Saturday, May 24, 2014

১১৫ তম জন্মদিনে যুগোত্তীর্ণ কালোত্তীর্ণ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম প্রণাম তোমায়


 ১১৫ বছর আগে এই দিনে পরাধীন বাঙালির মুক্তির বাণী নিয়ে ধূমকেতুর মতো অবিভক্ত বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ কবি। তাই বাঙালির নিজেকে নতুন করে সৃষ্টি করার দিনও এটি। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা কবির ১১৫ তম জন্মবার্ষিকীর দিনটি এবং কবির অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর পূর্তিও জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসায় আজ উদযাপন করবে। উল্লেখ্য, বাধার দুর্লংঘ পর্বত পাড়ি দেয়া এ কবির জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে। তার ডাক নাম ‘দুঃখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। নজরুল বিশেষজ্ঞদের মতে, নজরুলের কাব্যসাধনা শুরু হয়েছিল একটি ক্রান্তিকালে। তার উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচার, অবমাননার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর প্রতিবাদ এবং মানবিক জীবনের গভীরে মঙ্গলদায়ি শক্তিরূপে বিরাজমান যে প্রেম ও সৌন্দর্যের চেতনা রয়েছে তার উদ্বোধন করা। আর তা করতে গিয়েই এক সময় সকলকে চমকে দিয়ে তিনি বাংলার সাহিত্যাকাশে আত্মপ্রকাশ।

সবার উপরে মানুষ সত্য, মানুষের  প্রাণের ভেতরের যে সত্য , যে ধর্ম, তার উপর কোন ধর্ম নেই- এ কঠিন সত্যটি নজরুল বারবার আমাদের শিখিয়ে গেছেন । কবি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রাখেন "কৃষ্ণমোহাম্মদ"--ধর্মের উপরে যে মানুষ সত্য, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবার আগে আমরা যে মানুষ , সেটাই বারবার বলে গেছেন নজরুল।

অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৪১৮৯৯ – আগস্ট ২৯১৯৭৬)(জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ - ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)। আজ তাঁর ১১৫ তম জন্মদিন।  তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ওগান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর ' বিদ্রোহী' কবিতা তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যা দেয়। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। 


বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে কবিকে নিয়ে আসেন ঢাকায় ।কবির জন্যে বাড়ি বরাদ্দ করেন- পাশাপাশি পিজি হাসপাতালে কবির চিকিৎসা চলে।স্বাধীন দেশে কবির গানকে  রণসংগীত করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ।   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে অন্তিম শয়নে কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল তাঁর শেষ ভাষণে বলেছেন, "যদি আর বাঁশি না বাজে... আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, ভুলে যাবেন..."ভুলে যেতে বলাটাই কবিকে মনে করিয়ে দেয় বারবার। আমরা ভুলতে পারিনা সাম্যের গান । আমরা ভুলতে পারিনা বৈষম্য বিরোধী গান । আমরা ভুলতে পারিনা কী দারুণ সাহসে কবি বলে গেছেন -- "তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ !" 

“যদি আর না ফিরি” শিরোনামে কবির ভাষণটি  এখানে উল্লেখ করছি। কবি নির্বাক হওয়ার আগে এটিই সম্ভবত তাঁর শেষ বক্তব্য, যেখানে তাঁর সকল হতাশা, বেদনা আর কষ্টের কথা অকপটে উঠে এসেছে। এবং যা আজো সত্য!

বন্ধুগন,

আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন তা আমি মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রান আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেইদিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহন করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের আমি একজন,এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।

আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশেরই এই সমাজেরই নই,আমি সকল মানুষের। কবি চায় না দান;কবি চায় অঞ্জলী ,কবি চায় প্রীতি। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম ।
তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি,তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে  তাকে ক্ষুধা-দীর্ন মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি! যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি,কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি,ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।

আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি ,বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে -অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন,পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে । ধর্মের নামে  ভন্ডামি ও  কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। 

কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন , কাফের! আমি বলি,ও দু'টোর কোনটিই নয় । আমি কেবলমাত্র  হিন্দু -মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালি কে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি ।সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে  ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা , একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে  আছে ছুরি। 

হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি , জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ- বিগ্রহ।জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনের একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋন-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষানস্তুপের মত জমা হয়ে আছে। 

এই অসাম্য, ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও  সুন্দর- সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আমি যশ চাইনা ,খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা ,নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান,বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলীন। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত- এই আমার সাধনা- এই আমার তপস্যা।

রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দ্যাখ্  উন্মাদ , তোর জীবনে শেলীর মতো,কীট্‌সের মতো খুব বড়ো একটা ট্র্যাজেডি আছে-তুই প্রস্তুত হ",জীবনে সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য  আমি কতোদিন  অকারণে  অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই  জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত। মেঘের উর্ধে শূন্যের মতো। কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।

আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহাঅনুভূতির কথা- আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন যখন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়েছে ঠিক সেই দিনই ,সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে। 

যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শুন্য থেকে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ঞা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্না যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে,  আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন ,আমায় ভুলে যাবেন। 

বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি,আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরব পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। 
যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে-দেশপ্রেমিক-ত্যাগী, বীর-বিদ্রোহী - বিশেষনের পর বিশেষন, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে,বক্তার পর বক্তা!

 এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পারো, চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও , সেটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি—-“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা,কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা-নিশ্চুল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ!"

 সন্তানের মৃত্যু, সমাজের ধর্মান্ধ এবং ক্ষমতাসীন দের অত্যাচার এবং নিপীড়নে প্রচন্ড আঘাত  এবং বেদনা সয়ে র্নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন কবি, তবু তিনি বেঁচে আছেন, চিরকাল থাকবেন বাংলার মানুষের মনে,হৃদয়ে।তিনি তাই তিনি  অমর।

কবির স্মৃতিকে তাঁর সাহিত্যকে আমাদের নিজেদের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সে সবের চর্চা করতে হবে।পাকিস্তান সরকারের বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিনাশী হীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নজরুল কে বিকৃত ভাবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা  করা হয়েছিলো। সেই কালো ইতিহাস এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে  এই প্রজন্মের কাছে  স্বমহিমায় স্বরূপে উপস্থাপন করতে হবে কবি কে ।উপস্থাপন করতে হবে এক ধর্মনিরপেক্ষ,অসাম্প্রদায়িক, উদার গণতান্ত্রিক,সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিশ্ব নাগরিক,মানবতাবাদী বাঙালী কবিকে।

  একথা বারবার উঠে এসেছে , বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- এ কারণে  "বিদ্রোহী কবি", তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় নজরুল একাডেমী  গবেষণা কাজের জন্যে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ। 


বাংলা কাব্যে ভক্তিগীতি রচনা  করে  তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘নোবেল পুরস্কার’ পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৪ বছর। অনুজ নজরুলের ‘ধূমকেতু’ ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) প্রকাশিত হলে ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপিতে প্রথম ৬টি সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় ৭ম সংখ্যা থেকে ৩য় পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় স্তম্ভের ওপর তা ছাপা হয়- “আয় চলে আয়, রে, ধূমকেতু,/র্আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/জাগিয়ে দে'রে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন!” রবি ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা। 

 সমাজে ধর্মের নামে মানবতার অবমাননাকারী ধর্মবেসাতি করে যারা, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন নজরুল।  তাঁর 'আমার কৈফিয়ত কবিতায় লিখেছেন," মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও বজাত মেরে!/ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!/‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’"

ব্রিটিশ সরকারের পীড়নের কথা তুলে ধরেছেন এই কবিতায়-"বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!/যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু/শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?" 

লিখেছেন ক্ষুধাকাতর শিশুর কথাও ,"  ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,/বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।/কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!/কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?" 

কষ্টের কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, "বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!/দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,/তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,/বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!/অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!/পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,/মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।/প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!"  এভাবেই নিজের রক্ত দিয়ে হলেও অত্যাচারীর সর্বনাশ চেয়েছেন নজরুল।

অসাম্প্রদায়িক জাতি , সমাজ প্রত্যাশায় তাঁর 'কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় লিখেছেন,"অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন/কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।/হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র।...কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!/ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!/উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার/ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান/আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!"


“আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,তবু আমারে দেব না ভুলিতে” _ এই আত্মপ্রত্যয় ছিল যার মরণোত্তর অস্তিত্ব নিয়ে,তিনি চিরবিদ্রোহী,চিরবিরহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রেমে ও বিদ্রোহে, কোমলে-কঠিনে গড়া এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম।আজও দ্বিধাবিভক্ত সমাজে, শোষক আর শোষিতে বিভক্ত পৃথিবীতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাসসহ বিচিত্র রচনা মানবমুক্তির প্রেরণা জোগায়। তাই যথার্থ অহঙ্কারেই তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘আমারে দেব না ভুলিতে’।

 আর তাই ,জাতীয় কবিকে কখনও ভোলা সম্ভব নয়। বাংলা কাব্যে আর গানে যে নতুন জোয়ার তিনি এনেছেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য যে অবিস্মরণীয় প্রেরণাসঞ্চারী দ্রোহের বাণীতে উচ্চকিত করে তুলেছেন অবিভক্ত বাংলার কোটি কোটি মানুষের চিত্ত, সে বাণীর শাশ্বত দর্শন চিরপ্রাসঙ্গিক। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুন ঝরানো কবিতা আর শেকল ভাঙার গান। ‘বিদ্রোহী’ ‘অগি্নবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ফণীমনসা’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও।কারণ এমন কবিতা প্রথম শুনল বাঙালি।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানালেন এই নতুন কবিকণ্ঠকে। ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন কারাবন্দি নজরুলকে।’বিদ্রোহী’ কবিতায় এমন আশ্চর্য এক নতুন সুর আর নতুন ছন্দের দোলা, হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য আর পুরাণের এমন অপূর্ব প্রয়োগ, প্রেম আর বিদ্রোহের এমন আশ্চর্য সমন্বয়, এর তুলনা অতীতে ছিল না, পরবর্তীকালেও দেখা যায়নি।এই একটি মাত্র কবিতার মধ্যে নিহিত রয়েছে সমগ্র নজরুলের জীবনদর্শন আর অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ।’বিদ্রোহী’ কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাণী, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার আর চিরস্বাধীনতার স্বপ্ন।

তাঁর আবির্ভাব ঝড়ের মতোই। তিনি নিজেই লিখেছেন আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়।তবে তাঁর লেখা অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’র জন্যই তিনি বিদ্রোহী কবিরূপে পরিচিত হয়ে ওঠেন।কবিতাটি আলোড়ন তোলে বাংলার সাহিত্যের ধারায়।তখন উপমহাদেশ ভাগ হয়নি। চলছে দোর্দ- প্রতাপে ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের শাসন।যিনি দাঁড়িয়েছেন সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচারের বিরম্নদ্ধে,অবিচারের বিরম্নদ্ধে,মানুষের পূর্ণ মুক্তির পৰে।তাঁর সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে তিনি দেশের মানুষের অনত্মরে স্থায়ীভাবে আসন লাভ করেন। আজ এমন একটা দিন নাই যেদিন তাঁকে কোন না কোনভাবে স্মরণ করা হয় না।তিনি সত্যিকার অর্থেই প্রাতঃস্মরণীয়। কবি নজরম্নল আমাদের গর্ব। তাঁকে আমরা এখন প্রতিদিন স্মরণ করি।

পাকিস্তানী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের দীর্ঘ সময়কালে তাঁর কবিতা উচ্চারণ হয়েছে, তাঁর গান গেয়ে উদ্দীপনা লাভ করেছে মানুয।তাঁর ‘শিকল পরা ছল, মোদের এ শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’, ‘দুর্গম গিরি কানত্মার মরম্ন দুসত্মর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ গানগুলো মানুষের মনে হৃদয়ে শক্তি যুগিয়েছে,মনে জয়ের প্রত্যাশা জাগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তাঁর এসব এবং অন্যান্য গান মুক্তিযোদ্ধাদের মনে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি  যুদ্ধে প্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছে।

 জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর  শেখ মুজিবর রহমানের কাছে কবি নজরুলের বিশেষত্ব ছিল কবির বিদ্রোহী চেতনা। কলকাতায় পড়ার সময় হোস্টেল প্রতিবেশী কবি গোলাম কুদ্দুসের কাছে  বঙ্গবন্ধু জেনেছেন কবি সম্পর্কে। তাঁর বন্ধু পল্লীকবি  জসীমুদ্দিনও  নজরুল সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়েছেন। নজরুলের অপর শুভানুধ্যায়ী কবি জুলফিকার হায়দারের সাথে বঙ্গবন্ধুর গভীর সখ্য ছিল । যাকে সম্পাদক করে বঙ্গবন্ধূ ১৯৬৮-১৯৭০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত  ট্যাবলয়েড আকারে সাপ্তাহিক “নতুন দিন” বের করতেন (লালরঙের লোগো)।
পাকিস্তান জাতীয় গণপরিষদে ৫০দশকে বঙ্গবন্ধু প্রথম দাবি তোলেন কলকাতায় বাসরত কবি নজরুলকে মাসিক ভাতা প্রদানের। তার দাবি গ্রাহ্য হলেও টাকা পূর্বপাকি সরকারকে প্রদান করতে হয়। ১৯৬৫’র যুদ্ধকালে ভাতা পাটানো বন্ধ ছিল। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৮,৬৯ ও ৭০ সালে  পার্টির লোক পাঠিয়ে কবির জন্য কাপড়চোপড় -খাবার , টাকা পাঠাতেন। মুস্তফা সারওয়ার দুবার গেছেন। মুজিবনগর সরকার মাসিক ২৫০টাকা দিত। সরকারী প্রতিনিধি পাঠিয়ে কবির খোঁজ নিতেন।স্বাধীনতার পর ১০০০টাকা ভাতা দেওয়া হয়। 

  বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে  বিশেষ  অনুরোধ করে কবি নজরুলকে নিয়ে আসেন ঢাকায় । তাঁর জন্যে বাড়ি বরাদ্দ করেন-পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। অসুস্থ  নির্বাক কবিকে অতি উৎসাহি বাঙ্গালী নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে যেন শাস্তি দিতেন। তাঁকে দেখার জন্য ঢল পড়ে যেতো,কেউ  কেউ গান শোনাতেন।  বঙ্গবন্ধুর পাঠের তালিকায় নজরুল ছিলেন। জেলখানায় বঙ্গবন্ধু  কবিকে পেয়েছেন নিবিড় করে।

 ব্রিটিশ শাসনামলেই অসুস্থ হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন কবি । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে কলকাতা থেকে  সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়।এসময়ে তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়।এর কিছুদিন পর তাঁকে 'জাতীয় কবি' ঘোষণা করা হয়।তখন থেকেই তাঁর ঢাকায়  বসবাস এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।আজ  আমাদের  প্রাণপ্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই প্রাণের প্রণতি, গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

No comments:

Post a Comment