Monday, September 8, 2014

বিশ্বজুড়ে জঙ্গী অর্থায়ন -সুমি খান

 ০ বাংলাদেশে জাওয়াহিরির হুমকি খাটো করে দেখার সুযোগ নেই
০ জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধে শুধু কঠোরতা দিয়ে কাজ হবে না, নির্মূল করতে হবে
০ বার বার প্রমাণিত হলেও বিশেষ ব্যাংক ধরাছোঁয়ার বাইরে


আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা নেতা আল জাওয়াহিরি সম্প্রতি হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশেও তাদের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশে জেহাদের ঘোষণা দিয়েছে জঙ্গী নেতা জাওয়াহিরি। এই হুমকির মুখে এদেশে জঙ্গী দমনে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা বললেও জঙ্গী অর্থায়নের উৎস নির্মূল করা না গেলে এদেশে জঙ্গী তৎপরতা কোন ভাবেই দমন করা যাবে না মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো কোন নির্দিষ্ট দেশে আর তাদের তহবিল রাখছে না। আল কায়েদা বা অন্য জঙ্গী দলগুলো তাদের সংগঠনের ফান্ড সংগ্রহ করছে সারা বিশ্ব থেকে, ছড়িয়েও দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদের কাজে। যার উৎস অনুসন্ধান দুরূহ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিং (এফএটিএফ) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও চাপে রেখেছে, যাতে এদেশের কোন ব্যাংকে মানি লন্ডারিং এবং জঙ্গী অর্থায়ন নজরদারির আওতায় আসে। ১৯৮৯ সালে প্যারিসে জি-৭ এর রাষ্ট্রপ্রধান এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের প্রভাবশালী আট দেশের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে। জি-৭ সামিট থেকে ঘোষণা করা হয় বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতকে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিংয়ের হুমকি থেকে রক্ষা করতে হবে। সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী জঙ্গী অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিংরোধে গঠিত হয় ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিং (এফএটিএফ)।
ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, জঙ্গীবাদে অর্থায়ন প্রতিরোধে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুরক্ষার জন্য ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিং (এফএটিএফ)-এর ৪০টি সুপারিশ আছে। ২০০২ সাল থেকে এফএটিএফের আইন কয়েকবার বদলেছে। তখন থেকেই আমরা এদের সুপারিশ অনুসরণ করছি। কারণ, আমরা এদের প্রতিটি সুপারিশ মানতে বাধ্য। এ কারণে এই সুপারিশগুলো আমরা কঠোরভাবে মেনে চলার চেষ্টা করছি।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত দফতর ইউনোডিসি বা ইউনাইটেড নেশন অফিস অন ড্রাগস এ্যান্ড ক্রাইমের হিসাব মতে প্রতিবছর বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্থমূল্যের ২ থেকে ৫ শতাংশ মানি লন্ডারিং বা বেআইনী পথে হয় । এর পরিমাণ আনুমানিক ৮০ হাজার কোটি ডলার থেকে ২ লাখ কোটি ডলার। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষ এসএনবির সাম্প্রতিক তথ্য মতে, সুইজারল্যান্ডের ২৮৩টি ব্যাংকে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার জমা রয়েছে। অর্থনীতির সংজ্ঞামতে কালো টাকা বলতে হিসাববহির্ভূত অর্থ বোঝায়। কর ফাঁকি দেয়া সম্পদও কালো টাকার আওতায় পড়ে। আইনী পথে রোজগার করেও সেই উপার্জনের বিপরীতে যথাযথ কর না দেয়া হলেও তা কালো টাকার আওতায় পড়ে।
প্যারিসের শাঁতে লা মুয়েতের সদর দফতরে এ বছরের ২১ জুলাই বিশ্বের ৩৪টি দেশের সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর সদস্যরা জরুরী বৈঠক করে। ওইসিডিতে সাবেক বেলজিয়াম রাষ্ট্রদূত রজার অকরেন্টের নামাঙ্কিত কক্ষে সেই জরুরী বৈঠকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত বিশ্বের সদস্যরা স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান প্রদান ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। যার মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তে নামে বেনামে লুকানো লাখো কোটি ডলার খুঁজে বের করার জন্য অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর এই প্রয়াস।
২০১৩ সালের বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে বিশ্বের মোট উৎপাদন প্রায় ৭৫ লাখ কোটি ডলার। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে গোটা দক্ষিণ এশিয়া যা উৎপাদন করে, বিশ্বের কালো টাকা তাকেও ছাপিয়ে যায়। কোন দেশের আয়ের একটা অংশের ওপর সেই দেশের সরকার কর থেকে বঞ্চিত হয়। কর ফাঁকি দেয়া টাকার একাংশ বিদেশী কোন ব্যাংকে জমা হয়। যে অংশ দেশে রয়ে যায়, সেটা দেশের বাজারে ঘুরপথে ঢুকে পড়ে। এতে যে কোন দেশ এবং বিশ্ব অর্থনীতির দু’ভাবে সর্বনাশ হয়।
কোন্ দেশের মুদ্রা বাজারে ঠিক কত পরিমাণ অর্থ আছে সেই মূল হিসাবটাই আর সরকারের হাতে থাকে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরোপুরি মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যে ব্যবস্থাই নিক না কেন মুদ্রাবাজারে একাংশ তার আওতার বাইরে থেকে যায়। এতে দীর্ঘমেয়াদী কোন আর্থিক ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, বিদেশী ব্যাংকে হিসাববহির্ভূত অর্থ জমা হওয়ায় কোন দেশের বাইরে অনাকাক্সিক্ষত সম্পদ জমা হতে থাকে, যা সরকারের অজ্ঞাত থাকে। একই সঙ্গে সেই অর্থ কিভাবে ব্যয় হয়, তার ওপর কোন রকম নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে ধীরে ধীরে সেই দেশের বাইরে যদি আর্থিক ক্ষমতার অন্য ভরকেন্দ্র গড়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে।
সাধারণভাবে দেখা যায় এক দেশের হিসাববহির্ভূত অর্থ বেনামে অন্য দেশের ব্যাংকে জমা হচ্ছে বা কোন ব্যবসায়ে সেই টাকা ঢালা হচ্ছে। এই জন্যই অনেক দেশকে এক সঙ্গে কালো টাকা খোঁজার কাজে নামানোর চেষ্টা করছে ৩৪ সদস্য দেশের এই সংগঠন, যাতে কোন অপরাধী পালাতে না পারে। আমন্ত্রিত দেশ হিসেবে ভারত ইতোমধ্যেই সেই চুক্তিতে সই করেছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জি-২০ দেশের অর্থমন্ত্রীরা প্রস্তাবটিতে সম্মতি দিলে তা বিশ্বব্যাপী অভিযানে নেমে পড়বে।
সন্দেহ করা হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদীরা হাওয়ালা পদ্ধতিতে অর্থ আদান-প্রদান করে। বিভিন্ন দেশে হাওয়ালার বিভিন্ন নাম। যেমন ভারতে বলা হয় হুন্ডি, চীনে এর নাম ফেই-চিয়েন, হংকং এ হুই কুয়ান, ফিলিপিন্সে পাদালা, থাইল্যান্ডে ফেই কোয়ান। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, পশ্চিম আফ্রিকার মালি, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় ‘হাওয়ালা’র রমরমা। এই হিসাববহির্ভূত অর্থের মালিকরা প্রচ- ক্ষমতাশালী।
জামায়াতে ইসলামী, জেএমবি এবং অন্য জঙ্গী সংগঠনগুলোর অর্থায়নে ইসলামী ব্যাংকের সম্পৃক্ততা বার বার প্রমাণিত হওয়ার পর ও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে এই ব্যাংক। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের মালিকানা স্বত্ব দুটি জঙ্গী সংগঠনের কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ তিনটি ব্যাংকের একটি। এর শতকরা ষাট ভাগ শেয়ারের সৌদি প্রতিষ্ঠান অথবা কোন সৌদি নাগরিক। ইসলামী ব্যাংকের ওয়বেসাইট এবং উইকিপিডিয়াতে দেখা যায়, আরব বাদশাহ, কাতারের বাদশাহ এই ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার। এই দুই ব্যাংকেই আন্তর্জাতিক ইসলামী ত্রাণ সংস্থার এ্যাকাউন্ট রয়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান দুই শেয়ারহোল্ডার ইসলামী ত্রাণ সংস্থা এবং ‘লাযনাত আল বীর আল ইসলাম’ বা বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (বিআইএফ) জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওই ত্রাণ সংস্থাটি প্রত্যক্ষভাবে আল কায়েদা ও এর কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনকে অর্থ যোগান দিয়েছে। ওসামা বিন লাদেনের শ্যালক মোহাম্মদ জামাল হালিফা এই ত্রাণ সংস্থার ফিলিপিন্স শাখার প্রধান ছিলেন।
মার্কিন সিনেটের তদন্ত বিষয়ক স্থায়ী সাব কমিটি এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে বাংলাদেশ ও বিদেশের কোন্ কোন্ প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেই সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিল। এই তদন্ত বিষয়ক সাব কমিটি কংগ্রেসের ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালের ১৭ জুলাই প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দুটি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৯/১১ টুইন টাওয়ার হামলার নেপথ্যে এই ব্যাংকের দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নের প্রমাণ পেয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা দল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই দুটি ব্যাংক জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত এমন তথ্য-প্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ ব্যাংকিং জায়েন্ট এইচএসবিসি ওই দুটি ব্যাংককে ডলার সরবরাহ করেছে। এইচএসবিসির নিজস্ব তদন্ত গ্রুপ ওই দুই ব্যাংকের জঙ্গী কানেকশন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর আগেই তথ্য-প্রমাণ দিয়ে ওই দুটি ব্যাংকের সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়গুলো আরও কঠোর নজরদারিতে রাখার সুপারিশ করে। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশনা অনুসরণ করেননি। এইচএসবিসি ব্যাংকের এই গাফিলতি রীতিমতো বিস্ময়কর! যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের তদন্ত প্রতিবেদনে সন্দেহভাজন অর্থ লেনদেনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এইচএসবিসির আভ্যন্তরীণ পরিচালনা বিভাগের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সৌদি আরবের আল রাজি ব্যাংকও সন্দেহজনক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ যখন এইচএসবিসির যুক্তরাষ্ট্র শাখায় একটি ইউএস ডলার এ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন করেছিল তখন ব্যাংকটিতে সৌদি আল রাজি ব্যাংকের শতকরা ৩৭ ভাগ মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আলোচনায় উঠে আসে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আল রাজি ব্যাংকের সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং ইসলামী ব্যাংকে এমন এক বাংলাদেশীর এ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বোমা হামলার অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, জঙ্গীদের ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধ বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের দায়ে ইসলামী ব্যাংককে ইতোমধ্যেই তিনবার জরিমানা করা হয়েছে।
মার্কিন সিনেটের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সৌদি আল রাজি ব্যাংক বাংলাদেশের সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে একটি করেসপনডেন্স এ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে। সৌদিভিত্তিক এনজিও ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন’ (আইআইআরও) অনেক বছর এর একক বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ছিল।
এই ত্রাণ সংস্থাটিকে মার্কিন প্রশাসন জঙ্গী অর্থায়নের জন্য চিহ্নিত করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোন প্রকার লেনদেন বা ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের দ্বিতীয় শেয়ারহোল্ডার ছিল ইসলামী দাতব্য সংস্থা হিসেবে পরিচিত সংগঠন ‘লাযনাত আল বীর আল ইসলাম।’ এটি বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (বিআইএফ) নামেও পরিচিত।
বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনকে (বিআইএফ) মার্কিন প্রশাসন জঙ্গীদের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে শনাক্ত করেছে এবং এর সঙ্গে মার্কিন নাগরিকদের সকল প্রকার লেনদেনও নিষিদ্ধ করেছে। আল কায়েদার প্রধান অর্থ দাতা ২০টি সংগঠনের মধ্যে ‘ লাযনাত আল বীর আল ইসলাম’ বা বেনিভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (বিআইএফ) অন্যতম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশে সৌদি রাষ্ট্রদূত আল ফুয়াদের উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। উইকিপিডিয়াতে প্রকাশ, বর্তমানে আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহের এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ইউসিফ আবদুল্লাহ আল রাজী ভাইস চেয়ারম্যান। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ইসলামী জঙ্গী এবং জামায়াতে ইসলামীর অর্থনৈতিক মেরুদ- বলে বার বার প্রমাণিত। জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের প্রসার ঘটেছে। জঙ্গীবাদ বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তাদের অর্থনৈতিক মদদদাতা, সমর্থকদের দেয়া আর্থিক সহযোগিতাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি শতকরা ২০ ভাগ। দেশের গোটা ব্যাংক ব্যবস্থার গড় হারের দ্বিগুণ। ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের কিছু দিক এইচএসবিসিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাংককেও আকৃষ্ট করেছে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক এইচএসবিসির দুই ডজন এ্যাফিলিয়েটেড কাস্টমার। এ কারণে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে যায়। জঙ্গী অর্থায়নের সুযোগ বেড়ে যায়।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশের ৬৫টি জেলার মধ্যে ৬৪টি জেলায় জঙ্গীরা সিরিজ বোমা হামলা চালালে এ দেশে জঙ্গীদের অবস্থান নিশ্চিত হয়। এরপরও জেএমবি, জামায়াতের দাতা এবং ইসলামী ব্যাংকের কার্যকলাপের ওপর নজরদারি করেনি তখনকার গোয়েন্দা অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা।
জেএমবি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে ‘শয়তানের সৃষ্ট ব্যবস্থা’ বা ‘তাগুতি শাসন’ অভিহিত করে দেশে আল্লাহর শাসন বা ইসলামী হুকুমত কায়েমের নামে জঙ্গী তৎপরতা শুরু করে।
