Sunday, March 30, 2014

ভারতের দরিদ্রতম মূখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের মুখোমুখি সুমি খান

মানিক সরকার; ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য এবং আমাদের প্রতিবেশী ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী তিনি। চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়ে সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বাংলাদেশ থেকে সাক্ষাত করতে এসেছি জেনে সময় দিলেন। পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবি- পায়জামা পরে দৃঢ় এবং তেজোদ্দীপ্ত ব্যক্তিত্ব মানিক সরকার সিপিএম কার্যালয়ে অতিথিদের বসার জন্য সংরক্ষিত ছোট্ট একটি রুমে বসেই তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। সংক্ষিপ্ত সময়ের এই আলোচনায় আবারও উঠে এলো মহান মুক্তিযুদ্ধে এপার এবং ওপারের বাঙালীদের একাত্মতা এবং বাংলাদেশের জনগণের বীরোচিত ভূমিকার কথা। আলোচনায় উঠে আসে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানে আইএসআইয়ের অর্থ বিনিয়োগের গোয়েন্দা তথ্যপ্রমাণও। অকপটে বললেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নয়নে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার বিরাগ এবং তাদের বৈরী অবস্থানের কথা। জানালেন, এখনও আইএসআই-এর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে অবস্থান করছে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। জনকণ্ঠের পাঠকদের জন্য সাংবাদিক সুমী খান এর নেয়া সাক্ষাতকার তুলে ধরা হলো।


জনকণ্ঠ : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরাবাসীর আন্তরিকতা, ত্যাগ এবং সহযোগিতার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা আমাদের। পরপর চারবার ত্রিপুরার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সফলতার সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করছেন। এর পেছনে কি আপনার শৈশব থেকে তারুণ্যের বেড়ে ওঠা সময়ের কোন প্রভাব কাজ করেছে? আপনার বই পড়ে জেনেছি, তারুণ্যে স্কুলের পরিচ্ছন্নতা, স্কুলে বাগান করা, মঞ্চনাটক এসবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন কি?

মানিক সরকার : ধন্যবাদ! নেতা হব বলে তো কখনও কাজ করিনি! স্কুল পরিচ্ছন্নতা, বাগান করা , মঞ্চনাটক–সবই শিক্ষকদের নির্দেশে করেছি। এখনও কোন ব্যক্তির জন্য নয়, যারা সর্বহারা, সমাজের সবচেয়ে পেছনে যাদের অবস্থান- বহুমুখী সমস্যায় যারা জর্জরিত- সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা সেসব জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নিতে বামফ্রন্ট শাসন ব্যবস্থায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকার কাজ করছে। আমরা উপজাতি-আদিবাসীদের নিয়ে ৫ বছর মেয়াদী ‘পরিবার গুচ্ছ কর্মপ্রকল্প’ নামে বিশেষ কর্মসূচী নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি তাদের দ্রুত এগিয়ে নেবার লক্ষ্য নিয়ে। এদের মধ্যে কিছু আদিবাসী সংখ্যালঘু মুসলিমও আছেন।

জনকণ্ঠ : নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নারীকে এগিয়ে নিতে ত্রিপুরা রাজ্যসরকারের সফলতা ব্যাপক আলোচিত।

মানিক সরকার : হ্যাঁ। নারীর ক্ষমতায়নই শুধু নয়, নারীকে সাক্ষরতা সম্পন্ন এবং শিক্ষিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ত্রিপুরা ভারতবর্ষে প্রথম। এটা বাদ দিয়ে তো আর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। মহিলাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী করার কাজেও আমরা সফল। এই মুহূর্তে ত্রিপুরায় প্রায় ২০ হাজার সেলফ হেলপ গ্রুপ আছে, যা শুধু মহিলারা পরিচালনা করেন।

জনকণ্ঠ : ত্রিপুরা প্রেসক্লাবে নারী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল, জানলাম সেশন জজ হিসেবে নারীদের সংখ্যা খুব কম। বেশ কিছু ভুয়া ধর্ষণ মামলা হচ্ছে।

