Friday, December 6, 2013

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা এবং তার চ্যালেঞ্জ : সুমি খান

সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে।

এ ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ;মুখ্য হলো সম্প্রদায়।ধর্মনিষ্ঠার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার বিচারের।
সাম্প্রদায়িকতার যোগ সম্পদায়ের সাথে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব বেশি। এ ছাড়া সত্যিকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী। পরকালেই তার সত্যিকার পুরস্কারের আশা। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ইহলোকে।
 ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠ নির্লোভ মন,  সততা এবং নিষ্ঠা।  ধর্ম শান্তির বার্তা বয়ে নেয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ এবং বিবর্তনের ধারায় মানবসমাজের প্রয়োজনেই ধর্মের প্রবর্তন।
 যুগে যুগে কালে কালে  সমাজ বিবর্তনের ধারায় ভিন্ন ভিন্ন সমাজকাঠামোতে  মানুষের পরিবর্তন হয়েছে ।প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সৃষ্টিশীল চিন্তাশীল মানবতাবাদী মানুষ একাত্ম হয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায়। অন্যদিকে মুনাফালোভী এবং ধর্মের লেবাসধারীরা এক হয়েছে দুর্বলের পীড়নে । যাতে তাদের গোষ্ঠীগত এবং সমষ্টিগত ভাবে বাস্তুভিটেছাড়া , ধর্মচ্যূত, সমাজচ্যূত করে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করা যায়।
 প্রসিদ্ধ সমাজতাত্বিক ও অর্থনীতিবিদ গুনার মির্ডাল তার 'এশিয়ান ড্রামা' গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে এক বিরাট নাটক সংঘটিত হচ্ছে। এই নাটকের মূল বিষয় এই অঞ্চলের মানুষের আশা- আকাঙ্খা ও ব্যর্থতা। মির্ডাল এর মতে,এই ব্যর্থতার ফলে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে যে নাটকীয় সংঘাত রূপ পরিগ্রহ করছে , তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়তো ট্র্যাজিক হবে, যদি না এসব দেশের নেতৃবৃন্দ প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেন, দেশ কে সঠিক পথে চালিত করতে পারেন। অন্তত একটি দেশের ক্ষেত্র তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে, সে দেশের অসংখ্য জনগণের ভাগ্যে নেমে এসেছে বিরাট দু:খ দুর্দশা। সে দেশটি হলো পাকিস্তান।
সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন তার 'বাংলাদেশ-সংগ্রামের সামাজিক পটভূমি' প্রবন্ধে  এ কথা গুলো তুলে ধরে লিখেছেন, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হয়েছিলো এবং এই শ্রেণী সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুসলমান কৃষকরাও ভেবেছিলেন
পাকিস্তানে তারা শোষণমুক্ত হবেন।কিন্তু ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি-তত্বের ভিত্তিতে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে তারা দেখতে পেলেন এক প্রভুর বদলে তাদের কাঁধে আরেক প্রভু চেপে বসেছে।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হবার পর পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণী প্রথম অনুভব করেন যে, পূর্ববঙ্গের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তান তথা কেন্দ্রের আচরণ ঔপনিবেশিক সুলভ । এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ১৯৪৮ সালেই বেড়ে ভাষা আন্দোলনে  তা চুড়ান্ত রূপ নেয়। তারা ক্ষমতার জোরে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গের ভাষার মূলে আঘাত করে তার  কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য ধ্বংস করে পশ্চিম পাকিস্তানী সংস্কৃতির ছত্রছায়ায় নিয়ে আসা।  তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, ''বাংলা হিন্দু দের ভাষা। হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থের প্রেরণায় ও হিন্দু লেখকদের দ্বারা এই ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে , সুতরাং এই ভাষা পরিত্যাজ্য। উর্দু মুসলমান ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এবং মুসলমান লেখক দের দ্বারা পরিপুষ্ট। সুতরাং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। " ঊর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার এ প্রচেষ্টার পেছনে পশ্চিমা শাসকচক্রের যে অভিসন্ধি সক্রিয় ছিল , বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরা  সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরা এর উত্তরে জানান, ধর্মীয় কারণে যদি রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে আরবী কেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধে লিখেন, " বাংলাদেশের কোর্ট ও বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ঊর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে , ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার ই নামান্তর হইবে। ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশ সমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহন রূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে ঊর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন , আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকারের নীতি বিগর্হিত ও বটে।"
ঊর্দু নিয়ে এখনো পাঞ্জাবের সাথে পাকিস্তানের কেন্দ্রের চরম দ্বন্দ্ব। পাঞ্জাবের জনগণ পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলতে চান, তারা ঊর্দু ভাষার ঘোর বিরোধী। তাদের ভাষ্য, " আমরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলবো। আরবী অথবা ঊর্দু- কোনটিতেই নয়।  বিশ্বখ্যাত পাঞ্জাবী সাংবাদিক তারিক ফাতাহ্ প্রশ্ন রাখেন, "ইসলামের ভাষা আরবী কে বলেছে? কোথায় লেখা আছে? ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান , বাংলা অথবা অন্য কোন ভাষা নয় কেন?" তিনি বলেন, , ইতিহাস প্রমাণ করেছে ,ধর্মের ভিত্তিতে এভাবে মানুষে মানুষে বিভেদ -বৈষম্য নিপীড়কের শোষণের হাতিয়ার।
এই বাস্তবতায় সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে শোষণ রুখে দাঁড়াতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম। কারণ, গণমাধ্যম সমাজের দর্পন।
আমাদের সমাজে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বরাবর ই রাষ্ট্রের প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে। তার ই পরিণতি তে এদেশে এথনিং ক্লিনজিং বা সংখ্যালঘু নিশ্চিহ্ন করণ প্রক্রিয়া  চরম সফল হয়েছে বারবার।
এ প্রসঙ্গে এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসের একটি  ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরছি।

