Friday, September 12, 2014

শেখ রেহানার জন্মদিন: এম নজরুল ইসলাম

রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তিনি। বেড়ে ওঠা রাজনীতির আবহে। জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছেন, বাড়িতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আসা-যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। কিন্তু নিজে এড়িয়ে চলেন সব ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ। মানুষের কল্যাণ কামনা করেন সবসময়। এই কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা তো হয়েছে পারিবারিক সূত্রেই। নিজে সবসময় থেকেছেন আড়ালে। এই আড়ালচারিতা তাঁর মাহাত্ম্যকে একটুও ম্লান করেনি। বরং পাদপ্রদীপের আলোয় না এসেও তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে যে অবদান রেখে চলেছেন তা তুলনাহীন। মিতবাক এই নারী নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার সেবায়। তাঁর সেই নীরব নিবেদন সাদা চোখে সবার গোচরে আসে না।
কী পরিচয় তাঁর। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তিনি বাংলাদেশের তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন। তিনি শেখ রেহানা- আপন বলয়ে যিনি নিজেকে গড়েছেন সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। প্রচার এড়িয়ে চলেন সযত্নে। স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই চিনি তাঁকে। আমি তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহকারী সাধারণ সম্পাদক। শেখ কামাল ভাইয়ের নৈকট্যে সময় কাটে আমাদের। নিছকই কোন কারণ ছাড়াও যাওয়া হতো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। তখন তিনি নিতান্তই আটপৌরে, ঘরোয়া। অপরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে নৈকট্য লাভের সুযোগ অনেক পরে। তখন তাঁর প্রবাস জীবন। ভাগ্যান্বেষণে প্রবাসী আমিও। দেশে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে ঘরোয়া, আটপৌরে তরুণীকে দেখেছি, প্রবাসে তাঁকেই পাই অন্য রূপে।
জাতির জনকের কন্যা তিনি। কিন্তু জীবনটা তাঁর জন্য সহজ হয়নি। জীবনের অনেকটা পথ রীতিমতো লড়াই করেই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। বলতে গেলে জীবনের শুরুতেই জীবনযুদ্ধের সৈনিক তিনি। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সে হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাইদের। হারিয়েছেন স্বদেশের আশ্রয়। আশ্রয়হীন পরিবেশে দেশে দেশে ঘুরেছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল না কোথাও। ছিল না নিশ্চিত জীবন-যাপনের নিশ্চয়তাও। লড়াই করেছেন। ভেঙ্গে পড়েননি। উপার্জনের জন্য নিজেকে নিযুক্ত করতে হয়েছে নানা কাজে। বড় বোন শেখ হাসিনা রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের নেতৃত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। শেখ রেহানা নেপথ্যে বড় বোনকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখন তাঁর দুই সন্তান জয় ও পুতুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ রেহানা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যেমন বিত্ত-বৈভব, সহায়-সম্পত্তির কথা কোনদিন চিন্তাও করতেন না। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দায়-দায়িত্ব এবং বিপর্যয়কে হাসিমুখে গ্রহণ করতেন, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও বাবা-মায়ের মতোই পার্থিব লোভের উর্ধে থেকে সাদামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। শত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা পিতা-মাতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বিরল দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন এই দুই বোন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে পাওয়া ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের বাড়িটিতে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে ধানমন্ডি থানা স্থাপন করা হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে এই বাড়িটি বৈধ মালিকানায় ফেরত পাওয়া শেখ রেহানার জন্য অতি সহজ ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো হাইকোর্টের রিট মামলা প্রত্যাহার করেন। সরকার থেকে পাওয়া বাড়িটি সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেন ২০১২ সালের ১০ মার্চে। তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের এই নির্মোহ ও নিস্পৃহ থাকার বৈশিষ্ট্য তাঁকে মহীয়ান করেছে।
রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য তিনি। রাজনীতি থেকে নিজেকে সবসময় সরিয়ে রেখেছেন। তারপরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানা অংশ নিতে যাচ্ছেন, এমন গুজব মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। যদিও এসব কথা এখন পর্যন্ত গুঞ্জন হিসেবেই রয়ে গেছে। বাস্তবে এর কোন প্রমাণ মেলেনি। তাই বলে তাঁকে রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন কিংবা রাজনীতি-বিমুখ ভাবার কোন কারণ নেই। যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন তিনি। আড়াল থেকেই যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়া যায়, তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন। বিশ্বসংসারে এমন আড়ালচারী কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা নিভৃতে কাজ করেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। ব্যক্তিগত মোহের উর্ধে উঠে দেশচিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন শেখ রেহানা। নিজেকে নিয়ে ভাবিত হতে না পারার বিরল শক্তি তিনি অর্জন করেছেন। পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার সব সুযোগ ও সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখন অবধি নিজেকে রেখেছেন মোহমুক্ত। যাঁরা পারিবারিকভাবে নিতান্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত, রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠার পরও এমন নিভৃত জীবন কাটানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব। ক্ষমতা কখনও শেখ রেহানার মোহভঙ্গ করতে পারেনি। কারণ তিনি সেই বিরল স্বভাবের আড়ালচারী মানুষদের একজন, যিনি নেপথ্যে থেকেও সুস্থ রাজনৈতিক ধারার আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিবাচক শক্তির উৎস।
জন্মদিনে আজ তাঁকে জানাই শুভেচ্ছা। তিনি দীর্ঘায়ু হোন। বাংলার মানুষের পাশে সবসময় থাকুন। অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাহস যুগিয়ে যান দেশে ও বিদেশে। জয়তু শেখ রেহানা।
লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী ও মানবাধিকারকর্মী
nazrul@gmx.at
   

No comments:

Post a Comment