Tuesday, May 6, 2014

‘কোথাও সান্তনা নেই, পৃথিবীতে শান্তি নেই আজ’ - আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

গতকাল (মঙ্গলবার) ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে প্রকাশিত আমার লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে- ‘মধ্যযুগ এত রক্ত দেখেছে কখনও?’ লেখাটি ছিল নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক নরবলি নিয়ে। আজও লিখছি একই হত্যা প্রসঙ্গ নিয়ে, তবে একটু বিস্তৃত পরিসরে। আজও লেখার শিরোনামের জন্য জীবনানন্দ দাশের শরণাপন্ন হয়েছি। আমার এই লেখার শিরোনামটিও জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে নেয়া- ‘কোথাও স্বান্তনা নেই, পৃথিবীতে শান্তি নেই আজ।’ নারায়ণগঞ্জের নরবলি নিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই।


আজ লেখার টেবিলে বসে লেখার শুরুতেই খোঁজ নিলাম, নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডির হোতা বলে অভিযুক্ত নূর হোসেন গ্রেফতার হয়েছেন কিনা। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ বলে বর্ণিত ১১ জন গ্রেফতার হলেও নূর হোসেন এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হননি। তিনি আত্মগোপন করেছেন অথবা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। এটাও যেন বাংলাদেশের সেই চিরাচরিত ঘটনা। ভয়ানক কোন অপরাধীও যদি ক্ষমতাসীন দলের আশ্রিত হয়, সে পালিয়ে যাবার সুযোগ পায়। তারপর বেশ কিছুদিন আরাম-আয়েশে বিদেশে থাকার পর টাকার জোরে অথবা ক্ষমতাসীনদের মদদের জোরে সব অভিযোগমুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসে এবং নতুন করে আরও বড় অপরাধে যুক্ত হয়। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। 


