Friday, January 3, 2014

‘জয় বাংলা’ বলব ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলব না এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু : মুহম্মদ শফিকুর রহমান

জানতাম বাঙালী কৃতজ্ঞ জাতি। সে তার উপকারীকে মনে রাখে। জন্মদাতা পিতাকে তো ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। এখন দিন পাল্টে গেছে। বরং উপকারীকে বাঘে খায়, ক্ষতিকারক পুরস্কৃত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলতেন যত অপকর্ম শিক্ষিত সাদা কাপড়অলারাই করে। আমাদের শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, আমরা এখন সাদা কাপড় পরি। তার মানে অপকর্ম করা লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। 

১৬ ডিসেম্বর ২০১৩। মহান বিজয় দিবস। আমাদের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায় মহান মক্তিযুদ্ধের ৪৩তম বিজয়ের দিন। আবেগাপ্লুত হবার দিন। একদিকে ৩০ লাখ শহীদ ও ৬ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের বেদনা, আরেকদিকে হানাদার পাকি-মিলিটারি জান্তাকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের আনন্দ-এমনি আনন্দ-বেদনা-মিশ্রিত মহাকালের পথে যাত্রা শুরুর দিন এই ১৬ ডিসেম্বর। আমরা যারা এ পুরো প্রক্রিয়ার বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত হবার সুযোগ পেয়েছি, গণঅভ্যুত্থানে, মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের কাছে মহাকাল যাত্রার আবেগ-অনুভূতি এক রকম, পরবর্তী প্রজন্ম যারা কেবল বয়সের কারণে জড়িত হতে পারেনি, তাদের আবেগানুভূতি অন্য রকম। রাজাকাররা তো রাজাকারই।

দিনভর প্রেসক্লাব, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফিরলাম, বিষণœ মন নিয়ে। আগে প্রতিটি বিজয় দিবসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতাম। জিয়া-এরশাদের মিলিটারি শাসনের মধ্যেও। একবার তো এরশাদের মিলিটারির পিটুনি থেকে বেঁচে গেছি কেবল সাংবাদিক পরিচয়ে। তবে সেবার স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দের ওপর বাঙালী মিলিটারির নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছি। সঙ্গে ছিল সংবাদের রিপোর্টার (লন্ডন প্রবাসী) আবু মূসা হাসান।
১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তার আগে বছরের গোড়ার দিকে স্বাধীনতা দিবসের মাত্র দু’দিন আগে ২৪ ডিসেম্বর এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ক্যুর মাধ্যমে। রক্তপাতহীন ক্যু। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সাত্তার সাহেব সহজেই এরশাদ সাহেবকে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন (পরবর্তীতে দুই মিলিটারি কর্নেল জাফর ইমাম ও জেনারেল মাজেদুল হকের কাছে দলের চেয়ারপার্সনের ক্ষমতাটিও খালেদা জিয়াকে দিয়েছিলেনÑ সেটিও ছিল আরেক রক্তপাতহীন ক্যু)। সেবার (১৯৮২) জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্মৃতিসৌধ এলাকা ছেড়ে যাবার পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, মুহম্মদ নাসিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আরও অনেকে (সবার নাম এ মুূহূর্তে মনে পড়ছে না)। তারা একযোগে সেøাগান দিতে শুরু করেন ‘সামরিক শাসন-মানি না, মানব না’ ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন সরে যেতে থাকলেন। গেলেন না কেবল নেতৃবৃন্দ। তাঁরা তখনও সেøাগান দিচ্ছিলেন। এ সময় আমাদের পরিচিত একজন এএসপি বা এসবি (নাম মনে নেই) কাছে এসে আমাদের অদূরে তার পাশে দাঁড়াতে বললেন। প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি। বুঝলাম পরে-যে দৃশ্য ছিল বেদনাদায়ক। দেখলাম একদল তরুণ, হাতে রাবারের রড, হকিস্টিক, ইলেকট্রিক তার পাকানো রড ইত্যাদি নিয়ে দৌড়ে স্মৃতিসৌধের গেটের দিকে আসছে এবং এসেই নেতৃবৃন্দকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে? অমানুষিক নির্যাতন। মুহম্মদ নাসিমের সাদা পাঞ্জাবির নিচে পিঠে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে, আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দেখলাম শুধু। এসপি বললেন-কোন মন্তব্য করবেন না, ওরা ডিজিডিএফআই-এর লোক। রড হাতে এক তরুণ আমাদের সামনে এসে কর্কশ কণ্ঠে বলল- দডযড় ধৎব ুড়ঁ’? এএসপি সাহেব নিজের পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দু’জনেরও পরিচয় দিলেন সাংবাদিক বলে। বললেন আমরা ডিউটি করছি। দডযধঃ ফঁঃু’ বলে দু’জন সিপাইকে ডেকে বললেন এঁদের বাইরে রেখে এসো। সিপাই দু’জন আর্মি কম্বেট ইউনিফরম পরা। তারা আমাকে ও হাসানকে বললেন, ‘স্যার আপনারা বোধ হয় অফিসার? ওরাও বড় অফিসার তাই না? ওদের ছবি খবরের কাগজে দেখেছি। দেখলেন আমাদের অফিসাররা ওদের কিভাবে মারল, এটা কি ঠিক করেছে? এরপর তারা দু’জন আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমরাও ঢাকাগামী বাস পেয়ে উঠে বসি। তারপরও বহুবার সাভার স্মৃতিসৌধে গেছি। গত কয়েক বছর ধরে আর যাওয়া হয়নি। এবারও না। তবে আগেই বলেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সৃষ্ট বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে যেয়ে হোঁচট খেয়েছি। কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা?