 গত ২৯ মার্চ, এক অনুষ্ঠানে  মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান  একটি ভয়ংকর কথা বলেছেন। তার আশংকা,  আগামী ২০ বছরের মধ্যে  আমাদের দেশে কোন হিন্দু থাকবে না। তিনি বলেছেন, "হিন্দুদের অভয় দেয়ার ক্ষেত্রে, স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।"
 সারাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি আশংকা  করে বলেন, "আমার কাছে তথ্য আছে, তা থেকে বলছি, ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সহিংসার ঘটনা ঘটবে।"
ফিরে দেখা যাক ইতিহাসের দিকে। ১৯৩১ সালে এ ভূখণ্ডে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা হয় ২২ শতাংশ। ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে  অবিভক্ত ভারত  ভাগ হয়ে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান হলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা হলো।  এ কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেক  হিন্দু জনগণ ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা প্রভৃতি রাজ্য, এমনকি দণ্ডকারণ্যে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে।পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে কমসংখ্যক লোকজন এ দেশে এসেছে। এর প্রধান কারণ, ‘বাঙাল’দের সম্পর্কে তাদের ধারণা ভালো ছিল না এবং অনেকে বাংলা ভাষাও বুঝতো না।
সাম্প্রতিক সময়ে  পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে তাদের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ, যা ১৯৪৭-এ ছিল মাত্র ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশের গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে কোলকাতায় অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে। একই সাথে বিশ্বজুড়ে কট্টর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড অনুসারী জামায়াতে ইসলামী কোলকাতায় প্রতিবাদী সমাবেশ  করে বলেছে, ‘বাংলাদেশে শাহবাগীরা ইসলামের অবমাননা করছে।’ বিহারি-মুসলমান এ দেশে অনেক এসেছে এবং ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, চট্টগ্রামের পাহাড়তলি, সৈয়দপুর, খুলনার খালিশপুরসহ অনেক স্থানে তারা দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে।
১৯৭১ সালে এই বিহারীদের অনেকে দলবদ্ধভাবে বাঙালি হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে। সাথে ছিলো তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর - আল-শামস্ বাহিনী । ১৯৬৪ সালে তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান (মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত) সুপরিকল্পিতভাবে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা করেছিলেন।
 কিছুসংখ্যক পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস অফিসার আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের ক্ষমতা ব্যবহার করে এক কৌশলী আইন প্রণয়ন করে হিন্দুদের সম্পত্তি গ্রাসের সুযোগ উদ্ভাবন করেন। ১৯৬৫ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা করেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। এর পর পূর্ব পাকিস্তানে জারি হয় 'শত্রু-সম্পত্তি আইন'। সেনা অফিসাররা কৌশলে এসবের মালিক হন এবং রাজনীতিকদের ভূস্বামী হওয়ার সুযোগ করে দেন। সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক, তহশিলদাররা নব্যজমিদার হন।
ড. আবুল বারাকাতের গবেষণালব্ধ একটি বই (ডিপ্রাইভেশন অব হিন্দু মাইনোরিটি ইন বাংলাদেশ) এসব ঘটনার একটি ঐতিহাসিক দলিল। গবেষণায় দেখা যায়, হিন্দুরা ২৬ লাখ একর ভূ-সম্পত্তি হারিয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু 'শত্রু-সম্পত্তি আইন 'কে 'অর্পিত সম্পত্তি আইন ' বলে ঘোষণা দেন এবং এবার তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব অর্পিত সম্পত্তি বাংলাদেশে বসবাসকারী তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিলিবণ্টনের জন্যে 'অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন' করেন।

