Tuesday, August 6, 2013

৭২তম প্রয়াণ দিনেও অনিবার্য চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ৭২তম প্রয়াণ দিবস আজ বাইশে প্রাবণ। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে চিরপ্রস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার বিপুল কর্মযজ্ঞ বাঙ্গালীর মন আর মননে চিরঅম্লান । মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ।
সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পুজোর কথা বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের। চির নতুন তিনি। সবসময় প্রাসঙ্গিক। বাঙালীর চেতনার রঙ স্পষ্ট হয়েছিল রবির আলোয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বহুমাত্রিক অবদানে সমৃদ্ধ করা এই রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন। আজ ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনেও অনিবার্য তিনি। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী।

হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তাঁর এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে বিরল গৌরব এনে দেয়।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ কর্মের মাধ্যমে সূচনা করে গেছেন একটি কালের। একটি সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দিতে শুরু করেন তিনি। ১৪ বছর বয়সে ব্রজবলী ভাষায় লিখেছেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী।

বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্ররচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদ ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাঁদের আবেগ অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাঁর আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রথম জীবনে ভানুসিংহের পদাবলীতে কবি লিখেছিলেন- মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান... মৃত্যু অমৃত করে দান। একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তাররূপে বর্ণনা করে তিনি উচ্চারণ করেন- প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই। জীবনের শেষ দিকে এসে কবি জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। বলাই বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে।
মহাপ্রয়াণ দিবসে আজ মঙ্গলবার বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী। তবে রমজানের কারণে এবার আনুষ্ঠানিকতা থাকবে কম।

No comments:

Post a Comment