Monday, December 15, 2014

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতী এবং পড়ার সুখ! -রুদ্রাক্ষ রহমান

পড়ার সুখে যাকে একবার পেয়ে বসে তার পক্ষে অন্য কিছু করা মোটেও সুখকর হয়ে ওঠে না। অবশ্য এটা মানতেই হয় পড়তে না জানলে, নিয়মিত পড়ার অভ্যাস না থাকলে ভালো কিছু আয়ত্বে করা যায় না। যে পড়েছে, সেই এগিয়ে গেছে তার সময় এবং তার সময়ের মানুষদের থেকে। নিজে না পড়লে ক্লাসে ছাত্রদের পড়াবেন কী শিক্ষক!

বন্ধুদের আড্ডায় সেই প্রাণভোমরা হয়ে ওঠে যে একটু বেশি জানে। অন্যরকম জীবনের জন্যে তাই পড়াটা অন্তত জরুরি। আমাদের এই ভূখন্ডে এখন হেমন্ত চলছে। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে এখন নতুন ফসলের সমারোহ। পাকাধানের ছড়ার মৃদু-মন্দছন্দতোলা বাতাস এখন মাতিয়ে দিচ্ছে চারদিক। কৃষকরে মাঠ থেকে গোলায় উঠছে সোনার ধান। নতুন ধান আর পিঠার গন্ধে নবান্নের বাতাস এখন গ্রামের ঘরে ঘরে। রাতের আকাশ থেকে শিশির পড়া শুরু করেছে। শীতের আগমন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে গ্রামের প্রকৃতিতে। এমনি হেমন্ত আর দুরন্ত শীতের সকালে উঠানে খেজুরপাতার পাটি পেতে এদেশে পাঠের অভ্যাসটা তৈরি হয় সেই ছেলে বেলায়।

আর হেলে দুলে ছন্দপড়ার সময় থেকে সেই যে পাঠের আনন্দ তৈরি হয় বুকের ভেতর তা কোনওদিন তা ফুরিয়ে যায় না। ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ অথবা ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়রা/ ফুলতুলিতে যাই’, অথবা ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে/ ছাতিম তলায় কে/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে/ সোনামনির বে’ দিয়ে সেই যে পড়ার শোনা তা গেঁথে যায় বুকের গভীর তলে। নানা কারণে হয়তো তা কিছু দিরে জন্যে চাপা পড়ে যায় তবে ফুরিয়ে যায় না চিরদিনের জন্যে। আর একটা বই পড়ার মধ্যে কেবল আনন্দই থাকে না, থাকে অনেক কিছু। ধরা যাক একটা উপন্যাস, সেখানে একটা সময় থাকে, কতগুলো চরিত্র থাকে। সব কেমন প্রাণময় হয়ে চলে আসে অন্য এক সময়ের পাঠকের সামনে।

 বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় এক নির্মাতার নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক ‘পথের পাঁচালী’র জন্যেই তিনি অমর জায়গা করে নিয়েছেন কেবল বাংলা নয়, বিশ্ব সাহিত্য আসরে। সাদা-সিধে এই মানুষটি ছিলেন প্রকৃতির পূজারী। ‘ইছামতী’ নামে তার একটি অসাধারণ উপন্যাস আছে। বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ৬ মাঘ ১৩৫৬ সালে। প্রকাশক মিত্র ও ঘোষ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলিকাতা-১২। বইটার দাম ছিলো ৮ টাকা। ঠিক ৬৫টি বছর আগে প্রকাশিত বইটি ১৯৫০-৫১ সালের রবীন্দ্র পুরস্কার অর্জন করে নেয়। ৬৫টি বছর আগে প্রকাশিত ইছামতীর ঘটনাকাল আরও আগের, বাংলা ১২৭০, ইংরেজি ১৮৬৩। বিভূতি সেই কালের বর্ণনা করেছেন এভাবে‘১২৭০ সালের বন্যার জল সরে গিয়েছে সবে। পথ ঘাটে তখনও কাদা, মাঠে মাঠে জল জমে আছে। বিকেল বেলা ফিঙে পাখী বসে আচে বাব্লা গাছের ফুলে-ভর্তি ডালে।’ ৩৭৬ পৃষ্ঠার একটি বই পড়তে অনেক কষ্ট হয়, সময় বার করতে হয় আর মনোযোগেরও দাবি রাখে। তবে কথা হলো ওই যে, নেশা বা আনন্দ।