মানিক সরকার : সেশন জজ তো মেয়েদের মধ্যে থেকে আগ্রহী হয়ে আসতে হবে। আমরা চট করে বানিয়ে দিতে পারব না। পুলিশ হিসেবে প্রচুর মেয়ে নিয়োগ পাচ্ছে। থানায় মেয়েদের যে কোন অভিযোগ প্রথমেই মেয়ে অফিসাররা নেয়। উইমেন ডেস্ক আছে প্রতিটি থানায়। এসপি পদে অনেক নারী এসেছে। পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছি আমরা। মেয়েদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে যে কোন অভিযোগ কোন প্রশ্ন না করেই থানা সেই অভিযোগ নিতে বাধ্য। এই দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষে কোথাও নেই। এ দায়িত্বে অবহেলা করার কারণে নারী পুলিশকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

জনকণ্ঠ : বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ এবং উদ্বেগ কাজ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অকৃত্রিম বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্মরণে রেখেও এই সন্দেহ কেন?

মানিক সরকার : আমাদের নবীন প্রজন্মকে অতীত সম্পর্কে, ইতিহাস সম্পর্কে আমরা সচেতন করতে পারি নি-এটা যদি সত্যি হয়, সেটা অবশ্যই উদ্বেগজনক। এতে নবীন প্রজন্মের মধ্যে একটা শূন্যতা তৈরি হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ-ভারতের অকৃত্রিম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস জানতে হবে নতুন প্রজন্মকে। যে কোন জাতি তাদের অতীত সম্পর্কে, ইতিহাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন না করলে নবীন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনা, ভাবনার মধ্যে একটি শূন্যতা, অসম্পূর্ণতা তৈরি হয়। কোথায় ছিলাম, কোথায় এসেছি-কিভাবে আসলামÑ কোথায় যেতে হবে- যাওয়ার জন্য কী করতে হবে? এটা একটা সার্বিক ভাবনা-চিন্তা। এই সার্বিক ভাবনা চিন্তা নবীনদের মধ্যে তৈরি করতে হলে প্রবীণদের দায়িত্ব নবীনদের মধ্যে ইতিহাস সচেতনতা সৃষ্টি করা। এটা যদি করা না যায়, তাহলে একটা রাষ্ট্রের পক্ষে, একটি জাতি, একটি সমাজ, একটি সভ্যতার জন্য ঘনিয়ে আসা বড় ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে।

জনকণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ সমাজ সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারি কি?

মানিক সরকার : বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলনে আমি নজর রাখছি। খবরাখবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। এ দেখে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্ম নতুনভাবে ইতিহাস সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। এ কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অমানবিক, অগণতান্ত্রিক ভূমিকা নিয়েছিল- তাদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্ম সোচ্চার। অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছে তরুণরা। এ থেকে একটি বিশ্বাস আমার দাঁড়িয়েছে, প্রজন্মান্তরে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে–আমি বলব এটা ‘রে অব হোপ’Ñএটা গুড সাইন। এটা করতে হবে। এটা না করলে সঙ্কটের সৃষ্টি হবে। যেমন ৭৪ বছরের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে পড়ল। এর অন্যতম মূল কারণ ছিল ওখানকার নবীন প্রজন্ম জানত না তাদের বিপ্লবের ইতিহাস। নবজীবনের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। সোভিয়েত যে জার সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল– কী পরিস্থিতির মধ্যে ছিল- কী পরিস্থিতির মধ্য লড়াই করে সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্র এসেছে। এবং এই ৭৪ বছরে সোভিয়েত দেশের যে অগ্রগতি- কোন্ জায়গা থেকে কোন্ জায়গায় এসেছে- এই সামগ্রিক ঘটনাবলী সম্পর্কে তাদের দেশের নবীন প্রজন্মকে শিক্ষিত-সুশিক্ষিত করার কাজটি পুরোপুরি হয়নি। যে কারণে নবীন প্রজন্মের মধ্যে কতগুলো নতুন নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগ নিয়ে একটা গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের প্রলুব্ধ এবং বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। সেই ফাঁদে তারা পা দিয়েছে। তাদের যদি অতীত ভাল করে জানা থাকত, তারা ভাবত যে, ‘না, আমাদের পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল, আমরা অনেক পেছনে ছিলাম। অনেক কিছুই আমাদের ছিল না। আজকে এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই জায়গা থেকে আমাদের এরকম উন্নত জায়গায় এনেছে। আমাদের আরও কিছু করা দরকার- এজন্য আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।’ সোভিয়েতের প্রবীণরা এই কাজটা করতে পারেনি বলেই তো সোভিয়েত আজ বিপর্যয়ের দিকে চলে গেছে। সোভিয়েত রাষ্ট্রের নবীন প্রজন্ম নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে, যা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলো। এটা আমাদের জন্য একটা শিক্ষা। এ থেকে আমাদের করণীয় বুঝে নিতে হবে। আপনাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতার কাজ এগিয়ে নিতে হবে নতুন প্রজন্মকেও। তার মধ্যে আপনিও পড়েন। পরবর্তীতে আবার কোন বিপর্যয় ঠেকাতে প্রজন্মান্তরে ইতিহাস সচেতনতা সৃষ্টি করতে আপনাদের কাজ করতে হবে।

