Friday, April 18, 2014

বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস ও সংস্কার- শামসুজ্জামান খান

বাংলাদেশ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অংশ। এই সভ্যতা কৃষি সভ্যতা। নদী তীরবর্তী গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশের এই সভ্যতা বেশ প্রাচীন। মিসরের নীলনদ-তীরবর্তী অঞ্চলে যেমন প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা, চীন ও মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা তাও নদীতীরবর্তী এবং সুপ্রাচীন। প্রাচীন কৃষি সভ্যতার আনুষঙ্গিক নানা সংস্কার-বিশ্বাসও এই সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। এসব সংস্কার প্রথমে কৃষি উৎসবের অঙ্গীভূত ছিল, পরে নববর্ষ উৎসব চালু হলে এসব সংস্কারমূলক আঞ্চলিক উৎসব তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রাচীন এমন একটি সংস্কারমূলক উৎসবের নাম ‘আমানি’ উৎসব। আমানি ছিল মেয়েলি উৎসব, এর লক্ষ্য ছিল পরিবারের কল্যাণ ও পারিবারিক কৃষির সমৃদ্ধি কামনামূলক। এই পারিবারিক উৎসবের আচার সম্পন্ন করতেন বাড়ির মহিলাকর্ত্রী। কৃষি আবিষ্কারে নারীর পথিকৃতের ভূমিকা এবং তারই ফলে নারীতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্মৃতিচিহ্নবাহী বলে কেউ কেউ এ আচারমূলক অনুষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করেন। এ ছাড়া সমাজে শত্রুনিধনের আচার পালন করার রীতি ছিল বছরের প্রথম দিনে। লোকবিশ্বাস ছিল, এতে সারা বছর শত্রুর আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে নববর্ষে উদযাপন করা হতো বিগত বছরের গ্লানি মুছে ফেলার কামনায় কিছু আচার-অনুষ্ঠানও। চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায়। অন্যদিকে চৈত্রসংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখের দিনে গাজন বা চড়ক অনুষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে নতুন বছরের শুভ কামনা। লোকবিশ্বাস : চড়কের বাণফোঁড়ের ক্লেশের মধ্য দিয়ে বিগত বছরের পাপক্ষয়ের আরাধনা এবং নতুন বছরের সুখ কামনা করা হতো। আবার অন্য একটা চিত্রও পাওয়া যাচ্ছে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন : ‘প্রাচীনকালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব হতো। দোলযাত্রা বা হোলি সেই উৎসবেরই স্মারক।’ ‘দোলযাত্রা’ ও ‘হোলি’ আনন্দোৎসব, চড়ক ক্লেশ ও বেদনার। তাহলে দেখা যাচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষকে জোড়া উৎসব ধরা হলে তা একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনা দু ধরনের উৎসবকেই অঙ্গীভূত করেছে।
দুই
বাংলা নববর্ষের উৎসব এখন বাংলা বর্ষপঞ্জির বোশেখ মাসের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। বহু আগে নববর্ষ যে অন্য সময়ে হতো তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি ফাল্গুনী পূর্ণিমার তিথিতে নববর্ষের কথা উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিতায় অগ্রহায়ণ বন্দিত হয়েছে এই ভাষায়, ‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জনমতার, নাই যার চাষ।’ কবির অগ্রহায়ণ বন্দনার কারণ যতদূর জানা যায়, তখন অগ্রহায়ণ মাসে নববর্ষ ছিল। তবে কখন কীভাবে বৈশাখ মাসে নববর্ষ উদযাপন শুরু হলো তা জানা যায় না। কিন্তু মুকুন্দরামের সময়ে অগ্রহায়ণ মাসে যদি নববর্ষ হয়ে থাকে তাহলে ভারতচন্দ্রের সময়ে যে বৈশাখে নববর্ষ হয়ে গেছে তার প্রমাণ আছে তাঁরই কবিতায় : ‘বৈশাখে এ দেশে বড় সুখের সময়। নানা ফুল গন্ধে মন্দ গন্ধবহ হয়।’ তাছাড়া বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এবং আলীবদ্দী খাঁ বৈশাখের প্রথম দিনে পুণ্যাহ করতেন। এ দেশের কবিদের কবিতা ও গানে নববর্ষের নানা আবহ ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নববর্ষের উৎসবকে ভিন্ন তাৎপর্য ও নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। ফলে বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক মিলনমেলা। স্বার্থহীন বা লোভ-লালসাহীন মানবমৈত্রীর গভীরতর দ্যোতনায় বৈশাখের এ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে সর্বসম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ও ঐক্যচেতনার প্রতীক। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাঙালি জাতির এক সর্বজননীন মহান উৎসব। সকল বাঙালির মিলনমেলা। কৌম, গোত্র বা সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক ক্রিয়াকরণধর্মী (Ritualistic) আঞ্চলিক নববর্ষ উৎসব-আচারের জায়গায় গড়ে উঠতে থাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ঐতিহ্যভিত্তিক নতুন এক জাতীয় দিবস : বাংলা নববর্ষ, বাঙালির নববর্ষ।
তিন
সুপ্রাচীনকাল থেকে বঙ্গদেশে বাঙালি কৃষিজীবী মুসলমান সম্প্রদায় নানা দেশীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ আবাহন করেছেন। হিন্দু জমিদারের পুণ্যাহ আর দোকানদার-মহাজনের হালখাতা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো অংশ নিয়েছে। জমিদারি উচ্ছেদের পর পুণ্যাহ অবলুপ্ত হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিতে নগদ পয়সার নিত্যনৈমিত্ত প্রবাহ না থাকায় বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেচাকেনা ছিল অপরিহার্য। ফলে হালখাতার গুরুত্বও ছিল বিরাট। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন ভোক্তার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বাংলাদেশ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ঢুকে যাওয়ায় মানুষের হাতে নগদ পয়সাও জমা হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কেনাকাটায় বাকির ব্যবসা প্রায় উঠেই গেছে। আর তাই জৌলুস হারিয়েছে হালখাতা অনুষ্ঠানটিও। তবে নববর্ষের অন্যান্য গ্রামীণ অনুষ্ঠান ও মেলা এখনো কিছু পরিমাণে চালু আছে, উদাহরণ হিসেবে লাঠিখেলা বা কাঠি নাচ (কুষ্টিয়া, নড়াইল ও কিশোরগঞ্জ), ষাঁড়ের লড়াই (কেন্দুয়া, নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চল), মোরগের লড়াই (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), গরুর দৌড় (মুন্সিগঞ্জ), হাডুডু খেলা (মানিকগঞ্জসহ অন্যান্য স্থানে) এবং সারা দেশে নানা রকমের মেলার নাম উল্লেখ করা যায়। এসব অনুষ্ঠান-উৎসব বা প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক আনন্দের উৎস এবং ঐতিহ্যে অংশগ্রহণের উপযোগী মাধ্যম। কিন্তু সর্বজনীন জাতীয় বিস্তার এসব অনুষ্ঠানের ছিল না এবং এসব অনুষ্ঠানকে পরিকল্পনার মাধ্যমে নববর্ষের উৎসবের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তও করে নেওয়া হয় নি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নব উদ্ভূত শিক্ষিত নগরবাসী বাঙালি মুসলমান ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যেও তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নানা গোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকরণকে (Rituals) জাতীয় আধারে বিন্যস্ত করে নতুন এক সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগঠনমূলক কর্মকা-ে শামিল হতে প্রয়াসী হয়। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক এবং পূর্ব বাংলায় তার অনুসারীরা বাঙালির সমন্বিত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করেছে, একে নানা কৌশলে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কারণ এর মধ্যে তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যুবীজের অঙ্কুরোদগম লক্ষ করেছে। তাই এর বিরুদ্ধে শুরু করেছে বাঙালিকে জাতিগত নিপীড়ন তার আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেওয়ার কূটকৌশল। এই ধারাতেই বাধা এসেছে বাঙালির নববর্ষ উদযাপনেও। ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরই শুধু যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে বাঙালির জাতিগঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দান করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে বাঙালি তার নববর্ষ উদযাপন করে।
চার
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগৃতির উৎসমুখ খুলে যাওয়ায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে স্বৈরশাসন চালু এবং রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি সংস্কৃতিক্ষেত্রের প্রগতিশীল সক্রিয়বাদীদের বিপুলহারে গ্রেপ্তার করায় সংস্কৃতির মুক্তধারার যে উৎসমুখটি খুলে গিয়েছিল তা আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৫৮-এ আইয়ুবের সামরিক শাসন জারি হওয়ায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা, গণমুখী সংস্কৃতির অনুশীলন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু জনতার সংগ্রাম থেমে থাকতে পারে না। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগ বের করে গোপন লিফলেট ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’। ১৯৬২ সালে চার ছাত্রনেতার নেতৃত্বে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গঠন, এই বছরেই ‘দেশ ও কৃষ্টি’ বইয়ে বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী প্রপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলন সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ওপর তীব্র আঘাত হানতে থাকে এবং বাঙালির এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন তার রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। এই সময়ের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ এক নতুন ও নব দিকনির্দেশক স্লোগান হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাঙালিত্বের চেতনার তীব্র চাপে সে বছর (১৯৬৪) প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। সেদিন ঢাকার বিভিন্ন নববর্ষ অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব জনসমাগম হয়। বাংলা একাডেমী, পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ, ছায়ানট (প্রতিষ্ঠা ১৯৬১), পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ, নিক্বণ ললিতকলা কেন্দ্র, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্র সংসদ, গীতিকলা সংসদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাঙ্গামার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও বাংলা একাডেমীর বটতলায় ‘ঐক্যতানের’ অনুষ্ঠানে এত দর্শক-শ্রোতার সমাগম হয় যে, ভিড়ের চাপে কয়েকজন আহত হয়। বাঙালির নববর্ষ অনুষ্ঠানে এত বিপুল মানুষের উপস্থিতি দেখে দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার বিস্ময় প্রকাশ করে।
এরপর বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে রূপ দিয়ে রমনার অশ্বত্থমূলে অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৬ সারে বঙ্গবন্ধুর ‘ছয় দফা’ আন্দোলন শুরু করার পর এই আয়োজন এক নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য লাভ করে। সেই থেকে বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
পাঁচ
এবার আমরা বাঙালির বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করব। নববর্ষ উৎসব সব দেশেই সর্বজনীন উৎসব। সে জনেই সমাজ বিকাশের ধারায় একটা উন্নত পর্যায়েই কোনো জাতির নববর্ষ উৎসব ও তার পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটে। তাই এর একটা ধারাবাহিক ইতিহাস থাকে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের দিক থেকে ব্যাখ্যা করলে বাংলায় বর্ষবরণ ও বাঙালির বর্ষপঞ্জি উদ্ভাবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা অন্যান্য সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত প্রক্রিয়ারই পরিচয় বহন করে।
ইংরেজি ‘ক্যালেন্ডার’ শব্দটি মূলে ল্যাটিন শব্দজাত। যত দূর জানা যায়, এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো : ‘হিসাব-বই’। অন্যদিকে ইংরেজি আলমানাক শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে বলে অনুমিত হয়। ‘আলমানাক’ যে অর্থ প্রকাশ করে তার বাংলা অর্থ করলে ‘পঞ্জিকা’ বলা যেতে পারে। ক্যালেন্ডার বলি, আর আলমানাক বলি–দুয়েরই জন্মস্থান প্রাচীন মিসর। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন পঞ্জিকা মিসরে প্রস্তুত হয়েছিল বলে পঞ্জিকাকে মিসরীয় সভ্যতার অবদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মিসরীয়রাই প্রায় ৬ হাজার বছর আগে চান্দ্র হিসাবের ভুল চিহ্নিত করে সৌর পদ্ধতির গণনা শুরু করে। নীলনদ-তীরবর্তী এই বাসিন্দারা অত আগে প্রায় ৩৬৫ দিনে বছরের হিসাবের খুব কাছাকাছি পৌঁছে (The Calender : Devid Erwing Duncan : Fourth Estate, London, 1998)। এখানে খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার অপরিহার্য সম্পর্ক। মিসরকে নীলনদের দান বলেছেন বিশ্বের প্রথম ঐতিহাসিক হেরোডেটাস। নীলনদের একেিদক সবুজ কৃষিক্ষেত্র, অন্যদিকে ধূসর মরুভূমি। নীলনদ না থাকলে মিসর কৃষি সভ্যতার জননীস্বরূপ হতে পারত না। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের সমুদ্রতীরবর্তী রোমে রোমান ক্যালেন্ডার (ইংরেজি ক্যালেন্ডার কথাটি ভূল। কারণ ওই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে রোমের ক্যাথলিক ধর্মের সম্পর্ক ছিল–প্রটেস্টান্ট ইংরেজরা তাই ওই ক্যালেন্ডার ১৭০ বছর পর্যন্ত গ্রহণ করে নি) বা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়ে তা পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বহাল থাকে। পরে সে ক্যালেন্ডারের ভুলভ্রান্তি শুধরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়। সে ক্যালেন্ডার এখন সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেছে।
আমরা বলেছি, কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার সম্পর্ক নিবিড় ও অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ আমরা মিসরীয় ক্যালেন্ডার এবং ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের কথা বলব। মিসরীয় সভ্যতায় বিশ্বের প্রথম যে ক্যালেন্ডার তৈরি হয় তাতে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির প্রভাবই ছিল প্রধান। কারণ কৃষি ঋতুনির্ভর। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফসলের বীজ সংগ্রহ, বীজ বপন, ফসলের পরিচর্যা ফসল কাটা, সবকিছুই সময়মতো করা চাই। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার কৃষির জন্য উপযোগী নয়। চান্দ্র ক্যালেন্ডারে বছরে সাড়ে ১০ দিনের হেরফের হয়। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার (হিজরি ইত্যাদি) অনুসরণ করলে এ বছরে যখন ফসল বোনা হবে, তিন বছর পরে তা এক মাস পিছিয়ে যাবে। কৃষি উৎপাদন ও তার ব্যবস্থাপনায় তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে সৌর ক্যালেন্ডার প্রচলন হয়। মিসরীয় ক্যালেন্ডারেই এ সংশোধন করা হয়। বহু পরে (১৫৫২) ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ত্রুটি দূর করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চন্দ্র ও সূর্যের আবর্তনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়। ফলে জাগতিক কর্মকা- সূর্যের আবর্তননির্ভর বা ঋতুনির্ভর আর ধর্মীয় উৎসবাদি চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আসলে পঞ্জিকার মধ্যেও আমাদের সমাজ জীবনের ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ দুই সত্তাই একত্রে অবস্থান করাতে পঞ্জিকা জীবনের পূর্ণতারও প্রতীক।
বাংলা ও বিহারের (বাংলার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এবং বিহারের ঐতিহাসিক অধ্যাপক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল প্রমুখ) প্রখ্যাত বিজ্ঞানী-ঐতিহাসিক মনে করেন বাংলা সনের উদ্ভাবক সম্রাট আকবর। তিনি তাঁর রাজ্য শাসনের ২৯ বছরে (হিজরি ৯৯২ এবং ১৫৮৪ সালে) পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দেন। তিনি তার নবরতœসভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজির নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সনকে সৌর ও চান্দ্র বৈশিষ্ট্যে সমন্বিত করেন। তিনি একটি কেন্দ্রীয় ইলাহি সন করেছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলের ঋতু ও কৃষি উৎপাদনের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সুবিধার্থে নানা আঞ্চলিক সনের প্রবর্তন করেন বা আঞ্চলিক সনের কাঠামো নির্দেশ করে দেন। সেই কাঠমো-সূত্র অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেন। আমরা মনে করি নবাব মুরশিদ কুলি খান বাংলা সনে প্রবর্তক। আকবর অন্য যে আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন তা হলো উড়িষ্যার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। এই সনগুলোকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি ফসলি সন। “আইন-ই-আকবরি থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তার সে আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়েছিল বলে লক্ষ করি। কেননা বাংলা সন যেমন হিজরি সন নয়, তেমনি এটি ইলাহি সনের উপজাত হলেও মূল ইলাহি সন থেকে ভিন্ন। হিজরি সন নয়, তেমনি এটি ইলাহি সনের উপজাত হলেও মূল ইলাহি সন থেকে ভিন্ন। হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করা হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের মতো, তবে এটি শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকু যে, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে।”
বাংলা সন একেবারেই স্বকীয়। আমাদের এ অঞ্চলে ২৪টির মতো সন ছিল। সেসব সন রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা সীমিত অঞ্চলের (ত্রিপুরা রাজ্য), কিন্তু বাংলা সন বাংলাদেশ ও জাতির নামে। তাই এ সন বাঙালির এত প্রিয়, জনজীবনে এত গুরুত্ববহ।
ভারত উপমহাদেশে পঞ্জিকা-সংস্কার উদ্যোগ প্রথমে নেওয়া হয় মহারাষ্ট্রে। লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক, শঙ্করবালকৃষ্ণ দীক্ষিত (দ্র. The Indian Calender, Robert Sewel & Sankara Balkrishan Dikshit : M. B. Das Publishers, Delhi, 1995), ভেংকটেশ বাপুশাস্ত্রী কেতকর, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, ড. মেঘনাদ সাহা ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখ। শহীদুল্লাহ্ বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ছিলেন। তাঁর সংস্কারের পর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্স শহীদুল্লাহ্ কমিটির সংস্কার প্রস্তাবনার উন্নয়ন সাধন করেন। তা নিম্নরূপ :
১. সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩০ দিন গণ্য করা হবে।
২. গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ গণ্য করা হবে।
৩. অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণ্য হবে।
৪. আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তিত হবে।
উপসংহারে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় বাংলা সন-তারিখে যে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে, সে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা দরকার। এই অসামঞ্জস্যের ফলে নববর্ষ, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তি দুই অঞ্চলে একদিন আগে পরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর দায় বাংলাদেশের নয়। শহীদুল্লাহ্র সংস্কারে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার সংস্কার প্রস্তাবকেই বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকা সংস্কারে গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভারতে ড. সাহার প্রস্তাবের কিছু সংশোধন করে এস.পি. পাণ্ডে কমিটি ১৪ই এপ্রিলে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত পাণ্ডে শীর্ষক কমিটির রিপোর্টে বলা হয় “The Year shall start with the month of vaisaka when the sun enters niranayana mesa rasi which will be 14th April of the Gregorian calendar. (Indian Journal of History of sciences 39.4(2004) 519-534). বাংলা একাডেমীর টাস্কফোর্সও একই তারিখে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করেছেন এবং বাংলাদেশে সরকারিভাবে তা চালু হয়েছে। কিন্তু ভারতে সেখানকার পঞ্জিকাকারদের ব্যবসায়িক স্বার্থে পান্ডে কমিটির রিপোর্ট কার্যকর হয় নি।

