Tuesday, April 1, 2014

শিশু ইকরা ধর্ষণ মামলা এবং ধর্ষক সাত্তার মৌলভী

 ২০০৪ সালের মাঝামাঝি কোন এক শুক্রবার মধ্য দুপুরে  মায়ের ড্রইংরুমে দেখলাম কালো বোরখা পরা এক নারী বসে রয়েছেন। সাথে বছর চারেকের ছোট্ট  একটা মেয়ে  , চোখের কোণে কালি, ভীষণ শীর্ণ  কঙ্কালসার  শরীরে চিকন চিকন দু'টো পা, কাঠির মতো দু'টোহাত , গোলাপ ফুল বসানো একটা ফ্রক পরা।  গায়ের রঙ ফর্সা ই ছিল  কখনো -বোঝাই যায়! কেমন যেন বিবর্ণ-  পরে বুঝলাম, এই ফুটফুটে নিষ্পাপ শিশুটির জীবনের সব রঙ মুছে গেছে  !

শিশুটির নাম ইকরা, বললেন তার মা । বোরখা খুলে বসলেন।  তরুণীটির  মিষ্টি গোলগাল  চেহারাটি  বিষন্ন , ভারাক্রান্ত..... চোখে নীরব জলধারা।

স্তম্ভিত আমি।  এই ফুলের মতো ছোট্ট শিশুটি  ধর্ষিত হয়েছে। বর্বরতার বর্ণনা শুনে কিছুক্ষণ ভাষা পেলাম না কোন।

চট্টগ্রামের বাঁশখালির বৈলছড়ি গ্রামের আড়াই বছরের কন্যা ইকরা। বাড়ির উঠোনেই মাদ্রাসা। প্রচন্ড ধর্মান্ধ এক পরিবারের অতি সাধারণ  স্বল্পশিক্ষিত মা  ভাবলেন,  স্কুলে যাবার বয়স তো হয় নি তার কন্যার।  ঘরের দুয়ারেই মাদ্রাসা। একটু যাওয়া আসা করুক, আরবী  আর দোয়াদরুদ  শেখা হোক্ ।  ২০০৪ সালের ১৭মে  (সম্ভবত )একদিন অলস দুপুরে ইকরা উঠোনে খেলছিলো তার বন্ধু সাদিয়া আর অন্যান্যদের নিয়ে। হঠাৎ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার ইকরা কে ডেকে নিয়ে গেলেন। এর পরের গল্প খুব করুণ  এবং ক্ষমাহীন।

