Tuesday, July 2, 2013

একজন নারী সাংবাদিক- সুমি খান



চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আশৈশব আমার আদর্শ। মনে পড়ে, সেই কিশোরীবেলা থেকেই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত মোনাজাতউদ্দিনের রিপোর্ট নিয়ে বাবা-মায়ের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য শুনতাম। আর মনে মনে ভাবতাম, একদিন আমিও এরকম করে রিপোর্ট করবো, দেশের প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের সুখ-দু:খের কথা তুলে ধরবো পত্রিকার পাতায়। তখনো বুঝিনি, আমি এই সমাজের কাছে প্রথমত: ‘মেয়েমানুষ’ - মোনাজাতউদ্দিনের মতো চারণ সাংবাদিক হবার বাস্তবতা আমার নেই।
১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করলাম লেখালেখি। ।চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণে লিখলাম নারী অধিকার, মানবাধিকার, কালো মানুষের অধিকার নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের বিপ্লবের গণজাগরণের কবি বেঞ্জামিন মলয়ঁসে কে ১৯৮৫ সালে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। সেসময়ে স্কুলে পড়ি। মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না বিপ্লবের কবি মলয়ঁসের ফাঁসির আদেশ।লিখলাম , “বেঞ্জামিন মলয়ঁসে: মৃত্যুহীন প্রাণ”।
এর আগে রাজধানীতে সোগেরা মোর্শেদ নামে একজনকে সম্ভবত: হত্যা করা হয়েছিলো, এর প্রতিবাদে একটি লিখা দিয়েছিলাম। বলা প্রয়োজন,এই লেখাটি আমাকে লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলেক্স আলীম। চিন্তাশীল অনুভূতিকে কাজে লাগানোর এর চেয়ে মোক্ষম উপায় আর কী হতে পারে!
যাই হোক্ দৈনিক পূর্বকোণের জুবলী রোড সিগনেট প্রেস অফিসে গিয়ে এক নারী সহসম্পাদক ‌এর হাতে দিয়ে এলাম লেখাটি। তিনি লিখাটি চিঠিপত্র কলামে ছেপে দিলেন। আমার মতো এক কিশোরীর আবেগঘন প্রতিবাদী লেখাটি কলাম হিসেবে ছাপার যোগ্য মনে করেন নি হয়তো। মনে কিছুটা কষ্ট পেলাম।পূর্বকোণে আর লেখা দিলাম না; আজাদীতে লিখতে থাকলাম। বেঞ্জামিন মলয়ঁসে , ফরাসী বিপ্লবে নারীর অবদান, শ্রমজীবি নারীর শ্রমের অধিকার নিয়ে লিখতে থাকি। একসময়ে দৈনিক পূর্বকোণে লিখতে শুরু করি সাংবাদিক আবুল মোমেনের হাতে লিখা দিয়ে আসতাম।
১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আমার ভাশুরের প্রোমোশান উপলক্ষে বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এলেন অনেকে। তাদের মধ্যে দৈনিক ভোরের কাগজের তৎকালীন চট্টগ্রাম ব্যুরোচীফ আবুল মোমেন অন্যতম। তাকে বললাম, “ মোমেন ভাই, জে এম সেন এর মতো দেশনেতার নামে চট্টগ্রামের একমাত্র এভেনিউ জানতে পারলাম বাবার কাছে। আমি বাবাকে সাথে নিয়ে দেখেছি, দু’য়েকটি হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ছাড়া অধিকাংশ দোকানের সাইনবোর্ডেই তার এই নামটি লিখা নেই। এভাবে জে এম সেনের কর্ম, নাম হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কি একটা রিপোর্ট করতে পারি , যদি অনুমতি দেন?” আবুল মোমেন তার স্বভাবসুলভ স্মিত হেসে বললেন. “করো”।
তার কাছে কৃতজ্ঞ আমি তিনি আমার রিপোর্টিং এর সুযোগ করে দিয়েছিলেন সেদিন।
আমার অসাধারণ উদ্যমী আর সাহসী বাবা সাইফুদ্দিন খান আমাকে নিয়ে প্রতিটা দোকান মালিক এবং কর্মচারীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শেখালেন মানুষের সাথে মিশে কী করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। কোতোয়ালী, লালদীঘি , আন্দরকিল্লা এসব জায়গা বাবার শৈশব, কৈশোর, ভাষা আন্দোলন , শ্রমিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মিছিলের পায়ে পায়ে চেনা। চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত প্রতিটি দোকানে কথা বললাম। এই এলাকার একমাত্র পেট্রোলপাম্প এর মুসলমান মালিক ( নামটি মনে করতে পারছিনা, তিনি বেঁচে নেই) বললেন এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ হিসেবে কী করে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের অন্যতম সেনানী ব্যারিষ্টার যাত্রা মোহন সেন -জে এম সেনের নাম মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র থেকে সাইনবোর্ডে তার নাম লিখা হয় না। অথচ চট্টগ্রামে তখন পর্যন্ত সেটাই একমাত্র এভেনিউ ছিল। যাই হোক্ জে এম সেনের ইতিহাস এবং জে এম সেন এভেনিউর ইতিহাস তুলে ধরলাম। একটি জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজের চলমান চট্টগ্রামে ১৯৯৩ সালের সম্ভবত: জুন মাসে প্রকাশিত হলো লেখাটি। এর পর নারী বানিজ্যব্যক্তিত্ব, শহীদ পরিবার সহ নানান বিষয় নিয়ে অব্যাহত থাকলো লিখালিখি। বিশ্বজিৎ চৌধুরী বিল করতেন একটা লেখাতে ১০০ টাকা । এসব নিয়ে কোন কথা বলা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই রিপোর্টিং অব্যাহত রাখলাম। বসে থাকতাম রিপোর্টিং য়ের প্ল্যান আর আইডিয়া পাওয়ার জন্যে। না, সে আশার গুঁড়ে বালি। নিজেই ভাবতে থাকি কী করা যায়!
