Friday, September 12, 2014

শেখ রেহানার জন্মদিন: এম নজরুল ইসলাম

রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তিনি। বেড়ে ওঠা রাজনীতির আবহে। জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছেন, বাড়িতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আসা-যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। কিন্তু নিজে এড়িয়ে চলেন সব ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ। মানুষের কল্যাণ কামনা করেন সবসময়। এই কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা তো হয়েছে পারিবারিক সূত্রেই। নিজে সবসময় থেকেছেন আড়ালে। এই আড়ালচারিতা তাঁর মাহাত্ম্যকে একটুও ম্লান করেনি। বরং পাদপ্রদীপের আলোয় না এসেও তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে যে অবদান রেখে চলেছেন তা তুলনাহীন। মিতবাক এই নারী নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার সেবায়। তাঁর সেই নীরব নিবেদন সাদা চোখে সবার গোচরে আসে না।
কী পরিচয় তাঁর। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তিনি বাংলাদেশের তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন। তিনি শেখ রেহানা- আপন বলয়ে যিনি নিজেকে গড়েছেন সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। প্রচার এড়িয়ে চলেন সযত্নে। স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই চিনি তাঁকে। আমি তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহকারী সাধারণ সম্পাদক। শেখ কামাল ভাইয়ের নৈকট্যে সময় কাটে আমাদের। নিছকই কোন কারণ ছাড়াও যাওয়া হতো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। তখন তিনি নিতান্তই আটপৌরে, ঘরোয়া। অপরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে নৈকট্য লাভের সুযোগ অনেক পরে। তখন তাঁর প্রবাস জীবন। ভাগ্যান্বেষণে প্রবাসী আমিও। দেশে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে ঘরোয়া, আটপৌরে তরুণীকে দেখেছি, প্রবাসে তাঁকেই পাই অন্য রূপে।
জাতির জনকের কন্যা তিনি। কিন্তু জীবনটা তাঁর জন্য সহজ হয়নি। জীবনের অনেকটা পথ রীতিমতো লড়াই করেই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। বলতে গেলে জীবনের শুরুতেই জীবনযুদ্ধের সৈনিক তিনি। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সে হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাইদের। হারিয়েছেন স্বদেশের আশ্রয়। আশ্রয়হীন পরিবেশে দেশে দেশে ঘুরেছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল না কোথাও। ছিল না নিশ্চিত জীবন-যাপনের নিশ্চয়তাও। লড়াই করেছেন। ভেঙ্গে পড়েননি। উপার্জনের জন্য নিজেকে নিযুক্ত করতে হয়েছে নানা কাজে। বড় বোন শেখ হাসিনা রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের নেতৃত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। শেখ রেহানা নেপথ্যে বড় বোনকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখন তাঁর দুই সন্তান জয় ও পুতুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ রেহানা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যেমন বিত্ত-বৈভব, সহায়-সম্পত্তির কথা কোনদিন চিন্তাও করতেন না। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দায়-দায়িত্ব এবং বিপর্যয়কে হাসিমুখে গ্রহণ করতেন, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও বাবা-মায়ের মতোই পার্থিব লোভের উর্ধে থেকে সাদামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। শত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা পিতা-মাতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বিরল দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন এই দুই বোন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে পাওয়া ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের বাড়িটিতে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে ধানমন্ডি থানা স্থাপন করা হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে এই বাড়িটি বৈধ মালিকানায় ফেরত পাওয়া শেখ রেহানার জন্য অতি সহজ ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো হাইকোর্টের রিট মামলা প্রত্যাহার করেন। সরকার থেকে পাওয়া বাড়িটি সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেন ২০১২ সালের ১০ মার্চে। তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের এই নির্মোহ ও নিস্পৃহ থাকার বৈশিষ্ট্য তাঁকে মহীয়ান করেছে।
রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য তিনি। রাজনীতি থেকে নিজেকে সবসময় সরিয়ে রেখেছেন। তারপরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানা অংশ নিতে যাচ্ছেন, এমন গুজব মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। যদিও এসব কথা এখন পর্যন্ত গুঞ্জন হিসেবেই রয়ে গেছে। বাস্তবে এর কোন প্রমাণ মেলেনি। তাই বলে তাঁকে রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন কিংবা রাজনীতি-বিমুখ ভাবার কোন কারণ নেই। যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন তিনি। আড়াল থেকেই যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়া যায়, তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন। বিশ্বসংসারে এমন আড়ালচারী কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা নিভৃতে কাজ করেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। ব্যক্তিগত মোহের উর্ধে উঠে দেশচিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন শেখ রেহানা। নিজেকে নিয়ে ভাবিত হতে না পারার বিরল শক্তি তিনি অর্জন করেছেন। পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার সব সুযোগ ও সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখন অবধি নিজেকে রেখেছেন মোহমুক্ত। যাঁরা পারিবারিকভাবে নিতান্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত, রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠার পরও এমন নিভৃত জীবন কাটানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব। ক্ষমতা কখনও শেখ রেহানার মোহভঙ্গ করতে পারেনি। কারণ তিনি সেই বিরল স্বভাবের আড়ালচারী মানুষদের একজন, যিনি নেপথ্যে থেকেও সুস্থ রাজনৈতিক ধারার আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিবাচক শক্তির উৎস।
জন্মদিনে আজ তাঁকে জানাই শুভেচ্ছা। তিনি দীর্ঘায়ু হোন। বাংলার মানুষের পাশে সবসময় থাকুন। অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাহস যুগিয়ে যান দেশে ও বিদেশে। জয়তু শেখ রেহানা।
লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী ও মানবাধিকারকর্মী
nazrul@gmx.at
   

জামায়াত সারদা তৃণমূল দোস্তী-কোটি টাকার লেনদেন-সুমি খান

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে ভারতের সারদা গ্রুপ জামায়াতে ইসলামীকে কোটি কোটি টাকা দিয়েছে এমন  তথ্য তুলে ধরেছে ভারতের শীর্ষ বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার। শুক্রবার পত্রিকাটিতে  প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এর সঙ্গে পশ্চিম বাংলার তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান জড়িত।
 সরকারিভাবে এ ঘটনার তদন্ত চেয়ে জামায়াতের রাজশাহীর আমীর  আতাউর রহমান কে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনবার দাবি জানিয়েছেন রাজশাহীর সংসদ সদস্য ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক  ফজলে হোসেন বাদশা ও সাতক্ষীরার সাংসদ মুস্তাফা লুৎফুল্লাহ। ফজলে হোসেন বাদশা  বলেন, ‘ গত  সপ্তাহে যমুনা টেলিভিশনের টক শো তে রাজশাহী জামায়াতের আমীর আতাউর রহমান বলেছেন , ভারতের কিছু রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের যোগাযোগ আছে।” এর মাধ্যমে আনন্দবাজারে শুক্রবার প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত হয় বলে মনে করেন ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। তিনি বলেন, তৃণমূল নেত্রী মমতার বিরোধিতার কারণে  ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি এবং সীমান্ত চুক্তি থেমে আছে। এ ঘটনার সঠিক তদন্ত করে একাত্তরের  যুদ্ধাপরাধী শক্তির সাথে জড়িতদে বিরুদ্ধে ভারত এবং বাংলাদেশে ব্যবস্থা নিলে তিস্তা চুক্তি এবং সীমান্ত চুক্তি সম্পাদিত হবে। ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বিরাজমান সংকট কেটে যাবে।

ফজলে হোসেন বাদশা জনকন্ঠকে বলেন, ভারত বাংলাদেশ পরীক্ষিত সম্পর্ক । এদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে নির্মূল করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি শাসিত সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের কোন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে অস্ত্র এবং টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে যাবে- এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি সংসদে তার প্রতিবাদ উপস্থাপন করবেন জানিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবার দাবি জানাতে হবে।  তিনি বলেন, তৃণমূল সাংসদ ইমরানের সাথে মৌলবাদ এবং জঙ্গী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এমন তথ্য ভারতীয় পত্র পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের  অনেক সাংসদ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’
তিনি  এই প্রতিবেদককে জানান , ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে  সাতক্ষীরা থেকে জয়পুরহাট পর্যন্ত সীমান্তপথে প্রচুর অস্ত্র এবং গান পাউডার আনার তথ্য তারা নিশ্চিত হয়েছেন বিভিন্ন  সময়ে। তিনি বলেন, তখন আমাদের সন্দেহ হয়, সীমান্তের  ওপার থেকে কেউ না কেউ জামায়াতকে মদদ দিচ্ছে। এর পর কানসাটে গানপাউডার দিয়ে হামলা হলো , রাজশাহীর ট্রেন পুড়িয়ে দেয়া হলো। এসব  নাশকতার ঘটনা প্রমাণ করে  সারদার দুর্নীতির টাকা বাংলাদেশে এসেছে। আর এই দুর্নীতির টাকা পেয়ে বিএনপির মদতে জামায়াত একের পর এক নাশকতা করে যাচ্ছে। আগামীতে জামায়াতের  আরো ভয়াবহ হামলা করা আশংকা রয়েছে বলে মনে করেন ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। তিনি বলেন , বিএনপি এই ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করতে চাইলে  জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান প্রকাশ্যে জানাতে হবে।
 ১২ সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ভারতের তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ইমরান তাঁর বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে আনন্দবাজার বলছে, ২০১২ ও ২০১৩ সালে তৃণমূল সাংসদ ইমরানের মাধ্যমে ভারত থেকে দফায় দফায় বিপুল পরিমাণ অর্থ জামায়াত ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর হাতে পৌঁছেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার শুরু হবার সাথে সাথে দেশ জুড়ে জামায়াত  ব্যাপক নাশকতা ও সহিংসতা শুরু করে। সেই সময়েই উত্থান ঘটে জঙ্গী সংগঠন  হেফাজতে ইসলামের। গোয়েন্দা সূত্রে প্রকাশ , এসব সহিংসতায় ইন্ধন জোগাতেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল, যার একটা বড়ো অংশ সারদা গ্রুপের।
ভারতের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, সারদার কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সে নগদ ভারতীয় টাকার বান্ডিল ভরে নেওয়া হয়েছে  বনগাঁ, বসিরহাট, নদীয়া, মালদহ, বালুরঘাট ও কুচবিহারের সীমান্ত এলাকায়। পরে তা বাংলাদেশি টাকা, ডলার বা ইউরোতে পরিবর্তন করে জামায়াতের এজেন্টদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ।
এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমেও বাংলাদেশে সারদা গ্রুপের টাকা লগ্নি হয়েছে বলে এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য মতে  জামায়াতের পরিচালনায় বাংলাদেশের বেশ কিছু হাসপাতাল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামে সারদা গ্রুপ  বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে।এই অর্থ জামায়াতের সহিংস আন্দোলন ও সাংগঠনিক কাজে খরচ করেছে বলে ভারতের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনের হেডলাইন-সারদার জল এবার গড়াল বাংলাদেশেও।বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করতে কাজে লাগানো হয়েছে সারদার কোটি কোটি টাকা। আর তার সঙ্গে জড়িত তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান। এ ব্যাপারে ভারতের কাছে সরকারি ভাবে অভিযোগও জানিয়েছে বাংলাদেশ।
এই ঘটনার তদন্ত চেয়ে সরব হয়েছেন বাংলাদেশের জামাত-উপদ্রুত দুই এলাকা রাজশাহি ও সাতক্ষীরার দুই সাংসদ। যদিও ইমরান নিজে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, জামাতের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের জামাতে ইসলামীর ‘নিবিড় যোগাযোগের’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করতে কাজে লাগানো হয়েছে সারদার কোটি কোটি টাকা। আর তার সঙ্গে জড়িত তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান। এ ব্যাপারে ভারতের কাছে সরকারিভাবে অভিযোগও জানিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে উদ্ধৃত করে তারা আরো বলেছে, তৃণমূল কংগ্রেসের একজন সাংসদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পৌঁছানো হয় জামায়াতের হাতে।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের গোয়েন্দা প্রতিবেদনও এই বক্তব্যকে অনেকটাই সমর্থন করছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে অবশ্য এই দাবিও করা হয়েছে যে, ইমরানের মাধ্যমে অর্থের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকের বেশ কয়েকটি চালানও ভারত থেকে পৌঁছে গিয়েছিল জামাতের হাতে।
প্রথম পাতায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানের নাম উঠে এসেছে দুই দলের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধনকারী হিসেবে। যদিও ইমরান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
ইতোমধ্যে এসব অভিযোগের বিষয়ে নয়াদিল্লিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার পক্ষ থেকে নালিশ করা হয়েছে বলে আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে, ২০১২-১৩ সালে ইমরানের মাধ্যমে ভারত থেকে দফায় দফায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পৌঁছেছে জামাতে ইসলামী ও তাদের নানা শাখা সংগঠনের হাতে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার জামাতের প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা শুরু করার পরে বাংলাদেশে দাঙ্গা, নাশকতা ও সন্ত্রাস শুরু করেছিল মৌলবাদীরা। সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ করার হুঁশিয়ারি দিলে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে বকলমে আরও একটি মৌলবাদী সংগঠন গজিয়ে ওঠে। তারা ঢাকা অবরোধ করে সরকার ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল। গোয়েন্দা সূত্র অনুসারে, সেই কাজে ইন্ধন জোগাতেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। যার একটা বড় অংশ সারদা অর্থলগ্নি সংস্থার।
ঢাকার অভিযোগের সত্যতা নয়া দিল্লি পেয়েছে, যার ভিত্তি ভারতের গোয়েন্দা প্রতিবেদন।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ইমরানের মাধ্যমে অর্থের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকের বেশ কয়েকটি চালানও ভারত থেকে জামাতের হাতে দেয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারদার বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্সে কাঁচা টাকার বান্ডিল ভরে তা নিয়ে যাওয়া হতো বনগাঁ, বসিরহাট, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট ও কোচবিহারের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে। পরে তা বাংলাদেশি টাকা, ডলার বা ইউরোতে পরিবর্তন করে জামাতের এজেন্টদের হাতে তুলে দেয়া হয়। তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষও ইডি-কে লেখা চিঠিতে সারদার অ্যাম্বুলেন্সে করে বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীর কাছে টাকার বান্ডিল চালান যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এছাড়া, হাওয়ালা ও হুন্ডির মাধ্যমেও গিয়েছে সারদার টাকা। বাংলাদেশের গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, জামাত পরিচালিত বেশ কিছু হাসপাতাল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেনামে লগ্নিও করেছে সারদা। সেই অর্থও কার্যত জামাতের ‘জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে’ খরচ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই বাংলাদেশের জামাতে ইসলামীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু উর্দুভাষী নেতার দহরম মহরম শুরু হয়। ২০১১-র ভোটে সীমান্ত এলাকায় জামায়াত কর্মীরা তৃণমূলের হয়ে কাজ করে। সে সময়ে তৃণমূলকে অর্থেরও জোগান দিয়েছিল জামাতে ইসলামী।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেই সুসম্পর্ক থেকেই পরবর্তী কালে জামাতকে তৃণমূল শুধু পাল্টা সাহায্যই করেনি, তিস্তাচুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি আটকে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকেও বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশ সংক্রান্ত নীতির বিষয়ে মমতা বরাবর জামাতের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রাখা উর্দুভাষী নেতাদের মতামতই মেনে চলেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
এসব কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্তন সিমি নেতা, বর্তমান তৃণমূল সাংসদ ইমরানকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি।
দলের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ আনন্দবাজারকে বলেন, সিমিকে নিষিদ্ধ করার সময়ে মমতা কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন। তিনি সবই জানতেন। তার পরেও কেন তিনি ইমরানকে রাজ্যসভায় পাঠালেন?
তার দাবি, জামায়াতের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই তৃণমূল নেত্রী এই প্রার্থী বাছাই করেছেন। মমতার এই কাজকে ‘দেশদ্রোহ’ বলে মন্তব্য করে ওই বিজেপি নেতার অভিযোগ, এক জন মুখ্যমন্ত্রীর এমন কাজের জন্য রাজ্যে জঙ্গি ও দুষ্কৃতীরা সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে।কী বলা হয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা রিপোর্টে?
সে দেশের তদন্তকারীদের দাবি, ২০১২-’১৩ সালে ইমরানের মাধ্যমে ভারত থেকে দফায় দফায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পৌঁছেছে জামাতে ইসলামি ও তাদের নানা শাখা সংগঠনের হাতে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ সরকার জামাতের প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা শুরু করার পরে বাংলাদেশে দাঙ্গা, নাশকতা ও সন্ত্রাস শুরু করেছিল মৌলবাদীরা। সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ করার হুঁশিয়ারি দিলে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে বকলমে আরও একটি মৌলবাদী সংগঠন গজিয়ে ওঠে। তারা ঢাকা অবরোধ করে সরকার ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল। গোয়েন্দা সূত্র অনুসারে, সেই কাজে ইন্ধন জোগাতেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। যার একটা বড় অংশ সারদা অর্থলগ্নি সংস্থার।
ভারতের গোয়েন্দা রিপোর্টও এই বক্তব্যকে অনেকটাই সমর্থন করছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা রিপোর্টে অবশ্য এই দাবিও করা হয়েছে যে, ইমরানের মাধ্যমে অর্থের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকের বেশ কয়েকটি চালানও ভারত থেকে পৌঁছে গিয়েছিল জামাতের হাতে।
কী ভাবে?
ভারতের গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, সারদার বেশ কিছু অ্যাম্বুল্যান্সে কাঁচা টাকার বান্ডিল ভরে তা নিয়ে যাওয়া হতো বনগাঁ, বসিরহাট, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট ও কোচবিহারের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে। তার পরে তা বাংলাদেশি টাকা, ডলার বা ইউরোয় পরিবর্তন করে জামাতের এজেন্টদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষও ইডি-কে লেখা চিঠিতে সারদার অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাংলাদেশে জামাতে ইসলামির কাছে টাকার বান্ডিল চালান যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া, হাওয়ালা ও হুন্ডির মাধ্যমেও গিয়েছে সারদার টাকা। বাংলাদেশের গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, জামাত পরিচালিত বেশ কিছু হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেনামে লগ্নিও করেছে সারদা। সেই অর্থও কার্যত জামাতের ‘জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন’-এই খরচ হয়েছে।
রাজশাহির সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিজেদের নেতাদের বিচার বানচাল করতে বাংলাদেশ জুড়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস শুরু করেছিল জামাতে ইসলামি। রেললাইন উপড়ে, বাস-ট্রেন জ্বালিয়ে অজস্র মানুষকে হত্যা করা হয়। প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে তাঁদের প্রতিরোধ করেন। বাদশা বলেন, “বিশেষ করে রাজশাহি ও সাতক্ষীরার মতো সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে এই সন্ত্রাস মাত্রাছাড়া হওয়ায় ভারত থেকে থেকে অস্ত্র-বিস্ফোরক ও অর্থ আসার বিষয়ে আমরা সন্দিহান হই। পরে পুলিশ ও আধাসেনারা এই সব জায়গায় অভিযান চালিয়ে বহু মৌলবাদীকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকেই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।”
সাতক্ষীরার সাংসদ মুস্তাফা লুৎফুল্লা বলেন, “জামাতের দুষ্কৃতীরা পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। সেখানে শাসক দলের নেতারা তাদের আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করছে বলে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট খবর আছে। সন্ত্রাসের সময়েও সীমান্ত-পার থেকে নিয়মিত অর্থের জোগান পেয়েছে মৌলবাদীরা।”
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই বাংলাদেশের জামাতে ইসলামির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু উর্দুভাষী নেতার দহরম মহরম শুরু হয়। ২০১১-র ভোটে সীমান্ত এলাকায় জামাত কর্মীরা তৃণমূলের হয়ে কাজ করে। সে সময়ে তৃণমূলকে অর্থেরও জোগান দিয়েছিল জামাতে ইসলামি। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেই সুসম্পর্ক থেকেই পরবর্তী কালে জামাতকে তৃণমূল শুধু পাল্টা সাহায্যই করেনি, তিস্তা চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি আটকে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকেও বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ সংক্রান্ত নীতির বিষয়ে মমতা বরাবর জামাতের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রাখা উর্দুভাষী নেতাদের মতামতই মেনে চলেছেন বলে গোয়েন্দা রিপোর্টের দাবি।
বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের মতে, শেখ হাসিনার আমলে ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক যতটা মধুর হয়েছে, ততটাই তেতো হয়েছে কলকাতার সঙ্গে। এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন তিস্তা ও স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে মমতার কট্টর বিরোধিতাকে। ওই পদস্থ কূটনীতিকের দাবি, তৃণমূলের জামাত-ঘনিষ্ঠ নেতারাই মমতাকে এ কাজে প্রভাবিত করতে সফল হয়েছেন। ওই নেতারাই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা জামাতের দুষ্কৃতীদের কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় মাসের পর মাস আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়টিও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। ওই কূটনীতিকের অভিযোগ, তার পরেও সেই সব আশ্রয়শিবির কিন্তু বহাল রয়েছে। গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে এই সব অনুপ্রবেশকারী জামাত কর্মীরা তৃণমূলের হয়ে কাজ করেছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।
এই সব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতেই প্রাক্তন সিমি নেতা, বর্তমান তৃণমূল সাংসদ ইমরানকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। দলের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এ দিন বলেন, “সিমি-কে নিষিদ্ধ করার সময়ে মমতা কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন। তিনি সবই জানতেন। তার পরেও কেন তিনি ইমরানকে রাজ্যসভায় পাঠালেন?” তাঁর দাবি, জামাতের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই তৃণমূল নেত্রী এই প্রার্থী বাছাই করেছেন। মমতার এই কাজকে ‘দেশদ্রোহ’ বলে মন্তব্য করে ওই বিজেপি নেতার অভিযোগ, এক জন মুখ্যমন্ত্রীর এমন কাজের জন্য রাজ্যে জঙ্গি ও দুষ্কৃতীরা সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে।

