Tuesday, June 27, 2017

আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান- প্রাণপ্রাচুর্যের বরপুত্র

  আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান ।যিনি অসীম প্রাণপ্রাচুর্যের বরপুত্র ছিলেন । ১০টি বছর তিনি নেই । এ এক অসীম শূণ্যতা-কোথাও কেউ নেই যে এ শূণ্যতার কিছুমাত্র পূরণ করতে পারে ।
 বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী বাবাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, স্থিরপ্রতিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান লোক মৃত্যুতে মুহ্যমান হন না। তিনি নিজেও তাঁর প্রিয়তম পুত্রের ৩০ বছর বয়সের অকাল প্রয়াণে ও মুহ্যমান হন নি। রবীন্দ্রনাথ নজরুল সয়ে গেছেন সন্তান শোক। আমি এক অসহায় সন্তান। যার কোন রকম ক্ষমতা বা সাধ্যই নেই কিছু ধারণ করবার। সে তো কোন প্রজ্ঞাবান বা স্থির প্রতিজ্ঞ কেউ নয়, যে  সাইফুদ্দিন খানের মতো পিতার শূণ্যতা ১০ বছরে ভুলে যেতে পারি! বরং দিনে দিনে সেই শূন্যতা আর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের ব্যর্থতা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে বুকের ভেতর । আমার বাপ্পু ডা. কামাল এ খান এবং আমার বাবা এই দুই অসীম ব্যক্তিত্ববানের প্রয়াণের শূণ্যতা আমার চারপাশের কোথাও ন্যূনতম পূর্ণ হবার কোন সম্ভাবনা আর নেই। তবু আশায় থাকি কখনো হয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের মেধা মনন ,ত্যাগ এবং তিতিক্ষার মাধ্যমে মুছে দেবে মানুষে মানুষে সকল বিভেদ। প্রতিষ্ঠিত করবে অসাম্প্রদায়িক সমাজ।

অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সংগ্রামে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সন্তান আমার বাবা  ভাষা সৈনিক এবং আলবদরের নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন খান ২০০৭ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ আমার চিরসংগ্রামী  বাবার প্রয়াণের এক দশক। আমি দেখতে পাই এখনো তাঁর কথা তৃণমূল কৃষিজীবি থেকে দালানের চার দেয়ালের ভেতরকার মানুষগুলো ও স্মরণ করেন শ্রদ্ধাভরে , অনেক ভালোবাসার সাথে , অনেক মিস করা থেকে। তাঁর আদরের ভাইপো ভাইঝি থেকে নাতি নাতনি- প্রত্যেকে।
আক্ষরিক অর্থেই জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ -সব পারতেন আমার বাবা। একেবারে শৈশব থেকে  মসজিদে আজান দেয়া থেকে অত্যাধুনিক ক্যামেরাতে ফটোগ্রাফি , সহযোদ্ধাদের পড়ালেখার জন্যে পিতার থেকে অর্থ সাহায্য নেয়া, কারাবন্দীদের জন্যে হাজার হাজার মাইল দূরের বাড়ি থেকে গোশত রান্না করে আনানো , ঘরের মেয়েদের জন্যে নৌকা বানিয়ে তাদের স্বাধীন ইচ্ছের বাস্তবায়ন  বিপন্ন মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করা অথবা দায়িত্বশীলদের  নিষ্ক্রিয়তার মুখে জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পনায় বর্বরভাবে  নিহত নিরীহ ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শাহাদতের হত্যামামলা সামরিক আদালতে তুলে ঘাতক হারুণের বিচার নিশ্চিত করা -  জাল বুনা, মশারি সেলাই বেড কাভার সেলাই ,  ফার্নিচার তৈরি কাঠ মিস্ত্রীর কাজে সাহায্য করা রাজমিস্ত্রীর কাজে সাহায্য করা, কংক্রিট ভাঙ্গা... সাম্পান চালানো- কোন কিছুই বাবার জন্য 'অকাজ' ছিল না। শুধু পদ-পদবীর লোভে লোকদেখানো কিছু করা , আত্মপ্রচারণা বা মানুষকে জানানো -কোন হিপোক্রেসি -একমাত্র  'অকাজ' বা অন্যায় ছিল বাবার কাছে। 
 চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ার বরউঠান গ্রামে তাঁকে  স্মরণ করা হচ্ছে  পারিবারিক ভাবে অনাথদের নিয়ে সীমিত পরিসরে। তিনি  মানবতার কল্যাণে তাঁর চক্ষুদান করেন আশির দশকে। পরবর্তীতে নব্বইয়ের পর তিনি দেহদান করেন। যদিও  নোটারি পাবলিকের কাগজে স্বাক্ষর করার পরও তাঁর মৃত্যুর পর সেই অঙ্গিকার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় তাঁর পরিবারের সদস্যরা, আমি নিজে ও ব্যর্থ হয়েছি, যার উপর বাবার অগাধ আস্থা ছিল । সব মিথ্যে হয়ে গেছে ।
 একাত্তরের ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেম আলির টর্চার সেল ডালিম হোটেলে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান।সেই অপরাধে দায়ের করা ৪ নম্বর মামলায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আদালত (ICT) মীর কাশেম আলীকে সাজা দেয়। মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় কাশিমপুর কারাগারে। বাবা দেখে যেতে পারলেন না।
 তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে তুলে আনতে হয় কিছু কথা। 
সাইফুদ্দিন খানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি সমৃদ্ধ সমাজসচেতন পরিবারে । ২৫  বছরের ও বেশি সময় সরকারী উকিল  ( Government Pleader –GP)  জমিদার মৌলভি  ফজলুর রহমান খানের কনিষ্ঠ পুত্র  সাইফুদ্দিন খানের শৈশব - কৈশোর, ছাত্র জীবন খুবই বর্ণাঢ্য ছিল। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলনের সূতিকাগার পটিয়াতে কমিউনিষ্ট পার্টির অবন্থান অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল।  মাস্টার’দা সূর্যসেন , বীরকন্যা প্রীতিলতার পথ ধরে  পরাধীন দেশকে স্বাধীন করবার জন্যে এবং শোষণহীন সমাজ গড়বার  স্বপ্নে  অনেক জমিদার এবং  অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানেরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন । কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো , কমরেড আবদুস সালাম  তাদের অন্যতম। সাইফুদ্দিন খান তাঁদের ই সহযোগী ছিলেন ।

 কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের আইনের মেধাবী ছাত্র ফজলুর রহমান খান ব্যক্তিজীবনে অনেক ত্যাগী এবং সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। যে কারণে তিনি স্বেচ্ছায়  চট্টগ্রাম আদালতে না থেকে  পটিয়ার আদালতে জিপি’র দায়িত্ব পালন করেন।  তাঁর  সন্তানদের  সাথে সাথে গ্রামের সন্তানদেরও শিক্ষিত করার জন্যে গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ফজলুর রহমান খান। তবে নিজের নামে কখনো তিনি কিছু প্রতিষ্ঠা করেন নি। যে কারণে সাইফুদ্দিন খান তাঁর পিতার নামে শিক্ষা এবং সমাজহিতৈষিমূলক কিছু করবার পরিকল্পনা করেছিলেন , যা শেষ করে যেতে পারেন নি ।
জমিদার ফজলুর রহমান খান পশ্চিম পটিয়াতে  জনকল্যাণে হাসপাতাল,  সড়ক নির্মান করেছেন, অসংখ্য পুকুর ছিল বরউঠান গ্রামে, তাই জলাভাব কখনো ছিল না এখানে।  সাইফুদ্দিন খান এমন শিক্ষানুরাগী , সমাজহিতৈষী  জমিদার পিতার সন্তান হিসাবে বড়ো হয়ে মানবতার কল্যাণে কমিউনিজমে দীক্ষা নেন এবং  নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন প্রজাদের কাতারে। জমিদারের পুত্র হয়েও তেভাগা আন্দোলনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সেই বার্তা পৌছে দিয়েছেন প্রজাদের কাছে । তাদের অভাব অনুযোগে একাত্ম হয়ে তাদের সাথে নিয়েই স্বাধিকার আন্দোলন করেছেন।
সাইফুদ্দিন খানের অসমাপ্ত সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনীতে জানা যায়,ফজলুর রহমান খানের পেশাগত সিনিয়র বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং আইনজীবি বিনোদ বিহারী নন্দীর পরামর্শে ফজলুর রহমান খান তাঁর বড়ো ভাইপো নুরুল আলম খানকে পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন।পরবর্তীতে তিনি অন্যান্যদের সাথে নিয়ে পটিয়া আবদুস সোবহান রাহাত আলী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । নিজের সন্তানদের ও সেই স্কুলে পড়িয়েছেন তিনি।
 ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন । সব রকমের সম্প্রদায়িকতা , কুসংস্কার , সংকীর্ণতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ ছিলেন । মানবতার সংগ্রামে উৎসর্গ করেছেন তাঁর জীবন। কোন শীর্ষ নেতৃত্ব বা কোন  পদ আর পদবী তাঁকে টানে নি কখনো। বরাবরই এ ধরণের প্রস্তাব বা প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে গ্রহণ করেছেন ত্যাগ ও তিতিক্ষার জীবন। তিনি সাইফুদ্দিন খান। যিনি কখনো কোন লোভ বা প্রলোভনের কাছে হার মানেন নি।
 ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী লিখেছেন, সাইফুদ্দিন খান কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেন নি। সাম্প্রতিক সময়ে আমার অতি প্রিয় ও শুভাকাঙ্খী অনুজতুল্য সাইফুদ্দিন খান, জনাব আব্দুল্লাহ -আল-হারুণ চৌধুরী এবং আ্যাডভোকেট শফিউল আলম এই ৩ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে আমি নিজেও শোকাভিভূত ।এরা  ছাত্র জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশের রাজনীতি ও সমাজসেবায় নিবিড় ভাবে জড়িত ছিলেন।  দেশের প্রগতি, সমৃদ্ধি ও দুঃস্থ আর্ত অভাবক্লিষ্ট জনসাধারণের মুখে হাসি ফুটাবার উদ্দেশ্যে উদার, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। জনাব সাইফুদ্দিন খান সুরুচিপূর্ণ , সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বড় বাই জনাব ডা. কামাল এ খান চট্টগ্রামের সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। সাইফুদ্দিন খানের স্ত্রী নূরজাহান খান প্রখ্যত নারী নেত্রী । এদের প্রত্যেকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গত এপ্রিল মাসে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এবং হাসপাতালে অবস্থিত স্ত্রীকে আনার জন্যে আমার কোলকাতা যাবার আগের দিন জনাব সাইফুদ্দিন খান আমার বাসায় এসেছিলেন এবং একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। ১৯৩০ সালে কালারপুলের আনোয়ারার জুলধা গ্রামে যুববিদ্রোহের সদস্য রজত সেন , দেবপ্রসাদ গুপ্ত, মনোরঞ্জন সেন প্রমুখের সঙ্গে পুলিশের গুরিতে নিহত বিপ্লবীদের স্মৃতি রক্ষার্থে মনে মনে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন । এবং আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবার অনুরোধ করেছিলেন । কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি বলাতে সেই পরিকল্পনা টি আর বাস্তবে রূপ নেয় নি। তাঁর এ অন্তিম বাসনা পূর্ণ হবে কিনা জানি না। মাত্র দু'দিন আগে তাঁর দেহাবসানের খবর পেয়ে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক এই রাজনৈতিক নেতার অভাব অপূরণীয় ।..
এই মহান বিপ্লবীর অমর বাণীতে একাত্ম আমরা ও। চিরসংগ্রামী সাইফুদ্দিন খানের পরবর্তী প্রজন্মের দায়বদ্ধতায় হয়তো কখনো পূর্ণ হবে তাঁর অসমাপ্ত পরিকল্পনা-এমন আশাবাদ রইলো ।