নূর হোসেনের বেলাতেও যদি তাই হয় তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি ঘটার তিনদিনের মধ্যে নূর হোসেনকে কেন গ্রেফতার করা গেল না? তিনি তো সাত ব্যক্তির লাশ শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠার পরও নিজের এলাকাতেই ছিলেন এবং তিনি এই হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী নন এই মর্মে কথাবার্তাও বলছিলেন, এখন প্রশ্ন, তাকে পালাবার সুযোগ কারা দিয়েছেন এবং কেন দিয়েছেন? 
নারায়ণগঞ্জের নরবলির ঘটনায় র‌্যাবও অভিযুক্ত হয়েছে। র‌্যাবের মহাপরিচালক এই ব্যাপারে দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। উচ্চ আদালতও এই ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছে। এখন প্রশ্ন, এই সব তদন্তের কাজ কি দ্রুত শেষ হবে, কিংবা শেষ হলেও তার রিপোর্ট কি কখনও দিনের আলোর মুখ দেখবে? নাকি লালফিতার বন্ধনেই অনির্দিষ্টকাল বন্দী হয়ে থাকবে? এবং ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জের বীভৎস হত্যাকা-ও অন্যান্য গুম, হত্যাকা-ের ঘটনার মতো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে মানুষের স্মরণ থেকে মুছে যাবে? 
বাংলাদেশ আর কতদিন এভাবে অপরাধ ও অপরাধীদের পুষবে? দেশে আইন আছে, তার শাসন নেই। অপরাধ আছে। শুধু আছে নয়, তার রাজত্ব ক্রমবর্ধমান। কিন্তু অপরাধীর বিচার নেই। অর্থবল ও ক্ষমতাবানদের মদদ থাকলে যে কোন ব্যক্তি যে কোন গুরুতর অপরাধে অপরাধী হয়েও পার পেতে পারেন; সমাজের মুকুটমণি হয়ে থাকতে পারেন। তা না হলে তারেক রহমান, যার বিরুদ্ধে মহাদুর্নীতি, গুম, খুন, সন্ত্রাস, অবৈধ অর্থ পাচারের অসংখ্য গুরুতর মামলা রয়েছে, তিনি কী করে আদালতের জামিন নিয়ে বছরের পর বছর বিদেশে একজন প্রিন্সের মতো বাস করতে পারেন, বিচার ও দন্ড এড়িয়ে চলতে পারেন? কোথায় তাঁর বিচার ও দন্ড? তিনি এখন বিদেশে বসে ‘ইতিহাসবিদ’ সেজেছেন এবং এই অসত্য ইতিহাস চর্চা দ্বারা তিনি অনারারি ডক্টরেট পাওয়ার চেষ্টা করলে (কারণ প্রকৃত ডক্টরেট পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁর নেই) বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। 
নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটির মূল অপরাধী কারা তা এখনও জানা যায়নি। তবে সন্দেহ করা হয়েছে এটা আওয়ামী লীগেরই দুই গ্রুপের স্বার্থদ্বন্দ্বের ফল। এদের এক গ্রুপের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমিদস্যুতা ও সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে। এই চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির বিবাদে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ভেতরে রক্তক্ষয়ী গ্রুপ-দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বে খুন-খারাবিও হচ্ছে বিস্তর। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ভেতরে একে অন্যের গলা কাটছে।
সম্প্রতি ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা (সভাপতি সোহাগ এবং সেক্রেটারি নাজমুল) লন্ডনে এসেছিলেন সাংগঠনিক কাজের অজুহাতে। তাঁদের কার্যকলাপ দেখে বিস্মিত হয়েছি। এঁরা যদি দেশের কোন ছাত্র সংগঠনের নেতা হন তাহলে দেশে ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যত কী? এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত লিখব। আসল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগের সবচাইতে বড় শত্রু এখন আওয়ামী লীগ। আমাকে ঢাকার এক তরুণ কলামিস্ট (যিনি আওয়ামী লীগেরও সমর্থক) সখেদে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সম্ভবত যদু বংশের মতো নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করবে। আত্মকলহ, স্বার্থের দ্বন্দ্বই হবে এদের বিপর্যয়ের কারণ। বিএনপি-জামায়াতকে আর নতুন করে তৎপর হতে হবে না।
আমার এই লেখাটির শিরোনাম ‘কোথাও সান্তনা নেই, পৃথিবীতে শান্তি নেই আজ।’ কথাটি কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই সত্য। পৃথিবীজুড়ে চলেছে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি। পত্রিকার পাতাজুড়ে এখন শুধু হত্যা, রক্তপাতের খবর। আগেকার যুদ্ধে একটা নিয়ম-কানুন ছিল। যুদ্ধ ঘোষণা করতে হতো। বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ নিষিদ্ধ ছিল। এখন যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই যেভাবে এক দেশ অপর দেশে হামলা চালিয়ে হত্যা, ধ্বংস চালাচ্ছে, তার নজির ঘোষিত যুদ্ধেও নেই। সন্ত্রাস দমনের নামে বিনা যুদ্ধ ঘোষণায় পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে বেসামরিক এলাকায় আমেরিকা যেভাবে ড্রোন হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নিরীহ সিভিলিয়ান হত্যা করেছে তার উদাহরণ মধ্যযুগেও নেই। তারপরও মার্কিন রাষ্ট্রদূতেরা দেশে দেশে শান্তি, স্বাধীনতা ও মানবতার বাণী ছড়ায়। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজেনা সাহেব নিত্যই বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও মানবতার উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর দেশটিই যে আজ বিশ্বে শান্তি ও মানবতার বড় শত্রু এবং একটি ‘রে‌্যগ-স্টেট’ সে সত্যটি তিনি নিত্য আড়াল করে চলেছেন।