বাবার কাছে শুনেছি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল বাবার প্রথম কারাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। এর পর আরো অনেকবার বাবা গ্রেফতার হয়েছেন। এখনো পংকজ ভট্টাচার্যের লেখায় তার কিছুটা পাওয়া যায়। কারাগার থেকেই বাবা বি.কম পাশ করেছেন।দেশের শীর্ষ অনেক রাজনীতিকের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে ও তার কারাগারে দেখা হয়েছে বলে শুনেছি। রাজবন্দী হিসেবে তারা বেশ সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ছিলেন বলেই মনে হতো বাবার প্রাণোচ্ছ্বল গল্পে। তাই কারাগার নিয়ে আমার আলাদা আগ্রহ ছিল।
একদিন বললাম , কারাগার নিয়ে আমি একটা রিপোর্ট করতে চাই। বিশ্বজিৎ চৌধুরী সাথে সাথে বলে উঠলেন, “ কারাগারে আপনাকে ঢুকতে দেবে কেন? রিপোর্ট করতে চাইলেই তো আর করতে দেবে না”।
সামান্য একজন কন্ট্রিবিউটর হয়ে ও কোথা থেকে মনের জোর পেলাম জানি না। জবাবে কিছুটা দৃঢ়তার সাথে বললাম, “আমি করে আনতে পারবো”।
গেলাম চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেল সুপারের রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বন্দীরা কুয়া থেকে পানি নিয়ে গোসল করছে , হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাবার কাছে নাশতার টেবিলে বা খাওয়ার টেবিলে শোনা গল্পগুলো মনে পড়লো।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার এবং জেল সুপার অনেক তথ্য দিলেন। সেসব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম। বিশ্বজিৎ চৌধুরী চলমান চট্টগ্রামের কাভার ষ্টোরী করলেন। বক্স করে চট্টগ্রাম কারাগারের ইতিহাস আলাদা করে দিলেন। সেটাতে আমার স্বামী আবদুল আলীমের নাম দিলেন। সেদিন প্রথম জানতে পারলাম এবং কিছুটা ধাক্কা খেলাম – আমার কাজ অন্যের নামে প্রকাশ হতে পারে।এভাবে কেটে গেলো দিন।
১৯৯৩ সাল থেকেই প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে চাকরির চেষ্টা করেছি । ভোরের কাগজের কাজ গুলোর ব্যাপক প্রশংসা কাজের স্পৃহা বাড়িয়ে দিতো শতগুণ। কিন্তু চাকরি দেবার আগ্রহ দেখায়না নীতিনির্ধারকেরা।
নারী নেত্রী মালেকা বেগম কে সেই শৈশব থেকে দেখেছি মায়ের সাথে পথে প্রান্তরে নারী আন্দোলনের কাজে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অন্য সব কেন্দ্রীয় নেত্রীদের মতো মালেকা বেগম ও সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে চট্টগ্রামে গেলে আমাদের বাসাতেই থাকতেন। আমার মা নূরজাহান খান ব্যাংকার ছিলেন। কোনরকমে অফিস পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই মালেকা খালাম্মাকে সাথে নিয়ে মা বেরিয়ে পড়তেন । হেঁটে হেঁটে সারা শহরের নারীদের সংগঠিত করতেন। মালেকা খালাম্মার পায়ের চটির দিকে দেখতাম ধুলো- ময়লা মাখামাখি।রাজনৈতিক গল্প, একাত্তরের গল্প, সাংগঠনিক , পারিবারিক গল্প , আড্ডা হৈচৈ করে মা এবং মালেকা খালাম্মা ঘুমাতে যেতেন অনেক দেরিতে। মনে পড়ছে ,এসব করে ও মা আমাদের দেখা শোনা, মেহমান দের জন্যে উপাদেয় রান্না, কোনটাই বাদ দিতেন না। বাবা বেশ উৎসাহের সাথে অনেক বাজার করে আনতেন মেহমানদের জন্যে। ১৯৮৫ সালে প্রথম বান্দরবান যাই ।মালেকা খালাম্মা নিয়ে যান আমাদের। মালেকা খালাম্মার ছেলে সাশা, আমরা তিন ভাই বোন আর মা। খুব আনন্দ করেছিলাম।
১৯৯৩ সালের পর যখন ভোরের কাগজ বা প্রথম আলোর কোন প্রোগ্রামে আসতেন মালেকা খালাম্মা বা মতি চাচা ( প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ), তখন তারা হোটেলে থাকতেন। ১৯৯৫ সালের পর আমার মা মালেকা খালাম্মাকে বলেছিলেন , আমাকে ভোরের কাগজের সাথে যুক্ত করতে। আমি দেখেছি, তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলতেন, “এটা তো মোমেন ই পারে নূরজাহান আপা”।
এর পর একদিন মা আবুল মোমেন কে বললেন, “ মোমেন ভাই, সুমি তো আপনাদের সাথেই কাজ করছে অনেক দিন। আপনারা নতুন ভাবে পত্রিকা শুরু করছেন । ওকে কি আপনাদের কাজের সাথে নিতে পারেন? ওতো কাজ করে ।" আবুল মোমেন হেসে বললেন, “ কাজ একটু বেশী ই করে, কিন্তু এই মুহুর্তে তো সম্ভব না, দেখা যাক্ কী করা যায়।” মাকে এভাবে বারবার বিব্রত হতে দেখে আমার খুব কষ্ট হলো। প্রথম আলো বাজারে এলো। একদিন আমি ই আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আবুল মোমেন বললেন, “ চট্টগ্রামে মেয়েদের সাংবাদিকতা করার পরিবেশ নেই। তুমি ফ্রিল্যান্স করছো, করে যাও।” বুঝলাম আমাকে সাংবাদিকতা করার পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে।
