Sunday, March 23, 2014

মা -বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত

মানুষের জীবনে মৃত্যু হঠাৎই আসেন। আমাদের জীবনটা যেন একটানা বলে যাওয়া বিরামহীন বাক্যের মত। অনর্গল কথার মধ্যে একটা একঘেয়েমি আছে। সেই বয়ে যাওয়ার মধ্যে কেবলমাত্র যতি চিহ্নের সঠিক প্রয়োগ যেমন সেই সব কথার সঠিক অর্থ আমাদের কাছে পৌঁছে দেয় তেমনি আমাদের অনন্ত চলার এই জীবনে মৃত্যুই সেই যতি চিহ্ন। সবার অলক্ষ্যে সে এসে দাঁড়ায়, আর প্রতিবার জীবনের অর্থকে আমরা নূতন ভাবে বুঝি।  এই যে থামা, মুহুর্তের জন্য পিছনে ফেরা, সেই বিরাম আমাদের চলা কে দেয় অন্য এক অর্থ, জীবনকে সে তাঁর প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিতে এনে দাঁড় করায় আমাদের সামনে। আমরা চলার পথে হঠাৎ দাঁড়িয়ে দেখি কোন পথ পেরিয়ে এলেম, কোন পথ আছে সামনে। দূর থেকে দুরান্তরে মেলি আমাদের দৃষ্টি। কত ছায়া পড়ে তাতে। মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা, রাগ দুঃখ, হতাশা, আশা, নিরাশা, উদ্বেগ, উত্তেজনা, চাওয়া পাওয়া… কতই না আলো ছায়ার খেলা সেখানে।

বাক্যে যতিচিহ্নের অবস্থানের প্রকারভেদে যেমন বাক্যের অর্থের পরিবর্তন হয়, শব্দের প্রয়োগের তারতম্য ঘটে, তেমনি মৃত্যুর আকস্মিকতা ও আমাদের চলার পথে তাঁর আগমনের ক্ষণ ও অবস্থান আমাদের জীবনের অর্থকেই দেয় পাল্টে। চলার পথের প্রারম্ভেই যদি অকস্মাৎ পড়ে অমোঘ সেই যতি চিহ্ন, তবে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আক্ষেপ থেকে যায় অনেক। অকালে শেষ হয় কত প্রতিভা, ঝরে পড়ে কত আশা আকাঙ্খার মুকুল। পথ চলার আগেই শেষ হল যাত্রা। পড়ে রইল কত পথ। মন তখন বলে, “জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয়নি হারা”।
 আবার চলার পথে শেষের বেলায় সেই অনিবার্য যতিচিহ্নের আগমন পথশ্রমে ক্লান্ত পথিককে হয়তো দেয় এক চির শান্তির প্রলেপ। পরিশ্রান্ত আমরা শেষ বেলার পড়ন্ত মেদুর আলোয় দেখি ফেলে আসা এক অন্য আলোছায়ায় মাখানো মায়াবী জীবন।

যিনি চলে গেলেন তাঁর চলার পথে মৃত্যুর আগমন, পূর্ণচ্ছেদ এর যতিচিহ্ন স্বরূপ। কিন্তু আমরা যারা থেকে যাই, তাঁদের কাছে সেই আগমন বার্তা অর্ধচ্ছেদের মত। আমরা থামি, মুহুর্তের জন্য। কেউ বা থমকে দাঁড়ান। চলার পথে আসে এক নূতন মোড়। পথ যায় ঘুরে। অকস্মাৎ পরম নির্ভরতার সঙ্গী হারিয়ে লক্ষ্য হারায় চলা, সে চলে একা দিশেহারা। তবুও আমাদের চলতে হয়। অনন্ত চলাই জীবনের ধর্ম। গন্তব্য বলে তো কিছু নেই। চলো… চলো আলোর পথ যাত্রী। মুহুর্তের জন্য মৃত্যু যেন সেই প্রচন্ড চলার থেকে আমাদের ছিটকে এনে পথের পাশে স্থিতু হতে সাহায্য করে। আমরা চোখের পলকে চারপাশ দেখি। কোথাও তো কিছু কম দেখি না। প্রবল বেগে চলেছে জীবন।

আমরা যখনি জন্মগ্রহণ করি এই জগৎ-সংসারের সাথে এক প্রীতির সম্পর্কের সূচনা হয় সেই মুহুর্ত থেকে। চাওয়া পাওয়া প্রয়োজন, অপ্রয়োজন এরকম অনেক সরু সুতোয়, এক সুতো’র সাথে আরেক সুতোয় সূক্ষ্ম এক গিঁট বেঁধে বেঁধে বোনা সেই সম্পর্ক-জাল। যতই বয়স বাড়ে সেই সম্পর্কের জালে আমরা জড়িয়ে, সেই জালের উপর ভর করে ভেসে থাকি। এই এক একটি গিঁট এক একটি সম্পর্ক। মাঝে মাঝে মৃত্যু এসে সেই জীবনের সুতোয় ছেদ ঘটায়। পরম নির্ভরের সেই ভাসমান জাল থেকে খুলে যায় এক একটি গিঁট। ঢিলে হয়ে আসে জাল। আমরা অবলম্বন হারিয়ে অসহায় বোধ করি।

