Wednesday, September 10, 2014

এই বইটির প্রকাশ কি একটি সমন্বিত চক্রান্তের অংশ?- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলায় একটা কথা আছে, দশ চক্রে ভগবান ভূত। আমাদের অব. এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বেলায় কথাটা সঠিক মনে হয়। ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ শীর্ষক যে বইটি তার নামে বের করা হয়েছে, এটিও দশ চক্রের কাজ বলে আমার অন্য এক লেখায় উল্লেখ করেছি। আমার এই অনুমানের কারণ, এ কে খন্দকার ব্যক্তিগতভাবে একজন ভাল মানুষ। তাঁর মাথায় এই শেষ বয়সে এই ভূত চাপল কেন? এবং নিজে ভূত হতে গেলেন কেন?
একটু খোঁজখবর নিতেই জানলাম, তিনি সত্যিই দশ চক্রের কবলে পড়েছেন। এই চক্রটি লন্ডন থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই চক্রে বিএনপি, জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধীরা তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের সাবেক সমর্থক একটি গোষ্ঠীও রয়েছে। আমাকে প্রথম এ সম্পর্কে সতর্ক করেন লন্ডনে বসবাসকারী এক পাকিস্তানী সাংবাদিক বন্ধু। তিনি আমাকে বলেন, প্রচুর অর্থ-তহবিল নিয়ে মুজিব-বিরোধী একটি প্রোপাগান্ডা শুরু হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশ এবং পাকিস্তানও এই অর্থের যোগানদার।
আমি তাঁর কথা প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কারণ, বঙ্গবন্ধু এখন জীবিত নেই। ক্ষমতায় আসীন শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ। চক্রান্ত ও প্রচার অভিযান চালাতে হলে তো এঁদেরই টার্গেট হওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে টানাটানি করে লাভ হবে কি? পাকিস্তানের সাংবাদিক বন্ধু বললেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুপক্ষ এতদিনে বুঝে ফেলেছে যে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শক্তির ভিত্তি শেখ মুজিব। তাঁকে হত্যা করেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি। এখন তাঁর চরিত্র হত্যা দ্বারা ইতিহাস এবং বাংলার মানুষের মন থেকে তাঁকে মুছে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। তা যদি করা যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের শক্তির ভিত্তি ধ্বংস হবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেও বিতর্কিত করা যাবে।
এর পরেও আমি কথাটা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করছি না দেখে তিনি বললেন, শীঘ্রই দেখতে পাবে এই লন্ডন থেকেই মুজিব-বিরোধ প্রোপাগান্ডার অভিযান শুরু হয়েছে। শেখ মুুজিবুর রহমানকে হেয় করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের কিছু জামায়াতিমনা বাঙালী ও পাকিস্তানী স্কলারকে ভাড়া করা হয়েছে। তাঁরা তারেক রহমানকে সহায়তা যোগাবেন। তারেক রহমানের বিদ্যাবুদ্ধি না থাকলেও এদের সাহায্যে তিনি নতুন ইতিহাসবিদ সাজবেন। নতুন নতুন ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার করে শেখ মুজিবকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হবে।
আমি পাকিস্তানের সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছি, তাঁদের এই চেষ্টা সফল হবে না। বাংলাদেশে যতই দিন যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ততই নতুনভাবে জীবিত হয়ে উঠছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তিনি এখন বিশ্বময় স্বীকৃত। সাংবাদিক বন্ধু বললেন, এ কথা মুজিব-বিরোধী প্রচারক গোষ্ঠীও জানে। তাই তাদের প্রচারণা ধোপে টিকবে না, এ কথা বুঝতে পেরে তারা শেখ মুজিবের এককালের অনুসারী এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্য থেকেও কিছু লোককে নানাভাবে প্রলোভিত করে এই প্রচারণায় যুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন। যাঁরা শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন, শুধু তাঁরা কোন কথা বললে সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে, এই ধারণা থেকেই প্রচারণাটি শুরু করা হচ্ছে।
বেশ কিছুকাল আগে এক পাকিস্তানী সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে এই টিপ্্সটি পাওয়ার পরেও আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোন অসত্য প্রচারণা হঠাৎ গজিয়ে উঠতে পারে; বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন ব্যক্তি বা তাঁর অনুগামী ছিলেন এমন কেউ এই প্রচারণায় যোগ দিতে পারেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি প্রথম সচকিত হই, আমার এক অনুজপ্রতিম বন্ধু, বাংলা একাডেমি কর্তৃক গবেষক হিসেবে স্বীকৃত ফারুক আহমদের (লন্ডনে বসবাসকারী) হাতে একটি বই দেখে। ইংরেজী উপন্যাস, নাম ব্ল্যাক কোট। লেখকের নাম আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। একটি পশ্চিমা প্রকাশনা সংস্থা বইটি বের করেছে।
ফারুক আমাকে বললেন, এই বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত নোংরাভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। এটির প্রতিবাদ করা দরকার। আমি তাঁকে বলেছি, নোংরা জিনিস ঘাঁটতে নেই। কোথাকার কোন্ যদু মধু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লিখছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের উচিত এগুলো উপেক্ষা করা। আকাশের দিকে থুথু ছিটালে তা নিজের গায়েই পড়ে। আকাশকে স্পর্শ করে না। এর কিছুদিন পরেই জানতে পারি, এই বইয়ের প্রকাশনার অর্থায়নের পেছনে জামায়াত এবং তাদের বিদেশী পেট্রনরা রয়েছেন।
তারপর দু’দিন না যেতেই লন্ডনের সভায় ইতিহাসবিদ সেজে জিয়াপুত্র তারেক রহমানের আবির্ভাব। টার্গেট বঙ্গবন্ধু। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার এই অকাল কুষ্মা- পুত্রটি যে মিথ্যাচারের রেকর্ড ভঙ্গ করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বৈধ প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন তাঁর পিতা জিয়াউর রহমান, ২১ আগস্টের (২০০৪) শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলার জন্য শেখ হাসিনাই দায়ী ইত্যাদি লোক হাসানো অসংখ্য ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার করে তিনি কিছুদিনের জন্য বাজার গরম করে তোলেন।
জামায়াত ও তারেকের এই প্রচার অভিযানের পাশাপাশি যখন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন রিপি ‘পিতা ও নেতা’ নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করেন, তখন আমি আরও সচকিত হই। পাকিস্তানী সাংবাদিক বন্ধুর সতর্ক বাণীটি আমার স্মরণ হয়। কথায় বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। এই বিভীষণ যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবিরেও তৈরি করা হয়েছে তা আমি বুঝতে পারি।
তাজউদ্দীন ভাই ও জোহরা ভাবীর প্রতি শ্রদ্ধাবশত আমি কখনও তাঁর এই কন্যাটিকে নিয়ে কিছু লিখতে চাইনি। এমন কি তাঁর বইটি পড়ার পরেও চাইনি। কারণ, এই ধরনের ট্র্যাশ-বই দেশের শিক্ষিত মানুষের কাছে কোন গুরুত্ব পাবে না এই ধারণা আমি করেছি এবং আমার ধারণা সত্য হয়েছে।
রিপি নিজে বিভ্রান্ত এবং বিতর্কিত। নিজের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে তিনি স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের দ্বারা স্ট্যালিনকন্যা সেভেটলানার মতো যে ব্যবহৃত হয়েছেন তা সম্ভবত বুঝতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা প্রয়াত স্ট্যালিনের নামে অনেক সত্য-মিথ্যা প্রচার চালিয়েও যখন স্ট্যালিনের ভাবমূর্তিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারেনি তখন তাঁর কন্যা সেভেটলানকে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মার্কিন মুল্লুকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেভেটলানা তাঁর পিতা স্ট্যালিন যে কত বড় মনস্টার ছিলেন তা প্রচার করতে থাকেন। তাজউদ্দীনকন্যা রিপি জাতির পিতার ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে তাঁর নিজের পিতার ভাবমূর্তিতেও কালিমা লেপন করেছেন তা হয়ত বুঝতে পারেননি। কারণ, তিনি এ কে খন্দকারের মতো দশ চক্রে ভূত হয়েছেন। এই দশচক্রীদের একজনের কাছে তিনি আবার তাঁর বইতে বইটি লেখার ব্যাপারে সাহায্য লাভের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশও করেছেন। আমি সেই নামটি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অন্ধ ক্রোধের কারণ সম্পর্কে এখানে আর লেখালেখি করতে চাই না। তা কালি-কলমের অপচয়।
আজ কোথায় সেভেটলানা, আর কোথায় তাঁর বই? সিআইএ’র এত পেট্রোনাইজেশন সত্ত্বেও স্ট্যালিনকন্যা সেভেটলানা আজ সম্পূর্ণ বিস্মৃত এবং তাঁর বইটি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। বাংলাদেশে রিপির বইটি তো বাজারে বেরুতে না বেরুতেই বিস্মৃতপ্রায়। বঙ্গবন্ধু-বিরোধী প্রচারণায় দশ চক্র যখন দেখলেন, তাদের নিক্ষিপ্ত এই তীরটিও কোন কাজে লাগেনি তখন মঞ্চে প্রায় নিখোঁজ এক ব্যক্তিকে হাজির করা হয়। তার নাম সিরাজুল আলম খান। ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিকল্পনায় সাহায্যদানের জন্য গঠিত নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন। কিন্তু লেখাপড়া না করে প-িত সাজার ভ-ামি তার রাজনৈতিক জীবন ব্যর্থ করে দেয়।
অতি উচ্চাকাক্সক্ষা তাকে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের ষড়যন্ত্রেও সহযোগী করেছে বলে অনেকের ধারণা। দাড়ি-গোঁফ রেখে কিছুদিন তিনি কার্ল মার্কস সাজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাজারে তার নাম হয় কাপালিক। তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সমর্থক। কিন্তু এক সময় তার প্রায় স্থায়ী ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায় নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন। কিছু চটি বই লিখে তিনি তাত্ত্বিক সাজার চেষ্টা করেছিলেন, তাও ব্যর্থ হয়।
বঙ্গবন্ধু-বিরোধী তারেকের প্রচারণার পাশাপাশি দেখা গেল হঠাৎ সিরাজুল আলমেরও আবির্ভাব। তিনি তারেকের মতোই হঠাৎ ঐতিহাসিক সেজে ছোট ইস্তাহার বিলি করে সকলকে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি তারাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণটি দিচ্ছিলেন তখন কোন কোন কথা তিনি যাতে ভুলে না যান, সেজন্য তাঁর পাঞ্জাবির কোণা ধরে চাপ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এভাবে শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকেও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা হয়।
সিরাজুল আলম খান এ রকম দাবি করে বিকৃত মানসিকতা ও বুদ্ধিও সম্ভবত আমেরিকা থেকে পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনসের ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ ভাষণ সম্পর্কেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। কি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের শেষে লিঙ্কনস একটি ট্রেনে চেপে গেটিসবার্গে আসছিলেন । তখন তিনি একটি পুরনো পোস্টকার্ডের মধ্যে এই ভাষণের খসড়াটি লেখেন। তারপর গেটিসবার্গে উপস্থিত হয়ে ভাষণটি দেন।
প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনস আততায়ীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুবরণের পর তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাবি করে বসেন, গেটিসবার্গের ভাষণের মুসাবিদাটি ট্রেনে বসে তিনিই লিখে দিয়েছিলেন। তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। পরে প্রমাণিত হয়, ওই বন্ধু লিঙ্কনসের ভাষণের খসড়া লেখা দূরের কথা, ওইদিন লিঙ্কনসের সঙ্গে ট্রেনেই ছিলেন না।
সিরাজুল আলম খানদের বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবির কোণা ধরে টানাটানির গল্প শুনে মনে প্রশ্ন জাগে, এগুলো কি মানসিক বিকৃতির ফল, না কোন বৃহত্তর চক্রান্তের অংশ? আমার ধারণা, এক বৃহত্তর চক্রান্তের অংশ। চক্রান্তগুলো কি পরস্পর বিচ্ছিন্ন, না সমন্বিত? এই প্রশ্নের জবাব ঘটনাপ্রবাহ থেকেই বোঝা যাবে।
বঙ্গবন্ধু এখন বিশ্বময় ‘ফাউন্ডার ফাদার অব বাংলাদেশ’ নামে স্বীকৃত। বিবিসি রেডিওর জনমত সমীক্ষায় তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে নন্দিত। তাঁর ওপর একটি ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘The speeches that inspired history’ বইতে বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর একটি ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধু আজ স্বগৌরবে ও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ঠিক এই সময়ে তাঁকে হেয় ও বিতর্কিত করা না গেলে তাঁকে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আর নস্যাত করা যাবে না। শত্রুপক্ষের এই ভয়ভীতি থেকেই অকস্মাৎ বঙ্গবন্ধু-বিরোধী প্রচারণার শুরু বলে অবশ্যই ধারণা করা চলে।
প্রায় একই সময়ে এই প্রচারণাটি শুরু করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ব্ল্যাক কোট নাম দিয়ে বই প্রকাশ (নেপথ্যে জামায়াত), তারেকের বঙ্গবন্ধু-বিরোধী প্রচার অভিযান ও ইতিহাস বিকৃতি, তাজউদ্দীনকন্যার বই প্রকাশ এবং সর্বশেষে অব. এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের এই বই। মনে হবে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে অনেক মাথার সমন্বিত প্রয়াস তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। খন্দকারের বইটির প্রকাশক-‘প্রথমারই’ বা আসল চেহারা ও উদ্দেশ্য কি?

