Friday, March 21, 2014

নীতি, নৈতিকতা, বিবেকবোধ আজ বাক্সবন্দী ------ নাসরিন হক

মানুষ পরিবর্তনশীল আমরা সবাই এ কথা জানি। তবে প্রতিটি মানুষের কিছু নীতি থাকে। একজন সত্যিকারের মানুষ নীতির সাথে কখনই আপোষ করতে পারে না, করা যায় না। কিন্তু আজকে যারা আমাদের সমজের বড় বড় স্থানে অধিষ্ঠিত, জীবনে প্রতিষ্ঠিত তাদের নীতিহীন কর্মকান্ড দেখে তরুণ প্রজন্ম তাদের কাছে কি শিখবে! ব্যক্তি জীবনের সফলতা, সামাজিক সাফল্য আকাশচুম্বী, তারপরও তাদের অতিমাত্রায় ক্ষমতার লিপ্সা তাদেরকে করেছে বিবেকহীন, নীতিহীন। 
ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক, এদেশের একজন প্রথম সারির আইনজীবি। সফল জীবন তার। বিভিন্ন সময় আমরা দেখি সাংবাদিকেরা তার কাছে ছুটে যান রাজনৈতিক মতামতের জন্যে। তিনি তার সুবিধামত মতামতও ব্যক্ত করেন। কাল যা বলেন আজকের বলার সাথে দেখা যায় সম্পূর্ন বিপরীত অবস্থান। এমনই চলছে। তারপরও তারই কাছে আমাদের ছুটে যাওয়া, মতামত নেয়া, যেহেতু তিনি বিশিষ্টজন। 
গত ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তিনি বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি, সংবিধান পেয়েছি”। 
তিনি সত্যি কথাই বলেছেন। এক সাগর রক্ত আর তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিয়ে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ, ৭২’এর সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আমরা সেই সংবিধান পেয়েছি। 
বেশ কয়েকমাস আগে ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক তারেক রহমানের কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে তারেক রহমানকে নিয়ে একটি বক্তব্য রাখেন। যে তারেক রহমান ৭২’ এর সংবিধান মানেন না! তারেক রহমান ৫ জানুয়ারি লন্ডনে একটি সভায় প্রকাশ্যে বলেন-"বাহাত্তরের সংবিধান গণতন্ত্রের আকাঙ্খার পরিপন্থী"।
 সেই ৭২’এর সংবিধানের চেতনা বিরোধী তারেক রহমানের জন্যে যখন ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক যখন তার বক্তব্যে বলেন -"যে ব্যবস্থাই হোক বিএনপি আগামী নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করবে। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হলে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে। আর এটাই হবে তারেক রহমানের প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তারেক রহমান আমার চেয়ে ছোট। আমি তার বাবা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছি। আবার তার মা বেগম খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে কাজ করেছি। 
এমন কি তারেক রহমানের মামলাগুলোও দেখছি। তার মাত্র একটি মামলা জামিনের বাকি আছে। তাহলেই তারেক রহমান আইনিভাবে মুক্ত হবেন। লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তার বাসায় ডিনার খেয়েছি। তিনি এখন সুস্থ আছেন। পড়াশোনা করছেন। তারেক রহমানকে বলেছি, তুমি যখন দেশে ফিরবে, বিমান বন্দরে অন্তত ২০ লাখ লোকের সমাগম হবে”।
 সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫/৯/১৩ইং। 
শুধু তাই নয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিহত করতে ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় তারেক রহমান বলেন- “নির্দেশনার অপেক্ষা না করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ুন”।
 যা ছিল সারাদেশে ১৯দলের সহিংসতা ছড়ানোর প্রত্যক্ষ নির্দেশ। তার পরবর্তীতে কি ঘটেছিল এই দেশে সারা দেশবাসী সহ গোটা বিশ্ববাসী দেখেছে।