শামসুজ্জামান খান: প্রাবন্ধিক এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক।

Friday, April 11, 2014

শেখ কামাল ও মেজর ডালিমের স্ত্রীকে নিয়ে বিএনপি জামাতের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচন : ডলি জহুরের ইন্টারভিউ


অভিনেত্রী ডলি জহুর, এবং বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল পত্রিকার সংস্কৃতিমুখ বিভাগের জন্য ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম দেশের প্রখ্যাত সিনিয়র অভিনেত্রী ডলি জহুরের কাছে। তিন পাতার বিশাল সেই ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল কিছু রাজনৈতিক প্রসঙ্গ কেটে দিয়ে। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু কিছুই করার ছিল না । শুধু একটা বিষয় অনুধাবণ করেছি কালে কালে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উপর যেসব মিথ্যে অভিযোগ দেশময় ছড়িয়ে আছে তার অন্যতম বাহন ছিল গণমাধ্যম। এমনকী এই সময়ে এসেও কেউ সত্যি কথাগুলো প্রকাশ করতে চায় না। পাছে আওয়ামী লীগের সীল লেগে যায়। কিন্তু আমার এই নিয়ে কোন মাথাব্যথা নাই। জাতির পিতার পরিবারকে টম এন্ড জেরী কার্টুন বানানো হবে কতিপয় স্বার্থবাদী মানুষের জন্য সেটা আমি মানতে পারি না। তাই যেসব কথা ডলি জহুরের ইন্টারভিউ থেকে কেটে ফেলা হয়েছিল সেই কথাগুলো তুলে ধরলাম। কারণ এখনই সুসময় সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের।

স্বার্থবাদীরা আজ বিপন্ন হওয়ার অপেক্ষায়। অবশ্য দুনিয়াতে কখনই স্বার্থবাদীরা টিকে থাকে নি। যাই হোক ওইদিনের ইন্টারভিউয়ে ডলি জহুরের জন্য একটা প্রশ্ন ছিল-ম্যাডাম আপনার মঞ্চ নাটকের শুরুটা কিভাবে? তখন তিনি নানা কথা বলেন। সেসব কথার ফাঁকে উঠে বঙ্গবন্ধু পুত্র আসে শেখ কামালের কথা। আমি তার মুখে শেখ কামাল সম্পর্কে এসব নতুন কথা শুনে একেবারেই তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। শেয়ার করছি আপনাদের সাথেও।

শেখ কামাল আর ডলি জহুর একই নাট্যদলে কাজ করতেন। প্রতিদিন বিকাল থেকে শুরু হত নাটকের রিহার্সাল-একটানা চলত রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত। রিহার্সাল শেষে ডলি জহুর বাসায় ফিরতেন শেখ কামালের সাথে। কারণ ডলি জহুররা তখন হাতিরপুলে থাকতেন। ডলি জহুরকে বাসায় পৌছে দিয়ে তারপর ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসায় যেতে কামাল। ডলি জহুর আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন-১৯৭৩-৭৪ সালে ঢাকা শহরে রাত ১০টা মানেই অনেক রাত। রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। সেখানে প্রতিদিন কামাল ভাই আমাকে ১১টা-১২টার দিকে বাসায় পৌছে দিতেন।

প্রেসিডেণ্টের ছেলে হয়েও তার কাছে সবসময় টাকা থাকত না। এ নিয়ে অনেক ক্ষ্যাপাতাম। শুধু আমি না ক্যাম্পাসেও তার বন্ধুরা তাকে এই জন্য ক্ষ্যাপাত। যেদিন কামাল ভাইয়ের কাছে টাকা থাকত না সেদিন রাতে হেঁটে যেতাম। যেদিন টাকা থাকত সেদিন যেতাম রিকশায়। কত রাতের পরে রাত উনার সাথে আমি একা বাসায় ফিরেছি অথচ এক বারের জন্যও আমি তাকে আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাতে দেখিনি। আমি উনার ছোট বোন শেখ রেহানার বান্ধবী ছিলাম। ছেলেরা ছোটবোনের বান্ধবীদের সাথে কতরকম দুষ্টামী করে। উনি কোনদিন তাও করেন নি। ভুল করেও বলেন নি-ডলি তোর হাতটা দে তো ধরি। এক কথায় কামাল ভাই ছিলেন ভাইয়ের মতই ভাই। শুধু আমি কেন যেসব মেয়েরাই উনার সাথে মিশত সবাই এইকথা স্বীকার করবেন। আর এই দেশের মানুষ তাকে নিয়ে কতরকমের অপপ্রচার চালালো। কামাল ভাই নাকি কার বৌকে তুলে নিয়ে গেছেন হ্যান ত্যান। মানুষ এত মিথ্যাবাদী হয় কি করে আমি ভেবে পাই না! স্বার্থ মানুষকে ভিতর-বাহির থেকেই নষ্ট করে দেয়।

তাছাড়া কামাল ভাই ছিলেন প্রেসিডেন্টের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য শত শত মেয়ে পাগল। কখনও কোনদিন আমরা তাকে সেসব মেয়েদের পাল্লায় পরতে দেখিনি। তিনি কি পারতেন না সেসব মেয়েদের সাথে নোংরামী করতে? এখানেই শেষ নয়। সুলতানা কামালকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন কামাল ভাই। সুলতানা আপ ছিলেন নামকরা একজন খেলোয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলার জন্য তিনি এক নামে পরিচিত। অনেক লম্বা আর শক্ত পেটা শরীর। আমরা উনাকে ভয় পেতাম। সহজে কেউ সুলতানা আপার কাছে যেতাম না। ছেলেরাও ভয় পেত তাকে। এড়িয়ে চলত। সেই সুলতানা আপাকে পছন্দ করে বসলেন কামাল ভাই। আর তার হয়ে সুলতানা আপার কাছে এই কথাটা বলার দ্বায়িত্ব দেন
আমাকে। আমি তো ভয়েই শেষ। না করে দিলাম। কিন্তু কামাল ভাইয়ের জোরাজোরিতে রাজী হলাম। কথা দিলাম সুলতানা আপাকে জানাব যে কামাল ভাই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু দিন যায়, মাস যায় জানানো আর হয় না। কি করে হবে? আমি যতবার সুলতানা আপার কাছে এই কথা বলতে গিয়েছি ততবারই ভয়ে আমার গলা শুকিয়েছে। আমি ভীতু,....তেলাপোকা দেখে মরে যাই”...এসব কত্ত রকমের কথা শুনালো কামাল ভাই।
অবশেষে নিজেই একদিন সুলতানা আপাকে জানালেন তার মনের কথা। হলেন প্রত্যাখ্যাত। সুলতানা আপা বলে দিলেন প্রেম ট্রেম করতে পারবেন না। এতই যদি ভাল লাগে তবে যেন বাসায় লোক পাঠায়। তাই করেছিলেন কামাল ভাই। এবার ভেবে দেখ,যে মানুষ একটা মেয়েকে ভয় পেয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারে না, যে মানুষ তার ভালোবাসার কথা জানাতে আড়াই বছর সময় নেয়, সে মানুষ কি করে অন্যের বউ তুলে নিল???
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশের মানুষকে শান্ত রাখতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি ঘৃনার জন্ম দিতে সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছে। কামাল ভাইও সেই অপচেষ্টার শিকার। ৫ টাকার বাদাম কিনে যে ছেলে তার ছোট বোন আর তার বান্ধবীদের খুশি করতে পারত না তার নামেই ছড়ানো হয়েছে ব্যাংক লুটের কিচ্ছা-কাহিনী। আমার কথা হল কামাল ভাই যদি এত বড়ই লুটেরা হবে তাহলে সেসব টাকা গেল কই??? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কিছুই পাওয়া যায় নি। পাওয়া যায় নি উল্লেখ করার মত তেমন কোন ব্যাংক একাউন্ট। তাহলে ব্যাংক লুটের টাকা কোথায় গেল?
Photo: শেখ কামাল ও মেজর ডালিমের স্ত্রীকে নিয়ে বিএনপি জামাতের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচন —

''অভিনেত্রী ডলি জহুর, এবং বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল আমার পত্রিকার সংস্কৃতিমুখ বিভাগের জন্য ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম দেশের প্রখ্যাত সিনিয়র অভিনেত্রী ডলি জহুরের কাছে। তিন পাতার বিশাল সেই ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল কিছু রাজনৈতিক প্রসঙ্গ কেটে দিয়ে। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু কিছুই করার ছিল। শুধু একটা বিষয় অনুধাবণ করেছি কালে কালে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উপর যেসব মিথ্যে অভিযোগ দেশময় ছড়িয়ে আছে তার অন্যতম বাহন ছিল গণমাধ্যম। এমনকী এই সময়ে এসেও কেউ সত্যি কথাগুলো প্রকাশ করতে চায় না। পাছে আওয়ামী লীগের সীল লেগে যায়। কিন্তু আমার এই নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নাই। জাতির পিতার পরিবারকে টম এন্ড জেরী কার্টুন বানানো হবে কতিপয় স্বার্থবাদী মানুষের জন্য সেটা আমি মানতে পারি না। তাই যেসব কথা ডলি জহুরের ইন্টারভিউ থেকে কেটে ফেলা হয়েছিল সেই কথাগুলো তুলে ধরলাম। কারণ এখনই সুসময় সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের।

স্বার্থবাদীরা আজ বিপন্ন হওয়ার অপেক্ষায়। অবশ্য দুনিয়াতে কখনই স্বার্থবাদীরা টিকে থাকে নি। যাই হোক ওইদিনের ইন্টারভিউয়ে ডলি জহুরের জন্য একটা প্রশ্ন ছিল-ম্যাডাম আপনার মঞ্চ নাটকের শুরুটা কিভাবে? তখন তিনি নানা কথা বলেন। সেসব কথার ফাঁকে উঠে বঙ্গবন্ধু পুত্র আসে শেখ কামালের কথা। আমি তার মুখে শেখ কামাল সম্পর্কে এসব নতুন কথা শুনে একেবারেই তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। শেয়ার করছি আপনাদের সাথেও। শেখ কামাল আর ডলি জহুর একই নাট্যদলে কাজ করতেন। প্রতিদিন বিকাল থেকে শুরু হত নাটকের রিহার্সাল-একটানা চলত রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত। রিহার্সাল শেষে ডলি জহুর বাসায় ফিরতেন শেখ কামালের সাথে। কারণ ডলি জহুররা তখন হাতিরপুলে থাকতেন। ডলি জহুরকে বাসায় পৌছে দিয়ে তারপর ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসায় যেতে কামাল। ডলি জহুর আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন-১৯৭৩-৭৪ সালে ঢাকা শহরে রাত ১০টা মানেই অনেক রাত। রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। সেখানে প্রতিদিন কামাল ভাই আমাকে ১১টা-১২টার দিকে বাসায় পৌছে দিতেন। প্রেসিডেণ্টের ছেলে হয়েও তার কাছে সবসময় টাকা থাকত না। এ নিয়ে অনেক ক্ষ্যাপাতাম। শুধু
আমি না ক্যাম্পাসেও তার বন্ধুরা তাকে এই জন্য ক্ষ্যাপাত। যেদিন কামাল ভাইয়ের কাছে টাকা থাকত না সেদিন রাতে হেঁটে যেতাম। যেদিন টাকা থাকত সেদিন যেতাম রিকশায়। কত রাতের পরে রাত উনার সাথে আমি একা বাসায় ফিরেছি অথচ এক বারের জন্যও আমি তাকে আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাতে দেখিনি। আমি উনার ছোট বোন শেখ রেহানার বান্ধবী ছিলাম। ছেলেরা ছোটবোনের বান্ধবীদের সাথে কতরকম দুষ্টামী করে। উনি কোনদিন তাও করেন নি। ভুল করেও বলেন নি-ডলি তোর হাতটা দে তো ধরি। এক কথায় কামাল ভাই ছিলেন ভাইয়ের মতই ভাই। শুধু আমি কেন যেসব মেয়েরাই উনার সাথে মিশত সবাই এইকথা স্বীকার করবেন। আর এই দেশের মানুষ তাকে নিয়ে কতরকমের অপপ্রচার চালালো। কামাল ভাই নাকি কার বৌকে তুলে নিয়ে গেছেন হ্যান ত্যান। মানুষ এত মিথ্যাবাদী হয় কি করে আমি ভেবে পাই না! স্বার্থ মানুষকে ভিতর-বাহির থেকেই নষ্ট করে দেয়।

তাছাড়া কামাল ভাই ছিলেন প্রেসিডেন্টের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য শত শত মেয়ে পাগল। কখনও কোনদিন আমরা তাকে সেসব মেয়েদের পাল্লায় পরতে দেখিনি। তিনি কি পারতেন না সেসব মেয়েদের সাথে নোংরামী করতে? এখানেই শেষ নয়। সুলতানা কামালকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন কামাল ভাই। সুলতানা আপ ছিলেন নামকরা একজন খেলোয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলার জন্য তিনি এক নামে পরিচিত। অনেক লম্বা আর শক্ত পেটা শরীর। আমরা উনাকে ভয় পেতাম। সহজে কেউ সুলতানা আপার কাছে যেতাম না। ছেলেরাও ভয় পেত তাকে। এড়িয়ে চলত। সেই সুলতানা আপাকে পছন্দ করে বসলেন কামাল ভাই। আর তার হয়ে সুলতানা আপার কাছে এই কথাটা বলার দ্বায়িত্ব দেন
আমাকে। আমি তো ভয়েই শেষ। না করে দিলাম। কিন্তু কামাল ভাইয়ের জোরাজোরিতে রাজী হলাম। কথা দিলাম সুলতানা আপাকে জানাব যে কামাল ভাই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু দিন যায়, মাস যায় জানানো আর হয় না। কি করে হবে? আমি যতবার সুলতানা আপার কাছে এই কথা বলতে গিয়েছি ততবারই ভয়ে আমার গলা শুকিয়েছে। আমি ভীতু,
তেলাপকা দেখে মরে যা এসব কত্ত রকমের কথা শুনালো কামাল ভাই।
অবশেষে নিজেই একদিন সুলতানা আপাকে জানালেন তার মনের কথা। হলেন প্রত্যাখ্যাত। সুলতানা আপা বলে দিলেন প্রেম ট্রেম করতে পারবেন না। এতই যদি ভাল লাগে তবে যেন বাসায় লোক পাঠায়। তাই করেছিলেন কামাল ভাই। এবার ভেবে দেখ,যে মানুষ একটা মেয়েকে ভয় পেয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারে না, যে মানুষ তার ভালোবাসার কথা জানাতে আড়াই বছর সময় নেয়, সে মানুষ কি করে অন্যের বউ তুলে নিল???
 বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশের মানুষকে শান্ত রাখতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি ঘৃনার জন্ম দিতে সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছে। কামাল ভাইও সেই অপচেষ্টার শিকার। ৫ টাকার বাদাম কিনে যে ছেলে তার ছোট বোন আর তার বান্ধবীদের খুশি করতে পারত না তার নামেই ছড়ানো হয়েছে ব্যাংক লুটের কিচ্ছা-কাহিনী। আমার কথা হল কামাল ভাই যদি এত বড়ই লুটেরা হবে তাহলে সেসব টাকা গেল কই??? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কিছুই পাওয়া যায় নি। পাওয়া যায় নি উল্লেখ করার মত তেমন কোন ব্যাংক একাউন্ট। তাহলে ব্যাংক লুটের টাকা কোথায় গেল?