নানা কিসিমের সুতোয় বোনা এই সম্পর্কের জালের ঠিক মাঝখানে কেন্দ্রে থাকে এক বিশেষ রেশমি সুতো, সেই সুতোয় ভর করেই আমাদের এই জীবনের জাল বোনা হয়। এই রেশমি সুতোয় আমাদের জীবনের প্রথম সম্পর্কের গিঁটটি বেঁধে দেন আমাদের মা। এই সুতোই আমাদের মায়ের সাথে যোগসুত্র। সেই হল আমাদের নাড়ির টান। যতদিন মা বেঁচে থাকেন ততদিন সেই টান তাঁর সন্তান সন্ততীদের প্রতি থেকে যায় সেই সুক্ষ্ম রেশমি সুতো’র মতই। যেদিন মা শরীরে আমাদের ছেড়ে চলে যান, সেই দিন আমরা বুঝতে পারি আমাদের চারপাশে আবিষ্ট সেই জীবন-জালের ভর কেন্দ্রে এক আমূল পরিবর্তন হল। প্রধান শিকড় ছিন্ন হলে যেমন যে কোনো উদ্ভিদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে ওঠে তেমনি সেই নাড়ির টানে ছেদ পড়লে আমরা এক অসহায় বিপন্নতার সম্মুখীন হই। ছিন্ন মূল আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠি।

জীবনের চলার পথে ভোরে বা শেষ বেলায় যে বেলাতেই মা চলে যান না কেন তাঁর অনুপস্থিতির এক বিপুল অসহায়ত্ব বোধ আমাদের গ্রাস করে প্রবল ভাবে। নিজের সন্তানের মধ্যে সেই রেশমি সুতো’র যে টুকরো মা রেখে গেলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে আমরা তখন আকুল হয়ে আঁকড়ে ধরি সেই দ্রুত বিলীয়মান সেই ছিন্ন টুকরোকে, হাতড়ে বেড়াই তাকে স্পর্শ করবার জন্য।

এই সঙ্কট কালে মায়ের পুত্র ও কন্যা সন্তানের মধ্যে যেন অবস্থানের এক বিপুল পার্থক্য আছে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মা তাঁর মাতৃত্বের বোধ, যা তিনি তাঁর মায়ের থেকে আহরণ করেছিলেন তাই তাঁর কন্যা সন্তানের মধ্যে জন্ম জন্মান্তরের জন্য প্রবাহিত করে দেন। মা যতদিন থাকেন সেই মাতৃত্ব বোধ যেন কিছু সুপ্তই থেকে যায় মায়ের কন্যা সন্তানের মাঝে। মাকে হারিয়ে কন্যা সন্তান যেন নিজেই মাতৃত্বের আরেক রূপে আবির্ভূত হন। মা যাদের ছেড়ে চলে গেলেন, বাবা, ভাই বোন বা পরিবারের অন্য সবার প্রতি তাঁর এক অন্য দায়িত্ব স্নেহ ভালবাসা অধিকার জন্মায়। মা হারানোর সেই চরম সঙ্কট যেন কন্যা সন্তানের মধ্যে জন্ম দেয় এক অন্যমাপের আত্মবিশ্বাসের। মা’ই নিজে হাতে গড়ে দিয়ে যান সেই প্রতিমা। কেবল নিজে সরে গিয়ে যেন নিজের কন্যার মধ্য দিয়ে নিজেকেই উন্মোচিত করেন নূতন রূপে। তাই মাকে হারিয়ে নিজের মধ্যে মাতৃত্ব বোধের এক স্বাভাবিক উন্মোচনের ফলে মায়ের কন্যা সন্তান তাই তাঁর অসহায়ত্বের আধাঁরের মধ্যেও এক আশ্বাসের আলো দেখান। অবশ্যই এ কথা তখনিই খাটে যখন পরিণত বয়সে মা চলে যান। অবেলার ডাক পুত্র কন্যা আত্মীয় স্বজন নির্বিশেষে সবার কাছেই এক রকমের নিঃসহায় বিপর্যয়।