মিসরে চলছে আরও জঘন্য গণহত্যা। তাকে অনেকেই বলছেন জুডিসিয়াল মাস-মার্ডার। সাইদ ইউসুফ নামে এক মিসরীয় বিচারক ৭২০ ব্যক্তিকে একসঙ্গে ফাঁসির আদেশ দিয়ে ‘জাজ বুচার’ (কসাই বিচারক) আখ্যা লাভ করেছেন। তাঁর আদালতে আরও ৯১৯ ব্যক্তি বিচারাধীন রয়েছে। তাদেরও বিচার প্রহসনে ফাঁসি দেয়া হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বিচারকের কার্যকলাপে মিসরের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়েছে। দন্ডিত ও বিচারাধীন ব্যক্তিদের কেউই সামাজিক অপরাধী নয়; তারা রাজনৈতিক বন্দী। তারা মুসলিম ব্রাদারহুড এবং পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থক। এরা মুরসির সমর্থনে রাজপথে বিক্ষোভ-মিছিলে শামিল হয়েছিল।
মিসরের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থা বিচার্য। বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত একটানা ছয় মাস ধরে রাজপথে সন্ত্রাস চালিয়ে যে রক্ত ঝরিয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে, সেজন্য এই দল দু’টির সমর্থক, নেতা বা কর্মীদের একজনেরও ফাঁসির আদেশ হয়নি। ’৭১-এ যারা গুরুতর যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের মধ্যে মাত্র একজনের ফাঁসি হয়েছে। আরও দু’একজনের দণ্ডাদেশ হয়েছে। দণ্ড এখনও কার্যকর হয়নি। তাতেই বিশ্বব্যাপী আমেরিকা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন- সকলের কী মায়াকান্না। বাংলাদেশে মাত্র একজনের ফাঁসি (তাও প্রমাণিত গুরুতর অপরাধে) হওয়ায় আমেরিকা ও জাতিসংঘ পর্যন্ত দুঃখে কাতর হয়েছে। আর মিসরে রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনের নামে সাত শ’র বেশি মানুষকে ফাঁসির আদেশ দেয়ার পরও বিশ্বে তেমন চাঞ্চল্য নেই। ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই গণ-ফাঁসির আদেশের দায়সারা গোছের একটি প্রতিবাদ জানিয়েই ক্ষান্ত রয়েছে। এই হচ্ছে তথাকথিত বিশ্ব বিবেকের আসল চেহারা।উন্নত অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সকল দেশেই এখন সন্ত্রাসের তা-ব চলছে। নানা চেহারার সন্ত্রাস। আমেরিকায়, জাপানে মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি বন্দুক হাতে স্কুলে ঢুকে শিক্ষকসহ বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নির্বিচারে হত্যা করছে; ভারতে চলছে দেশী এবং বিদেশী নাগরিকদের অপহরণ ও ধর্ষণ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা; মাওবাদী সন্ত্রাস। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও বামপন্থী সমর্থকদের মধ্যে চলছে নিত্য হানাহানি, খুন-খারাবি। কোন দেশ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে জর্জরিত, কোন দেশ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসে নিত্য রক্তাক্ত।ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের পার্থক্য; ইউরোপ ও আমেরিকায় অপরাধ যেমন হয় তেমনি অপরাধী যত উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি (প্রেসিডেন্ট নিকসন হলেও) হন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার বিচার ও দ- হয়। বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না। ব্রিটেনে বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতির জন্য ইউনুস পাওয়েলের মতো নেতাকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছিল; আমেরিকায় বর্ণদাঙ্গায় জড়িত অভিযোগে রিপাবলিকান নেতারও কারাদ- হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমানের বিচার ও দন্ড বিলম্বিত হয় এবং তাঁর গাড়িতে মন্ত্রিত্বের পতাকা ওড়ে। পাকিস্তানে লিয়াকত হত্যা, ডা. খান সাহেব হত্যা, বেনজির হত্যাসহ অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের অপরাধীদের বিচার ও দন্ড হয়নি। ভারতের গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দু’হাজার সংখ্যালঘু হত্যার দায়ে অভিযুক্ত নরেন্দ্র নাথ দামোদর দাস মোদি এখন নির্বাচনে ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদপ্রার্থী। তিনি জিতেও যেতে পারেন।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি মানুষের চেতনা জাগ্রত না হয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠে, তাহলে তাকে উচ্ছেদ করা অসম্ভব। বাংলাদেশে দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে একইভাবে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। ফলে এই দু’টি মহাব্যাধি থেকে দেশকে মুক্ত করা যাচ্ছে না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ভাল কাজ করেও দেশের মানুষের কাছে কল্কে পাচ্ছে না। কারণ, বড় বড় দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দায় এখন আওয়ামী লীগের ঘাড়েই।
নারায়ণগঞ্জের এই নির্মম ঘটনাটি কোন মহলের কারসাজিতেই যেন ধামাচাপা না পড়ে, সেদিকে আওয়ামী লীগ সরকারকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। নূর হোসেন পালাতে পেরেছেন, তাতে কী হয়েছে? রানা প্লাজার পলাতক মালিককে যদি ভারত থেকে ধরে আনা যায়, তাহলে নূর হোসেনকে কেন পারা যাবে না? তাকে অবশ্যই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় শাস্তি পেতে হবে। সবচাইতে বড় কথা, আওয়ামী লীগ থেকে একসময় সন্ত্রাসীদের দূর করার নামে জয়নাল হাজারী ও আরও কিছু ব্যক্তিকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল, তাতে লাভ হয়েছে কি? মাছের অসংখ্য ছানার মতো আওয়ামী লীগের ভেতরেও এখন নানা ধরনের অপরাধী, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজেরা রীতিমতো সিন্ডিকেট গড়ে তুলে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বঙ্গবন্ধু এদের নাম দিয়েছিলেন ‘চাটার দল।’ এই চাটার দল এখন লুটেরা ও খুনী গ্রুপে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা ভেবে দেখুন এদের কবল থেকে কেমন করে দল, দেশ ও জাতিকে মুক্ত করবেন।


No comments:

Post a Comment