Tuesday, April 1, 2014

ওসামা বিন লাদেন আইএসআইয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিল-কার্লোটা গল এর অনুসন্ধানী রিপোর্ট


[আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ২০১১ সালের মে মাসে এ্যাবোটাবাদে পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক একাডেমি থেকে মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে উঁচু প্রাচীরঘেরা এক অট্টালিকায় মার্কিন কমান্ডো অভিযানে নিহত হন। সেই বাড়িতে ছয়টি বছর তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। এটা কি সম্ভব যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ওখানে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানত না? নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার কার্লোটা গল এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখিয়েছেন, পাকিস্তান বিন লাদেন সম্পর্কে কতটা কি জানত। দেখিয়েছেন, আইএসআইয়ের শীর্ষ মহল কিভাবে লাদেনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল। তাঁর সেই অনুসন্ধানী বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো।] 


১১ সেপ্টেম্বরের হামলার কিছুদিন পর আমি নিউইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে আফগানিস্তান থেকে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। তালেবানরা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হবার পর পরবর্তী ১২ বছরের বেশিরভাগ সময় আমি সেখানে কাটিয়েছি তালেবান শাসন অবসানের পর যে স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তাতে আমি রোমাঞ্চিত বোধ করেছি এবং তারপর সেই আশা প্রত্যাশার ধীরে ধীরে অপমৃত্যু ঘটতে দেখেছি। নতুন সংবিধান প্রণীত হলো, দুদফা নির্বাচন হলো। কিন্তু তাতে সাধারণ আফাগানদের জীবন যাত্রার কোন উন্নতি হলো না। তালেবানরা নতুন করে সংগঠিত হলো এবং তাদের গেরিলা কর্মকা-ের পক্ষে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সমর্থক পেয়ে গেল। তারা আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল পুনর্দখলের জন্য উচ্চাভিলাষী আক্রমণাভিযান চালাল এবং একশত বেশি আত্মঘাতী বোমাবাজ লেলিয়ে দিল। ২০০৬ সাল নাগাদ পরিষ্কার হয়ে গেল যে এক ভয়ঙ্কর ও সংকল্পদৃঢ় প্রতিপক্ষ শক্তিমত্তায় বেড়ে চলেছে, দুর্বল হচ্ছে না। নবজাগ্রত তালেবানদের বোমা বিধ্বস্ত এলাকা ও রণাঙ্গনগুলো সফরকালে আমাকে আফগানরা সেই একই কথা বলতে থাকে। তাহলো তালেবান সন্ত্রাসীদের সংগঠকরা পাকিস্তানে বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা কোয়েটায় রয়েছে। পুলিশী তদন্তেও দেখা যেতে লাগল যে বোমাবাজদের অনেকে পাকিস্তান থেকে আসছে।

২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি বিমানে করে কোয়েটায় যাই। সেখানে কয়েকজন পাকিস্তানী রিপোর্টার ও একজন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা একত্রে এমন সব পরিবারের দেখা পেলাম যারা এই ধারণাকে আঁকড়ে ধরে আছে যে তাদের ছেলেরা আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। কেউ কেউ আবার এমন সংবাদ বিশ্বাস করবে কি-না সে সম্পর্কে নিশ্চিতও ছিল না। খরবগুলো তাদেরকে জানানো হয়েছিল অজ্ঞাত পরিচয় কোন ব্যক্তির টেলিফোন কল থেকে কিংবা সমাজের কোন একজনের মাধ্যমে দ্বিতীয় হাত ঘুরে। তাদের ছেলেরা কিভাবে মারা গিয়েছিল, কে তাদের রিক্রুট করেছিল একথা বলতে তাদের সবাই শঙ্কিতবোধ করছিল। তারা ভয় পাচ্ছিল যে পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সদস্যরা তাদের ঝামেলায় ফেলতে পারে।