বাবার নাকি একটা ভেসপা ছিলো, যেটা দিয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সব কাজ করতেন বাবা। আমি নাকি সেটাতে চড়ালে কাঁদতাম। আবার বেচে দেয়ার পর ও কেঁদেছি ।
সাইফুদ্দিন খানকে ভুলতে পারেন না   আজন্ম  যিনি পরিবারের কন্যা জায়া জননীদের  প্রাণের সাধকে বাস্তবতা ছুঁয়ে যেতে এগিয়ে গেছেন সবার আগে। পরিবারের কন্যাদের , পুত্রবধুদের সাধ  ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়েছিলেন, এক অর্থে স্বাধীনতার সংজ্ঞা শিখিয়েছিলেন আমার সেই ছোট্টবেলায় । 
বাবা  নিজের জীবন দিয়ে শিখিয়েছেন মানবতার সেবায়  কিভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয় ।  আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যেই সেটা কিছুটা আছে । তবে আমার দুই ভাইয়ের মধ্যে সেটা অনেক বেশি ,তাদের সবটা দিয়ে তারা মানবতার সেবা করে যায়। আমি কতোটা পারি জানি না, তবে অন্তর থেকে চেষ্টা করি কাজ করে যেতে, সেবা করে যেতে। আমার সন্তানদের ও  তাদের জীবনে আমার বাবার সেই শিক্ষা কাজে লাগাতে দেখি, মনে মনে প্রার্থনা করি, তারা যেন সারাজীবন এভাবেই নিজেদের উজাড় করে মানুষকে ভালোবেসে যায় । 
 বাবা তাঁর মনন , মেধা আর শ্রমে সেবা করে গেছেন নিরন্তর । সাথে নিয়ে গেছেন বিপ্লবীদের স্পর্শে -যারা দেশমাতৃকার কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের সোনালী যৌবন থেকে মৃত্যুর প্রহর পর্যন্ত।  সেসব জানিয়ে লিখবো একদিন , এমন ভাবছি সেই কবে থেকে, হচ্ছে না। আজ বাবাকে অনুভব করে কিছু কাজ করবার দিন । লিখবার ও দিন বটে। পর্যায়ক্রমে সবই করবো যদি এই দেহে প্রাণ আরো কিছুদিন থাকে।
সুমি খান, ২৮ জুন, ২০১৭ বেলা ৯টা

No comments:

Post a Comment