পথে পথে পাথর - শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা


মানুষ যখন ইতিহাসের পাতা উল্টায়
সময় ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গলের
তাড়া-খাওয়া চিত্রল হরিণের মতো
দল বেঁধে লাফিয়ে-লাফিয়ে ছোটে...।
কী সাংঘাতিক সুন্দর, কী চমৎকার,
কী সংঘাতময় অনতিক্রম্য সে-দৃশ্য!
আমি ধাবমান ব্যাঘ্র ও হরিণের
প্রাণপণ সংগ্রাম ও সংঘর্ষের
দুর্বিনীত দ্যুতির ভিতরে
প্রত্যক্ষ করি কালের যাত্রাকে।
প্রকৃতির অনতিক্রম্য এই নিষ্ঠুরতাকে
আমি পাশ কাটিয়ে চলতে চেয়েছি।
কিন্তু পারিনি। বাঘ আর হরিণের মধ্যে
ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আমার সময়।
কখনও সে বাঘের ছাল পরেছে গায়ে,
কখনওবা সে সেজেছে চিত্রল হরিণ।
আমার বুকের ভিতরে তারই রক্তঝর্ণা...
মাধবকুন্ডের ক্ষীণ ঝর্নাধারার মতোই
মাথা কুটেছে বাংলাদেশের মাটিতে।
আমি প্রার্থনা করেছি বৌদ্ধমন্ত্র,
জগতের সকল প্রাণীর মঙ্গল হোক।
সর্বে সত্তা সুখিনা ভবন্তু।
জানি শেষ-পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হবে সত্য।
মুজিবের স্বপ্নধারায় সৃষ্ট এই বাংলাদেশ
তাঁরই রক্তধারা নিয়ে প্রবাহিত হবে নিরন্তর,
কৃতজ্ঞবাঙালিচিত্তে চিরদিন, চিরকাল।
শেখ হাসিনা, অপনার বেদনা আমি জানি।
আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে
আপনি পা রেখেছেন মাত্র।

Friday, April 4, 2014

নিঃসঙ্গ শেরপা শেখ হাসিনা ॥ কাকে নিয়ে রাজনীতি করবেন তিনি? - স্বদেশ রায়

তিনি সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিলেন। মন্ত্রী হয়েছেন বলে নয়, সততার জন্য। আওয়ামী লীগের বড় নেতা হওয়া সত্ত্বেও নবাবপুর রোডের ২শ’ টাকার হোটেল থেকে তিনি এসে মন্ত্রী হয়েছিলেন। আমাদের এই সামরিক শাসনতাড়িত লোভ ও দুর্নীতির আকণ্ঠ মানসিকতার দেশে সেটা ছিল অনেক বড় সংবাদ। সেই সংবাদের পর অনেক দিন গেছে। তাকে নিয়ে আর কিছুই জানি না। নানান কারণে এখন আর মাঠের নিউজ করার সময় মেলে না। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখাও হয় কম। তাই অনেক খবর না জানা থেকে যায়। তারপরেও ঘুষ ও দুর্নীতি থেকে যে অধিকাংশ মুক্ত নয় সেটুকু সকলে বোঝে। তারপরেও কিছু কিছু জায়গায় তো আস্থা রাখতে হয়! নইলে পৃথিবীতে চন্দ্র সূর্য উঠবে কাদের জন্য! কিন্তু সেদিন যে খবর পেলাম তাতে মনে হলো চন্দ্র সূর্য অনেক কষ্টে আলো দিচ্ছে এ পোড়া দেশে।
দেখা হয়েছিল গ্রামের এক বেকার তরুণের সঙ্গে। গত তিন চার বছরই সে চাকরি খুঁজছে। চাকরির তদ্বিরের জন্যে সে গিয়েছিল দুই শ’ টাকার হোটেল থেকে এসে যিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন তাঁর কাছে। গেলেই তার পিএস তাকে বলে, সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে হবে। দিয়েছিলও সে। তার কথা এ পর্যন্ত শুনে জোর দিয়ে বলি, এসব ওই বাটপাড় পিএসদের কাজ। ছেলেটি জোর দিয়ে বলল, না-পিএস মন্ত্রীর সামনেই কথা বলেছিল। এবং মন্ত্রী সে কথা শুনতে পায়। তাছাড়া মন্ত্রী তাকে চেনে। সে ছাত্রলীগের রাজনীতি করত। মন্ত্রীর নির্বাচনেও কাজ করেছে। ছেলেটির এ কথাগুলো শেষ হতেই বলি, তুমি ভুল করছ। মন্ত্রী মনে হয় শুনতে পাননি এমনভাবে পিএস বলেছেন। অপাপবিদ্ধ ছেলেটি মুখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ঠিক নয়, মন্ত্রী জানেন। এবং তার সামনে আরেকজন পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে যায় সেদিন। এছাড়া ছেলেটির পরিচিত অনেকেই চাকরির জন্য মন্ত্রীকে টাকা দিয়েছে।
শূন্য থেকে ভূমিতে পতন হলে যেমন হয় অনেকটা তেমন অবস্থা নিয়ে বললাম শুধু কি ওই মন্ত্রী টাকা নিতেন। আর এমপিরা নিতেন না। ছেলেটি বলল, মন্ত্রী তার নিজের এলাকার এমপি নন, তার নিজ এলাকার এমপিকেও সে একটি চাকরির জন্যে তিন লাখ ও আরেকটি চাকরির জন্যে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছিল। তিনি এখন মন্ত্রী হয়েছেন। তারপরে বললেন, মন্ত্রী এমপি কেন, মেয়রও তো টাকা নিতেন চাকরি দেয়ার জন্যে।

ছেলেটির সঙ্গে এ নিয়ে আর কথা বলিনি। কারণ, এর বেশ আগে একজন সৎ রাজনৈতিক কর্মীর কাছে শুনেছিলাম, তার এলাকার একজন মহিলা এমপি, যিনি এবার বাদ পড়েছেন তিনি কিভাবে মাদ্রাসার জন্যে টাকা নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বিগত সরকার ও বর্তমান সরকারের একজন দক্ষ উপদেষ্টা আওয়ামী লীগের গত টার্মের শেষ দিকে এসে ব্যক্তিগত আলোচনায় দুঃখ করে বলছিলেন, শেখ হাসিনা এত কাজ করলেন কিন্তু মন্ত্রী এমপিরা সব শেষ করে দিল এলাকার লোকের কাছ থেকে চাকরি দেয়ার নাম করে টাকা নিয়ে। ওই উপদেষ্টার অসহায় মুখ দেখে সেদিন মনে হয়েছিল, আসলে শেখ হাসিনা কত অসহায়! কিন্তু তিনি যে এত অসহায় সেটা এই বেকার তরুণের সঙ্গে দেখা না হলে বুঝতে পারতাম না। কারণ, দু’শ’ টাকার হোটেল থেকে এসে মন্ত্রী হয়ে তিনি যদি এভাবে চাকরি বাণিজ্যে নামেন, তাহলে শেখ হাসিনা কাকে নিয়ে দল করবেন?

আসলে এ মুহূর্তে এটা অনেক বড় প্রশ্ন- শেখ হাসিনা কাকে নিয়ে দল করবেন? কাদের নিয়ে দেশ চালাবেন? 
গতবার থেকে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা দেশের নানান প্রান্ত থেকে নবীন ও প্রবীণ এবং বিভিন্ন পেশা থেকে আসা লোকদের নেতৃত্বে ও মন্ত্রিত্বে এনে সেকেন্ড লাইন গড়তে চাচ্ছেন। একটি দলকে ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকতে গেলে যা প্রয়োজন হয়। যেমন সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী একে খোন্দকার বয়সের কারণে নিজেই রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। শেখ হাসিনা হয়ত এ কারণে বা অন্য কোন হিসেব থেকে ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক হওয়া লোটাস কামালকে পরিকল্পনামন্ত্রী বানিয়েছেন। কিন্তু তিনি অর্থমন্ত্রী সম্পর্কে যে সকল বক্তব্য রেখেছেন- তা কোন পর্যায়ে পড়ে? তার বক্তব্য প্রসঙ্গে বলার আগে বলতে হয় শেখ হাসিনা আসলে নানান দিক থেকে ভাগ্যবান। 
যেমন খালেদা-তারেক মিলে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেও তাকে ২১ আগস্ট হত্যা করতে পারেনি। ভাগ্যের জোরে তিনি বেঁচে যান। তেমনি অনেক ছোট একটি দিক, তারপরেও অনেক বড়- শেখ হাসিনা দুজন অর্থমন্ত্রী পেয়েছেন- এক, শাহএএমএস কিবরিয়া আর আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ দু’জনের ভুল ভ্রান্তি থাকতে পারে কিন্তু অতি বড় শত্রুরাও বলবেন না তাঁরা অসৎ। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন লাঞ্ছিত দেশে, যেখানে সব মূল্যবোধ শেষ হয়ে যায়। তরুণ থেকে বৃদ্ধ অধিকাংশই যেখানে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ফেলে বা ফেলতে বাধ্য হয়। সেই দেশে একজন সৎ অর্থমন্ত্রী পাওয়া কেবল শেখ হাসিনার ভাগ্য ছাড়া অন্য কিছু নয়।
এ তো গেল শুধু সততার দিক থেকে। এছাড়া আবুল মাল আবদুল মুহিত শুধু একজন অর্থনীতিবিদ বা অর্থমন্ত্রী নন। বরং সুধী সমাজে আবুল মাল আবদুল মুহিতের বড় পরিচয় কিন্তু মন্ত্রী নন, তিনি একজন লেখক, ইতিহাসবিদ, বিদ্বান, সুপত এবং সংস্কৃতিবান মানুষ। যাকে দেখে, যার আচরণকে অনুকরণ করে তরুণরা নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। এই আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী মোস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) যে মন্তব্য করেছেন তার থেকে এটা স্পষ্ট হয়, আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও তিনি বোঝেন না এমনকি বোঝেন না তিনি বর্তমানে যে পদে আছেন সেই পদের মর্যাদা। 
অবশ্য এটা তার দোষ নয়, কারণ আবুল মাল আবদুল মুহিতের শুধু পারিবারিক ঐতিহ্য নয়, তিনিও দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় নিজেকে গড়ে তুলেছেন। তাকে হঠাৎ করে যে কারও বোঝা সম্ভব নাও হতে পারে। যেমন অনেক সাংবাদিক তাঁর বক্তব্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে না। যে কারণে তাকে পুনরায় তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে হয়। এটা কিন্তু আবুল মাল আবদুল মুহিতের জ্ঞান ও সংস্কৃতির ঘাটতি নয়, ঘাটতি ওই সাংবাদিকদের। লোটাস কামালের ক্ষেত্রে তেমনই ঘটেছে। কারণ হঠাৎ করে লাঙ্গলের ক্ষেত থেকে কাউকে পেইন্টিং এক্সিবিশনে নেয়া হলে তার পক্ষে পেইন্টিং বোঝা সম্ভব নয়। এখানেও বিষয়টি অমনই ঘটে গেছে।
 ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা আর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-এ তো সাগরসম পার্থক্য। যেমন তিনি বলেছেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত বিস্তারিত বাজেট দেন। তিনি হলে এটা পনেরো পাতায় শেষ করে দিতে পারতেন। তার এ কথা বলার পরে, তার প্রতি করুণা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না বা বলারও থাকে না। কারণ একটি দেশের পরিকল্পনামন্ত্রী যখন এ কথা বলেন, তখন এটা স্পষ্ট যে, তিনি বাজেট কি সেটা বোঝেন না। তিনি বাজেটকে মনে করেন একটা আয় ব্যয়ের হিসাব মাত্র। যেমন তার ব্যবসা অফিসে বছরের শেষে হয়। 
বাজেট যে একটি সরকার বা যে রাজনৈতিক দল ওই সরকারটি গঠন করে তাদের দর্শন ও দেশকে এগিয়ে নেবার সার্বিক রূপরেখা তা হয়তো তিনি জানার সময় পাননি। তাকে শুধু অনুরোধ করব, তিনি যেন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাজেটটি, পার্লামেন্ট লাইব্রেরি থেকে নিয়ে সময় করে একটু পড়েন। এবং তাজউদ্দীনের ভাষা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের দর্শন না বুঝতে পারলে আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাহায্য নিতে পারেন। তিনি অনেক বড় মনের মানুষ। এবং তিনি হাসি মুখে সে কাজ করবেন। 
মনে হয় এ কাজটি যদি মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী করেন তাহলে রাষ্ট্র, বাজেট ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কে তার একটি ধারণা হবে। নিশ্চিত বলা যায়, রাষ্ট্র বাজেট এগুলো সম্পর্কে তার প্রাথমিক ধারণা হলে তিনি আর বলবেন না যে ১৫ পৃষ্ঠায় বাজেট করা যায়। আর যে অসংস্কৃত ভাষায় তিনি একজন ভদ্রলোক সম্পর্কে কথা বলেছেন, এই ভাষা তার পরিবর্তন হবে কিনা এটা বলা যায় না। কারণ এটা দীর্ঘ পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিষয়। এর জন্যে শর্টকাট কোন রাস্তা নেই। 
যেমন বেগম জিয়া কথা বলতেন না বলে লোকে তার সম্পর্কে বুঝতে পারতেন না। তিনি যখন পুলিশ সদস্যদের গালি দিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে ঝগড়া করলেন ঠিকই বোঝা গেল তার সংস্কৃতির লেভেল। এটা পরিবর্তনের জন্যে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে তারপরেও যেটুকু দরকার সেটা কিন্তু আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, মন্ত্রীদের কথা বার্তায় একটা শিষ্টাচার থাকতে হয়।
শুধু মন্ত্রী নয়, সকল জনপ্রতিনিধির কথাবার্তায়, আচরণে এবং কাজের একটি সীমারেখা দরকার আছে। নইলে এই যে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের কর্মীদেরই দুঃখ তাদের মন্ত্রী ও এমপিরা চাকরির জন্য টাকা নেন। তাদের ব্যবহার ভাল নয়। তারা জমিদারের মতো চলেন। যে কারণে শেখ হাসিনার সকল ভাল কাজ ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। এই সব দুর্নীতির ও আচরণের একটা সীমা রেখা টানা দরকার। জিরো পর্যায়ে না নামুক রাতারাতি অন্তত একটি সীমা রেখা এখনই টানা দরকার। লোভেরও একটি সীমা রেখা দরকার। যেমন শেখ হাসিনার বিশাল উন্নতি যজ্ঞের মধ্যে একটি বড় কালো তিলক শেয়ারবাজার। এখানে কিন্তু অর্থমন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কোন আর্থিক দুর্নীতি নেই। 
বরং আজ যারা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের নাম বাজার জোড়া। তারাই এ বাজারকে নিয়ে জুয়া খেলেছেন এটা মানুষের মুখে মুখে। এটা সত্য কি মিথ্যা সেটা তদন্তে প্রমাণ করবে। কিন্তু বিষয়টি কতদূর গড়িয়েছে তার একটি উদাহরণ দেই, এদের মধ্য থেকে একজনকে মন্ত্রী ও আরেকজনকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকতে দেখে এক আড্ডায় বিদেশি এক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, এই অভিযোগ আমার দেশে হলে এ ব্যক্তি জেলে থাকতেন। আর এখানে মন্ত্রী হলেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে গেলেন। ওই রাষ্ট্রদূতের কথা যে বেদবাক্য তা নয়। কিন্তু এই সত্য এখান থেকে দেখতে হবে যে, এরা শেখ হাসিনার সরকারের ভাবমূর্তি এভাবেই ক্ষতি করছে।

আর এদের এই সব কীর্তি দেখে যেটা স্পষ্ট হয় যে, শেখ হাসিনা আসলে একা। তিনি একা কত যুদ্ধ করবেন। দুই শ’ টাকার হোটেল থেকে এসে যিনি মন্ত্রী হন তাঁর সম্পর্কে চাকরি বাণিজ্যের অভিযোগ। আবার ম্যান পাওয়ার, শেয়ারবাজার থেকে এসে যিনি মন্ত্রী হন, বিদেশীরা মনে করেন তার জেলে থাকা উচিত। এখন একা শেখ হাসিনা কত দিক সামলাবেন। যেমন এ মুহূর্তে তথ্য মন্ত্রণালয়ে আছেন মুজিব বাহিনীর একজন বড় নেতা। তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ে থাকতে যদি ২৬ মার্চের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত পোস্টারে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ না থাকে তাহলে শেখ হাসিনার কী করার আছে? এটাও কি শেখ হাসিনাকে দেখতে হবে? 
এমনকি ২৬ মার্চ বিটিভিতে বাসদের এক নেতার সাক্ষাতকার দেখলাম। সেখানে তিনি বলছেন, একটি ‘বিশেষ দলের’ নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করলেও সেটা ছিল সকলের যুদ্ধ। ‘বিশেষ দল’ না বলে আওয়ামী লীগ বলতে লজ্জা কেন? আর এটা তো সামরিক শাসকরা বলত। এখন শেখ হাসিনার আমলেও কি টেলিভিশনে সেটাই বলা হবে? আওয়ামী লীগ শব্দটি উচ্চারিত হবে না? তথ্যমন্ত্রী মুজিব বাহিনীর নেতা অথচ এগুলো কি শেখ হাসিনাকে দেখতে হবে?
আসলে শেখ হাসিনা মনে হয় এ মুহূর্তে এক নিঃসঙ্গ শেরপা। নইলে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী ফোন করে বলেন, ভাই একটু লিখুন না, শেখ হাসিনা যেন সপ্তাহে একটি দিন অন্তত বিকেল চারটা থেকে রাত ৮টা অবধি তাঁর দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে বসেন। তাহলে ছয় মাসেই সংগঠন ঠিক হয়ে যাবে। ওই কর্মীর বক্তব্য সম্পূর্ণ তাদের দলীয় বিষয়। বাস্তবে এটা আওয়ামী লীগের দলীয় বিষয়। আমরা অন্য পেশার মানুষ এ সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম। কিন্তু এটা তো সত্য, আওয়ামী লীগের কর্মীরা মনে করছে শেখ হাসিনা ছাড়া তাদের সংগঠন ঠিক করার আর কেউ নেই। একি দুঃসহ ভার একজন নেতার ওপর! তাহলে বাদবাকি সব কি ‘নকল বুদিগড়’! আসলে আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষ আমরা যতটুকু খোঁজ খবর পাই তাতে কিন্তু শেখ হাসিনাকে সেই রবীন্দ্রনাথের নকল বুদিগড়ের হারাবংশী বীর কুম্ভের মতোই মনে হয়। চোখ বুঁজে চিন্তা করলে মনে হয় শেখ হাসিনা যেন সেই হারাবংশী রাজপুত বীর কুম্ভের মতো, ‘ভূমি পরে জানু পাতি তুলি ধনুস্বর, একা কুম্ভ রক্ষা করে ...swadeshroy@gmail.com

