Monday, June 2, 2014

নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় - বাঁধন সেনগুপ্ত

কাজী নজরুলের জীবনের শেষ চৌত্রিশটা বছর ছিল বড় মর্মান্তিক । কোন সৃষ্টিশীল মানুষ নজরুলের মত অবহেলা আর বঞ্চনার যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন কিনা জানি না। মধুসূদন দত্ত জীবনের শেষ দিনগুলো আত্মীয়-পরিজনহীন, চরম দারিদ্র ও অবহেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু নজরুল ইসলামের শেষ জীবন আরো বেশি মর্মন্তুদ,বেদনাদায়ক ।

নজরুলের অসুস্থ হয়ে পড়ার দিন নিয়েও সঠিক তথ্য জানা যায় না । কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে (৭ই অগস্ট ১৯৪১) কলকাতা রেডিওতে ‘রবিহারা’ কবিতাটিঐদিনই লিখে আবৃত্তি করার সময় কবির কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসে, কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন । হতেপারে একটা প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছিল ঐদিন থেকে । একবছর পর ১০ই জুলাই নজরুল তাঁরসুহৃদ জুলফিকার হায়দারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন “তুমি এখনি চলে এসো ... আমি কাল থেকেঅসুস্থ” । অতয়েব আমরা ধরে নিতে পারি ১৯৪২এর ৯ই অগষ্ট থেকেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন ।কবি তখন আক্ষরিক ভাবেই কপর্দকহীন । সংসারে দুই শিশু পুত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীপ্রমীলা, সর্বক্ষণের অভিভাবক শাশুড়ি গিরিবালা । ১৭০০ গানের রেকর্ডে লক্ষলক্ষ টাকা মুনাফার সন্ধান দেওয়া গ্রামফোন কোম্পানী কোন রয়ালটি, প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিচ্ছেনা,তাঁর লেখার প্রকাশকরা ফিরেও তাকাচ্ছে না । ১৭ই জুলাই ১৯৪২, শারীরিক যন্ত্রণাউপেক্ষা করে এক বন্ধুকে পত্র লেখেন কবি । লিখেছিলেন -  “আমি blood pressureএ শয্যাগত, অতিকষ্টে চিঠি লিখছি । আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ,পাওনাদারদের তাগাদা, প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি । তারপর নবযুগের worries ৩/৪মাস পর্যন্ত । এইসব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে । ... কথা বন্ধ হয়ে গিয়ে অতি কষ্টে দু’একটা কথা বলতেপারি,বললে যন্ত্রণা হয় সর্ব শরীরে”।

কবির অসুস্থতার কারণ বা কি ছিল তাঁর অসুখ, তা নিশ্চিত ভাবে কেউজানাননি । নানারকম কথা নানান জনে লিখে গেছেন । শোনা যায় ‘নবযুগ’ সম্পাদনা কালে একবার কবি উত্তরপাড়ায় এক দুষ্কৃতি দলেরকাছে প্রহৃত হয়েছিলেন, কয়েকজন যুবক উত্তরপাড়া থানার হেপাজত থেকে, ঘাড়ে ও মাথায় কঠিন আঘাত পাওয়া নজরুলকে বাড়ি পৌছে দিয়েছিলেন । এই আঘাতের কথা কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি । শোনা যায় নির্বাক কবি যখন বাংলাদেশে (১৯৭২), তখন নাকি তাঁরচিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড, কবির ঘাড়ে পুরাতন কঠিন আঘাতের চিহ্নটি সনাক্ত করেছিলেন । 

