Wednesday, October 2, 2013

এই রায়কে অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না - আবদুল গাফফার চৌধুরী


লিখতে বসেছিলাম অর্ধনোবেল জয়ী ড. ইউনূসের নবতর কা-কীর্তি নিয়ে। গত সপ্তাহে ‘চতুরঙ্গের’ লেখায় সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ (মঙ্গলবার) ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারের রায় ঘোষিত হলে খুব সকালে (লন্ডন সময়) লেখার টেবিলে লিখতে বসেই তা জানতে পারব, তা আগে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম লন্ডনের সকাল মানে ঢাকার দুপুর। সুতরাং রায় ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে সকালেই সেটা জানার কোন অসুবিধা নেই। লেখার সাবজেক্ট তাই বদলাতে হলো।
যুদ্ধাপরাধ, হত্যা, গণহত্যাসংক্রান্ত তেইশটি অভিযোগ ছিল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে। রায়ে বলা হয়েছে, তার মধ্যে নয়টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং তাঁকে মৃত্যুদন্দাদেশ দেয়া হয়েছে। এ রায়কে বেদনাক্রান্ত মনে অভিনন্দন জানাই। আমার অভিনন্দনকে বেদনাক্রান্ত আখ্যা দিলাম এ জন্য যে, এই পরিবারটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় অর্ধশতকের। আবার এ রায়কে অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না এ কারণে যে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁর পিতা ফজলুর কাদের চৌধুরীর সঙ্গে মিলে মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধগুলো করেছেন, তার বিচার ও দ- না হলে এ দেশের মাটি থেকে মানবতা শব্দটিই বিদায় নিত।
সাকা চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অসংখ্য গুরুতর অপরাধের মধ্যে কু-েশ্বরীর নূতন সিংহকে হত্যা মাত্র একটি। এ অসংখ্য অপরাধের জন্য সাকা চৌধুরী কখনও অনুতপ্ত হননি, বিবেকপীড়া অনুভব করেননি। বরং যে বঙ্গবন্ধু জেলে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ফজলুল কাদের চৌধুরীর মৃত্যু হলে তাঁর পরিবার ও পুত্রদের প্রতি সস্নেহ অভিভাবকত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে ঘাতকদের হাতে মর্র্মান্তিক মৃত্যুবরণের পর সাকা চৌধুরী সেই ঘাতক দলের সঙ্গে গিয়ে জুটেছিলেন।
তার পর গত প্রায় চার দশক ধরে রাজনীতি করার নামে তিনি যে একটার পর একটা নৃশংস কা- ঘটিয়েছেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন, আচার-আচরণে খিস্তি-খেউড়, অভব্যতা ও অশ্লীলতার পরিচয় দেখিয়েছেন, তার কোন তুলনা নেই। তিনি শুধু কর্মকান্ডে সন্ত্রাসী নন, বাক্য সন্ত্রাসীও। তাঁর জন্য এ চরম দ-াদেশের রায় শুনে তাঁর হাতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিহত অসংখ্য মানুষের পরিবার-পরিজন যে তাদের দীর্ঘকালের ঘোষিত শোক ও বেদনায় কিছুটা হলেও সান্ত¡না পাবে, তাতে সন্দেহ নেই।
এ রায়ে দেশের মানুষের সঙ্গে আমিও সুখী। ঔঁংঃরপব যধং ফড়হবÑ ন্যায়বিচার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি বেদনাসিক্ত। আমার এ পরস্পরবিরোধী মনোভাবের কারণ আমি ইতোমধ্যেই ব্যক্ত করেছি। এই পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘকালের। সাকা চৌধুরীর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। যদিও তাঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল যোজনযোজন দূরের। এই দূরত্বকে অতিক্রম করে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে।
ছাত্রজীবনে (কলকাতায়) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফজলুল কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে যদিও দুজনের রাজনীতি বিপরীতমুখী হয়েছে; কিন্তু প্রাকযৌবনে দুজনেই ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ-রাজনীতিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের যুবনেতা। সেই সূত্রে দুজনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা। তাদের এই ব্যক্তিগত সম্পর্ক ফজলুল কাদের চৌধুরী আইয়ুব খানের মন্ত্রী থাকাকালেও নষ্ট হয়নি।
আজ ভাবতেও অবাক লাগে, ’৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কোলাবরেটর এবং অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের নায়ক হিসেবে ফজলুল কাদের চৌধুরীর এবং তাঁর পুত্রের এমন চরম অধঃপতন ঘটতে পারে। চল্লিশের দশকে ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের একজন জাঁদরেল ছাত্রনেতা। মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হওয়ার আগে তিনি ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। চল্লিশের দশকের গোড়ায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ‘অন্ধকূপ হত্যার’ মিথ্যা অভিযোগে ব্রিটিশ শাসকদের নির্মিত হলওয়ে মনুমেন্ট ভাঙ্গার জন্য যখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় বিরাট শোভাযাত্রা হয়, সেই শোভাযাত্রায় যে ক’জন মুষ্টিমেয় মুসলমান ছাত্র ছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজলুল কাদের চৌধুরী। কিশোর বঙ্গবন্ধু তখন চোখের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ছিলেন।
এই ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তিনি তাঁর অত্যন্ত কঠোর ও কর্কশ স্বভাব সত্ত্বেও আমাকে কেন ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন, তা আমি জানি না। তিনি যখন আইয়ুব আমলে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং কখনও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তখনও চাটগাঁয় এলে তিনি তাঁর টাইগার্স হিলের বাসায় আমাকে আমন্ত্রণ জানাতেন। আমি শেখ মুজিব এবং তাঁর ছয় দফার সমর্থক জেনেও কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। তাঁর সুউচ্চ হিল ভবনের ছাদে তখন দেখতাম তাঁর দুই পুত্র সালাউদ্দিন ও গিয়াসউদ্দিন খেলা করছেন।
আইয়ুব মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ফজলুল কাদের চৌধুরী যখন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের সময় ঢাকায় ইস্কাটনে নয় নম্বর দিলু রোডে অবস্থান করতেন, তখন প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত হতো। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেই পতেঙ্গার একগাদা লাল মিষ্টি তরমুজ নিয়ে আসতেন আমার স্ত্রীর জন্য। বলতেন, বৌমার জন্য এনেছি। আইয়ুব সরকারের হাতে তিনি নানাভাবে হেনস্থা হয়েছেন। বিস্ময়ের কথা এই যে, আইয়ুবের পতনের পর পতিত স্বৈরাচারী কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দেন এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতির পদে বসান। তিনি ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় ফিরে এলে তাঁকে বলেছিলাম, এটা আপনি কী করলেন? ফজলুল কাদের চৌধুরী হেসে বলেছেন, ‘এখন আমি মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হয়েছি, শীঘ্রই পাকিস্তানেরও প্রেসিডেন্ট হব।’ আমার মনে হয়েছিল, তিনি রাজনৈতিক ফ্যান্টাসিতে ভুগছেন।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর মধ্যে ক্রুর এবং কোমল দুটো চরিত্রই ছিল। তাঁর পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পিতার চরিত্রের শুধু ক্রুর দিকটা পেয়েছেন, কোমল দিকটা পাননি। পিতার মধ্যে যে ক্ষীণ দেশপ্রেম ছিল, সাকা চৌধুরীর মধ্যে তাঁর কণামাত্র নেই। নিজের কথাবার্তায় তিনি বহুবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর আনুগত্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি নয়; তাঁর অনুগত্য এখনও পাকিস্তানের প্রতি। অনেকে সন্দেহ করেন, তাঁর রাজনীতির সঙ্গে ‘পাকিস্তান কানেকশন’ যুক্ত, এমনকি আইএসআইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও বিস্ময়ের কিছু নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন সময়ে যে সব মন্তব্য করেছেন, তাতে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ ছাড়াও দেশদ্রোহিতার অভিযোগেও তাঁকে বিচারে সোপর্দ করা যেত।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল কয়েকজনকেই মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছেন। একজনকে (গোলাম আযম) দিয়েছেন যাবজ্জীবন কারাদন্ড।
এই দন্ডিতেরা সকলেই ’৭১-এর ঘাতক দল জামায়াতের নেতা। এখন সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রাণদন্ডের আদেশ হওয়ায় বিএনপির একজন শীর্ষনেতা দন্ডাদেশ পেলেন। এই মামলাটির বৈশিষ্ট্য, জাতীয় সংসদের সদস্য থাকাকালেই বিএনপির এক শীর্ষনেতা যুদ্ধাপরাধে দন্ডিত হলেন এবং তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটিরও সদস্য।
এখন এই দন্ডিত নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা না দিয়ে বিএনপি যদি এই দন্ডাদেশপ্রাপ্ত নেতার সমর্থনে হরতাল ডাকে, জামায়াতকে সঙ্গী করে রাজপথে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে, তাহলে বিএনপিকেও কি যুদ্ধাপরাধীদের দল বলে গণ্য করা যাবে না? আর সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করানোর অযোগ্য, তাহলে একই ক্যাটাগরিতে কি বিএনপিও পড়ে যাবে না? অবশ্য এটা আইনগত বিষয়। আইন বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে ভাল বলতে পারবেন।
রায়টি ঘোষিত হওয়ার পর বিএনপি এখন পর্যন্ত (আমার এই লেখা যখন লিখছি) এ সম্পর্কে কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায়, ঢাকায় হরতাল ডাকা ছাড়াই রাজপথে ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো শুরু করা দেখে। চট্টগ্রামে আজ (মঙ্গলবার) হরতাল ডাকা হয়েছে। ঢাকায় বিএনপির আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের যারা আজ বিচার করছে, বাংলার মাটিতে তাদের একদিন বিচার হবেই।’ এই মন্তব্য শুধু বিচারব্যবস্থার অবমাননা নয়, বিচারপতিদেরও হুমকি দেয়ার সমতুল্য। এই ধরনের আইনজীবীদের সম্পর্কে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা, তা আইনমন্ত্রীকে বিবেচনা করতে হবে।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত দ-াদেশ নিয়ে বিএনপি যদি রাজপথে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নামে এবং তাতে জামায়াত ও শিবির যোগ দেয়, তাহলে দেশের রাজনীতির চিত্রটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। রাজনীতির মাঠে একদিকে দেখা যাবে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের শিবির। অন্যদিকে দেখা যাবে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- যারা সমর্থন করে সেই গণসমর্থিত গণতান্ত্রিক শিবির। সম্ভবত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েই বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চূড়ান্ত যুদ্ধটা হবে। এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগটা ক্রমশই কমে আসছে।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে এককালে ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলাম এবং সাকা চৌধুরীদেরও তাদের কিশোর কাল থেকে অত্যন্ত কাছ থেকে চিনি, এ জন্যই আজ সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদ-াদেশে ব্যথা অনুভব না করে পারছি না। কিন্তু তাকে দ- দেয়া ছিল মানবতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন। সুতরাং এই রায়কে মনের বেদনা সত্ত্বেও অভিনন্দন না জানিয়ে পারি না। বিএনপি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ও শাস্তি রোধ করতে পারেনি; ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-ও রোধ করতে পারবে না। মাঝখানে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন দিয়ে তারা দেশের মানুষের কাছে নিজেদের আসল চেহারা উন্মোচন করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনদানই যে দেশে যথাসময়ে একটি নির্বাচন হলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সকল খোয়াব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে এই সত্যটা তারা এখন বুঝতে পারছে না। -দৈনিক জনকন্ঠ

No comments:

Post a Comment