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি বলেছেন, “ইতিহাস লেখা সহজ নয়। অতীতের ইতিহাস দশটা বই ঘেঁটে লেখা যায়। কিন্তু সমসাময়িক ঘটনার সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা দুরূহ।” নিজের একটি অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি দিয়েছেন। একটি জেলের সামনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। দুই প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে তিনি একই বিবরণ শোনেননি। কিছু দূরে গিয়ে তিনি ঘটনাটির বিবরণ অন্য লোকদের মুখে শুনতে পান, তা আগে শোনা বিবরণগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়েও এখন বিপরীত (বিকৃত) বিবরণ লেখায় একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এবং তাতে উৎসাহ যোগানোর জন্য পেট্রো ডলারের ছড়াছড়ি চলছে লন্ডন থেকে ঢাকা পর্যন্ত। কিন্তু এই ফাঁকে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) এ কে খন্দকারের মতো লোক নিজেকে জড়াতে পারেন তা ছিল আমার কাছে অবিশ্বাস্য। তাঁর মধ্যেও ড. জেকিলের সঙ্গে একজন মি. হাইড লুকিয়ে আছে তা কে জানত?
বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য দেশের বাম ও ডান রাজনীতির, এমনকি বঙ্গবন্ধুর এককালের একশ্রেণীর ঘনিষ্ঠ মানুষের এই নিরন্তর প্রচেষ্টা কেন তা আমি অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। ভাষা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর কোন অবদান ছিল না এটা প্রমাণ করার জন্য বদরুদ্দীন উমর আদা পানি খেয়ে লেগেছিলেন। সফল হননি। এখন শুরু হয়েছে, স্বাধীনতার যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ও অবদান নিয়ে চারদিক থেকে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা এবং ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াস।
ইতিহাস বিকৃতির এই অবিরাম চেষ্টা যে অসৎ এবং উদ্দেশ্যমূলক তা বোঝা যায়, এই মিথ্যা তত্ত্ব ও তথ্যগুলোকে ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ দ্বারা বার বার মিথ্যা বলে প্রমাণ করার পরও বিভিন্ন মহল থেকে একই মিথ্যার পুনরুক্তি করা চলছে। গোয়েবলসের মতো এদের সম্ভবত ধারণা, ‘‘একটা মিথ্যাকে বার বার বলা হলে তা সত্য হয়ে যায়।” এ কে খন্দকারকে এ তত্ত্বটি কারা বুঝিয়েছেন এবং এই বইটি তাঁর নামে লেখানোর জন্য নেপথ্যে বসে কলকাঠি নেড়েছেন, তা এখন আমার জানা হয়ে গেছে। নামোল্লেখ করে তাঁদের নিয়ে আলোচনা করতে চাই না এ জন্যে যে, তাঁরা আলোচনায় আসার মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নহেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন শীর্ষ সংগঠক হিসেবেই একে খন্দকার ইতিহাসে বেঁচে থাকতে পারতেন। কিন্তু কিছু হনুমান-বন্ধুর পরামর্শে পড়ে তিনি নিজেই নিজের মুখে কালি মাখলেন। নিজের ব্যক্তিত্বে দৃঢ় থাকতে পারলে এ কাজটি তিনি করতে পারতেন না। মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও নেতৃত্বের প্রতি তাঁর যে কোন কালেই আস্থা ছিল না তাঁর এই বইটি পড়লে তা বোঝা যায়। পাকিস্তানের হানাদারদের হাতে নিহত হওয়ার ভয়ে জিয়াউর রহমানের মতো তিনিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আগে বোঝা যায়নি। এই বইটি পড়ে এখন এয়ার ভাইস মার্শালের (অব) চরিত্রটি বোঝা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং পরেও তিনি ‘দোদিল বান্দা’ ছিলেন। প্রয়াত রুহুল কুদ্দুস সাহেব বলেছেন, “১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রমনা রেসকোর্সের মাঠে যৌথ কমান্ডের নেতা জেনারেল অরোরার কাছে হানাদারদের নেতা জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের সময়ের কথা। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন এ কে খন্দকার। কিন্তু তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টার প্রস্তুত। তাজউদ্দীন সাহেব রুহুল কুদ্দুসকে পাঠালেন খন্দকারকে খুঁজতে।