এইচএসবিসির গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে জঙ্গী সংগঠন জমিয়াতুল মুজাহিদীনের বাংলাদেশ শাখার সাবেক প্রধান শায়খ আব্দুর রহমান ও তার ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়েরও এ্যাকাউন্ট ছিল। আবদুর রহমান, বাংলাভাইসহ ৬ জেএমবি নেতাকে ২০০৭ সালে দুই বিচারককে হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের ২টি শাখা সন্দেহজনক অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এমন প্রমাণ পায়। তবে সেই সময়ে এই লেনদেনের তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনার পর ইসলামী ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
যে কোন দেশের কাউন্টার টেররিজমের তালিকায় জঙ্গী অর্থায়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয় মার্কিন সিনেট অধিবেশনের আলোচনায়। একই সঙ্গে ইসলামী ব্যাংক এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত এমন তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এইচএসবিসি ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্র শাখার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগে বাংলাদেশের এই ব্যাংক দুটির প্রতি সন্দেহের তীর- জঙ্গী এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। একই সঙ্গে এই ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে চলেছে এমন সন্দেহও রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের। গত ২ সেপ্টেম্বর ইউএস হাউসের গোয়েন্দা কমিটি ৮শ’ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা রিপোর্ট করেছে ইসলামী ব্যাংক জামায়াতে ইসলামীর জন্য বিদেশ থেকে অর্থ পাচারের সুযোগ ও বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। বিদেশ থেকে ওই অর্থ এনে জামায়াত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে- এমন তথ্য প্রমাণও পেয়েছে সিআইএ। জামায়াতে ইসলামী এ জন্য ‘ইসলামিক ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন চালু করেছে, যা ইসলামিক ব্যাংকের সকল প্রকল্প তদারক করে থাকে। এ সব প্রকল্প থেকে অর্জিত মুনাফা এবং বিদেশী অনুদান থেকে লব্ধ কমিশন বা সুদ ইসলামী ব্যাংকের ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের’ এ্যাকাউন্টে জমা হয়। ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রধান জামায়াতে ইসলামীর কার্যকরী কমিটির সদস্য ও সৌদিভিত্তিক ইসলামী এনজিও রাবেতা-আল-আলম-আল-ইসলামীর কান্ট্রি ডিরেক্টর মীর কাশেম আলী। রাবেতা-আল-আলম-আল-ইসলামী বাংলাদেশে জামায়াতের বেশ কিছু প্রকল্পের দাতা সংস্থার ভূমিকা পালন করে। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মীর কাশেম আলী জামায়াতে ইসলামীর অর্থবিষয়ক কর্মকা-ের প্রধান ব্যক্তি।
২০০৭ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর কুয়েতভিত্তিক আন্তর্জাতিক ইসলামী এনজিও ‘রিভাইভ্যাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি’র কার্যক্রম নজরদারিতে আনা হয়। ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় এই এনজিওর এ্যাকাউন্টটিতে ২০০৬ সালে কিছু অনিয়ম পাওয়ার কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় ‘রিভাইভ্যাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি’র এ্যাকাউন্ট থেকে জঙ্গী অর্থায়নের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা। ২০০৫ এর নবেম্বরে ওই এ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি টাকা তোলা হয়েছিল বাংলাদেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা ঘটানোর উদ্দেশ্যে। তদন্তে এ দেশের গোয়েন্দারা আরও দেখতে পান ‘রিভাইভ্যাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি’র কুয়েতী দুইজন কর্মকর্তা ওই ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশী ও বিদেশী জঙ্গীদের ৭ লাখ ডলার দিয়েছিলেন।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশে কিছুকাল ধরে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং করছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি ভারতে কিছু যোগাযোগ গড়ে তুলেছে। অবাঞ্ছিত ও সন্দেহজনক কার্যকলাপের কারণে এই ব্যাংকের কার্যকরী ভাইস প্রেসিডেন্ট শওকত আলীকে কলকাতা পুলিশ ২০০৬ সালের আগস্টে গ্রেফতার করে। পরে তাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কলকাতায় অর্থ পাচার এবং সেখান থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং ভারতের বাইরে জঙ্গীদের কাছে সে সব অর্থ পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। এই ব্যাংকটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দা বলে জানা যায়।
সৌদিভিত্তিক আরেকটি এনজিও ‘আল হারমাইন ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ আল কায়েদার অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত। সংস্থাটি ঢাকায় এর কার্যালয় স্থাপন করেছিল এবং ঢাকার আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন চালাত। এই এনজিওর অর্থের প্রধান যোগানদার সৌদি রাজপরিবার। সৌদি আরবে সম্প্রতি বোমা হামলা এবং সৌদি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এর নেটওয়ার্কিং ধ্বংস করে দেবার প্রেক্ষিতে এর তৎপরতা কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হয়।