একটি কথা প্রসঙ্গক্রমে আনা প্রয়োজন। আমার বড়ো চাচা ডা. কামাল এ খান চট্টগ্রামের আন্দোলন, সংগ্রাম , ক্রীড়া জগৎ, সংস্কৃতিক জগতের নিবেদিতপ্রাণ প্রচারবিমুখ অসাধারণ এক ত্যাগী সংগঠক ছিলেন। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের চট্টগ্রাম সফর মানেই আয়োজক এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আমাদের বাপ্পু ডা. কামাল এ খান। তার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রগবেষক ওয়াহিদুল হক শিল্পকলা একাডেমীতে বলেছিলেন , “ ডা. কামাল এ খানের নামে মেলা হওয়া উচিত এমন নিষ্প্রাণ শোকসভা নয়”।
আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বাপ্পুর প্রসঙ্গ আনবার কারণ হলো, ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলো দু’টি পত্রিকার নীতিনির্ধারক এবং সংবাদকর্মীরা শুরুর সময়ে চট্টগ্রামে প্রথম কিছুদিন অফিস হিসেবে বাপ্পুর চেম্বারেই বসেছেন। কথাটা এজন্যেই বলছি ,বাপ্পু মারা যাবার পর প্রথম আলোতে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করার জন্যে আমাকে বেশ অনেক বার ফোন করতে হয়েছে ঢাকায়। বাপ্পুর পারিবারিক বন্ধু এবং তার অনেক অনুগ্রহের পাত্র হলে ও এই মানুষটির ত্যাগ এবং তিতিক্ষার কথা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্বশীলতা থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি সংগঠক এবং সাংবাদিকেরা অনেক দূরে । ডি. কামাল এ খানের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশেও ভীষণ হীনমন্যতার প্রকাশ দেখলাম তাদের। সাংবাদিকদের পেশাদারীত্ব আর দায়বদ্ধতার এমন অভাব কাছে থেকে দেখতে হয়েছে আমাকে বার বার।
গোষ্ঠী চিন্তা আর ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার উর্ধে উঠে একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবাধিকার সংগঠকের স্মৃতির প্রতি সামান্যতম দায়িত্বশীলতার পরিচয় ও দিতে পারলেন না কেউ।আমাদের দুর্ভাগ্য।
যাই হোক্ এক সময়ে ঢাকায় এলাম । দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদকের কাছে গেলাম। বললাম আমি মোনাজাত উদ্দিনের মতো কাজ তুলে আনতে চাই প্রত্যন্ত জনপদ থেকে । সম্পাদক আহমেদুল কবীর চাচা তখন গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি । বাবা তার ভীষণ স্নেহভাজন অনুজ। তিনি নিয়মিত বাবাকে ফোন করতেন ল্যান্ড ফোনে। আমি রিসিভ করলে তার ভরাট কন্ঠ শুনে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেতাম।তাকে আমার চাকরির কথা বলতে পারলাম না কেন যেন। বাবা কেও বলি নি।১৯৯৯ সালে যুগান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান জসীম চৌধুরী সবুজআমাকে বললেন, “ আপনি তো ভালো লিখেন, আমাদের পত্রিকায় আসেন”।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট হলো ফিচার এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। আরো একজনের একই সাথে এ্যাপয়েন্ট হলো, তাদের কারো আগে কোন রিপোর্টিং য়ের অভিজ্ঞতা নেই। তারা পুরুষ বলেই তাদের রিপোর্টার হিসেবেই চাকরি হলো। নভেম্বর ১৯৯৯ থেকে নভেম্বর ২০০০ ।
এর মধ্যে শিক্ষা বোর্ড এবং নারী নির্যাতন ইস্যুতে অনেক আলোচিত রিপোর্ট করেছি। অনেক রিপোর্ট বাস্কেটে ফেলে দেয়া হতো। এরকম একটি ঘটনা এসিড ছুঁড়ে মারা হয়েছিলো স্ত্রীকে। অপরাধী স্বামীর ছবি জোগাড় করেছি অনেক কষ্টে। দেখলাম সেই ছবি টি ব্যুরোচীফ তার টেবিলের পাশে বাস্কেটে ফেলে দিলেন। অপরাধ কী? এখনো জানি না।