Monday, March 17, 2014

যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান!- সুমি খান

 ‘...এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান?


যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান!


তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-


চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি!


/যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান-ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ


১৭ মার্চ – বিশ্বজয়ী কিংবদন্তী  রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৫ তম জন্মদিবস! রাষ্ট্রীয় নিয়মে দিনটি  শিশু দিবস। কিন্তু অনেক শিশুই জানেনা  দিনটির কথা। ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলোতে তো নয়ই, বাংলা মাধ্যম স্কুলে ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন আলোচনা দেখা যায় না। শিশুরা জানতেই পারে না , কার কারণে তারা বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে । 


 ২০০ বছরের ব্রিটিশ আর পাকিস্তান অপশাসনের গ্লানি মুছে বাঙ্গালীর আত্মপরিচয় ফিরে পাবার জন্যে যে মানুষটি কৈশোর থেকে সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন- তাঁর  প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তাঁর জন্মের  এ শুভক্ষণটি গৌরবের সাথে পালনে আমাদের দীনতার শেষ নেই!


 আমরা ভুলে যাই, বা ইচ্ছে করেই ভুলে থাকি  বিশ্ব মানচিত্রে গর্বের সাথে ঠাঁই করে নেয়া ‘বাংলাদেশ ‘ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সম্পর্কে আমাদের অনেক জানার আছে।  শেকড়ের খোঁজে যেতেই হবে একদিন। তাই আমাদের প্রজন্মান্তরে সত্য ইতিহাস তুলে ধরা জরুরী!


বঙ্গবন্ধুর  রাজনীতি ছিল দেশমাতৃকা আর মানবতার কল্যাণে !! বর্তমান রাজনীতিকেরা নিজেদের যে পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন –তারা কখনো বিবেচনা করেন না- বঙ্গবন্ধু র জীবন এবং কর্মযজ্ঞ তাদের আদর্শের ভিত ।


সেই বিবেচনা বোধ নেই বলেই আজ নগরে বন্দরে রাজপথ আর গলিপথ নেতা কর্মীদের বিশাল বিশাল সব ছবির বিলবোর্ডে সয়লাব। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার জন্মদিনে কেক কেটে পত্রিকা বা ফেসবুকে ছবি প্রচারের চেয়ে  তার যোগ্য অনুসারী হলে তাদের জীবনধারায় বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনস্কতা প্রতিষ্ঠা অনেক জরুরী।  


 গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে  মাদারীপুর দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার শেখ লুত্‍ফর রহমান আর মা মোসাম্মৎ সায়েরা বেগমের ঘরে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ  জন্ম নেন  তাদের প্রথম পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান  ।  ৪ বোন ২ ভাইয়ের মাঝে তৃতীয় মুজিবকে বাবা-মা বোনেরা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’৷ ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে গমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ।এরপর ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ।১০ বছর বয়সে বাবার কাছে মাদারীপুরে যান৷ সেখানকার মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। মাদারীপুরে থাকার সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। তার চোখে ছানি পড়ে ।  শেখ লুত্‍ফর রহমান কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত চক্ষু চিকিত্‍সক ডা. টি আহমদের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করান মুজিবরের । এর পর থেকে সেই কৈশোরেই চোখে চশমা পরতে হয় মুজিবের। এরপর গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন ।এরপর ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । সেখানে সফল অস্ত্রোপচারের পর তিনি সুস্থ হলেও ডাক্তারের পরামর্শে তখন থেকেই চশমা পরতে শুরু করেন।


১৯৪০ সালে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে আসেন৷ পরিদর্শন কাজ শেষে বাংলোতে ফেরার পথে এক ছাত্র তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায়৷ অকপটে বলে যায়, ছাত্রাবাসের ছাদ চুঁইয়ে পড়া পানিতে বর্ষাকালে ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হবার ভোগান্তির কথা৷ তা মেরামতের দাবি জানায় সে৷ প্রধানমন্ত্রী তত্‍ক্ষণাৎ তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে বারোশ’ টাকা মঞ্জুর করেন এবং ছাত্রাবাসটি মেরামত করার নির্দেশ দেন । সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির সত্‍সাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হন।  পিয়ন মারফত স্লিপ পাঠিয়ে বাংলোতে এনে  আলাপ করে মুগ্ধ হন। এই ছেলেটিই পরবর্তীকালের অগ্রপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু  সোহরাওয়ার্দীকে ‘রাজনৈতিক গুরু’ বলে স্বীকার করতেন । শেরেবাংলা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নাতি’ বলে সম্বোধন করতেন।