অতপর সৌদি সরকার আল-হারামাইন ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে নিষিদ্ধকরণ এবং এর সকল ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াফত করার অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে তদন্ত করে জানতে পারে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের রংপুর ও কক্সবাজার শাখা থেকে কেবলমাত্র টেলিফোন বার্তার মাধ্যমেই আল হারামাইনের বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে। টেলিফোনে বার্তা পাবার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যায়।
ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স অন মানি লন্ডারিংয়ের (এফএটিএফ) ৪০ সুপারিশের ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে বললেন-কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান। ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য ইসলামী ব্যাংক তাঁদের মনোনীত ব্যক্তিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের নিয়ম এখন নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
২০০৬ সালে জামায়াত-বিএনপি শাসনামলে জামায়াতের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তাদের নির্দেশনামা শিথিল করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নতুন গাইডলাইন জারির মাধ্যমে ‘গবর্নিং বডি’ এবং ‘শূরা কাউন্সিল ’ উভয়েরই বিধান বলবত করে। বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আলাদা কোন গাইডলাইন নেই।
বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৬ সালে দেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে পরিচিত রূপালী ব্যাংককে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন সৌদি প্রিন্স বান্দার বিন সুলতান বিন আব্দুল আজিজ আল সউদ ৬শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগের শর্তে প্রায় ২শ’ কোটি ডলার মূল্যমানের রূপালী ব্যাংক কেনার উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে অর্থপ্রদানের শর্তপূরণে গড়িমসি করায় সামরিক সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রিন্সের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। অবশ্য এই চুক্তি বাতিলের দরুন সম্ভবত উপমহাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদকে চাঙ্গা করতে অডিট ছাড়া সৌদি অর্থ সরাসরি ও নিয়মবহির্ভূতভাবে জঙ্গীদের হাতে পৌঁছবার পরিকল্পনাটি শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়।
সৌদি এনজিও দ্য ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও) এবং লাজনাত আল ডি আল ইসলাম ১৯৯৫ সালে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেয়। এই দুই সংগঠনকে ৯/১১ আক্রমণের নেপথ্য অর্থদাতা হিসেবে সন্দেহের তালিকায় নিয়েছে মার্কিন ফরেন এ্যাসেটস কন্ট্রোল এবং জাতিসংঘের কাউন্টার টেররিজম বডি। একই সঙ্গে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বা এসআইবিএল এবং ইসলামী ব্যাংকের জঙ্গী অর্থায়নের প্রমাণসহ প্রতিবেদন দেয় মার্কিন সিনেট কমিটি। এই দুই ব্যাংকের অবৈধ অর্থের প্রবাহ প্রতিরোধে ব্রিটিশ ব্যাংক এইচএসবিসির ব্যর্থতাকে দায়ী করে মার্কিন সিনেট কমিটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বা এসআইবিএলের কয়েকটি শেয়ারহোল্ডার আন্তর্জাতিক জঙ্গী অর্থায়নে সম্পৃক্ত ছিল-এমন প্রমাণ তারা পেয়েছেন। এর পর বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আইনের আওতায় আনে। পরবর্তীতে এসআইবিএলের মালিক পুরো শেয়ার বিক্রি করে বিদেশে ফিরে যান।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, বাংলাদেশে জামায়াত অথবা মৌলবাদের অর্থনীতির বার্ষিক নীট মুনাফা এখন আনুমানিক ১২শ’ কোটি টাকা। এ মুনাফার সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ আসে ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি থেকে। জামায়াত এ দেশে যেভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেছে, পরিকল্পিতভাবে এই উৎস সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ দেশে জঙ্গীবাদের উৎস নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
এ দেশে জঙ্গীদের অর্থের অবাধ প্রবাহ শনাক্ত করে এর উৎস বন্ধ করা না গেলে এ দেশে জঙ্গীবাদ প্রসারে আল কায়েদার হুমকির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2014-09-08&ni=184704

No comments:

Post a Comment