যা বলছিলাম, একদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭২’এর সংবিধান পেয়েছেন বলে ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক গর্বিত, ওপরদিকে ৭২’এর সংবিধানের বিপক্ষে তারেক রহমানের জন্যে তার অবস্থান! পেশার কারনে নীতি, বিবেক সব বাক্সবন্দি করে রেখে দিয়েছেন! কবে, আর কবে সেই বাক্স খুলতে পারবেন তিনি তার এই জনমে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন, এদেশের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী। বঙ্গবন্ধুর সহচর বিখ্যাত সাংবাদিক মানিক মিয়ার আত্মীয়ও বটে। এখন তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা। যিনি এখন বিডিআর ট্রাজেডির খলনায়কদের পক্ষে আইনী লড়াই লড়ছেন! শুধু কি তাই, কসাই কাদেরের অন্যতম আইনজীবীও বটে। আমরা তাকে কসাই কাদেরের জন্যে ছুটোছুটি করতে দেখেছি, ট্রাইব্যুনালকে হুমকি দিতেও দেখেছি। বিচারকদের বিচার করবার হুমকী পর্যন্ত তিনি একজন আইনজীবী হিসেবে দিতে পারলেন !
অথচ ৪০ বছর আগে এই খন্দকার মাহবুব হোসেনই রাজাকারদের বিপক্ষে লড়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে রাজাকারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নিম্নলিখিত মামলাগুলোতে শাস্তি নিশ্চিত করতে এডভোকেসি করেছেন তৎকালীন স্পেশাল পিপি খন্দকার মাহবুব হোসেন -- 
১.১৯৭২ সালের দালাল আইন এর ১(খ) এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৩৬ নাম্বার ধারায় হানাদার বাহিনীর দালালী ও অগ্নিসংযোগ অভিযোগের দায়ে দুই জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড:
সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ, ৮/৯/ন১৯৭২ইং। 
২. খুনি রাজাকার আব্দুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে ট্রাইবুনালের জজ খোরশেদ আলী: 
সূত্রঃ দৈনিক বাংলা, ২৯/১১/১৯৭২ইং। 
৩. শাহজাহানপুর কলোনির ত্রাস রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান ওরফে মুন্নার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের জজ জনাব এস এম মাহমুদ।
সূত্রঃ দৈনিক বাংলা, ১/৯/১৯৭৩ইং। 
৪. রাজাকার কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে দায়েরকৃত মামলা নং: (৫)৭২, জি আর নং- ২৫০ (২) ৭২ ৫) সাকা চৌধুরীর নামে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে চট্টগ্রাম জেলার হাট হাজারী থানায় ১৩/৪/১৯৭২ তারিখে ১৭ নং মামলা দায়ের হয়। রাউজান থানায় ৪১(১)৭২ নং এবং ৪৩(১)৭২ নং মামলা দায়ের করা হয়। এফআইআর নাম্বার হচ্ছে- ইউ/এস/৩০২/১২০(১৩)/২৯৮ দণ্ডবিধি। 
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব ৪০ বছর আগে যাদের বিরুদ্ধে মামলায় লড়ছেন ৪০ বছর পর এখন তাদের পক্ষে লড়ছেন! শুধুই পেশার কারনে মানুষের এমন নৈতিকতার অধঃপতন হতে পারে কি? সমাজের এমন উচ্চ পর্যায়ে থেকে এমন নীতিহীন কাজ তখনই করা সম্ভব যখন তাদের বিবেক আর নীতিবোধকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন। এসব নীতিহীন মানুষদেরাই আজ আমাদের বাংলাদেশের এলিট শ্রেণী, দেশের মানুষকে, সরকারকে সুযোগ পেলেই উপদেশ দেন, দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের সময় এদের ভূমিকা স্পষ্ট ধরা পরে যায় আমজনতার চোখে। তাদের ভূমিকায় আমরা লজ্জিত হলেও তারা থাকেন উজ্জ্বীবিত ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হবার দিবাস্বপ্নে। 
নাসরিন হক।

No comments:

Post a Comment