Wednesday, May 21, 2014

মানবমুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত আশৈশব বিপ্লবী পূণ্যপ্রাণ প্রণতি দস্তিদার হোক্ নব প্রজন্মের প্রেরণা-সুমি খান


স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার , যেখানে  এদেশের নারী -পুরুষ-হিন্দু-মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান  নির্বিশেষে আত্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্ব মানচিত্রে! সেই স্বপ্নে জীবন উৎসর্গকারী পূণ্য প্রাণ প্রণতি দস্তিদার! তাঁর বাবা খ্যাতিমান আইনজীবী নগেন্দ্র কুমার দাশের পথ ধরে স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে পরাধীন দেশের মুক্তি অর্জনে  শৈশবেই শপথ নিয়েছিলেন প্রণতি দস্তিদার, আমাদের রাণী মাসী ! আমৃত্যু বড়ো ত্যাগী এবং  সাধারণ জীবন যাপন করেছেন! তাঁর মহাপ্রয়াণে আমার বিনম্র প্রণতি!
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বিপ্লবী প্রণতি দস্তিদার আর নেই। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ মে , ২০১৪ বুধবার দুপুর পৌনে ১টায় তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। প্রণতি দস্তিদার প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা এবং ওয়ার্কার্স পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের সাবেক সদস্য প্রয়াত শরদিন্দু দস্তিদারের সহধর্মিনী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। 
বিভিন্ন সময়ে বারবার সাম্প্রদায়িক আক্রমনে জর্জরিত এদেশের মানবসমাজ। বিংশ শতাব্দীর  পাঁচের দশকের   ৪৮% হিন্দু বিতাড়িত এবং হত্যার শিকার হয়ে ৮% নেমে এসেছে। এ ধরণের বর্বর সন্ত্রাসের ক্রীড়নকেরা ঘোষণা দেন  সব মানুষকে হত্যা করে  'মুসলিম সাম্রাজ্য' প্রতিষ্ঠা করবেন কবে? আর এই বর্বর অমানবিক যন্ত্রনায় নির্যাতিতদের  বেদনা আর যন্ত্রনায় একাত্ম এবং  হতাশ হয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও   'হিন্দু'   সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। নারীবাদীরা ভাবেন নারী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার । তারা কি কখনো ভাবতে পারেন , একবিংশ শতাব্দীর এই 'সভ্য' সমাজ আর নিশ্চিন্ত কর্মসংস্থান, স্বাধীন মাতৃভূমির জন্যে কতো প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছে? 
১৯৩১ সালের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় খ্যাতিমান আইনজীবী নগেন্দ্র কুমার দাশের  ঘরে জন্ম নেন তাঁর কন্যা বিপ্লবী প্রণতি দস্তিদার ।  তাঁর  বড়ো বোন আরতি দস্তিদার ও একই ধারার বিপ্লবী ছিলেন। আরতি দত্ত মারা যান ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। আরতি দস্তিদার ছিলেন চট্টগ্রামের কিংবদন্তী কমিউনিষ্ট নেতা সুধাংশু দত্তের স্ত্রী। সুধাংশু দত্ত পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকা অবস্থাতেই সাতের দশকের শেষে মৃত্যুবরণ করেন। আরতি দস্তিদার চট্টগ্রামের পোস্তারপাড় বালিকা বিদ্যালয়ের  প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।  বছর পাঁচেক আগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। বিপ্লবী প্রণতি দস্তিদারের মৃত্যুতে  চট্টগ্রামের নারী আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই প্রজন্মের তারুণ্য কখনো ভাবতে পারবে কি ,কতোটা নির্যাতন সয়ে, কতোটা আত্মদান তাারা এদেশ আর এদেশের মানুষের জন্যে করে গেছেন। 
প্রণতি দস্তিদারের প্রজন্মের বিপ্লবীরা মানবমুক্তির সংগ্রামে সেই শৈশবেই জীবন উৎসর্গ করেছেন। নিজের চেষ্টায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তাঁরা দু'বোন।  তাঁদের বাবা স্বদেশী আন্দোলন সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকায় শৈশবেই  দেশমুক্তির সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেন প্রণতি দস্তিদার।১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর শরদিন্দু দস্তিদারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন প্রণতি।  সে সময়ে তিনি গ্ল্যাক্সো তে চাকরি করতেন। বিয়ের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবন আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে । স্বামী এবং পার্টির নির্দেশে সংসার পরিচালনার পাশাপাশি তিনি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। কয়েকদফায় গ্রেফতার হলে তাঁর চাকরি চলে যায়। রাজনৈতিক জীবনে প্রণতি দস্তিদার কয়েক দফা কারাগারে বন্দী হন ।  কারাগারে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন প্রণতি দস্তিদার। 

