। যার ফলে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সভা সমাবেশ এবং সরকারের গণবিরোধী, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার যেকোনও দলের বা ব্যক্তির সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার। কিন্তু সে অধিকার অন্যের অধিকার হরণ করে, মানুষের জীবনজীবিকা বিপন্ন করে ভোগ করা যায় না। বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য যত কর্মসূচীই দিক না কেন মানুষ তাতে সাড়া দিচ্ছে না। এ কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচীর নামে সাধারণ মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়, সরকারী-বেসরকারী সম্পদ ধ্বংসসহ জননিরাপত্তা বিপর্যস্ত করা হয়, আঘাত করা হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ভিত্তিমূলে। জামায়াতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ও প্রতিহিংসার রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে এ সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকবে।
মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের চলমান আন্দোলনে বিচারপতি কেএম সোবহানের অবদান সব সময়ে উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো পথ প্রদর্শন করবে।

৩০ ডিসেম্বর ২০১৩

No comments:

Post a Comment