১৯৬১ (১৯.৫ শতাংশ) ও ১৯৭১ ( ১৪.৫ শতাংশ) সালের মধ্যে ৫ শতাংশ হিন্দু দেশত্যাগ করে। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মতো মহান নেতারা যদি ‘বাঙ্গালি র“খিয়া দাঁড়াও’ বলে ৬০-এর দশকে প্রতিরোধ এবং প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ না করতেন, তাহলে ১৯৭০ সালেই হিন্দুদের সংখ্যা ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসত।
বর্তমানে ২০১১ সালে জনসংখ্যা ও গৃহগণনা থেকে দেখা যায়, দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫.৮৪ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১ কোটি ৩৫ লাখ হিন্দু। অথচ ১৯৭৪ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ। অর্থাৎ গত ৩৯ বছরে হিন্দু জনগণের সংখ্যা বাড়েনি, বরং কমেছে। অথচ পরিসংখ্যানবিদদের হিসাব হচ্ছে , এখন বাংলাদেশে কমপক্ষে তিন কোটি হিন্দু জনগোষ্ঠী থাকার কথা। যখন বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি হিন্দু বসবাস করে।
১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ (প্রায় ৪২ লাখ) হিন্দু জনগোষ্ঠী এ দেশ থেকে চলে যায়। এর প্রধান কারণ বাবরি মসজিদ ইস্যুতে সরকার হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙায় উৎসাহ দিয়েছে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর আগৈলঝাড়া, রামশীলসহ সমগ্র বাংলাদেশে তাণ্ডব চালানো হয়েছে।
  সম্প্রতি  সাবেক এক উপদেষ্টা তার একটি প্রবন্ধে হিন্দুদের উপর হামলার প্রতিবাদ করে বলেছেন, হিন্দুরা কেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গেল যে তারা ১৯৭১ সালে দেশছাড়া, ঘরছাড়া, পিতা-মাতা ও সন্তানহারা হয়েছে। কেন বলতে গেল, স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে প্রায় ২৩ লাখ ছিল হিন্দু। কেন বলতে গেল, তাদের মা-বোনেরা নির্যাতিত হয়েছে নির্মমভাবে। কেন চিহ্নিত করল, অধ্যক্ষ নতুন বাবুকে কে বা কারা গুলি করেছে। কেন মধুসূদন ঘরামি সাক্ষ্য দিতে গেল, তার স্ত্রী সম্ভ্রম হারিয়েছে। সবই তাদের অপরাধ। এ যেন এমন এক পরি¯ি’তি, যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক (বিমান দুর্ঘটনায় নিহত) কালাত প্রদেশে বসবাসরত কয়েক লাখ হিন্দুকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন অতি অল্প সময়ে পরিকল্পিতভাবে। পরিণতি কী হল? জিয়াউল হকের পুরো দেহ আগুনে পুড়ে ছাই হল মহাকাশে। অহংকারী, অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণদের এই হচ্ছে পরিণতি।
সাম্প্রদায়িকতার এ চ্যালেঞ্জ গুলো কে মোকাবেলা করতে হলে  গোষ্ঠী চিন্তার উর্ধে উঠে পেশাদারী মন নিয়ে গণমাধ্যম কে অনেক বেশী স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ হতে হবে।
 কারণ, বাংলাদেশের এ ভূখণ্ডে শত-সহস্র বছর ধরে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী, বহু ভাষাভাষী, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণে বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গে বসবাস করে আসছে। তাই এ ভাষার চারণ কবিরা গান ধরেছিলেন, ‘প্রীতি প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে/স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়েঘরে।’ বাঙালির হƒদয় ও আচরণে, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তাই ভব্যতা প্রাধান্য পেয়েছে, আতিথেয়তা সংস্কৃতির অংশ হয়েছে। উৎসবে, অনুষ্ঠানে, বৈশাখী মেলায় ও বিভিন্ন পার্বণে সব দেশবাসীর মিলন ঘটে একই অঙ্গনে। কুশলবিনিময়, সুখ-দুঃখের আলোচনা করে মেয়েরা প্রকাশ্যে, রসিকতা ও রঙ্গ-তামাশার মাঝে। তারা মনে করে, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ এ ধরনের ভাবনা বিশ্বে বিরল। অথচ এ ঐকান্তিকতার গভীর অনুভূতিকে বিনষ্ট করছে কিছু লোক অন্যায়ভাবে। সরকার সেখানে নীরব দর্শক।
বিষয়-সম্পত্তির লোভে, দুর্বৃত্তায়নের নির্মম লালসায় এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার বাসনায় একশ্রেণীর অমানুষ বাঙালির সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করেই চলছে এবং তাতে ইন্ধন দিচ্ছে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত লোভ-লালসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত কিছু দলীয় নেতা এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ প্রতিপালনের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করুন এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ও চেতনার বিকাশে কিছু অবদান রাখুন। মন্দির ভাঙার যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা জরুরী। অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।‘সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রণালয়’ গঠনের কথাও ভাবতে পারে সরকার। তা গঠন করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ সরকার- এমন ও মনে করেন অনেকে।
 নাহয়, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের আশংকা ই সত্য হবে।

এভাবে প্রকাশ্যে সরকারের নীরবতায় এবং সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সক্রিয় সহযোগিতায় মন্দির ভাঙা ও লুটপাটের রাজনীতি অবিরাম গতিতে চলতে থাকলে ভূমিপুত্রদের বোধহয় ২০৩৩ সাল অবধি সময় লাগবে না, তার আগেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না এ ভূখণ্ডে। হিন্দুরা এ দেশ থেকে বিতাড়িত হলে বাংলাদেশের জনগণ খুশি হবে না, কিছু দুর্বৃত্ত ছাড়া।
 গণমাধ্যম তাই সাম্প্রদায়িকতার গভীর সংকটের গোড়া নির্ধারণ এবং তা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।!
০৭ মে ২০১৩

No comments:

Post a Comment