Friday, March 15, 2013

আপনি কাপুরুষ বিধায় ত্বকীকে হত্যা করেছেন,যদি বীরপুরুষ হয়ে থাকেন আমাকে হত্যা করুন:শামীম ওসমানকে মেয়র ডা.আইভী


নারায়ণগঞ্জ: মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে দায়ী করেছেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী।


ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে পাঁচ দিনের টানা কর্মসূচির শেষদিন শুক্রবার বিকেলে শহরের চাষাঢ়ায় শহীদ মিনারে আয়োজিত গণজমায়েতে তারা এ অভিযোগ করেন। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট এ গণসমাবেশের আয়োজন করে।

তারা বলেছেন, “শামীম ওসমান নিজেকে কাপুরুষের পরিচয় দিয়েছেন ত্বকীকে হত্যা করে। প্রশাসন যদি এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় খুনিদের বের করতে না পারে তাহলে শামীম ওসমানকে বর্জন করা হবে।”

শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, “আপনি কাপুরুষ বিধায় ত্বকীকে হত্যা করেছেন। আপনি যদি বীরপুরুষ হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে হত্যা করুন। যদি খুনিদের ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে আপনাদের সঙ্গে রাজনীতি করবো, নইলে আপনাকে বর্জন করা হবে।”

এর আগে আইভী যখন বক্তব্য শুরু করেন তখন স্লোগান ওঠে, “গডফাদারের আস্তানা, নারায়ণগঞ্জে রাখবো না।”

আইভী শহীদ মিনারে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে দেখে বলেন, “নারায়ণগঞ্জের মানুষ আজ প্রতিহত করার প্রত্যয়ে মাঠে নেমেছেন। আজ সময় এসেছে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নেওয়ার। এই শহরে অনেক সিরিজ হত্যা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের মানুষকে স্তব্ধ করে দিতে অনেক খুন হয়েছে। কিন্তু আর মেনে নেওয়া যায় না। নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখন মুক্তি চায়।”

৩০ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জবাসী অত্যাচার সহ্য করে আসছে উল্লেখ করে আইভী বলেন, “আমরা আর শিকলে বন্দি থাকতে চাই না। আমরা ত্বকীর মৃত্যুর পর এ অবস্থার মুক্তি চাই। আমরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়তে চাই।”

২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আইভীর কাছে পরাজিত হন সাবেক এমপি শামীম ওসমান। এ ঘটনাকে উল্লেখ করে আইভী বলেন, “আমি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কারণে আমি অপরাধী হতে পারি। ওই নির্বাচনে মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে কোন রক্তচক্ষুকে ভয় পায়নি। কিন্তু ত্বকীর মতো একজন মেধাবীকে হত্যা করে আপনি কাপুরুষের পরিচয় দিয়েছেন। আপনাকে আমি নির্বাচনের পর আপনার সহায়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তা না করে উল্টো হত্যার রাজনীতি শুরু করেছেন। আপনারা আওয়ামী লীগের নামের উপর ভর করে জুজুর ভয় দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জে ছড়ি ঘোরানোর ফায়দা লুটছেন। দলের দুঃসময়ে আপনারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে চাঁদাবাজীর টাকায় স্বর্গরাজ্যে বসবাস করেন আর আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতাকর্মীরা ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট করে।”

আইভী তার বক্তব্যে শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, “আপনি রফিউর রাব্বির মাত্র দশ গজ দূরে ট্রাকের উপর থেকে বক্তব্য দিয়েছেন ত্বকীকে আপনি খুন করেননি। আপনি জানেন ত্বকীকে কে খুন করেছে। আপনার অনেক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু আমাদের তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। আমাদের যোগাযোগ সাধারণ জনগণের সঙ্গে।”

