Wednesday, December 25, 2013

‘বাংলাদেশ দখল করতে হবে’: মুনতাসীর মামুন


পাকিস্তানের সাংসদ, মন্ত্রী, ক্রিকেট খেলোয়াড় ইমরান খান ও জামায়াতে ইসলামী আমাদের একটি বড় ধরনের উপকার করেছে। গত চল্লিশ বছর আমরা বলে এসেছি এবং নির্মূল কমিটি হওয়ার পর আরও জোরেশোরে যে- জামায়াত পাকিস্তানপন্থী একটি অপরাধী সংগঠন এবং মানবতাবিরোধী সংগঠন। এর নেতারা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটের সঙ্গে জড়িত। জিয়াউর রহমান তাদের সসম্মানে পুনর্বাসিত করে জাতির সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন, তিনি একজন অপরাধী। জামায়াত সব সময় দাবি করেছে, তারা এ ভূখ-ের অধিবাসী। হ্যাঁ, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবিশ্বাস করে না। ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা ও গণধর্ষণ হয়েছে তার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। শুধু তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তারা একটি আদর্শবাদী দল। আর ১৯৭১ সালে যেহেতু তারা কোনকিছুতে অংশগ্রহণ করেনি সুতরাং, তারা কেন অনুতপ্ত হবে। তাদের এ বক্তব্য অনেকে বিশ্বাস করেছে, বিশেষ করে বাচ্চা জামায়াতী ও বিএনপির ছেলেবুড়ো সবাই এবং তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ এক পয়সা দু’পয়সার ১৬টি দল।
কসাই কাদেরের ফাঁসিতে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা দিলে খুব চোট পেয়েছেন। তাদের হৃদয়ের ব্যথা উপশম করতে তারা ঢাকাসহ সারাদেশে নতুনভাবে আবার মানুষ হত্যা ও পোড়ানো শুরু করেছে। তারা গাড়ি পোড়াচ্ছে, বাস পোড়াচ্ছে। তাদের আক্রোশ এখন এত ভয়ঙ্কর যে, তারা পুরনো বৃক্ষ কেটে ফেলছে।
কসাই কাদেরের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ আরও হত্যাকাণ্ডের হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার প্রতি ফোঁটা রক্ত তাঁর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের জন্য অভিশাপ বয়ে আনবে। তাদের ধ্বংস অনিবার্য। তাদের করুণ পরিণতি দেশবাসী অতি শীঘ্রই প্রত্যক্ষ করবে। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণ এ হত্যার বদলা নেবে।’ [সংগ্রাম, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪২০]
কসাই কাদের যাদের হত্যা করেছে সেই বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কাদেরকে তারা এক সারিতে ফেলে ঘোষণা করেছে। সারাদেশে শনিবার তারা ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাসহ সকল শহীদের জন্য দোয়া অনুষ্ঠান’ করবে। [ঐ]
কসাই কাদেরের রায় কার্যকর হওয়ার পর তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭১ সালের ‘জখম’ বাংলাদেশ আবার উন্মুক্ত করেছে। কাদের ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিল দেখে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে অনেকের আদর্শ ক্রিকেটার ইমরান খান একই ধরনের কথা বলেছেন। কয়েকটি শহরে তার জন্য জানাজা পড়া হয়েছে। পাকিস্তান জামায়াতের প্রধান বলেছেন, ‘কাদের তো আমাদেরই [অর্থাৎ পাকিস্তানের] লোক। তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার জন্য বাংলাদেশের আরেকটি দল লড়াই করছে [অর্থাৎ বিএনপি]।
 বাংলাদেশে এখন অস্থিতিশীল অবস্থা। এ সুযোগে পাকিস্তানের উচিত হবে বদলা নেয়া। বাংলাদেশকে দখল করে নেয়া। পাকিস্তানের সিনেটও শোকপ্রস্তাব করেছে।
এর আগে, কসাই কাদেরকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তুরস্কের প্রেসিডেন্টও আবদার করেছেন। পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিবিদ কাদের মোল্লার আইডেনটিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জামায়াত থেকেও অবশ্য বলা হয়েছিল, এই কাদের সেই কাদের নয়।
জামায়াতে ইসলাম যে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশ শাখা তা জামায়াতের পাকি আমিরই বলেছেন। তিনি যেমন কাদেরকে পাকিস্তানের লোক বলছেন, তেমনি জামায়াতের লোকও বলছেন। তার জন্য গায়েবানা জানাজাও পড়ানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের জন্য ফাঁসি দেয়া হয়েছে তখন জামায়াতীরা যে পাকিস্তানী বাংলাভাষী তাও পরিষ্কার করা হয়েছে। আমরা জানি পাকিস্তানী হলেই অনবরত মিথ্যা বলতে হয়, জামায়াতী হলেও; এখনও সে ঐতিহ্য তারা বজায় রেখেছে।
কসাই কাদেররা, পাকিরা এখন বলে, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কারণে তার ফাঁসি হয়েছে সেটি ১০০ ভাগ মিথ্যা। বিএনপি বার বার ‘স্বচ্ছতা’, ‘আন্তর্জাতিক মান’ ইত্যাদি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সব সময় এবং এখনও বলে আসছে। সরকার বিরোধীদের আন্দোলন দমনের জন্য নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে দেশের ও বিদেশের কিছু মিডিয়া একই সুরে সুর মিলিয়েছে। এর একটি কারণ যে টাকা, তা বুঝতে জ্ঞানী হওয়ার দরকার হয় না। বাংলাদেশে গণহত্যার বিচার একটি বিষয় তুলে ধরেছে। বর্তমান সময়ে আদর্শ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। অর্থই হচ্ছে মূল আদর্শ। এ সব প্রতিবেদন, বিবৃতিতে সুশীল সমাজ, তরুণ ও অনেকে যে প্রভাবিত হন না, তা বলা যাবে না।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছে গণহত্যার রাজনীতিকরণ। গণহত্যা যখন রাজনীতির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন গণহত্যা তার প্রকৃত অর্থ হারায়। বিষয়টি লঘু হয়ে দাঁড়ায়। লঘু হলে দণ্ড লঘু হতে পারে, দণ্ড নাও হতে পারে। গণহত্যা না থাকলে ১৯৭১ থাকে না। ১৯৭১ না থাকলে জামায়াতকে কিভাবে দোষী করা যায়? ১৯৭১ না থাকলে পাকিস্তানে একজন কাদের বা সাকাচৌ তো পাকিস্তানী হয়েই থাকে, তাহলে তার বিচার হবে কেন?