কোয়েটায় আমাদের প্রথম দিনের সংবাদ পরিবেশনার পর আমরা লক্ষ্য করলাম মোটরবাইক আরোহী এক গোয়েন্দা এজেন্ট আমাদের পিছু নিয়েছে। আমরা যাদের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকের কাছে পরে আইএসআই এজেন্টরা গিয়ে হাজির হয়েছিল। আমরা পশতুনাবাদ বা পশতুদের শহর নামে এক এলাকা পরিদর্শনে যাই। ওটা ছিল প্রধানত আফগান অধ্যুষিত সঙ্কীর্ণ অলিগলির এক ঘনসংবদ্ধ মহল্লা। এই শরণার্থীরা কয়েক বছরে পাহাড়ের পাশে ছড়িয়ে পড়ে কাদামটি ও খড়কুটো দিয়ে একচালা বাড়ি বানিয়ে বাস করছিল। মানুষগুলো মেহনতি শ্রেণীর : মুটে মজুর বাস ড্রাইভার ও দোকানদার। এই মহল্লায় বেশ কয়েকজন তালেবান সদস্যেরও আবাস যারা উঁচু প্রাচীরঘেরা বড় বড় বাড়িতে বাস করে। প্রায় ক্ষেত্রেই বাড়িগুলো তাদের পরিচালিত মসজিদ ও মাদ্রাসার পাশে অবস্থিত।



রাস্তার পাশে অন্যতম একটি মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া। এর ছোট ও পরিচ্ছন্ন প্রবেশপথ দেখে প্রতিষ্ঠানটির সাইজ বুঝে ওঠার উপায় নেই। ভিতরে ইট ও কংক্রিটের তৈরি তিনতলা উঁচু ভবন। মাঝখানে আঙ্গিনা ও ক্লাসরুম যেখানে ২৮০ জন ছাত্রের স্থান সঙ্কুলান হতে পারে। আমরা যেসব আত্মঘাতী বোমাবাজের খোঁজ খবর করছিলাম তাদের অন্তত তিনজন এখানকার ছাত্র ছিল। আরও অনেকেই ছাত্র ছিল বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলোর সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং প্রাদেশিক সরকারের কর্মকর্তারা প্রায়ই এখানে আসতেন এবং তালেবান সদস্যরাও অনেক সময় রাতের আঁধারে এসইউভি’র বহরে করে আসতেন।


আমরা এক সাক্ষাতকার নিতে চাইলাম। বলা হলো মহিলা সাংবাদিককে ভেতরে যেতে দেয়া হবে না। তাই আমি আমার সঙ্গে থাকা পাকিস্তানী রির্পোটারকে কিছু প্রশ্ন চালান করে দিলাম। সে এবং ফটোগ্রাফারটি ভেতরে চলে গেল। কোন জঙ্গীকে সেখানে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে বা জিহাদের জন্য জবরদস্তি করে কাউকে রিক্রুট করা হয়েছে একথা মাদ্রাসার উপপ্রধান অস্বীকার করলেন। বললেন যে “আমরা ছাত্রদের কোরান শিক্ষায় শিক্ষিত করছি এবং কোরানে লেখা আছে যে জিহাদে অংশ নেয়া প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। কোরানে কি লেখা আছে আমরা শুধু সে কথাই তাদের বলছি। তারপর জিহাদে যাওয়া না যাওয়া তাদের দায়িত্ব।” তিনি কথাবার্তা শেষ করলেন। ক্লাস শেষ হয়ে এসেছিল। ছাত্রদের ক্লাসরুম থেকে হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে আসার সেই কলরব শুনতে পেলাম। ছেলেরা গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। একজনের পেছনে একজন ছুট লাগাল কেউ পায়ে, কেউবা সাইকেলে চেপে ঢিলেঢালা পোশাক ও টুপি মাথায় তাদের লম্বা ও কৃশ দেখাচ্ছিল।


রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার মাদ্রাসার বাইরে আমার সঙ্গে যোগ দিল। জানাল সে ভেতরের প্রাঙ্গণে মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক এক পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক দলের নেতা ও তালেবানপ্রধান মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের প্রশস্তি করে বেশ কিছু দেয়ালের লিখন আঁকা। পাকিস্তানে অনেক মাদ্রাসার মতো এই মাদ্রাসাটি তালেবানদের পুনরুত্থানের উৎস, সে পুনরুত্থানের সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও অন্যান্য আফগান নেতা অনেক আগে থেকেই হুঁশিয়ার করে দিয়ে আসছিলেন। কোয়েটার এক গরিব তল্লাটে বিচিত্র ধরনের মাদ্রাসাটি হলো সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে বিরাজমান শত শত মাদ্রাসার একটি। 



এই মাদ্রাসাতেই তালেবান ও পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলো জঙ্গীবাদের একটি বাহিনী গড়ে তোলার জন্য একযোগে কাজ করছিল। ঐ এলাকার এক পশতু সাংসদ আমার কাছে বলেছেন, “মাদ্রাসাগুলো হলো খোলস একটা আবরণমাত্র যার ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে আছে আইএসআই।”



প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ ও তার গোয়েন্দা প্রধান লে জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানীর অধীনে পাকিস্তান সরকার তালেবানদের পালছিল ও রক্ষা করছিল। উদ্দেশ্য ছিল দুটো সে সময় দেশে অবস্থানরত ‘নানা ধরনের জঙ্গী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং আফগানিস্তানের চাপ সৃষ্টি ও শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যে তাদেরকে প্রক্সি হিসাবে ব্যবহার করা। এই সূত্রটি এমনভাবে কাজ করছে যে বাইরে থেকে ধরতে পারা কঠিন। তবে এতে পাকিস্তানে যে কৌশলটি গড়ে উঠেছে তা হলো আমেরিকার সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে সহযোগিতা দেখানো এবং অন্যদিকে গোপনে তালেবান, কাশ্মীরি ও বিদেশি আলকায়েদার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গীদের সাহায্য করা ও তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এই দ্বিমুখী ও কখনও কখনও বাহ্যত পরস্পরবিরোধী কৌশলের অপরিহার্য অংশ হলো আইএসআই। এই সংস্থার মধ্য দিয়েই চরমপন্থী জঙ্গীদের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রকৃত সম্পর্ক নির্ণয় করা যেতে পারে। এই সত্যটি উপলব্ধি করতে যুক্তরাষ্ট্র মন্থরতার পরিচয় দিয়েছে এবং পরবর্তীকালে একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দেশটা এই বাস্তবতাকে সরাসরি মোকাবেলা করতে অস্বীকৃতি জানায়।



কোয়েটায় আমাদের অবস্থানের পঞ্চম ও শেষদিনে চারজন সাদা পোশাকধারী এজেন্ট আমার ফটোগ্রাফার সহকর্মীটিকে তার হোটেলে আটক করে। তারা তার কম্পিউটার ও ফটো তোলার উপকরণ জব্দ করে এবং আমি ওই হোটেলে অবস্থান করছিলাম। সিটির পার্কিং লটে তাকে নিয়ে আসে। সেখানে তাকে দিয়ে আমাকে ডাকায় এবং আমাকে নিচে নেমে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলে। সহকর্মীটি আমাকে বলে “আমি এখানে বিপদে পড়েছি। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি নিচে নেমে এসে পার্কিং লটে যেতে চাইলাম না। তবে আমার সহকর্মীকে বললাম যে আমি সাহায্য চাইব। আমি নিউইয়র্কে আমার এডিটরকে পরিস্থিতিটা জানিয়ে দিলাম, তারপর পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম।

তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই এজেন্টরা দরজা ভেঙ্গে আমার হোটেলের রুমটিতে ঢুকে পড়ল। চৌকাঠটি কয়েক টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল। ওরা ঝড়ের বেগে ছুটে আমার ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিল। একজন ইংরেজী বলিয়ে অফিসার ছিল পরনে খাকি রংয়ের নতুন শার্ট পশমী পোশাক, বাকি তিনজনের পেশীবহুল শরীর। ওদের একজন ফটোগ্রাফারকে টেনে নিয়ে এসেছিল।


