Saturday, December 7, 2013

ধর্মোন্মাদনার বিরুদ্ধে সুধন দাস -আগরতলায় মসজিদ সুরক্ষা ও সংহতি উত্‍সব-এদেশেও জরুরী: সুমি খান

ধর্মোন্মাদনার বিরুদ্ধে এক অসাধারণ সংহতি  উৎসব এবং চন্দ্রপুর মসজিদে শান্তির পতাকা হাতে এক স্বপ্নচারী সুধন দাসের  প্রতি সম্মান জানিয়ে শুরু করছি এই লেখা।

সম্ভবত, মোগল আমলের শেষদিকে  ভারতের আগরতলার চন্দ্রপুরে নির্মিত তিন গম্বুজওয়ালা  ৫শ' বছরের প্রাচীন মসজিদ ও মাজার পুনর্নিমান করে  ২১ বছর আগে শুরু হয় সংহতি উত্‍সব ।   অর্থাত্‍ ১৯৯২ সালে  রাজনগর থেকে কিছুটা দূরে  ডিমাতলীর গভীর জঙ্গলের ভেতরে  এই মসজিদের ধ্বংসম্তূপ আবিষ্কার  হয়। 

 ভূমি থেকে প্রায়  একশ' মিটার উঁচুতে একটি টিলার উপর অবস্থান ছিল এই মসজিদটির। এখন থেকে ৭২৫ বছর আগে ৭২৩ হিজরি তে এই মসজিদ টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মনে করেন এলাকার অনেকে, তবে তারা মনে করেন এর সঠিক ইতিহাস উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন।  বাবরী মসজিদ ধ্বংসের  প্রতিবাদ হিসেবে সে বছরই মসজিদটি পুনর্নির্মান  করে ১৯৯৩ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে  সংহতি উৎসব শুরু করেন  স্বপ্নবিলাসী তরুণ, সুধন দাস । সংহতি বিনাশের অপপ্রয়াস রুখতে শুরু হয়  এই সংহতি উত্‍সব ।এই উত্‍সব  এবার পা দিয়েছে ২১ বছরে ।  ৬ থেকে ৮ ডিসেম্বর ২০১৩ এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই মসজিদ থেকে সামান্য দূরত্বেই বাংলাদেশ। 
কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে  জনগণের রায়ে এখন সুধন দাস বিধায়কের দায়িত্ব আছেন।  সম্প্রতি  চন্দ্রপুরের বিধায়ক পদে নির্বাচিত হয়েছেন সুধন দাস । তারই উদ্যোগে, এবছরও  ৬ ডিসেম্বর শুরু হলো সংহতি উত্‍সব  । 

প্রাচীন ভগ্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত এই  মসজিদ সংরক্ষণের কাজ এবং সংহতি উৎসবের জন্যে  চন্দ্রপুর মসজিদ প্রাঙ্গনে  জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে  একটি মাটির কলস থেকে শ্রমিকরা উদ্ধার করেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর  ৭৬টি রৌপ্যমুদ্রা ।
 উদ্ধারকৃত  মুদ্রা গুলোর একদিকে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি, অন্যদিকে চতুর্থ উইলিয়ামসের ছবি। আগরতলা রাজ্য জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্যে বিধায়ক সুধন দাস এলাকা বাসীকে বুঝিয়ে তাদের থেকে  ৭৬ টি মুদ্রা ই  ফেরত পান। সেসব সংরক্ষণ করে ৬ ডিসেম্বর সংহতি উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে  রাজ্যের উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন  বিধায়ক সুধন দাস । সংহতি, ঐক্য আর  ভালোবাসার ডাকে ইতিহাস যেন কথা বলছে  চন্দ্রপুর মসজিদে ।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় বাবরি মসজিদের ইতিহাস। ১৬ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদ অযোধ্যার  ২ দশমিক ৭ একর জমিতে অবস্থিত। এ জমি অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার বলে দাবি করে আসছে হিন্দু এবং জৈন ধর্মের অনুসারীরা। এ জমি  দেবতা রামের জন্মভূমি বলে তারা দাবি করে। অন্যদিকে মুসলমানদের দাবি, এ জমি সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াক্ফ বোর্ডের।

 ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০  রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত প্যানেল এ রায় ঘোষণা করেছেন। বিচারপতিরা হচ্ছেন এস ইউ খান, ডি ভি শরমা ও সুধির আগারওয়াল। রায়ে বাবরি মসজিদের জমি সমান তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড, নিরমহি আখড়া এবং রামনালা পার্টিকে সমান তিনভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে ২ দশমিক ৭ একর জমি।  বাবরী মসজিদ ঘিরে  ভ্রাতৃবিরোধী দাঙ্গা হাঙ্গামার তেমন সুযোগ এখন আর নেই।
 মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করার জঘন্য উদ্দেশ্যে  বাবরী মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিলো ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর । এই উপমহাদেশে দুই হাজারের ও বেশী মানুষ মারা যায় বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনাকে কেন্দ্র করে।  ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ধ্বংস করার  এ ষড়যন্ত্র আর অপচেষ্টা ঠেকাতেই   আগরতলায় এই সংহতি  উৎসব ।  জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে বিভেদ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রশাসকগণ; এর উদ্দেশ্য তাদের শাসনক্ষমতা জিইয়ে রাখা, বা ফিরে পাওয়া। অনেক সময়ে বিরোধীদলও এই বিভেদকারী বা ষড়যন্ত্রের  প্রধান অংশ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র তাই প্রমাণ করে।  মানুষ এবং মানবতা ধ্বংসের এই  খেলা অনুধাবন এবং তা প্রতিরোধের ক্ষমতা আমাদের নেই, বলেই, আমরা সাধারণ মানুষ । আমাদের ক্ষেপিয়ে তোলা যায় সহজে । রাজনৈতিক দলগুলির কথায় আমরা বিশ্বাস করি সহজে । সংহতি ধ্বংসের এই প্রয়াস কত ভয়ংকর ও আত্মঘাতী-তা আমরা কবে বুঝবো?
 এই উপমহাদেশের  প্রতিটি দেশের সহজসরল  সাধারণ মানুষেরা এই ষড়যন্ত্র এবং হত্যাযজ্ঞের শিকার । এশিয়ার  শক্তিশালী দেশ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান  সবখানে এই বিভেদ জিইয়ে রাখা হয়েছে  বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে । নিজের ঘরে আগুন দিয়ে উল্লাসে নাচছে মূর্খ ও উন্মাদ কিছু লোক । যারা আসল পুতুল নাচিয়ে, তারা  বিপুল অর্থের বিনিময়ে  'দেবতা ' র  মুখোশ পরে নিজেদের অপকর্ম লুকিয়ে রাখতে সফল ।অপরাজনীতি , অবৈধ অর্থে গড়ে তোলা বিপুল বৈভব, প্রভাব প্রতিপত্তি  সমাজে এই ঘাতকদের  সুরক্ষা দিয়েছে।  

এই  রূঢ় বাস্তবতায় সংহতি উত্‍সব অনন্য এক সম্প্রীতির উদ্যোগ এবং প্রকাশ। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে ২১ বছর আগে এই অসাধারণ সংহতি  উৎসবের উদ্যোগ নিয়েছিলেন  যে  মানবতাবাদী তরুণ সুধন দাস; মানবপ্রেম তার পাথেয় । এ মহান উৎসব এবং এই মানবতাবাদী উদ্যোক্তার কথা জানলাম  আগরতলার খ্যাতিমান কবি সমরজিৎ সিনহার থেকে । 

 আমার বিশ্বাস , আমাদের দেশের  প্রতিটি   মসজিদ , মাজার আর মন্দির  সহ প্রাচীন স্থাপনা ঘিরে এমন সংহতি উৎসব পালিত হলে হেরিটেজ সুরক্ষা  করার পাশাপাশি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সুদৃঢ় করা সম্ভব হবে।  একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পর্যন্ত এ দেশে সংখ্যালঘু এবং প্রগতিশীল মানুষদের অনেকেই  আক্রান্ত হয়েছেন । এর মধ্যে হত্যা , নির্যাতন ,অগ্নিসংযোগ-কিছুই বাকি নেই। এখন শুরু হয়েছে  একেবারে সাধারণ পথচারী -কর্মজীবি , দিনমজুর , শিশু কিশোর,নারী নির্বিশেষে জীবন্ত দগ্ধ করে দেয়া। রক্তের এই হোলিখেলায় মত্ত মাতাল জামাত বিএনপি ক্ষমতার লোভে  দিশেহারা হয়ে জিম্মি করেছে সাধারণ জনগণ কে। 

ধর্ম-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সব ধরণের  হত্যাযজ্ঞ,  অপতৎপরতা আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সাম্য আর ঐক্যের বন্ধনে এক হতে হবে এই জনপদের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষকে। ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় করতে এগিয়ে আসতে হবে ভাই বোনদের , নতুন প্রজন্মের সন্তানদের।  মুসলিম অধ্যূষিত এদেশের মাটিতেও  চিরকালের মতো  'রাম রহিম  না জুদা করো' শ্লোগানে  আগরতলার সুধন দাসের দোসর কোন ভাই রহিম বা অন্য কেউ  সোচ্চার হয়ে , উদ্যোগী হবেন -এমন প্রত্যাশা সত্য হবে কবে? 

sumikhan29bdj@gmail.com

1 comment: