Sunday, May 18, 2014

দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহল বিনিময় ॥ ভারতের গণমাধ্যমও সোচ্চার -সুমি খান


  ১৯ ডিসেম্বর , ২০১৩ ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বুধবার তৃণমূল কংগ্রেস এবং আসাম গণপরিষদের সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত একটি বিল রাজ্যসভায় উত্থাপন করেছে।
এ বিলটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্তবর্তী ছিটমহল বিনিময় সহজ হবে।তবে বৃহস্পতিবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার ‘বাংলাদেশ ল্যান্ড সোয়াপ বিল টেবলড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাহায্য করতেই দ্রুত এ বিল পাসে তৎপর হয়েছে ভারতের জোট সরকার।
বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদনে বুধবার রাজ্যসভার অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিলটি উত্থাপন করতে গিয়ে বিরোধিতার মুখে পড়েন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ।তিনি বিল উত্থাপনের উদ্যোগ নিতেই ডেরেক ও’ব্রায়েনের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বীরেন্দ্র প্রসাদ বৈশ্যর নেতৃত্বে আসাম গণপরিষদের সদস্যরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের হাত থেকে বিলের কপি ছিনিয়ে নেয়ারও চেষ্টা করেন।
এক পর্যায়ে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে বীরেন্দ্র বৈশ্যসহ কয়েকজন সালমান খুরশিদের দিকে তেড়ে যান। ফলে ব্যাপক হট্টগোলের  মধ্যে অধিবেশন ২০ মিনিটের জন্য মুলতবি করা হয়। ২০ মিনিট পর অধিবেশন শুরু হলে সালমান খুরশিদ ভারতের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের এই বিল উত্থাপন করেন। তবে তখনো তৃণমূল ও অসম গণপরিষদের সদস্যরা হৈ চৈ চালিয়ে যাচ্ছিল। বিলটি উত্থাপনের পরপরই রাজ্যসভার চলতি অধিবেশন শেষ হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী অধিবেশনে তা নিয়ে আলোচনা হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগেও গত মে ও আগস্ট মাসে দুই দফা এই বিলটি উত্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসসহ কয়েকটি দলের বিরোধিতা কারণে তিনি সফল হননি।
বুধবার বিক্ষুব্ধ রাজ্যসভার সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন, ডেপুটি চেয়ারম্যান পি জে কুরিয়েন তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি তা রক্ষা করেননি। তাদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই বিলটি উত্থাপন করা হয়েছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নতুন সরকার গঠনে সহায়তা করতেই এ বিল পাশে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশে আবারো সরকার গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দল। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থেই এ দলটির ফের ক্ষমতায় আসাটা দিল্লির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
আর হাসিনা সরকারের দাবি এ চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে তার পক্ষে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত বিরোধীদের মুখ বন্ধ করা সম্ভব হবে।হাসিনার বারবার তাগাদার মুখেই সরকার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিলের সঙ্গে এ চুক্তিটি জুড়ে রাজ্যসভায় উত্থাপন করে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়। কংগ্রেস নেতারা আশা করছেন বিলটি পাস হলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তারা সহজেই মুসলমান ভোটারদের সমর্থন পাবে।
কিন্তু বুধবার স্থল সীমান্ত চুক্তি বিলটি রাজ্যসভায় উত্থাপনের সময় তৃণমূল কংগ্রেস, আসাম গণপরিষদ ও বিজেপির বিরোধিতার কারণে বিপাকে পড়ে ক্ষমতাসীনরা। রাজ্যসভায় পাস হওয়ার পর এটি লোকসভায় তোলা হবে।
 সীমান্ত চুক্তি ও প্রটোকলের আওতায় ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের মোট ৭ হাজার ১১০ একর আয়তনের ৫১টি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের মোট ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল বিনিময়ের কথা রয়েছে।বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার।

বিজেপি ও আসাম গণপরিষদ শুরু থেকে এই বিলের বিরোধিতা করে আসছে। তাদের আশঙ্কা ছিটমহল বিনিময় হলে ভারত প্রায় ৭ হাজার একরের বেশি জমি হারাবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসও এর বিরোধিতা করছে। মমতা বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না।

৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’-দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী। এরা প্রত্যেকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বিশ্ববাসী এক। মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে একটি টকশোতে উঠে আসে বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বাস্তবায়ন এবং তিস্তা চুক্তি। প্রশ্ন তোলা হয়, রাজনৈতিক হঠকারিতার কাছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নতজানু কি-না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে হত্যা করার কারণে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কার আদর্শ থেকে সরে গিয়েছিল। এই ব্যবস্থা অনেকদিন চলেছে। ছিটমহলে পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ ও ১৯৬১ সালে জনগণনা করা হয়েছিল। এর দীর্ঘদিন পর মনমোহন-হাসিনার ২০১১ সালের চুক্তি ছিটবাসীদের আশাবাদী করেছে।

এই নিরীহ মানুষগুলোর জন্যেও কথা বলতে হবে বাংলাদেশ এবং ভারতের সচেতন নাগরিকদের। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা প্রশ্নে এদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাহীনতা ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশকেই চরম হুমকির মুখে রেখেছে। এই বাস্তবতা দুই দেশের নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।

ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। নেই তাঁদের ভোটার পরিচয়পত্র। একই চিত্র বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলেও। ছিটমহলবাসীর পরগাছা হিসেবে নিজেদের নাম-পরিচয় লুকিয়ে বাস করতে হচ্ছে ।
 
ভারতীয় ছিটমহল বা বাংলাদেশের ছিটমহলের প্রকৃত বসবাসকারীরা এখন আর নেই। বাংলাদেশী ছিটমহলে ভারতীয় আর ভারতীয় ছিটমহলে বাংলাদেশীরাই বর্তমানে বসবাস করেন। এটি একটি জটিল সমস্যা। ছিটমহল বিনিময় হলে ভারতের ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশকে দিয়ে দিতে হবে। ভারতের সংবিধান অনুসারে জমি নেয়া যেতে পারে কিন্তু দেয়া যায় না। এর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এখানেই তৃণমূল নেত্রী মমতা এবং ভারতীয় উগ্র মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির আপত্তি।
বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে এবং ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার ভারত ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। এর মধ্যে ৪৮টি কোচবিহার জেলায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। ১৯১১ সালের ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত উভয় দেশের যৌথ আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন নাগরিক বাস করছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয় নাগরিক (নাগরিকত্ব না থাকলেও জন্মসূত্রে নাগরিক)। আইন মোতাবেক ভারতের ভূখণ্ডে বসবাসকারী ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশী আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১১১টি ছিটমহলে বসবাসকারীরা ভারতীয়। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব দেবার সময় এসেছে। 
ছিটমহলের ‘নাইদেশের নাগরিক’দের মানবেতর জীবনের জন্যে দায়ী রাজনীতিকদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এসে গেছে। ছিটমহল বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক অধিকারকে সুরক্ষিত করা এবং তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে বিশিষ্ট আইনজীবী অনির্বাণ দাস কলকাতা হাইকোর্টে গত সোমবার ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছেন।বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার ছিটমহল বিনিময়ের জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি থাকলেও বাদ সাধেন ভারতের অসম রাজ্যের দুই বিজেপি সাংসদ আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রী মমতার দাবি, এই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ ক্ষুণœ হবে। ‘নিজেদের স্বার্থ’ বিসর্জন (?) দিয়ে কোন বিনিময় চুক্তি হতে দেবেন না তিনি। মুখ থুবড়ে পড়ে ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছিটমহলজুড়ে। ছিটমহল বিনিময়ের দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। 
মমতা কদিন আগে হঠাৎ বলেন, ‘ছিটমহলবাসী চাইলে ছিটমহল বিনিময় হবে।’ অথচ ১৯৯৪ সাল থেকে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী অবস্থান ধর্মঘট ও অনশনসহ নানান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মমতা এসব না জানার ভান করলেন। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত আমাকে বলেছেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে দুই দেশেই আন্দোলন করছি। আমরা চাইছি, ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিটমহল বিনিময় হোক। এতে ছিটমহলের বাসিন্দারা একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হয়ে বাস করতে পারবে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার।’ 
সম্প্রতি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করতে দেয়া হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির আসামের দুই সাংসদ আপত্তি করেছে। বিলটি লোকসভায় উত্থাপন করা যায়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয় ছিটমহলবাসী। জ্বলছে তাঁদের মনে ক্ষোভের আগুন। তাঁরা ক্ষুব্ধ হন মমতার বিরুদ্ধে। 
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদকের বরাতে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল যদি সংসদে না ওঠে, তবে তাঁরা মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনী লড়াইয়ের পথে যাবেন। মামলা করবেন উচ্চ আদালতে।
নাগরিকত্ব না থাকার কারণে কোনো সন্তানসম্ভবা মা তার সন্তানের জন্ম দেয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী নেই। এ কারণে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে এই বাসিন্দারা যা এড়াতে পারে না দু’দেশ।
এই ছিটমহল বিনিময় না হওয়ার ফলে দুদেশের সরকার রাজস্ব বা বিভিন্ন প্রকারের কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সুযোগে একদল অসাধু লোক ছিটের বাইরের লোকদের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে জোর করে নামমাত্র মূল্যে ছিটমহলের নামে স্ট্যাম্প পেপার তৈরি করে জমি-বাড়ি রেজিস্ট্রি করাচ্ছে। এই খবর প্রথম বাংলানিউজে প্রকাশ হবার পর ছিটমহলের নিরীহ বাসিন্দাদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়ে দেয়।
আগেই বলেছি, নাগরিকত্বের কোন প্রমাণ নেই বলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা থাকছেন ভারতের ছিটমহলে। পরদেশে পরগাছা হিসেবে বাস করছেন তারা। ছিটমহলের ঠিকানা বদলিয়ে তারা ভারতের কোন ঠিকানা ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন, ভারতের এলাকায় ভুয়া ঠিকানা দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 
এমনই মানবেতর জীবনযাপন করছে ছিটমহলের নিরীহ মানুষগুলো। এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চান তাঁরা। বাস করতে চান একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে। সুযোগ-সুবিধাও চান সেই দেশের। তাই তাঁরা ছিটমহল বিনিময়ের দাবি তুলেছেন। 
ছিটমহল বিনিময়ের অযৌক্তিক বিরোধিতা ছিটমহলবাসীর জটিল সঙ্কট নিরসনের প্রতিবন্ধক। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ ঠেকিয়ে দেবার কারণে মমতা-বিজেপি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ছিটমহলবাসী ক্ষুব্ধ। 
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিটমহল বিনিময়ে দুই দেশ রাজি হলে ছিটমহল বিনিময়ের কয়েক দশকের আন্দোলন সফলতার পথ উন্মুক্ত হয়। সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেয় উভয় দেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সফরের তিনদিন আগে মমতা হঠাৎ বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন। আপত্তি তোলেন ছিটমহল বিনিময়ের বিরুদ্ধে। স্থগিত হয়ে যায় ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া। 
সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে জানা যায়, দৈর্ঘ্যে তিন কিলোমিটার আর প্রস্থে পৌনে তিন কিলোমিটার ভারতের বাত্রিগাছ ছিটমহল। এখানে বাংলাদেশের অন্তত ৫০০টি পরিবার বাস করে। ছিটমহলবাসী আজাদ হোসেন, জয়নাল মিয়া, মোহাম্মদ আলী, বকুল মিয়া ও কল্পনাথ রায় হতাশ, ক্ষুব্ধ স্বরে সাংবাদিকদের বলেছেন, “লুকোচুরি খেলে তো জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এভাবে আর বাঁচা যায় না। এবার ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য দিতে হবে ছিটমহল বিনিময়ের সুযোগ”। এবার এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চাইছেন তাঁরা। আকুল আবেদন করেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে। তারা যেন ছিটমহল বিনিময়ের দাবির পাশে এসে দাঁড়ান।