বাস্তবতা সম্পর্কে এতোটাই অজ্ঞ মা- বুঝতেই পারলেন না তার অবোধ শিশুটি  ধর্ষণের শিকার।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে  অঝোর ধারায় চোখের জলে ভেসে  এই অসহায় মা বললেন, "  এক রাতে  হঠাৎ আমি দেখি, আমার মেয়েটার জাঙ্গিয়া রক্তে ভিজে  যাচ্ছে। বারবার জাঙ্গিয়া বদলে দেই, তাও ভিজে যায়। পরদিন  ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার ওষুধ লিখে ছেড়ে দেয় ( বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসক  ধর্ষণ বা কোন অপরাধে আহতদের চিকিৎসা করতে গিয়ে পুলিশ কেস হতে পারে বলে , বিষয়টি এড়িয়ে যায়-কোন মানবিকতা তাদের স্পর্শ করেনা)।
 ইকরার  মা বলে যান - ইকরার রক্তপাত বন্ধ হয় না। বাচ্চা কিছু খায় না, কথা বলার শক্তি নেই , কান্নার ও শক্তি নেই। আমার স্বামী সেনাবাহিনির জওয়ান। সিএমএইচে ( কম্বাইন্ড মিলিটারী হসপিটাল)  নিয়ে যেতে বললেন।
সিএমএইচে নিলাম। ওরা চেক আপ করলো।
হঠাৎ একজন মহিলা ডাক্তার এসে  ক্ষুব্ধ স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,  " আপনার মেয়ে রেপ হয়েছে ,আপনি লুকিয়েছেন  আমাদের থেকে । কেন?"
আমি হতভম্ব। ডাক্তার এসব কী বলছে? আমার অবোধ শিশুটা....... কিছু বুঝলাম না। হঠাৎ এ  কী হলো , কী করে হলো ? আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে।
পরে আমার স্বামীকে খবর দিলো সিএমএইচ থেকে । আমার ম্বামী আর আমি  কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।  ইকরাকে জিজ্ঞেস করলাম," আম্মু, কও তো ,তুঁই দুক্খু পাইও না ( তুমি ব্যথা পেয়েছো, মা?)  ?  অ'মা , ক'নে  দি'য়ে  দুকখু? (ব্যথা কে দিলো , মা?) ? "
ইকরা ভয়ার্ত আধোবোলে বললো, " সত্তর মলই ( সাত্তার মৌলভী) ! অবিশ্বাস্য ঠেকে তার বাবা-মায়ের কাছে। কয়েকশ' কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম বৈলছড়ি মাদ্রাসায় ছুটে যায় ইকরার  বাবা-মা। তাদের সাথে অন্যান্য পাড়া প্রতিবেশী রাও। তাদের ধারণা হয় নতুন একজন তরুণ শিক্ষক মাদ্রাসায় এসেছে, সেই নিশ্চয়ই এই বর্বরতা ঘটিয়েছে।
 ছোট্ট ইকরা তার বাবার কোলে । সেনাবাহিনীর তাগড়া জওয়ান পুরুষটি হতাশায়, বেদনায় চুরমার ততোক্ষণে । অসহায়   পিতা  ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে ছুটে বেড়ান মাদ্রাসার এ কক্ষ থেকে সে  কক্ষ ।
ছুটে সেই তরুণ নতুন শিক্ষকের সামনে। না, ইকরার ছোট্ট তর্জনী পাশের রুমের দিকে। এ কী -ঐ রুম তো অধ্যক্ষের কক্ষ ।
উদভ্রান্ত পিতা -মাতা, পাড়া প্রতিবেশী ওদিকেই ছুটে যান। সরাসরি আবদুস সাত্তারের চোখের দিকে ইকরার  ছোট্ট তর্জনী ।

শিশু ইকরার ধর্ষক আবদুস সাত্তার
" এই সত্তর মলই আঁর জাঙ্গিয়া খুলি আঁরে  দুক্খু দিয়ে, আব্বু....... ( এই সাত্তার মৌলভী আমাকে পেন্টি খুলে ব্যথা দিয়েছে আব্বু.... )"  সেনা জওয়ান পিতা যেন এই জগতে আর নেই!  দু'চোখে জলের বন্যা।  বিষ্ফারিত নেত্রে চেয়ে ভাবতে থাকে - দেবদূতের মতো  মাথায় টুপি,  কাঁচা পাকা  লম্বা দাঁড়ি  ৫২ বছর বয়স্ক মাদ্রাসা  অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার  ছোট্ট  অবোধ শিশু ইকরার ধর্ষক?? এও কি সত্যি হতে পারে ?? আল্লাহর সাত আসমান ভেঙ্গে পড়লো না কেন সেই দিন?   চিৎকার করে বলে উঠে , " সত্তর ভাই, অ'নে? আঁর বন্ধু হই অ'নে আঁর মাইয়ার উ'র এতো অত্যাচার গরিত পাইরগন না?  ( আপনি ?? আপনি সাত্তার ভাই আমার বন্ধু হয়ে আমার ছোট্ট , বাচ্চা  মেয়েটার উপর এতো অত্যাচার করতে পারলেন? )... বলেই  অজ্ঞান হয়ে  ধর্ষক সাত্তারের বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন ছোট্ট ইকরার অসহায় পিতা। মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক সহ অনেকেই ধর্ষক  সাত্তারের পক্ষে মত দিলো। ছোট্ট ইকরা ধর্ষিতা হবার পরও পবিত্র ধর্ম শিক্ষাদাতা প্রতিষ্ঠান সেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে একটি কথা বলার সাহস কেউ করলো না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের  তৎকালীন সভাপতি নূরজাহান খান আমার মা নূরজাহান খান এই মামলা পরিচালনার ভার নিলেন । একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রম তাঁর। চার দশকের  ্এ নেশা তাকে নিপীড়িতের অধিকার আদায়ে ছুটিয়ে বেড়ায়, এবং দিনশেষে অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করতে সফল ও হন তিনি।
 