কিশোর মুজিবের ২ ঘন্টার কারাবাস


নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন মিশন স্কুলে ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা ছিল।  ১৪৪ ধারা জারি করে সেই সভা বন্ধ করে দেন এসডিও । ছাত্ররা সমবেত হয়ে মসজিদে গিয়ে  সেই সভা করে৷ শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সেকেন্ড কোর্টে হাজির করে দু’ঘন্টা আটক করে রাখা হয় মুজিবকে ।  মুজিবের মুক্তির দাবিতে অন্যান্য ছাত্রদের বিক্ষোভ ও চাপে শেষ পর্যন্ত মুজিব কে মুক্তি দেবার নির্দেশ দেন আদালত । মুজিবের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে এই ছিল প্রথম গ্রেফতার ।


১৯৩৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে  শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সাথে৷ পরবর্তীকালে এ দম্পতি ৩ পুত্র ও ২ কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।


১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে(বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ)আইএ ক্লাসে ভর্তি হন৷ তখন থেকেই মুসলিম লীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি৷ শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন । ইসলামিয়া কলেজ থেকে ।১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন মুজিব। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের কর্মী ।


১৯৪৩ সালে মুজিব সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-হাসিম গ্রুপের সাথে তিনি  সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন । ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্ব দেয়।


১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট  পাকিস্তান ও  ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ।  ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন । বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।  এই কারণে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ এরপর তাকে  গ্রেফতার করা হয়। তাঁর  আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবন সমাপ্ত  করা হয় না।


১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি  কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব৷


১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলীম লীগ” গঠিত হয়। একজন রাজবন্দী হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন৷ কারাবন্দি থেকেই শেখ মুজিব অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।


 ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।


 অক্টোবরে আর্মানিটোলা থেকে এক বিশাল ভুখামিছিল থেকে আবার  গ্রেফতার হলেন মুজিব। সাথে  মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক সহ অন্যেরা।


১৯৫২ সালে মুজিব কারাবন্দী।ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ উত্তাল।  ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনটিকে ‘ভাষা দিবস’  ঘোষণা করা হয়।


 মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্রনেতারা  গভীর রাতে  ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন । শেখ মুজিব কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন।




২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর শহীদ হন। কারাগারের ভেতর একটানা অনশনে মুজিবের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হয় । পাকিস্তান আমলে রাজবন্দীদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কারা কর্মকর্তাদের কঠিন সাজা হতো। শেখ মুজিবের শারীরিক অবনতি ঠেকাতে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ কারা কর্তৃপক্ষ  মুক্তি দেয় । মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে আওয়ামী মুসলিম লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন ।


১৯৫২ সালে মহাচীনের রাজধানী বেইজিং নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব।  ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন।


দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিপরিষদ (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন মুজিব।  তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । মুজিব ছিলেন দক্ষ সংগঠক।  শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো শেখ মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব  গভীর ভাবে অনুধাবন করতেন।  ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সাহসী পদক্ষেপ নেন মুজিব। সোহরাওয়াদী তখনও রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না এবং এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে সকলের কাজের পক্ষে ছিলেন।


 এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শেখ মুজিব  ১৯৬৩ সালে এনডিএফ ত্যাগের ঘোষণা দেন।  ২৫ জানুয়ারি, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সেই সভায় মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।  


১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন । প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ।


 ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।  ১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে  ৮ বার গ্রেফতার হন  জননেতা শেখ মুজিব।


এ সময় রাজনীতির মাঠ ভীষণ উত্তপ্ত । বাঙালির জন্যে নতুন আশার সঞ্চার করে ৬ দফা।  ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেসনোটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়৷ এর আগের ২০ মাস জেলে আটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু ৷১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি সমাপ্ত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ মামলার অন্যতম প্রধান আইনজীবী ছিলেন।একই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।


এ সময় ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে ঢাকাসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে৷ পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, কারফিউ, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারায় দেশ অস্থির হয়ে ওঠে৷ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ।


পাকিস্তান সরকার সরকার শেখ মুজিবকে  ‘প্যারোলে’ মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন ।শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা মুক্তি লাভ করেন।


১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ নিরঙ্কুশ এ বিজয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ১৯৯টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন  ।পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর যে দাবি ভূট্টো করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এ ধরণের অন্যায় এবং অবাস্তব প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে তা প্রত্যাখ্যান করেন।


১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ‘বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১লা মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রতিবাদে ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয় ।দেশজুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।


আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ৷ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে । সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়৷।এই সেই দিন, যেদিন তিনি সেই  ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাতে ছিল দিক নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা। ভায়েরা আমার,



আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো।


তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।


আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।


কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।


টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।


ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।


গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!!