Wednesday, April 2, 2014

অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ!-মারুফ রসূল

বুধবার, ২ এপ্রিল ২০১৪, ১৯ চৈত্র ১৪২০
জানি না এখনও খবরটি জাতীয় গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কি না। দেশে নানা বিতর্ক চলছে, এসবের ফাঁকে এই খবরটি চাপা পড়ে গেলেও আশ্চর্য হব না। তবে নাগরিক হিসেবে, একজন ব্লগার হিসেবে নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারব না। ঠিক যেমন পারিনি এর আগে, যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গ্রেফতার করা হয়েছিল চারজন ব্লগারকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আবার। এবার সেই কালো আইন ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হলো দুই ব্লগারকে। তাঁদের দুজনই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। গত ৩০ মার্চ তাদের গ্রেফতার করে চট্টগ্রামের চকবাজার থানার পুলিশ। এজাহার থেকে জানা যায়, তাঁদের দুজনের মধ্যে একজনের নাম রায়হান রাহী এবং অন্যজন উল্লাস দাস। এজাহারে দুজনেরই বয়স উল্লেখ করা হয়েছে আঠারো। চট্টগ্রামের ব্লগারদের ব্লগ ও ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, রায়হান রাহী এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আগামী ০৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী সে। যখন রায়হানের বন্ধুরা পরীক্ষার জন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন রায়হানকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে অগণতান্ত্রিক ৫৭ ধারার আর তার পরিবারকে পোহাতে হচ্ছে আদালত আর থানা-হাজতের ঝক্কি ঝামেলা। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য বোধ করি আর কোন পরীক্ষার্থীর নেই, আর কোন পরিবারের নেই।
রায়হান রাহী ইস্টিশন ব্লগে ব্লগিং করতেন। তাঁর ব্লগ ও ফেসবুক ঘেঁটে এমন কিছুই পাওয়া যায় না, যে কারণে তাঁকে ৫৭ ধারায় আটক করতে হবে। তবে আটকের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়- এর পেছনের কারণগুলো। ইস্টিশনে প্রকাশিত রাহীর সহব্লগারদের লেখা থেকে জানা যায়, রাহী তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে কলেজে যায় এইচএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনার জন্য। সেখানে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী। শিবিরের জঘন্য কীটেরা রাহী ও তাঁর বন্ধু উল্লাসের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। এরপর পুলিশ আসে এবং তাঁদের সেখান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ব্লগপোস্টটি থেকে জানা যায়, থানায় আগে থেকেই রাহীর নামে ত্রিশ পৃষ্ঠার মতো নথিপত্র জমা দেয়া ছিল, যেখানে মূলত জামায়াত-শিবিরের ফেসবুক পেজ (যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক সম্বন্ধে নানা কটূক্তি করা হয় এবং যে পেজটি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ) বাঁশেরকেল্লার বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ ও স্বাধীনতাবিরোধী পোস্টে রাহীর তীব্র প্রতিবাদের অক্ষরমালা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সেখানে ছিল ফারাবী নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিকৃত মস্তিষ্কের শিক্ষার্থীর (ব্লগার রাজীব হায়দারকে যখন জামায়াত-শিবির হত্যা করে তখন শহীদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়িয়েছিলেন যে ইমাম, তাঁকে হত্যার হুমকিদাতা) বিভিন্ন সাইকোপ্যাথেটিক বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র ও শাণিত প্রতিবাদ। এরপর থানায় নিয়ে ৫৭ ধারায় তার নামে মামলা করে চকবাজার থানার এসআই শিবেন বিশ্বাস। 
পুরো ঘটনাটিতে দুটো বিষয় লক্ষ্যণীয়। এক, রায়হান রাহী ও তাঁর বন্ধু উল্লাস দাসকে প্রথমে শিবিরের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে। বেধড়ক মারধর করে। দুই, পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে আক্রান্ত দুই ব্লগারকে আটক করে এবং তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করে। তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়াল? শিবিরের সন্ত্রাসীদের এতই দাপট যে, তারা সাধারণ নাগরিকের জীবননাশের অপতৎপরতা চালিয়েও পুলিশের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে চলে, আর আটক হয়, মামলার শিকার হয় অসহায় দুই ব্লগার! যে ব্লগার বাঙলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান রক্ষার্থে নিরন্তর যুক্তির লড়াই করে গেল স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার হলো! সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র তোমার পুলিশ প্রশাসন! কী বিচিত্র তোমার আইন!
॥ দুই ॥
মামলার এজাহারটি ভাল করে পাঠ করে স্পষ্ট কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। পুলিশ বলছে, সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং সেখান থেকে দুই ব্লগারকে (পুলিশের ভাষায় আসামি, অভিযোগ প্রমাণের আগেই!) ‘উত্তেজিত জনতার কবল হইতে উদ্ধার করিয়া উপস্থিত জনসাধারণকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারি.. ..’- অর্থাৎ পুলিশ স্পটেই কাজ সেরেছেন। পুলিশের ভাষায়, উত্তেজিত জনতা হলো শিবিরের সন্ত্রাসীরা। তাদের মাঝখানে দুজন ব্লগারকে রেখে পুলিশ কি ব্লগারদের কোন বক্তব্য শুনতে পেরেছিল? না কি একতরফা শিবিরের সন্ত্রাসীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে আসে? যদি শেষ পর্যন্ত থানাতেই নিয়ে আসে, তবে কেন রায়হান রাহীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন স্পটে সকলের সামনে খোলা হলো? পুলিশ এ কাজটি করতে পারে কেবল তখনই, যখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকবে আসামির বিরুদ্ধে এবং পুলিশ প্রশাসনের কাছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকবে। কেবল মোবাইল ফোন খুলে দেখা পর্যন্তই শেষ নয়, সকলের সামনে রায়হান রাহীর ফেসবুকের ইনবক্সের মেসেজ পড়ে শোনানো হয়। সে মেসেজের উল্লেখও রয়েছে এজাহারে। এখন প্রশ্ন হলো, ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নয়, উপরন্তু তারা সন্ত্রাসীÑ যাদের হাতে নিরাপদ নয় রাহী, উল্লাসসহ মুক্তমনের ব্লগারগণ। সেই সন্ত্রাসীদের সামনে পুলিশ সদস্যরা কিভাবে একজনের (পুলিশী ভাষায় আসামি) ব্যক্তিগত তথ্যের উন্মোচন ঘটায়? এটা কি পুলিশের আইন লঙ্ঘন নয়? ইনবক্স একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর একান্ত ব্যক্তিগত প্লাটফর্ম। ফেসবুকের ‘স্টেটমেন্ট অব রাইটস এন্ড রেসপনসিবিলিটিস’- এর ‘প্রটেক্টিং আদার পিপলস রাইটস’ অংশে সুস্পষ্টভাবে অন্য কোন ব্যবহারকারীর তথ্য গোপন রাখার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশ সে নির্দেশনা অবমাননা করেছে, কারণ এজাহারেই উল্লেখ আছে- ‘... ইনবক্সের মন্তব্যগুলো উপস্থিত জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করিলে দেখা যায়...।’ 
এ পর্যায়ে এজাহারে ফারাবী সাফিউর রহমানের নাম আসে এজাহারে। এই ফারাবিই হলো সেই সাইকোপ্যাথেটিক রোগী, যার কাজই হলো ফেসবুকে বা ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল ও মুক্তমনের ব্লগারদের নানাবিধ হুমকি দেয়া এমনকি প্রকাশ্যে তাদের প্রাণনাশের ঘোষণা দানকারী। এই ফারাবিই শহীদ ব্লগার রাজীব হায়দারের জানাজা পড়িয়েছিলেন যে ইমাম, তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এ কারণে সে গ্রেফতারও হয়েছিল। সম্প্রতি সুলেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত গ্রন্থ সম্বন্ধেও সে নানাবিধ কটূক্তি করে যাচ্ছে এবং নানাভাবে লেখক অভিজিৎ রায়কে হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। এজাহারে ফারাবির সঙ্গে রাহীর কথোপকথনের উল্লেখ দেখানো হয়। এই ফারাবি ফেসবুকে ও ব্লগে নানা অকথ্য ভাষায় অন্য ধর্ম সম্বন্ধে কটূক্তি করে থাকে। অন্য ধর্ম অবমাননা করে থাকে, কিন্তু হায়, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ৫৭ ধারা দেখাতে পারে না। এই ফারাবির সঙ্গে রাহীর যে কথোপকথন দেখা গেছে, তা থেকে সহব্লগারদের অনেকের কাছেই এটি স্পষ্ট যে, ফারাবির বানোয়াট ও উদ্ভট তথ্যের জবাব দেয়াটাই রাহীর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফারাবি সেগুলো চালান করেছে, যা নয়, তার চেয়েও গুরুতরভাবে উপস্থাপন করেছে থানায়। শিবিরের সন্ত্রাসী এই বিকৃত মস্তিষ্কের ফারাবি পুরো ঘটনার কুপ্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। বলাই বাহুল্য, ফেসবুকের ‘স্টেটমেন্ট অব রাইটস এন্ড রেসপনসিবিলিটিস’- এর ধারা ফারাবিও অমান্য করেছে এবং ব্যক্তির তথ্যের যে গোপনীয়তা, তাও লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে, রাষ্ট্র ধর্মের চোখ দিয়ে দেখছে না।

॥ তিন ॥
রাহীর সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। হাতে যে সময় আছে, আর তাঁর উপর দিয়ে যে মানসিক চাপ যাচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠে পরীক্ষা দেয়াটা তাঁর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জটা কেবল তাঁর জন্যই নয়, আমাদের জন্যও। যে ব্লগার স্বাধীনতার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ব্লগিং করেছে, যুক্তির লড়াই করেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে পরাজিত করতে, তাঁদের মিথ্যাচারের জবাব দিতে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রাক্কালে তাঁকে বহন করতে হচ্ছে ৫৭ ধারার অভিশাপ। যে দেশে প্রতিদিন প্রতিরাত কুচক্রী মহল বিকৃত করছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর সরকার কেবল বক্তৃতার মাঝেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে, যে দেশে ইতিহাস বিকৃতিকারীদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না ৫৭ ধারা, যে দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের পরেও হেঁটে বেড়ায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা, অথচ প্রচলিত আইনের ধারায় তারা আটক হয় না, সে দেশে রাহীর মতো একজন ব্লগার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারবে না? তাঁকে হেরে যেতে হবে? একটা বছর নষ্ট হবে তাঁর মূল্যবান জীবন থেকে? আর যারা নির্বিকারে এখনও ‘বাঁশেরকেল্লা’ চালিয়ে যাচ্ছে, অপমান করছে আমার মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতাকে, অপমান করছে জাতির পিতাকে- প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায়, সেই নরপশুরা কি না ঘুরে বেড়াবে? আইনের এই তবে বিচার? এটা কি? ট্র্যাজেডি? না কি আলোহীন ভবিষ্যতে অচেনা এক বাংলাদেশের এপিটাফ? 
লেখক : ব্লগার ও কথাসাহিত্যিক

Tuesday, April 1, 2014

শিশু ইকরা ধর্ষণ মামলা এবং ধর্ষক সাত্তার মৌলভী

 ২০০৪ সালের মাঝামাঝি কোন এক শুক্রবার মধ্য দুপুরে  মায়ের ড্রইংরুমে দেখলাম কালো বোরখা পরা এক নারী বসে রয়েছেন। সাথে বছর চারেকের ছোট্ট  একটা মেয়ে  , চোখের কোণে কালি, ভীষণ শীর্ণ  কঙ্কালসার  শরীরে চিকন চিকন দু'টো পা, কাঠির মতো দু'টোহাত , গোলাপ ফুল বসানো একটা ফ্রক পরা।  গায়ের রঙ ফর্সা ই ছিল  কখনো -বোঝাই যায়! কেমন যেন বিবর্ণ-  পরে বুঝলাম, এই ফুটফুটে নিষ্পাপ শিশুটির জীবনের সব রঙ মুছে গেছে  !

শিশুটির নাম ইকরা, বললেন তার মা । বোরখা খুলে বসলেন।  তরুণীটির  মিষ্টি গোলগাল  চেহারাটি  বিষন্ন , ভারাক্রান্ত..... চোখে নীরব জলধারা।

স্তম্ভিত আমি।  এই ফুলের মতো ছোট্ট শিশুটি  ধর্ষিত হয়েছে। বর্বরতার বর্ণনা শুনে কিছুক্ষণ ভাষা পেলাম না কোন।

চট্টগ্রামের বাঁশখালির বৈলছড়ি গ্রামের আড়াই বছরের কন্যা ইকরা। বাড়ির উঠোনেই মাদ্রাসা। প্রচন্ড ধর্মান্ধ এক পরিবারের অতি সাধারণ  স্বল্পশিক্ষিত মা  ভাবলেন,  স্কুলে যাবার বয়স তো হয় নি তার কন্যার।  ঘরের দুয়ারেই মাদ্রাসা। একটু যাওয়া আসা করুক, আরবী  আর দোয়াদরুদ  শেখা হোক্ ।  ২০০৪ সালের ১৭মে  (সম্ভবত )একদিন অলস দুপুরে ইকরা উঠোনে খেলছিলো তার বন্ধু সাদিয়া আর অন্যান্যদের নিয়ে। হঠাৎ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার ইকরা কে ডেকে নিয়ে গেলেন। এর পরের গল্প খুব করুণ  এবং ক্ষমাহীন।

বাস্তবতা সম্পর্কে এতোটাই অজ্ঞ মা- বুঝতেই পারলেন না তার অবোধ শিশুটি  ধর্ষণের শিকার।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে  অঝোর ধারায় চোখের জলে ভেসে  এই অসহায় মা বললেন, "  এক রাতে  হঠাৎ আমি দেখি, আমার মেয়েটার জাঙ্গিয়া রক্তে ভিজে  যাচ্ছে। বারবার জাঙ্গিয়া বদলে দেই, তাও ভিজে যায়। পরদিন  ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার ওষুধ লিখে ছেড়ে দেয় ( বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসক  ধর্ষণ বা কোন অপরাধে আহতদের চিকিৎসা করতে গিয়ে পুলিশ কেস হতে পারে বলে , বিষয়টি এড়িয়ে যায়-কোন মানবিকতা তাদের স্পর্শ করেনা)।
 ইকরার  মা বলে যান - ইকরার রক্তপাত বন্ধ হয় না। বাচ্চা কিছু খায় না, কথা বলার শক্তি নেই , কান্নার ও শক্তি নেই। আমার স্বামী সেনাবাহিনির জওয়ান। সিএমএইচে ( কম্বাইন্ড মিলিটারী হসপিটাল)  নিয়ে যেতে বললেন।
সিএমএইচে নিলাম। ওরা চেক আপ করলো।
হঠাৎ একজন মহিলা ডাক্তার এসে  ক্ষুব্ধ স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,  " আপনার মেয়ে রেপ হয়েছে ,আপনি লুকিয়েছেন  আমাদের থেকে । কেন?"
আমি হতভম্ব। ডাক্তার এসব কী বলছে? আমার অবোধ শিশুটা....... কিছু বুঝলাম না। হঠাৎ এ  কী হলো , কী করে হলো ? আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে।
পরে আমার স্বামীকে খবর দিলো সিএমএইচ থেকে । আমার ম্বামী আর আমি  কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।  ইকরাকে জিজ্ঞেস করলাম," আম্মু, কও তো ,তুঁই দুক্খু পাইও না ( তুমি ব্যথা পেয়েছো, মা?)  ?  অ'মা , ক'নে  দি'য়ে  দুকখু? (ব্যথা কে দিলো , মা?) ? "
ইকরা ভয়ার্ত আধোবোলে বললো, " সত্তর মলই ( সাত্তার মৌলভী) ! অবিশ্বাস্য ঠেকে তার বাবা-মায়ের কাছে। কয়েকশ' কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম বৈলছড়ি মাদ্রাসায় ছুটে যায় ইকরার  বাবা-মা। তাদের সাথে অন্যান্য পাড়া প্রতিবেশী রাও। তাদের ধারণা হয় নতুন একজন তরুণ শিক্ষক মাদ্রাসায় এসেছে, সেই নিশ্চয়ই এই বর্বরতা ঘটিয়েছে।
 ছোট্ট ইকরা তার বাবার কোলে । সেনাবাহিনীর তাগড়া জওয়ান পুরুষটি হতাশায়, বেদনায় চুরমার ততোক্ষণে । অসহায়   পিতা  ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে ছুটে বেড়ান মাদ্রাসার এ কক্ষ থেকে সে  কক্ষ ।
ছুটে সেই তরুণ নতুন শিক্ষকের সামনে। না, ইকরার ছোট্ট তর্জনী পাশের রুমের দিকে। এ কী -ঐ রুম তো অধ্যক্ষের কক্ষ ।
উদভ্রান্ত পিতা -মাতা, পাড়া প্রতিবেশী ওদিকেই ছুটে যান। সরাসরি আবদুস সাত্তারের চোখের দিকে ইকরার  ছোট্ট তর্জনী ।

শিশু ইকরার ধর্ষক আবদুস সাত্তার
" এই সত্তর মলই আঁর জাঙ্গিয়া খুলি আঁরে  দুক্খু দিয়ে, আব্বু....... ( এই সাত্তার মৌলভী আমাকে পেন্টি খুলে ব্যথা দিয়েছে আব্বু.... )"  সেনা জওয়ান পিতা যেন এই জগতে আর নেই!  দু'চোখে জলের বন্যা।  বিষ্ফারিত নেত্রে চেয়ে ভাবতে থাকে - দেবদূতের মতো  মাথায় টুপি,  কাঁচা পাকা  লম্বা দাঁড়ি  ৫২ বছর বয়স্ক মাদ্রাসা  অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার  ছোট্ট  অবোধ শিশু ইকরার ধর্ষক?? এও কি সত্যি হতে পারে ?? আল্লাহর সাত আসমান ভেঙ্গে পড়লো না কেন সেই দিন?   চিৎকার করে বলে উঠে , " সত্তর ভাই, অ'নে? আঁর বন্ধু হই অ'নে আঁর মাইয়ার উ'র এতো অত্যাচার গরিত পাইরগন না?  ( আপনি ?? আপনি সাত্তার ভাই আমার বন্ধু হয়ে আমার ছোট্ট , বাচ্চা  মেয়েটার উপর এতো অত্যাচার করতে পারলেন? )... বলেই  অজ্ঞান হয়ে  ধর্ষক সাত্তারের বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন ছোট্ট ইকরার অসহায় পিতা। মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক সহ অনেকেই ধর্ষক  সাত্তারের পক্ষে মত দিলো। ছোট্ট ইকরা ধর্ষিতা হবার পরও পবিত্র ধর্ম শিক্ষাদাতা প্রতিষ্ঠান সেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে একটি কথা বলার সাহস কেউ করলো না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের  তৎকালীন সভাপতি নূরজাহান খান আমার মা নূরজাহান খান এই মামলা পরিচালনার ভার নিলেন । একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রম তাঁর। চার দশকের  ্এ নেশা তাকে নিপীড়িতের অধিকার আদায়ে ছুটিয়ে বেড়ায়, এবং দিনশেষে অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করতে সফল ও হন তিনি।
 
চট্টগ্রামের নারী ও শিশু আদালতে উঠলো ইকরা ধর্ষণ মামলা ।২০০৫ সাল । আমি তখন দৈনিক সমকাল পত্রিকার সিনিয়ার রিপোর্টার । অন্যান্য গণমাধ্যমের সহকর্মী সাংবাদিকদের কয়েকজন কে জানিয়েছি, যাঁদের  কেউ কেউ অনেক প্রগতিশীল।  কিন্তু কাউকেই  এই মামলার রিপোর্টিং বা ফলোআপে  আদালতে ও দেখলাম না,  ্ইএকটি অবোধ শিশুর প্রতি এমন অবিচারের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে একজন সাংবাদিককে ও পাশে পেলাম না। বেদনার ভার চাপাই রইলো।
কিন্তু মানবতার কাজ কি থেমে থাকে?
আরো দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যায়  কাজ - থামাতে পারেনি  অন্ধকারের শক্তি  ধর্ষক সাত্তার তার বিচারের প্রক্রিয়া।

 ইকরার বড়ো দুই ভাই সেই মাদ্রাসায় ক্লাস থ্রি ফোরের ছাত্র ছিল। বছরের মাঝামাঝি  বিনা নোটিশে তাদের বহিস্কার করা হলো। ইকরার কাকা-মা অসহায় বোধ করলেন, ছেলেদের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে গেলো! শুধু তাই নয়, একঘরে করা  হলো এই পরিবারকে ।
এই পরিবার   'ইসলাম বিরোধী এবং সমাজচ্যুত '  ফতোয়া জারি করলো ধর্ষক সাত্তার -  !
নির্যাতিতা শিশুটির পরিবার বলে তারা যেন  পথে বসলো। রাষ্ট্র , সমাজ, ধর্ম-কেউ  এই অন্যায়ের প্রতিরোধ করলো না!