পাকিস্তানের নৌ-ঘাঁটিতে আল-কায়েদার দক্ষিণ এশিয়া শাখার হামলা:৩ নৌ-কর্মকর্তা আটক


পাকিস্তানের করাচিতে নৌ-ঘাঁটিতে গত মঙ্গলবার হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদার দক্ষিণ এশিয়া শাখা। গত মঙ্গলবার করাচি নৌ-ঘাঁটিতে পরিচালিত ওই হামলায় এক নৌ কর্মকর্তা ও তিন হামলাকারী নিহত হন।গতকাল বৃহস্পতিবার সংগঠনটি দাবি করে, এই হামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তারা তাদের সহযোগিতা করেছেন। এ ঘটনায় কোয়েটার লাক পাস এলাকা থেকে সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আল-কায়েদার ভাষ্যমতে, তাদের দক্ষিণ এশীয় নতুন শাখার এটাই প্রথম হামলা।এর আগে ২০১১ সালে করাচির নৌঘাঁটিতে ১৭ ঘণ্টা ধরে চালানো হামলায় আল-কায়েদা জড়িত ছিল। সেই হামলায় ১০জন নিহত ও মার্কিন দুটি গোয়েন্দা বিমান ধ্বংস করা হয়।
গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল -জাওয়াহিরি সংগঠনটির এই নতুন শাখা খোলার ঘোষণা দেন। আজ শুক্রবার এএফপি ও ডন ডটকমের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাওয়াজা আসিফ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গত বুধবার পার্লামেন্টে বলেন, ‘এ ঘটনায় যে অভ্যন্তরীণ লোকজন জড়িত, তা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। কারণ তাদের সহযোগিতা ছাড়া দুর্বৃত্তদের পক্ষে এই নিরাপত্তাবেষ্টনী ভাঙা সম্ভব নয়।’
আল-কায়েদার পক্ষ থেকে গতকাল এএফপিকে পাঠানো উর্দু ভাষায় লেখা এক বিবৃতিতে বলা হয়, করাচির উপকূলে ওই হামলা আল-কায়েদা চালিয়েছে।
দেশটির একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ডন ডটকমকে বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কোয়েটার আশপাশে অভিযান চালিয়ে সন্দেহজনক অবস্থায় তিন নৌ কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। তবে তাঁদের পদমর্যাদা কী, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি ওই কর্মকর্তা। আটক হওয়া ওই তিন কর্মকর্তাকে উড়োজাহাজে করে করাচিতে পাঠানো হয়েছে। আফগানিস্তানে পালানোর সময় তাঁদের আটক করা হয়। ওই কর্মকর্তা জানান, ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের পর ওরমারা ও করাচি থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকজনকে আটক করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।

Wednesday, September 10, 2014

এই বইটির প্রকাশ কি একটি সমন্বিত চক্রান্তের অংশ?- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলায় একটা কথা আছে, দশ চক্রে ভগবান ভূত। আমাদের অব. এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বেলায় কথাটা সঠিক মনে হয়। ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ শীর্ষক যে বইটি তার নামে বের করা হয়েছে, এটিও দশ চক্রের কাজ বলে আমার অন্য এক লেখায় উল্লেখ করেছি। আমার এই অনুমানের কারণ, এ কে খন্দকার ব্যক্তিগতভাবে একজন ভাল মানুষ। তাঁর মাথায় এই শেষ বয়সে এই ভূত চাপল কেন? এবং নিজে ভূত হতে গেলেন কেন?
একটু খোঁজখবর নিতেই জানলাম, তিনি সত্যিই দশ চক্রের কবলে পড়েছেন। এই চক্রটি লন্ডন থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই চক্রে বিএনপি, জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধীরা তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের সাবেক সমর্থক একটি গোষ্ঠীও রয়েছে। আমাকে প্রথম এ সম্পর্কে সতর্ক করেন লন্ডনে বসবাসকারী এক পাকিস্তানী সাংবাদিক বন্ধু। তিনি আমাকে বলেন, প্রচুর অর্থ-তহবিল নিয়ে মুজিব-বিরোধী একটি প্রোপাগান্ডা শুরু হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশ এবং পাকিস্তানও এই অর্থের যোগানদার।
আমি তাঁর কথা প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কারণ, বঙ্গবন্ধু এখন জীবিত নেই। ক্ষমতায় আসীন শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ। চক্রান্ত ও প্রচার অভিযান চালাতে হলে তো এঁদেরই টার্গেট হওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে টানাটানি করে লাভ হবে কি? পাকিস্তানের সাংবাদিক বন্ধু বললেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ এতদিনে বুঝে ফেলেছে যে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শক্তির ভিত্তি শেখ মুজিব। তাঁকে হত্যা করেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি। এখন তাঁর চরিত্র হত্যা দ্বারা ইতিহাস এবং বাংলার মানুষের মন থেকে তাঁকে মুছে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। তা যদি করা যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের শক্তির ভিত্তি ধ্বংস হবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেও বিতর্কিত করা যাবে।
এর পরেও আমি কথাটা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করছি না দেখে তিনি বললেন, শীঘ্রই দেখতে পাবে এই লন্ডন থেকেই মুজিব-বিরোধ প্রোপাগান্ডার অভিযান শুরু হয়েছে। শেখ মুুজিবুর রহমানকে হেয় করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের কিছু জামায়াতিমনা বাঙালী ও পাকিস্তানী স্কলারকে ভাড়া করা হয়েছে। তাঁরা তারেক রহমানকে সহায়তা যোগাবেন। তারেক রহমানের বিদ্যাবুদ্ধি না থাকলেও এদের সাহায্যে তিনি নতুন ইতিহাসবিদ সাজবেন। নতুন নতুন ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার করে শেখ মুজিবকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হবে।
আমি পাকিস্তানের সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছি, তাঁদের এই চেষ্টা সফল হবে না। বাংলাদেশে যতই দিন যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ততই নতুনভাবে জীবিত হয়ে উঠছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তিনি এখন বিশ্বময় স্বীকৃত। সাংবাদিক বন্ধু বললেন, এ কথা মুজিব-বিরোধী প্রচারক গোষ্ঠীও জানে। তাই তাদের প্রচারণা ধোপে টিকবে না, এ কথা বুঝতে পেরে তারা শেখ মুজিবের এককালের অনুসারী এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্য থেকেও কিছু লোককে নানাভাবে প্রলোভিত করে এই প্রচারণায় যুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন। যাঁরা শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন, শুধু তাঁরা কোন কথা বললে সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে, এই ধারণা থেকেই প্রচারণাটি শুরু করা হচ্ছে।
বেশ কিছুকাল আগে এক পাকিস্তানী সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে এই টিপ্্সটি পাওয়ার পরেও আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোন অসত্য প্রচারণা হঠাৎ গজিয়ে উঠতে পারে; বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন ব্যক্তি বা তাঁর অনুগামী ছিলেন এমন কেউ এই প্রচারণায় যোগ দিতে পারেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি প্রথম সচকিত হই, আমার এক অনুজপ্রতিম বন্ধু, বাংলা একাডেমি কর্তৃক গবেষক হিসেবে স্বীকৃত ফারুক আহমদের (লন্ডনে বসবাসকারী) হাতে একটি বই দেখে। ইংরেজী উপন্যাস, নাম ব্ল্যাক কোট। লেখকের নাম আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। একটি পশ্চিমা প্রকাশনা সংস্থা বইটি বের করেছে।
ফারুক আমাকে বললেন, এই বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত নোংরাভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। এটির প্রতিবাদ করা দরকার। আমি তাঁকে বলেছি, নোংরা জিনিস ঘাঁটতে নেই। কোথাকার কোন্ যদু মধু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লিখছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের উচিত এগুলো উপেক্ষা করা। আকাশের দিকে থুথু ছিটালে তা নিজের গায়েই পড়ে। আকাশকে স্পর্শ করে না। এর কিছুদিন পরেই জানতে পারি, এই বইয়ের প্রকাশনার অর্থায়নের পেছনে জামায়াত এবং তাদের বিদেশী পেট্রনরা রয়েছেন।
তারপর দু’দিন না যেতেই লন্ডনের সভায় ইতিহাসবিদ সেজে জিয়াপুত্র তারেক রহমানের আবির্ভাব। টার্গেট বঙ্গবন্ধু। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার এই অকাল কুষ্মা- পুত্রটি যে মিথ্যাচারের রেকর্ড ভঙ্গ করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বৈধ প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন তাঁর পিতা জিয়াউর রহমান, ২১ আগস্টের (২০০৪) শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলার জন্য শেখ হাসিনাই দায়ী ইত্যাদি লোক হাসানো অসংখ্য ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার করে তিনি কিছুদিনের জন্য বাজার গরম করে তোলেন।
জামায়াত ও তারেকের এই প্রচার অভিযানের পাশাপাশি যখন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন রিপি ‘পিতা ও নেতা’ নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করেন, তখন আমি আরও সচকিত হই। পাকিস্তানী সাংবাদিক বন্ধুর সতর্ক বাণীটি আমার স্মরণ হয়। কথায় বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। এই বিভীষণ যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবিরেও তৈরি করা হয়েছে তা আমি বুঝতে পারি।
তাজউদ্দীন ভাই ও জোহরা ভাবীর প্রতি শ্রদ্ধাবশত আমি কখনও তাঁর এই কন্যাটিকে নিয়ে কিছু লিখতে চাইনি। এমন কি তাঁর বইটি পড়ার পরেও চাইনি। কারণ, এই ধরনের ট্র্যাশ-বই দেশের শিক্ষিত মানুষের কাছে কোন গুরুত্ব পাবে না এই ধারণা আমি করেছি এবং আমার ধারণা সত্য হয়েছে।
রিপি নিজে বিভ্রান্ত এবং বিতর্কিত। নিজের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে তিনি স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের দ্বারা স্ট্যালিনকন্যা সেভেটলানার মতো যে ব্যবহৃত হয়েছেন তা সম্ভবত বুঝতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা প্রয়াত স্ট্যালিনের নামে অনেক সত্য-মিথ্যা প্রচার চালিয়েও যখন স্ট্যালিনের ভাবমূর্তিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারেনি তখন তাঁর কন্যা সেভেটলানকে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মার্কিন মুল্লুকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেভেটলানা তাঁর পিতা স্ট্যালিন যে কত বড় মনস্টার ছিলেন তা প্রচার করতে থাকেন। তাজউদ্দীনকন্যা রিপি জাতির পিতার ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে তাঁর নিজের পিতার ভাবমূর্তিতেও কালিমা লেপন করেছেন তা হয়ত বুঝতে পারেননি। কারণ, তিনি এ কে খন্দকারের মতো দশ চক্রে ভূত হয়েছেন। এই দশচক্রীদের একজনের কাছে তিনি আবার তাঁর বইতে বইটি লেখার ব্যাপারে সাহায্য লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশও করেছেন। আমি সেই নামটি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অন্ধ ক্রোধের কারণ সম্পর্কে এখানে আর লেখালেখি করতে চাই না। তা কালি-কলমের অপচয়।
আজ কোথায় সেভেটলানা, আর কোথায় তাঁর বই? সিআইএ’র এত পেট্রোনাইজেশন সত্ত্বেও স্ট্যালিনকন্যা সেভেটলানা আজ সম্পূর্ণ বিস্মৃত এবং তাঁর বইটি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। বাংলাদেশে রিপির বইটি তো বাজারে বেরুতে না বেরুতেই বিস্মৃতপ্রায়। বঙ্গবন্ধু-বিরোধী প্রচারণায় দশ চক্র যখন দেখলেন, তাদের নিক্ষিপ্ত এই তীরটিও কোন কাজে লাগেনি তখন মঞ্চে প্রায় নিখোঁজ এক ব্যক্তিকে হাজির করা হয়। তার নাম সিরাজুল আলম খান। ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিকল্পনায় সাহায্যদানের জন্য গঠিত নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন। কিন্তু লেখাপড়া না করে প-িত সাজার ভ-ামি তার রাজনৈতিক জীবন ব্যর্থ করে দেয়।
অতি উচ্চাকাক্সক্ষা তাকে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের ষড়যন্ত্রেও সহযোগী করেছে বলে অনেকের ধারণা। দাড়ি-গোঁফ রেখে কিছুদিন তিনি কার্ল মার্কস সাজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাজারে তার নাম হয় কাপালিক। তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সমর্থক। কিন্তু এক সময় তার প্রায় স্থায়ী ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায় নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন। কিছু চটি বই লিখে তিনি তাত্ত্বিক সাজার চেষ্টা করেছিলেন, তাও ব্যর্থ হয়।
বঙ্গবন্ধু-বিরোধী তারেকের প্রচারণার পাশাপাশি দেখা গেল হঠাৎ সিরাজুল আলমেরও আবির্ভাব। তিনি তারেকের মতোই হঠাৎ ঐতিহাসিক সেজে ছোট ইস্তাহার বিলি করে সকলকে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি তারাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণটি দিচ্ছিলেন তখন কোন কোন কথা তিনি যাতে ভুলে না যান, সেজন্য তাঁর পাঞ্জাবির কোণা ধরে চাপ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এভাবে শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকেও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা হয়।
সিরাজুল আলম খান এ রকম দাবি করে বিকৃত মানসিকতা ও বুদ্ধিও সম্ভবত আমেরিকা থেকে পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনসের ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ ভাষণ সম্পর্কেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। কি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের শেষে লিঙ্কনস একটি ট্রেনে চেপে গেটিসবার্গে আসছিলেন । তখন তিনি একটি পুরনো পোস্টকার্ডের মধ্যে এই ভাষণের খসড়াটি লেখেন। তারপর গেটিসবার্গে উপস্থিত হয়ে ভাষণটি দেন।
প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনস আততায়ীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুবরণের পর তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাবি করে বসেন, গেটিসবার্গের ভাষণের মুসাবিদাটি ট্রেনে বসে তিনিই লিখে দিয়েছিলেন। তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। পরে প্রমাণিত হয়, ওই বন্ধু লিঙ্কনসের ভাষণের খসড়া লেখা দূরের কথা, ওইদিন লিঙ্কনসের সঙ্গে ট্রেনেই ছিলেন না।
সিরাজুল আলম খানদের বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবির কোণা ধরে টানাটানির গল্প শুনে মনে প্রশ্ন জাগে, এগুলো কি মানসিক বিকৃতির ফল, না কোন বৃহত্তর চক্রান্তের অংশ? আমার ধারণা, এক বৃহত্তর চক্রান্তের অংশ। চক্রান্তগুলো কি পরস্পর বিচ্ছিন্ন, না সমন্বিত? এই প্রশ্নের জবাব ঘটনাপ্রবাহ থেকেই বোঝা যাবে।
বঙ্গবন্ধু এখন বিশ্বময় ‘ফাউন্ডার ফাদার অব বাংলাদেশ’ নামে স্বীকৃত। বিবিসি রেডিওর জনমত সমীক্ষায় তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে নন্দিত। তাঁর ওপর একটি ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘The speeches that inspired history’ বইতে বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর একটি ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধু আজ স্বগৌরবে ও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ঠিক এই সময়ে তাঁকে হেয় ও বিতর্কিত করা না গেলে তাঁকে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আর নস্যাত করা যাবে না। শত্রুপক্ষের এই ভয়ভীতি থেকেই অকস্মাৎ বঙ্গবন্ধু-বিরোধী প্রচারণার শুরু বলে অবশ্যই ধারণা করা চলে।
প্রায় একই সময়ে এই প্রচারণাটি শুরু করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ব্ল্যাক কোট নাম দিয়ে বই প্রকাশ (নেপথ্যে জামায়াত), তারেকের বঙ্গবন্ধু-বিরোধী প্রচার অভিযান ও ইতিহাস বিকৃতি, তাজউদ্দীনকন্যার বই প্রকাশ এবং সর্বশেষে অব. এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের এই বই। মনে হবে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে অনেক মাথার সমন্বিত প্রয়াস তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। খন্দকারের বইটির প্রকাশক-‘প্রথমারই’ বা আসল চেহারা ও উদ্দেশ্য কি?