 আজ  মনে পড়ছে আমার আশৈশব এই বিপ্লবীদের সাথে ওঠাবসা ছিল আমার  বাবার কারণে । আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান কমিউনিষ্ট পার্টির  ষাটের দশকের অন্যতম সংগঠক ছিলেন; তাই এই বিপ্লবী দের সাথে  বাবার  প্রায় ছয় দশকের  সখ্য যা আমৃত্যু লালন করেছেন-তা স্মরণযোগ্য! সত্তরে  বামরাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত হয়- চীন পন্থী আর মস্কো পন্থী । বাবা মস্কোপন্থী আর শরদিন্দু কাকা, রাণী মাসী (প্রণতি দস্তিদার) , আরতি মাসী  চীনপন্থী। কিন্তু তাদের গুরুশিষ্যের শ্রদ্ধাপূর্ণ সখ্য  আমৃত্যু অটুট ছিল। সবসময়েই বাবার হাত ধরে যেতে হতো শরদিন্দু কাকার বাড়িতে । সেখানে দেখতাম রাণী মাসী (প্রণতি দস্তিদার) আর আরতি মাসী কে।  বাবাকে দেখতাম, শরদিন্দু কাকা আর এই দুই মাসীর সাথে আড্ডয় মেতে উঠতে। আমার ছেলে অতুলন ফুলকিতে পড়তো। বাবা তার দৌহিত্র অতুলন কে আনতে যেতেন। প্রতিদিন ফুলকি থেকে ফেরার পথে বাবা অতুলন কে সাথে নিয়ে নন্দনকানন ২ নং গলিতে  শরদিন্দু কাকার ঘরে চলে যেতেন!  শরদিন্দু কাকার মৃত্যু বার্ধক্যজনিত, তবু বাবার সে কী কান্না!!  এই প্রজন্মে বাম রাজনীতিক এবং তার অনুসারী দের মধ্যে যে অবক্ষয় , একে অন্যকে অশ্রদ্ধা এবং অসম্মান করার যে অপচর্চা, তা ঠেকাতে হলে এই মহামানব দের অবদান তুলে ধরতে হবে নতুন প্রচন্মের কাছে। এর কোন বিকল্প নেই!

কতো স্মৃতি  এই চিরপ্রণম্য বিপ্লবী দের নিয়ে! রাণী মাসীর এমনই হাস্যোজ্জ্বল মুখ মনে পড়ে বারবার । চিরদিনের সব দুঃখ  ভুলে যাঁর মুখে স্মিতহাসি চিরকাল লেগে ছিল!  তাঁর প্রয়াণে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে এই মহাপ্রাণ দের আত্মদানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ক্ষমতায় , নারীর ক্ষমতায়ন সর্বত্র। অথচ যারা এই সফলতার বীজ বুনেছিলেন প্রায় একশতক আগে-তাঁদের অবদান যদি আমরা স্মরণ না করি , ইতিহাস কখনো আমাদের ক্ষমা করবে না। রাণী মাসী, আপনার প্রতি এ জাতি যোগ্য সম্মান দেখাতে পারেনি, ক্ষমা করবেন! 

No comments:

Post a Comment