চট্টগ্রামের নারী ও শিশু আদালতে উঠলো ইকরা ধর্ষণ মামলা ।২০০৫ সাল । আমি তখন দৈনিক সমকাল পত্রিকার সিনিয়ার রিপোর্টার । অন্যান্য গণমাধ্যমের সহকর্মী সাংবাদিকদের কয়েকজন কে জানিয়েছি, যাঁদের  কেউ কেউ অনেক প্রগতিশীল।  কিন্তু কাউকেই  এই মামলার রিপোর্টিং বা ফলোআপে  আদালতে ও দেখলাম না,  ্ইএকটি অবোধ শিশুর প্রতি এমন অবিচারের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে একজন সাংবাদিককে ও পাশে পেলাম না। বেদনার ভার চাপাই রইলো।
কিন্তু মানবতার কাজ কি থেমে থাকে?
আরো দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যায়  কাজ - থামাতে পারেনি  অন্ধকারের শক্তি  ধর্ষক সাত্তার তার বিচারের প্রক্রিয়া।

 ইকরার বড়ো দুই ভাই সেই মাদ্রাসায় ক্লাস থ্রি ফোরের ছাত্র ছিল। বছরের মাঝামাঝি  বিনা নোটিশে তাদের বহিস্কার করা হলো। ইকরার কাকা-মা অসহায় বোধ করলেন, ছেলেদের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে গেলো! শুধু তাই নয়, একঘরে করা  হলো এই পরিবারকে ।
এই পরিবার   'ইসলাম বিরোধী এবং সমাজচ্যুত '  ফতোয়া জারি করলো ধর্ষক সাত্তার -  !
নির্যাতিতা শিশুটির পরিবার বলে তারা যেন  পথে বসলো। রাষ্ট্র , সমাজ, ধর্ম-কেউ  এই অন্যায়ের প্রতিরোধ করলো না!

আমি  দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার তখন । সমকালে আমি নিয়মিত মামলার ফলোআপ করতে থাকলাম। ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে রিপোর্ট গুলো কখনো কখনো ছাপা হতো, কখনো হতো না।  অনেক পাঠকের মানবিক প্রতিক্রিয়া পেলাম।
এমন ঘৃণ্য অপরাধীকে সাজা দেবার জন্যে সাক্ষী প্রমাণ জোগাড় করা এবং ইকরার পরিবারের পাশে আমার মা নূরজাহান খান একদম  একা লড়াই করে গেলেন ৫টি বছর ।
 রায়ে অপরাধী প্রমাণের পর কি ধর্ষকের ছবি তোলা মানা?  আমি ছবি তুলছি বলে আমার দিকে হুমকি 

    ছোট্ট ইকরার দিকে তাকালেই আমার বুক ভেঙ্গে যায় । আমি ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকি। গল্প করি , চড়ুই পাখির মতো ছোট্ট মেয়েটা, কী ভয়ংকর 'দুনিয়া' দেখে ফেললো? বড়ো হবে  কি করে?

নির্যাতিতা শিশুটির পাশে নূরজাহান খান ছাড়া কেউ নেই। তিনি ডাকলে অনেক প্রভাবশালী আইনজীবি  আসেন। তবে  ্লএকটানা লেগে থাকতে হয়। তাদের ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার চাপ থেকে । স্বেচ্ছাসেবার জন্যে সময় বের করা বড্ডো কঠিন।
মামলা চললো ৫ বছর।
এই ৫ বছরে আমার পেশাগত জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেলো। আমি ঢাকায় একুশে টেলিভিশনে কাজ শুরু করলাম। মামলার  তারিখ পড়লে সাপ্তাহিক ডে-অফ নিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে  হাজির থাকতাম।