ওরা আমার কাপড় চোপড় তল্লাশি করল। আমার নোট বইগুলো ও সেলফোন নিয়ে নিল। একজন আমার হাতব্যাগ আঁকড়ে ধরলে আমি প্রতিবাদ করলাম। সে আমাকে সজোরে দুটো ঘুষি মেরে বসল। একটা মুখে অন্যটা কপালে ও কানের মাঝখানে। আমি কফি টেবিলটির ওপর উল্টে পড়লাম। পতন ঠেকাতে অফিসারটির জামা আঁকড়ে ধরলাম তারপর মেঝেতে পড়ে গেলাম। কয়েকটা কাপ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য ব্যাপারটাকে কৌতুকপূর্ণ লেগেছিল। মনে হচ্ছিল ছায়াছবিতে দেখা হোটেল রুমে মারামারির কোন দৃশ্য। তারপর আমি রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম। একজন মহিলার বেডরুমে জোর করে প্রবেশ করা এবং শারীরিকভাবে প্রহার করার জন্য তাদের তীব্র ভর্ৎসনা করলাম। অফিসারটি আমাকে বলল, আমার পশতুনাবাদ এলাকায় যাবার অনুমতি নেই। তালেবান সদস্যদের সাক্ষাতকার নেয়া আমার জন্য নিষেধ। ওরা চলে যাওয়ার সময় আমি বললাম ফটোগ্রাফারকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে। অফিসারটি বলল ‘ও পাকিস্তানী। আমরা ওকে নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারি’ আমি জানতাম ওরা তাঁকে অত্যাচার করতে পারে। মেরেও ফেলতে পারে। বিশেষ করে কোয়েটায় যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নিজেরাই আইন। তারা যে বাহিনী প্রকাশ হতে দিতে চায়নি তাহলো আফগানিস্তান ও তার বাইরে সন্ত্রাসবাদের প্রচার ও প্রসারের কাজে লিপ্ত জঙ্গী গ্রুপগুলোর প্রতি সরকারের গোপন সমর্থন।


ছ’মাস পর পাকিস্তানে মহাবিস্ফোরণের মতো এক ঘটনা ঘটল। ২০০৭ সালের বসন্তে ইসলামাবাদের লাল মসজিদের সঙ্গে যুক্ত এক মাদ্রাসার ছাত্রীরা নগরীর কিছু মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রতিবাদে অবস্থান ধর্মঘট করছিল। লাল মসজিদ আফগানিস্তানেও গোটা মুসলিম বিশ্বে পরিচালিত জেহাদের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত জিহাদী ভাবধারার প্রচারক মওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, যিনি ১৯৯৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। মৃত্যুর অল্পদিন আগে তিনি আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। আলকায়েদা সেসময় তাঁর হত্যকান্ডের জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করে।

আবদুল্লাহর ছেলেরা মসজিদটির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করে এবং এর উগ্রবাদী শিক্ষা চালিয়ে যেতে থাকে। বড় ছেলে মওলানা আবদুল আজিজ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রকাশ্য ভূমিকা নেয়া এবং আমেরিকার সঙ্গে কাজ করার জন্য মোশারফের শানিত সমালোচনা করে জুমার জামাতে জ্বালাময়ী খুতবা দেয়। তার ছোট ভাই আবদুর রশিদ গাজী আগে ধর্ম-বর্ণ নিয়ে অত মাথা ঘামাত না এবং আমলা হিসেবে তার সুনাম ছিল। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর তার আমূল পরিবর্তন ঘটে। ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং বিন লাদেনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়। ২০০৭ সাল নাগাদ তার অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে গ্রেফতার হবার আশঙ্কায় সে লাল মসজিদ প্রাঙ্গণের বাইরে বের হতো না। সে হুঁশিয়ার করে দিল যে সরকার বিক্ষোভরত মাদ্রাসা ছাত্রীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিলে প্রতিশোধ হিসাবে আত্মঘাতী বোমাবাজের দল পাল্টা আঘাত হানবে।