সম্প্রতি হাইডেলবার্গে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে। এখানে যাঁরা বক্তব্য রেখেছেন তাঁরা দ্রাবিড় নন, ককেশীয়। আমাদের সুশীল বাটপাড়রা বা রাজনৈতিক নেতারা দ্রাবিড়দের থেকে ককেশীয়দের কথায় বেশি গুরুত্ব দেন। মফিজুল হক প্রমুখের সম্পাদনায় সম্মেলনের কার্যবিবরণী প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ব্রাসেলসের সাউথ এশিয়া ডেমোক্র্যাটিক ফোরামের পরিচালক পাওলো কাসাকা একটি প্রবন্ধে এ বিষয়টি আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের গণহত্যায় নিহতের সংখ্যাটি এখন স্বীকৃত। কেউ এ নিয়ে তেমন কথা তোলেনি। বিষয়টি লঘু করার জন্য বিরোধীরা যা বলেছে তাতে সহায়তা করেছে পাকিস্তান, আমেরিকা ও চীন; যাদের তিনি ‘বিষষ well determined quarters’ বলেছেন। এখন এটি বেশ চলতি হয়ে উঠছে এবং ২০১০ সালের পর এটি পরিণত হচ্ছে একটি ‘Vast movement of dinial’-এ। বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ পড়ছে এবং যারা গণহত্যা চালিয়েছে তারা ‘violent action’s’-এ যাচ্ছে। তাদের যুক্তি তিনটি-
১. আদালতের লক্ষ্য রাজনৈতিক, কেননা যারা অভিযুক্ত তারা রাজনৈতিক দলের সদস্য। [লক্ষ্য করবেন বিবিসি, আল জাজিরাসহ সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অপরাধীদের রাজনৈতিক দলের সদস্য অথবা বিরোধী ইসলামী নেতা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে]।
২. গণহত্যার সংখ্যা, গণহত্যার উদ্দেশ্য, সংঘাতের প্রকৃতি এ সবই কিন্তু এতদিন ছিল ‘বিষষ বংঃধনষরংযবফ’. এখন এগুলোকেই বিতর্কিত করে তোলা হচ্ছে। [আমাদের অধিকাংশ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় টকশোতে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে বিতর্কিত করে তোলার জন্য জামায়াত-বিএনপিপন্থীদের নিয়ে আসা হয়। এর একটি উদ্দেশ্য তাদের পলিটিক্যাল স্পেস করে দেয়া। দুই, গণহত্যাকে লঘু করে তোলা]।
৩. এত বছর পর এ ধরনের বিচার সমীচীন নয়।
পাওলো লিখেছেন, ২ ও ৩ নম্বর যুক্তি সব জেনোসাইড রিভিলিনিস্টরাই দেয়। হলোকাস্টের বিরুদ্ধে যারা বলে তাদের যুক্তিও এরকম। তবে প্রথম যুক্তিটি একটু ভিন্ন ধরনের।
এই ভিন্নতার কারণ হচ্ছে অবস্থার পরিবর্তন। হলোকাস্ট যারা ঘটিয়েছে তাদের ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে গণহত্যাকারীরা শুধু ক্ষমতায় আসেনি, একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে। [উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাশিম আলী মার্কিন এক লবিস্ট ফার্মকে প্রথম কিস্তিতে ২৫০ কোটি ডলার দিয়েছে। এটি শুধু একটি কিস্তির হিসাব]। এ কারণে, তাদের অতীত তদন্ত করতে গেলে বলা হচ্ছে বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়াটিই রাজনৈতিক। পাওলো জোরাল ভাষায় জানাচ্ছেন, কূটনৈতিকভাবে, বিরুদ্ধ মিডিয়া ও উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সখ্যের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর একটি প্রচারণা চালাচ্ছে। [This argument was supported in an overwhelming diplomatic campaign, other than the direct pressure of states, a bruttac publicity campaign was done through opposition friendly media and certain high-level associations]
পাওলো এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ইকোনোমিস্ট’ এবং হিউম্যান রাইটসের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরাও দেখেছি প্রায় প্রতিসপ্তাহে ইকোনোমিস্ট শেখ হাসিনা, তাঁর সরকার ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বিকৃত সব প্রতিবেদন ছাপাচ্ছে। হিউম্যান রাইটস বিবৃতি দিচ্ছে- পাওলো বলছেন, বিএনপির এক নেতার বিবৃতিকে অবলম্বন করে রাজনীতির সঙ্গে মানবাধিকার মিশিয়ে, তার পর অন্যদের একই কারণে অভিযুক্ত করছে। তাদের একটি প্রেস রিলিজের উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি-
‘Bangladesh : Upgrade War Crimes Law Failure to Meet International Standards could undermind credibility of Trials for 1971 Atrocities.’ লক্ষ্য করুন গণহত্যা বা জেনোসাইট হয়ে গেল এ্যাট্রোসিটিস। যেমনি ২৫ মার্চ মধ্যরাতের গণহত্যা বাংলাদেশে অনেকে প্রবল পিটুনি বা গ-গোল বলে উল্লেখ করেন। পাওলো লিখেছেন, ‘That an organisation which was supposed to fight impunity and to act independently on behalf of human rights does exactly the opposite in perhaps the biggest drama of our present times.’
একইভাবে আমাদের দেশেও গণহত্যার রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে এ কারণে যাতে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক সুবিধা হয়। লক্ষ্য করবেন, একদল সুশীল বাটপাড় ও সুশীল সংস্থা যেমন সুজন ইত্যাদি প্রায় নির্বাচন নিয়ে আমাকে সবক দেয় যেন আমরা নাবালক। এই নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়কের নয়, এটি আদর্শগত হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি তারা উল্লেখ করেন না। তত্ত্বাবধায়ক সুপ্রীমকোর্ট বাতিল করেছে, তা আর কখনও সংবিধানে আনা যাবে না এটি কি তারা বোঝেন না? বোঝেন। নাহলে বিদেশী পয়সায় সংস্থা [এনজিও] চালান কিভাবে? আন্দোলন ও সন্ত্রাসের তারা পার্থক্য বোঝেন না? শিশু নয় যে তারা নাক টিপলে দুধ বের হবে। এই যে গত এক মাসে জামায়াত-বিএনপি ২০০ লোক হত্যা করল, পুড়িয়ে মারল, কত পরিবারের সর্বনাশ করল, একজনও প্রতিবাদ জানিয়েছে। এত যে মানবাধিকার সংস্থা, একজনও প্রতিবাদ জানিয়েছে? জানায়নি। বরং, তারা ‘একদলীয় নির্বাচন’ ‘গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর’ ইত্যাদি বলে পত্রিকা ভরে ফেলেছেন, টিভিতে আর্তনাদ করেছেন। লক্ষ্য একই- যুদ্ধাপরাধী ও তার সমর্থকদের স্পেস করে দেয়া। এ দেশে কেউ কখনও এ সব উচ্চকণ্ঠ সুশীল বাটপাড়কে জিজ্ঞেস করেননি, যুদ্ধাপরাধী ও তার সমর্থকরা নির্বাচনে না এলে ক্ষতি কী? গণতন্ত্র কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়? আসলে ওই যে একমাত্র বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় আনা হয়েছে, আর্থিক ভিত্তি দেয়া হয়েছে। এরা তার বেনেফিশিয়ারি। প্রভুর জন্য তাদের হা-হুতাশ করতেই হয়।