বিস্ময়েহতবাক হয়ে হয় - কি নিদারুণ অব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর অসুস্থতা প্রকট হওয়ার পর । প্রথমসাতদিন চিকিৎসা করেন হোমিওপ্যাথিক মতে, নজরুলেরই বাড়িওয়ালা ডাক্তার ডি এল সরকার ।অথচ মাত্র তিনদিন চিকিৎসার পর অতি উৎসাহী হয়ে নজরুলের সেই বন্ধু জুলফিকার হায়দার খবরের কাগজে কবির অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পাঠিয়ে প্রচার করে দেন নজরুল ‘উন্মাদ’ হয়ে গেছেনবলে । বাইশ বছর পরে লেখা তাঁর গ্রন্থে (‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় – ১৯৬৪) জুলফিকারহায়দার এই মিথ্যা সংবাদ প্রচারের সাফাই দিয়েছিলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘হয়তোঅসুখের সংবাদ পেয়ে কাজীদার অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ভক্ত অনুরক্তদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যাবে,দেখতে আসবে’ । অথচ জুলফিকার হায়দার প্রচারিত কবির ‘মস্তিষ্ক বিকৃতি’রমিথ্যা সংবাদ প্রচারের দুইবছর পরেও ১৯৪৪এর ২৭শে ফেব্রুয়ারি একজন নুরুল ইসলামকে একটা কাগজে লিখে নজরুল জানিয়েছিলেন - “শ্রীমান মোহম্মদ নুরুল ইসলাম, তুমি চিরঞ্জীবহয়ে থেকো । আমায় ও আমার ছেলে দুটিরে চিরদিন মনে রেখো”।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় কবিকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মধুপুর পাঠানো হল১৯৪২এর ১৯শে জুলাই, কিন্তু অর্থ শেষ হয়ে যাবার পর কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয় ২১শেসেপ্টেম্বর । ১৯৪৪এর ২৪শে মে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কবি নজরুল পীড়িত’ শিরোনামে একটিআবেদন প্রচারিত হয় । আবেদনে বলা হয়েছিল ‘বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুদিন যাবত পক্ষাঘাতে শয্যাগত । অসক্ত হইয়া পড়ায় তিনি এখন নিঃস্ব ও কপর্দকহীন । তাঁহার স্ত্রীও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়িনী । চিকিৎসা দূরের কথা,এমন সঙ্গতি নাই যে শিশু পুত্রদ্বয়,রুগণা পত্নী ও নিজের আহার্যটুকু জোটে। বাংলার জাতীয় কবির প্রাণরক্ষায় সহৃদয় সর্বসাধারণের অকুন্ঠ সাহায্য একান্ত আবশ্যক’ । 

এরপর কয়েকটি সাহায্য সমিতি গঠিত হয় । কলকাতার সুখ্যাত চিকিৎসকেরা কবিকেদেখেন একাধিকবার, কিন্তু নিরাময়ের কোন লক্ষণ দেখা যায় না । কবি কাজী আবদুল ওদুদেরউদ্যগে গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগে কবিকে রাঁচির মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানোহয় ১৯৫২র ২৫শে জুলাই । কিন্তু চার মাস চিকিৎসাধীন থেকেও কোন উন্নতি না হওয়ায়ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় । পরের বছর ১০ই মে ১৯৫৩ কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে ।সেখানকার চিকিৎসকেরা মতপ্রকাশ করেন যে কবির ব্রেন কুঁকড়ে গেছে অর্থাৎ মষ্টিস্কেরসংকোচন হয়েছে । লন্ডন থেকে ১০ই ডিসেম্বর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েনায় । সেখানেওচিকিৎসকের অভিমত ছিল কবিকে আর সুস্থ করে তোলা যাবে না । এরপরেও পূর্ব জার্মানীর বন বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক রুশ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন । তাঁর অভিমতছিল যে অনেক দেরি করে রোগীকে আনা হয়েছে । সাতমাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩’র ১৪ই ডিসেম্বর ।

এর পরেও ২৩বছর জীবিত ছিলেন নজরুল । অভাবের তাড়না, মানসিক কষ্ট,নিঃসঙ্গতা, পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া, অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনেরসঙ্গী । পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত ও দুইবাংলা থেকেই লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছিল । ১৯৬২র ২৩শে জুন দীর্ঘ ২৩বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাগত স্ত্রী প্রমীলার দেহাবসান হ’ল, কবি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন ।

জীবনের শেষ চারটি বছর কবি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় তাঁর প্রাপ্য সমাদর পেয়েছিলেন । মৃত্যুর সাত ঘন্টার মধ্যেই তাঁর আপনজনেরউপস্থিতির আগেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নীরব কবিকেসমাহিত করলেন সে দেশের সরকার

[ তথ্যসূত্র– নজরুল জীবনের শেষ পর্যায় / বাঁধন সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা , কাজী নজরুলইসলাম শতবার্ষিকী সংখ্যা ]

No comments:

Post a Comment