কিন্তু মায়ের পুত্র সন্তানের অসহায়ত্বের যেন কোনো শেষ নেই। মাতৃগর্ভ থেকেই সে তাঁর যে জীবনরস মায়ের থেকে আহরণ করতে শুরু করেছিল, জন্মের পর নাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন হলেও সেই প্রথম ক্ষণ থেকে সে কেবল মাকে আকঁড়েই ধরতে শিখেছে। যত সে আঁকড়ে ধরেছে মাকে মা’ও সমান ভাবে কেবলি অক্লেষে টেনে ধরে জড়িয়ে রেখেছেন। নির্ভর করেছেন। মা চলে যাওয়াতে সেই নাড়ির টান সেই পরম নির্ভরের সুক্ষ্ম রেশমি সুতো’র বাঁধন যখন চিরকালের জন্য ছিন্ন হয়ে যায় তখন তাঁর বোধ হয় এই জগৎ সংসারের সাথে সমস্ত সম্পর্কের যে প্রদীপ শিখাটি জ্বলছিল তা বুঝি নিভে গেল। মা কে হারিয়ে তাঁর পুত্র সন্তান তাই বিপুল এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে বোধ করে সে বুঝি প্রকৃতই অনাথ হল। মাতৃবিয়োগের যতিচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে তাই প্রথমবার নিজেদের অবস্থান কে কন্যা সন্তান যে পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করেন, পুত্র সন্তানকে বোধ হয় এক অন্য পরিপ্রেক্ষিতে তা বিচার করতে হয়। এতদিন আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল মা’ই বিরাজ করতেন। তাই এখন তাঁর অভাবে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় অন্য আরেক প্রেক্ষিতে – প্রকৃতির দিকে। সেখানে চলেছে এক বিচ্ছেদহীন বিরামহীন খেলা। কিছুর কমতি নেই। কোনো খামতি নেই, অসঙ্গতি নেই সেথায়।  প্রকৃতির বুকে দেখি সেখানে সেই রেশমি সুতো, যার স্পর্শে আমাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন মা, সেই সুতোয় বোনা এক অনন্ত অবিচ্ছেদ্য জাল বিছানো রয়েছে। নিজের ছন্দে আনন্দে অবলীলায় সৃষ্টি হচ্ছে প্রাণ। একিই ছন্দে ধ্বংস হচ্ছে প্রাণের। নিয়ত প্রাণের এই সৃষ্টি ও ধ্বংস চলেছে এক স্বাভাবিক ছন্দে। কোনও সঙ্কট নেই, অপূর্ণতা নেই বিলাপ নেই, আক্ষেপ নেই। এই আসা যাওয়ার খেলার মধ্যে কেবল উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রাণের এক উচ্ছল অনন্ত চলমান প্রকাশ। সেই প্রকাশের দ্যুতি আমাদের বুকে চমক দিয়ে বোঝায় আমাদের মা এই অনন্ত প্রাণের প্রকাশের এক অংশ মাত্র। নিজের শরীর নিংড়ে তিনি আমাদের সৃষ্টি করে, প্রতিষ্ঠা করেছেন, যুক্ত করেছেন এই প্রাণের চলার পথে। আমাদের যোগ সৃষ্টি করেছেন মূল প্রাণের ধারার সাথে। মা যদি না যেতেন, চিরকাল থাকতেন তবে তো আমাদের মা’র আসল পরিচয় আমরা পেতামই না। তাঁর উপস্থিতি এত বিরাট এত বিপুল এত তীব্র যে তিনি থেকে গেলে বুঝতামই না, আমার মা আসলে প্রকৃতিতে বিরাজমান বিশ্বমাতৃ শক্তিরই এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির মূহুর্ত থেকে প্রতি মুহুর্তে প্রতি প্রাণে প্রতি জীবে মা নিশঃব্দে তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, প্রাণ সৃষ্টি করে তাকে পালন করে প্রাণের এই অনন্ত চলাকেই অব্যাহত রেখেছেন তিনি। কাজ শেষে স্বাভাবিক ভাবেই মিশে যাচ্ছেন সেই বৃহৎ মাতৃ শক্তিতে।  তাই তাঁর বিদায়ের মুহুর্তে আজ দাঁড়িয়ে নিজের বিচ্ছেদের অপূর্ণতা কে বড় না করে দেখে যদি এই প্রাণের আনন্দের মাঝে মায়ের মিলনের সাথে নিজের মন কে মেলাতে সচেষ্ট হই, তবে এই চরম বিচ্ছেদ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুর থেকে উত্তরীত হয়ে আমরা পাব এক প্রকৃত পূর্ণতার আস্বাদ।

(আজ থেকে ৯ বছর আগে আমার শাশুড়ি মায়ের চলে যাবার পর এই লেখা লিখে ছিলাম। এর পরে আমার নিজের মা কেও হারিয়েছি। সম্প্রতি আমার সহপাঠী ভাস্করের মা চলে গেলেন। খেলা ভাঙ্গার খেলতে মাসিমা চলে গেলেন, সাথে আমাদের ছোটবেলায় বেড়ে ওঠার একটা বিরাট সময় হারিয়ে গেল।)

সঙ্গের ছবিটি পাবলো পিকাসো’র আঁকা মা ও ছেলে ১৯২২

No comments:

Post a Comment