বিভূতিভূষণের লেখা পড়লে বোঝা যায় মাত্র ১০০ বছর বা তার কিছু আগে আমাদের গ্রাম বাংলার অবস্থা কেমন ছিলো। জাত-পাতের শেকলে আটকে পড়া সাধারণ হিন্দু পরিবারের কথা বাদ দিয়েই ব্রাক্ষণদের অর্থনৈতিক অবস্থাও যে ভালো ছিলো না তার ছবি ফুটে উঠেছে বিভূতির কলমের আঁচড়ে।

দেশে তখন চলছিলো ইংরেজ শাসন। তখন ইংরেজ সাহেবদের দেখলে সাধারণ মানুষ কেবল পথই ছেড়ে দিতো না, রীতিমত পালাত। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো এঅঞ্চলের কিছু মানুষ, তারা ইংরেজ শাসন টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেদের অবস্থা ভালো করার জন্যে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতো, এমনকি খুনও। ইছামতীতে ইংরেজদের নীল চাষের সেই নিষ্ঠুর অধ্যায় ধরা পড়েছে ভেতর থেকে। আবার এই উপন্যাসে ইংরেজ এবং তাদের তাবেদার এদেশীয় দেওয়ানদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ফুঁসে ওঠার বর্ণনাও আছে। মোল্লাহাটির নীলকুঠির বড় সাহেব পথ দিয়ে যাবেন বলে গ্রামের সাধারণ মানুষ, মাথায় মোট নিয়ে হাটে হাটে ঘুর বেড়ানো নালু পাল সব ফেলে রেখে ফসলের ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলো। কালক্রমে সেই নালু পাল যখন ওই এলাকাল সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে, আর নীলকুঠির আলো একটু একটু করে নিবতে থাকে, তখন সেই নালুর কাছেই বিক্রি করতে হয় ওই কুঠি।

 বাংলার পথে পথে, জনপদে ইংরেজ সাহেবরা তখন বাঙালি দেওয়ান আর সঙ্গে চাবুক নিয়ে ঘুরতো। সাহেবী চাবুকের তেজ আর আঘাত এমনি নিষ্ঠুর ছিলো যে মানুষ নাম দিয়েছিলো ‘শ্যামচাঁদ’। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের গায়ে সেই শ্যামচাঁদের ঘা পড়তো যখন-তখন, পান থেকে চুন খসলেই। কত কষ্ট, কত লাঞ্ছনা, অপমান আর সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের। ইংরেজ শাসনের পাঠ চুকেছে ১৯৪৭-এ। পাকিস্তান নামের সাম্প্রদায়িক দুঃশাসনকে আমরা পরাজিত করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। সুদীর্ঘকালের অভাবের ছায়া, উত্তরাধিকার তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে ছেড়ে যায় নি। খুব বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র ৩৫ বছর আগেও আমি এই বাংলাদেশে পদ্মার তীরের মানুষদের কষ্ট দেখেছি। ভরা বর্ষায় অনেকের হাড়িতে ভাত জুটতো না। আলু শাকের সঙ্গে একটু চিংড়ি মাছের মিশেলে দুবেলার আহার হতো। অনেকে কেবল লবন দিয়ে আটা সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটিয়েছে তখন।