তিনবিঘা করিডরে চুক্তির সময় বলা হয়েছিল এবার ছিটমহল বিনিময় হবে। আইনী জটিলতার কারণে কখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১০ সালে ভারতের জনগণনার সময় কোচবিহারের জেলাশাসক বলেছিলেন আমার জেলায় গণনা করতে গেলে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য লাগবে। কারণ বাংলাদেশী ছিটমহল এই জেলায় রয়েছে। তাদের প্রশ্ন তাহলে এই এলাকায় ভারতের সার্বভৌমত্ব কোথায় আছে? ছিটমহলবাসী প্রশ্ন তোলেন, গোয়া, সিকিম যদি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তাহলে কেন ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে না? 
বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারকে বিস্তারিত সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সঠিকভাবে জানতে হবে ছিটমহলের বাসিন্দারা কে কোথায় যেতে চান।
বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে ৩৭ হাজার ৩২৯ জন বাস করেন। ছিটমহল বিনিময়ের পরে তার মধ্যে মাত্র ৭৪৩ জন ভারতে আসতে চান-এটা জরিপের তথ্য। ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিটমহল সংক্রান্ত এক আলোচনাসভায় মনসুর আলি মিঞা বলেন, ‘আমি আজ যেভাবে এখানে এসেছি, তা রাষ্ট্রের ভাষায় অবৈধ। কারণ আমি খাতা-কলমে বাংলাদেশের বাসিন্দা। কিন্তু আমার বাংলাদেশের কোন পরিচয়পত্র নেই। আমার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। বাংলাদেশে গিয়ে আমি শরণার্থী হতে চাই না। আমি জন্মেছি ভারতে। ভারতেই মরতে চাই। একইভাবে বাংলাদেশের ভেতরে ছিটের বাসিন্দারাও তাই চান। 
৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে সম্প্রচারিত এক মুক্ত আলোচনায় বিজেপির মুখপাত্র তরুণ বিজয় স্বীকার করেন, ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থেই’ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিজেপি তাদের শক্ত অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে মনে হচ্ছে। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস ও অসম গণপরিষদ এখনও বিরোধিতা করে যাচ্ছে।
এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য পার্লামেন্টে বিল পাস করতে হলে রাজ্যসভা ও লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার, যা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তিন দফা বিল তোলার উদ্যোগ নিলেও দুইবার বিজেপি ও আসাম গণপরিষদ এবং একবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। 
মমতার ভূমিকা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভ্রান্তি হিসেবে উল্লেখ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করা হয় এই টক শোতে।টিভি টকশোতে বিজয় বলেন, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ প্রশমনে সাড়া দিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষকে ‘সঠিক বার্তাটি’ পৌঁছে দিতে’ ভারতেরও উচিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করা।
পশ্চিমবঙ্গ ও অসম বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বরুণ গান্ধীও গত মাসে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন।
তবে এনডিটিভির টকশোতে বিজয় আবারও বলেছেন, মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের উচিত ছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি করার আগে বিরোধী দলের মতামত নেয়া। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ চুক্তির বিষয়ে যে উদ্বেগের কথা বলে আসছেন, তাও কেন্দ্র সরকারের আমলে নেয়া উচিত বলে মনে করেন এই বিজেপি নেতা। 
কংগ্রেসের মন্ত্রী শশী থারুর ও বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি এ চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতে জনমত গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো মত দেন। শশী থারুর বলেন, ‘ঢাকা আমাদের বড় বন্ধু। এখন আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি অঙ্গীকার রাখতে না পারলে তা হবে একটি বিপর্যয়।’
বীণা সিক্রি বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী। ভারত যদি বিশ্বের কাছে গুরুত্ব আশা করে, তাহলে কোন দেশের সঙ্গে করা চুক্তি বাস্তবায়নের সামর্থ্য তার থাকা উচিত।’ স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম ভূমি হারাবে বলে যে অভিযোগ তৃণমূল ও আসাম গণপরিষদ করে আসছে, তাও নাকচ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
শশী থারুর ও বীণা সিক্রির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রবীণ সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক বলেন, পররাষ্ট্রনীতি যদি পাকিস্তানের মতো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়Ñ সেটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। ভারতের ভবিষ্যত এর পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর অনেকটা জড়িত। আর এ দুটো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। আর সম্পর্ক উল্টে গেলে ক্ষতিও হবে একই মাত্রার। বাংলাদেশে হাসিনার শাসন প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের জন্যে নিরাপদ। কারণ, শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আলোচনার এই পর্যায়ে বিজেপি নেতা তরুণ বিজয় বলেন, ‘আমি সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে একমত।’ 
আলোচকদের অধিকাংশই চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দেয়ায় একপ্রকার কোণঠাসা স্বাগত রায় ‘কূটনৈতিক কৌশলের’ আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, একজন মন্ত্রী হিসেবে শশী থারুরের এমন কিছু বলা উচিত নয়, যাতে মনে হয় যে দিল্লী­ ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জবাবে স্বভাবসুলভ রসিকতার সুরে শশী বলেন, ‘কার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে মিস্টার রায় এবং তার নেত্রী (মমতা) কি তা নিয়ন্ত্রণ করতে চান? তারা কি ভাবছেন যে, কে আমার বন্ধু আর কে তা নয়- এটা বোঝার মতো বুদ্ধিও আমার নেই?’
এই টকশো দেখে ছিটমহলবাসীর মনে অন্তত আশা জাগবে তাদের দাবি এবার নীতিনির্ধারকদের নজরে আসবে। উচ্চ আদালত অথবা গণমাধ্যম সকল প্রচেষ্টা সফল করে ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকার সচেষ্ট হবে এমন আশা করছে ৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী।
শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩, ২২ ভাদ্র ১৪২০, দৈনিক জনকণ্ঠ



http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2013-09-06&ni=147841

No comments:

Post a Comment