আমি  দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার তখন । সমকালে আমি নিয়মিত মামলার ফলোআপ করতে থাকলাম। ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে রিপোর্ট গুলো কখনো কখনো ছাপা হতো, কখনো হতো না।  অনেক পাঠকের মানবিক প্রতিক্রিয়া পেলাম।
এমন ঘৃণ্য অপরাধীকে সাজা দেবার জন্যে সাক্ষী প্রমাণ জোগাড় করা এবং ইকরার পরিবারের পাশে আমার মা নূরজাহান খান একদম  একা লড়াই করে গেলেন ৫টি বছর ।
 রায়ে অপরাধী প্রমাণের পর কি ধর্ষকের ছবি তোলা মানা?  আমি ছবি তুলছি বলে আমার দিকে হুমকি 

    ছোট্ট ইকরার দিকে তাকালেই আমার বুক ভেঙ্গে যায় । আমি ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকি। গল্প করি , চড়ুই পাখির মতো ছোট্ট মেয়েটা, কী ভয়ংকর 'দুনিয়া' দেখে ফেললো? বড়ো হবে  কি করে?

নির্যাতিতা শিশুটির পাশে নূরজাহান খান ছাড়া কেউ নেই। তিনি ডাকলে অনেক প্রভাবশালী আইনজীবি  আসেন। তবে  ্লএকটানা লেগে থাকতে হয়। তাদের ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার চাপ থেকে । স্বেচ্ছাসেবার জন্যে সময় বের করা বড্ডো কঠিন।
মামলা চললো ৫ বছর।
এই ৫ বছরে আমার পেশাগত জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেলো। আমি ঢাকায় একুশে টেলিভিশনে কাজ শুরু করলাম। মামলার  তারিখ পড়লে সাপ্তাহিক ডে-অফ নিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে  হাজির থাকতাম।

  ‌ইকরার খেলার সাথী প্রতিবেশী শিশু সাদিয়া একদিন সাক্ষ্য দিয়ে গেলো- ঘটনার দিন  দুপুরে  ্ইকরার সাথে  বাড়ির উঠোনে  তারা খেলছিলো- তখন 'সাত্তার মৌলভী'  এসে ইকরার হাত ধরে  পড়াবে বলে  দোতালায় মাদ্রাসার ভেতরে  নিয়ে যায়।

ধর্ষক সাত্তার জঙ্গী সংগঠনের সাথে জড়িত বলে এলাকার অনেকে বলেন । সাত্তারের পাসপোর্টে অনেক দেশের ভিসা। সন্দেহজনক তার গতিবিধি। আর  তার চারিত্রিক সনদ পত্রে স্বাক্ষর করলেন বিএনপি শাসিত তৎকালীন  সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর , বানিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অনেকে।

 সেই চারিত্রিক সনদ আদালতে উপস্থাপনের কারণে জামিনেই থাকলো ধর্ষক। মামলা চললো।
বিস্ময়করভাবে সমাজসেবা অফিসের দুই কর্মকর্তা  ধর্ষক সাত্তারের পক্ষে  আদালতে সাক্ষ্য দিলেন, ঘটনার দিন নাকি সাত্তার সমাজসেবা অফিসে ছিলেন। কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া  ্এ সাক্ষ্য! এ যেন মগের মুল্লুক।
 পাবলিক প্রসিকিউটর মফিজুর রহমান ভুঁইয়া ও তখন বিএনপি র সংগঠক। দুই পক্ষ থেকে্ই প্রচুর টাকা নেন। ইকরার মা বাবা সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে।
নূরজাহান খানের কারণে নির্যাতিতের উপর খুব চাপ ও দিতে পারেন না পিপি - নাহয়   আরো বেশি টাকা আয় হয়ে যেতো এই সুযোগে।

এর মধ্যে বার বার  ম্যাজিষ্ট্রেট বদলায় আর  ্আদালতে নতুন করে  ঘটনার বর্ণনা দিতে হয়  ধর্ষিতা শিশু ইকরা আর তার মা'কে।

 ইকরাকে কোলে নিয়ে   আদালতের সামনে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে  ইকরার মা তার কন্যাশিশুর  উপর বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে যান। আর আসামী পক্ষের আইনজীবিরা  দাবি জমি সংক্রান্ত  শত্রুতার কারণে মিথ্যা অভিযোগে সাত্তার কে 'ফাঁসানো ' হয়েছে।  নির্যাতিত অবোধ শিশুটি বুঝতেই পারলো না তার আর তার পরিবারের বিরুদ্ধে  এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামী পক্ষের অশ্লীল বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হয় ইকরার মা কে। তারা প্রশ্ন করে  " এই  বাচ্চা মেয়েটা কে ধর্ষণ  করার মতো  কী আছে ওর,  হুজুর  আদালত? সবই মিথ্যা কথা । ওর বাবা সেনাবাহিনীর প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা অভিযোগে এসব মামলা করে আমাদের হয়রানি করছে।"

বারবার   ইকরা কে বর্ণনা করতে হয় তার নির্যাতনের কথা। আর আসামীর দিকে ছোট্ট তর্জনী দেখিয়ে বলতে হয়- "ঐ সত্তর ম'লই আঁরে দুক্খু দিয়ে!" ছোট্ট ইকরার চোখের জল ও শুকিয়ে যায় একদিন।

 পিপির সহায়তায় আসামী পক্ষ বারবার তারিখ নেয় নানান অজুহাতে ।তাদের ধারণা ইকরা  তার নির্যাতনকারীর চেহারা ভুলে যাবে।  আমার বিরুদ্ধে ও আসামী পক্ষের আইনজীবি  আদালতে অভিযোগ করলেন - " সুমি খান একজন সাংবাদিক । এই মামলায় তিনি উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আদালতে  হাজির থাকছেন । " এর প্রতিবাদ করে  প্রথিত যশা আইনজীবি রানা দাশগুপ্ত দাঁড়িয়ে বলেন, " মাননীয় আদালত, সুমি খান একজন মানবাধিকার সংগঠক। তিনি এই মামলা পরিচালনার কাজে আদালতে  নিয়মিত  উপস্থিত থাকছেন।"

 ২০০৬ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলো। পাবলিক প্রসিকিউটার, ম্যাজিষ্ট্রেট সবই বদলে গেলো।  গ্রেফতার হলেন সাত্তার , কিন্তু মামলা চলতেই থাকলো। আমি ঢাকা থেকে একদিনের জন্যে চট্টগ্রামে আসতাম।  কাঁধে লাল-সাদা চেক চেক ওড়না পরা ('সৌদী পবিত্রতার চিহ্ণ' )  সাত্তার  আমার দিকে দেখে দেখে  বিড়বিড় করে কী যেন  পড়ে থুথু ছুঁড়তো-  আর অভিসম্পাত দিতো আমাকে !এভাবে ই পাঁচ বছর পার হলো।

  ২০০৯ সালের অক্টোবর। নারী-শিশু নির্যাতন আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট তার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে ইকরা কে দাঁড় করালেন আদর করে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছিলো ? ইকরা কে এক প্যাকেট বিস্কুট হাতে দেন।  বলেন, " বলো তো কি হয়েছিলো?"  ইকরা করুণ ছোট্ট  মুখে আধো আধো বুলিতে বলতে থাকে , "  (ছোট ছোট হাতে তর্জনি দিয়ে সাত্তার কে  দেখিয়ে)ঐ সত্তর মলই আঁরে দুকখু দিয়ে? " ম্যাজিষ্ট্রেট প্রশ্ন করেন , কোথায় ব্যথা দিয়েছে? কিভাবে ব্যথা দিয়েছে? "  ইকরা তার নিজের  ছোট্ট দু'টো গাল দেখিয়ে বলে, " ইনদি ইনদি দুক্খু দিয়ে ...(এখানে এখানে কামড় দিয়েছে ) জামা নামানোর চেষ্টা করে বুক দেখিয়ে বলে, বুকে কামড় দিয়েছে , আর আমার জাঙ্গিয়া খুলে অনেক ব্যথা দিয়েছে-ঐ সত্তর ম'লই  (সাত্তার মৌলভী)!  " ৫ বছরে এতোটুকু বাড়েনি ইকরা। অতোদিনে আটবছর বয়স হবার কথা তার । কিন্তু দেখতে সেই ছোট্ট তিনবছরের শিশুটিই ছিল ইকরা।  শারীরিক সব অগ্রগতি যেন মামলার মতোই থমকে গেছে।

 এমন কঠিন মুহুর্তে হাকিম ও ভাষা হারান হয়তো- ম্যাজিষ্ট্রেটের চোখ ভিজে যায়।  কিছু মুহুর্ত নীরবে নিচের দিকে চেয়ে ভাবলেন।  ইশারা করেন আর্দালী কে। আর্দালী   ইকরা কে কোলে করে চেয়ার থেকে নামিয়ে  মায়ের কোলে দিয়ে যায়। মামলার কাজ শেষ হলো। ২০০৯ সালের ৮ নভেম্বর রায় হলো।  ৭ বছরের কারাদন্ড হয় আবদুস সাত্তারের।
আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই আমার সেই সময়কার বেদনার অনুভূতিটুকু বলছি- অধীর আগ্রহে রায়  শুনছিলাম- মনে মনে ভাবছিলাম , আচ্ছা, এমন শিশুকে ধর্ষন কি 'এ্যাটেম্প টু মার্ডার' নয়? তাহলে কি সাত্তারের মৃত্যুদন্ড হতে পারতো না? মাত্র ৭ বছর তো তার কাছে নস্যি! রায়ে বলা হলো, যেহেতু একেবারেই শিশু, তাই ধর্ষণের মতো শারীরিক গঠন তার হয় নি। তাই নির্যাতন হিসেবেই গন্য হলো!
সাত বছরের সাজাও নানান অজুহাতে কমে গেছে ্, তেমন কোন সাজা ভোগ করতে হয়নি এই ধর্ষককে।

বিস্মিত,   স্তম্ভিত আমি !! দীর্ঘ ৫ বছরের অনিশ্চিত যাত্রা শেষে অন্তত ৭ বছর সাজা হয়েছে- এতেই  নূরজাহান খান কিছুটা শান্তি পেলেন!!
আমার মা সর্বংসহা, আমি নই ।আর তাই  শান্তি পাচ্ছি না এতো বছর পরও!‍  এ রায় মেনে নেয়া যায় কিনা জানি না!! শুধু জানি-  বর্বর সাত্তারকে যদি তড়পে তড়পে মরতে হতো... কখনো কি বুঝতো শিশু ইকরার যন্ত্রনার সহস্র ভাগের এক ভাগও ..!!
ইকরার মা বললেন, " কক্ষনো আর আমার সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়াবো না। বাংলা স্কুলে পড়াবো।"বললাম, "ওকে  জজ ব্যারিষ্টার বানাবেন। যেন ইকরার স্বাক্ষরে একদিন সাত্তারের মতো বর্বরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়-  আর কোন সাত্তার যেন এই সমাজে ঠাঁই না পায়!!"

রায় শুনে  ক্ষুব্ধ  ধর্ষক সাত্তার শাপ শাপান্ত করে যায়  আদালত পুলিশ , নূরজাহান খান-সুমি খান -সবাইকে!  অভিসম্পাত দিতে দিতে পুলিশের সাথে প্রিজন ভ্যানে উঠে যায় সাত্তার  !!
আর আমি  ধর্ষক সাত্তরের ছবি তুলবার জন্যে তার পেছন পেছন ছুটি। পুলিশ ছবি তোলাতে সহযোগিতা করতে সাত্তারকে সোজা করে দাঁড় করাতে চাইলেই প্রচন্ড গালাগাল শুরু করলো সাত্তার। আমার কাজ সেরে নেই সেই ফাঁকে।
আদালতের রায় উপেক্ষা করে  বিপুল অর্থের বিনিময়ে ২/৩ মাস পর ই  জামিনে ছাড়া পেয়ে  ধর্ষক আবদুস সাত্তার  আবার মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের পদ দখল করে নেয়। এর পর আবার সেই মাদ্রাসায় সাত্তারের অনাচার শুরু হয়।  সাত্তারের বিতাড়িত লোকেরা  ইকরার মায়ের কাছে এসে বলছে আদালতে আপীল করতে। ইকরার মা জবাব দিলেন, "এতোদিন তো আমাকে লাঠি নিয়ে দৌড়িয়ে ছুটালেন, এমন অবোধ শিশুর উপর নির্যাতন ও আপনাদের বিবেক নাড়াতে পারে নি।  এখন কেন এসেছেন?"
 কোন মিডিয়া, কোন বিবেকবান মানুষ সাত্তারের অনাচার রোধ করতে পরে না। এভাবেই সাত্তরেরা বারবার পার পেয়ে যায়।

..........................
এরকম আরো অসংখ্য মামলা নূরজাহান খান এখনো পরিচালনা করছেন । একে একে তুলে ধরবো এই প্রজন্মের জন্যে।  দুরূহ এ কাজ  এই প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে হবে , তাই একথা গুলো তুলে ধরা।

নূরজাহান খান সম্পর্কে দু'চার কথা

 নূরজাহান খান মানবাধিকার সংগঠক। ১৯৪৮ সালের ১১ আগষ্ট  কোলকাতা মেডিকেল কলেজে তাঁর জন্ম  । তাঁর যখন তিনদিন বয়স, তাঁর মা  জাহান আরা সিদ্দিকী  টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে  মাত্র ২১ বছর বয়সে  মৃত্যুবরণ করেন।নূরজাহান খানের বাবা জামাল আহমেদ সিদ্দিকী ছিলেন কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের কৃতি ছাত্র। ল্যান্ড এ্যাকুইজিশান ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট  জামাল আহমেদ সিদ্দিকী বলতেন,  ''হাকিম নড়বে, কিন্তু হুকুম নড়বে না''।

জামাল আহমেদ সিদ্দিকীর বাবা শফিকুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন ব্রিটিশ এক্সাইস সুপারিন্টেন্ডেন্ট। সদ্য মা হারা শিশু নূরজাহান খানের নাম রাখলেন আল্লাদি । ফারসী এ শব্দের অর্থ-'আল্লাহ রেখেছে' ।
ভোর ৬টা  থেকে সন্ধ্যা ৬টা আর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা দু'জন  নার্স শিফটিং ডিউটি করে   তিনদিন বয়সী আল্লাদীকে নিরন্তর সেবা যত্ন করে একটু বড়ো করে তোলে। এর পর আসেন নতুন মা । কোলকাতার ইমামবাড়া থেকে । হাজী মুহম্মদ মহসীন এর পরিবারের সন্তান।ঊর্দুভাষী এই নতুন মা সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি হলেও  পীর বাড়ির মেয়েটিকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেন  আল্লাদী।

 বাবার চাকরিসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বদলি হলেন যখন, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক কালজয়ী শিক্ষক হরলাল রায়ের ছাত্রী হলেন ।  মায়ের আশৈশব  রবীন্দ্রানুরাগ একটু শক্তি পেলো।  ।  এখনো খুব জ্বর এলে প্রলাপ বকেন আবৃত্তি করে। রবীন্দ্রনাথের কচ ও দেবযানী ,  নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ,  বিসর্জন...অথবা 'কোথা সে ছায়া সখী , কোথা সে জল, কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশ্বথ্থ তল! ছিলাম আনমনে , একেলা গৃহকোণে, কে যেন ডাকিলো রে -জলকে চল! বেলা যে পড়ে এলো জলকে চল ..."!!
তবে মানুষের কাজেই ব্যস্ত থাকেন। থানা, পুলিশ , আদালত- অপরাধীর শাস্তি আর নিরপরাধের প্রশান্তিই তার শান্তি।

 বাঙ্গালীর স্বাধীকারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সাল থেকে  জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামালের হাত ধরে  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চট্টগ্রামে সংযুক্ত হলেন মা।  যুগের পর যুগ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে!, তাদের ভরণ পোষণ করেছেন, অনেক  অসহায় পরিবারের দায়িত্ব তার মাথায়, অনেক মেধাবী ছাত্র ছাত্রীর পড়ালেখার খরচ দেন।

 ১৯৮০ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে  সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এখন সেই সংগঠনের কাজীর গরু কেতাবে সীমাবদ্ধ , গোয়ালে না থাকলে ও চলে। আর নূরজাহান খানের মতো 'পুরনো' কাজপাগলদের  সারা দেশের সব শাখা থেকেই ঝেড়ে ফেলেছে  মহিলা পরিষদ। মিলিয়ন ডলার ফান্ড- ঢাকা শহরের  কোটি কোটি টাকার আয় ব্যয়ের হিসাব দেখানো লোকদেখানো কাজ দরকার। নির্যাতিতের জন্যে আদালতে লেগে থাকা তাদের জন্যে  'সময়ের অপচয়' !

যাই হোক্   বর্তমানে নিজেই' লিরো'   LEERHO  )Labour, Education, Environment, Rehabilitation, Health organization )  নামের একটি সংগঠন করে  পুত্রদের পাঠানো হাত খরচের টাকা দিয়ে মানুষের জন্যে কাজ করেন , আদালতে ছুটে অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করে  কখনো কখনো  মধ্যরাত বা শেষ রাতে বিছানায় তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যান।



ওসামা বিন লাদেন আইএসআইয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিল-কার্লোটা গল এর অনুসন্ধানী রিপোর্ট


[আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ২০১১ সালের মে মাসে এ্যাবোটাবাদে পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক একাডেমি থেকে মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে উঁচু প্রাচীরঘেরা এক অট্টালিকায় মার্কিন কমান্ডো অভিযানে নিহত হন। সেই বাড়িতে ছয়টি বছর তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। এটা কি সম্ভব যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ওখানে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানত না? নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার কার্লোটা গল এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখিয়েছেন, পাকিস্তান বিন লাদেন সম্পর্কে কতটা কি জানত। দেখিয়েছেন, আইএসআইয়ের শীর্ষ মহল কিভাবে লাদেনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল। তাঁর সেই অনুসন্ধানী বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো।] 


১১ সেপ্টেম্বরের হামলার কিছুদিন পর আমি নিউইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে আফগানিস্তান থেকে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। তালেবানরা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হবার পর পরবর্তী ১২ বছরের বেশিরভাগ সময় আমি সেখানে কাটিয়েছি তালেবান শাসন অবসানের পর যে স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তাতে আমি রোমাঞ্চিত বোধ করেছি এবং তারপর সেই আশা প্রত্যাশার ধীরে ধীরে অপমৃত্যু ঘটতে দেখেছি। নতুন সংবিধান প্রণীত হলো, দুদফা নির্বাচন হলো। কিন্তু তাতে সাধারণ আফাগানদের জীবন যাত্রার কোন উন্নতি হলো না। তালেবানরা নতুন করে সংগঠিত হলো এবং তাদের গেরিলা কর্মকা-ের পক্ষে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সমর্থক পেয়ে গেল। তারা আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল পুনর্দখলের জন্য উচ্চাভিলাষী আক্রমণাভিযান চালাল এবং একশত বেশি আত্মঘাতী বোমাবাজ লেলিয়ে দিল। ২০০৬ সাল নাগাদ পরিষ্কার হয়ে গেল যে এক ভয়ঙ্কর ও সংকল্পদৃঢ় প্রতিপক্ষ শক্তিমত্তায় বেড়ে চলেছে, দুর্বল হচ্ছে না। নবজাগ্রত তালেবানদের বোমা বিধ্বস্ত এলাকা ও রণাঙ্গনগুলো সফরকালে আমাকে আফগানরা সেই একই কথা বলতে থাকে। তাহলো তালেবান সন্ত্রাসীদের সংগঠকরা পাকিস্তানে বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা কোয়েটায় রয়েছে। পুলিশী তদন্তেও দেখা যেতে লাগল যে বোমাবাজদের অনেকে পাকিস্তান থেকে আসছে।

২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি বিমানে করে কোয়েটায় যাই। সেখানে কয়েকজন পাকিস্তানী রিপোর্টার ও একজন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা একত্রে এমন সব পরিবারের দেখা পেলাম যারা এই ধারণাকে আঁকড়ে ধরে আছে যে তাদের ছেলেরা আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। কেউ কেউ আবার এমন সংবাদ বিশ্বাস করবে কি-না সে সম্পর্কে নিশ্চিতও ছিল না। খরবগুলো তাদেরকে জানানো হয়েছিল অজ্ঞাত পরিচয় কোন ব্যক্তির টেলিফোন কল থেকে কিংবা সমাজের কোন একজনের মাধ্যমে দ্বিতীয় হাত ঘুরে। তাদের ছেলেরা কিভাবে মারা গিয়েছিল, কে তাদের রিক্রুট করেছিল একথা বলতে তাদের সবাই শঙ্কিতবোধ করছিল। তারা ভয় পাচ্ছিল যে পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সদস্যরা তাদের ঝামেলায় ফেলতে পারে।



কোয়েটায় আমাদের প্রথম দিনের সংবাদ পরিবেশনার পর আমরা লক্ষ্য করলাম মোটরবাইক আরোহী এক গোয়েন্দা এজেন্ট আমাদের পিছু নিয়েছে। আমরা যাদের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকের কাছে পরে আইএসআই এজেন্টরা গিয়ে হাজির হয়েছিল। আমরা পশতুনাবাদ বা পশতুদের শহর নামে এক এলাকা পরিদর্শনে যাই। ওটা ছিল প্রধানত আফগান অধ্যুষিত সঙ্কীর্ণ অলিগলির এক ঘনসংবদ্ধ মহল্লা। এই শরণার্থীরা কয়েক বছরে পাহাড়ের পাশে ছড়িয়ে পড়ে কাদামটি ও খড়কুটো দিয়ে একচালা বাড়ি বানিয়ে বাস করছিল। মানুষগুলো মেহনতি শ্রেণীর : মুটে মজুর বাস ড্রাইভার ও দোকানদার। এই মহল্লায় বেশ কয়েকজন তালেবান সদস্যেরও আবাস যারা উঁচু প্রাচীরঘেরা বড় বড় বাড়িতে বাস করে। প্রায় ক্ষেত্রেই বাড়িগুলো তাদের পরিচালিত মসজিদ ও মাদ্রাসার পাশে অবস্থিত।



রাস্তার পাশে অন্যতম একটি মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া। এর ছোট ও পরিচ্ছন্ন প্রবেশপথ দেখে প্রতিষ্ঠানটির সাইজ বুঝে ওঠার উপায় নেই। ভিতরে ইট ও কংক্রিটের তৈরি তিনতলা উঁচু ভবন। মাঝখানে আঙ্গিনা ও ক্লাসরুম যেখানে ২৮০ জন ছাত্রের স্থান সঙ্কুলান হতে পারে। আমরা যেসব আত্মঘাতী বোমাবাজের খোঁজ খবর করছিলাম তাদের অন্তত তিনজন এখানকার ছাত্র ছিল। আরও অনেকেই ছাত্র ছিল বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলোর সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং প্রাদেশিক সরকারের কর্মকর্তারা প্রায়ই এখানে আসতেন এবং তালেবান সদস্যরাও অনেক সময় রাতের আঁধারে এসইউভি’র বহরে করে আসতেন।


আমরা এক সাক্ষাতকার নিতে চাইলাম। বলা হলো মহিলা সাংবাদিককে ভেতরে যেতে দেয়া হবে না। তাই আমি আমার সঙ্গে থাকা পাকিস্তানী রির্পোটারকে কিছু প্রশ্ন চালান করে দিলাম। সে এবং ফটোগ্রাফারটি ভেতরে চলে গেল। কোন জঙ্গীকে সেখানে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে বা জিহাদের জন্য জবরদস্তি করে কাউকে রিক্রুট করা হয়েছে একথা মাদ্রাসার উপপ্রধান অস্বীকার করলেন। বললেন যে “আমরা ছাত্রদের কোরান শিক্ষায় শিক্ষিত করছি এবং কোরানে লেখা আছে যে জিহাদে অংশ নেয়া প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। কোরানে কি লেখা আছে আমরা শুধু সে কথাই তাদের বলছি। তারপর জিহাদে যাওয়া না যাওয়া তাদের দায়িত্ব।” তিনি কথাবার্তা শেষ করলেন। ক্লাস শেষ হয়ে এসেছিল। ছাত্রদের ক্লাসরুম থেকে হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে আসার সেই কলরব শুনতে পেলাম। ছেলেরা গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। একজনের পেছনে একজন ছুট লাগাল কেউ পায়ে, কেউবা সাইকেলে চেপে ঢিলেঢালা পোশাক ও টুপি মাথায় তাদের লম্বা ও কৃশ দেখাচ্ছিল।


রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার মাদ্রাসার বাইরে আমার সঙ্গে যোগ দিল। জানাল সে ভেতরের প্রাঙ্গণে মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক এক পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক দলের নেতা ও তালেবানপ্রধান মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের প্রশস্তি করে বেশ কিছু দেয়ালের লিখন আঁকা। পাকিস্তানে অনেক মাদ্রাসার মতো এই মাদ্রাসাটি তালেবানদের পুনরুত্থানের উৎস, সে পুনরুত্থানের সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও অন্যান্য আফগান নেতা অনেক আগে থেকেই হুঁশিয়ার করে দিয়ে আসছিলেন। কোয়েটার এক গরিব তল্লাটে বিচিত্র ধরনের মাদ্রাসাটি হলো সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে বিরাজমান শত শত মাদ্রাসার একটি। 



এই মাদ্রাসাতেই তালেবান ও পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলো জঙ্গীবাদের একটি বাহিনী গড়ে তোলার জন্য একযোগে কাজ করছিল। ঐ এলাকার এক পশতু সাংসদ আমার কাছে বলেছেন, “মাদ্রাসাগুলো হলো খোলস একটা আবরণমাত্র যার ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে আছে আইএসআই।”



প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ ও তার গোয়েন্দা প্রধান লে জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানীর অধীনে পাকিস্তান সরকার তালেবানদের পালছিল ও রক্ষা করছিল। উদ্দেশ্য ছিল দুটো সে সময় দেশে অবস্থানরত ‘নানা ধরনের জঙ্গী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং আফগানিস্তানের চাপ সৃষ্টি ও শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যে তাদেরকে প্রক্সি হিসাবে ব্যবহার করা। এই সূত্রটি এমনভাবে কাজ করছে যে বাইরে থেকে ধরতে পারা কঠিন। তবে এতে পাকিস্তানে যে কৌশলটি গড়ে উঠেছে তা হলো আমেরিকার সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে সহযোগিতা দেখানো এবং অন্যদিকে গোপনে তালেবান, কাশ্মীরি ও বিদেশি আলকায়েদার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গীদের সাহায্য করা ও তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এই দ্বিমুখী ও কখনও কখনও বাহ্যত পরস্পরবিরোধী কৌশলের অপরিহার্য অংশ হলো আইএসআই। এই সংস্থার মধ্য দিয়েই চরমপন্থী জঙ্গীদের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রকৃত সম্পর্ক নির্ণয় করা যেতে পারে। এই সত্যটি উপলব্ধি করতে যুক্তরাষ্ট্র মন্থরতার পরিচয় দিয়েছে এবং পরবর্তীকালে একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দেশটা এই বাস্তবতাকে সরাসরি মোকাবেলা করতে অস্বীকৃতি জানায়।



কোয়েটায় আমাদের অবস্থানের পঞ্চম ও শেষদিনে চারজন সাদা পোশাকধারী এজেন্ট আমার ফটোগ্রাফার সহকর্মীটিকে তার হোটেলে আটক করে। তারা তার কম্পিউটার ও ফটো তোলার উপকরণ জব্দ করে এবং আমি ওই হোটেলে অবস্থান করছিলাম। সিটির পার্কিং লটে তাকে নিয়ে আসে। সেখানে তাকে দিয়ে আমাকে ডাকায় এবং আমাকে নিচে নেমে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলে। সহকর্মীটি আমাকে বলে “আমি এখানে বিপদে পড়েছি। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি নিচে নেমে এসে পার্কিং লটে যেতে চাইলাম না। তবে আমার সহকর্মীকে বললাম যে আমি সাহায্য চাইব। আমি নিউইয়র্কে আমার এডিটরকে পরিস্থিতিটা জানিয়ে দিলাম, তারপর পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম।

তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই এজেন্টরা দরজা ভেঙ্গে আমার হোটেলের রুমটিতে ঢুকে পড়ল। চৌকাঠটি কয়েক টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল। ওরা ঝড়ের বেগে ছুটে আমার ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিল। একজন ইংরেজী বলিয়ে অফিসার ছিল পরনে খাকি রংয়ের নতুন শার্ট পশমী পোশাক, বাকি তিনজনের পেশীবহুল শরীর। ওদের একজন ফটোগ্রাফারকে টেনে নিয়ে এসেছিল।


ওরা আমার কাপড় চোপড় তল্লাশি করল। আমার নোট বইগুলো ও সেলফোন নিয়ে নিল। একজন আমার হাতব্যাগ আঁকড়ে ধরলে আমি প্রতিবাদ করলাম। সে আমাকে সজোরে দুটো ঘুষি মেরে বসল। একটা মুখে অন্যটা কপালে ও কানের মাঝখানে। আমি কফি টেবিলটির ওপর উল্টে পড়লাম। পতন ঠেকাতে অফিসারটির জামা আঁকড়ে ধরলাম তারপর মেঝেতে পড়ে গেলাম। কয়েকটা কাপ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য ব্যাপারটাকে কৌতুকপূর্ণ লেগেছিল। মনে হচ্ছিল ছায়াছবিতে দেখা হোটেল রুমে মারামারির কোন দৃশ্য। তারপর আমি রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম। একজন মহিলার বেডরুমে জোর করে প্রবেশ করা এবং শারীরিকভাবে প্রহার করার জন্য তাদের তীব্র ভর্ৎসনা করলাম। অফিসারটি আমাকে বলল, আমার পশতুনাবাদ এলাকায় যাবার অনুমতি নেই। তালেবান সদস্যদের সাক্ষাতকার নেয়া আমার জন্য নিষেধ। ওরা চলে যাওয়ার সময় আমি বললাম ফটোগ্রাফারকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে। অফিসারটি বলল ‘ও পাকিস্তানী। আমরা ওকে নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারি’ আমি জানতাম ওরা তাঁকে অত্যাচার করতে পারে। মেরেও ফেলতে পারে। বিশেষ করে কোয়েটায় যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নিজেরাই আইন। তারা যে বাহিনী প্রকাশ হতে দিতে চায়নি তাহলো আফগানিস্তান ও তার বাইরে সন্ত্রাসবাদের প্রচার ও প্রসারের কাজে লিপ্ত জঙ্গী গ্রুপগুলোর প্রতি সরকারের গোপন সমর্থন।


ছ’মাস পর পাকিস্তানে মহাবিস্ফোরণের মতো এক ঘটনা ঘটল। ২০০৭ সালের বসন্তে ইসলামাবাদের লাল মসজিদের সঙ্গে যুক্ত এক মাদ্রাসার ছাত্রীরা নগরীর কিছু মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রতিবাদে অবস্থান ধর্মঘট করছিল। লাল মসজিদ আফগানিস্তানেও গোটা মুসলিম বিশ্বে পরিচালিত জেহাদের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত জিহাদী ভাবধারার প্রচারক মওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, যিনি ১৯৯৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। মৃত্যুর অল্পদিন আগে তিনি আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। আলকায়েদা সেসময় তাঁর হত্যকান্ডের জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করে।

আবদুল্লাহর ছেলেরা মসজিদটির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করে এবং এর উগ্রবাদী শিক্ষা চালিয়ে যেতে থাকে। বড় ছেলে মওলানা আবদুল আজিজ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রকাশ্য ভূমিকা নেয়া এবং আমেরিকার সঙ্গে কাজ করার জন্য মোশারফের শানিত সমালোচনা করে জুমার জামাতে জ্বালাময়ী খুতবা দেয়। তার ছোট ভাই আবদুর রশিদ গাজী আগে ধর্ম-বর্ণ নিয়ে অত মাথা ঘামাত না এবং আমলা হিসেবে তার সুনাম ছিল। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর তার আমূল পরিবর্তন ঘটে। ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং বিন লাদেনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়। ২০০৭ সাল নাগাদ তার অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে গ্রেফতার হবার আশঙ্কায় সে লাল মসজিদ প্রাঙ্গণের বাইরে বের হতো না। সে হুঁশিয়ার করে দিল যে সরকার বিক্ষোভরত মাদ্রাসা ছাত্রীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিলে প্রতিশোধ হিসাবে আত্মঘাতী বোমাবাজের দল পাল্টা আঘাত হানবে।

এমন সব নেতা তাদের পেছনে থাকায় ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে। ওরা ছিল র‌্যাডিকেল ও ঘোরে পাওয়া। বিক্ষোভ বন্ধ করার চাইতে তারা মৃত্যুকেই বরণ করে নেবে এমন শপথ নিয়েছিল। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা তাদের উল্টো উৎসাহিত করে তুলেছিল। বিক্ষোভ শুরু হবার কয়েকমাস পর একদল ছাত্র মধ্যরাতে এক ম্যাসেজ পার্লারে হানা দিয়ে বেশ কজন চীনা মহিলাকে অপহরণ করে।

পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্র চীন এর তীব্র প্রতিবাদে জেনারেল মোশারফকে ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয়। ৩ জুলাই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর রেঞ্জাররা রাস্তার ওপারের একটি স্কুল দখল করে নেয় এবং পুলিশ অফিসার ও জওয়ানরা মসজিদকে ঘিরে ফেলে। ওদিকে মসজিদেও ভেতর থেকে রকেট ও এসল্ট রাইফেল নিয়ে সশস্ত্র যোদ্ধারা আবির্ভূত হয়। মসজিদের দেয়াল বরাবর বালুর বস্তা ফেলে অবস্থান নেয়। লাউড স্পীকার থেকে ছাত্রদের উদ্দেশে বলা হয় বীরত্ব প্রদর্শনের এখনই সময়। এক ছাত্রী মাইক্রোফোনটা তুলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘হে আল্লাহ! কোথায় তোমার সাহায্য? শত্রুকে ধ্বংস করে দাও। তাদের হৃৎপি- ছিন্ন ভিন্ন কর। তাদের ওপর আগুনের গোলা ছুড়ে মার।’

সিভিল সার্জেন্ট ও কূটনীতিকদের জন্য সবুজ শ্যামল, শান্ত ও নিস্তরঙ্গ এলাকা ইসলামাবাদ। কিন্তু কয়েকটি দিন গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের আওয়াজে এলাকাটি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। সন্তানদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সারাদেশ থেকে উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা এসে ভিড় জমিয়েছিল। লাল মসজিদের নেতারা ছাত্রছাত্রীদের ধরে রাখতে চাইছিল। জনৈক ছাত্রের বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘ওদের কথা ছিল মেয়েরা ও অন্যরা মারা গেলে মানুষ তাদের পক্ষ অবলম্বন করবে।’ আমি তখন উপলব্ধি করেছিলাম এসব কিছু কতই না পূর্বপরিকল্পিত, তাদের বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনায় কিভাবেই না মেয়েদেরকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

অবরোধ শুরু হবার এক সপ্তাহ পর হিংস্র লড়াই বেধে যায়। পাকিস্তানী এলিট কমান্ডোরা হেলিকপ্টার থেকে মসজিদে আঘাত হানে। তারা মেশিনগানের গুলি ছোড়ে। মসজিদের মিনারে এবং মাদ্রাসার ৭৫টি কক্ষের সব কয়টিতে অবস্থানরত জঙ্গীরা ১০ ঘণ্টা ধরে লড়াই চালায়। বাঙ্কার থেকে তারা গ্রেনেড ছুড়ে মারে। আত্মঘাতী বোমাবাজরা বোমা নিয়ে হামলাকারীদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কমান্ডোরা সিঁড়ির তলায় ইটের ওপর ইট বসিয়ে আড়াল করা জায়গায় ছাত্রীদের লুকিয়ে থাকতে দেখে এবং ৫০ জন মহিলা ও বালিকাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। গাজী মসজিদ প্রাঙ্গণের এক বেজমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন। তিনি সেখানেই মারা যান। শেষ জীবিত যোদ্ধারা তাঁর চারপাশ থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।