একবছরের মাথায় আমাকে যুগান্তর ছাড়তে বাধ্য করা হলো। এর কারণ টি এর আগে আরেকটি লেখায় আমি দিয়েছিলাম। তবু এখানে বলতে হচ্ছে-এক কিশোরী গৃহপরিচারিকা কে ধর্ষণ করে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। সেই রিপোর্ট করে আমি সাংবাদিক সমাজের চোখে অপরাধ করেছিলাম। ধর্ষণকারীর ছোটভাই এবং ভাগ্নী জামাই তখন প্রভাবশালী সাংবাদিক। প্রেসক্লাবে আমার বিচার বসলো আবুল মোমেন এবং অন্যান্য সাংবাদিক দের নেতৃত্বে । যাই হোক্, সে সময়ে সাপ্তাহিক ২০০০ এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধির দায়িত্ব পেলাম। প্রথম সারির পত্রিকার সাংবাদিকেরা ও অপেক্ষায় থাকতো আমি সপ্তাহশেষে কী রিপোর্ট দিচ্ছি। দিন রাত খাটনি আর পরিশ্রম করে সপ্তাহের কাভার স্টোরী করতাম। চট্টগ্রাম থেকে একমাসে ৩/৪টা কাভার স্টোরী আমার থাকতো। আমি কাজ করার আগে চট্টগ্রামে পত্রিকার সার্কুলেশন ৭৫/একশ’ কপি ছিল। আমার রিপোর্ট প্রকাশ হতে শুরু করলো আর ৫/৭ হাজার কপি পর্যন্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, জাপান সহ অনেক দেশে সাপ্তাহিক ২০০০ এর সার্কুলেশন । পাঠকদের অনেক চিঠি পাই। অস্ত্র , চোরাচালান , জঙ্গীবাদ, জামাত শিবিরের সন্ত্রাস নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতাবেদন করতে থাকি। তরুণ প্রধান প্রতিবেদক গোলাম মোর্তোজা এবং আরো অপেক্ষাকৃত তরুণ নির্বাহী সম্পাদক মোহসিউল আদনান প্রচন্ড সম্মান করেন এবং সহযোগিতা করেন। সাপ্তাহিক ২০০০ চট্টগ্রাম অফিস করা হয় আমাদের বাসার ই একটি ছোট্টরুমে।
২০০২ এর ২৮ নভেম্বর বিকেল ৪টায় আমার অফিস থেকে কোতোয়ালী থানার ও সি রুহুল আমিন সিদ্দিকী এবং এসআই ইয়াসমিন বেগমের নেতৃত্বে একটি দল এসে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমার ছোট ছেলেটার গায়ে সেদিন প্রচন্ড জ্বর। কনভেন্টে প্লে গ্রুপে পড়ে। একা একা পুলিশের গাড়ির পেছনে রাস্তায় চলে যায়, দু’চোখে জলের ধারা। তার মা’কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, কারণ কিছুই বুঝতে পারে না । আমার বাবা দুপুর বেলা একটু বিশ্রামে ছিলেন অসুস্থ শরীরে লুঙ্গী পরা অবস্থায় পুলিশের জীপের পেছন পেছন সিএমপি হেডকোয়ার্টারে ছুটে যান। এসি ডিবির রুমে আমাকে দেখে তৎকালীন এসি ডিবি শফিকুর রহমান কে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করলেন , “ আমি তো পাকিস্তান সরকারের সময়ে অনেক জেল খেটেছি, নির্যাতন সয়েছি। এখন স্বাধীন দেশ। আমার মেয়েটাকে কেন ধরে আনলেন?” তিনি বললেন তিনি কিছুই জানেন না। মোর্তোজা ভাইকে মোবাইলে জানালাম। আমার হাতে তখনো মোবাইল ছিল, এর পরেই সীজ করে নেয়। মোর্তোজা ভাই য়ের কাছে এসি ডিবি অস্বীকার করলেন তার রুমে আমার অবস্থানের কথা। সাড়ে ১১ ঘন্টায় দফায় দফায় ইন্টারোগেশান হয়। সিদ্ধান্ত ছিল রাতেই আমাকে ঢাকায় জয়েন্ট ইন্টারোগেশান সেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। রাত সাড়ে তিনটায় আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
তার দু’দিন আগে সাংবাদিক সালিম সামাদ, প্রিসিলা রাজ, চ্যানেল ফোরের জাইবা মালিক এবং লিও পোল্ডো গ্রেফতার হন ঢাকা এবং বেনাপোল সীমান্ত থেকে। তাদের সাথে আমার কোন চেনা পরিচয় না থাকলেও তাদের সাথে আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সালিম ভাই পরে বলেছিলেন, ওনাদের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো –তারা যদি সুমি খান কে তাদের কাজের সহযোগী হিসেবে বলেন, তাদের মুক্তি দেয়া হবে। তখন সালিম ভাইয়ের সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না। তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিস চৌধুরী বিবিসি এবং অন্যান্য মিডিয়াতে বলেন, “সুমি খানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে । এবার ছেড়ে দিলেও তাকে আবার ধরা হবে”।
পরদিন জানতে পারি আমাকে ছেড়ে দেবার পেছনে আমার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, মাহফুজ আনাম মতিয়া চৌধুরী এবং মালেকা বেগম এবং এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সহ অনেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন । মালেকা খালাম্মা আম্মুকে বলেছেন, “নূরজাহান আপা, আপনি এখন সুমির মা শুধু নন, আপনি মহিলা পরিষদ নেত্রী। একটা মেয়েকে কিছুতেই রাতে থানায় রাখতে দেবেন না”।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাকে বললেন, “ আমি আইজি কে বলেছি, সুমি কেন্দ্রের সমন্বয়কারী। ওকে ১৯৯৫ সাল থেকে আমি চিনি। যদি ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোমরা প্রমাণ করতে না পারো, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে না, মনে রেখো”।