এরই মাঝে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন। আলোচনার ছল করেন, যা ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে।আলোচনা অসমাপ্ত রেখে গোপনে ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।

ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরীহ জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করে৷ নিরীহ বাঙ্গালী জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে গণহত্যার মতো বর্বরতম ঘটনা ঘটায়।


২৫ মার্চ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চীফ মারফত খবর পান ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তিনি দলীয় হাই কমান্ড ও অন্য নেতাদের আত্মগোপনে যাবার নির্দেশ দেন। নিজে রয়ে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে৷ ২৫ মার্চ রাতের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়৷ প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং পরে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হয়৷


 বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাইকমান্ড তাজউদ্দিন আহমেদ গোপনে ভারতে চলে যান৷ সেখানে অন্যান্য নেতাদের সহযোগিতায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।  ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথতলার আম্রকাননে সরকার শপথ গ্রহণ করে।প্রবাসী এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে৷ অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে ।১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়৷ যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, প্রতীক্ষা।


স্বাধীন দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকার তাদের কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ তিনি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসেন৷ এদিন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর শিরোনাম ছিল “ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে।” দৈনিক পূর্বদেশের  শিরোনাম ছিল, “ভেঙ্গেছো দুয়ার, এসেছো জ্যোতির্ময়, তোমারি হোক্ জয়!! ”


আবারও রেসকোর্স ময়দানে এসে দাঁড়ান  শেখ মুজিব। লাখো মানুষ আনন্দাশ্রু নিয়ে জাতির জনককে বরণ করে নেয় !!


এবার তিনি হাত দেন দেশগঠনে।  মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন ।১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত প্রতিকূল এবং বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার মতো দুরূহ কাজ এগিয়ে নিলেও তাকে বাঁচতে দেয়া হয় নি।


 যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি অসংখ্য সমস্যা-সঙ্কুল, সাড়ে ৭ কোটি জনমানুষ অধ্যুষিত দেশের সমস্যা সমাধানের কাজ  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে ।আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, খাদ্য উত্‍পাদন বাড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, তাদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, অনাহারি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন যোগান এবং আরো নানামুখি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।স্বাধীনতার পরবর্তী সময়। বিপুল অস্ত্র তখনও দেশের সাধারণ মানুষের হাতে রয়ে গেছে। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশজুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ‘রক্ষী বাহিনী’ গঠন করেন। একাত্তরের ঘাতকদের ষড়যন্ত্র এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় এ  শুভ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়৷।এরই সাথে তাঁর সরকারের মাঝে অবস্থানকারী কতিপয় ক্ষমতালোভী, চাটুকার, স্বার্থলোভীর নির্লজ্জ কর্মতত্‍পরতায়,  দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।  কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করে ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ৷ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর দুঃসময়ের অনেক প্রকৃত সাথীর দূরত্ব বেড়ে যায়৷ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।


বাংলাদেশের  উন্নতি ঠেকাতে  ষড়যন্ত্র সফলে  প্রাণপণে নেমে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি।  নেতৃত্বে থাকে এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক ও সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য৷ এ সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর একটি অংশের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা  জানান।


এর জবাবে  বঙ্গবন্ধু  বলতেন-‘এরা আমার সন্তান, আমাকে কেউ কিছু করবে না।’ তাঁর স্বভাবসুলভ উদারতা তাঁর বিপদ ডেকে আনে ৷ তাঁর কাছে  ষড়যন্ত্রকারীদের নামে কোন গোয়েন্দা তথ্য পৌঁছানোর আগেই গায়েব করে দেয়া হতো।


১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল৷ রাতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কর্মকর্তা ও সেনারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঘেরাও করে ভেতরে প্রবেশ করে। নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁর ৩ পুত্র, ২ পুত্রবধু, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনসহ ১৭ জনকে ! পরদিন তাঁর মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া নেওয়া হয় এবং কোনরকম জানাজা না পড়িয়ে জাতির পিতাকে  তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়৷ একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ মদদে এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়৷ ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ বাঙালি জাতি স্তম্ভিত- দিশেহারা হয়ে যায়৷   এ দেশের কুলাঙ্গার সন্তানদের হত্যার শিকার হয়েছেন জাতির জনক- এই পবিত্র মাটি অপবিত্র হয় জনকের পবিত্র রক্তে!!  এর চেয়ে লজ্জার , হতাশার কোন উদাহরণ বিশ্বে নেই ! !!