সেনা অবরোধের ১০ জন কমান্ডোসহ এক শ’রও বেশি নিহত হয়। মসজিদ ও এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আইএসআইয়ের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। ভেতরের দুজন ইনফর্মার তাদের গোপনে তথ্য যুগিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সংস্থাটি অদ্ভুত রকমের অকার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। অবরোধ অভিযান শেষ হবার পর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মন্ত্রীরা জঙ্গীদের কার্যক্রম রোধে গোয়েন্দা সার্ভিসের ব্যর্থতার বিষয়ে আইএসআইয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এক মন্ত্রী ওই কর্মকর্তাকে বলেন, ‘সন্ধ্যায় আমি কার সঙ্গে দেখা করি ও কি নিয়ে আলোচনা করি তা পরদিন সকালে আপনাদের ডেস্কে দেখতে পাওয়া যায়। এটা কেমন কথা যে আইএসআই সদর দফতর থেকে মাত্র এক শ’ মিটার দূরে কি ঘটছিল আপনারা কিছুই জানতেন না। মন্ত্রীরা টেবিল চাপড়িয়ে এই বক্তব্যের সঙ্গে এক মত প্রকাশ করেন। কর্মকর্তাটি টু শব্দটি না করে বসা ছিলেন। বৈঠকে অংশ নেয়া এক সাবেক কেবিনেট মন্ত্রী আমাকে বলেন, ‘ওরা কি ঘটছে না ঘটছে এক শ’ ভাগই জানত।’ তিনি বলেন ‘আইএসআই সহানুভূতি থেকেই জঙ্গীদেরকে তারা যা করতে চেয়েছিল করতে দিয়েছিল। লোকে রাষ্ট্রকে যতটা অকর্মন্য মনে করে ততটা অকর্মন নয়।’

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অল্পদিনের মধ্যেই এক হিংস্র প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়। পরবর্তী কয়েক মাসে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সৈন্যদের কনভয়ের ওপর কয়েকটি হামলা হলো এবং সারাদেশে সরকারী সামরিক ও বেসামরিক টার্গেটগুলোতে একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলা চলে। এর মধ্যে ছিল রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর সদরদফতর ও আইএসআইয়ের প্রধান কম্পাউন্ড। প্রক্সিযুদ্ধে লড়তে বছরের পর বছর জিহাদীদের লালন করার পাল্টা ফল কি হতে পারে পাকিস্তান এখন তা ভোগ করছে।  লাল মসজিদ অবরোধের ছ’মাস পর এক সাবেক সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও তাঁর এক সহকর্মী আমার কাছে বলেন, ‘আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।’

জঙ্গীরা তাদের মনিবদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও পাকিস্তানী জেনারেলরা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এদেরকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। তার মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য একটি উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোকে টার্গেট করা, যিনি প্রায় এক দশক প্রবাস জীবন কাটানোর পর ২০০৭ সালের হেমন্তে বিমানযোগে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মোশারফের সঙ্গে বেনজীরের একটা রফা হয়েছিল যে তিনি তাকে সেনা প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আরেকটা মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে দিবেন এবং এভাবে বেনজীরের নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পথ পরিষ্কার হবে। ২০০৮ সালের প্রথমদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল।


জঙ্গী উগ্রবাদের বিপদ সম্পর্কে বেনজীর ভুট্টো যে কোন পাকিস্তানী রাজনীতিকের চেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। পাকিস্তানের ভূখন্ডের  একাংশ গ্রাস করে নেয়ার জন্য তিনি বিদেশী জঙ্গীদের দায়ী করেন এবং ওয়াজিরিস্তানে সামরিক অভিযানে চালানোর দাবি জানান। তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলাকে অনৈসলামিক ঘোষণা করেন এবং যারা তাঁকে হামলার টার্গেট করতে পারে তাদেরকে বাহ্যত  চ্যালেঞ্জ করে বসেন। 

গোলমেলে মন, গোঁজামিলের রাজনীতি- মুনতাসীর মামুন


আজকাল দেখি সবাই রেগে আছেন। সবাই কোন না কোন কারণে ক্ষুব্ধ। গ্রীষ্ম বাড়ছে। জানি না, গ্রীষ্মের উত্তাপ আবার সবার মধ্যে সঞ্চারিত হবে কিনা। তবে, একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় এই ক্রোধের ভিত্তি কোন না কোনভাবে জামায়াতে ইসলাম। উপজেলা নির্বাচন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় আরও দুটি ইস্যু নিয়ে কথাবার্তা চালাচালি হচ্ছে। সেখানেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইস্যু হচ্ছে জামায়াত।

মন্ত্রীরা পরস্পরকে এবং একত্রে ‘বুদ্ধিজীবী’দের সমালোচনা করছেন। এখানে ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে তাঁরা সংবাদপত্রের কলামিস্ট, লেখক, অধ্যাপকদের চিহ্নিত করছেন। আবার অন্যদিকে ‘বুদ্ধিজীবী’রাও নীতি নির্ধারকদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে ও বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সমালোচনা করছেন। বিএনপি-জামায়াত-কমিউনিস্ট পার্টি আবার জোট সরকারের সমালোচনা করছে। একদিকে থেকে এসব তর্কবিতর্ক খারাপ না। গণতান্ত্রিক বোধ যে আমাদের তীব্র হচ্ছে তারই প্রমাণ। তর্কাতর্কি হচ্ছে বটে তবে বিএনপি- জামায়াত আমলের মতো ‘বুদ্ধিজীবী’দের আক্রান্ত হতে হচ্ছে না। এটি আশার বিষয়। এদেশের ‘বুদ্ধিজীবীরা’ সংখ্যালঘুদের চেয়ে সংখ্যালঘু। বিএনপি-জামায়াত আমলে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন তাদের প্রাক্তন মন্ত্রী ও নেতারা গ্রেফতার হচ্ছেন। এসব গ্রেফতারের কারণ কতটা যথার্থ সে সব বিষয়ে যাব না। সব মামলাই বিচারধীন। কখনও কী বলে ফেঁসে যাই। আর এমনিতেই আদালতের হাত লম্বা।

প্রথমে ধরা যাক, জাতীয় সঙ্গীতের কথা। দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য বর্তমান সরকারের দুটি প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। দুটি প্রচেষ্টায়ই সেনাবাহিনীর উদ্যোগ লক্ষণীয়। সরকারী-বেসরকারী যে কোন উদ্যোগই হোক সেখানে ভরসা করতে হচ্ছে সেনাবাহিনীর ওপর। সিভিল প্রশাসন আর জনগণ এখন আর ক্ষমতাধর নয়, কারও ভরসাস্থলও নয়। রাজনৈতিক দল যারা সিভিল সমাজের প্রতিনিধি জনগণ তাদের কাছে প্রিয় জনসভা ও ভোটের সময়।

প্রথম উদ্যোগটি ছিল মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট সবচেয়ে বড় পতাকা। যদিও আমি দেশপ্রেম শব্দটির উল্লেখ করেছি কিন্তু যাঁরা এটি প্রযোজনা করেছেন তাঁরা বলেছেন, এটি গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্থান পাওয়ার জন্যই করা। তাঁরা সফল হয়েছেন। তবে, তাঁরা যদি বলতেন সেটি মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, দেশপ্রেমের আবেগ সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য, তাহলে বিষয়টি আরও গ্রহণযোগ্য হতো। মনে রাখা উচিত একটি বেসরকারী কোম্পানি বিজ্ঞাপনের কারণেই এ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিল। তবুও প্রয়াসটি অভিনন্দনযোগ্য। কারণ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে, এমনকি আমাদের মাঝেও তা আবেগের সৃষ্টি করেছিল। উদ্যোগটি বেসরকারী ছিল বলে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হয়নি।
এবার সরকার গ্রহণ করেছে। লাখোকণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার। এই প্রস্তাবটিও অভিনব। এর সঙ্গেও দেশপ্রেমের আবেগটি জড়িত। কিন্তু, মুশকিল হলো, প্রথমে বলা এবং তারপরও বলা হয়েছে হয়েছিল, এটিও করা হচ্ছে গিনেস বুক অব রেকর্ডসের জন্য। মাঝে মাঝে তখন এও বলা হয়েছে, সংস্কৃতিমন্ত্রীই বলেছেন দেশপ্রেমের আবেগ সৃষ্টির জন্যই লাখো মানুষকে একত্রিত করা হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় সঙ্গীত হাওয়ার জন্য। অবশ্য এটিও গিনেস বুক অব রেকর্ডসে উঠবে।

গিনেস বুক অব রেকর্ডস একটি কোম্পানি। নিছক ব্যবসার জন্য গিনেস বুক অব রেকর্ডসের সৃষ্টি। এবং এই কোম্পানি ব্যবসা সফল। কয়টা কেঁচো খেলো, কে কয়টা হ্যামবার্গার খেলো, কোন শেফ সবচেয়ে বড় চকলেট কেকটি বানালেন, এক পায়ে কে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল প্রধানত এগুলোই রেকর্ডসের উপজীব্য। প্রায় ৪৫০০টি ‘রেকর্ড’ স্থান পেয়েছে সেখানে। দেশপ্রেম নিয়ে এ ধরনের রেকর্ড বুকে রেকর্ড সৃষ্টি করার খুব একটা দরকার ছিল না। সরকারের তো নয়ই। কোন কোম্পানির কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কিছু প্রমাণের দরকার নেই। সরকারের তো নেই-ই। কিন্তু তবুও বলব, দুটি প্রচেষ্টাই অভিনন্দন যোগ্য। এ দুটি বিষয় দিয়ে কিন্তু তরুণ ও বয়স্কদের ঐক্যবদ্ধ করা যায়। আবেগের সৃষ্টি করা যায় যা এ মুহূর্তেও প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে ইস্যু যেখানে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতি। এ দুটি ইস্যুতে অন্য ধরনের বক্তব্যও রাখা যেতে পারে।

পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লাখ শহীদের সঙ্গে জড়িত। যখন একটি শিশু বড় হয়ে ওঠে, মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিশ লাখ শহীদের কথা না জানলেও একটি বিষয় বোঝে জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত তার পরিচয় বহন করে। বিদেশে যখন কোন অনুষ্ঠানে, ভবনে জাতীয় পতাকা দেখি বা জাতীয় সঙ্গীত শুনি তখন জামায়াতে ইসলামের ক্যাডার ছাড়া সবার হৃদয়ই- আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে। জাতীয় পতাকাটা সবাই চিনি, সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত, মনে রাখাও সহজ। জাতীয় পতাকার নিয়মকানুনও আছে যা আমরা অধিকাংশই মানি না। যেমন, ১৬ ডিসেম্বর গাড়িতে, রিক্সায় জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। নিয়মকানুন মানলে তা সম্ভব নয়। কিন্তু, বিজয়ের আনন্দে পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। ক্রিকেটে জিতলে জাতীয় পতাকা নিয়ে বেরোই।

অন্যদিকে, জাতীয় সঙ্গীত যে অধিকাংশ মানুষ পুরোপুরি জানে না সেটি আমি নিশ্চিত। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এ লাইন দুটি জানি, তারপর অধিকাংশ লাইনই আর মনে পড়ে না। শুদ্ধ সুরেও গাই না। কোন অনুষ্ঠানে কত লাইন গাওয়া হবে তারও নিয়ম আছে। অনেক অনুষ্ঠানে দেখি সেটাও মানা হয় না। তাই সবাই মিলে লাখোকণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াটা একটি বিশুদ্ধ আনন্দ তো বটেই।

এখন এটিই প্রশ্ন । ছেলে বেলায়, প্রতিটি স্কুলে ‘অ্যাসেম্বলি’ বলে একটি কথা চালু ছিল। চট্টগ্রামের মতো মফস্বলে গত শতকের ষাটের দশকে স্কুল শুরু হওয়ার আগে সব ছাত্ররা মিলিত হতাম। তখনকার পাকিস্তানী পতাকা উঠানো হতো এবং আমরা এক সঙ্গে গাইতাম ‘পাক সার জমিন শাদ বাদ।’ এটি কি খুব খারাপ প্রথা ছিল? বিন্দুমাত্র না। গত কয়েক দশক আমরা এই সাধারণ দাবিটি করে আসছিলাম যে, বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে মাদ্রাসা ও ইংরেজী স্কুলগুলোতে পতাকা ওঠানো ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বাধ্যতামূলক করা হোক। করা হয়নি। আজ লাখো কণ্ঠে গান গাওয়া হবে, বিশ্বরেকর্ড হবে। সবাই মিলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে এবং তারপর যেই কী সেই। অথচ, স্কুলের বিষয়টি বা সেই মৌল কাজটির প্রভাব হতো সুদূর প্রসারী এবং এতে কোন পয়সা খরচ হতো না।

লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার ক্ষেত্রে বিতর্ক আরো উসকে দিয়েছেন সরকারের দুই মন্ত্রী। প্রকাশ্য বাকযুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হলেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ইসলামী ব্যাংকের অনুদানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া অনুচিত। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ ধরনের কোন অনুদান সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। কিন্তু বিডি নিউজ ২৪ডটকম জানাল, ‘ব্যাংকের (ইসলামী) এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান বলেন, লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত আয়োজনের জন্য ১৪ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিন কোটি টাকা অনুদানের চেক তুলে দেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটিডের ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফা আনোয়ার। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী ও জ্বালানি উপদেষ্টা। সংস্কৃতিমন্ত্রী পরে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুদানের চেক দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তহবিলের টাকা কোন খাতে ব্যয় হবে সেটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ঠিক করে না। তবে, তার জানা মতে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে এই খাতে টাকা আসেনি। আরো পরে তিনি জানান, ইসলামী ব্যাংক তো বেআইনী নয়। তার সব কটি যুক্তিই সঠিক।


 কিন্তু সঠিক যুক্তির পরও কথা থাকে যা লিখেছেন স্বদেশ রায়। তিনি লিখেছেন- “বাস্তবে এই আপোসের টনিকটি শুধু আজ নয়, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তো আর বেআইনী ছিলেন না, যে কারণে কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংও তাঁর সঙ্গে খাল কাটতে গিয়েছিলেন। এ সব স্বেচ্ছাসেবী কাজে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন সব সময়ই ভাল তাই তারা সেদিন ভালই খাল কেটেছিল। আর সেই খাল দিয়ে যে সব কুমির এসেছে এই যেমন জামায়াতে ইসলামী এরা তো বেআইনী নয়। আইন অনুযায়ী তো তারা রাজনীতি করছে। খালেদা জিয়ার বিএনপি, সেও তো বেআইনী নয়। আইন অনুযায়ী তারা রাজনীতি করছে। তাই জামায়ত-বিএনপি নরহত্যা, নারী হত্যা, শিশু হত্যাÑ সর্বোপরি গণহত্যা করলেও তাদের সঙ্গে আপোস চলে। কারণ, তারা তো বেআইনী নয়।

তবে এইটুকু সত্য মনে হয় এখন মনে রাখার সময় এসেছে যে, ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ছিনতাই করার পরে অনেক কিছু আইনী কাঠামোর ভিতর ঢুকানো হয়েছে। যা কোনক্রমে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে না। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের উষ্ণতার সঙ্গে, সাড়ে ছয় লাখ মা-বোনের আব্রু হারানোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মানুষ জামায়াত-বিএনপির হাতে জীবন দিয়েও এই সরকারকে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে কেউ যেন মনে না করেন মানুষ তাদের ক্ষমতায় পাঠায়নি। মানুষ তাদের পক্ষে ছিল বলেই কিন্তু নির্বাচনের পরের দিনই বিএনপি-জামায়াতের তা-ব ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে। আর এই মানুষ স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষ। এই মানুষ যারা গণজাগরণ মঞ্চে সারাদেশে এক হয়েছিল সেই মানুষ” [জনকণ্ঠ : ২৪.০৩.২০১৪]। 


ইনু বললেন, ‘টাকা ফেরত দেয়া উচিত।’ নূর বললেন, ‘টাকা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেয়নি।’ প্রশ্ন হলো, টাকা নেয়া হলো কেন? যতদূর মনে আছে, আমাদের হাসিখুশি সরল অর্থমন্ত্রী এই ঘটনার আগে বলেছিলেন, ঠাট্টা করে যে, টি২০ ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার আয়োজনের জন্য অনেক টাকা লাগবে। ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ জানানো হয় তারা যেন প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দান করেন। মন্ত্রী এটিকে ‘চাঁদাবজি’ বলে উল্লেখ করেন। ঠাট্টা করে বললেও বিষয়টি তো সত্য। প্রাইভেট ব্যাংককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ব্যবসা করার জন্য। 

কিছুদিন পর পর এভাবে টাকা চাইলে তারা তো বলতে পারে কোন আইনে লেখা আছে যে টাকা দিতে হবে। কিন্তু ব্যাংক তো সামাজিক খাতে ব্যয় করবেই। সেখান থেকেই টাকা দিতে বলা হয়। কিন্তু কোন ব্যাংকের সেই খাতের টাকা শেষ হয়ে গেলে তারা এই টাকা দেবে কোত্থেকে? সেটিও বিবেচনায় নেয়া উচিত।

ইসলামী ব্যাংকের টাকা সরকার জেনে শুনে নিয়েছে এবং এর যে এ রকম প্রতিঘাত হবে তা বোধহয় কর্তা ব্যক্তিরা ভাবেননি, আগেও নিয়েছে। প্রশ্ন হলো, ইনু কি বিষয়টি জানতেন না? দুই মন্ত্রী ময়লা কাপড় বাইরে কাচাকাচি করলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না। একটি সামান্য প্রশ্ন মনে আসছে, কেবিনেট মিটিংয়ে তিনি বা তারা প্রশ্নটি কেন তুললেন না। সেখানেই তো বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে পারত।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। কয়েকদিন আগে আমরা কয়েকজন ইয়াঙ্গুন গিয়েছিলাম। সেখানে জাতীয় জাদুঘরে গেছি। পুরনো কয়েকটি ছবিতে দেখলাম, রাজা বসে আছেন সিংহাসনে [যখন মিয়ানমারে রাজা ছিলেন]। 

সামনে এক দল অমাত্য। তারা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার ভঙ্গিতে বসে আছেন। একজন মন্তব্য করলেন, ঠিক আমাদের মন্ত্রীদের মতো! সবার অট্ট হাসিতে রক্ষী পর্যন্ত সচকিত হয়ে উঠলেন। 

এই লেখা শেষ করার সময় খবর পেলাম, সরকার ইসলামী ব্যাংকের টাকা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ায় ব্যয় করবে না। ব্যাংক টাকাটা ফেরত নিতে পারে বা অন্য খাতে দিতে পারে। সরকার আরও জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক বিধিবদ্ধ ব্যাংক। অর্থাৎ, এ বিষয়ে মানুষজন ক্ষুব্ধ তাই এ খাতে টাকা নেয়া যাবে না। অন্য খাতে আপত্তি নেই। এ প্রসঙ্গে স্বদেশ রায়ের বাক্য আগেই উল্লেখ করেছি। একই প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন, ইসলামী ব্যাংক “দীর্ঘ দিন যাবত সন্ত্রাস অর্থ যোগান দিয়ে আসছে। এখানে ‘টাকা আমারও দরকার জগৎ শেঠ’ এই নীতিতে শরীর ও মনপ্রাণ ডুবিয়ে আপোস করার সুযোগ নেই। সে আপোস যদি সরকার করতেও চায় তা হলে সরকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারবে। এবং বাংলাদেশের শেষ আশ্রয়স্থল শেখ হাসিনাকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের সঙ্গে গত তিন মাসে বার বারই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।” আমাদের অনেকের বক্তব্যই তা। কিন্তু শেখ হাসিনাই তো সরকার।


সরকার যে টাকা ফেরত দেয়ার ঘোষণা দিল সে জন্য শেখ হাসিকে ধন্যবাদ। তিনি অনুধাবন করেছেন, এর জন্য মানুষের শুব্ধ আবেগকে আহত করা হবে। সরকারের এ কাজ করা ঠিক হবে না। জনমতকে প্রাধান্য দেয়া গণতান্ত্রিক সরকারের মূল কাজ। কাজটি তিনি করেছেন এ জন্য আমরা খুশি। সব সময় যদি তা করতেন!