২০০৪ সালের ২৭ এপ্রিল আমি একটি রিপোর্ট নিয়ে রাতের বেলা রিক্সায় করে এস এ পরিবহনে যাবার পথে অন্ধাকার রাস্তায় সন্ত্রাসীরা আক্রমন করে। আমি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলাম। এলাকার ছেলেরা আমায় সেন্টার পয়েন্ট ক্লিনিকে নিয়ে যায় । সাংবাদিকেরা জানতে পেরে আমার বাসায় খবর দেয়।এর আগে থেকে ই আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠিতে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে হুমকি দেয়া হয়। আমি মুখে এবং হাতে বেশ আহত হই। আমার বড়ো ছেলে অতুলন ভয়ে আমার দিকে তাকাতো না।আমার ছোট ছেলে গহন তার ছোট ছোট মাটির পুতুল গুলো এনে আমার মাথার কাছে বসে বসে আমাকে খেলতে বলতো, যেন এতে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এর মধ্যে ৩ মে ২০০৪ প্রেস ফ্রিডম ডে। হঠাৎ দেখি সালিম সামাদ আমাকে দেখতে চট্টগ্রাম চলে গেছেন। সেদিন ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি। সব অনুষ্ঠান ফেলে তিনি বললেন চট্টগ্রামে আমার বোন আক্রান্ত হয়েছে, তাকে আমার দেখে আসতে হবে। সেদিন ই প্রথম তার সাথে পরিচয় এবং আপন বড়ো ভাই হিসেবেই তাকে বিপদের সময়ে চট্টগ্রামে পাশে পেলাম। সেই থেকে আজো আমার এই ভাইটির প্রতি আমার এবং আমার পরিবারের প্রত্যেকের বিনম্র শ্রদ্ধা।
কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে, হাতের আঙ্গুল সোজা করতে পারতাম না। ভেবেছিলাম আর কখনো লিখতে পারবো না। দাঁতের চিকিৎসা চট্টগ্রামে করলাম। হাতের আর নার্ভের চিকিৎসা মাদ্রাজে করলাম। ধীরে ধীরে আমার আঙ্গুল স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমার যেন পুনর্জন্ম হলো!
জামাতের শীর্ষসন্ত্রাসী আহমইদ্যা গয়েশ্ব্বর রায়ের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিলো। আহমেদুল হক চৌধুরী প্রকাশ আহমদ্যা জামাত সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৯০ দিন সময় বেঁধে দিলেন –হয় শাহজাহান চৌধুরী থাকবে, নয়তো আহমদু থাকবে। এসময় আমি চট্টগ্রামের ত্রাস আহমেদুর ইন্টারভিউ নেবার চেষ্টা করি।
তার সাথে যোগাযোগ হয়। আমাকে সময় দিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়, তার লোকজন রেইকি করে আহমদুর নিরাপত্তি নিশ্চিত হবার পর আহমদু আসেন সাড়ে সাতটার দিকে। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ঐ কাবাব হাউজের বাইরে দেখলাম সাংবাদিক নজরুল কবির তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে কাবাব খেতে গেছেন। তার সাথে কুশল বিনিময় করে ভেতরে একটি টেবিলে বসলাম ভয়ংকর এ সন্ত্রাসীর ইন্টারভিউ নিতে। খোলামেলা আলাপে বললেন ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে তাকে কিভাবে ছাত্র শিবিরের রাজনীতি এবং অস্ত্র হাতে তুলে দেয় শাহজাহান চৌধুরী। লম্বা , ফর্সা আকর্ষনীয় যুবক আহমেদু অকপটে বলে যান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির নেতা কর্মীদের খুন করে তাদের রক্তে হোলিখেলায় শিবির ক্যাডার দের মাতাল করেছেন জামায়াত নেতা এবং সাংসদ শাজহাজান চৌধুরী। বোরকা পরে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে কয়েকটি খুনের বর্ণনাও দিলেন। গয়েশ্বর রায়ের হাতে ফুলের মালা দিয়ে বিএনপি তে যোগদানের কয়েকটি ছবি ও তিনি আমাকে দিলেন। সাপ্তাহিক ২০০০ টপ কভার ষ্টোরি করলো । মার মার কাট কাট সার্কুলেশন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের শুক্রবার জুমার নামাজের আগ মুহুর্তে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করা হয় আহমেদু কে। র‍্যাব-৭ এর তৎকালীন পরিচালক কর্ণেল এমদাদ ( পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত) কে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, " কেন আহমেদু কে হত্যা করা হলো ? " তিনি জবাব দিলেন," আপনাকে আহমইদ্যা যা ইন্টারভিউ দিয়েছে এর পর কী আর তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়?" প্রশ্ন করেছিলাম, " তাহলে আহমইদ্যাকে সন্ত্রাসের দীক্ষা যে দিয়েছে, তার মতো অসংখ্য কিশোর তরুণের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে জামাত নেতা শাহজাহাস চৌধুরী - এই তথ্য নিশ্চিত হয়েই কি শাহজাহান চৌধুরীর জীবনের হুমকি কে সরিয়ে দিলেন?" হাসলেন কর্ণেল এমদাদ। সাপ্তাহিক ২০০০ পরের সংখ্যায় কর্ণেল এমদাদ এর এই ইন্টারভিউ ছাপা হলো।