আইভী বলেন, “আপনি বলছেন, আপনি ত্বকীকে খুন করেননি। আপনাকে তো কেউ বলেনি আপনি ত্বকীকে হত্যা করেছেন। আপনি নিজেকে বিশেষ মহল ভাবছেন কেন? আর আপনি যদি জেনে থাকেন কে ত্বকীকে হত্যা করেছে তাহলে তাকে ধরে এনে জনতার সামনে হাজির করুন। সেই খুনি যদি আমি হই বা আমার ভাই হয় বা আমার দলের কোন কর্মী হয় তাহলে তাকেও হাজির করুন। নইলে আমরা আপনাকে বর্জন করবো। আর যদি খুনিদের ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে আপনাদের সঙ্গে রাজনীতি করবো।”


তিনি বলেন, “শামীম ওসমানের বাবা সামসুজ্জোহার সঙ্গে আমার বাবা আলী আহাম্মদ চুনকার নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ থাকলেও তারা সন্ত্রাস করেনি। কিন্তু এখন আমরা সত্য কথা বলতে গেলে জামায়াত-শিবিরের তকমা লাগানো হচ্ছে।”

আইভী বলেন, “আপনারা নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজে ভদ্র শিক্ষিতদের হাতে কলমের বদলে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন আপনাদের ৩ ভাইকে রক্ষা করতে। আপনাদের কারণে মেধাবী ছাত্র গোলাম সারোয়ার এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। মাকসুদকে আপনারাই হত্যা করেছেন। নিয়াজুল এখন চেষ্টা করছে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে।”

রাব্বি আগে থেকেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাব্বি বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদ, রেলওয়ের স্থাপনা উচ্ছেদ, তেল-গ্যাস নিয়ে আন্দোলন করার কারণেই অনেকেই তার উপর ক্ষুব্ধ।”

আইভী আরও বলেন, “২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে যখন আমি দেশে ফিরে আসি, তখন অনেক বাঘ-সিংহ দেশে ছিল না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যখন বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের কারণে আওয়ামী লীগের করুণ দশা ছিল, তখন এক সময়ে নারায়ণগঞ্জে রাজত্বকারী কেউ ছিল না।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে আইভী বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ যখন আপনাকে গণরায় দিয়েছিল, তখন দেশে কোনো গডফাদার ছিল না। আপনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিচার কাজ শেষ হলে দেশবাসী আপনার পক্ষে আবারও গণরায় দেবে। নারায়ণগঞ্জকে কোনো জল্লাদের হাতে তুলে দেবেন না। নারায়ণগঞ্জের মানুষ মুক্তভাবে নিশ্বাঃস নিতে চায়। আর যদি নারায়ণগঞ্জকে কোনো জল্লাদের হাতে তুলে দিতে হয়, তবে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলুন।”

তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, “আপনার প্রশাসনকে নির্দেশ দেন ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেন কোনো জজমিয়া নাটক না হয়। আমরা কোনো জজমিয়া নাটক দেখতে চাই না। নয়তো যেদিন সাধারণ মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নামবে তখন নারায়ণগঞ্জে কোনো জল্লাদ, কোনো গডফাদার রক্ষা পাবে না। কোনো টর্চার সেল নারায়ণগঞ্জে থাকবে না।”

এক ভাইয়ের প্রশ্রয়ে ত্বকীকে হত্যা: রাব্বি



ছেলে হত্যাকাণ্ডের পর আটদিন পর শুক্রবার প্রকাশ্যে সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ত্বকীর বাবা নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি রফিউর রাব্বি।

তিনি বলেন, “ত্বকী আমার ছেলে, মরে গেছে। নারায়ণগঞ্জে ত্বকীর বয়সের যতো তরুণ রয়েছে তারা সবাই আমার সন্তান। তাদের জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ত্বকী আমাকে দিয়ে গেছে। সারাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করছে। আমরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করে আসছি, ঠিক সেই সময় ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। তিন ভাইয়ের এক ভাইয়ের প্রশ্রয়ে ও একটি সংস্থার সহায়তায় খুনিদের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই এক ভাইকে ডেকে নিয়ে বলেছেন নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যা নিয়ে বাড়াবাড়ি যেন না হয়। সেই ভাই বলেছেন, দুই-চারদিন হৈ চৈ হবে তারপর বন্ধ হয়ে যাবে।”