বাড়ি ফিরেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রাইটিং প্যাড টেনে লিখতে শুরু করলাম, এগোলো না। জাতি হিসেবে আমরা কি তবে অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছি? বাঙালী কৃতজ্ঞ জাতি- তা কি তবে ঘুছে গেছে? ভাবলাম কারও সঙ্গে শেয়ার করে মনটা হাল্কা করব। সেলফোন তুলে বন্ধু স্থপতি বদরুল হায়দারকে ডায়াল করলাম। বদরুলও আমার সঙ্গে একমত-আমরা কি তবে অকৃতজ্ঞ জাতি? বদরুলের সঙ্গে কথা শেষ করে ফোন রাখতেই বেজে উঠল। এবার অপরপ্রান্তে এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, মাঝে মধ্যে মালেক ভাইর বাসায় (আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়। আবদুস সালাম ছাত্রজীবনে ক্যাম্পাসে ছাত্রনেতা ছিলেন। টেলিফোন তুলেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন- আমরা কি তবে সত্যি সত্যি অকৃতজ্ঞ?

এবারের ১৬ ডিসেম্বর দেশে তিনটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে গেল। দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো। তিনটি বিশেষ ঘটনার কারণে। নতুন প্রেক্ষিতের কারণে অন্য রকম মাত্রা পেয়েছিল :

এক. বাঙালী জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আপন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনেক ঘটনাবহুল স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইমরান-লাকি-মারুফ রসুলদের গণজাগরণ মঞ্চের বিজয় উদ্যাপন সমাবেশে লাখো মানুষের অংশগ্রহণ এবং তাদের আহ্বানে দেশব্যাপী কোটি বাঙালীর একসঙ্গে দাঁড়িয়ে এককণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন। একই মঞ্চ থেকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-এর ডাকে একইভাবে কোটি কণ্ঠে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ গ্রহণ। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং শপথ বাক্য পাঠের সময় (পাঠ করেন ফোরাম চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ. কে. খন্দকার) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত টেলিভিশন বেতারের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছে, শপথ বাক্য পাঠ করেছে।
দুই. দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হলো ২৭,১৩৭ জনের হাতে লাল-সবুজ কার্ড, নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় পতাকার রূপ নেয়, যা ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাতীয় পতাকা। এটি গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এ স্থান লাভ করেছে।
তিন. তৃতীয় ঘটনাটি হলো মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর। এ সেই মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লা যে শত শত লোককে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, মেহেরুন্নিসা নামে একজন কবিকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে, আলবদর বাহিনী গঠিত হলে তাতে যোগ দিয়ে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তার ফাঁসি কার্যকরও হলো ১৩ ডিসেম্বর রাত ১০টা ০১ মিনিটে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের একদিন আগে ও বিজয় দিবসের তিন দিন আগে। 