বিএনপি নেতা এবং সংগঠক জামালউদ্দিন অপহরণ হলেন ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই। তিনবছর পর তার কঙ্কাল উদ্ধার করা হয় ফটিকছড়ির জঙ্গল থেকে। এই তিন বছর নানান রকমের গল্প। আমার এক অজানা সোর্সের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য গুলো পেয়ে যেতাম। জামালউদ্দিনের নব্বইবছর বয়সী মা শুধু আমাকেই ইন্টারভিউ দিলেন। বললেন , “আমাদের রাখালের ছেলে সরওয়ার জামাল নিজাম এমপি আমার ছেলেকে খুন করেছে”।
আমি ধারাবাহিক ভাবে জামালউদ্দিন অপহরণ এবং হত্যা নিয়ে রিপোর্ট করতে থাকি। আক্রান্ত হবান চিকিৎসা করতে গেছি, সরওয়ার জামাল নিজাম সাপ্তাহিক ২০০০ অফিসে ফোন করে মোর্তোজা ভাইকে বললেন, আপনাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি কী করে চট্টগ্রামে চলাফেরা করে আমি দেখে নেবো। এবার গোলাম মোর্তোজা বিশেষ প্রতিবেদন লিখলেন। সেখানে তিনি আশংকা প্রকাশ করে বললেন এভাবে প্রকাশ্যে আমাদের প্রতিবেদক কে হুমকি দেবার কারণে আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত।আমার কাজ থেমে থাকে নি। কিছু টি শংকা ছিল সন্তান দের নিয়ে। আমি চেষ্টা করতাম তাদের স্কুলে যাওয়া এড়িয়ে চলতে যাতে তাদের উপর হুমকি না আসে।
২০০৫ সালে তিনটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করি।সৎ সাংবাদিকতা এবং প্রেস ফ্রিডম এর জন্যে বিশ্বের একজন কেই এই পুরস্কার দেয়া হয়। ইনডেক্স গার্ডিয়ান হুগো ইয়ং এ্যাওয়ার্ড। লন্ডনের সিটি হলে ২০০৫ এর ৪ মার্চ আমাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এর পর ই নিউইয়র্ক থেকে পেলাম ইন্টারন্যাশনাল উইমেন মিডিয়া ফাউন্ডেশন এর আই ডব্লিউ এম এফ ‘ক্যারেজ এ্যাওয়ার্ড’।
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিষ্ট ' সিপি জে 'এ্যাওয়ার্ড পেয়েছি তার আগেই। কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার পর অফিসের কারো কারো আচরণ ভীষণ বৈরি হয়ে গেলো। কাজ করা কঠিন হয়ে গেলো । ‘সিপি জে এ্যাওয়ার্ড’ নিতে অস্বীকার করলাম। কর্তৃপক্ষ কে বললাম ,"তোমরা এই পুরস্কার এর ঘোষণা দিও না। আমাকে কাজ করতে দাও। আমি কখনো কোথাও পুরস্কারের জন্যে আবেদন করিনি। পাঠকের স্বীকৃতি ই আমার পুরস্কার। "
‘আইডব্লিউ এমএফ কারেজ এ্যাওয়ার্ড’ নিতে গেছি যখন, তখন সিপিজে থেকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে তারা একটি চেক দিয়ে আসে আমাকে। এসব নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখবার ইচ্ছে আছে ।
এর আগে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে আমার কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠায়। আমি দিতে অস্বীকার করি। পরে তারা ভীষণভাবে চেপে ধরে মানবাধিকার রিপোর্ট পাঠাতে বলে।সেদিন শেষ সময়। তাড়াহুড়ো করে জামালউদ্দিন অপহরণ মামলায় পুলিশ কাস্টডিতে নিহত ফটিকছড়ির কাশেম চেয়ারম্যানের ক্যাশিয়ার অমর কর (সম্ভবত।নামটা এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না) এর উপর সাপ্তাহিক ২০০০ য়ে প্রকাশিত রিপোর্ট পাঠাই। প্রথম আলো , ভোরের কাগজ সহ সব পত্রিকার বাঘা বাঘা রিপোর্টার তাদের রিপোর্ট পাঠায়। একজন অমর করের উপর প্রকাশিত তার রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলো। পরে ডেমোক্রেসী ওয়াচ থেকে ফোন করে জানালেন চট্টগ্রাম বিভাগে 'শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার রিপোর্ট এ্যাওয়ার্ড 'আমি পেয়েছি। ঢাকায় এসে এই রিপোর্ট নিতে গিয়ে পরিচয় হলো বিখ্যাত রিপোর্টার গৌরাঙ্গ নন্দীর সাথে। খুলনার শ্রেষ্ঠ রিপোর্টার এর পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। পরে ডেমোক্রেসী ওয়াচের এহসান ভাই ফোন করে বললেন, “ সুমি আপা, আপনি যে কিসের মধ্যে কাজ করছেন, আমরা কিছুটা বুঝতে পারছি।“
আমি একটু অবাক হলাম তার কথা শুনে। বললেন , চট্টগ্রামের রিপোর্টার দের যা বকা আমাদের শুনতে হলো! তারা বলছে, “চট্টগ্রামে সুমি খান ছাড়া আর রিপোর্টার নাই আপনাদের চেনা? মেয়েমানুষ বলেই তাকে পুরস্কার টা দিতে হলো”? এহসান ভাই আরো বললেন তাকে কিভাবে বিব্রত করা হয়েছে আক্রমনাত্মক প্রশ্ন করে এবং ‘মেয়েমানুষ’ কে পুরষ্কার দেবার মনগড়া অভিযোগে দায়ী করে। আমি মনে মনে এতো কষ্ট পেলাম, এতো হতাশ হলাম!