এমন সব নেতা তাদের পেছনে থাকায় ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে। ওরা ছিল র‌্যাডিকেল ও ঘোরে পাওয়া। বিক্ষোভ বন্ধ করার চাইতে তারা মৃত্যুকেই বরণ করে নেবে এমন শপথ নিয়েছিল। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা তাদের উল্টো উৎসাহিত করে তুলেছিল। বিক্ষোভ শুরু হবার কয়েকমাস পর একদল ছাত্র মধ্যরাতে এক ম্যাসেজ পার্লারে হানা দিয়ে বেশ কজন চীনা মহিলাকে অপহরণ করে।

পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্র চীন এর তীব্র প্রতিবাদে জেনারেল মোশারফকে ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয়। ৩ জুলাই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর রেঞ্জাররা রাস্তার ওপারের একটি স্কুল দখল করে নেয় এবং পুলিশ অফিসার ও জওয়ানরা মসজিদকে ঘিরে ফেলে। ওদিকে মসজিদেও ভেতর থেকে রকেট ও এসল্ট রাইফেল নিয়ে সশস্ত্র যোদ্ধারা আবির্ভূত হয়। মসজিদের দেয়াল বরাবর বালুর বস্তা ফেলে অবস্থান নেয়। লাউড স্পীকার থেকে ছাত্রদের উদ্দেশে বলা হয় বীরত্ব প্রদর্শনের এখনই সময়। এক ছাত্রী মাইক্রোফোনটা তুলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘হে আল্লাহ! কোথায় তোমার সাহায্য? শত্রুকে ধ্বংস করে দাও। তাদের হৃৎপি- ছিন্ন ভিন্ন কর। তাদের ওপর আগুনের গোলা ছুড়ে মার।’

সিভিল সার্জেন্ট ও কূটনীতিকদের জন্য সবুজ শ্যামল, শান্ত ও নিস্তরঙ্গ এলাকা ইসলামাবাদ। কিন্তু কয়েকটি দিন গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের আওয়াজে এলাকাটি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। সন্তানদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সারাদেশ থেকে উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা এসে ভিড় জমিয়েছিল। লাল মসজিদের নেতারা ছাত্রছাত্রীদের ধরে রাখতে চাইছিল। জনৈক ছাত্রের বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘ওদের কথা ছিল মেয়েরা ও অন্যরা মারা গেলে মানুষ তাদের পক্ষ অবলম্বন করবে।’ আমি তখন উপলব্ধি করেছিলাম এসব কিছু কতই না পূর্বপরিকল্পিত, তাদের বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনায় কিভাবেই না মেয়েদেরকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

অবরোধ শুরু হবার এক সপ্তাহ পর হিংস্র লড়াই বেধে যায়। পাকিস্তানী এলিট কমান্ডোরা হেলিকপ্টার থেকে মসজিদে আঘাত হানে। তারা মেশিনগানের গুলি ছোড়ে। মসজিদের মিনারে এবং মাদ্রাসার ৭৫টি কক্ষের সব কয়টিতে অবস্থানরত জঙ্গীরা ১০ ঘণ্টা ধরে লড়াই চালায়। বাঙ্কার থেকে তারা গ্রেনেড ছুড়ে মারে। আত্মঘাতী বোমাবাজরা বোমা নিয়ে হামলাকারীদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কমান্ডোরা সিঁড়ির তলায় ইটের ওপর ইট বসিয়ে আড়াল করা জায়গায় ছাত্রীদের লুকিয়ে থাকতে দেখে এবং ৫০ জন মহিলা ও বালিকাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। গাজী মসজিদ প্রাঙ্গণের এক বেজমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন। তিনি সেখানেই মারা যান। শেষ জীবিত যোদ্ধারা তাঁর চারপাশ থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।