পাকিস্তান সরকার এই একই প্রক্রিয়ায় গণহত্যার রাজনীতিকরণ করতে চাচ্ছে। কারণ তারা এর জন্য দায়ী। এই মুসলিম লীগ [যারা এখন ক্ষমতাসীন] ও জামায়াতই তো পাকিস্তানী সেনাদের হয়ে গণহত্যা চালায়। কাদের মোল্লা কেন কসাই কাদের মোল্লা তার কারণ কি তারা জানে না? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বলা উচিত ছিল কাদের মোল্লাদের যেহেতু তারা তাদের দেশের নাগরিক মনে করে সুতরাং, তাদের বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যাক। বাংলাদেশের মানুষের এখন সিদ্ধান্তে আসা উচিত, পাকিস্তানীদের এখানে রাজনৈতিক দল করতে দেয়া উচিত কিনা? পাকিস্তানীদের এখানে ভোটাধিকার দেয়া উচিত কিনা? এ কথা আজ পরিষ্কারভাবে সবাইকে জানানো উচিত যে, জামায়াতকে যে সমর্থন করবে, সে পাকিস্তানকেই সমর্থন করছে।
পাকিস্তানীরা বলছে [সরকার] যে, কসাই কাদেরের ফাঁসি জুডিসিয়াল মার্ডার। এরা কখনও বলার সাহস রাখে না যে, ভুট্টোর ফাঁসি ছিল জুডিসিয়াল মার্ডার। কারণ, সেটি সেনাবাহিনী করেছিল। তারা জানে যে, সেনারা তাদের বেয়নেটের ওপর বসিয়ে রাখবে। বাংলাদেশ তো তা করতে পারবে না। কারণ, সেখানে তাদের মানুষজনও প্রচুর।
কোন্ জুডিসিয়াল মার্ডার? কারণ, একজন বিরোধী ‘ইসলামী’ নেতা হিসেবে তাকে হেনস্থা করা হয়েছে। পাকিস্তান সমর্থন রাজনীতির অংশ। কিন্তু আপনারা সবাই জানেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল তাতে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য নামে কোন অভিযোগ ছিল না। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো একবার বিবেচনা করে দেখুন। ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে কলেজছাত্র পল্লবকে দু’দিন মিরপুরে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল কাদের, তারপর হত্যা করা হয়েছিল। এ অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সন্দেহাতীতভাবে। ২৭ মার্চ কাদের ও তার বিহারী সহযোগীরা কবি মেহেরুননেসার বাড়িতে ঢুকে তাঁকে, তাঁর মা ও দুই ভাইকে হত্যা করে। মেহেরুননেসার মাথা কেটে ঝুলিয়ে রাখে। এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ২৯ মার্চ পয়গামের সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের জল্লাদখানায়। আবু তালেবের মেয়ে জানিয়েছেন, কোরবানির গরুর মতো তালেবকে জবাই করে মাংসগুলো টুকরো টুকরো করে উল্লাসে তারা মেতে ওঠে। এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কাদের মিরপুরের হযরত আলী লস্কর ও তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করে ও ১১ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে। এই অভিযোগও প্রমাণিত। ২৪ এপ্রিল মিরপুরে আলোকদী গ্রামে ৩৪৪ জনকে নির্যাতন করে খুন করে। মামা বাহিনীর শহীদুল হক মামা জানিয়েছেন, আজলা ভরে মানুষের চোখ তিনি সমাহিত করেছেন। এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। প্রমাণিত হয়নি ঘাটের চরের গণহত্যায় কাদেরের ইনভলভমেন্ট।
সুপ্রীমকোর্ট সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে বিবেচনা করেছে এবং সবগুলোর জন্যই সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্য বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু একজনকে তো বার বার ফাঁসি দেয়া যায় না সেজন্য একটি অভিযোগের কারণেই ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে। এখানে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কোন প্রশ্নই আসেনি। একজনকে খুন করলে ফাঁসি হতে পারে আর ৩৫৫ জনকে খুন করলে ফাঁসি হবে না এটি কী ধরনের লজিক? যে পাকিস্তান জুডিসিয়াল মার্ডারের কথা বলছে সেই পাকিস্তানে হরদম ‘পঞ্চায়েত’ বসিয়ে মানুষজকে খুন করা হচ্ছে কোন বিচার না করেই।
অর্থাৎ পাকিস্তান সরকার যা বলেছে তা মিথ্যা। একই ধরনের মিথ্যাচার করছে জামায়াত এবং হ্যাঁ, আপনাদের কষ্ট লাগতে পারে বিশেষ করে বিএনপির এ্যাপোলজিস্টদের। যে বিএনপিও একইভাবে মিথ্যাচার করছে এবং এ্যাপোলজিস্টরা ‘প্রধান বিরোধী দল’ বলে তাদের রাজনৈতিক স্পেস দেয়ার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানীদের প্রতিক্রিয়ায় খুব আনন্দিত হয়েছি। এক. তারা যা বলছে তার সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির বক্তব্য ও অবস্থানের মিল আছে। দুই. ১৯৭১ সালের পরাজয়ের বেদনা জামায়াত, মুসলিম লীগ বা পাকিস্তানী এসটাবলিশমেন্ট এখনও ভুলতে পারেনি। একইভাবে বাংলাদেশের জামায়াত ও বিএনপি ও সেই ‘হিউমিলিশিয়েন’ বা পরাজয়ের খাদ ভুলতে পারেনি এবং সেই একই কারণে দুটি দল মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
আমরা জামায়াতকে মানবতাবিরোধী অপরাধীর দল বলি বা যুদ্ধাপরাধীদের [চলতি জনপ্রিয় শব্দ] দল বলি। কিন্তু বিএনপিকে বলি না। গণজাগরণ মঞ্চ যা নিয়ে সবাই আশাবাদী তারা জামায়াতের নাম ধরে সেøাগান দেয় বটে; কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে চুপ। আমাদের বন্ধুরা, একই ফ্যাদর্শের বন্ধুরাও অবলীলাক্রমে জামায়াতকে গালাগাল করেন বিএনপির কথা এলেই নিশ্চুপ। এর কয়েকটি কারণ আছে বলে আমার মনে হয়।
এক. জামায়াত ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছে, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। সুতরাং জামায়াতের বিরুদ্ধে সবাই বলে, নিজে বললে অসুবিধা নেই। তা ছাড়া প্রগতিশীল বলে চিহ্নিত হওয়া যায়।
দুই. বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধীদের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে তারেক রহমান পর্যন্ত সব সময় বিএনপি তাদের সমর্থকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ধনী বানিয়েছে। ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া অনেক কিছু তারা নিয়ন্ত্রণ করে। বিপরীত মতাদর্শের অনেকে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করেছেন, ব্যবসা করেছেন। যেমন এই আমলে আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী ও নেতারা প্রায় ক্ষেত্রে বিএনপির মানুষজনকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে, শোনা যায় অর্থের বিনিময়ে। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সেøাগান দিলেও এ ধরনের সম্পর্ক অটুট। সেজন্য বিএনপিকে কোন কারণে তারা অভিযুক্ত করতে চায় না।