 দিন কত বদলেছে! আমরাই বদলে দিয়েছি সব। এখন, এই বাংলাদেশে কারো ঘরে ভাতের অভাব আছে এমন কথা শোনা যায় না। ধনি-দরিদ্রের ব্যবধানের রেখাটা হয়তো আরও মোটা হয়েছে, হয়তো ‘মধ্যবিত্ত’ নামের অসাধারণ অহমের ঐতিহ্য আমরা হারিয়েছি, তাই বলে এখন আর কেউ ভাতের অভাবে মরছে না। আজ থেকে ৫০ বছর আগের বাংলাদেশ, ৪০ বছর আগের বাংলাদেশ এবং এসময়ের বাংলাদেশ নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ লিখেছেন, লিখছেন। এসব সময়, এসব সংগ্রামের কথা নিশ্চয়ই বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা থাকবে। আগামী দিনের কোনও এক পাঠক পুরো বইয়ের পাতায় খুঁজে পাবে তার বাংলাদেশকে। যেমন আমি খুঁজে পেলাম ১৫১ বছর আগের বাংলাদেশকে ‘ইছামতী’র পাতায় পাতায়। অর্ধশতাব্দীরও আগে প্রকাশিত বই। সাবধানে ধরতে হয়, নইলে খুলে যায় সেলাই, খসে পড়তে চায় কাগজ! আর সময় যে কীভাবে বইয়ের পাতায় চুপটি করে বসে থাকে তার একটু প্রমাণ দেয়া যাক ইছামতী থেকে।
‘ গ্রামের সকলেই নালু পালকে ভালোবাসে। সকলেই তাকে ভালো ভালো কথা বলে গেল। শম্ভু রায়(রাজারাম রায়ের দূর সম্পর্কের ভাইপো, সে কলকাতায় আমুটি কোম্পানীর হৌসে নকলবিশ) বললে, চলো নালু, আমাদের সঙ্গে সোমবারে কলকাতা, উৎসব হচ্চে সামনের হপ্তাতে খুব আনন্দ হবে, দেখে আসবা রেলগাড়ি খুলেচে হাওড়া থেকে পেঁড়ো বর্ধমান পজ্জন্ত, দেখে আসবা
  রেলগাড়ি জানি। আমার মাল সেদিন এসেচে রেলগাড়িতে ওদিকের কোন জায়গা থেকে। আমার মুহুরী বলছিল।
দেখেচ?


 কলকাতায় গেলাম কবে যে দেখবো?
 চলো এবার দেখে আসবা।
ভয় করে, শুনিচি নাকি বেজায় চোর জুয়োচোরদের দেশ।’
তারপর নালুপাল স্ত্রী তুলসীকে নিয়ে কলকাতা দেখতে গিয়ে ভীষণ এক অভিজ্ঞতা পেলো। গড়ের মাঠে গিয়ে দেখল সাহেবরা বেত হাতে করে সামনের লোকদের মারতে মারতে নিজেরা বীরদর্পে চলে যাচ্ছে। ভয়ে লোকজন পথ ছেড়ে দিচ্ছে। নালু পালের স্ত্রীর গায়ে এক ঘা বেত লেগেছিল। বিভূতি বর্ণনা করছেন, ‘পেছনে চেয়ে দেখে দুজন সাহেব আর একজন মেম, দুই সাহেব বেত হাতে নিয়ে শুধু ডাইনে বায়ে মারতে মারতে চলেচে।… নালু পাল কলকাতায় বাজার করতে গিয়ে দেখল দুধের সের এক আনা ছ’ পয়সা। তাও খাঁটি দুধ নয়, জল মেশানো’। সেময়ের কলকাতার নিষ্ঠুরতা আর বাজারের চড়া পণ্যমূল্য দেখে নালু পাল অবাক হয়েছিলো। আর বিভূতির লেখায় পাওয়া গেলো কলকাতার দুধে তখনিই পানি মেশানোর ঘটনা। আর কলকাতার ঘি যে খাঁটি ছিলো না তার কথা আছে বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জবানীতে।


 ইছামতী না পড়লে জানাই হতো না দেড়শ’ বছর আগে ইছামতী নদীর দুপারের মানুষের সেই জীবন কথা। আর যদি বিভূতিভূষণ না লিখতেন এই উপন্যাস তাহলে প্রকৃতি ফুটে উঠতো না এমনি করে। উপন্যাস শুরুর আগে একটু ভূমিকা আছে। সেখানে বলা হয়েছে‘ ইছামতীর যে অংশ নদীয়া ও যশোর জেলার মধ্যে অবস্থিত, সে অংশটুকুর রূপ সত্যিই এত চমৎকার, যারা দেখবার সুয়োগ পেয়েচেন, তারা জানেন। কিন্তু তারাই সবচেয়ে ভালো করে উপলব্ধি করবেন, যারা অনেকদিন ধরে বাস করচেন এ অঞ্চলে।’