রুহুল কুদ্দুস তাঁর বাসায় গিয়ে দেখেন, তিনি তখনও সেখানে। ঢাকায় যেতে গড়িমসি করছেন। রুহুল কুদ্দুস তাঁকে তাড়া দিতেই খন্দকার বললেন, তিনি তো এখনও পোশাকটোশাকও পরেননি। রুহুল কুদ্দুস বললেন, দরকার নেই পোশাক পরার। দেরি করলে রমনার মাঠে ঠিক সময় পৌঁছতে পারবেন না। রুহুল কুদ্দুসই তাঁকে টেনেহিঁচড়ে হেলিকপ্টারে তুলে দেন। ঢাকা যাত্রার জন্য তখন হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরছে।
আমাদের এই ড. জেকিলের মধ্যে যে মি. হাইডও লুকিয়ে আছেন তার আরও বড় প্রমাণ আছে। শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে রেসকোর্স ময়দানে ‘শিখা চিরন্তন’ প্রজ্বলন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি ঐতিহাসিকতা লাভ করে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং সম্ভবত ইয়াসির আরাফাতেরও উপস্থিতি দ্বারা। কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররাও এই অনুষ্ঠানে থাকবেন। কিন্তু দেখা গেল অনুষ্ঠানে একে খন্দকার নেই।
তিনি তখন আওয়ামী লীগের একজন এমপি। অন্য সেক্টর কমান্ডাররা অনুষ্ঠানে এসেছেন, খন্দকার আসেননি দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি খন্দকারের খোঁজে লোক পাঠালেন। খন্দকার পতœীকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তিনি গাড়িতে পাবনা যাত্রা করছেন। এখন হয়ত অর্ধপথে আছেন। তাঁকে আর অনুষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা যায়নি। এই অনুষ্ঠান এড়ানোর জন্যই যে দিনক্ষণ ঠিক করে তিনি পাবনা চলে যান তা পরে ধরা পড়ে। এই হলো ‘ছহি বড় দ্বিতীয় খন্দকারনামা।’
ইংরেজদের টাকা খেয়ে যেসব বাঙালী ইতিহাসবিদ সেকালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করেছিল, পরবর্তীকালে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাঁদের আখ্যা দিয়েছিলেন ‘পুওর লায়ার’ বা হতভাগ্য মিথ্যাবাদী। বর্তমানে আমাদের অবসরভোগী এয়ার ভাইস মার্শালও যে এই পুওর লায়ারদের দলে পড়েন তার প্রমাণ জিয়াউর রহমানের আমলে সঙ্কলিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিল দস্তাবেজ’ নামে যে কয়েকখ- বই রয়েছে, সেগুলোকেও তিনি উপেক্ষা করেছেন।
এই দলিল-দস্তাবেজের দ্বিতীয় খ-ের ৬০৯ পৃষ্ঠায় রয়েছে, রমনা রেস কোর্সের ৪ জানুয়ারি ১৯৭১-এর জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ এবং ওই বইয়ের (২য় খ-) ৭০২ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলে শেষ করেন। ইতিহাসের দলিল যে কথা বলে না, লাখ লাখ মানুষ সেদিনের জনসভায় যে কথা শোনেনি, সে কথা ওই সভায় হাজির না থেকেও খন্দকার সাহেব শুনেছেন। তিনি নাকি সেক্টর্স কমান্ডার্স ফোরামের বর্তমান সদস্য সচিব হারুন হাবিবের কাছে টেলিফোনে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে যে জয় পাকিস্তান বলেছেন, তা নাকি রেডিওতে শুনেছেন। কোন্ রেডিওতে তা শুনেছেন? ৭ মার্চ তারিখে ভাষণটি ঢাকা রেডিওতে প্রচারিত হয়নি। হয়েছে পরদিন সকালে। এই সকালের রেডিওতে প্রচারিত ভাষণটিও লাখ লাখ মানুষ শুনেছে। আমিও শুনেছি। ভাষণটি জয় বাংলা বলে শেষ হয়েছে। তাহলে খন্দকার সাহেব এত বড় ডাহা মিথ্যা কথাটি এই বয়সে বলতে গেলেন কাদের স্বার্থে, কী উদ্দেশ্যে?