এই পুরো ঘটনাবলীতে ভিন্নমাত্রা ভিন্ন আবেগ যোগ হলেও সর্বত্র একটি ঘাটতি থেকে গেল সব ক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ সেøাগানটি উচ্চারিত হলেও কোথাও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারিত হয়নি। অথচ ‘জয় জনতা’ ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’ এসব সেøাগানও শোনা যায়। এর নাম কি তবে নিরপেক্ষতা? অথচ ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ এই দুই সেøাগান দু’টি একটি আরেকটি ছাড়া আধুরা, অসম্পূর্ণ। সেøাগান দুটির একটি ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস এবারের বিজয় দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সঙ্গে জড়িত।
বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নামও এই নাম ছিল না। ছিল না স্বাধীনতা স্তম্ভ, ছিল না গগণচুম্বী গ্লাস টাওয়ার এবং তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এই নাম এই অবয়বে গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বাঙালী জাতির ইতিহাসের কয়েকটি বিশাল ঘটনা এবং যে ঘটনাগুলো গড়ে ওঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে তাঁর নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে।
পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল রেসকোর্স। এখানে ঘোড় দৌড়ের জুয়া খেলা হতো। অর্থাৎ ঘোড়ার দৌড়ের ওপর বাজি ধরা হতো। যার ঘোড়া প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হতো সে বা সেই সব লোক কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যে বিশাল অঙ্কের টাকার মালিক হয়ে যেত। যাদের বাজির ঘোড়া হেরে যেত তারা একইভাবে কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যে ফকির হয়ে যেত। এমন গল্পও শোনা গেছে, এই রেস খেলায় হারতে হারতে কেউ বউকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে (যদিও এ কথার কোন তথ্যভিত্তিক প্রমাণ নেই)।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশ থেকে মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড় দৌড় ইত্যাদি অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে দেন। মানবতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত-মুসলিম লীগ-নেজামে ইসলামীও নিষিদ্ধ করেছিলেন। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স-এর নাম পাল্টে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করেন। জাতির দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মিলিটারি জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে একদিকে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ..... রাহিম’ সংযোজন করেন, পাশাপাশি পুনরায় মদ-জুয়া-হাউজি চালু করলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম পাল্টাবার ধৃষ্টতা দেখাননি। এখানে রেসকোর্স তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে সংঘটিত কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করছি।
তবে শিশুপার্ক বানিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা বঙ্গবন্ধুর নাম আড়াল করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু উপাধি

এই সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখানে সমবেত বাঙালী তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব লাহোরে সর্বদলীয় বৈঠকে বাঙালী জাতির পক্ষে ‘বাঙালীর মুক্তি সনদ’ ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। এক কথায় বলতে গেলে এই ৬ দফা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং তা থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীর সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও স্বপ্নের আপন জাতি রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬ দফা দেয়ার পর তৎকালীন পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক আইয়ুব প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে এবং পরে একে একে সকল প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে ফাঁসিতে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। গোটা বাংলাদেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ডাকসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং ৬ দফার আলোকে ছাত্রদের ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন তখন ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক চলতে থাকে। সারা বাংলায় সৃষ্টি হয় এক সাহসী গণঅভ্যুত্থান। বাঙালীর প্রতিবাদের ভাষা বুঝতে পারে আইয়ুবের মিলিটারি প্রশাসন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সংবর্ধনা এবং সংবর্ধনাও হয় এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্সে)। সংবর্ধনায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ১০ লাখ মানুষের ২০ লাখ উত্থিত হাত তা সমর্থন করে। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হন ‘বঙ্গবন্ধু’। সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ এক সেøাগানে পরিণত হয়।

৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের কথা নতুন করে বিস্তারিত বলার আছে বলে মনে করি না। কেবল এটুকুই বলব, ৭ মার্চের ভাষণটিও বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। এই ভাষণ বিশ্বের ২/৩টি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের একটি। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অডিও-ভিডিও-সিডি বা মাইকে গত ৪৩ বছরে যতবার বাজানো হয়েছে বিশ্বে এর কোন দ্বিতীয় নজির নেই। একাত্তরের মার্চ মাসব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ডাকে ইতিহাসের এক তাক লাগানো নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলনের মাঝে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা, কিভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করতে হবে তারও রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা ছিল।

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে রাত দেড়টায়। এর পর পরই পাকি মিলিটারি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় তিনি “যার যার আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার এবং সর্বশেষ পাকি হানাদার আর্মিটিও বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন”। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বাঙালী যে যেভাবে পেরেছে যুদ্ধে গেছেন, ভারতে যেয়ে ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে এসে যুদ্ধে শামিল হয়েছেন এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয়ের পেছনে আত্মত্যাগও ছিল সীমাহীন। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ এবং ৬ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। তার মধ্যে পৌনে ৩ লাখকে ধর্ষণ করে করে হত্যা করা হয়েছিল।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করেছিল।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বিশ্ববিবেকের চাপে এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগারে দুইবার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হয়, কবরও খোড়া হয়েছিল, কিন্তু পারেনি (বাঙালী জাতির লজ্জা পাকিস্তান যা করতে সাহস পায়নি বাঙালীর কুলাঙ্গার সন্তান খুনী মোশতাক-জিয়া তা করেছিলেন)।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে প্রথমে লন্ডনে গেলে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান। সেখান থেকে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করলে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি (ভরাহ গিরি ভেংকট গিরি) ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। সেখানে মিসেস গান্ধীর (ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী) সঙ্গে ৪০ মিনিট একান্ত বৈঠক করেন (এই বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু ভারতীয় সৈন্য বাংলার মাটি থেকে নিয়ে যাবার অঙ্গীকার আদায় করেন)। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে সরাসরি এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে যুদ্ধ জয়ের জন্যে জাতিকে অভিনন্দন জানান এবং আল্লাহ পাকের শোকরিয়া আদায় করেন।
সেদিন বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত যেন গোটা বাংলাদেশ ভেঙ্গে পড়েছিল। কত লোক হয়েছিল তার তুলনাও কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সাড়ে ৬ বছর প্রবাসী জীবন শেষে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গেই হতে পারে। সেদিনও সারাদেশ যেন ভেঙ্গে পড়েছিল রাজধানীতে।