তিন. আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি গ্রাম্য মোড়লী ভাব আছে। গ্রামের সালিশীর মাতব্বরের মতো। ভাবটা এ রকম এসো হে, ঝগড়া-ফ্যাসাদ হয়েছে, আচ্ছা মিটমাট করে দিচ্ছি। তার পর সালিশী শেষে পান চিবুতে চিবুতে ঘরে ফেরা। বিএনপি কিন্তু তা নয়। তারা আমেরিকার মতো। কে কখন কী বলেছে, কী করেছে তারা তা রেকর্ড করে রাখে এবং সময়মতো শোধ নেয়। যেমন, নাজমুল হুদা ১৯৯১ সালে মন্ত্রী হয়েই শাহরিয়ার কবিরকে চাকরিচ্যুত করে কেননা, বিচিত্রার শাহাদাত চৌধুরী ও অন্যরা যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তার সঙ্গে তাঁর বনাবনি হয়নি। নাজমুল হুদা কোর্টকাছারি, প্রতিবাদ কোন কিছুই গ্রাহ্য করেননি। আমি অনেকবার ভেবেছি ২০০২ সালে কেন খালেদা-নিজামী আমাকে শাহরিয়ার কবির বা সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেফতার করল? পরে মনে হলো, ২০০১ সালের নির্বাচনে যে প্রবল রকম কারচুপি করেছে সেনাবাহিনী, এ নিয়ে আমি এবং শাহরিয়ার কবির প্রথম বিবৃতি দেয়ার উদ্যোগ নিই। এর আগে তারা যে এথনিক ক্লিনজিং করছিল তার প্রতিবাদের উদ্যোগও আমরা এবং নির্মূল কমিটি নিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত তা ভোলেনি। এ ছাড়া, আমরা তো সব সময় জামায়াতবিরোধিতা করেছিও। সাবের ছিলেন আওয়ামী লীগের উদীয়মান নেতা, ভাল ইমেজের, যার কারণে মির্জা আব্বাস সুবিধা করতে পারছিলেন না। মির্জার সুবিধার জন্য সাবেরকেও হেনস্থা করা দরকার ছিল। তাই এক সঙ্গে আমাদের গ্রেফতার করেছিল। আওয়ামী লীগ এসব কখনও মনে রাখে না বরং পারলে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক করে এবং এখনও করছে। খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, সংবাদকর্মীরা কখনও খালেদা জিয়াকে কোন প্রশ্ন করার সাহস রাখে না।
চার. অনেকের ধারণা, জামায়াত-বিএনপিকে আলাদা করতে পারলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধা হয়। এটি যারা বলে তাদের মূর্খ বলব না, কারণ, আমরা কেউ-ই মূর্খ নই, তবে জ্ঞানপাপী বটে। এ তত্ত্বের ধারকরাও একদিক থেকে বিএনপি এ্যাপোলজিস্ট। বিএনপি-জামায়াত আলাদা হতে পারে না আদর্শগত কারণে, এখন তো আরও পারবে না, কারণ তারা একত্রে না থাকলে অচিরেই তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। একজন জামায়াতী কখনও ১৪ দলীয় কাউকে বা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। মৃত্যু হলেও। এটি তাদের কমিটমেন্ট, যে কমিটমেন্ট এ আমলের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে নেই। তবে মূল কারণ, পেশী এবং অর্থের কারণে বিএনপির বিরুদ্ধে সরাসরি কেউ বলতে চায় না এবং যেহেতু বড়লোক ও মধ্যবিত্তরা অনেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে যুক্ত নানা কারণে, তারা বিএনপির বিরুদ্ধে কিছু বলতে বিব্রতবোধ করেন। সত্যের মুখোমুখি হওয়া আসলেই কঠিন।
জামায়াতের নেতৃত্বে যদি মানবতাবিরোধী অপরাধীরা থেকে থাকে এবং সে কারণে তাদের যুদ্ধাপরাধীদের দল বা মানবতাবিরোধী অপরাধীর দল বলি, তাহলে একই অভিধায় বিএনপিকেও ভূষিত করতে হবে। বিএনপির বড় নেতা, স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকাচৌ এখন অভিযুক্ত। বিএনপির এক সময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতা এখন অভিযুক্ত। তা হলে?
বিএনপি যেভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সমর্থন করেছে সে উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। এ ধরনের অনেক বিরল ঘটনা ঘটিয়েছে বিএনপি। যেমন, বেতারবার্তা পাঠকারী একজন তাদের স্বাধীনতার ঘোষক। এটি নাকি ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দল।’ পৃথিবীতে এমন উদাহরণ নেই যে একজন নাকি পার্টি করে আর বাইরে বলে সে গণতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট। পরাজিত এবং দেশবিরোধী শক্তি/দলকে ক্ষমতায় এনে বসানোর নজিরও পৃথিবীতে নেই। যে আমেরিকা তাদের সমর্থক তারাও নিজেদের দেশে এ ধরনের দলকে রাজনীতি করতে দিত না।
বিএনপি-জামায়াতের আদর্শগত মিলটা কোথায়? জেনারেল জিয়া যখন ক্ষমতায় আসেন তখন বেছে বেছে কেন শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকগুলো নষ্ট করলেন সে প্রশ্ন কেউ করেন না এবং করলেও উত্তর দেন না।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথম যে কাজটি করেন, তা হলো জেলহত্যা তদন্ত কমিটি বাতিল। মোশতাক ৫ নবেম্বর জেলহত্যা তদন্ত কমিটি করেছিলেন। জিয়ার চাপে পড়ে ৯ তারিখ সে কমিটি বাতিল করা হলো কেন? হয় তিনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন অথবা যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের রক্ষা করা যা পরোক্ষভাবে নিজেকে জড়িত করা।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জিয়ার মন্ত্রিসভায় যাঁরা ছিলেন তাঁদের ৩১ জন ছিলেন দলছুট। এই দলছুটদের মধ্যে ১৯ জন ছিলেন বাংলাদেশবিরোধী অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি।
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এক সামরিক ফরমানের মাধ্যমে জিয়া সংবিধানের ৬৬ ধারার একটি উপধারা ও ১২২ ধারা বিলুপ্ত করান, যার ফলে পাকিস্তানী দালালরা ভোটার হওয়ার সুযোগ পেল। ৩৮ ধারায় সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দলসমূহের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের মে মাসে তা বাতিল করা হয় যাতে জামায়াত, মুসলিম লীগ ইত্যাদি রাজনীতি করার সুযোগ পায় এবং পাকিস্তানী মানস বিস্তৃত করতে পারে।
সংবিধানের মূল উপাদানগুলো তিনি বাতিল করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের শুধু ইনডেমনিটি নয়, বড় পদ দিয়ে বিদেশ পাঠান। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত না থাকলে এটি কেন করা হবে? তিনিই ত্রাস রাজাকার আলবদরদের মন্ত্রী করলেন।
আজ প্রায়ই একটি কথা বলা হয়, খালেদা-নিজামীর আসন থেকে যে, মুক্তিযুদ্ধপন্থী সবার হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর গাড়িতে দেশের পতাকা উড়ছে দেখে। হৃদয় ভেঙ্গে গেলেও জোরালো প্রতিবাদ কোন সুজন সুশীল বা প্রগতিশীল/মুক্তিযুদ্ধপন্থীরা করেননি। কিন্তু খালেদাকে দোষী করা কেন? ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান প্রথম আলবদর, রাজাকারদের গাড়িতে, বাড়িতে পতাকা তুলে দেন। এ কথা আমরা বলা দূরের কথা, স্মরণ করতেও চাই না। কারণ, আমাদের অনেকেই তা সমর্থন করেছিল।
জিয়াউর রহমান যা করেছিলেন তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তিনি বীতরাগ ছিলেন। এর কারণ, তিনি বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। পাকিস্তানী সংস্কৃতিতে মানুষ, যিনি বাংলা প্রায় লিখতে পারতেন না তাঁকে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দিলে তাঁর কেমন লাগে? তখনকার নেতৃত্ব এটি বুঝেছিলেন দেখে তাঁকে একজন সেক্টর কমান্ডারও করেননি। এমনকি বাংলাদেশে সেনাপ্রধানও করতে চাননি। জিয়া তাতে আরও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ঐ ক্রোধের ফল বিএনপি। আর ভালবাসার ফল স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আদর্শগত ঐক্য।