  ‌ইকরার খেলার সাথী প্রতিবেশী শিশু সাদিয়া একদিন সাক্ষ্য দিয়ে গেলো- ঘটনার দিন  দুপুরে  ্ইকরার সাথে  বাড়ির উঠোনে  তারা খেলছিলো- তখন 'সাত্তার মৌলভী'  এসে ইকরার হাত ধরে  পড়াবে বলে  দোতালায় মাদ্রাসার ভেতরে  নিয়ে যায়।

ধর্ষক সাত্তার জঙ্গী সংগঠনের সাথে জড়িত বলে এলাকার অনেকে বলেন । সাত্তারের পাসপোর্টে অনেক দেশের ভিসা। সন্দেহজনক তার গতিবিধি। আর  তার চারিত্রিক সনদ পত্রে স্বাক্ষর করলেন বিএনপি শাসিত তৎকালীন  সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর , বানিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অনেকে।

 সেই চারিত্রিক সনদ আদালতে উপস্থাপনের কারণে জামিনেই থাকলো ধর্ষক। মামলা চললো।
বিস্ময়করভাবে সমাজসেবা অফিসের দুই কর্মকর্তা  ধর্ষক সাত্তারের পক্ষে  আদালতে সাক্ষ্য দিলেন, ঘটনার দিন নাকি সাত্তার সমাজসেবা অফিসে ছিলেন। কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া  ্এ সাক্ষ্য! এ যেন মগের মুল্লুক।
 পাবলিক প্রসিকিউটর মফিজুর রহমান ভুঁইয়া ও তখন বিএনপি র সংগঠক। দুই পক্ষ থেকে্ই প্রচুর টাকা নেন। ইকরার মা বাবা সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে।
নূরজাহান খানের কারণে নির্যাতিতের উপর খুব চাপ ও দিতে পারেন না পিপি - নাহয়   আরো বেশি টাকা আয় হয়ে যেতো এই সুযোগে।

এর মধ্যে বার বার  ম্যাজিষ্ট্রেট বদলায় আর  ্আদালতে নতুন করে  ঘটনার বর্ণনা দিতে হয়  ধর্ষিতা শিশু ইকরা আর তার মা'কে।

 ইকরাকে কোলে নিয়ে   আদালতের সামনে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে  ইকরার মা তার কন্যাশিশুর  উপর বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে যান। আর আসামী পক্ষের আইনজীবিরা  দাবি জমি সংক্রান্ত  শত্রুতার কারণে মিথ্যা অভিযোগে সাত্তার কে 'ফাঁসানো ' হয়েছে।  নির্যাতিত অবোধ শিশুটি বুঝতেই পারলো না তার আর তার পরিবারের বিরুদ্ধে  এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামী পক্ষের অশ্লীল বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হয় ইকরার মা কে। তারা প্রশ্ন করে  " এই  বাচ্চা মেয়েটা কে ধর্ষণ  করার মতো  কী আছে ওর,  হুজুর  আদালত? সবই মিথ্যা কথা । ওর বাবা সেনাবাহিনীর প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা অভিযোগে এসব মামলা করে আমাদের হয়রানি করছে।"

বারবার   ইকরা কে বর্ণনা করতে হয় তার নির্যাতনের কথা। আর আসামীর দিকে ছোট্ট তর্জনী দেখিয়ে বলতে হয়- "ঐ সত্তর ম'লই আঁরে দুক্খু দিয়ে!" ছোট্ট ইকরার চোখের জল ও শুকিয়ে যায় একদিন।