তবু সময় প্রমাণ করেছে  বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ দেহ, সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট, পেছনে আঁচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ-  তবে সেই পাইপ থেকে এড়িনমোরর’স তামাকের সুবাস নেই  - তার নির্দেশনা পাচ্ছে না দুর্ভাগা এ জাতি! তাই এই জাতি আজো বিভ্রান্ত- দিশেহারা!


প্রশ্ন আসে কারা ছিল জাতির পিতার হত্যাকারী?


বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি লে· কর্নেল (অবঃ) খন্দকার আবদুর রশিদ  এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং কর্নেল (অবঃ) তাহের বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের গ্রামীণফোন তৃতীয় মাত্রায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক জিলুর রহমান বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি কর্নেল (অবঃ) রশিদের একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। চ্যানেল আইয়ের সাথে উক্ত সাক্ষাতকারের বিস্তারিত-  জিলুর রহমান জানিয়েছেন, টানা পাঁচদিনে তিনি এ সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন। তবে পুরো সাক্ষাতকার প্রচারিত হয় নি।


এই সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধ, ভারত সম্পর্কে তার মনোভাব, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে বিতর্ক এমনকি জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে অকপটে খোলামেলা কথা বলেছেন কর্নেল (অবঃ) রশিদ। সাক্ষাতকারের কিছু বক্তব্য চ্যানেল আই সংবাদে প্রচারিত হলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সাক্ষাতকারে কর্নেল (অবঃ) রশিদ বলেন,  “ ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে তৎকালীন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে ডেকে পাঠান। সেখানে কর্নেল তাহেরও ছিলেন। ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল (অব·) রশিদ অকপটে বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন শেখ মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকার জন্য তাকে সম্মানিত করা উচিত। কেউ কেউ জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বললেও তিনি তা বলতে নারাজ। তিনি মনে করেন, রেডিওতে জিয়ার এক মিনিটের বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতে চলে যায় তাদের মনোবল শক্ত করতে সাহস যোগায়। তার মানে এই নয়, তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। সে সময় শফিউল্লাহ সহ জিয়ার অনেক সিনিয়র আর্মি অফিসারও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে ফেরারি জীবন-যাপন প্রসঙ্গে কর্নেল (অব·) রশিদ বলেন, ব্যক্তিস্বার্থে তিনি কিছু করেননি। তার বিশ্বাস মুসলমান হিসেবে সবকিছুর জন্য তিনি আলাহর কাছে দায়ী।


তিনি জানান, ১৯৪৬ সালের ৬ ডিসেম্বর কুমিলার চান্দিনা থানায় তার জন্ম। শৈশবে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে বিয়ে করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্নেল (অব·) ফারুক সম্পর্কে তার ভায়রা। ১৯৭৩ সালে তার শ্যালিকাকে ফারুক বিয়ে করেন। তার বাসভবনেই দু’জনের পরিচয় ও মন দেয়া-নেয়ার পর দু’পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে কর্নেল (অব·) রশিদ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কর্নেল (অব·) ফারুক তখন ডেপুটেশনে আবুধাবিতে ছিলেন। তিনি যোগ দেন ১২ ডিসেম্বর।


তার মতে, পরিস্থিতি যেদিকে গড়িয়েছিল তাতে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব মেজরিটি অর্জনের পর যখন পাকিস্তান  ক্ষমতা হস্তান্তর করল না তখন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে জনগণ ব্যাপক অংশগ্রহণ করে। শেখ মুজিব যতটুকু যাওয়ার ততটুকুই গেছেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব পরিস্কার বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৭ মার্চের ভাষণ তিনি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে শুনেছেন। তিনি জনগণের আকাঙ্খা দেখে বুঝতে পেরেছেন, জনগণ প্রস্তুত। ৭ মার্চের ভাষণের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে পূর্ব পাকিস্তানি পিআর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়।তিনি জানান, ওই সময় সেনাবাহিনীতে কনফেডারেশন নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতো। তিনিও মনে করতেন, কনফেডারেশন হলে মুসলমান দেশটির জন্য ভালো হয়। কর্নেল অলিসহ কেউ কেউ মনে করেন, ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৭ এপ্রিল সামরিক যুদ্ধ ছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল না। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা এভাবে কথা বলেন সেটা আত্মপ্রচার ছাড়া কিছু নয়। তাদের দাবির কোন সত্যতা নেই।