বেগম জিয়া স্বামীর আদর্শই শুধু অনুসরণ করেছেন। তিনি এই কারণে যাঁরা গোলাম আযমের বিচার চেয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছেন। ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে নিজের দলকে এমনভাবে মিলিত হয়েছিল যে, তাঁর পুত্র তারেক মোল্লাকে বলেছিলেন, জামায়াত একই বৃন্তে দুটি ফুল। সুতরাং জামায়াতকে লাঞ্চিং ব্যাগ করব বিএনপিকেও নয়- তা শুধু এক ধরনের ফ্যালাসি নয়, সুবিধাবাদ এবং বিএনপিকে রাজনৈতিক স্পেস দেয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়া মাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘আন্দোলন’ করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি নেতৃবৃন্দ বুঝেছিলেন, এই ট্রাইব্যুনাল দীর্ঘস্থায়ী হলে তাদের অনেককেও অভিযুক্ত হতে হবে। জামায়াতের অনেক নেতা দ-িত হবেন। জামায়াত শুধু দুর্বল নয়, ঘৃণিত দল হিসেবে পরিগণিত হবে। তা হলে বিএনপির রাজনৈতিক সুবিধা ক্ষুণœ হবে। আর জামায়াত তো অভিযুক্ত। তারা ১৯৭১ সালের মতো হত্যা লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করবে তাতো জানা কথাই। সুতরাং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টির যাতে রাজনীতিকরণ করা যায়, এর গুরুত্ব যাতে কমে যায় এবং এক ধরনের ‘আন্দোলনের’ ঢেউ যদি তোলা যায় তা হলে মানুষ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবে না। যতই অপরাধীদের রায় দেয়া হতে লাগল বা অন্য কথায় ট্রাইব্যুনালের গতি বাড়ল ততই বিএনপি-জামায়াতের ‘আন্দোলনের’ তীব্রতা বাড়তে লাগল।
বিএনপি কি জানে না তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর সংবিধানে আনা যাবে না। বিলক্ষণ জানে। কারণ দলটির নেতৃত্বে অনেক আইনজীবী আছেন। সুতরাং, যা আনা যাবে না তা নিয়ে কেন আন্দোলন করছেন। খুব অবাক হই যখন ড. কামাল হোসেনের মতো আইনজ্ঞও বলেন, একটি সংশোধনী করলেই ব্যাপারটি মিটে যায়। যে কোন সংসদ এ ধরনের সংশোধনী আনলে তা বাতিল হতে বাধ্য। বিএনপি এটি জানে, তাই সে জামায়াতের সঙ্গে এই আন্দোলন করছে নিজের এবং জামায়াতের কারণে।
শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি কখনও যুদ্ধাপরাধের নিন্দা জানায়নি, ট্রাইব্যুনালকে সমর্থন জানায়নি বরং সব সময় বিচার ও ট্রাইব্যুনালকে অভিযুক্ত করেছে। কসাই কাদেরের রায়ের পর খালেদা জিয়া কী বলেছেন সেটি দিয়েই শুরু করা যাক এ পর্ব।
‘বাংলাদেশ দখল করতে হবে’
মুনতাসীর মামুন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর বেগম জিয়া বলেছেন, এ দেশে “স্বাধীন বিচারব্যবস্থার স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে” (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৩-১২-২০১৩)।
খালেদা জিয়ার ‘চিন্তা ট্যাংকি’র সদস্যরা আরও জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন। আমি নিশ্চিত এসব বক্তব্যের অধিকাংশ আপনাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। কিছু কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, দীর্ঘ হলেও, এ কারণে যে, যুদ্ধাপরাধ বিচার যে তাদের মধ্যে কী জ্বালার সৃষ্টি করেছে এবং বিএনপি যারা করে তাদের প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য।
সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর পরই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কাদের কসাই মারা গেছে। এখন কাদের মোল্লাকে কাদের কসাই সাজিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অথচ এই কাদের মোল্লা ’৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ইসলামী আন্দোলন করার কারণে তাকে জোর করে হত্যা করতে চায় সরকার। তিনি আদালতের রিভিউ আবেদন খারিজ করার সমালোচনা করে বলেন, এখন সরকার ও আদালত একাকার হয়ে গেছে। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকারকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশকে ধ্বংস করার এসাইনমেন্ট পালন করছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, ভয় পাওয়ার দিন শেষ। এখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময়। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ আন্দোলন চলবে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত (সংগ্রাম ১৩-১২-২০১৩)।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, “দেশে নাগরিকদের কোন অধিকার নেই। মানবাধিকার সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণের ওপর চেপে বসেছে। গণআন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে হবে।
বর্তমান সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ উল্লেখ করেন বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব ড. পিয়াস করিম। তিনি বলেন, দেশের ইতিহাসে এমন নিপীড়নকারী সরকার আর ছিল না। রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে লুণ্ঠন করেছে।” [ঐ]
সাবেক সচিব সোলায়মান চৌধুরী বলেন, “৭১ সালে কাদের মোল্লা ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা করতেন। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ’৭২ সালে ঢাকায় আসেন। অথচ তাকে ’৭১ সালে মিরপুরের ঘটনায় জড়িয়ে জোর করে অপরাধী বানানো হচ্ছে। একজন নাগরিক হিসেবে তার জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। অন্য নাগরিকরাও একই শঙ্কায় রয়েছেন। নাগরিকদের জীবন রক্ষায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে রাজপথে নেমে আসতে হবে।” [ঐ]
এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, জাতিসংঘ বলেছে, বাংলাদেশে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। এ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশী। কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশন খারিজ করে আদালত তাই প্রমাণ করেছে। অথচ আন্তর্জাতিক আদালতে রিভিউ করার সুযোগ দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ’৭১ সালে কাদের মোল্লা নামে কারও নাম শুনিনি। তাকে ‘কসাই কাদের’ সাজিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি আরও বলেন, সরকার জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর মতো যুদ্ধ করছে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত অভিলাষের কারণে দেশ আজ চরম সঙ্কটে। তিনি আরও বলেন, কাদের মোল্লা একজন নিরপরাধ ও সহজ সরল মানুষ। গায়ের জোরে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাঁকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চেষ্টা চলছে। ঢাকার মিরপুরের ‘কাদের কসাই’ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই মারা গেছে। অথচ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে কাদের মোল্লাকে ঝুলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সরকার বিচারালয় শেষ করে দিয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, সীমা লঙ্ঘনকারীদের আল্লাহ ধ্বংস করে দিবেন।” [ঐ]
বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের গুরু, খন্দকার মাহবুব এর আগে বলেছেন, যারা এ বিচার করছে তাদের সবার বিচার হবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পাকিস্তান সরকার, পাকিস্তানের কিছু রাজনৈতিক দল এবং জামায়াত যে বক্তব্য দিয়েছে তার সঙ্গে আশ্চর্য মিল আছে জামায়াত ও বিএনপির বক্তব্যের। শুধু একটি অমিল আছে। তাহলো, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জামায়াত নেতৃবৃন্দ কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ বলে উল্লেখ করেছেন, বিএনপি নেতৃবৃন্দ শুধু ‘শহীদ’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন।
‘শহীদ’ শব্দের একটি ধর্মীয় অনুষঙ্গ আছে। ‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁরা বলতে চান, কসাই কাদের ধর্মের জন্য ত্রাণ দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, একজন যে প্রায় ৪০০ খুনের সঙ্গে যুক্ত, ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত তিনি ধার্মিক হন কোন সুবাদে? কোন ধর্ম খুন ধর্ষণ সমর্থন করে? আর কসাই কাদেরকে বিচার করে দ- দেয়া হয়েছে এবং সে কার্যকর হয়েছে। এখানে তো লুকোছাপার কোন ব্যাপার নেই। হত্যারও ব্যাপার নেই। তাঁরা আসলে কসাই শব্দটির বদলে শহীদ শব্দটি প্রতিষ্ঠা করতে চান, যা এক ধরনের রাজনীতিকরণ।
বিএনপির যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের মূল বক্তব্য কসাই কাদেরের বিচার ন্যায়সঙ্গত হয়নি এবং এ কাদের কসাই কাদের নয়। পাকিস্তানীরাও তাই বলেছিলেন, শুধু তাই নয়, জামায়াতীরা এ কথাও বলছেন যে নকল মোমেনার সাক্ষ্যে হয়েছে মোল্লার মৃত্যুদ-। [ঐ]
এ সব বক্তব্যের ভিত্তি দুটি বিষয় এক. উদ্দেশ্যমূলক; দুই. আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটি না পড়া। প্রথম থেকেই এ দুটি দল থেকে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে সে কারণে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য সব সময় রাখা হয়েছে। যেমন, প্রথমে বলা হয়েছে, নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে বিচারের কথা বলা হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে বিচার হবে। ট্রাইব্যুনাল হলে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল হলে কী হবে গ্রেফতার তো হবে না। গ্রেফতার হলে বলা হয়েছে জামায়াত-বিএনপিকে চাপে রাখার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। 
কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর বেগম জিয়া বলেছেন, এ দেশে “স্বাধীন বিচারব্যবস্থার স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে” (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৩-১২-২০১৩)।
খালেদা জিয়ার ‘চিন্তা ট্যাংকি’র সদস্যরা আরও জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন। আমি নিশ্চিত এসব বক্তব্যের অধিকাংশ আপনাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। কিছু কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, দীর্ঘ হলেও, এ কারণে যে, যুদ্ধাপরাধ বিচার যে তাদের মধ্যে কী জ্বালার সৃষ্টি করেছে এবং বিএনপি যারা করে তাদের প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য।
সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর পরই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কাদের কসাই মারা গেছে। এখন কাদের মোল্লাকে কাদের কসাই সাজিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অথচ এই কাদের মোল্লা ’৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ইসলামী আন্দোলন করার কারণে তাকে জোর করে হত্যা করতে চায় সরকার। তিনি আদালতের রিভিউ আবেদন খারিজ করার সমালোচনা করে বলেন, এখন সরকার ও আদালত একাকার হয়ে গেছে। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকারকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশকে ধ্বংস করার এসাইনমেন্ট পালন করছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, ভয় পাওয়ার দিন শেষ। এখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময়। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ আন্দোলন চলবে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত (সংগ্রাম ১৩-১২-২০১৩)।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, “দেশে নাগরিকদের কোন অধিকার নেই। মানবাধিকার সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণের ওপর চেপে বসেছে। গণআন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে হবে।
বর্তমান সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ উল্লেখ করেন বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব ড. পিয়াস করিম। তিনি বলেন, দেশের ইতিহাসে এমন নিপীড়নকারী সরকার আর ছিল না। রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে লুণ্ঠন করেছে।” [ঐ]
সাবেক সচিব সোলায়মান চৌধুরী বলেন, “৭১ সালে কাদের মোল্লা ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা করতেন। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ’৭২ সালে ঢাকায় আসেন। অথচ তাকে ’৭১ সালে মিরপুরের ঘটনায় জড়িয়ে জোর করে অপরাধী বানানো হচ্ছে। একজন নাগরিক হিসেবে তার জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। অন্য নাগরিকরাও একই শঙ্কায় রয়েছেন। নাগরিকদের জীবন রক্ষায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে রাজপথে নেমে আসতে হবে।” [ঐ]
এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, জাতিসংঘ বলেছে, বাংলাদেশে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। এ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশী। কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশন খারিজ করে আদালত তাই প্রমাণ করেছে। অথচ আন্তর্জাতিক আদালতে রিভিউ করার সুযোগ দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ’৭১ সালে কাদের মোল্লা নামে কারও নাম শুনিনি। তাকে ‘কসাই কাদের’ সাজিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি আরও বলেন, সরকার জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর মতো যুদ্ধ করছে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত অভিলাষের কারণে দেশ আজ চরম সঙ্কটে। তিনি আরও বলেন, কাদের মোল্লা একজন নিরপরাধ ও সহজ সরল মানুষ। গায়ের জোরে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাঁকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চেষ্টা চলছে। ঢাকার মিরপুরের ‘কাদের কসাই’ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই মারা গেছে। অথচ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে কাদের মোল্লাকে ঝুলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সরকার বিচারালয় শেষ করে দিয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, সীমা লঙ্ঘনকারীদের আল্লাহ ধ্বংস করে দিবেন।” [ঐ]
বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের গুরু, খন্দকার মাহবুব এর আগে বলেছেন, যারা এ বিচার করছে তাদের সবার বিচার হবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পাকিস্তান সরকার, পাকিস্তানের কিছু রাজনৈতিক দল এবং জামায়াত যে বক্তব্য দিয়েছে তার সঙ্গে আশ্চর্য মিল আছে জামায়াত ও বিএনপির বক্তব্যের। শুধু একটি অমিল আছে। তাহলো, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জামায়াত নেতৃবৃন্দ কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ বলে উল্লেখ করেছেন, বিএনপি নেতৃবৃন্দ শুধু ‘শহীদ’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন।
‘শহীদ’ শব্দের একটি ধর্মীয় অনুষঙ্গ আছে। ‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁরা বলতে চান, কসাই কাদের ধর্মের জন্য ত্রাণ দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, একজন যে প্রায় ৪০০ খুনের সঙ্গে যুক্ত, ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত তিনি ধার্মিক হন কোন সুবাদে? কোন ধর্ম খুন ধর্ষণ সমর্থন করে? আর কসাই কাদেরকে বিচার করে দ- দেয়া হয়েছে এবং সে কার্যকর হয়েছে। এখানে তো লুকোছাপার কোন ব্যাপার নেই। হত্যারও ব্যাপার নেই। তাঁরা আসলে কসাই শব্দটির বদলে শহীদ শব্দটি প্রতিষ্ঠা করতে চান, যা এক ধরনের রাজনীতিকরণ।
বিএনপির যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের মূল বক্তব্য কসাই কাদেরের বিচার ন্যায়সঙ্গত হয়নি এবং এ কাদের কসাই কাদের নয়। পাকিস্তানীরাও তাই বলেছিলেন, শুধু তাই নয়, জামায়াতীরা এ কথাও বলছেন যে নকল মোমেনার সাক্ষ্যে হয়েছে মোল্লার মৃত্যুদ-। [ঐ]
এ সব বক্তব্যের ভিত্তি দুটি বিষয়Ñ এক. উদ্দেশ্যমূলক; দুই. আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটি না পড়া। প্রথম থেকেই এ দুটি দল থেকে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে সে কারণে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য সব সময় রাখা হয়েছে। যেমন, প্রথমে বলা হয়েছে, নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে বিচারের কথা বলা হয়েছে তার অর্থ এ নয় যে বিচার হবে। ট্রাইব্যুনাল হলে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল হলে কী হবে গ্রেফতার তো হবে না। গ্রেফতার হলে বলা হয়েছে জামায়াত-বিএনপিকে চাপে রাখার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। 

জামায়াত যদি সমঝোতা করে ১৪ দলের সঙ্গে তাহলে ছেড়ে দেয়া হবে। বিচার শুরু হলে বলা হলো, বিচার অনেকদিনের ব্যাপার। এটি নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেয়া হবে যাতে জামায়াত সমঝোতা করে। আর বিচার হলেই রায় হবে এমন কথা কে বলল? রায় হলে বলা হলো, রায় হলেও দ- কার্যকর করা হবে না। বলা হবে, ভোট দিন রায় কার্যকর হবে। এখন রায় কার্যকর হওয়ার পর বলা হচ্ছে, বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয়, বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয় এবং কাদের মোল্লার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকেও এ কথা বলা হয়েছে। ৩০ লাখ যখন শহীদ হয়েছেন বা ৩০ লাখ শহীদের মানবাধিকার নেই, মানবাধিকার থাকবে একজন খুনীরÑ এই বক্তব্য উদ্দেশ্যমূলক নয়ত কি?
এই কাদের যদি সেই কাদের না হয় তাহলে পাকিস্তানীরা কেন এই কাদেরকে তাদের লোক, শহীদ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে ক্রোধ প্রকাশ করল। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ে এর যথাযথ উত্তর আছে।
ইউরোপীয় দেশগুলো নাখোশ হয়েছে মৃত্যুদ-ের ব্যাপারে। সৌদি আরবে যে সামান্য কারণে কাশাস কার্যকর করা হয় জনসমক্ষে নাঙ্গা তালোয়ার দিয়ে তখন ইউরোপীয় দেশগুলো সম্মিলিতভাবে কি সৌদি বাদশাহকে নারাজি জানাতে পারবে? বা আমেরিকাকে, যে দেশের অনেক রাজ্যে মৃত্যুদ- এখনও বহাল।
মৃত্যুদ-ের মুহূর্তেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কাদের মোল্লার রায় কার্যকর না করার জন্য বলেছেন। আমেরিকা সবসময় গণহত্যাকে মদদ দিয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকেই এই দেশটি বাঙালীর বিরুদ্ধে। তুরস্ক যেভাবে কুর্দিদের হত্যা করেছে, বাংলাদেশ সে হত্যা বন্ধ করতে বললে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কী বলতেন? তুরস্ক শাসন করছে এখন ব্রাদারহুড বা তুরস্কের জামায়াতীরা। মুর্সিও ছিলেন ব্রাদারহুডের। এবং ব্রাদারহুডের সঙ্গে জামায়াতীদের এক ধরনের সখ্য আছে।
খালেদা জিয়া থেকে সানাউল্লাহ মিয়া পর্যন্ত কেউ এই আইনটি পড়েছেন কিনা জানি না। এই আইন নাকি আন্তর্জাতিক মানের নয়। এই আইন যখন করা হয় তখন ন্যুরেমবার্গ বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের মতামত নেয়া হয়। গত এক দশকে যে সব দেশে মানবতাবিরোধী আইন হয়েছে তার সব ভিত্তি বাংলাদেশের আইন। অন্য দেশে এ ধরনের কোন আইনে জামিনের বা সুপ্রীমকোর্টের আপীলের বা রিভিউ পিটিশনের কোন ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের আইনে এগুলো আছে। অর্থাৎ একজন মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও বিচারের সময় যাতে তিনি সব রকমের সুযোগ সুবিধা ও মানবিক সুযোগ-সুবিধা পান তার সব ব্যবস্থা এই আইনে আছে। ধর্ষণকে আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। এ আইনে তা, এবং সামাজিক দায়কে বিবেচনায় আনা হয়েছে যা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে আন্তর্জাতিক আইনে। ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত যত রায় দিয়েছে তার প্রত্যেকটিই একটি মান নির্ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যা একটি স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে পরিগণিত হবে। সুতরাং দ্বিতীয় যে প্রচারণা সেটিও উদ্দেশ্যমূলক।
এই রায় কার্যকর হওয়ার পর দেশজুড়ে মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে শুধুমাত্র বিএনপি-জামায়াত নয়। পাকিস্তান যখন কাদের মোল্লাকে নিয়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রস্তাব পাস করেছে সংসদে ও বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছে তখনও বিএনপি এর কোন নিন্দা করেনি। বিএনপির এক নেতা নজরুল ইসলাম বললেন, সরকারের তো আগেই করার কথা ছিল। সরকার তো করেছে, কিন্তু, বিএনপি কেন করল না। আপনাদের কি মনে পড়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের খবর কাগজে সংবাদ বেরিয়েছিল যে, নির্বাচনের আগে কয়েক শ’ কোটি টাকা আইএসআই সরবরাহ করেছে বিএনপি ও সামরিক বাহিনীকে। এ নিয়ে সে সময় অনেক লেখালেখিও হয়েছিল।
বিএনপি কেন এসে জঙ্গীবাদকে উসকে দিয়েছিল? কারণ আইএসআই তাই চাচ্ছিল। আইএসআই চায় ভারতের পূর্ব সীমান্তে একটি মিনি পাকিস্তান গড়তে। কেন চায়? কারণ, ১৯৭১ সালের পরাজয় ভোলা পাকিস্তানের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। প্রায় এক লাখ সৈন্যসামন্তের আত্মসমর্পণ! এটি তারা মানতে পারেনি। কাদের মোল্লার ফাঁসি আবার ১৯৭১কে সামনে নিয়ে এসেছে। সুতরাং পাকিস্তান ক্রোধান্বিত হবে সেটিই স্বাভাবিক।
আইএসআই [মানেই পাকিস্তান। তারাই সরকার চালায়] চায় বাংলাদেশ দখল করতে। ভৌগোলিকভাবে এটি আর সম্ভব নয়। সে জন্য তারা চায় তাদের এজেন্টরা ক্ষমতা দখল করুক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিক।
আইএসআইয়ের প্রথম ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করছে জামায়াত। দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে বিএনপি। উপরের বিবরণ তার প্রমাণ। সবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসিতে সন্তোষ প্রকাশ না করা ও পাকিস্তানের বেয়াদবির প্রতিবাদ না করা হচ্ছে এর সর্বশেষ প্রমাণ। এবং উপরের বিবরণ এটিও প্রমাণ করে যে, বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে মৌলিক কোন তফাত নেই। জামায়াত নিষিদ্ধ করলে জামায়াতীরা সব বিএনপির সভ্য হয়ে যাবে।
বিএনপি ও জামায়াত পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশ দখল করতে চায় আক্ষরিকভাবে। সে জন্য বিজয়ের সারাটা মাস তারা হরতাল ডেকেছে। যানবাহনে পেট্রোলবোমা ছুড়েছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জামায়াত যেমন মরণকামড় দিয়ে বৃদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। জামায়াত-বিএনপি একইভাবে আওয়ামী লীগ, হিন্দু ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। আসাদুজ্জামান নূরের ওপর আক্রমণ, সাতক্ষীরা, নাটোর, কোম্পানিগঞ্জ বা রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের বাড়িঘর জড়িয়ে দেয়া, আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের পুড়িয়ে বা গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাসে জামায়াতীরা শেষ গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। এবারও দুইদিন একই কায়দায় প্রায় ২০০ মানুষ হত্যা করেছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে হানাদার ও তার দালালদের হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একেকটি অঞ্চল মুক্ত করছিল। তেমনি জামায়াত-বিএনপি বা ১৮ দল একেকটি এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে।
তারা আওয়ামী লীগ/১৪ দল/প্রগতিশীল/সংখ্যালঘুদের হত্যা ধর্ষণের মাধ্যমে পদানত করতে চায় সে জন্যই গত দু’মাস সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে আন্দোলনের নামে। নির্বাচন এখন আর মূল ইস্যু নয়। সরকারের পতন হলে যেভাবে হোক তারা ক্ষমতায় আসবে, তারপর সবাইকে পদানত করে আইএসআইয়ের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে।
সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষে যাঁরা আছেন তাঁদের লড়াইটা শুধু জামায়াতের বিরুদ্ধে করলেই চলবে না, সেটি হতে হবে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধেও। তারা কম শক্তিশালী নয়। অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা সবখানে তাদের লোক আছে যারা প্রয়োজনে পথে নামবে। সুতরাং, খালি জামায়াতের কথা বলা হবে একদেশদর্শী এবং জনমানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।
শেখ হাসিনা যদি না থাকতেন, আমরা অনেকে নিশ্চিত ট্রাইব্যুনালও হতো না, কাদের মোল্লার রায়ও কার্যকর হতো না। আমেরিকার মজেনা ও কেরি এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, জাতিসংঘ আরও ইত্যাদির চাপে নত হতে হতো। মজেনার ঔদ্ধত্য এখনও কী প্রবল যে তিনি অর্থমন্ত্রীর কাছে নির্বাচনের ব্যাপারে বক্তব্য চান। অর্থমন্ত্রীর বলা উচিত ছিল, তিনি তাদের পররাষ্ট্র নীতির ব্যাখ্যা চান। আসলে এরা শক্তি বোঝে। ভারতকে দেখুন। তাদের কূটনীতিবিদকে হেনস্থা করায় তারা দিল্লীতে মার্কিন কূটনীতিবিদদের সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করেছে। এখন জামায়াত-বিএনপিকেও শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা।
মিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটি রব উঠিয়েছিলেন বিএনপি জিতবে নির্বাচনে। তাদের ছাড়া নির্বাচন ও গণতন্ত্র সিদ্ধ নয়। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, তারা নির্বাচন করতে পারবে না। সেটি যদি সিদ্ধ হয় তাহলে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ফ্রন্ট নির্বাচনে না এলে গণতন্ত্র রসাতলে যাবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। পাকিস্তানীদের সঙ্গে গণতন্ত্র ভাগাভাগি করতে হবেÑএ ধরনের আগ্রহ যত কম থাকবে গণতন্ত্রের জন্য ততই তা হবে উত্তম।
বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশ দখল করতে চায়? নিঃশব্দ সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সাইলেন্ট মেজরিটি পাকিস্তানের পক্ষে এমন ভাবার কোন কারণ নেই [এটি জামায়াত বুঝেছে। সে কারণে তাদের ওয়েবসাইটে কাদের মোল্লা সংক্রান্ত পাকিস্তানের কোন বক্তব্য নেই]। বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করবেন তাদের সবাইকে বাংলাদেশের পক্ষে থাকতে হবে। পাকিস্তানী দালালদের বা ব্রিফধারীদের এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না।
কাদের মোল্লার রায়ের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য কত লোক হয়েছিল? ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যখন আমরা সোহরাওয়ার্দী গিয়েছিলাম তখন যে পরিমাণ মানুষ দেখেছিলাম তারপর আর সেরকম জনসমাবেশ দেখিনি। এখন আমি প্রৌঢ়। ৪৩ বছর পর আমি আবার সেই একই দৃশ্য দেখলাম। না, বঙ্গবন্ধু নেই। কিন্তু সবার মুখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই ধ্বনিÑ জয়বাংলা! কাদের মোল্লার ফাঁসির পর আমি যত এসএমএস পেয়েছি তাতে দু’টি শব্দই শুধু ছিলÑ জয়বাংলা! বাংলাদেশের পাকিস্তানীরা যেন শব্দ দুটি মনে রাখে।

No comments:

Post a Comment