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাছি, অদ্বৈত মল্ল বর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম বাদ দিলে নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন, তাদের গল্প তেমন করে ধরা পড়েনি আর কোনও উপন্যাসে।
 বিভূতিভূষণ ইছামতীর দুই তীরের মানুষগুলোকে দেখেছেন আপন করে। তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। পিতা সম্পর্কে বিভূতিপুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ‘আমার পিতৃদেব বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির একনিষ্ঠ উপাসক হিসেবে বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যে অনন্য আসনের অধিকারী। বর্ষণক্ষান্ত শ্রাবণসন্ধ্যায় গ্রাম্য নদী ইছামতীর তীরে সারিবদ্ধ সাঁইবাবলা গাছ, ঘেঁটুফুলের কটুতিক্ত ঘ্রাণে ভারাক্রান্ত বসন্ত অপরাহ্নের মন্থর বাতাস, উদাস দ্বিপ্রহরে নির্জন বাঁশবনে বউ-কথা-কও পাখির ডাক, ধুলোয় ভরা পথের বাঁকে ফুটে থাকা অনাদৃত বুনোফুল এসমস্ত বিভূতিভূষণের সাহিত্য নিজের অনাড়ম্বর সারল্যের প্রভাবে জনচিত্তে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলেছে’। বিভূতিভূষণের ‘শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প’-র( প্রথম প্রকাশ ১৯৮৭ সাল, পত্রপুট, ৩৭/৯ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা) প্রারম্ভিকীতে আছে কথাগুলো।


 আর ইছামতীতে আছে অনেক মানুষের অনেক গাঁথা। উপন্যাসের এক সাহসী চরিত্রের নাম নিস্তারিণী। অনেক নিয়ম ভাঙা এই নারী তখনি স্বামীকে ঘরে রেখে অন্য পুরুষের প্রেমে পড়ে, তার সঙ্গে জঙ্গলে অভিসারে বেরোয়। একা একা পথে বেরোয়, নদীতে নামে, আর নদীতে ডুব দিয়ে পেয়ে যায় এক অবাক ঝিনুক যার ভেতরে ছিলো একশ টাকার মুক্তো। এখন যার মূল্য লাখ টাকা। এই নিস্তারিণীর কণ্ঠে ইছামতী তীরের বউ-ঝিরা শুনে ভীষণ এক প্রেমের গান।


‘ভালবাসা কি কথার কথা সই
 মন যার মনে গাঁথা
 শুকাইলে তরুবর বাঁচে কি জড়িত লতা
প্রাণ যার প্রাণে গাঁথা।’


আর বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইছামতীর উপসংহারে লিখেন, ‘আজকার এই যে সঙ্গীত, জীবজগতের এইপবিত্র অনাহুত ধ্বনি আজ যেসব কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্চে পাঁচশত কি হাজার বছর পরে সেসব কণ্ঠ কোথায় মিলিয়ে যাবে! ইছামতীর জলের স্রোতে নতুন ইতিহাস লেখা হবে কালের বুকে।’


কালের বুকে অনেক কিছুই লেখা হবে, অনেক কিছুই হয়তো হবে না। আজকের এই সময়ের অনেক কিছুই হয়তো আগামীর মানুষরা জানবে না, তবে কিছু কিছু তো জানবে। তাই কাউকে না কাউকে কালের কথা, কালের গাথা লিখতে হয়, যেমন লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ, কাজি নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে একালের হুমায়ুন আজাদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শামসুর রাহমান। আর পাঠকের হাতে হাতে সেই লেখা পৌঁছে যাচ্ছে কাল থেকে মহাকালে।


 রুদ্রাক্ষ রহমানঃ গল্পকার

No comments:

Post a Comment