কর্নেল রশিদ বলেন, যদি সার্ভিস হোল্ডার হিসেবে যুদ্ধের কথা বলেন তাহলে সেটা যুদ্ধ হয় না। সামরিক বাহিনীর ভেতর বিদ্রোহ হয়। কর্নেল অলি যদি মনে করেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল না সেটা হবে তার ভুল ধারণা। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা তখনই হল, যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। ৭ মার্চের পর মুজিবকে আটক করা পর্যন্ত পাক আর্মি আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে লড়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ জিয়া দেননি, মুজিব দিয়েছেন। এসব বিবেচনা করলে, যারা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে চায় তাদের বক্তব্য ঠিক নয়। শেখ মুজিবের যা পাওনা তা তাকে দেয়া উচিত। জিয়াকেও তার প্রাপ্য দেয়া উচিত।


কুমিলায় বাড়ি হলেও এবং নামের পদবি খন্দকার হলেও খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তার কোন আত্মীয়তা নেই বলে জানান কর্নেল (অব·) রশিদ। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ হওয়া উচিত ছিল কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতের জন্য তখন অবশ্যই একটা সুযোগ এসেছিল এবং তা তারা নেবেই। পাক-ভারত যুদ্ধ বহুবার হয়েছে এবং ফাইনাল রেজাল্ট ছাড়াই শেষ হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই অনেকে ভারত চলে যায়। প্যারা-মিলিটারিতে যোগ দেয় এবং তারা সরকার গঠন করে। যে সরকার গঠন হয়, অবশ্যই জিয়া তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। সবাই পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ায় তাদের থাকা-খাওয়া সবই ভারতের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  এতো গুলো মানুষের বোঝা  সীমাহীন সময় ধরে বহনের অর্থনৈতিক ক্ষমতা  কোন রাষ্ট্রের থাকে না। এ কারণে তারা জেতার আগ্রহ নিয়ে কাজ করে। তিনি একাত্তরে ভারতের সহযোগিতার জন্য ভারতকে  ধন্যবাদ জানান। তবে  একাত্তরে পাক আর্মির রেখে যাওয়া অনেক জিনিস ভারত নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে বা রাজনৈতিকভাবে মানুষ মাত্রই ভুল করে। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে যদি কেউ আবারও ইস্যু করে তা ঠিক হবে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করেন। এসব বাদ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। স্বাধীনতার পর কি জাতীয় সরকার গঠন ভালো হতো না? এই প্রশ্নের জবাবে কর্নেল (অব·) রশিদ বলেন, ’৭০-এর জয়লাভের কারণে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন সঠিক ছিল। ’৭২-এর সংবিধান ছিল গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনায় কর্নেল তাহেরের সংশিষ্টতা সম্পর্কে কর্নেল রশিদের মন্তব্যকে ‘ডাহা মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তাহেরের রাজনৈতিক ভাবধারার অনুসারী ও জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু। ৬ নভেম্বর ,২০০৭ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইনু বলেন, রশিদ ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা নিজেরাই বহুবার এ হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আটক রয়েছেন তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। আদালত তাদের বক্তব্য শুনেছেন। এ মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কখনোই কর্নেল তাহেরের সংশিষ্টতা দাবি করেননি। তিনি বলেন, যারা বিদেশে পলাতক তারাও এ ব্যাপারে গত ৩০ বছরে একটি কথাও বলেননি। এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট একটা দাবি। ইনু বলেন, আসামিরা বুঝতে পারছে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি সংকুচিত হয়ে আসছে। এ কারণেই তারা সবার মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য এসব বিভ্রান্তিমূলক কথা বলছেন। কর্নেল রশিদ তার সঙ্গে জিয়াউর রহমান ও কর্নেল (অব·) তাহেরের বৈঠক হয়েছিল বলে যে দাবি করেছেন ইনু তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের কোন আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। তবে টেলিফোনে কথাবার্তা হতো। ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment