Monday, June 2, 2014

ব্যর্থ জনকের পুত্রঋণ -রণজিৎ বিশ্বাস


সংসারে কোন্ পিতা সবচেয়ে হতভাগ্য? সেই পিতা যাকে কাঁধে তুলতে হয় আপন সন্তানের প্রাণহীন দেহ। তেমন কাউকে কি আপনি দেখেছেন? নিয়তই দেখি। প্রায় প্রতিদিনই দেখি। সেদিন চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় একই বাহনে ছিলেন আমার এক সহকর্মী, যার মেধাবী সন্তান সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বন্ধুদের সঙ্গে স্নান করতে নেমে আর কূলে ফিরতে পারেনি। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া পুত্রের দেহটি অন্তত পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার সেই সেন্টমার্টিনসে যাচ্ছেন। উন্মাদপ্রায় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে।
: আপনার নিজের জীবনে কি এমন কিছু ঘটেছে? আপনি কখনও কি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন?
: হয়েছি। বড় অকালে অসময়ে ও অপ্রয়োজনে হয়েছি। ষোলোটি বছর ধরে সে যন্ত্রণা পুষে চলেছি ও সে যন্ত্রণা আমি বয়ে মরছি। যে আমার হাতের কাজ কেড়ে নিত, সে তার একমাত্র বোনের বিয়ের সময় বলতে পারত- একটুও কাঁদবিনে বুড়ি, তোর সঙ্গে আমি আছি। বাবার কথা কিছুও ভাববিনে তুই, বাবাকে বোঝাবার দায়িত্ব আমার, মেধা বিচারে যে হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেরা শিক্ষক, সে আমার সঙ্গে নেই। তার কাছে আমার ঋণের কোন শেষ নেই। সে অনেকটা বছর ধরে আমার আনন্দে নেই, আমার ক্রন্দনে আছে কিন্তু ক্রন্দনসিক্ত পিচ্ছিল পদযাত্রায় নেই; আমার উদ্বেগে আছে কিন্তু পরিকল্পনায় নেই; বঞ্চনায় আছে কিন্তু আমার স্বপ্নে নেই; আমার ভাবনায় আছে কিন্তু সম্ভাবনায় নেই। যে দিন থেকে সে নেই, সেদিন যদি তার পিতৃত্বের অভিষেক হতো, একদিন এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অসামান্য সুন্দর একটি বক্তৃতা দিয়ে বিজিত দলের যে মেয়েটির মনিবন্ধ চোরাচুরি করে মুঠোয় নিতে গিয়ে তার বাবার কাছে ধরা পড়েছিল, সেই কান্তিময়ী মেয়েটিই যদি তার জীবনের সঙ্গী হতো, এতদিনে তাদের ঘরে দশবারো বছরের অন্তত একজন পৌত্র বা পৌত্রী আমার থাকতে পারত।
যা হোক এসব নিয়ে এখন আর খুব বেশি ভাবি না আমি। মাঝেমাঝে কাঁদি, কান্নার সে জল মাটিতে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে উবে যায়।
সে হয়ত এখন পরপারের সিংদুয়ারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবাকে আর মাকে গ্রহণ করার জন্য। হয়ত সে পরিকল্পনা সাজিয়ে বসে আছে কী সেবা করবে তার বাবাকে, কী সেবা করবে তার মাকে অথবা কী শাসন করবে তাদের দু’জনকে, তার বয়স্ক ও অবাধ্য দু’সন্তানকে।
এই পুত্রের কাছে আমার ঋণ অপরিসীম। সে তার বাবাকে তৃপ্তপরিতৃপ্ত; সম্মানিত, ব্যর্থ, সমৃদ্ধ, পরিচিত, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, আঁধিমুক্ত, তর্কিত-বিতর্কিত, বিধ্বস্ত, হতাশাগ্রস্ত ও চিরদিনের জন্য ক্রন্দনশীল করে রেখে গেছে। জীবনের বাকি সময়ের জন্য সে তার বাবাকে অরণ্যবিদীর্ণ নির্জন ও শ্বাপদসঙ্কুল পথ বড় অসময়ে বড় অপ্রয়োজনে বড় উদারভাবে উপহার দিয়ে গেছে। এখন অসামান্য ও অমেয় মূল্যের উপহার সংসারে খুব বেশি লোকের জোটে না। যখনই সে আমার মনে আসে, তখনই সে বুঝিয়ে ছাড়ে- সন্তানের কারণে তো মা-বাবার ভোগবিপাক দুর্যোগ দুর্ভোগ অনেক হয়, সন্তান যদি রোগে ভোগে জরায় পড়ে, যদি সে উপযুক্ত না হয়, যদি সে ঝাপটাশিল্পী হননশিল্পী পেশীশিল্পী কিংবা কর্তনশিল্পী হয়, যদি তাকে ঘনঘন প্রহৃত হতে হয় ও ‘রাজবাড়ির অতিথি’ হয়, যদি তার কারণে মা-বাবাকে ক্যামেরার সামনে বা