Saturday, March 16, 2013

বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম আর নেই


চট্টগ্রাম: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভৌতবিজ্ঞানী ও প্রফেসর ইমিরেটাস ড. জামাল নজরুল ইসলাম আর নেই। বিশ্ববরেণ্য এ শিক্ষাবিদ চট্টগ্রামের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক ছিলেন।শুক্রবার রাত ১২টায় চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিজ্ঞানী জামাল নজরুল শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।



ওই হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. নূরুল হক বলেন, ‘জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে গত বুধবার থেকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। গত রাত ১২টার দিকে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর রাত আড়াইটার দিকে তার স্বজনেরা মরদেহ নগরীর সার্সন রোডে স্যারের বাসায় নিয়ে যান।’
১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ড. জামাল নজরুল ইসলাম ঝিনাইদহ সদরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তখন এই শহরের মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য) ছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তার বাবা কলকাতায় বদলি হন।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস ছিলেন। বিশিষ্ট এ বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান করেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।
চুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন,‘স্যার অসুস্থ শরীর নিয়ে গত ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।’
ড. জামাল নজরুল গণিত এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন। বেশকিছু গাণিতিক সূত্র এবং জটিল গাণিতিক তত্ত্বের সহজ পন্থার উদ্ভাবক জামাল নজরুল মহাকাশের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন। তার লেখা বেশকিছু বই অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ড. জামাল নজরুল ইসলাম একাধারে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ। তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত।
ড. জামাল নজরুল প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনের পাশাপাশি পরিবেশসহ বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। বিজ্ঞানী ড.জামাল নজরুল ইসলামের মরদেহ শনিবার বিকেল ৪টায় চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে।
মৃত্যুকালে জামাল নজরুল ইসলাম স্ত্রী ও দু’মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর বড় মেয়ে সাদাফ পেশাগত জীবনে মাইক্রো বায়োলজিস্ট ও ঢাকায় কর্মরত এবং ছোট মেয়ে নার্গিস সাইকোলজিস্ট ও লন্ডনে কর্মরত। বর্তমানে সবাই চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন।
তার মৃত্যুতে চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মৃত্যুর খবর শুনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা তার বাসায় ছুটে গেছেন।
শিক্ষাজীবন
জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীতে শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়াশোনা করেন তিনি। কলকাতায় মডেল স্কুলের পর চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেন। ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে ‘ডাবল প্রমোশন’ দিয়ে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।
চট্টগ্রামের বিখ্যাত এ বিদ্যালয়ে তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মূলত এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালবাসার সৃষ্টি হয়। নবম শ্রেণীতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।
সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। সে সময় সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের ‘ও লেভেল’ এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের ‘এ লেভেল’ বোঝাতো।
উল্লেখ্য হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি ‍তাঁর ঝোঁক ও ভালবাসা তৈরি হয়।
লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান এবং সেখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন।
বিএসসি শেষে ১৯৫৭ সালে জামাল নজরুল ইসলাম কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি (১৯৫৯) অর্জন করেন। তারপর সেখান থেকেই মাস্টার্স (১৯৬০) ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অধ্যাপক জামাল নজরুল কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে ড. জামাল নজরুল বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
রচনাবলী
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তার গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে একাধিক বই লেখেন। এসব বই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর তা বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ ও যুগোশ্লাভ ভাষায় অনুদিত হয়।
এছাড়া তার রোটেটিং ফিল্ড্‌স ইন জেনারেল রিলেটিভিটি গ্রন্থটি ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত হয়। একই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ। যা পরে স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত হয়।
তার অন্যান্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২), বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত কৃষ্ণ বিবর এবং রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ ।
এছাড়া ডব্লিউ বি বনোর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪)।
পুরস্কার
বিশিষ্ট এ বিজ্ঞানী একুশে পদকসহ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হন। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ১৯৮৫ সালে তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেণ্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়।

No comments:

Post a Comment