 পিপির সহায়তায় আসামী পক্ষ বারবার তারিখ নেয় নানান অজুহাতে ।তাদের ধারণা ইকরা  তার নির্যাতনকারীর চেহারা ভুলে যাবে।  আমার বিরুদ্ধে ও আসামী পক্ষের আইনজীবি  আদালতে অভিযোগ করলেন - " সুমি খান একজন সাংবাদিক । এই মামলায় তিনি উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আদালতে  হাজির থাকছেন । " এর প্রতিবাদ করে  প্রথিত যশা আইনজীবি রানা দাশগুপ্ত দাঁড়িয়ে বলেন, " মাননীয় আদালত, সুমি খান একজন মানবাধিকার সংগঠক। তিনি এই মামলা পরিচালনার কাজে আদালতে  নিয়মিত  উপস্থিত থাকছেন।"

 ২০০৬ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলো। পাবলিক প্রসিকিউটার, ম্যাজিষ্ট্রেট সবই বদলে গেলো।  গ্রেফতার হলেন সাত্তার , কিন্তু মামলা চলতেই থাকলো। আমি ঢাকা থেকে একদিনের জন্যে চট্টগ্রামে আসতাম।  কাঁধে লাল-সাদা চেক চেক ওড়না পরা ('সৌদী পবিত্রতার চিহ্ণ' )  সাত্তার  আমার দিকে দেখে দেখে  বিড়বিড় করে কী যেন  পড়ে থুথু ছুঁড়তো-  আর অভিসম্পাত দিতো আমাকে !এভাবে ই পাঁচ বছর পার হলো।

  ২০০৯ সালের অক্টোবর। নারী-শিশু নির্যাতন আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট তার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে ইকরা কে দাঁড় করালেন আদর করে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছিলো ? ইকরা কে এক প্যাকেট বিস্কুট হাতে দেন।  বলেন, " বলো তো কি হয়েছিলো?"  ইকরা করুণ ছোট্ট  মুখে আধো আধো বুলিতে বলতে থাকে , "  (ছোট ছোট হাতে তর্জনি দিয়ে সাত্তার কে  দেখিয়ে)ঐ সত্তর মলই আঁরে দুকখু দিয়ে? " ম্যাজিষ্ট্রেট প্রশ্ন করেন , কোথায় ব্যথা দিয়েছে? কিভাবে ব্যথা দিয়েছে? "  ইকরা তার নিজের  ছোট্ট দু'টো গাল দেখিয়ে বলে, " ইনদি ইনদি দুক্খু দিয়ে ...(এখানে এখানে কামড় দিয়েছে ) জামা নামানোর চেষ্টা করে বুক দেখিয়ে বলে, বুকে কামড় দিয়েছে , আর আমার জাঙ্গিয়া খুলে অনেক ব্যথা দিয়েছে-ঐ সত্তর ম'লই  (সাত্তার মৌলভী)!  " ৫ বছরে এতোটুকু বাড়েনি ইকরা। অতোদিনে আটবছর বয়স হবার কথা তার । কিন্তু দেখতে সেই ছোট্ট তিনবছরের শিশুটিই ছিল ইকরা।  শারীরিক সব অগ্রগতি যেন মামলার মতোই থমকে গেছে।

 এমন কঠিন মুহুর্তে হাকিম ও ভাষা হারান হয়তো- ম্যাজিষ্ট্রেটের চোখ ভিজে যায়।  কিছু মুহুর্ত নীরবে নিচের দিকে চেয়ে ভাবলেন।  ইশারা করেন আর্দালী কে। আর্দালী   ইকরা কে কোলে করে চেয়ার থেকে নামিয়ে  মায়ের কোলে দিয়ে যায়। মামলার কাজ শেষ হলো। ২০০৯ সালের ৮ নভেম্বর রায় হলো।  ৭ বছরের কারাদন্ড হয় আবদুস সাত্তারের।
আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই আমার সেই সময়কার বেদনার অনুভূতিটুকু বলছি- অধীর আগ্রহে রায়  শুনছিলাম- মনে মনে ভাবছিলাম , আচ্ছা, এমন শিশুকে ধর্ষন কি 'এ্যাটেম্প টু মার্ডার' নয়? তাহলে কি সাত্তারের মৃত্যুদন্ড হতে পারতো না? মাত্র ৭ বছর তো তার কাছে নস্যি! রায়ে বলা হলো, যেহেতু একেবারেই শিশু, তাই ধর্ষণের মতো শারীরিক গঠন তার হয় নি। তাই নির্যাতন হিসেবেই গন্য হলো!
সাত বছরের সাজাও নানান অজুহাতে কমে গেছে ্, তেমন কোন সাজা ভোগ করতে হয়নি এই ধর্ষককে।

