Wednesday, October 2, 2013

সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত চেহারা- রুখসানা কাজল


শরত মানেই পুজোর গন্ধ। আকাশ বাতাস কাশবন নদী ও মানুষ- শরত এলেই রঙিন হয়ে উঠে। আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন দুর্গা পুজো আমাদের এক করে তুলে। দূর শহর থেকে আমাদের মন চলে যায় পাড়ার ম-পে ম-পে।
আমি জানতে চাই, হ্যাঁরে এবার পুজোর থিম কি হবে রে? মেলা বসবে তো? কোন্ যাত্রা পার্টি আসছে? কি কি বই হবে জানিস কিছু? সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাইজ কিন্তু ভাল হওয়া চাই! আর গান? কলকাতার সব পুজোর গান যেন থাকে! ম-প সাজানোতে সাবেকির পাশে নতুনত্ব ও রাখিস। আর লাইট? মানে আলোকসজ্জা-দেখিস আমাদের পাড়া যেন ফার্স্ট হয়!
আমার এত এত আবেগি প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। মফস্বল শহরের সংবাদকর্মী ভাইটি উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে বসে আছে অনেকক্ষণ। ওর মুখটা লাল। মুঠোফোনের গভীর কালো রঙে ডুবতে ডুবতে খুব আবছা করে জানায়: এবার আর পুজো হচ্ছে না দিদি। চমকে উঠি! আমার ঝলমলে শরত আকাশ মুহূর্ত মাত্র শ্রাবণের ঘন মেঘে ঢাকা পড়ে গেল।
যে ছোট্ট শহরটিতে আমার জন্ম, শরত এলেই যে শহরের হিন্দু-মুসলমান-খৃীষ্টান সবাই এই দুর্গা পুজোর মহাআনন্দ উৎসবে সব কিছু ভুলে মেতে ওঠে, এবার পুজো হচ্ছে না সে শহরে। আসছেন না সিংহ আরোহিনী মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। আসছেন না লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ। আসছে না মেলা, সার্কাস, নাগরদোলা, যাত্রাগান, গরম জিলেপি, পাঁপড়ভাজা, নানা রঙের নানা ঢংয়ের মাটির পুতুল। আমি মন খারাপের ঘোলা জলে হাবুডুবু খেয়ে জানতে চাইলাম: কেন রে? এবার কেন মূর্তি গড়া হবে না? ও বিষন্ন দুটি চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল আর তখনই সেলুলয়েডের ফিতায় ভেসে উঠল দৃশ্যপট। মুহুর্মুহু নিঃশব্দতার চড় আমাকে ফেলে দিল অমার্জনীয় এক লজ্জায়। আমিও স্তব্ধ বেদনাকে সঙ্গী করে বসে থাকলাম ভাইয়ের পাশে। আমাদের কষ্ট এক, বেদনা এক- শুধু লজ্জা এসে বলে গেল- আজ থেকে দিদি মুসলিম আর তার ভাইটি হিন্দু!
এমন নয় যে, আমরা এর আগেও এ রকম পরিস্থিতিতে পড়িনি। পড়েছি। ইতিহাস সাক্ষী। কিন্তু বার বার কেন এমন লজ্জাজনক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় আমাদের! কেন এই লজ্জা ঢাকতে বার বার বিচ্ছিন্ন হতে হয় আমাদের? কেন স্বভূমিতে আমরা বেঁচে থাকি মুখ ঢেকে, কেন কেউ কেউ স্বভূমি ছেড়ে চলে যায় চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে? ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসরত প্রতিটি হিন্দু-মুসলিম-খৃীষ্টান-শিখ-বৌদ্ধ ধর্মের নাগরিকই কেন এই একই বেদনায় রঞ্জিত হয় বার বারÑ কখনও না কখনও?
১৯৪৭-এর ভয়াবহ দাঙ্গার স্মৃতি স্মরণে এখনও শিউরে উঠে হিন্দু মুসলিম অনেকেই। ইতিহাস খুব জটিল পথে ধায় আর রাজনীতি পা ফেলে আরও স্বার্থপর আলো আঁধারের গোলোক পথে। ’৪৭-এর দেশ ভাগ কি সাধারণ হিন্দু-মুসলিম জনগণ কখনও চেয়েছিল? কাদের স্বার্থে কেন হলো এই দেশ ভাগ? কেবলই ধর্মের জিরাফ এসে এঁকে দিল এক সীমারেখা আর আমরা ছিটকে গেলাম অখ- জন্মভূমির এ পারে, ও পারে!
দেশ ভাগ কেবল ধর্মীয় প্রভাবের ফলাফল নয়। এর পেছনে রয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক বোদ্ধা এবং প-িতদের স্বার্থপর চিন্তা ধারার এক জটিল মিথস্ক্রিয়া। হিন্দুর জন্য হিন্দু রাষ্ট্র, মুসলমানের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রÑ এই দ্বি-জাতিতত্ত্বের উদ্ভাবক এবং ধারক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মি. জিন্নাহ ব্যক্তিগত জীবনে কোন ধর্মগুরু ছিলেন না। এমন কি তিনি সরাসরি অনেক ধর্মীয় আচার-আচরণের ধারও ধারতেন না। মূলত তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাশ্চাত্য চাল-চলনে অভ্যস্ত তখনকার সমাজের একজন উঁচু তলার ব্যক্তি মাত্র। কংগ্রেসের তৎকালীন অনেক শীর্ষ নেতাও দেশ ভাগ নিয়ে আশ্চর্য নীরবতায় মৌনী ছিলেন। মূলত নেহেরু এবং জিন্নাহর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ, রাজনৈতিক অভিপ্সা, নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের অতি দাদাগিরি মনোভাব ক্রমাগত মুসলিম লীগের নেতাদের ইন্ধন ও উৎসাহ যুগিয়েছে নতুন নতুন রাজনৈতিক রণকৌশল নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পরেও জিন্নাহ স্বতন্ত্র পাকিস্তানের কথা বলেননি। ১৯৬৯ সালে শিব রাও লিখেছেন যে, ১৯৩৭-এর নির্বাচনের অল্পকাল পরেই জিন্নাহ একটি প্রকাশ্য ঘোষণায় বলেন, ‘হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে একটি সম্মানজনক বোঝাপড়া হোক’ এই বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রকাশ্যে মহাত্মা গান্ধীর কাছে সাহায্যের আবেদন রাখেন। কিন্তু গান্ধী অসহায়ের মতো হতাশার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপারগতা প্রকাশ করেন। যদিও তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বস্ত ছিলেন, কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেসের নেতৃত্বে তখন আর তার কোন প্রভাব ছিল না বললেই চলে। নেহেরুর চিন্তা, পথ, ভাষা এমনকি বাচনভঙ্গিতেও অখ- ভারত রক্ষার কোন সম্মানজনক সহিষ্ণুতাও প্রকাশ পায়নি কখনও। ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে নেহেরুর এক উগ্র মন্তব্য ভারতবর্ষের একই সূত্রে গ্রন্থিত অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসকে অভিন্ন পথের পরিবর্তে দুটি ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে দিয়েছিল। আত্মতৃপ্তি, রাজনৈতিক সাফল্য ও বিজয়, জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার স্বপ্নে অন্ধ হয়ে কংগ্রেস ভারতের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে তার আজ্ঞাবহ দল হিসেবে ভাবতে শুরু করে। নেহেরু অত্যন্ত আত্মঅহঙ্কারে বলেছিলেন, ‘ভারতে এখন কেবল দুটি শক্তি আছে : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ- কংগ্রেস যার প্রতিনিধি। পাল্টা জবাবে জিন্নাহ বলেছিলেন, না, ভারতে তৃতীয় আরও একটি শক্তি আছে- আর তা হচ্ছে মুসলমানরা।
মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস নেতাদের এই রাজনৈতিক পাশা খেলায় ভারতবর্ষের জনগণ ঘুঁটির মতো ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাণ গিয়েছে। মান গিয়েছে, জমি-জিরেত, ধন, সম্পদ গিয়েছে। আর হারিয়ে গিয়েছে কোটি মানুষের আজন্মের ঠিকানা- বদলে গেছে জননী জন্মভূমির পবিত্র মানচিত্র।
ভারতবর্ষের মাটিতে, নদীতে, আকাশে, বাতাসে, মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ। সেই বৃক্ষে ফুল হয়েছে, ফল ধরেছে, বীজ ছড়িয়ে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে। রাজনৈতিক নেতাদের চাপান-উতর রাজনীতির পাশা খেলায় ক্ষুদ্র বা বৃহৎ যে ভুলই হোক না কেন সেই ভুলের কঠিন সুদ গুনতে হয়েছে ভারতবর্ষের সাধারণ হিন্দু-মুসলমান জনগণকে। আর সেই বিষবৃক্ষের ফলে এত বিদ্বেষ যে অনাদিকালের ধর্মনিরপেক্ষতার নিরাপদ ভূমিতে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয় ঐক্যকে খ-বিখ- করে দিয়েছে নিষ্ঠুরের মতো।
দ্বি-জাতিতত্ত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বিনিময়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয় একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র- বাংলাদেশ। সংবিধানে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল স্তম্ভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করলেও মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় হত্যা করা হয় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বদলে যায় সংবিধান। বদলে যায় শাসক শ্রেণীর চরিত্র। তৈরি হয়ে যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় মৌলবাদী এক গোষ্ঠী। রাজনীতিতে সক্রিয় এই শ্রেণী বাঙালীর সংস্কৃতির স্থানে প্রচলন ঘটাতে চায় আরবীয় সংস্কৃতি। বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে এরা বদ্ধপরিকর। তাই মাঝে মাঝেই ঘটে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সংখ্যালঘুর ঘর পুড়ছে, প্রাণ যাচ্ছে, লুট হয়ে যাচ্ছে মন্দির ও নারী। সেখানে পুজো হয় কি করে? কোন মেয়ে কি এ রকম বিপন্ন বাবা মায়ের ঘরে বেড়াতে আসে সন্তানদের নিয়ে?
তাই এবার আর পুজো হবে না। সপ্তমী অষ্টমী নবমী জুড়ে দল বেঁধে আমাদের মতো মানুষদের ম-পে ম-পে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখা হবে না আর। দশমীর দুপুর থেকেই বিসর্জনের বেদনা এসে ছুঁয়ে দেবে না সব ধর্মের মায়েদের মন। পুজো মানেই তো ছুটি। বাবা মায়ের কাছে ক’দিনের জন্য বিবাহিত মেয়ের বেড়াতে আসা। সংসার জটিলতার ফাঁকে ভাবনাহীন নিটোল কয়েকটি দিন। কি চমৎকার একটি পারিবারিক মিলনের গল্প! অথচ সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত রঙে এমন মধুর একটি গল্পে আমরা কালি দিয়ে দিলাম!
কি আছে আমাদের সামনে?

No comments:

Post a Comment