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি বলেছেন, “ইতিহাস লেখা সহজ নয়। অতীতের ইতিহাস দশটা বই ঘেঁটে লেখা যায়। কিন্তু সমসাময়িক ঘটনার সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা দুরূহ।” নিজের একটি অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি দিয়েছেন। একটি জেলের সামনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। দুই প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে তিনি একই বিবরণ শোনেননি। কিছু দূরে গিয়ে তিনি ঘটনাটির বিবরণ অন্য লোকদের মুখে শুনতে পান, তা আগে শোনা বিবরণগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়েও এখন বিপরীত (বিকৃত) বিবরণ লেখায় একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এবং তাতে উৎসাহ যোগানোর জন্য পেট্রো ডলারের ছড়াছড়ি চলছে লন্ডন থেকে ঢাকা পর্যন্ত। কিন্তু এই ফাঁকে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) এ কে খন্দকারের মতো লোক নিজেকে জড়াতে পারেন তা ছিল আমার কাছে অবিশ্বাস্য। তাঁর মধ্যেও ড. জেকিলের সঙ্গে একজন মি. হাইড লুকিয়ে আছে তা কে জানত?
বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য দেশের বাম ও ডান রাজনীতির, এমনকি বঙ্গবন্ধুর এককালের একশ্রেণীর ঘনিষ্ঠ মানুষের এই নিরন্তর প্রচেষ্টা কেন তা আমি অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। ভাষা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর কোন অবদান ছিল না এটা প্রমাণ করার জন্য বদরুদ্দীন উমর আদা পানি খেয়ে লেগেছিলেন। সফল হননি। এখন শুরু হয়েছে, স্বাধীনতার যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ও অবদান নিয়ে চারদিক থেকে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা এবং ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াস।
ইতিহাস বিকৃতির এই অবিরাম চেষ্টা যে অসৎ এবং উদ্দেশ্যমূলক তা বোঝা যায়, এই মিথ্যা তত্ত্ব ও তথ্যগুলোকে ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ দ্বারা বার বার মিথ্যা বলে প্রমাণ করার পরও বিভিন্ন মহল থেকে একই মিথ্যার পুনরুক্তি করা চলছে। গোয়েবলসের মতো এদের সম্ভবত ধারণা, ‘‘একটা মিথ্যাকে বার বার বলা হলে তা সত্য হয়ে যায়।” এ কে খন্দকারকে এ তত্ত্বটি কারা বুঝিয়েছেন এবং এই বইটি তাঁর নামে লেখানোর জন্য নেপথ্যে বসে কলকাঠি নেড়েছেন, তা এখন আমার জানা হয়ে গেছে। নামোল্লেখ করে তাঁদের নিয়ে আলোচনা করতে চাই না এ জন্যে যে, তাঁরা আলোচনায় আসার মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নহেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন শীর্ষ সংগঠক হিসেবেই একে খন্দকার ইতিহাসে বেঁচে থাকতে পারতেন। কিন্তু কিছু হনুমান-বন্ধুর পরামর্শে পড়ে তিনি নিজেই নিজের মুখে কালি মাখলেন। নিজের ব্যক্তিত্বে দৃঢ় থাকতে পারলে এ কাজটি তিনি করতে পারতেন না। মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও নেতৃত্বের প্রতি তাঁর যে কোন কালেই আস্থা ছিল না তাঁর এই বইটি পড়লে তা বোঝা যায়। পাকিস্তানের হানাদারদের হাতে নিহত হওয়ার ভয়ে জিয়াউর রহমানের মতো তিনিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আগে বোঝা যায়নি। এই বইটি পড়ে এখন এয়ার ভাইস মার্শালের (অব) চরিত্রটি বোঝা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং পরেও তিনি ‘দোদিল বান্দা’ ছিলেন। প্রয়াত রুহুল কুদ্দুস সাহেব বলেছেন, “১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রমনা রেসকোর্সের মাঠে যৌথ কমান্ডের নেতা জেনারেল অরোরার কাছে হানাদারদের নেতা জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের সময়ের কথা। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন এ কে খন্দকার। কিন্তু তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টার প্রস্তুত। তাজউদ্দীন সাহেব রুহুল কুদ্দুসকে পাঠালেন খন্দকারকে খুঁজতে।
রুহুল কুদ্দুস তাঁর বাসায় গিয়ে দেখেন, তিনি তখনও সেখানে। ঢাকায় যেতে গড়িমসি করছেন। রুহুল কুদ্দুস তাঁকে তাড়া দিতেই খন্দকার বললেন, তিনি তো এখনও পোশাকটোশাকও পরেননি। রুহুল কুদ্দুস বললেন, দরকার নেই পোশাক পরার। দেরি করলে রমনার মাঠে ঠিক সময় পৌঁছতে পারবেন না। রুহুল কুদ্দুসই তাঁকে টেনেহিঁচড়ে হেলিকপ্টারে তুলে দেন। ঢাকা যাত্রার জন্য তখন হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরছে।
আমাদের এই ড. জেকিলের মধ্যে যে মি. হাইডও লুকিয়ে আছেন তার আরও বড় প্রমাণ আছে। শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে রেসকোর্স ময়দানে ‘শিখা চিরন্তন’ প্রজ্বলন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি ঐতিহাসিকতা লাভ করে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং সম্ভবত ইয়াসির আরাফাতেরও উপস্থিতি দ্বারা। কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররাও এই অনুষ্ঠানে থাকবেন। কিন্তু দেখা গেল অনুষ্ঠানে একে খন্দকার নেই।
তিনি তখন আওয়ামী লীগের একজন এমপি। অন্য সেক্টর কমান্ডাররা অনুষ্ঠানে এসেছেন, খন্দকার আসেননি দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি খন্দকারের খোঁজে লোক পাঠালেন। খন্দকার পতœীকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তিনি গাড়িতে পাবনা যাত্রা করছেন। এখন হয়ত অর্ধপথে আছেন। তাঁকে আর অনুষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা যায়নি। এই অনুষ্ঠান এড়ানোর জন্যই যে দিনক্ষণ ঠিক করে তিনি পাবনা চলে যান তা পরে ধরা পড়ে। এই হলো ‘ছহি বড় দ্বিতীয় খন্দকারনামা।’
ইংরেজদের টাকা খেয়ে যেসব বাঙালী ইতিহাসবিদ সেকালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করেছিল, পরবর্তীকালে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাঁদের আখ্যা দিয়েছিলেন ‘পুওর লায়ার’ বা হতভাগ্য মিথ্যাবাদী। বর্তমানে আমাদের অবসরভোগী এয়ার ভাইস মার্শালও যে এই পুওর লায়ারদের দলে পড়েন তার প্রমাণ জিয়াউর রহমানের আমলে সঙ্কলিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিল দস্তাবেজ’ নামে যে কয়েকখ- বই রয়েছে, সেগুলোকেও তিনি উপেক্ষা করেছেন।
এই দলিল-দস্তাবেজের দ্বিতীয় খ-ের ৬০৯ পৃষ্ঠায় রয়েছে, রমনা রেস কোর্সের ৪ জানুয়ারি ১৯৭১-এর জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ এবং ওই বইয়ের (২য় খ-) ৭০২ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলে শেষ করেন। ইতিহাসের দলিল যে কথা বলে না, লাখ লাখ মানুষ সেদিনের জনসভায় যে কথা শোনেনি, সে কথা ওই সভায় হাজির না থেকেও খন্দকার সাহেব শুনেছেন। তিনি নাকি সেক্টর্স কমান্ডার্স ফোরামের বর্তমান সদস্য সচিব হারুন হাবিবের কাছে টেলিফোনে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে যে জয় পাকিস্তান বলেছেন, তা নাকি রেডিওতে শুনেছেন। কোন্ রেডিওতে তা শুনেছেন? ৭ মার্চ তারিখে ভাষণটি ঢাকা রেডিওতে প্রচারিত হয়নি। হয়েছে পরদিন সকালে। এই সকালের রেডিওতে প্রচারিত ভাষণটিও লাখ লাখ মানুষ শুনেছে। আমিও শুনেছি। ভাষণটি জয় বাংলা বলে শেষ হয়েছে। তাহলে খন্দকার সাহেব এত বড় ডাহা মিথ্যা কথাটি এই বয়সে বলতে গেলেন কাদের স্বার্থে, কী উদ্দেশ্যে?
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ইন্টারনেটে এখনও শোনা যায়। আমি এই নিবন্ধ লেখার সময় আবার শুনেছি। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে একবারও পূর্ব পাকিস্তান কথাটি ব্যবহার করেননি। বলেছেন পূর্ব বাংলা। যে নেতা তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান কথাটি পর্যন্ত ব্যবহার করেননি; করেছেন পূর্ব বাংলা; তিনি বক্তৃতা শেষে জয় পাকিস্তান বলবেন, এটা কোন গাঁজাখোরও বিশ্বাস করবে কি?
আমার কাছে আরও বিস্ময় লেগেছে আমাদের গোলআলু পণ্ডিত ড. আনিসুজ্জামানের এই বইটি সম্পর্কে আত্মপ্রতারক ভূমিকা দেখে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র নামক গ্রন্থগুলোর সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য সচিব ছিলেন প্রয়াত হাসান হাফিজুর রহমান। এই সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন ড. আনিসুজ্জামানও। তাঁর সঙ্গে ড. সালাউদ্দীন, ড. মফিজুল্লা কবির, ড. এনামুল হক প্রমুখও ছিলেন। এই গ্রন্থটি সম্পাদনার সময় আমাদের গোলআলু পণ্ডিত কি দেখতে পাননি যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে যে দলিলপত্র তিনি নিজে সম্পাদনা করেছেন, তাতে কী বলা হয়েছে? ইতিহাসের দলিলপত্র সত্য নয়, কে সকালে ঘুমঘোরে রেডিওতে কী শুনে অথবা না শুনে অথবা বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীর মতো কেউ ৪ জানুয়ারির ভাষণে শোনা বঙ্গবন্ধুর কথাকে ৭ মার্চের কথা ভেবে বিভ্রান্তিতে ভুগে যে মন্তব্য করেছেন সেটাই সত্য হয়ে গেল?
(অব) এয়ার ভাইস মার্শালের বইটির প্রকাশক প্রথমা। এটি প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত প্রকাশনা সংস্থা। প্রথম আলো প্রকাশনা গ্রুপের অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা মতিউর রহমান শুধু বামপন্থী নন, একসময় বাকশালেরও সদস্য ছিলেন। তোফায়েল আহমেদের পায়ে ধরে তিনি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের নাম বাদ দিয়ে বাকশালের একটি ফ্রন্টে নিজের নাম ঢুকিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে কী ছিল, তা তিনি জানেন না তা নয়। তারপরও তাঁর প্রকাশনা সংস্থা থেকে এই বইটি বের হয় কী করে? বইটির তথ্য নিয়ে যখন দেশব্যাপী প্রতিবাদ হচ্ছে, তখন বইটিকে সংশোধন না করে দ্বিতীয় সংস্করণ বের করেন কিভাবে? এটা কি সৎ ব্যবসা?
এখানে পাঠকদের কাছে আমার মনের একটা সন্দেহের কথা বলি। যে কোন কুরুচিপূর্ণ বই-ই বাজারে একটু বেশি চলে। কলকাতায় একসময় ‘হরিদাসীর গুপ্ত কথা’ নামে বই শরৎ চন্দ্রের বইয়ের কাটতি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে সব বইয়ের তেমন কাটতি নেই, সেসব বইও চালানোর জন্য অসাধু ও অসৎ পুস্তক ব্যবসায়ীরা একটা কাজ করেন। বইটির হাজার হাজার কপি ছেপে বাঁধাই না করে গুদামে রেখে দেন। শুধু টাইটেল পেজগুলো বার বার ছাপেন। এক শ’-দু’শ’ বই প্রথম সংস্করণ লেখা টাইটেল পেজসহ বাজারে ছেড়ে দু’দিন পরই দ্বিতীয় সংস্করণ লেখা টাইটেল পেজ ছেপে গুদাম থেকে আরও এক শ’-দু’শ’ বই বাঁধাই করে বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়। বলা হয় বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত। আমাদের মতিউর রহমানও সম্ভবত বটতলার পুস্তক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুস্তক ব্যবসায়ের এই অসৎ প্রকরণটি শিখেছেন। এককালের একজন ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি অধঃপতিত হলে কোন্ পাতালে নামতে পারে, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সম্ভবত তার সবচাইতে বড় প্রমাণ।
[লন্ডন বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪।]
   