জনকণ্ঠ : ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা। বর্তমানে এর কোন পরিবর্তন ঘটেছে কি?

মানিক সরকার : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে এর জন্য অনেক কারণ দায়ী। প্রথম কথা এখানে যে সন্ত্রাসবাদীরা ‘স্বাধীন’ হবার জন্য বা ‘বিচ্ছিন্ন’ হবার আন্দোলন করে। ‘ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব’ এমন দাবি তুলেছিল- এর পেছনে মূল কারণ ছিল অনুন্নয়ন। রাস্তা-ঘাট, স্কুল- কলেজ, হাসপাতাল কিছুই ছিল না, সেচের সুযোগ ছিল না। বিদ্যুত সংযোগ ছিল না। এর মধ্যে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলো আরও পিছিয়ে ছিল। সেই পরিস্থিতিতে অনুন্নয়নের বিষয়টা দারুণভাবে তাদের ভাবনা চিন্তায় ডমিনেট করেছে। আমরা এই বিষয়টাকেই এ্যাড্রেস করার চেষ্টা করছি। ঠিকই তো। উপজাতি অংশের মানুষ এখানকার আদিবাসী-আদি বাসিন্দা। ১৮৪ জন রাজা ছিলেন ত্রিপুরায়, এদের সবাই উপজাতি ছিলেন। রাজারা উপজাতি হয়েও উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য কোন কাজই করেননি! এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। স্বাধীনতার বয়স ৬৬-৬৭ বছর। স্বাধীন ভারতবর্ষে পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকার বা রাজ্য সরকারের যে ভূমিকা নেয়া উচিত ছিল, তা তারা নেয়নি। ফলে বঞ্চিতদের মনে হতাশা তৈরি হয়েছে- হতাশা থেকে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ক্ষোভ থেকে বিপথগামিতার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমরা বামফ্রন্ট সরকার এই বিষয়গুলো গুরুত্বে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। এর জন্য বামফ্রন্ট সরকার দায়ী নয়। এর জন্য বাঙালীরাও দায়ী নয়। অনুন্নয়নের কারণে বাঙালী– উপজাতি উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত। উপজাতিরা একটু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কাজেই গরিব মানুষ হিসেবে উপজাতি-বাঙালী নির্বিশেষে উভয়ের মধ্যে একতা-সংহতি রক্ষা করতে হবে। উন্নয়নের কাজে একসঙ্গে হাত মেলাতে হবে। এই আদর্শগত রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে আমরা উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছি। ব্যাপকভাবে উন্নয়নের কাজে হাত দিয়েছি। উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় নজর দিয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছি। এই যে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের কথা বলেছি আপনাকে, প্রথমত: এর অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো সন্ত্রাসবাদকে মোকাবেলা করা। দ্বিতীয়ত: আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বাংলাদেশের ভেতর থেকে এসে সন্ত্রাসবাদীরা গোলমাল করত। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইতিবাচক সদর্থক ভূমিকা নেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে যদি কেউ আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে অশান্তির আগুন ছড়াবার চেষ্টা করে সেটাকে আমরা প্রশ্রয় দেব না।’

জনকণ্ঠ : তবে কি বাংলাদেশের এই বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই সন্ত্রাসবাদ দমনে সফল হয়েছেন আপনারা?