কারো সাথে প্রতিযোগিতায় তো নামিনি। কারো কোন কাজে ও ডিসটার্ব করি নি কখনো। নিভৃতে আমার কাজ আমি করে গেছি। তবু কেন তারা আমার উপর এতো ক্ষুব্ধ? কাজ করার পরিবেশ আবো ভেবে ২০০৬ সালে ঢাকায় চলে আসি পুরোপুরি।২০০৬ এর ডিসেম্বর থেকে একুশে টেলিভিশনের সাথে কাজ শুরু করি সম্ভবত: ২০০৭ এর মার্চর ১৯ তারিখ ১৫ মার্চ এর তারিখে আমাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে বাধ্য হয় এইচ আর প্রধান রুহুল আমিন। এ ধরণের ঘটনা ঢাকায় এসেও বার বার আমাকে আঘাত করেছে। সেসব পরে অন্য কোন দিন বলা যাবে । শুভ কামনা থাকলো সকল সাংবাদিক সহকর্মীর প্রতি।১০.০৩.১৩
(ডিআর ইউর নারী দিবস বিশেষ প্রকাশনা তে প্রকাশিত লেখা)

Sunday, June 30, 2013

ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অনেক বড়ো বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। এসো বন্ধুরা - সুমি খান


ফেসবুকে আমার কমেন্ট , পোষ্ট অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগায়। প্রতিক্রিয়া জেনে অন্তত তাই বুঝলাম। কাল বিকেলে একুশে টেলিভিশনের পাশের খুপড়ি চায়ের দোকানে বসে পুরনো কলিগদের সাথে চা খেতে খেতে আমার এক অনুজ নারী সাংবাদিক প্রশ্ন করলো ," আপু , আপনার লেখা -পোষ্ট পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছেন। " অতি বাম রাজনীতির সৈনিক আমার এই অনুজ ।তার রাজনৈতিক দীক্ষায় আওয়ামী বিরোধিতা আর ভারত বিরোধিতা বদ্ধমূল ধারণায় গেঁথে রেখেছে। তার যখন এ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়, আমি তখন একুশে টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক। আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং স্নেহভাজন এই অনুজ কে বললাম, "দ্যাখো, এমন মনে হতেই পারে । কিন্তু আমার কথা গুলো সত্য এবং বাস্তব! কারণ আমরা তো ভুক্তভোগী! ২০০১ থেকে ২০০৫ যারা সাংবাদিকতায় একনিষ্ঠ ছিল, তারা কাছে থেকে দেখেছে জামাত -বিএনপি মানবতা র কী ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনে। সাংবাদিক নির্যাতন কাকে বলে ....!!" এ কথা গুলো গেলো তিন বছর আরাম আয়েশে বিএনপি বীট করা এ্ই টিভি সাংবাদিক এর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি। তার চোখে বিএনপি নেতা দের 'নিপীড়ন' নির্যাতন' অনেক বড়ো ব্যাপার। তারা তো মানিক সাহা , হুমায়ুন কবির বালু, গৌতম দাস সহ ১৩ সাংবাদিক হত্যা, মুনতাসীর মামুন , শাহরিয়ার কবির , সালিম সামাদ , পিরোজপুরের মিঠু, বরুন বিশ্বাসকে কী ভয়ংকর নির্যাতন সইতে হয়েছে- শুধু সাংবাদিকতা করার অপরাধে- তার কতোটা অনুমান করতে পারবেন এখনকার শখের সাংবাদিকেরা? শখের সাংবাদিক বলতে বাধ্য হলাম। কারণ এখন পর্দায় মুখ দেখিয়ে তারকা হবার জন্যেই টেলিভিশন সাংবাদিকতায় ছুটে আসেন অনেকে। সেই সময়ে জাইবা মালিক, প্রিসিলা রাজ অথবা আমার মতো নগন্য সাংবাদিক কে ও নির্যাতন , গ্রেফতার এবং হত্যার নিরন্তর হুমকির মুখেই বাঁশখালি, সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি , সন্দ্বীপ সহ প্রত্যন্ত এলাকার বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে যেতে হয়েছে। বিএনপির বড়ো ডোনার হয়েও অপহরণ, হত্যার শিকার হয়ে তিনবছর গুম রাখা হয়েছে জামালউদ্দিন কে। বাবর শিকার করেছে বিএনপির সাংসদ সারওয়ার জামাল নিজামের থেকে এজন্যে ৫শ'কোটি টাকা নিয়েছে তারেক জিয়া। জামালউদ্দিনের পরিবার এখনো বিপন্ন । কারণ আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো তাগিদ নেই এই খুনি কে গ্রেফতার অথবা বিচারের মুখোমুখি করা! এই ঘটনার বিচার হবার জন্যে অন্তত আবার ওয়ান ইলেভেন আসা দরকার বলেই আমার মনে হয়! জামাতের খুনি শাহজাহান চৌধুরীর হত্যাযজ্ঞের প্রধান সাক্ষীআহমদু, প্রকাশ আহমইদ্যা বিএনপি তে যোগ দেয়ার একবছরের মধ্যেই নব্বই দিন সময় বেঁধে হুমকি দিয়েছিলো শাহজাহান চৌধুরী কে। বলেছিলো -" জামাতের