ইন্দিরা মঞ্চ

বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁকেও সংবর্ধনা দেয়া হয় এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। এ উপলক্ষে যে সংবর্ধনা মঞ্চটি করা হয়েছিল তার নামও দেয়া হয়েছিল ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। এখানে একটা কথা বলে রাখিÑ ১৯৭১ সালে মিসেস গান্ধী যেভাবে যুদ্ধ জয়ে সহযোগিতা করেছেন, যে যুদ্ধে ভারতের ১৭ হাজার সৈন্যও শহীদ হয়েছিল এবং যেভাবে এক কোটি শরণার্থীকে মাতৃস্নেহে দীর্ঘ ৯ মাস লালন করেছেন তার তুলনাও কেবল তিনিই। যে কারণে ইন্দিরা গান্ধী চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

শিখা চিরন্তন

মিলিটারি জিয়া ছিলেন চরম আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী। তিনি প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর দাফন না করার চক্রান্ত করেন। তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে বঙ্গবন্ধুর নাম জিয়া তা মুছে দেয়ার জন্য শিশুপার্ক নির্মাণ করেন। যেমন তার স্ত্রী আজ গোপালগঞ্জের নাম মুছে দিতে চান। শিশুপার্ক যেহেতু বাচ্চাদের বিনোদনের ব্যাপার সেহেতু স্পর্শকাতর-এই সুযোগটিই জিয়া নিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালী জাতি ১৯৯৬ ও ২০০৮-এ ভোট দিয়ে জিয়ার সেই চক্রান্ত নস্যাত করার ম্যান্ডেট দেয় শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাও জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনেন।
আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ। এখানে রয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস; শিখা চিরন্তন এবং গগণচুম্বী স্বাধীনতা (গ্লাস) টাওয়ার। আর এই শিখা চিরন্তনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে যোগ দেন বিশ্ব বরেণ্য নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত ও সুলেমান ডেমিরেল। তাঁরা শিখা চিরন্তন প্রজ্বলন ও স্বাধীনতা টাওয়ারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে অংশ নেন।

গণআদালত

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য শুরু হয়। ৩৮ হাজার গ্রেফতার হয় এবং তন্মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধের চার্জ আনা হয় এবং তন্মধ্যে ৬ শতাধিকের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদী সাজা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া বিচার বন্ধ করে দেন এবং আটক ও সাজ্জাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেন।
আজ সেই কালো দিন (৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫) যেদিন মিলিটারি জিয়া যুদ্ধাপরাধী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ৬৩ জেলা ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। বিচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তারপর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল, জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী, প্রধান কবি শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসানো হয় এবং তাতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আযমের ফাঁসির (প্রতীকী) রায় দেয়া হয়। এই পুরো তৎপরতার পেছনে ছিলেন সেদিনের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা, যার নেতৃত্বে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে।
এসব ঘটনা উল্লেখ করলাম কেবল তরুণ প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য। ইতিহাস লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কথা হলো বাঙালী জাতির হাজার বছর ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে, বহুবার জিতেও ধরে রাখতে পারেনি। সে সব সংগ্রাম ছিল বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম। একটি মাত্র মানুষ একটি মাত্র বজ্রকণ্ঠ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসে সকল বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম এক মোহনায় প্রবাহিত করিয়ে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং তা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই।

ইতিহাসের সেই মহানায়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালী জাতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। তারই পদভারে আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালীর বিজয় উদযাপিত হবে, আমাদের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান  ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হবে, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারিত হবে না, এ ক্ষেত্রে কেবল এ টুকুই বলব ‘এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু’।

No comments:

Post a Comment