সেনা অবরোধের ১০ জন কমান্ডোসহ এক শ’রও বেশি নিহত হয়। মসজিদ ও এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আইএসআইয়ের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। ভেতরের দুজন ইনফর্মার তাদের গোপনে তথ্য যুগিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সংস্থাটি অদ্ভুত রকমের অকার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। অবরোধ অভিযান শেষ হবার পর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মন্ত্রীরা জঙ্গীদের কার্যক্রম রোধে গোয়েন্দা সার্ভিসের ব্যর্থতার বিষয়ে আইএসআইয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এক মন্ত্রী ওই কর্মকর্তাকে বলেন, ‘সন্ধ্যায় আমি কার সঙ্গে দেখা করি ও কি নিয়ে আলোচনা করি তা পরদিন সকালে আপনাদের ডেস্কে দেখতে পাওয়া যায়। এটা কেমন কথা যে আইএসআই সদর দফতর থেকে মাত্র এক শ’ মিটার দূরে কি ঘটছিল আপনারা কিছুই জানতেন না। মন্ত্রীরা টেবিল চাপড়িয়ে এই বক্তব্যের সঙ্গে এক মত প্রকাশ করেন। কর্মকর্তাটি টু শব্দটি না করে বসা ছিলেন। বৈঠকে অংশ নেয়া এক সাবেক কেবিনেট মন্ত্রী আমাকে বলেন, ‘ওরা কি ঘটছে না ঘটছে এক শ’ ভাগই জানত।’ তিনি বলেন ‘আইএসআই সহানুভূতি থেকেই জঙ্গীদেরকে তারা যা করতে চেয়েছিল করতে দিয়েছিল। লোকে রাষ্ট্রকে যতটা অকর্মন্য মনে করে ততটা অকর্মন নয়।’

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অল্পদিনের মধ্যেই এক হিংস্র প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়। পরবর্তী কয়েক মাসে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সৈন্যদের কনভয়ের ওপর কয়েকটি হামলা হলো এবং সারাদেশে সরকারী সামরিক ও বেসামরিক টার্গেটগুলোতে একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলা চলে। এর মধ্যে ছিল রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর সদরদফতর ও আইএসআইয়ের প্রধান কম্পাউন্ড। প্রক্সিযুদ্ধে লড়তে বছরের পর বছর জিহাদীদের লালন করার পাল্টা ফল কি হতে পারে পাকিস্তান এখন তা ভোগ করছে।  লাল মসজিদ অবরোধের ছ’মাস পর এক সাবেক সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও তাঁর এক সহকর্মী আমার কাছে বলেন, ‘আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।’

জঙ্গীরা তাদের মনিবদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও পাকিস্তানী জেনারেলরা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এদেরকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। তার মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য একটি উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোকে টার্গেট করা, যিনি প্রায় এক দশক প্রবাস জীবন কাটানোর পর ২০০৭ সালের হেমন্তে বিমানযোগে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মোশারফের সঙ্গে বেনজীরের একটা রফা হয়েছিল যে তিনি তাকে সেনা প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আরেকটা মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে দিবেন এবং এভাবে বেনজীরের নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পথ পরিষ্কার হবে। ২০০৮ সালের প্রথমদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল।


জঙ্গী উগ্রবাদের বিপদ সম্পর্কে বেনজীর ভুট্টো যে কোন পাকিস্তানী রাজনীতিকের চেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। পাকিস্তানের ভূখন্ডের  একাংশ গ্রাস করে নেয়ার জন্য তিনি বিদেশী জঙ্গীদের দায়ী করেন এবং ওয়াজিরিস্তানে সামরিক অভিযানে চালানোর দাবি জানান। তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলাকে অনৈসলামিক ঘোষণা করেন এবং যারা তাঁকে হামলার টার্গেট করতে পারে তাদেরকে বাহ্যত  চ্যালেঞ্জ করে বসেন। 

No comments:

Post a Comment