জঙ্গী আস্তানায় ৫ দিন- সুমি খান (বাগমারা থেকে ফিরে)

Arup Biswas Posted in Facebook

জঙ্গী আস্তানায় ৫ দিন ১ -সুমি খান (বাগমারা থেকে ফিরে) ॥
এবার গ্রেনেড হামলা
০ মহিলা জঙ্গীরা বোরকার ভেতরে বহন করবে গ্রেনেড
০ জেলখানার অনেক বিডিআর সদস্য জেএমবিতে যোগ দিয়েছে বলে তাদের দাবি
০ প্রথম সফলতা হিসেবে দাবি করছে ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাই

সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে বাস্তবোচিত রিপোর্ট তৈরীতে সুমি খানের এই রিপোর্টটার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের চলমান ঘটনা প্রবাহের আলোকে সাংবাদিক সুমি খানের উপস্থাপিত তথ্য গুলো যেন মিলে যায় অনেকটাই। সিরিজ ইনভেষ্টিগেটিভ রিপোর্টটি চার পর্বে ছাপা হয়েছে দৈনিক জনকন্ঠে বৃহষ্পতিবার ২৮ আগষ্ট ২০১৪ থেকে। আজ ছাপা হয়েছে শেষ পর্ব । পুরো রিপোর্টে সুমি খান তার পর্যবেক্ষন এবং জে এম বি সংশ্লিষ্টদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপ চারিতার ভিত্তিতে এমন কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন যার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে গত ক'দিনে ঢাকা শহরে ঘটে যাওয়া পর পর দুটি হত্যাকান্ড তেমন ঈঙ্গিতই দেয় ।  বড় পরিসরের রিপোর্টটি কারো কারো বিরক্তির কারন হবে জেনেও সবটা এক সঙ্গে পোষ্ট করছি।
=========================================================
বৃহস্পতিবার, ২৮ আগষ্ট ২০১৪, ১৩ ভাদ্র ১৪২১
জঙ্গী আস্তানায় ৫ দিন ১ ॥ এবার গ্রেনেড হামলা
০ মহিলা জঙ্গীরা বোরকার ভেতরে বহন করবে গ্রেনেড
০ জেলখানার অনেক বিডিআর সদস্য জেএমবিতে যোগ দিয়েছে বলে তাদের দাবি
০ প্রথম সফলতা হিসেবে দাবি করছে ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাই
সুমি খান (বাগমারা থেকে ফিরে) ॥ ২০০৪ সালে জেএমবি এবং বাংলা ভাইয়ের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে রাজশাহীর যে জনপদ প্রায় জনশূন্য হতে বসেছিল দশ বছর পর সেই জনপদ আবার আতঙ্কের অন্ধকার ভেদ করে আগের মতোই শান্ত-সুন্দর একটি গ্রাম। অন্যদিকে প্রশাসনের দাবি, তাদের নজরদারি এড়াতে জঙ্গীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায়। তবে বাংলা ভাইয়ের বর্বর নির্যাতন এবং হত্যার শিকার হয়েছিল যারা তাদের স্বজনদের এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলো। আর কখনও কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয় এমনই প্রত্যাশা নির্যাতিতদের। অন্যদিকে জেএমবির দাবি-তারা আবারও সংগঠিত এবং শক্তিশালী। যে কোন সময় বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে তারা প্রস্তুত।
বাগমারার খোদেজা বেগম অশীতিপর বৃদ্ধা। এখনও দু’চোখ তার জলে ভেসে যায়। কেন তার নিরীহ সন্তানকে এভাবে হত্যা করা হলো, সেই প্রশ্œ তাড়িয়ে ফেরে। এই প্রতিবেদকের কাছে বললেন সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাস। ইয়াকুব প্রামাণিক এবং খোদেজা বেগমের কনিষ্ঠ পুত্র মুকুল প্রামাণিক। ২৫ বছরের তরুণ। মুরগির খামারের ব্যবসা করত। হঠাৎ তাকে খামার থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মাথা নিচে দিয়ে পা দুটো গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে বর্বর নির্যাতন করে বাংলা ভাই এবং তার সহযোগীরা। মুকুলের মা শুনলেন তার ছেলেকে ‘সর্বহারা’ নিধনের নামে ধরে নেয়া হয়েছে। মাইকে শোনানো হলো মুকুলের গগনবিদারী আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ এখনও তাড়া করে ফেরে খোদেজা বেগমকে। এলাকায় কোন ভীতি নেই। জেএমবির কোন তৎপরতাও নেই। তবু সেই মৃত্যুভীতি তাড়া করে ফেরে এখনও তাকে। বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি হলেও এখনও কেন যেন ভয় কাটেনি খোদেজা বেগমের। বার বার শিউরে ওঠেন, আবার যদি বাংলা ভাইয়ের আর কোন সহযোগী পরিবারের অন্যদের ওপর ও রকম হামলা করে?
এই প্রতিবেদককে খোদেজা বেগম বললেন, “এলাকার অনেক মানুষকে বাংলা ভাই খুন করেছে। আমাদের কোনপাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় মুকুলকে। হামিরকুর্শে জেএমবির ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্পে রাত ৮টা পর্যন্ত মিটিং করেছে জেএমবির জঙ্গীরা। এর পর মাইকে ঘোষণা দিয়ে আমার ছেলেকে যেভাবে পিটিয়েছে, চোরকেও কেউ এমন করে পেটায় না। মাথা নিচে পা উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে এত মেরেছে যে মুকুলের ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গেছে। হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তার বলে, ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গেছে, তাকে আর বাঁচানো যাবে না। আমার ছেলেকে এমন করে খুন করল যারা তাদের বিচার আল্লাহই করবে। বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে যারা মাইকে ঘোষণা দিয়েছিল তারা এখনও এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। আমার তাই ভয় কাটে না। এরা আবার কোন আক্রমণ করবে না কে বলে?”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহীর পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, জেএমবির কোন আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে না। তাদের নজরদারি এড়িয়ে কোন জঙ্গী ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়। প্রতিসপ্তাহে পুলিশের রিপোর্ট যাচ্ছে এলাকায়, কোন জেএমবি নেই। কোথাও তাদের তৎপরতা সন্দেহজনক মনে হলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। জেএমবির সর্বশেষ দুটি মামলা বিচারাধীন ছিল, ২০১৩ সালে সেই দুটি মামলার নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে জানালেন রাজশাহীর এসপি।
জেএমবি এখন অনেক সংগঠিত এমন দাবি করছে জেএমবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সংগঠক। জেএমবির গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
এই জঙ্গী সংগঠক বলেন, আমরা অপেক্ষা করছি একটা হরতাল ডাকার জন্য। হরতাল ডাকলেই আমরা মাঠে নামব। হরতাল হলেই গ্রেনেড আক্রমণ হবে। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে প্রচুর শক্তিশালী অস্ত্র আছে। তবে তুলনামূলকভাবে গ্রেনেড আমাদের জন্য সুবিধাজনক । আমাদের মেয়েদের বোরকার ভেতরে করে গ্রেনেড নিলে অনেকটা নিরাপদেই অপারেশন সফল করা সম্ভব হয়।
এই মুহূর্তে কয়েক হাজার নারী সদস্য কাজ করছে বলে দাবি করলেন জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদীন বা জেএমবির এই সংগঠক। তিনি বলেন, তাদের এহসারদের স্ত্রীদেরও ‘দাওয়াতী’ হতে হয়। ‘দাওয়াতী’রা নির্দ্বিধায় দলের নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকে।
এই মুহূর্তে গায়েরী এহসারের সংখ্যা অনেক। এহসারও আগের চেয়ে অনেক বেশি বলে জানালেন জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এই সংগঠক। প্রতিটি বিভাগে ১০ জন করে গায়েরী এহসার কাজ করছে।
নিয়মিত কোন মোবাইল ব্যবহার করে না জেএমবি শূরা সদস্য বা গায়েরী এহসাররা। পুলিশ বা গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে তারা প্রতিদিনই সিম পাল্টায়।
তিনি বলেন,গত দুই বছর থেকে আমরা নতুন কৌশল নিয়েছি। আমাদের সঙ্গে বিডিআর জওয়ানরা যুক্ত হয়েছে কারাগারের ভেতর থেকেই। তাই আমরা এখন দক্ষ সংগঠক পেয়েছি। এই টিমের প্রথম সফলতা ত্রিশালে পুলিশভ্যান থেকে জঙ্গী ছিনতাইয়ের সফল অভিযান।
ত্রিশালে আমাদের ‘দাওয়াতী‘ বন্দীদের কারামুক্ত করে অপহরণ করার পরিকল্পনা কত সফলভাবে করেছি আমরা। এতে অন্তত রাষ্ট্র এবং সমাজের কাছে আমাদের শক্তি প্রমাণিত হলো । এই কাজে সফল হয়েছি। কারণ জেলখানার ভেতর বিডিআর- এর অনেক জওয়ান এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন আমাদের এহসার (জেএমবি) হয়ে গেছে। তারা খুব দক্ষতার সঙ্গে অপারেশন সফল করে দেয়। আগামীতেও আমরা এভাবে কিছু সফল অভিযান করব, নিশ্চিত।
নিকট ভবিষ্যতে আত্মঘাতী হামলার কোন পরিকল্পনা নেই বললেন জেএমবির এই নেতা।
২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা প্রসঙ্গে জেএমবির এই সংগঠক বলেন, ২১ আগস্টের অভিযান ব্যর্থ হওয়াতে হাসিনা বেঁচে গেলেন, আমাদেরও ফাঁসিয়ে দিলেন। তিনি সরকার গঠন করলেন । এই আশঙ্কা ছিল আমাদের । হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের প্রচ- চাপে রেখেছে। তবু আমরা অনেক সংগঠিত।
২০০৫ সালে এহসার ধরিয়ে দিলে ২ লাখ টাকা, আর ‘বাংলা ভাইকে ধরিয়ে দিলে ৫০ হাজার টাকা ঘোষণা করে খালেদা জিয়া। এ কারণে তার বিরুদ্ধে জেএমবির এহসারদের ক্ষোভ রয়েছে বলে জানান এই জঙ্গী নেতা।
হাসিনার অনেক প্রোটেকশন, তাকে এখন হত্যা করা কঠিন। তবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের টার্গেট। যাকে মারলে এই ‘তাগুতি সরকার’ প্রধান হাসিনাকে বিপদে ফেলা যাবে। বড় রকমের বিশৃঙ্খলা করা যাবে।
ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে তাদের ভাল যোগাযোগ রয়েছে। বিদেশী দাতা এবং দেশে জামায়াত-বিএনপির কিছু নেতা ও সংগঠনের কাছ থেকে নিয়মিত ডোনেশন পাচ্ছে জেএমবি। এই মুহূর্তে জেএমবির কোন ফান্ড সঙ্কট নেই বলে জানায় এই সংগঠক।
শুক্রবার, ২৯ আগষ্ট ২০১৪, ১৪ ভাদ্র ১৪২১
জঙ্গী আস্তানায় ৫ দিন ২ ॥ আগস্টেই বড় কিছু করার টার্গেট জেএমবির -
২০০১ থেকে ২০০৫ সময়ে বিএনপির প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপির নেতৃত্বে উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত জনপদের নিরক্ষর এবং দরিদ্র-প্রান্তিক মানুষকে জঙ্গীবাদে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। জঙ্গী সংগঠন জেএমবির নীতি অনুযায়ী ধর্মের ব্যাখা বা হারাম-হালালের সংজ্ঞায় যা বলা হয়েছে তাই এই জঙ্গীদের কাছে ধ্রুব সত্য। স্পষ্ট উচ্চারণ তাদের-ওসামা বিন লাদেন তাদের দীক্ষাগুরু। তালেবানী শিক্ষাই তাদের শিক্ষা। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বা এই শাসন ব্যবস্থার রক্ষাকবচ বা প্রধান ভিত সেনাবাহিনী, বিজিবি বা পুলিশের দায়িত্বে যারা আছেন তারা সবাই ‘জাহান্নামে যাবে’ এমন অপপ্রচারে স্থিরবিশ্বাস জঙ্গীদের। আত্মগোপনে থাকা জেএমবির এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের একান্ত সাক্ষাতকারের বিবরণ-
জনকণ্ঠ : জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হলেন কেন? কে কে ছিলেন আপনাদের সঙ্গে?
জেএমবি : সর্বহারাদের দমন করার জন্য আতিক ভাই, যারে ‘বাংলা ভাই’ নামে চিনেন সবাই-সেই আতিক ভাই-ই আমারে জামা’তুল মুজাহেদীনে যুক্ত করে। সেই সময়ে আতিক ভাই-ই বাগমারায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিএনপি সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আরও প্রভাবশালী লোক ছিলেন আমাদের সঙ্গে। পুলিশের এসপি ছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তিনি দাবি করেন- বিএনপির তৎকালীন এমপি নাদিম মোস্তফা, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, ব্যারিস্টার আমিনুল হক তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতেন, নির্দেশনা দিতেন। সর্বহারাদের দমন করাই আমাদের কাজ ছিল। ঐ যে বাদশা, যারে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলিয়ে মারছে বাংলা ভাই। সেই বাদশা অনেক মানুষকে হত্যা করেছে।
জনকণ্ঠ : বাদশা অপরাধ করলে আইনী পথে বিচার হতো। আপনারা আইন হাতে তুলে নিলেন। তা কি সরকারের মন্ত্রীদের নির্দেশে? আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, আপনারা নিরীহ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন। সেটা আদালতে প্রমাণও হয়েছে। আপনাদের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে, সাজাও কার্যকর হয়েছে। আপনাদের সদস্যসংখ্যা কত?
জেএমবি: অভিযোগ সত্য না। আমরা আল্লাহর নির্দেশ কায়েম করছি। বাগমারাতে সর্বহারাদেরই মেরেছি। আর জামা’তুল মুজাহেদীনের কয়েক হাজার সদস্য সারা দেশে আছে। সবাই তো সক্রিয় না, তাই সঠিক হিসেব করা মুশকিল। তবে একটা বড় কাম করতে বেশি লোকের দরকার হয় না। সরকার মনে করছে কয়জনই বা আছে এদের দলে? যখন মরবেন তখন সব বুঝবেন। যেমন মনে করেন, আপনাকে যদি একটা মশা কামড় দেয়-গোটা মাথা, গোটা শরীর যন্ত্রণা করে, তাই না? কাম করতে বেশি মানুষ লাগে না। কিছু বিডিআর সদস্য এক শ’ সেনাবাহিনীর অফিসারকে মেরে ফেলল।
জনকণ্ঠ : বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে কি আপনারা জড়িত ছিলেন?
জেএমবি : না, কোনভাবেই না। জামা’তুল মুজাহেদীনের লোক কখনও সরকারের কোন প্রহরী হবে না। গণতন্ত্রের প্রহরী হওয়া ‘হারাম’। যে পাহারা দেবে, আজকেও যারা পাহারা দিচ্ছে, তারা সব জাহান্নামে যাবে। হাসিনারে যে পাহারা দেবে, সেও জাহান্নামে যাবে। খালেদারে যে পাহারা দেবে, সেও জাহান্নামে যাবে। সেটা স্পষ্ট দলিলে লেখা আছে।
গণতন্ত্রের পক্ষে যারা থাকবে, যারা চাকরি করবে তারা জাহান্নামে যাবে। অত বেশি বুঝি না, তবে অল্প যেটা বুঝি, সেটা নিয়ে গবেষণা করেছি। সেই গবেষণায় বুঝি, একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিকে মারলে দেশে বিশৃঙ্খলা হবে। আমরা এখন সেটাই করতে চাই।
জনকণ্ঠ : রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মতো তাদের সন্তানদেরও কি টার্গেট করেছেন আপনারা ?
জেএমবি : না। সন্তানদের মারবার কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই। তবে সেই সন্তানদের মধ্যে যে প্রভাবশালী-যাকে মারলে বড় রকমের বিপদে পড়বে হাসিনা সরকার, তাকে পেলে জামা’তুল মুজাহেদীন মেরে দিত। এমন দেশে সে আছে, যেখানে জামা’তুল মুজাহেদীদের আবির্ভাব কম। তবে ভারতে আমাদের অবস্থান খুব শক্ত। আমাদের ছেলেরা তাকে ভারতেও যদি পেত, ঠিক মেরে দিত।
জনকণ্ঠ : এতক্ষণ যাদের কথা বললেন, যারা আপনাদের সমর্থন দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে, তাদের নেতাদের হত্যা করবেন আপনারা?