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ইন্টারনেটে এখনও শোনা যায়। আমি এই নিবন্ধ লেখার সময় আবার শুনেছি। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে একবারও পূর্ব পাকিস্তান কথাটি ব্যবহার করেননি। বলেছেন পূর্ব বাংলা। যে নেতা তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান কথাটি পর্যন্ত ব্যবহার করেননি; করেছেন পূর্ব বাংলা; তিনি বক্তৃতা শেষে জয় পাকিস্তান বলবেন, এটা কোন গাঁজাখোরও বিশ্বাস করবে কি?
আমার কাছে আরও বিস্ময় লেগেছে আমাদের গোলআলু পণ্ডিত ড. আনিসুজ্জামানের এই বইটি সম্পর্কে আত্মপ্রতারক ভূমিকা দেখে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র নামক গ্রন্থগুলোর সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য সচিব ছিলেন প্রয়াত হাসান হাফিজুর রহমান। এই সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন ড. আনিসুজ্জামানও। তাঁর সঙ্গে ড. সালাউদ্দীন, ড. মফিজুল্লা কবির, ড. এনামুল হক প্রমুখও ছিলেন। এই গ্রন্থটি সম্পাদনার সময় আমাদের গোলআলু পণ্ডিত কি দেখতে পাননি যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে যে দলিলপত্র তিনি নিজে সম্পাদনা করেছেন, তাতে কী বলা হয়েছে? ইতিহাসের দলিলপত্র সত্য নয়, কে সকালে ঘুমঘোরে রেডিওতে কী শুনে অথবা না শুনে অথবা বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীর মতো কেউ ৪ জানুয়ারির ভাষণে শোনা বঙ্গবন্ধুর কথাকে ৭ মার্চের কথা ভেবে বিভ্রান্তিতে ভুগে যে মন্তব্য করেছেন সেটাই সত্য হয়ে গেল?
(অব) এয়ার ভাইস মার্শালের বইটির প্রকাশক প্রথমা। এটি প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত প্রকাশনা সংস্থা। প্রথম আলো প্রকাশনা গ্রুপের অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা মতিউর রহমান শুধু বামপন্থী নন, একসময় বাকশালেরও সদস্য ছিলেন। তোফায়েল আহমেদের পায়ে ধরে তিনি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের নাম বাদ দিয়ে বাকশালের একটি ফ্রন্টে নিজের নাম ঢুকিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে কী ছিল, তা তিনি জানেন না তা নয়। তারপরও তাঁর প্রকাশনা সংস্থা থেকে এই বইটি বের হয় কী করে? বইটির তথ্য নিয়ে যখন দেশব্যাপী প্রতিবাদ হচ্ছে, তখন বইটিকে সংশোধন না করে দ্বিতীয় সংস্করণ বের করেন কিভাবে? এটা কি সৎ ব্যবসা?
এখানে পাঠকদের কাছে আমার মনের একটা সন্দেহের কথা বলি। যে কোন কুরুচিপূর্ণ বই-ই বাজারে একটু বেশি চলে। কলকাতায় একসময় ‘হরিদাসীর গুপ্ত কথা’ নামে বই শরৎ চন্দ্রের বইয়ের কাটতি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে সব বইয়ের তেমন কাটতি নেই, সেসব বইও চালানোর জন্য অসাধু ও অসৎ পুস্তক ব্যবসায়ীরা একটা কাজ করেন। বইটির হাজার হাজার কপি ছেপে বাঁধাই না করে গুদামে রেখে দেন। শুধু টাইটেল পেজগুলো বার বার ছাপেন। এক শ’-দু’শ’ বই প্রথম সংস্করণ লেখা টাইটেল পেজসহ বাজারে ছেড়ে দু’দিন পরই দ্বিতীয় সংস্করণ লেখা টাইটেল পেজ ছেপে গুদাম থেকে আরও এক শ’-দু’শ’ বই বাঁধাই করে বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়। বলা হয় বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত। আমাদের মতিউর রহমানও সম্ভবত বটতলার পুস্তক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুস্তক ব্যবসায়ের এই অসৎ প্রকরণটি শিখেছেন। এককালের একজন ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি অধঃপতিত হলে কোন্ পাতালে নামতে পারে, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সম্ভবত তার সবচাইতে বড় প্রমাণ।
[লন্ডন বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪।]
   


No comments:

Post a Comment