রাব্বি বলেন, “আমরা কোনোভাবেই মনে করি না ত্বকীকে জামায়াত-শিবির হত্যা করেছে। তাকে আমাদের সেই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হত্যা করেছে, যাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি। বাস ভাড়া বাড়ার ব্যাপারে যখন আমি আন্দোলন করি, তখন বাস মালিকরা র‌্যাবের কাছে একটি তালিকা দিয়েছিল তারা মাসে কতো টাকা নাসিম ওসমান ও শামীম ওসমানকে চাঁদা দেয়। আমি সেই তালিকা দেখিয়ে ডিসি অফিসে বলেছিলাম, এই চাঁদা যদি বন্ধ করা হয় তাহলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বাস ভাড়া ২২ টাকারও কম হবে।”

রাব্বি আরও বলেন, “নারায়ণগঞ্জে একটি টর্চার সেল আছে। সেই টর্চার সেলের আশে পাশে যারা থাকে তারা রাতে চিৎকারে শব্দ শুনতে পায়, গুলির শব্দ পায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে পুলিশ গোয়েন্দা জানে না সেই টর্চার সেলের কথা, শোনে না গুলি আর চিৎকারের শব্দ।”

শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে রাব্বি বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে আমাদের জামায়াতের দোসর বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতের দোসর কে, তা নারায়ণগঞ্জবাসীকে জানাতে হবে। এই পর্যন্ত জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আপনি কয়জন জামায়াত-শিবিরকে মেরেছেন তা নারায়ণগঞ্জের মানুষকে বলেন। আপনার শ্বশুর জামায়াতের সংগঠন সোসাইটির সভাপতি, যে মুজাহিদের সাথে কাজ করে। আমরা অসাম্প্রদায়িতার কথা বলি আপনি সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন। সিটি নির্বাচনের সময় আপনি হিন্দু মন্দিরে হামলা করে সংখ্যালঘুদের বুঝাতে চেয়েছেন শামীম ওসমানকে ভোট না দিলে নারায়ণগঞ্জে হিন্দুরা থাকতে পারবে না।”

তিনি আরও বলেন, “আপনারা আপনাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সন্ত্রাসী চাদাঁবাজি করিয়ে থাকেন। খুন করিয়ে থাকেন। আপনাদের তৈরি টর্চার সেলে আমাদের সন্তানদের টর্চার করে থাকেন। এসব আর হতে দেওয়া হবে না। নারায়ণগঞ্জের মানুষ টর্চার সেলে হামলা চালিয়ে একটি ইঁট পর্যন্ত খুলে নিয়ে আসবে।”

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিকের সভাপতিত্বে গণজমায়েত সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন নারায়ণঞ্জ প্রেসকাবের সভাপতি কবি হালিম আজাদ, নারায়ণগঞ্জ খেলাঘরের সভাপতি রথিন চক্রবর্তী, নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট প্রদীপ ঘোষ বাবু, সাবেক সভাপতি ভবানি শংকর রায়, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল কাদির, জেলা কৃষকলীগের সভাপতি রোকনউদ্দিন আহম্মেদ, জেলা বাসদের সমন্বয়ক নিখিল দাস, জেলা সিপিবি সমন্বয়ক হাফিজুল ইসলাম, শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ, মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল, কাউন্সিলর অসিত বরুন বিশ্বাস, মনিরুজ্জামান, সাগর, সাবেক কমিশনার দেলোয়ার হোসেন চুন্নু, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল সুজন, রফিউর রাব্বির ছোট ভাই ওয়াহিদ রেজা।

এখানে উল্লেখ্য, গত ৬ মার্চ থেকে নিখোঁজ থাকে ত্বকী। এরপর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৯ মার্চ এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে হরতাল পালিত হয়।

৫ দিনব্যাপি কর্মসূচির প্রথম দিন সোমবার জেলা প্রশাসকের কার্যালায় ঘেরাও ও স্মারক লিপি প্রদান করা হয়। মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় শহীদ মিনারে নাগরিক শোকসভা, ১৩ মার্চ বুধবার দিনব্যাপি এলাকায় এলাকায় গণসংযোগ, ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম


No comments:

Post a Comment