এক গুণ- ধর্মের নামে মানুষ খুন। নব্বই দিন পর হয় শাহজাহান চৌধুরী থাকবে, নয় আমি থাকবো। " তার এ ঘোষণার পর আমার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার দেয় আহমেদুল হক চৌধুরী, প্রকাশ আহমইদ্যা। ক্লাস এইটে পদার সময়ে ফুলকুঁড়ি আসরের মাধ্যমে তাকে কিভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়। এবং এর অল্পদিন পরেই শাহজাহান চৌধুরী তাকে অস্ত্র হাতে দিয়ে একের পর এক আওয়ামী রীগের নেতা দের হত্যা করিয়েছে- এর বর্ণনা এবং অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো আহমদু। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবার সাথে সাথেই আহমদু কে র‍্যাব এর ক্রসফায়ারের মাদ্যমে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়। এর পর আমার সাথে সাক্ষাৎকারে র‍্যাব-৭ এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল এমদাদ ( পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত) বলেছিলেন," আপনাকে যে সাক্ষাৎ কার দিয়েছ, তার পর তো তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না!" আমার প্রশ্ন ছিল , এই সাক্ষাৎকারের পর আপনাদের সুযোগ ছিল সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের- যদি সত্যি আপনারা সন্ত্রাস দূর করতে চান। আপনারা শাহজাহান চৌধুরী কে কেন ক্রসফায়ারে ফেললেন না- যদি সৎসাহস থাকে? উল্টো তার পথের কাঁটা দূর করলেন? " নীরব হাসি ছাড়া আর কোন জবাব ছিল না কর্ণেল এমদাদ এর।
এসব তো এখনকার সৌখিন সাংবাদিকেরা দ্যাখে নি! কী করে ধারণা করবে তারা বিএনপি জামাতের ভয়ংকর রূপ? আওয়ামী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ও একের পর এক হঠকারী ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ করে তুলছে সাধারণ জনগণকে । তাদের ভালো কাজগুলোর চেয়ে অন্যায় আর অপরাধের চিত্র অদূরদর্শী হনগণের কাছে অগ্রগণ্য।... বিএন পির ক্ষমতায়ন তাই তাদের কাছে স্বপ্নের মতো!
.. বিএনপি ক্ষমতায় এলে যদি এই সাংবাদিকরা বিশেষ ভাবে ক্ষমতায়ন না হয়ে সাধারণ সাংবাদিকের কাতারে থাকে- তাদের এই স্বপ্নের ঘোর কাটতে এক ঘন্টা সময় ও লাগবে না... রক্তের বন্যা বয়ে যাবে দেশ জুড়ে!! দেশের বাম নেতা আর বুদ্ধিজীবি তাত্বিকেরা ২০০১-৫ যেমন ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলেন- রোম পুড়লে নিরো বাঁশি বাজায় যেমন - তেমনি অবস্থানে ছিলেন- একই অবস্থানে আবার ফিরে যাবেন তারা !
আর সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হবে নিরীহ মানুষ আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি। যারা ৪০ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে পূর্বপুরুষ আর স্বজনদের নারকীয় হত্যার বর্ণনা দিয়ে সাক্ষী দিয়ে গেছে, তাদের এবার কচু কাটা করা হবে! একাত্তরের ঘাতক হায়েনার দল গারদ থেকে বেরিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়বে , রক্তপিপাসু জিভে আবার রক্তের স্বাদ নিতে হামলে পড়বে হিন্দু- বৌদ্ধ আর খৃষ্টান দের বাড়ি-ঘর- মন্দিরে....হ্যাঁ, সাথে তাদের জামাত-বিএনপি - আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা সবাই থাকবে- জমি জিরেতের ব্যাপার- ভোগ দখলের ব্যাপার... ভারত সীমান্তে লক্ষ লক্ষ বিপন্ন মানুষ ভীড় করবে প্রাণ বাঁচাতে.... এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান দের হত্যা -নির্যাতন করবে বিজেপি আর নরেন্দ্র মোদীর শিষ্যরা। এর প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে সহিংসতা !! তাই ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে উঠে আমাদের একটু সচেতনতা, একটু দূরদর্শীতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অনেক বড়ো বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। এসো বন্ধুরা মানবতার জয়গানে সব ধরণের সহিংসতা প্রতিরোধ করি!