আরেকটি অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ও সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও তোফায়েল আহমদ ছিলেন। মিজানুর বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী একটি গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে... ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে অক্টোবর ও নবেম্বরে যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, মানুষের নিরাপত্তা যেভাবে বিঘিœত হয়েছে –তার নিরাপত্তা করতে বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। দুই মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেনÑ ‘সরকারের কাছের ও প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর কাছে বলতে চাই, আমরা মানবাধিকার কমিশন থেকে যখন ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি, তখন দেখেছি সংখ্যালঘু বাড়িতে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হাতেগোনা কয়েকজকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে কয়েক শ’ বা কয়েক হাজার।’ তিনি বলেন, এটা দোষীদের খুঁজে বের করার জন্য নয়, ব্যবসা করার জন্য এভাবে মামলা করা হয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে এ ধরনের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। 

পরে মিজানুর রহমানের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, হামলার সঙ্গে কারা জড়িত, এটা সবার কাছে স্পষ্ট। এখানে একজন বক্তব্য দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু যারা সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেন না। কেন বললেন না? কারণ এরা হলেন সেই শক্তির ধারক। এরা তাদের খরচ যোগান। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে শুধু মাঠ গরম করা যায়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মিজানুর রহমানের সমালোচনা করে বলেন, ‘এখানে একজন মন্ত্রীদের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করলেন না। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবীদের পার্থক্য রয়েছে। তারা স্পষ্ট করে কথা বলেন না। যেটা প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেই যায়।’[ প্রথম আলো : ২২-০৩-১৪]

বোঝা যায় যে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কথায় তারা দু’জনই খুবই রুষ্ট। কিন্তু কারণটি কি? তাদের উক্তি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, আওয়ামী লীগ [নেতৃবৃন্দ] কিভাবে বাইরের জগৎটি দেখে, কেন তার বিস্তৃতি ঘটছে না যেভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে বিএনপি-জামায়াতের।


প্রথমেই ড. মিজানের ব্যাপারটি দেখা যাক। মানবাধিকার কমিশনকে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। দাতাদের ও দেশীয় মানবাধিকার কর্মীদের চাপে এটি গঠন করতে হয়েছে। কোন সরকারই এ ধরনের কমিশন গঠনে ও কার্যকর করতে আগ্রহী হবে না। চাপে পড়ে এটি করা হয়েছে এবং যা ছিল তাই আছে। এর চেয়ে পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের অবস্থা অনেক ভালো। ড. মিজানের বলতে গেলে কোন কাজ নেই, মাঝে মাঝে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দেয়া ছাড়া। 

তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন মন্ত্রীদের সামনে তার কোন অংশটি ভুল?
১.নির্বাচনের আগে কি সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের দলন করা হয়নি?
২. নির্বাচনের পর কি একই ঘটনা ঘটেনি?
৩. পুলিশ কি প্রায় ক্ষেত্রে শ’ থেকে হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি করেনি?
৪. এবং এগুলোর কি খানিকটা বাণিজ্যকরণ হয়নি?
এর কোনটি অসত্য? 

ড. মিজান বলেছেন-
৫. এসব কর্মকান্ড  করেছে স্বাধীনতা বিরোধীরা? এটি কি ভুল? এবং এ কারণে তিনি মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্র দলিতদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র/সরকার সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। এটি আমার থেকে মন্ত্রীদ্বয় ভাল জানেন। তাঁরা নিজেরাই কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার বয়ান করেছেন। তাঁরা হয়ত সরকার ব্যর্থ হয়েছে তা বলেননি। না বলার কারণ তাঁরা এখন মন্ত্রী, আমরা অবশ্য এও লক্ষ্য করেছি, ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে অনেকে এমপি থাকা অবস্থায় সরকার সমালোচনায় মুখর ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর সবাই সবকিছু দার্শনিক দৃষ্টিতে অবলোকন করছেন। ড. মিজান তো আওয়ামী লীগের ক্যাডার নন। এই সরকারের আমলে কাউেেক কোন পদে দিল কি ধরে নিতে হবে তাকে কিনে ফেলা হয়েছে? একজন মন্ত্রী যা বলতে পারেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তা বলতে পারেন না। এই মর্যাদাবোধটুকু তাকে না দিলে মানবাধিকার কমিশন লুপ্ত করে দেখাই শ্রেয়।

দু’জন মন্ত্রীই বলেছেন, সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের নাম বলেননি ড. মিজান। সুতরাং তিনি তাদেরই অর্থাৎ তিনি হামলাকারীদেরই লোক। ড. মিজান পরিষ্কারভাবে বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা এর সঙ্গে যুক্ত। মন্ত্রীদ্বয় কি মনে করেন আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী? যদি না হয় তাহলে স্বাধীনতা বিরোধী কারা? এত কিছু তারা বোঝেন আর এটি বোঝেন না?

সরকারের অর্থাৎ বর্তমান সরকারের সমালোচনা করলেই একজন হয়ে যায় স্বাধীনতাবিররোধী। এই মানসিকতা সুস্থ মানসিকতা নয়। তোফায়েল আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,“আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবীদের পার্থক্য রয়েছে। তারা স্পষ্ট করে কথা বলেন না। সেটা প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেই যায়।” প্রাক্তন এক ছাত্র নেতা নূরে আলম সিদ্দিকি কয়েকদিন আগে বলেছেন, যার মর্মার্থ দাঁড়ায় কমিউনিস্টরা বাংলাদেশের সর্বনাশ করেছে। আওয়ামী লীগের সর্বনাশ হচ্ছে বেশি। 
প্রচন্ড  বিত্তশালীরা এ কথা বলতেই পারেন। আওয়ামী লীগ লুটেরাদের দলে পরিণত হোক এটি কারও কাম্য হলে তাও সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়।

মাননীয় দু’জন মন্ত্রী অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ এবং প্রভাবশালী। তোফায়েল আহমেদ তো আমরা ছাত্র থাকাকালীন আমাদের নেতাই ছিলেন। তাদের পরামর্শ বা জ্ঞান দেবার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে, একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি।
তখন তিন উদ্দিনের অন্ধকার যুগ চলছে। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক আমল। মোহাম্মদ নাসিম জেলে। ভারতীয় হাইকমিশন এক ভোজসভার আয়োজন করেছে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সম্মানে, হোটেল র‌্যাডিসনে। অনেকের সঙ্গে আমি ও শাহরিয়ার কবিরও ছিলাম। পার্টিতে যা হয়, ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। সামরিক শাসনের যন্ত্রণার কথা যখন বলছিলাম তখন তিনি অবাক হয়ে বলছিলেন, তাই নাকি! তাই নাকি! বলেই ফেললাম, আপনি কি এই দেশের নাগরিক? যদি নাগরিক হন তাহলে কী ঘটছে আপনি জানেন না একজন রাজনীতিবিদ হয়ে? তিনি অবশ্যই ক্ষুব্ধ হলেন কিন্তু না আমরা ক্ষুব্ধ হয়নি। কারণ, আমরা জানতাম তিনি তত্ত্বাবধায়ক সামরিক কর্তাদের সমর্থক। এক পর্যায়ে আবদুর রাজ্জাককে পেলাম, তিনি তখন সংস্কারপন্থীদের নেতা। আমি তার সংস্কার পন্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দ্রুত কাজ আছে বলে, পার্টি ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর পাওয়া গেল সংস্কারপন্থীদের আরেক নেতা শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। তিনি এমন একজন রাজনীতিক যার সঙ্গে ঝগড়া করাও আনন্দদায়ক। আমাদের দু’জনকে তিনি স্নেহও করেন। আমরা সংস্কার নিয়ে তার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। বরং অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী এসে দু’একটি কড়া কথা বলছিলেন। সুরঞ্জিত দা একবার বললেন, ঠাট্টা করতাছ। বুঝবা মিয়ারা বুঝবা। তা বোঝার জন্য শাহরিয়ার কবির বলল, সুরঞ্জিত দা, পুরো বিষয়টা আমরা আপনার কাছে বুঝতে চাই। আমরা মনে করি না শেখ হাসিনা ছাড়া সংস্কার হবে বা তিনি ছাড়া আওয়ামী টিকবে। তিনিই একমাত্র নেতা যাকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সবাই জানে। সুরঞ্জিত দা নিরুপায় হয়ে বললেন, আগামীকাল বাসায় আস। পরের দিন শাহরিয়ার ফোন করে জানাল, সুরঞ্জিতদার খোঁজ করলাম, উনি কানাডা চলে গেছেন। এ রকম আরো ঘটনার পর তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমার দেখা। বললাম, ‘তোফায়েল ভাই, আপনি কি মনে করেন শেখ হাসিনাকে আপনারা বাদ দিতে চাইলে কারো পিঠের চামড়া থাকবে?’ তখন অনেকে বলাবলি করেছিল, তিনিও সংস্কারপন্থীদের সমব্যথী। তোফায়েল ভাই পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা ছাড়া কিছু করা যাবে না, আমি তাঁর পক্ষে। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ছিলেন কি ছিলেন না জানি না। তবে, প্রকাশ্যে কখনও তিনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বলেননি।

এখন আমার প্রশ্ন, আওয়ামী লীগের একটি অংশ তো শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল। আপনারা কি কখনও তাদের সমালোচনা করেছিলেন? সেই সময়কার পত্রপত্রিকা খুঁজে দেখুন। যারা প্রতিনিয়ত সামরিকবাদের বিরোধিতা করে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, স্বদেশ রায়, আবেদ খান ছাড়া আরও অনেকের নাম পারেন। জেলে গেছেন প্রায় আট দশজন শিক্ষক। আওয়ামী লীগের কয়জন সামরিকবাদ বা সংস্কারপন্থীদের রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।’ এই ড. মিজানও তখন বক্তৃতা বিবৃতিতে আমরা যা বলেছি তাই বলেছেন। আওয়ামী লীগের একাংশ তখন প্রায় নিশ্চিত শেখ হাসিনাকে যেতে হচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায় আর এই ‘বুদ্ধিজীবী’রাই রুখে দাঁড়িয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ছয় বছরে যাদের পুরস্কৃত করেছেন বিভিন্নভাবে তাদের অনেকে তখন বিদেশে কাটিয়েছেন, পালিয়ে গেছেন, নীরবে থেকেছেন। তখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কে কি বলেছিলেন যদি জানতে চান, বলবেন, বড়সড় একটি লেখায় তা জানান যাবে। আচ্ছা প্রিয় তোফায়েল ভাই, নাসিম ভাই, কয়েকজন এক সময় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে জুতা বানাবেন, যাদের আমরা সুমেকার বলি, তাদের অনেককে আপনারা মন্ত্রী/সাংসদ বানাননি? এক সঙ্গে ক্ষমতা উপভোগ করেননি? তখন তো কাউকে সামান্য প্রতিবাদ করতেও দেখিনি। 


বঙ্গবন্ধু খুনের পর খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কি কোন বুদ্ধিজীবী গিয়েছিলেন? সমর্থন করেছিলেন? নাকি, আওয়ামী লীগের নেতারা তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন? তাদের কয়জনকে আপনারা সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন? দুর্নীতি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজির সঙ্গে কতজন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ নেতা, ছাত্র নেতা জড়িত? আর পুরনো কমিউনিস্টদের কয়জন? মাত্র একজন আবদুল মান্নান খান। আপনারা কয়জন, হ্যা, জনাব তোফায়েল আহমেদ ও জনাব নাসিম, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জামায়াত নেতৃবৃন্দের নাম করে সমালোচনা করে বিরোধিতা করে ছিলেন? তাই বলি হিসাবের খাতা খুলতে চান আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা আদর্শের প্রশ্নে, খুলুন, আমরা খুশি হব।

এই পুরো নিবন্ধ, তাতে দেখবেন, অন্তিমে জামায়াত ইস্যুকে কেন্দ্র করেই সব বিতর্ক বা অভিযোগ। কিন্তু, এই জামায়াতের ক্ষেত্রে শুধু আওয়ামী লীগ নেতারাই নয়, অন্যরাই পরিষ্কার স্পষ্ট স্ট্যান্ড নেননি। হ্যা আমাদের অনেকেও নিইনি। কিন্তু কথা বলতে ভালবাসি।

জনাব তোফায়েল আহমেদ ও জনাব নাসিম নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রভাবশালী। আমাদের প্রশ্ন, ২০০১-০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত সংঘটিত সহিংসতার বিরুদ্ধে শাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্ট দেয়ার পরও জোট সরকার কেন তা প্রকাশ করেনি? ঐ সব সহিংস ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? এইসব মামলা তো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হওয়া উচিত। যারা এসব ঘটিয়েছে তাদের নাম কমিশনে আছে এবং আমরাও উল্লেখ করেছি। [আওয়ামী লীগ নেতারা জামায়াত-বিএনপির ক’জন নেতার কথা বলেছেন?] তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো না কেন? তত্ত্বাবধায়ক সামরিক আমলে সেনাবাহিনীর যে সব অফিসার গন্ডি   ছাড়িয়ে অত্যাচার করেছে ও অর্থ আত্মসাত করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হলো না কেন? নির্বাচনে আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াতের যারা সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? জামায়াত রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তো আমরা গত তিন দশক ধরে করছি। নিষিদ্ধ করছেন না কেন? ইসলামী ব্যাংক তো টাকা পাচার ও জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত, ব্যবস্থা নেননি কেন? আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীরা এখন জামায়াতের বিরুদ্ধে কিছু কিছু কথা বলেন, তাহলে ইসলামী ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতা কেন নেন?’ 

যে সব চ্যানেলকে আপনারা আমাদের পক্ষ মনে করেন এবং তাদের খুশি করার জন্য অনেক কিছু করেন, তাদের সংবাদ শিরোনাম থেকে অনেক কিছুর স্পন্সর ইসলামী ব্যাংক কেন? আমাদের অনেকে ইসলামী ব্যাংকে টাকা রাখেন আর জামায়াত নিষিদ্ধের কথা বলেন, তাহলে কিভাবে হবে? আওয়ামী লীগের এক ধরনের অঙ্গসংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কয়জন ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ইত্যাদিতে কাজ করেন? আওয়ামী লীগের কতজন খাতক ইসলামী ব্যাংকে? 

এসব প্রশ্ন কি বিবেচনায় আনবেন অনুগ্রহ করে? একটি প্রশ্নের জবাব মুক্তিযুদ্ধের পরে যে কেউ আপনাদের কাছে চাইতে পারে এবং উদ্ধত না হলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনারা সে প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য, তা হলো-১৯৪৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলাম এতসংখ্যক আসন পায়নি যা পেয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জামায়াত পেয়েছে ৩৩টি ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৩৩টি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি সঠিক হলে, গ্রহণযোগ্য হলে এই আমলে এত আসন কিভাবে তারা পেল? এর কারণ গোঁজামিলের রাজনীতি ও আমাদের গোলমেলে চিন্তাধারা। তা স্বীকার করতে না পারেন, ঔদ্ধত্যের বা আত্মগরিমার কারণে। যে কারণে একজন রাজনীতিবিদ সরে গেলে, সরিয়ে দেয়া হলে, সরে যেতে বাধ্য হলে, ৫০ বছরের মধ্যে বিস্মৃত হন, বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন হলেও থাকেন, থাকবেন, কারণ তাদের মধ্যে গোলমালটা কম, তফাত এখানেই। তবে, কাউকে সমালোচনা করছি না, অভিযোগও করছি না, এগুলো ভাগ্য হিসেবে আমরা মেনে নিয়েছি। বোঝা যাচ্ছে, সবাই কোন না কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে নানা কথা বলছেন, সরকারের নীতি নির্ধারকরাও বলছেন তাতে ইতিবাচক কোন প্রভাব ফেলছে না। নিজেদের, নিজেদের দল, নিজেদের নেতা নেত্রী গোলমেলে মন আর গোঁজামিল দিয়ে হিরো হওয়ার চেষ্টা আগে বন্ধ করুন তারপর আপনাদের সমালোচক বা ‘বুদ্ধিজীবী’দের নিন্দামন্দ করুন। সমাপ্ত
(৩০/০৩/২০১৪ -১/০৪/২০১৪)