বিস্মিত,   স্তম্ভিত আমি !! দীর্ঘ ৫ বছরের অনিশ্চিত যাত্রা শেষে অন্তত ৭ বছর সাজা হয়েছে- এতেই  নূরজাহান খান কিছুটা শান্তি পেলেন!!
আমার মা সর্বংসহা, আমি নই ।আর তাই  শান্তি পাচ্ছি না এতো বছর পরও!‍  এ রায় মেনে নেয়া যায় কিনা জানি না!! শুধু জানি-  বর্বর সাত্তারকে যদি তড়পে তড়পে মরতে হতো... কখনো কি বুঝতো শিশু ইকরার যন্ত্রনার সহস্র ভাগের এক ভাগও ..!!
ইকরার মা বললেন, " কক্ষনো আর আমার সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়াবো না। বাংলা স্কুলে পড়াবো।"বললাম, "ওকে  জজ ব্যারিষ্টার বানাবেন। যেন ইকরার স্বাক্ষরে একদিন সাত্তারের মতো বর্বরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়-  আর কোন সাত্তার যেন এই সমাজে ঠাঁই না পায়!!"

রায় শুনে  ক্ষুব্ধ  ধর্ষক সাত্তার শাপ শাপান্ত করে যায়  আদালত পুলিশ , নূরজাহান খান-সুমি খান -সবাইকে!  অভিসম্পাত দিতে দিতে পুলিশের সাথে প্রিজন ভ্যানে উঠে যায় সাত্তার  !!
আর আমি  ধর্ষক সাত্তরের ছবি তুলবার জন্যে তার পেছন পেছন ছুটি। পুলিশ ছবি তোলাতে সহযোগিতা করতে সাত্তারকে সোজা করে দাঁড় করাতে চাইলেই প্রচন্ড গালাগাল শুরু করলো সাত্তার। আমার কাজ সেরে নেই সেই ফাঁকে।
আদালতের রায় উপেক্ষা করে  বিপুল অর্থের বিনিময়ে ২/৩ মাস পর ই  জামিনে ছাড়া পেয়ে  ধর্ষক আবদুস সাত্তার  আবার মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের পদ দখল করে নেয়। এর পর আবার সেই মাদ্রাসায় সাত্তারের অনাচার শুরু হয়।  সাত্তারের বিতাড়িত লোকেরা  ইকরার মায়ের কাছে এসে বলছে আদালতে আপীল করতে। ইকরার মা জবাব দিলেন, "এতোদিন তো আমাকে লাঠি নিয়ে দৌড়িয়ে ছুটালেন, এমন অবোধ শিশুর উপর নির্যাতন ও আপনাদের বিবেক নাড়াতে পারে নি।  এখন কেন এসেছেন?"
 কোন মিডিয়া, কোন বিবেকবান মানুষ সাত্তারের অনাচার রোধ করতে পরে না। এভাবেই সাত্তরেরা বারবার পার পেয়ে যায়।

..........................
এরকম আরো অসংখ্য মামলা নূরজাহান খান এখনো পরিচালনা করছেন । একে একে তুলে ধরবো এই প্রজন্মের জন্যে।  দুরূহ এ কাজ  এই প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে হবে , তাই একথা গুলো তুলে ধরা।

নূরজাহান খান সম্পর্কে দু'চার কথা

 নূরজাহান খান মানবাধিকার সংগঠক। ১৯৪৮ সালের ১১ আগষ্ট  কোলকাতা মেডিকেল কলেজে তাঁর জন্ম  । তাঁর যখন তিনদিন বয়স, তাঁর মা  জাহান আরা সিদ্দিকী  টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে  মাত্র ২১ বছর বয়সে  মৃত্যুবরণ করেন।নূরজাহান খানের বাবা জামাল আহমেদ সিদ্দিকী ছিলেন কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের কৃতি ছাত্র। ল্যান্ড এ্যাকুইজিশান ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট  জামাল আহমেদ সিদ্দিকী বলতেন,  ''হাকিম নড়বে, কিন্তু হুকুম নড়বে না''।