কাঠগড়ায় জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হয়, যদি তার ভাল একটা চাকরি না জোটে মা-বাবাকে কত দুয়ারে ধর্ণা দিতে হয়, কত অঘাটকে ঘাট মানতে হয়- তাতো তোমাদের জানা আছে বাবা। তাহলে আমার অকাল প্রস্থান নিয়ে এত ভাবাভাবি আর কাঁদাকাঁদি কেন কর! আমি তো তোমাদের অনেক বিপদ অনেক দুশ্চিন্তা ও অনেক খরচাখরচ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি বাপ! তাহলে আর আমার ‘আর্লি ডিপার্চার’-এর জন্য আফসোস কেন! তুমি কি পত্রপত্রিকা পড় না। তুমি কি দেখনা সন্তানের হাতে পিতামাতা আলাদা আলাদা অথবা জোড়াজোড়া খুন হয়ে যাচ্ছে। অথবা, পিতার হাতে সন্তানের জীবন যাচ্ছে! দেখ না তুমি! দেখে না আমার মা! এইসব ঝুঁকি থেকে আমি তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছি। আমি তো বাবা ‘রক’-এ বসে আড্ডা দিতে পারতাম, ইভটিজিঙে এক্সপার্ট হয়ে উঠতে পারতাম, পাশের বাড়ির মেয়েটির অথবা আমার বন্ধুর বোনটির জন্য আতঙ্ক হয়েও উঠতে পারতাম। আমি তো পরীক্ষায় নকল করে ধরা পড়তে পারতাম, চুরিডাকাতি, বদমাশি, খুন খারাবি, রাহাজানি করে এক নিরীহ হাবাগোবা আর ইডিয়টিক টাইপের শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক আর তার শিক্ষক স্ত্রীর মাথা কাটাতে পারতাম, তার জীবনের সমস্ত অর্জন ধুলোয় বালিতে ও আবর্জনে কাদায় মিশিয়ে দিতে পারতাম। আমি তো নষ্ট ও ভ্রষ্টদের পদপ্রান্তে তোমাকে মাথা নইয়ে চলার ব্যবস্থা নির্দয়ভাবে পাকা করে দিতে পারতাম। আমার তো একটা বিকলাঙ্গ সন্তান হতে পারত, আমার স্ত্রী তো একটি অটিস্টিক বাচ্চার মা হতে পারত, আমার দাম্পত্যজীবনে অশান্তি ও অবিশ্বস্ততা থাকতে পারত, আমাকে বারবার হয়ত বিবাহ বিচ্ছেদে জড়াতে হতো, তোমার বৌমা একজন ক্যান্সার পেসেন্ট হতে পারত, চাকরিজীবনে তোমার মতোই হয়ত বঞ্চনা, অবিচার আর দলনপীড়নের শিকার হতে হতো। আমি এ্যাকসিডেন্টে কিংবা হরতালে অবরোধে কিংবা হার্ট-এ্যাটাক’-এ প্রাণ হারাতে পারতাম।
এই সব তো বটেই, আরও তিন হাজার সাঁইত্রিশ রকম ঘটন দুর্ঘটন আমাকে নিয়ে হতে পারত, তোমাদের ছেড়ে অসময়ে চলে আসায় আমার কারণে এসব পোহানোর ঝুঁকি থেকে তোমরা মুক্ত আছো। চলে আসার আগে যদি কোন কারণে অথবা একাধিক কারণে তোমাদের ভুগিয়ে থাকি, যদি আমাকে দেয়া স্বাধীনতার অপব্যবহার করে থাকি; যদি তোমার ও তোমাদের দেয়া স্নেহপ্রশ্রয়ের অপচয় আমি করি, এখন মনে হয় যে করেছিও; আমাকে ক্ষমা করো। সেটি করতে পারো না পারো, এটুকু অন্তত বুঝে নিও, আমি কিন্তু অনেকগুলো কারণে তোমাদের কৃতজ্ঞও করে এসেছি, দায়মুক্তি আর স্বস্তি সোয়াস্তিতও দিয়ে এসেছি। আমাকে নিয়ে তোমাদের যে অনেক সুখস্মৃতি আর নন্দনন্দ আনন্দ স্মৃতিও আছে, তাও তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না বাপ! সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়, আমার কাছে তোমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জীবনের অকাল অবসানের জন্য কোন দুঃখ নেই। এখন বুঝতে পারি, এর জন্য কতটুকু দায় এই অপোগ-জনার ছিল। দুঃখ শুধু পাঁচ বছরের ছোট বোনটির জন্য। দুঃখ ছাড়া ওর দাদার কাছ থেকে কিছুই সে পায়নি। তাও পেয়েছে বড় ছোট বয়সে। ঐ শিশুটির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোন মুখ আমার নেই। তবে, আমি মানি এবং ভালমতোই মানি, জীবন এরকমই, জীবন জীবনের মতোই, তার মতো আর কিছু নেই।

লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক।

1 comment:

  1. কঠিন সত্যের যে আগুন আমাদের অন্তরকে দগ্ধ করে, সে আগুনে আমাদের হৃদয় মোমের শিখার মত আলোকিত হয়ে ওঠে। তার নামই কি জীবনের কাছে আমাদের অহং এর সমর্পণ?

    ReplyDelete