জেএমবি : হাসিনাকে বিপদে ফেলার জন্য আমরা সব করতে পারি। গণতান্ত্রিক সরকার তাগুতি সরকার। এই সরকারের বিরুদ্ধে হামলা করতে হবে, এটা আল্লাহর নির্দেশ। দলিলে আছে।
জনকণ্ঠ: কোন্ দলিলে লেখা আছে এমন কথা? আপনি নিজে দেখেছেন?
জেএমবি: আমি পড়ালেখা জানি না। হাদিস-কোরান পড়ি নাই। অত বুঝি না; অল্পই বুঝি। তবে এটা জানি যে, আমি যা বলতেছি , সবই দলিলে লেখা আছে।
জনকণ্ঠ: কিন্তু ইসলাম তো শান্তির ধর্ম। সেই ধর্মের প্রকৃত বাণী না জেনে তার বিপরীত ক্জা করছেন আপনারা,সেটা জানেন আপনি? আপনি কি জানেন, আমাদের নবীজী খুব পরোপকারী ছিলেন? শান্তির জন্য, মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে বলেছেন তিনি। নবীজীর চলার পথে যে বৃদ্ধা কাঁটা রাখত, একদিন সে অসুস্থ ছিল, কাঁটা দিতে পারে নাই। সেদিন তার বাড়ি খুঁজে নিয়ে নবীজী সেই বুড়িকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। বলেছিলেন, আবার আমার পথে কাঁটা দাও, তবু তুমি সুস্থ থাক-এই গল্প আমার শৈশবে পড়েছি। আপনি শুনেছেন এই গল্প?
জেএমবি: (এই প্রতিবেদককে থামিয়ে দিয়ে) এসব জাল দলিল আপা। আপনারা যা জানেন-সব জাল দলিলের কথা জানেন। দলিলে আছে আল্লাহর নির্দেশে লাদেন যুদ্ধ করেছে। আমরা তার অনুসারী। তার পথেই আমরা যুদ্ধ করছি।
জনকণ্ঠ : আপনাদের টার্গেটে আর কারা আছেন?
জেএমবি: আওয়ামী লীগের জেলা নেতাদের প্রথম টার্গেট করেছিলাম আমরা। ৬৪ জেলার সভাপতি সাধারণ-সম্পাদককে ১৭ আগস্টের মতো একই দিনে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলাম, যাতে হাসিনার মনে একটা ভীতি কাজ করে। কিন্তু সম্প্রতি আমরা এই পরিকল্পনা স্থগিত করেছি।
জনকণ্ঠ: কেন?
জেএমবি: কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওয়ামী লীগ যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকছে তত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হোক। বরং শীর্ষ কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে মারলে হাসিনার ওপর দোষ আসবে। দেশে বড় রকমের বিশৃঙ্খলা হবে। বিরোধী দলও মাঠে নামবে। দুই দলে কামড়াকামড়ি লাগবে। সেই সুযোগে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকে শেষ করে দেব। তখন দোষ পুরোটাই বিএনপির ঘাড়ে আসবে। আওয়ামী লীগের নেতারা মরবে। বিএনপির নেতাকর্মী কিছু এ্যারেস্ট হবে, মারবে, গুলি চলবে। দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জামা‘তুল মুজাহেদীন বসে দেখবে। আমাদের শত্রু এরা দুই পক্ষই। কারণ, এরা গণতন্ত্রপন্থী। তাই এদের আমরা ‘তাগুতি পন্থী’ বলি। এজন্য কৌশল করা হয়েছে, এদের শেষ করতেই হবে।
জনকণ্ঠ: এই পরিকল্পনা কতদিনের?
জেএমবি: ছয় মাস আগে এই পরিকল্পনা করেছি আমরা। আগস্ট মাসে একটা বড় কিছু করার টার্গেট আমাদের।
জনকণ্ঠ : আপনাদের টার্গেটে আর কে আছে?
জেএমবি: ঐ যে ইমরান সরকার আছে না, তাকেও মারবার টার্গেট ছিল। কিন্তু তখন ইমরান সরকারের সামনে এত ছোট ছোট বাচ্চা বসে থাকত, তাকে মারতে গেলে এই বাচ্চাগুলো মারা পড়ত।
জনকণ্ঠ: আপনারা বাচ্চা মারতে চান না?
জেএমবি : (হেসে) না, বাচ্চা মারতে চাই না আমরা। আপনারা বলেন না, আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যত? আমরা তো মনে করি এই শিশুরাও একদিন জেএমবি হবে। আমাদের ভবিষ্যত মেরে ফেললে হবে কী করে? তবে আপনাকে যে কথাগুলো বলছি, তা যদি সত্য না লিখেন, আপনার বিপদ আছে। অসুবিধা হবে। ঐ যে সুলতানা কামাল আছেন, তারে এত সহযোগিতা করলাম, অথচ তিনি ঢাকা ফিরে সব মিথ্যা কথা লিখেছেন আমাদের নামে।
জনকণ্ঠ: কী সহযোগিতা করেছেন?
জেএমবি : তিনি জানতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাই সম্পর্কে। আমরা লোক ঠিক করে দিয়েছিলাম তার সঙ্গে এলাকা ঘুরে সব দেখাতে। বাংলা ভাই কাদের, কেন মেরেছে সব বলা হয়েছে তাকে। সব সঠিক কথা জেনেও বাংলা ভাইয়ের নির্যাতনের মিথ্যা কথা লিখেছে। এসব বললে বহুত ব্যাপার। আমরা পরিবার ছেড়ে পালিয়ে থেকেছি, গ্রেফতার হয়েছি।
জনকণ্ঠ: আপনাদের এসব পরিকল্পনা কতদিনের মধ্যে বাস্তবায়নের টার্গেট?
জেএমবি : সর্বশেষ পরিকল্পনাটা মনে হয় ভেস্তে গেল এবারের মতো। যিনি টার্গেট, তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। সেদিন বিভিন্নভাবে মহিলা-পুরুষ মিলে কমপক্ষে ৫০ এহসার পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। মহিলারা ছিল ‘সাপ্লাইম্যান’। আর পুরুষ ছিল-যারা ব্যবহারকারী।
জনকণ্ঠ: কী অস্ত্র নেয়া হয়েছিল? গ্রেনেড? যদি গ্রেনেডগুলো সময়ের আগেই বিস্ফোরণ ঘটে যেত, এই মহিলারা কি আত্মঘাতী হতো?
জেএমবি : আত্মঘাতী পরিকল্পনা এখন আমাদের নাই। গ্রেনেড সাপ্লাইকারী মহিলারা জানে কিভাবে হ্যান্ড গ্রেনেড সাবধানে রাখতে হয়। এখন প্রশাসন এত সতর্ক, গ্রেনেড না হলে সম্ভব না। প্রশাসনের তদারকি থাকে। সিসিক্যামেরা ফিট করা আছে চারদিকে। বড় জিনিস বহন করা কঠিন। গ্রেনেড সিসিক্যামেরায় ধরা পড়ে না। বড় রাজনৈতিক সমাবেশে হাজার হাজার লোকের মিছিল। ঢল নেমে মানুষ সমাবেশে ঢোকে, তখন তো আর চেক করাও সম্ভব না। সেটা যে দলেরই হোক না কেন। কিছু মহিলা হয়ত কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বসে থাকে একপাশে। সুযোগমতো হাতে দিল, নিয়ে ছুড়ে দিল। যে ছুড়ে মারবে সে হিসেব করেই রাখে- হয় মারবে, নয় ধরা পড়বে, নয় মরবে। একজন বা দু’জন মারল, অন্যরা সরে গেল নিরাপদে, ঝামেলা শেষ।
জনকণ্ঠ: শেষ পরিকল্পনা ভেস্তে গেল বলে কি হতাশ আপনারা?
জেএমবি: না, জামা‘তুল মুজাহেদীন কোন কাজে হতাশ না। হয়নি তো হয়নি। আল্লাহর ইচ্ছা নাই হয়ত। পরে হবে। ১৫ দিন থেকে আমাদের নেটওয়ার্ক খুব পরিকল্পিতভাবে সেট করা ছিল। প্রশাসন টাকা দিয়ে বিভিন্নভাবে সোর্স নিয়োগ করে তো। আমার মনে হয়, জেএমবির এই পরিকল্পনা হয়ত গোয়েন্দারা জেনে গেছে। তাদের নির্দেশে হয়ত আমাদের টার্গেট আর সমাবেশে আসেনি।
জনকণ্ঠ : তাহলে আপনাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কি ? কারা আপনাদের শত্রু?
জেএমবি: বর্তমানে যারা দেশ পরিচালনা করছে তাদেরই আমরা শত্রু মনে করি। প্রশাসন তো গবর্নমেন্টই চালাচ্ছে। গবর্নমেন্টের দায়িত্ব আমরা নিতে পারলে প্রশাসন আমরাই চালাব। আমরা যেভাবে বলব প্রশাসন অস্ত্র সেদিকেই ঘুরাবে।
জনকণ্ঠ : তাহলে কি আপনারা র্যা ব-পুলিশকে টার্গেট করেছেন? এত পুলিশ মারা হলো-এরা কি আপনাদের লোক?
জেএমবি: না, আমরা র্যাযব-পুলিশকে টার্গেট করি নাই। পুলিশে গরিব মানুষের ছেলেমেয়ে আছে। এরা বেতন পেলে চলে। এদেরও পরিবার সন্তান আছে। পুলিশ হত্যা করেছে জামায়াত-শিবির। জামায়াত এলোমেলা হত্যা করেছে। পুলিশ তো সরকারের কমান্ডে চলে। এদেরকে হটাতে হলে সরকারকে হটাতে হবে। তাগুতি সরকার হঠিয়ে আমাদের সরকার গঠন করতে হবে। তবে আমাদের কোন কাজের খবর পেয়ে গোয়েন্দারা যদি আমাদের এ্যাটাক করে তখন জামাআ’তুল মুজাহেদীন মারবে। এরা (জেএমবি) বলছে রাষ্ট্রের দায়িত্বে যারা আছে তাদের মারতে হবে। যাতে এরা কোন নির্বাচন করতে না পারে। যেন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে না পারে।
জনকণ্ঠ: আপনারা কি নির্বাচনের বিরুদ্ধে?
জেএমবি: হ্যাঁ। আমরা নির্বাচনের বিরুদ্ধে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আমরা মানি না।
শনিবার, ৩০ আগষ্ট ২০১৪, ১৫ ভাদ্র ১৪২১
জঙ্গী আস্তানায় ৫ দিন ৩ ॥ তাগুতিদের খতম করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই প্রধান খায়েশ-
সুন্নীবাদ, সুফীবাদ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সঙ্গে ধর্মীয় মতাদর্শগত বিরোধের কারণে যেমন জামায়াতের টার্গেট, তেমনই জেএমবির টার্গেটও এরা- জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেএমবি নেতা। তারা মনে করে ইসলাম শান্তির ধর্ম তখনই হবে যখন ‘তাগুতি’দের খতম করে ফেলা হবে। যতদিন গণতন্ত্রকামী বা ‘তাগুতি’দের শেষ করা যাবে না, ততদিন জেএমবি-জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারবে না। জেএমবির দাবি- তাদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের একাত্মতা জন্মগত। তবে জেএমবি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিএনপি নেতা সাবেক ভূমি উপমন্ত্রীর ভাইপো ও ভাগ্নে হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে। বিএনপি- জামায়াতের বি-টিম হিসাবে রাজশাহীর বাগমারা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাই ছিল তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেএমবি সংগঠক এই প্রতিবেদককে একান্ত সাক্ষাতকারে বলেন, জেএমবি প্রথম জামায়াতের ভেতরেই ছিল। জামায়াত-শিবিরও লাদেনপন্থী, জেএমবিও লাদেনপন্থী। আর তাই এখনও কওমী মাদ্রাসার ছাত্র এবং শিবির কর্মীদের অনেকে জেএমবির সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তবে জামায়াত কৌশলগত ভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। জেএমবি নির্বাচনবিরোধী, তাগুতিদের হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায় তালেবানদের মতো। জেএমবির এই জঙ্গী নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, কৌশলগত কারণে জেএমবি জামায়াত থেকে বের হয়ে এসেছে। তবে জেএমবির অনুদান আন্তর্জাতিক অনেক ফান্ড জামায়াতের মাধ্যমেই আসে। জামায়াতের নেতারাও বড় রকমের ডোনেশান দেয়। জেএমবির অনেক কাজ মূলত জামায়াতের সঙ্গেই হয়- বলেন তিনি। তার মতে জামায়াত অনেক এলোমেলা কাজ করে, জেএমবি পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করে হত্যা করে।
জেএমবি নেতা বলেন, সাংগঠনিকভাবে অনেক মিল বা অভিন্নতা থাকার কারণে জামায়াতের নির্দেশ মতো তাদের অনেক টার্গেটকে জেএমবি ‘খতম’ করে দেয়। জেএমবির এই ক্যাডাররা প্রথম দিকে নিজেদের ‘দুলু বাহিনী, গামা বাহিনী, আল-কায়েদা বাহিনী, মুসলিম রক্ষা পরিষদ, মুজাহিদীন বাংলাদেশ, হরকত-উল-জিহাদ’সহ নানা নামে নিজেদের জাহির করে। পরবর্তীতে তারা ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ বা জেএমজেবি নামে তাদের হত্যাযজ্ঞ বা অপারেশন চালাতে থাকে।
বাংলা ভাই এবং শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী রচিত বিভিন্ন বই এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের অনেক সিডি ক্যাসেট পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, জেএমবির জঙ্গীবাদে বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা আড়াল করার জন্যই মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাই ও বাংলা ভাই বাহিনী বা জঙ্গী সংগঠনের কোন অস্তিত্ব নেই বাংলাদেশে। এসব মিডিয়ার সৃষ্টি।’
জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির সম্পৃক্ততার তথ্য প্রমাণ পুলিশের কাছে থাকলেও তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি রাষ্ট্রনায়কদের নির্দেশে গায়েব করে ফেলা হয় বলে স্থানীয় অনেকে জনকণ্ঠকে জানান। এ ব্যাপারে রাজশাহীর পুলিশ সুপার আলমগীর কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি এখনও এ ধরনের তথ্য পাননি।
বাংলা ভাইয়ের হত্যা আর নির্যাতনের ধরন ছিল- মানুষকে উল্টো করে ঝুলিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ওসমান বাবুকে (২৭) বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে আহত করার পর জবাই করে হত্যা করে। সর্বহারা নিধনের নাম দিয়ে এরকম হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে তারা রাজশাহীর অন্যান্য থানাতেও । এটাই ছিল বাংলা ভাইয়ের প্রথম প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড।
বাংলা ভাইয়ের জঙ্গী বাহিনীর নির্যাতনে নিহত অনেকের কথাই এখনও প্রকাশ হয়নি বলে মনে করেন নির্যাতিতরা। তবে ৩২ জনের কথা জানা যায় সেই সময়ে। এদের সবার নাম পাওয়া যায়নি। যাদের নাম পাওয়া গেছে-(১) ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ওয়াসিম ওরফে ওসমান বাবু, (২) ১১ এপ্রিল (১১ এপ্রিল নির্যাতনের পর ১৭ এপ্রিল নিহত) বাগমারার কনোপাড়ার গোলাম রব্বানী মুকুল প্রামাণিককে মাথা নিচে পা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতন। (৩) ২০ এপ্রিল দুর্গাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য আজাহার আলী (৪) ২২ এপ্রিল নওগাঁর রানীনগরের বেলঘরিয়ার মোশারফ হোসেন, (৫) নাটোরের পীরগাছার সাইফুর, (৬) ২৩ জুলাই নওগাঁ জেলার আত্রাইয়ের কাশিয়াবাড়ির দীপংকর, (৭) ২৭ এপ্রিল ইউপি দফাদার, (৮) এপ্রিল মাসেই দুর্গাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য আজাহার আলীকে নির্যাতন করে বাংলা ভাই। নির্যাতনের কারণে প্রচ- অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কয়েক বছর পর মারা যান। (৯-১১) ১ মে আত্রাই য়ের ভোঁপাডার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য শেখ ফরিদ ও অজ্ঞাত ৩ ব্যক্তি, (১২) রাজশাহীর বাগমারার নিমপাড়ার রাবেয়া, ১৩ মে বাংলা ভাইয়ের ধর্ষণের শিকার হয়। ১৪ মে আত্মহত্যা করে রাবেয়া (১৩) ১৫ মে বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ও সর্বহারা নেতা নওগাঁর রানীনগরের সফিকপুরের আবদুল কাইয়ুম বাদশাকে হত্যার পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখে, (১৪) ২৪ জুন রানীনগরের সিম্বা গ্রামের আওয়ামী লীগ ও সর্বহারা নেতা খেজুর আলীকে টুকরো টুকরো করে কাটে বাংলা ভাই, (১৫) রানীনগরের বড়গাছার আফজাল, (১৬) ৩০ জুন গাছে ঝুলিয়ে বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় বাগমারার মাডারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ইয়াসিন আলীকে (১৭-১৮) ২৫ জুন নাটোরের বাসুদেবপুরে অজ্ঞাতনামা ৩ ব্যক্তিকে হত্যা, (১৯) ১৪ নবেম্বর রানীনগরের ভেটি ক্যাম্পে ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউল হক জিয়া, (২০) ২৭ নবেম্বর বাগমারার তাহেরপুরের বিষ্ণুপুরে বাসদ (মাহবুব) নেতা আলী আকবর, (২১,২২) ২০০৫ সালের ২২ জানুয়ারি বাগমারার শ্রীপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুর হত্যা ও আওয়ামী লীগ নেতা জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন মৃধাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া বাংলা ভাইয়ের অত্যাচার নির্যাতনে বাড়িছাড়া হন অনেকে। এদের মধ্যে রহিমা বেওয়া কিছুদিন আগে মৃত্যুবরণ করেন। ৫ বছর পর এলাকায় ফিরে নিজের বাড়িতে বসবাস করছেন বাগমারার আবদুল বারী।
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পর ও নিরাপদ বোধ করেনি এলাকার লোকেরা। সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এলাকার নির্যাতিতরা তাদের নিরাপত্তা এবং ২০০৪ এর এপ্রিল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত নির্যাতনের ন্যায়বিচার প্রার্র্থনা করেন। জেএমবির জঙ্গীবাদ বর্বর নির্যাতনে সহযোগিতার অভিযোগে তারা স্থানীয় বিএনপি নেতৃত্বকে দায়ী করেন।
রাজশাহীর পুলিশ সুপার আলমগীর কবির এ তথ্য জানিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, বাগমারার নির্যাতিত যারা বেঁচে আছেন এবং নিহতদের স্বজনেরা পুলিশের কাছে অভিযোগে জানিয়েছেন, বাংলা ভাই বাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডে সরাসরি মদদ দিয়ে জেএমবির সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন রাজশাহীর আলোচিত তৎকালীন এসপি মাসুদ মিয়া (জঙ্গী তৎপরতার অভিযোগে চাকরিচ্যুত), রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুর থেকে নির্বাচিত বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজশাহী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাদিম মোস্তফা, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী রহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, সাবেক ডাক ও টেলিযোগোযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক ।
২০০৫ সালের ২২ জানুয়ারি বাগমারার আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন মৃধাকে বাংলা ভাই বাহিনীর ক্যাডাররা হত্যা করতে এসে জনপ্রতিরোধের শিকার হয়। জনতার ওপর বোমা হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুবুর রহমানকে হত্যা করে জেএমবি। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধে আটক হয় বাংলা ভাই বাহিনীর তিন ক্যাডার। তিনজনই গণপিটুনিতে নিহত হয় সেইদিন।
সেই ঘটনার পর ২০০৫ সালের ২৪ জানুয়ারি রাজশাহীর বিতর্কিত এসপি মাসুদ মিয়া প্রথমবারের মতো বাংলা ভাইয়ের অবস্থান এবং কর্মকা- স্বীকার করে বলেন, ‘বাংলা ভাই আছে।’ সেই সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বাংলা ভাইকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ দেবার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতারকৃত বাংলা ভাই বাহিনীর ক্যাডারদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বাংলা ভাই ও বাংলা ভাইয়ের আধ্যাত্মিক গুরু বলে পরিচিত শায়খ আবদুর রহমানের নেতা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ-আল-গালিবের নাম আলোচনায় আসে।
এর পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গালিবকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্দেশে পুলিশ ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেষ রাতে ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে ড. গালিবকে তার তিন সহযোগী (আবদুস সামাদ সালাফী, আবদুল লতিফ ও আযীযুল্লাহ)সহ গ্রেফতার করে। এর পর আবার বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেফতারের অভিযান থমকে যায়।
২০০৫ সালের ১১ মার্চ রাজশাহীর তৎকালীন এসপি মাসুদ মিয়াকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। পরবর্তীতে জঙ্গী তৎপরতায় মদদ দেয়ার অভিযোগে এসপি মাসুদকে চাকরিচ্যুত করে সরকার।
২০০৫ সালে বাংলা ভাই জেএমবি জঙ্গীবাদ সন্ত্রাস প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে-বিদেশে প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে।
২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দফতর থেকে বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানকে ধরিয়ে দেবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সেই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ঘোষণা দেন এই দুই জঙ্গী সন্ত্রাসীকে ধরে দিতে পারলে এক কোটি টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। যেকোন একজনকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকার পুরস্কার। বহু নাটকীয়তার পর অবশেষে ২০০৬ সালের ১ মার্চ সিলেটের শাপলাবাগের সূর্যদীঘল বাড়ি নামের একটি বাড়িতে শায়খ আবদুর রহমানের অবস্থান নিশ্চিত হবার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, র্যা ব বিশাল বাহিনী নিয়ে অভিযান চালায়। শায়খ আবদুর রহমান বাধ্য হয় আত্মসমর্পণ করতে। এর কয়েকদিন পর ৬ মার্চ বাংলা ভাই ধরা পড়েন মুক্তাগাছার রামপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে।
২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এলাকায় সন্ত্রাসের প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ের দ্বন্দ্বে বিএনপি নেতার ভাইপোকে তার সহযোগীসহ হত্যা করে সর্বহারা দল। নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলাধীন কামারপাড়া বাজারে সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীরা হত্যা করে তৎকালীন ভূমি উপমন্ত্রী বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাইপো ও যুবদল নেতা গামা, তার সহযোগী পুঠিয়ার সাধনপুরে যুবদল নেতা পাখি ও দুর্গাপুরের ওয়ার্র্ড কমিশনার বিএনপি নেতা আনোয়ারকে। পাখি ও আনোয়ার কমিশনার বিএনপির স্থানীয় সাংসদ নাদিম মোস্তফার ক্যাডার বাহিনীর সদস্য ছিল। তাদেরও হত্যা করে সর্বহারা দলের সন্ত্রাসীরা ।
এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর আরেক ভাইপো যুবদল নেতা ডলার এবং দুলুর ভাগ্নে ডালিমের নেতৃত্বে প্রায় দু’শ’ লোকের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী নলডাঙ্গার কাজীপাড়া আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতা-কর্মীদের ৩১টি বাড়ি ও ১৫টি দোকানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট, ভাংচুর ও গান পাউডার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। গামা এবং দুলুর ভাইপো সর্বহারাদের হাতে নিহত হবার পর কথিত সর্বহারাদের নিধনের নামে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির জন্যে জঙ্গীদের মাঠে নামানো হয় বলে মনে করে এলাকার জনগণ।
রবিবার, ৩১ আগষ্ট ২০১৪, ১৬ ভাদ্র ১৪২১
লন্ডনে ইনুকে আক্রমণ করে আমাদের লোকেরাই...
জঙ্গী আস্তানায় ৫ দিন শেষ পর্ব -
ঠিক দুপুর বেলা, ভূতে মারে ঠেলা। না, ভূতের কোন অস্তিত্ব নেই। চারদিকে সবুজ আর শাল শিমুলে ঘেরা পুকুর। দুই তরুণী গলা জলে ডুবে মুখোমুখি অন্তরঙ্গ কথকতায় মত্ত। সারা শরীর জলে ডুবিয়ে চোখে চোখ রেখে দুই সখীর কী এত কথা? কার কথা? কোন সুখ? কোন ব্যথা? দশ বছর আগে এই জনপদের নিরীহ মানুষগুলো দুঃস্বপ্নের অতলে হারিয়ে গিয়েছিল সেই সব দিনের কথা।
প্রত্যন্ত জনপদের এই সবুজ মনোমুগ্ধকর জীবন আবার কখনও ফিরে আসবে এমন বাস্তবতা এই তরুণীদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল। কিন্তু সেসব দুঃস্বপ্ন এখন শুধুই মরা অতীত। শান্ত নিস্তব্ধ রাজশাহীর বাগমারার অজপাড়া গাঁয়ে উদাস দুপুর এখন শান্ত, নীরব। হংসমিথুন আর কিশোরীর জলকেলির চিরন্তন দৃশ্য আবার দৃশ্যমান। ২০০৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত একেবারে হারিয়ে গিয়েছিল। সে সময়ে বাংলা ভাইয়ের তথাকথিত সর্বহারা নিধন অভিযানে নিহত হয়েছে এই এলাকার শতাধিক মানুষ, ধর্ষিতা হয়েছে অসংখ্য নারী।
শঙ্কিত এ জনপদ আর বিশাল এক গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে নিস্তরঙ্গ জলের ওপর। সেই ডালের চিরল পাতার ছায়ায় পুকুরের এক পাড়ে দাঁড়িয়ে থমকে দূর থেকেই গলাজলে ডুবন্ত দুই তরুণীর দিকে অপলক চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। জঙ্গী অধ্যুষিত এই জনপদে হেঁটে হেঁটে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম জেএমবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। পুকুরের নিস্তব্ধ জল থেকে নজর সরানো গেল না। নিস্তব্ধ বেশ কিছুক্ষণ। না, দুই সখী চোখে চোখ রেখে আড্ডায় নিমগ্ন-জগতে কেহ কিছু নাহি আর। এক পর্যায়ে জেএমবির এক নারীর মুখোমুখি হলাম অনেক কসরৎ করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নারী বললেন তার ‘দাওয়াতী’ স্বামী জেএমবির এহসার। সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী তাকে দাওয়াতী হতেই হবে। দীর্ঘদিন জেএমবির সঙ্গে আছেন যারা, তাদের মনে এখন নানান দ্বন্দ্ব, নানান প্রশ্ন। দশ বছর পর তারা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের এখন অস্তিত্বের সঙ্কট চরমে। একান্ত সাক্ষাতকারে সেই বিষয়টিই উঠে এসেছে।
জেএমবি : আওয়ামী লীগ বিএনপির সব নেতাদের একটা একটা করে জবাই করেছে চরমপন্থীরা। সেই সর্বহারা চরমপন্থীদের দমন করতে আমাদের সহযোগিতা করেছে বিএনপি। এরা আমাদের সাংগঠনিক লোক নয়, চরমপন্থী দমনে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। তাই জেএমবির ওপর নির্ভর করেছে এরা। ভেবেছে, ‘এরা যদি পারে চাল ভাত দিয়ে সহযোগিতা করলে ক্ষতি কী আছে?’
জিহাদ করা আল্লাহর হুকুম, এটা করা দরকার, এটা প্রয়োজন, ঠিক আছে। এদেশে যুদ্ধ করা যাবে না। কারণ, প্রথম কথা নিরাপদ জায়গা দরকার। অন্য দেশে মনে করেন, পাহাড় থাকে, চর থাকে- যেখানে লুকানোর জায়গা থাকে। আফগানিস্তানে পালানোর বা লুকানোর জায়গা আছে, যেখানে সরকারের কোন লোকই যায় না। বাংলাদেশে এ রকম কোন জায়গাই নেই- যেখানে আমরা নিরাপদ মনে করতে পারি। আমাদের দেশে এ রকম নিরাপদ জায়গা নেই। তাই এদেশে যুদ্ধ করা যাবে না। এদেশে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্তই ভুল।
‘ইনুকে লন্ডনে আক্রমণ করেছে আমাদের ছেলেরাই। আক্রমণ করেছে- যে কোনভাবে বেঁচে গেছে। পরিকল্পনায় দুর্বলতা ছিল হয়ত। হয়তবা দলের শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তই তেমন ছিল। নির্দেশনা যদি থাকত- ‘মেরে দাও’- তাহলে মেরেই দিত। সেই সুযোগ ছিল। তবে সব প্রোগ্রাম সাকসেসফুল নাও হতে পারে। তবে বিএনপির ওপর আমাদের অনেক রাগ আছে। কেন বাংলা ভাইকে ধরিয়ে দিলে ৫০ হাজার টাকা দেবে বলেছিল বিএনপি সরকার? তাদের কথায় এত কাজ করেছে আমাদের মুজাহিদীন, বাংলা ভাই। তারা সব ভুলে গেল?
এখন আবার আমাদের অনেক মেয়ে কাজ করছে। ইসলামী ছাত্রী সংস্থা থেকে অনেক মেয়ে আসে। সারাদেশে দুই থেকে তিন হাজার হবে। আমরা মাঝে মাঝে ঢাকায় গাজীপুর, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকায় বৈঠকে যাই। দাওয়াতী বৈঠক। আমাদের সবার খরচ দেয় সংগঠন।
আল্লাহর নির্দেশে স্বামী যা বলে আমরা তাই করি। সংগঠনের মধ্যেই তালাক হয়, আবার বিয়েও দেয় দাওয়াতীদের সঙ্গে।
আমাদের ঘরে কোন ছবি রাখা যাবে না। হাতমোজা, পায়ে মোজা, বোরখা পরতে হয়। শুধু চোখ খোলা রাখি আমরা। কারণ, দাওয়াতীদের ইসলামী কায়দায় চলতে হয়।
যারা তাগুতি তাদের মারার নির্দেশ আছে কোরানে। বেনজীর ভুট্টোকে মারল না, পাকিস্তানে? আমাদেরই লোক। আমাদের নেতারা অনুসরণ করেন টার্গেট, নির্দেশনা এলেই আমরা কাজ করি। মনে করেন আপনি এখানে এসেছেন, আপনার কোন প্রটেকশন নেই। আপনাকে মেরে দেয়া সহজ।
হরতালে সব ইসলামী সংগঠন একসঙ্গে কাজ করেছে। এখানে আমরা সব সংগঠন চেয়েছি সাঈদী বাঁচুক। আমাদের নির্দেশনা আছে হরতালের ঘোষণা হলেই সব ইসলামী সংগঠনের নেতাকর্মী এক হবে। পেট্রোল বোমা আর গ্রেনেড নিয়ে হাজির হবে সবাই। যারা বানাতে পারে না- তাদের অন্যেরা সহায়তা করবে।
২০০৪ সালে আমাদের একমাত্র অস্ত্র ছিল গ্রেনেড। দশ বিশটা তাদের ব্যাগে ছিল। মোটরসাইকেলে করে যাবার সময় কেউ ধরলেই ছুড়ে মারত, ব্যস উড়ে যেত।
ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আর বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সব এক। আমাদের একই অস্ত্র। সারা বিশ্বে যত অস্ত্র বোমা মৌলবাদীরাই বানায় আর বোমা মারে, মনে রাখবেন। এহসাররা সান্তাহারে ৭০ জন ইঞ্জিনিয়ারকে রিসিভ করেছে একদিন। সব বিদেশী। এরা পাকিস্তান ভারত থেকে এসেছে।
হেফাজত, জামায়াত, বিএনপি আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করছে। বাংলা ভাইয়ের বিয়ে হয় সাধারণ মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটি এই সংগঠন সম্পর্কেও জানত না। কোন দাওয়াতী ছিল না। এখন জেলে। তার পক্ষে কোন আইনজীবীও নেই। ভয়েও তার পক্ষে মামলা করে না কেউ।
‘এহসাররা কখনও ক্ষমা চাইবে না।’ বাংলা ভাই ওকালতনামায় সই করেনি। আষ্টপতির (রাষ্ট্রপতি) কাছে ক্ষমাভিক্ষা করেনি। কারণ, আল্লাহ প্রশ্ন করবে তুমি কার কাছে ক্ষমা চেয়েছ? প্রাণভিক্ষার মালিক আমি না আষ্টপতি (রাষ্ট্রপতি)? যারা শারীয়া আইন মানে না- তাদের কাছেই ক্ষমা চাইলা? আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাবে না। আমাদের বোরকার ভেতরে তো চেকিং হয় না। আমরা বড় জিনিস (অস্ত্র) নিতে পারি না, তবে বোমা (গ্রেনেড) নিতে পারি।
ত্রিশালের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে- তাদের কোন পুরস্কার নেই, তবে তার কৌশল সফল হলে ধাপে ধাপে এগোবে। আমি যুক্তির কথা বলি। কোরান হাদিস জানি না, তবু আমাকে মানে সবাই। অনেক নারী আমার কথায় গায়েরী এহসার হয়েছে। আগামীতে আমাদের বড় পরিকল্পনা আছে- তবে পরিস্থিতির ওপর তা নির্ভর করবে।
sumikhan29bdj@gmail.com

Monday, September 8, 2014

বিশ্বজুড়ে জঙ্গী অর্থায়ন -সুমি খান

 ০ বাংলাদেশে জাওয়াহিরির হুমকি খাটো করে দেখার সুযোগ নেই
০ জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধে শুধু কঠোরতা দিয়ে কাজ হবে না, নির্মূল করতে হবে
০ বার বার প্রমাণিত হলেও বিশেষ ব্যাংক ধরাছোঁয়ার বাইরে


আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা নেতা আল জাওয়াহিরি সম্প্রতি হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশেও তাদের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশে জেহাদের ঘোষণা দিয়েছে জঙ্গী নেতা জাওয়াহিরি। এই হুমকির মুখে এদেশে জঙ্গী দমনে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা বললেও জঙ্গী অর্থায়নের উৎস নির্মূল করা না গেলে এদেশে জঙ্গী তৎপরতা কোন ভাবেই দমন করা যাবে না মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো কোন নির্দিষ্ট দেশে আর তাদের তহবিল রাখছে না। আল কায়েদা বা অন্য জঙ্গী দলগুলো তাদের সংগঠনের ফান্ড সংগ্রহ করছে সারা বিশ্ব থেকে, ছড়িয়েও দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদের কাজে। যার উৎস অনুসন্ধান দুরূহ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিং (এফএটিএফ) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও চাপে রেখেছে, যাতে এদেশের কোন ব্যাংকে মানি লন্ডারিং এবং জঙ্গী অর্থায়ন নজরদারির আওতায় আসে। ১৯৮৯ সালে প্যারিসে জি-৭ এর রাষ্ট্রপ্রধান এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের প্রভাবশালী আট দেশের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে। জি-৭ সামিট থেকে ঘোষণা করা হয় বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতকে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিংয়ের হুমকি থেকে রক্ষা করতে হবে। সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী জঙ্গী অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিংরোধে গঠিত হয় ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিং (এফএটিএফ)।
ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, জঙ্গীবাদে অর্থায়ন প্রতিরোধে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুরক্ষার জন্য ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিং (এফএটিএফ)-এর ৪০টি সুপারিশ আছে। ২০০২ সাল থেকে এফএটিএফের আইন কয়েকবার বদলেছে। তখন থেকেই আমরা এদের সুপারিশ অনুসরণ করছি। কারণ, আমরা এদের প্রতিটি সুপারিশ মানতে বাধ্য। এ কারণে এই সুপারিশগুলো আমরা কঠোরভাবে মেনে চলার চেষ্টা করছি।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত দফতর ইউনোডিসি বা ইউনাইটেড নেশন অফিস অন ড্রাগস এ্যান্ড ক্রাইমের হিসাব মতে প্রতিবছর বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্থমূল্যের ২ থেকে ৫ শতাংশ মানি লন্ডারিং বা বেআইনী পথে হয় । এর পরিমাণ আনুমানিক ৮০ হাজার কোটি ডলার থেকে ২ লাখ কোটি ডলার। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষ এসএনবির সাম্প্রতিক তথ্য মতে, সুইজারল্যান্ডের ২৮৩টি ব্যাংকে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার জমা রয়েছে। অর্থনীতির সংজ্ঞামতে কালো টাকা বলতে হিসাববহির্ভূত অর্থ বোঝায়। কর ফাঁকি দেয়া সম্পদও কালো টাকার আওতায় পড়ে। আইনী পথে রোজগার করেও সেই উপার্জনের বিপরীতে যথাযথ কর না দেয়া হলেও তা কালো টাকার আওতায় পড়ে।
প্যারিসের শাঁতে লা মুয়েতের সদর দফতরে এ বছরের ২১ জুলাই বিশ্বের ৩৪টি দেশের সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর সদস্যরা জরুরী বৈঠক করে। ওইসিডিতে সাবেক বেলজিয়াম রাষ্ট্রদূত রজার অকরেন্টের নামাঙ্কিত কক্ষে সেই জরুরী বৈঠকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত বিশ্বের সদস্যরা স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান প্রদান ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। যার মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তে নামে বেনামে লুকানো লাখো কোটি ডলার খুঁজে বের করার জন্য অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর এই প্রয়াস।
২০১৩ সালের বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে বিশ্বের মোট উৎপাদন প্রায় ৭৫ লাখ কোটি ডলার। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে গোটা দক্ষিণ এশিয়া যা উৎপাদন করে, বিশ্বের কালো টাকা তাকেও ছাপিয়ে যায়। কোন দেশের আয়ের একটা অংশের ওপর সেই দেশের সরকার কর থেকে বঞ্চিত হয়। কর ফাঁকি দেয়া টাকার একাংশ বিদেশী কোন ব্যাংকে জমা হয়। যে অংশ দেশে রয়ে যায়, সেটা দেশের বাজারে ঘুরপথে ঢুকে পড়ে। এতে যে কোন দেশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির দু’ভাবে সর্বনাশ হয়।
কোন্ দেশের মুদ্রা বাজারে ঠিক কত পরিমাণ অর্থ আছে সেই মূল হিসাবটাই আর সরকারের হাতে থাকে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরোপুরি মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যে ব্যবস্থাই নিক না কেন মুদ্রাবাজারে একাংশ তার আওতার বাইরে থেকে যায়। এতে দীর্ঘমেয়াদী কোন আর্থিক ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, বিদেশী ব্যাংকে হিসাববহির্ভূত অর্থ জমা হওয়ায় কোন দেশের বাইরে অনাকাক্সিক্ষত সম্পদ জমা হতে থাকে, যা সরকারের অজ্ঞাত থাকে। একই সঙ্গে সেই অর্থ কিভাবে ব্যয় হয়, তার ওপর কোন রকম নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে ধীরে ধীরে সেই দেশের বাইরে যদি আর্থিক ক্ষমতার অন্য ভরকেন্দ্র গড়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে।
সাধারণভাবে দেখা যায় এক দেশের হিসাববহির্ভূত অর্থ বেনামে অন্য দেশের ব্যাংকে জমা হচ্ছে বা কোন ব্যবসায়ে সেই টাকা ঢালা হচ্ছে। এই জন্যই অনেক দেশকে এক সঙ্গে কালো টাকা খোঁজার কাজে নামানোর চেষ্টা করছে ৩৪ সদস্য দেশের এই সংগঠন, যাতে কোন অপরাধী পালাতে না পারে। আমন্ত্রিত দেশ হিসেবে ভারত ইতোমধ্যেই সেই চুক্তিতে সই করেছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জি-২০ দেশের অর্থমন্ত্রীরা প্রস্তাবটিতে সম্মতি দিলে তা বিশ্বব্যাপী অভিযানে নেমে পড়বে।
সন্দেহ করা হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদীরা হাওয়ালা পদ্ধতিতে অর্থ আদান-প্রদান করে। বিভিন্ন দেশে হাওয়ালার বিভিন্ন নাম। যেমন ভারতে বলা হয় হুন্ডি, চীনে এর নাম ফেই-চিয়েন, হংকং এ হুই কুয়ান, ফিলিপিন্সে পাদালা, থাইল্যান্ডে ফেই কোয়ান। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, পশ্চিম আফ্রিকার মালি, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় ‘হাওয়ালা’র রমরমা। এই হিসাববহির্ভূত অর্থের মালিকরা প্রচ- ক্ষমতাশালী।
জামায়াতে ইসলামী, জেএমবি এবং অন্য জঙ্গী সংগঠনগুলোর অর্থায়নে ইসলামী ব্যাংকের সম্পৃক্ততা বার বার প্রমাণিত হওয়ার পর ও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে এই ব্যাংক। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের মালিকানা স্বত্ব দুটি জঙ্গী সংগঠনের কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ তিনটি ব্যাংকের একটি। এর শতকরা ষাট ভাগ শেয়ারের সৌদি প্রতিষ্ঠান অথবা কোন সৌদি নাগরিক। ইসলামী ব্যাংকের ওয়বেসাইট এবং উইকিপিডিয়াতে দেখা যায়, আরব বাদশাহ, কাতারের বাদশাহ এই ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার। এই দুই ব্যাংকেই আন্তর্জাতিক ইসলামী ত্রাণ সংস্থার এ্যাকাউন্ট রয়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান দুই শেয়ারহোল্ডার ইসলামী ত্রাণ সংস্থা এবং ‘লাযনাত আল বীর আল ইসলাম’ বা বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (বিআইএফ) জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওই ত্রাণ সংস্থাটি প্রত্যক্ষভাবে আল কায়েদা ও এর কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনকে অর্থ যোগান দিয়েছে। ওসামা বিন লাদেনের শ্যালক মোহাম্মদ জামাল হালিফা এই ত্রাণ সংস্থার ফিলিপিন্স শাখার প্রধান ছিলেন।
মার্কিন সিনেটের তদন্ত বিষয়ক স্থায়ী সাব কমিটি এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে বাংলাদেশ ও বিদেশের কোন্ কোন্ প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেই সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিল। এই তদন্ত বিষয়ক সাব কমিটি কংগ্রেসের ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালের ১৭ জুলাই প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দুটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৯/১১ টুইন টাওয়ার হামলার নেপথ্যে এই ব্যাংকের দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নের প্রমাণ পেয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা দল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই দুটি ব্যাংক জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত এমন তথ্য-প্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ ব্যাংকিং জায়েন্ট এইচএসবিসি ওই দুটি ব্যাংককে ডলার সরবরাহ করেছে। এইচএসবিসির নিজস্ব তদন্ত গ্রুপ ওই দুই ব্যাংকের জঙ্গী কানেকশন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর আগেই তথ্য-প্রমাণ দিয়ে ওই দুটি ব্যাংকের সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়গুলো আরও কঠোর নজরদারিতে রাখার সুপারিশ করে। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশনা অনুসরণ করেননি। এইচএসবিসি ব্যাংকের এই গাফিলতি রীতিমতো বিস্ময়কর! যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের তদন্ত প্রতিবেদনে সন্দেহভাজন অর্থ লেনদেনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এইচএসবিসির আভ্যন্তরীণ পরিচালনা বিভাগের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সৌদি আরবের আল রাজি ব্যাংকও সন্দেহজনক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ যখন এইচএসবিসির যুক্তরাষ্ট্র শাখায় একটি ইউএস ডলার এ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন করেছিল তখন ব্যাংকটিতে সৌদি আল রাজি ব্যাংকের শতকরা ৩৭ ভাগ মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আলোচনায় উঠে আসে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আল রাজি ব্যাংকের সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং ইসলামী ব্যাংকে এমন এক বাংলাদেশীর এ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বোমা হামলার অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, জঙ্গীদের ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধ বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের দায়ে ইসলামী ব্যাংককে ইতোমধ্যেই তিনবার জরিমানা করা হয়েছে।
মার্কিন সিনেটের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সৌদি আল রাজি ব্যাংক বাংলাদেশের সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে একটি করেসপনডেন্স এ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে। সৌদিভিত্তিক এনজিও ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন’ (আইআইআরও) অনেক বছর এর একক বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ছিল।
এই ত্রাণ সংস্থাটিকে মার্কিন প্রশাসন জঙ্গী অর্থায়নের জন্য চিহ্নিত করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোন প্রকার লেনদেন বা ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের দ্বিতীয় শেয়ারহোল্ডার ছিল ইসলামী দাতব্য সংস্থা হিসেবে পরিচিত সংগঠন ‘লাযনাত আল বীর আল ইসলাম।’ এটি বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (বিআইএফ) নামেও পরিচিত।
বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনকে (বিআইএফ) মার্কিন প্রশাসন জঙ্গীদের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে শনাক্ত করেছে এবং এর সঙ্গে মার্কিন নাগরিকদের সকল প্রকার লেনদেনও নিষিদ্ধ করেছে। আল কায়েদার প্রধান অর্থ দাতা ২০টি সংগঠনের মধ্যে ‘ লাযনাত আল বীর আল ইসলাম’ বা বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (বিআইএফ) অন্যতম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশে সৌদি রাষ্ট্রদূত আল ফুয়াদের উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। উইকিপিডিয়াতে প্রকাশ, বর্তমানে আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহের এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ইউসিফ আবদুল্লাহ আল রাজী ভাইস চেয়ারম্যান। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ইসলামী জঙ্গী এবং জামায়াতে ইসলামীর অর্থনৈতিক মেরুদ- বলে বার বার প্রমাণিত। জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের প্রসার ঘটেছে। জঙ্গীবাদ বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তাদের অর্থনৈতিক মদদদাতা, সমর্থকদের দেয়া আর্থিক সহযোগিতাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি শতকরা ২০ ভাগ। দেশের গোটা ব্যাংক ব্যবস্থার গড় হারের দ্বিগুণ। ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের কিছু দিক এইচএসবিসিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাংককেও আকৃষ্ট করেছে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক এইচএসবিসির দুই ডজন এ্যাফিলিয়েটেড কাস্টমার। এ কারণে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে যায়। জঙ্গী অর্থায়নের সুযোগ বেড়ে যায়।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশের ৬৫টি জেলার মধ্যে ৬৪টি জেলায় জঙ্গীরা সিরিজ বোমা হামলা চালালে এ দেশে জঙ্গীদের অবস্থান নিশ্চিত হয়। এরপরও জেএমবি, জামায়াতের দাতা এবং ইসলামী ব্যাংকের কার্যকলাপের ওপর নজরদারি করেনি তখনকার গোয়েন্দা অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা।
জেএমবি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে ‘শয়তানের সৃষ্ট ব্যবস্থা’ বা ‘তাগুতি শাসন’ অভিহিত করে দেশে আল্লাহর শাসন বা ইসলামী হুকুমত কায়েমের নামে জঙ্গী তৎপরতা শুরু করে।
এইচএসবিসির গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে জঙ্গী সংগঠন জমিয়াতুল মুজাহিদীনের বাংলাদেশ শাখার সাবেক প্রধান শায়খ আব্দুর রহমান ও তার ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়েরও এ্যাকাউন্ট ছিল। আবদুর রহমান, বাংলাভাইসহ ৬ জেএমবি নেতাকে ২০০৭ সালে দুই বিচারককে হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের ২টি শাখা সন্দেহজনক অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এমন প্রমাণ পায়। তবে সেই সময়ে এই লেনদেনের তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনার পর ইসলামী ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
যে কোন দেশের কাউন্টার টেররিজমের তালিকায় জঙ্গী অর্থায়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয় মার্কিন সিনেট অধিবেশনের আলোচনায়। একই সঙ্গে ইসলামী ব্যাংক এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত এমন তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এইচএসবিসি ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্র শাখার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগে বাংলাদেশের এই ব্যাংক দুটির প্রতি সন্দেহের তীর- জঙ্গী এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। একই সঙ্গে এই ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে চলেছে এমন সন্দেহও রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের। গত ২ সেপ্টেম্বর ইউএস হাউসের গোয়েন্দা কমিটি ৮শ’ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা রিপোর্ট করেছে ইসলামী ব্যাংক জামায়াতে ইসলামীর জন্য বিদেশ থেকে অর্থ পাচারের সুযোগ ও বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। বিদেশ থেকে ওই অর্থ এনে জামায়াত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে- এমন তথ্য প্রমাণও পেয়েছে সিআইএ। জামায়াতে ইসলামী এ জন্য ‘ইসলামিক ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন চালু করেছে, যা ইসলামিক ব্যাংকের সকল প্রকল্প তদারক করে থাকে। এ সব প্রকল্প থেকে অর্জিত মুনাফা এবং বিদেশী অনুদান থেকে লব্ধ কমিশন বা সুদ ইসলামী ব্যাংকের ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের’ এ্যাকাউন্টে জমা হয়। ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রধান জামায়াতে ইসলামীর কার্যকরী কমিটির সদস্য ও সৌদিভিত্তিক ইসলামী এনজিও রাবেতা-আল-আলম-আল-ইসলামীর কান্ট্রি ডিরেক্টর মীর কাশেম আলী। রাবেতা-আল-আলম-আল-ইসলামী বাংলাদেশে জামায়াতের বেশ কিছু প্রকল্পের দাতা সংস্থার ভূমিকা পালন করে। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মীর কাশেম আলী জামায়াতে ইসলামীর অর্থবিষয়ক কর্মকা-ের প্রধান ব্যক্তি।
২০০৭ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর কুয়েতভিত্তিক আন্তর্জাতিক ইসলামী এনজিও ‘রিভাইভ্যাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি’র কার্যক্রম নজরদারিতে আনা হয়। ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় এই এনজিওর এ্যাকাউন্টটিতে ২০০৬ সালে কিছু অনিয়ম পাওয়ার কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় ‘রিভাইভ্যাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি’র এ্যাকাউন্ট থেকে জঙ্গী অর্থায়নের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা। ২০০৫ এর নবেম্বরে ওই এ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি টাকা তোলা হয়েছিল বাংলাদেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা ঘটানোর উদ্দেশ্যে। তদন্তে এ দেশের গোয়েন্দারা আরও দেখতে পান ‘রিভাইভ্যাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি’র কুয়েতী দুইজন কর্মকর্তা ওই ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশী ও বিদেশী জঙ্গীদের ৭ লাখ ডলার দিয়েছিলেন।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশে কিছুকাল ধরে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং করছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি ভারতে কিছু যোগাযোগ গড়ে তুলেছে। অবাঞ্ছিত ও সন্দেহজনক কার্যকলাপের কারণে এই ব্যাংকের কার্যকরী ভাইস প্রেসিডেন্ট শওকত আলীকে কলকাতা পুলিশ ২০০৬ সালের আগস্টে গ্রেফতার করে। পরে তাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কলকাতায় অর্থ পাচার এবং সেখান থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং ভারতের বাইরে জঙ্গীদের কাছে সে সব অর্থ পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। এই ব্যাংকটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দা বলে জানা যায়।
সৌদিভিত্তিক আরেকটি এনজিও ‘আল হারমাইন ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ আল কায়েদার অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত। সংস্থাটি ঢাকায় এর কার্যালয় স্থাপন করেছিল এবং ঢাকার আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন চালাত। এই এনজিওর অর্থের প্রধান যোগানদার সৌদি রাজপরিবার। সৌদি আরবে সম্প্রতি বোমা হামলা এবং সৌদি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এর নেটওয়ার্কিং ধ্বংস করে দেবার প্রেক্ষিতে এর তৎপরতা কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হয়।
অতপর সৌদি সরকার আল-হারামাইন ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে নিষিদ্ধকরণ এবং এর সকল ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াফত করার অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে তদন্ত করে জানতে পারে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের রংপুর ও কক্সবাজার শাখা থেকে কেবলমাত্র টেলিফোন বার্তার মাধ্যমেই আল হারামাইনের বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে। টেলিফোনে বার্তা পাবার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যায়।
ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিংয়ের (এফএটিএফ) ৪০ সুপারিশের ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে বললেন-কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান। ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য ইসলামী ব্যাংক তাঁদের মনোনীত ব্যক্তিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের নিয়ম এখন নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
২০০৬ সালে জামায়াত-বিএনপি শাসনামলে জামায়াতের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তাদের নির্দেশনামা শিথিল করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নতুন গাইডলাইন জারির মাধ্যমে ‘গবর্নিং বডি’ এবং ‘শূরা কাউন্সিল ’ উভয়েরই বিধান বলবত করে। বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আলাদা কোন গাইডলাইন নেই।
বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৬ সালে দেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে পরিচিত রূপালী ব্যাংককে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন সৌদি প্রিন্স বান্দার বিন সুলতান বিন আব্দুল আজিজ আল সউদ ৬শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগের শর্তে প্রায় ২শ’ কোটি ডলার মূল্যমানের রূপালী ব্যাংক কেনার উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে অর্থপ্রদানের শর্তপূরণে গড়িমসি করায় সামরিক সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রিন্সের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। অবশ্য এই চুক্তি বাতিলের দরুন সম্ভবত উপমহাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদকে চাঙ্গা করতে অডিট ছাড়া সৌদি অর্থ সরাসরি ও নিয়মবহির্ভূতভাবে জঙ্গীদের হাতে পৌঁছবার পরিকল্পনাটি শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়।
সৌদি এনজিও দ্য ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও) এবং লাজনাত আল ডি আল ইসলাম ১৯৯৫ সালে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেয়। এই দুই সংগঠনকে ৯/১১ আক্রমণের নেপথ্য অর্থদাতা হিসেবে সন্দেহের তালিকায় নিয়েছে মার্কিন ফরেন এ্যাসেটস কন্ট্রোল এবং জাতিসংঘের কাউন্টার টেররিজম বডি। একই সঙ্গে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বা এসআইবিএল এবং ইসলামী ব্যাংকের জঙ্গী অর্থায়নের প্রমাণসহ প্রতিবেদন দেয় মার্কিন সিনেট কমিটি। এই দুই ব্যাংকের অবৈধ অর্থের প্রবাহ প্রতিরোধে ব্রিটিশ ব্যাংক এইচএসবিসির ব্যর্থতাকে দায়ী করে মার্কিন সিনেট কমিটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বা এসআইবিএলের কয়েকটি শেয়ারহোল্ডার আন্তর্জাতিক জঙ্গী অর্থায়নে সম্পৃক্ত ছিল-এমন প্রমাণ তারা পেয়েছেন। এর পর বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আইনের আওতায় আনে। পরবর্তীতে এসআইবিএলের মালিক পুরো শেয়ার বিক্রি করে বিদেশে ফিরে যান।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, বাংলাদেশে জামায়াত অথবা মৌলবাদের অর্থনীতির বার্ষিক নীট মুনাফা এখন আনুমানিক ১২শ’ কোটি টাকা। এ মুনাফার সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ আসে ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি থেকে। জামায়াত এ দেশে যেভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেছে, পরিকল্পিতভাবে এই উৎস সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ দেশে জঙ্গীবাদের উৎস নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
এ দেশে জঙ্গীদের অর্থের অবাধ প্রবাহ শনাক্ত করে এর উৎস বন্ধ করা না গেলে এ দেশে জঙ্গীবাদ প্রসারে আল কায়েদার হুমকির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2014-09-08&ni=184704

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় আল কায়েদার নেটওয়ার্ক -শাহরিয়ার কবির

যে সময় ইরাক ও সিরিয়ায় উগ্র মৌলবাদী ‘আইসিস’ (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড সিরিয়া) সামরিক অভিযান চালিয়ে একের পর এক জনপদ দখল করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী হুকুমত কায়েম করছে, তখন আল কায়েদার প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ ও বার্মায় মুসলমানদের রক্ষা এবং ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা প্রসারিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর (২০১৪) জাওয়াহিরির ৫৫ মিনিটের ভিডিও বার্তাটি ইন্টারনেটে প্রচারিত হওয়ার পর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ‘রেড এ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যারা এতদিন বাংলাদেশে আল কায়েদার কোন কার্যকলাপ নেই বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন তারা জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তার সত্যতা যাচাই করছেন। তবে তাদের কেউ কেউ যথারীতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশে আল কায়েদার অবস্থান নেই বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন।
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে ‘Ignorance is golden’, যার বাংলা- ‘অজ্ঞতা হিরন্ময়’। প্রাকৃত ভাষায় আমরা বলি ‘না জানার আনন্দ’ কিংবা ‘পাগলের সুখ মনে মনে’। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কয়েকটি গণমাধ্যম আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছিল। আমি এক কথায় বলেছি, যারা বলেন, বাংলাদেশে আল কায়েদার নেটওয়ার্ক নেই তারা হয় অজ্ঞ, না হয় আল কায়েদার লোক।
বাংলাদেশে আল কায়েদার অবস্থানের বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে প্রায় পনেরো বছর ধরে। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি হরকাত-উল জিহাদের জঙ্গীরা বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানকে তাঁর বাড়িতে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। কবিকে আঘাত করতে না পারলেও হামলাকারীদের বাধা দিতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রবধূ আহত হয়েছিলেন এবং হামলাকারীরা গ্রেফতার হয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে পুলিশ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী প্রচারপত্র উদ্ধার করে এবং শেষ পর্যন্ত আরও ৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
শামসুর রাহমান শুধু কবি ছিলেন না, বাংলাদেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের একজন পুরোগামী নেতা তিনি। ১৯৯৩ সালের মার্চে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন শামসুর রাহমান। পরের বছর ১৯৯৪-এর ২৬ মার্চ এক বিশাল জনসমাবেশে ৮ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর দুষ্কর্ম সম্পর্কে কমিশনের প্রতিবেদন পাঠ করেছিলেন শামসুর রাহমান, যে মঞ্চে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং কমিশনের অপরাপর সদস্যের সঙ্গে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামাল উপস্থিত ছিলেন। যে ৮ জন যুদ্ধাপরাধী সম্পর্কে শামসুর রাহমান সেদিন দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন তাদের ভেতর ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তখন থেকেই শামসুর রাহমান জঙ্গী মৌলবাদীদের অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলেন।
এর ছয় বছর পর শামসুর রাহমান হত্যা প্রচেষ্টার সূত্র ধরে পুলিশ যখন হরকাত-উল জিহাদের অর্ধশত জঙ্গী গ্রেফতার করে, তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের ভেতর একজন দক্ষিণ আফ্রিকা এবং একজন পাকিস্তানের নাগরিকও ছিল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক আহমেদ সাদেক জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্বীকার করেছি- ওসামা বিন লাদেন তাদের ২০ লাখ ডলার দিয়েছিলেন বাংলাদেশে জঙ্গী রিক্রুট ও ট্রেনিংয়ের জন্য। এই অর্থ সে গ্রেফতারকৃত পাকিস্তানী মোহাম্মদ সাজেদকে দিয়েছিল, কারণ সাজেদ ছিল আফগানিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে আল কায়েদার নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী। সাজেদ এই অর্থ দিয়েছে অপর গ্রেফতারকৃত হুজি নেতা বখতিয়ারকে। বখতিয়ার এই অর্থ ৪২১টি মাদ্রাসায় দিয়েছিল দলের কর্মী রিক্রুট করবার জন্য।
বাংলাদেশে হরকাত-উল জিহাদের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯২ সালে, যখন খালেদা জিয়া ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় হুজির ওপর প্রথম আঘাত আসে ব্যাপক ধরপাকড়, আস্তানা ও প্রকাশনা বন্ধ করবার মাধ্যমে। জামায়াতে ইসলামী সব সময় হুজিসহ কোন ধরনের জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও হুজি নেতাদের জবানবন্দি এবং তাদের আস্তানা থেকে জব্দ করা দলিলপত্র থেকে তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল জামায়াতের সঙ্গে জঙ্গীদের আদর্শিক, আর্থিক ও সামরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো। এর পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দলের নেতা, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সমাবেশ এমনকি পীরের মাজারে হামলা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল, যার চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ দেখেছি ২০০১-২০০৬ সালে। যখন জামায়াত-বিএনপির জোট ক্ষমতায় ছিল। শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয়, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী ভারত ও বার্মায় জামায়াত ও জঙ্গীরা কিভাবে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে- সে সময় দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বহু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
আল কায়েদার মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় ১৯৯৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, যখন আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন মিসরের আইমান আল জাওয়াহিরি ও আহমেদ তাহা এবং পাকিস্তানের মীর হামযার সঙ্গে বাংলাদেশের জিহাদ মুভমেন্টের ফজলুর রহমান এক যুক্ত ঘোষণায় স্বাক্ষর করে আমেরিকাকে ধ্বংস এবং আল আকসা মসজিদ উদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাপী মুসলিম ভাইদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২০০০ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হুজি কোটালিপাড়ায় তাঁর জনসভাস্থলে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা স্থাপন করেছিল যা সভা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে পুলিশ অক্ষত অবস্থায় ফিউজসহ উদ্ধার করে। এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য আরও কয়েক দফা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাঁর সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংসতম গ্রেনেড-বোমা হামলায়।
জামায়াত-বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল হুজি ও অপরাপর জঙ্গী সন্ত্রাসীরা সরকারের যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। যাবতীয় জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা- থেকে তাদের রক্ষার জন্য খালেদা-নিজামীদের সরকার সব সময় বলেছে এসব আওয়ামী লীগ ও ভারত করেছে। বিএনপি-জামায়াতের এই বক্তব্য দেশের মানুষ যেমন প্রত্যাখ্যান করেছে, পশ্চিমের গণমাধ্যম ও সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করেননি। বরং তখন পশ্চিমা গণমাধ্যমে এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৯/১১-এ নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর যখন লাদেন ও জাওয়াহিরিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে খোঁজা হচ্ছিল তখন তারা বাংলাদেশের সরকারী তত্ত্বাবধানে বেশ কিছুদিনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, এমনকি সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকে এরকম ধারণা পোষণ করেন- বাংলাদেশে আল কায়েদার অবস্থান স্বীকার করলে আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে। আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- আমেরিকা কখন কোন দেশে কী ধরনের হস্তক্ষেপ করবে সেটা সম্পূর্ণভাবে তাদের আন্তর্জাতিক আধিপত্য নীতির অন্তর্গত। কোন সরকার যদি জঙ্গী সন্ত্রাস দমনে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং তার প্রতি যদি দেশের জনগণের এবং প্রতিবেশীদের সমর্থন থাকে, আমেরিকার পক্ষে কখনও সে দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ সম্ভব হবে না।
জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন আছে- বিশ্বব্যাপী যা ‘সালাফিবাদ’ বা ‘ওহাবিবাদ’ নামে পরিচিত, দক্ষিণ এশিয়ায় তা হচ্ছে ‘মওদুদিবাদ’। ‘ওহাবিবাদ’ ও ‘মওদুদিবাদ’-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ এবং খোদ আমেরিকা। গত শতাব্দীর আশির দশকে আফগানিস্তানে ড. নজিবুল্লাহর সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের জন্য আমেরিকা তালেবান ও আল কায়েদাকে মদদ দিয়েছে। নজিবুল্লাহকে হত্যা করে তালেবানরা যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে পশ্চিমের দিকে বর্শাফলক ঘুরিয়ে দেয় তখন আমেরিকা মোল্লা উমর ও লাদেনের সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছিল। পাকিস্তানের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ একবাল আহমেদ লিখেছেন, সেই অবরোধের সময় ইসলামাবাদে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত কিভাবে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। আল কায়েদা ও তালেবানের বিরুদ্ধে আমেরিকার ‘ওয়ার অন টেরর’ প্রকৃতপক্ষে ছোটদের কার্টুন সিরিজ ‘টম এ্যান্ড জেরি’র খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। খেলা হলেও কার্টুনের মতো এটি নির্দোষ ও নির্মল নয়, এর জন্য লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে, শত শত জনপদ- এমনকি সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার একাধিকবার জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস সম্পর্কে ‘জিরো টলারেন্স’-এর ঘোষণা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর মাঠ পর্যায়ে প্রচুর জঙ্গী ধরা পড়েছে, প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, প্রচুর দলিলপত্র জব্দ হয়েছে। জব্দকৃত জঙ্গী প্রকাশনা ও দলিলপত্র থেকে জানা গেছে শেখ হাসিনা এখনও জঙ্গীদের হিটলিস্টের এক নম্বরে রয়েছেন। তারপরও ২০১৩ সালে জামায়াত-হেফাজতের মহাতা-বের পর গুরুত্বপূর্ণ যেসব জঙ্গী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তারা যথারীতি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।
গত বছর ৫ মে’র মহাতা-বের পর জামায়াত ও জঙ্গীরা তাদের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করেছিল সরকার হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করেছে, ভারতকে তুষ্ট করবার জন্য আলেমদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হচ্ছে। ‘অধিকার’ নামের জামায়াত-বান্ধব একটি এনজিওর কর্মকর্তা আদিলুর রহমানকে গ্রেফতারের পর ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু মানবাধিকার সংগঠন এমনই মাতম শুরু করেছিল যে, সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার বহু প্রতিষ্ঠান সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অর্থে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে, যারা আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের মতো মনে করে জামায়াত একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দল, এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে, জঙ্গী সন্ত্রাসের প্রসার ঘটবে। ‘মওদুদিবাদ’ সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলে, ’৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে সন্দিহান হলে, ‘ওহাবিবাদ’-এর রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকা- সম্পর্কে অজ্ঞ হলে জামায়াতকে ‘মডারেট ইসলামী’ দল মনে করা স্বাভাবিক। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই বোধগম্য ও অবোধগম্য কারণে জামায়াতের প্রতি দুর্বল।
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে জঙ্গী দমন কার্যক্রম সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘বন্ধাগমনের মতো নিষ্ফল হতে বাধ্য। একইভাবে জঙ্গী দমনে নাগরিক সমাজকে অন্ধকারে রেখে কোন উদ্যোগ সফল হবে না। শুধু কওমী মাদ্রাসা নয়, আলিয়া মাদ্রাসায়ও মওদুদীর লেখা ও জীবনী পড়ানো হয়, অথচ বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই পড়ানো হয় না। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির, যেটি সন্ত্রাস বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তালিকার শীর্ষে রয়েছেÑ সরকারি বেসরকারি যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্নে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। প্রতিপক্ষকে হত্যা, রগকাটা শিবিরের প্রাত্যহিক কার্যক্রমের অংশ হয়ে গেছে।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করলেও এর প্রয়োগ গত ছয় বছরেও ঘটেনি। সদিচ্ছা থাকলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনেও জামায়াত নিষিদ্ধ করা যায়। এর জন্য নতুন আইন প্রণয়ন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘আঞ্চলিক টাস্ক ফোর্স’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা বলেছিলাম দেশে দেশে যেভাবে মৌলবাদী সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিচ্ছে এর জন্য আন্তর্জাতিক ‘টাস্কফোর্স’ গঠন প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্যে ‘আইসিস’ ও আমেরিকার মরণঘাতী খেলায় যেভাবে সুমেরীয় সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য আঞ্চলিক টাস্ক ফোর্স গঠন আরও জরুরী হয়ে উঠেছে। সবাই যদি আগ্রহী নাও হয়- জাওয়াহিরির সাম্প্রতিক ঘোষণার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ, ভারত ও বার্মা অন্তত প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস সমূলে উৎপাটিত না হলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা যেমন বিঘিœত হবে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিসহ এই অঞ্চলের দশ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা বিপন্ন হবে।