জামাল আহমেদ সিদ্দিকীর বাবা শফিকুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন ব্রিটিশ এক্সাইস সুপারিন্টেন্ডেন্ট। সদ্য মা হারা শিশু নূরজাহান খানের নাম রাখলেন আল্লাদি । ফারসী এ শব্দের অর্থ-'আল্লাহ রেখেছে' ।
ভোর ৬টা  থেকে সন্ধ্যা ৬টা আর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা দু'জন  নার্স শিফটিং ডিউটি করে   তিনদিন বয়সী আল্লাদীকে নিরন্তর সেবা যত্ন করে একটু বড়ো করে তোলে। এর পর আসেন নতুন মা । কোলকাতার ইমামবাড়া থেকে । হাজী মুহম্মদ মহসীন এর পরিবারের সন্তান।ঊর্দুভাষী এই নতুন মা সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি হলেও  পীর বাড়ির মেয়েটিকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেন  আল্লাদী।

 বাবার চাকরিসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বদলি হলেন যখন, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক কালজয়ী শিক্ষক হরলাল রায়ের ছাত্রী হলেন ।  মায়ের আশৈশব  রবীন্দ্রানুরাগ একটু শক্তি পেলো।  ।  এখনো খুব জ্বর এলে প্রলাপ বকেন আবৃত্তি করে। রবীন্দ্রনাথের কচ ও দেবযানী ,  নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ,  বিসর্জন...অথবা 'কোথা সে ছায়া সখী , কোথা সে জল, কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশ্বথ্থ তল! ছিলাম আনমনে , একেলা গৃহকোণে, কে যেন ডাকিলো রে -জলকে চল! বেলা যে পড়ে এলো জলকে চল ..."!!
তবে মানুষের কাজেই ব্যস্ত থাকেন। থানা, পুলিশ , আদালত- অপরাধীর শাস্তি আর নিরপরাধের প্রশান্তিই তার শান্তি।

 বাঙ্গালীর স্বাধীকারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সাল থেকে  জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামালের হাত ধরে  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চট্টগ্রামে সংযুক্ত হলেন মা।  যুগের পর যুগ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে!, তাদের ভরণ পোষণ করেছেন, অনেক  অসহায় পরিবারের দায়িত্ব তার মাথায়, অনেক মেধাবী ছাত্র ছাত্রীর পড়ালেখার খরচ দেন।

 ১৯৮০ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে  সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এখন সেই সংগঠনের কাজীর গরু কেতাবে সীমাবদ্ধ , গোয়ালে না থাকলে ও চলে। আর নূরজাহান খানের মতো 'পুরনো' কাজপাগলদের  সারা দেশের সব শাখা থেকেই ঝেড়ে ফেলেছে  মহিলা পরিষদ। মিলিয়ন ডলার ফান্ড- ঢাকা শহরের  কোটি কোটি টাকার আয় ব্যয়ের হিসাব দেখানো লোকদেখানো কাজ দরকার। নির্যাতিতের জন্যে আদালতে লেগে থাকা তাদের জন্যে  'সময়ের অপচয়' !

যাই হোক্   বর্তমানে নিজেই' লিরো'   LEERHO  )Labour, Education, Environment, Rehabilitation, Health organization )  নামের একটি সংগঠন করে  পুত্রদের পাঠানো হাত খরচের টাকা দিয়ে মানুষের জন্যে কাজ করেন , আদালতে ছুটে অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করে  কখনো কখনো  মধ্যরাত বা শেষ রাতে বিছানায় তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যান।



1 comment:

  1. অসাধারন !! ইকরা-কে নূর জাহানের মতো হতে হবে। নূর জাহার বেঁচে থাকুন হাজার বছর।

    ReplyDelete