মানিক সরকার : শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা আমাদের সন্ত্রাসবাদ দমনে সাহায্য করেছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রধান কাজটা আমাদেরই প্রথম করতে হয়েছে। মতাদর্শগতভাবে তারা যে ভুল সেøাগান তুলেছে, ‘বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব, স্বাধীন হয়ে যাব, আলাদা রাষ্ট্র করব’–এটা হয় না। আমরা রাজনৈতিকভাবে মতাদর্শগতভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাস্তবতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। ব্যাপকভাবে জনগণকে সচেতন করেছি। দ্বিতীয়ত: তাদের পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলোতে অনেক উন্নয়ন করেছি। আরও বড় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ এগুচ্ছে। তৃতীয়ত : সীমান্তবর্তী এলাকায় দীর্ঘদিনের এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য কাজ করছে নিরাপত্তাবাহিনী। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাস ঠেকাতে দায়িত্বরত এই নিরাপত্তা বাহিনীকে আমরা শক্তিশালী করেছি। তাদের কাজে আমরা হস্তক্ষেপ করতাম না। সতর্ক করেছি তাদের কারণে যেন কোন নিরীহ মানুষের হয়রানি না হয়। তবে বলেছি, দুষ্কৃতকারীর কোন ক্ষমা নেই। দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আর বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ মিলে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এই কারণে সন্ত্রাসবাদ বহুলাংশেই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।

জনকণ্ঠ : তবে কি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সহায়তায় আপনারা বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে সফল হয়েছেন?

মানিক সরকার : সমস্যার সমাধান হয়েছে আমি বলব না। তবে আমাদের কাছে খবর আছে বাংলাদেশে এখনও ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি আছে। আমাদের কাছে সন্ত্রাসী বাহিনীর ঘাঁটির হিসেব আছে। বাংলাদেশ সরকারকে আমরা আমাদের গোয়েন্দা তথ্যসহ এই খবর জানিয়েছি। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে জানেন। বলেছেন, তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবার চেষ্টা করছেন, তাদের ইতিবাচক দৃষ্টি রয়েছে।

জনকণ্ঠ : সম্প্রতি দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় রায় হয়েছে। এতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের চালানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে। ভারতের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন সরকারের এ ধরনের বিপজ্জনক অবস্থান কেন নিতে হলো? এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে যৌথভাবে এখন যেভাবে কাজ করছেন, তা তখন হলো না কেন?

মানিক সরকার : দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি ছিল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার তো স্বীকারই করত না, বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি আছে। এই সন্ত্রাসবাদ দমনে বিএনপি সরকার যেন সহযোগিতামূলক ভূমিকা নেয়, ভারত সরকারের সঙ্গে যেন এক হয়ে কাজ করে-তার জন্য ভারত সরকার বার বার বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে অনুরোধ করেছে। সন্ত্রাসবাদ তো শুধু ভারতের ত্রিপুরায় নয়, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৬/৭টা রাজ্যের মধ্যে সমস্যা ছিল। প্রায় সব রাজ্যের সন্ত্রাসবাদীদের ডেরা বা ঘাঁটি ছিল বাংলাদেশে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নানাভাবে মদদ যোগাত। এখনও আইএসআই মদদ যোগাচ্ছে। নাহলে এই দশ ট্রাক অস্ত্র কোথা থেকে এল? কারা সংগ্রহ করল? টাকা কোত্থেকে আসল? চট্টগ্রাম থেকে বন্দর অতিক্রম করে অস্ত্রগুলো ভারতবর্ষে ঢুকবে- আসামের উলফার হাতে যাবে-এই তো ঘটনা? এই উলফাকে যারা এই অস্ত্রগুলো দিল, কেন দিল? ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্থিতিশীল করার জন্য।

জনকণ্ঠ : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অস্থিতিশীল করতে কেন চায় পাকিস্তান? এর নেপথ্যে মূলত কি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন আপনি?

মানিক সরকার : ১৯৭১ সালের বীরত্বপূর্ণ বিজয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা ধরে নিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের নৈতিক এবং সক্রিয় সমর্থনই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম কারণ। আমরা এভাবে দেখি না। অন্তত আমি এভাবে দেখি না। বাংলাদেশের জনগণের ভূমিকাকে বাদ দিয়ে শুধু ভারত সরকারের অবস্থানকে সামনে আনলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করা হবে। আসল ভূমিকা নিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। ভারত সরকার পরবর্তী সময়ে দেরিতে হলেও সদর্থক ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান এটাকে ভালভাবে নেয়নি। ভারতবর্ষকে একটা ‘শিক্ষা’ দেবার জন্য বরাবরই পাকিস্তানের মাথায় একটা চিন্তা ছিল। সেই চিন্তা থেকেই পাকিস্তান ভাবল, আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হব, স্বাধীন হব, এমন অযৌক্তিক দাবিতে যারা সন্ত্রাস করছিল, তাদের ব্যবহার করতে পারলে বোধহয় ভারতের বিরুদ্ধে যুৎসই প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে। সেই উদ্দেশ্য থেকেই আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী- বাংলাদেশে যাদের ঘাঁটি আগেও ছিল, এখনও আছে তাদের পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই মদদ দিচ্ছে।

জনকণ্ঠ : তবে কি পাকিস্তানই ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষক? এর কোন তথ্যপ্রমাণ কি আপনারা পেয়েছেন?

মানিক সরকার : পাকিস্তানের মাথায় ভারত সরকারকে শাস্তি দেবার চিন্তা বরাবরই কাজ করে। আইএসআই প্রতিশোধ নিতেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আটক হয়েছে। তাদের ইন্টারোগেশানে এসব তথ্যপ্রমাণ নিশ্চিত হয়েছি আমরা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিয়মিত অস্ত্র এবং বিপুল অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের।

জনকণ্ঠ : তবে কি ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা একাই এই ষড়যন্ত্র করছে?

মানিক সরকার : এই সন্ত্রাসে আইএসআই একা তো নেই, তাদের সঙ্গে সিআইএও আছে।

জনকণ্ঠ : ত্রিপুরা দীর্ঘদিন সন্ত্রাসবাদের হুমকির মুখোমুখি বলছেন- প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে কখনও এই বাস্তবতা জানিয়ে আপনাদের এই চরম সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করেছেন কি?

মানিক সরকার : নিশ্চয়ই। বার বার আমরা তাগিদ দিয়েছি বাংলাদেশ সরকারকে। বাংলাদেশে বিএনপি শাসনামলে কখনও আমাদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। সেই সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একদিন বললেন,‘ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর যদি সন্দেহ হয়, তাকে আমরা নিয়ে আসব। নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়াব। উপর থেকে তাকে দেখাব এখানে কোন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি-টাটি নেই!’ অর্থাৎ এভাবে বলার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে থেকে ভারতের অভ্যন্তরে যারা অশান্তির পরিবেশ ছড়াচ্ছিল, পরোক্ষভাবে তাদেরকেই মদত দিয়েছেন সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

জনকণ্ঠ : আপনাদের ইন্টারোগেশানে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে প্রমাণ হলো যে এই সন্ত্রাস দমন করা যায়নি এখন? আর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সেসব ঘাঁটির তথ্য কি বাংলাদেশ জানে?

মানিক সরকার : দমন করতে পারার প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে ঘাঁটি আছে, আমাদের কাছে তথ্য আছে। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের মাধ্যমে এই তথ্য বিনিময় করা হয়েছে, আমরা জানিয়েছি বাংলাদেশ সরকারকে। বাংলাদেশ সরকার অবহেলা করছেন না। বলেছেন, আমরা দেখছি। এতেই সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের আন্তরিকতার প্রকাশ পায়। আমরা আশাবাদী।
জনকণ্ঠ : ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে তরুণ প্রজন্মে সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে আপনার কোন সুনির্দিষ্ট পরামর্শ?
মানিক সরকার : ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ যে কোন উদ্যোগে আমার আন্তরিক সমর্থন থাকবে সবসময়। তবে আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দরকার দু’দেশের মধ্যে খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি বিনিময়।
জনকণ্ঠ : এতক্ষণ সময় দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মানিক সরকার : ধন্যবাদ আপনাকেও। ভাল থাকবেন।

No comments:

Post a Comment