Sunday, March 30, 2014

জঙ্গী অর্থায়ন আর কত দিন? -সুমি খান

মানুষ মানুষের জন্য
শোক সংবাদ
পুরাতন সংখ্যা
রবিবার, ৩০ মার্চ ২০১৪, ১৬ চৈত্র ১৪২০

‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের সহায়তা ফেরত দিয়েছে সরকার। যাক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় দেরিতে হলেও জনগণের পালস বোঝার চেষ্টা করেছে।
যে দেশ দাতা গোষ্ঠীর নাগপাশ মুক্ত হতে নিজেদের অর্থে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করে পদ্মা সেতু নির্মাণে সাহসী হতে পারে– সেই বীরের জাতির মাত্র তিন কোটি টাকা নিতে হয় একাত্তরের ঘাতক সন্ত্রাসী জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংক থেকে?
জনগণের পরম কাক্সিক্ষত এ সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার জনগণকে কিছুটা অন্তত স্বস্তি দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও একটু দম পেলাম যেন। কেমন দম বন্ধ করা গুমোট অবস্থায় এগিয়ে আসছিল এবারের মহান স্বাধীনতা দিবস।
এই পরিস্থিতি হঠাৎ তৈরি হয় যেদিন ইসলামী ব্যাংক চরম ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তিন কোটি টাকা তুলে দেবার কথা। পরাজিত অন্ধকারের শক্তি তো উদ্ধত হবেই- যদি তাদের টাকার কাছে আমাদের নানান পর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা জিম্মি থাকেন!
প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব অরিজিৎ চৌধূরী স্বাক্ষরিত ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রদত্ত সহায়তার বিষয়ে সরকারের বিবৃতি’ তে বলা হয়, আমাদের সরকার যেমন গত মেয়াদে তেমনি বর্তমান মেয়াদে অনেক জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং করবে। এইসব উদ্যোগে আমাদের চিরাচরিত পদ্ধতি অনুযায়ী সারা জাতি অংশগ্রহণ করে। এবং আমাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এইসব উদ্যোগে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। সরকারও এইসব বিষয়ে সহযোগিতা এবং উৎসাহ প্রদান করে।
এই কার্যক্রমে সরকারের তরফ থেকে অবকাঠামো খাতে কয়েকশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ খেলাটি সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করার জন্য আমরা আমাদের তরফ থেকে বিভিন্ন আয়োজন করেছি এবং সেসবে আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা কামনা করেছি এবং পেয়েছিও।
আগামী স্বাধীনতা দিবসে ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ গানটি উপস্থাপন করার ক্ষেত্রেও আমাদের ব্যক্তি মালিকানা খাত অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছামতো সহায়তা প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রদত্ত চেকগুলো গ্রহণ করেন এবং সেখানে অর্থমন্ত্রী, সংস্কৃতি মন্ত্রী, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, ক্রীড়া উপমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত ও জ্বালানি উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। প্রাপ্ত সহায়তার সমন্বয় করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ অনুষ্ঠানের জন্য তিন কোটি টাকা প্রদান করেছে। এই পর্যায়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রদত্ত সহায়তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। সেই অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রদত্ত আর্থিক সহায়তা আমরা গ্রহণ করছি না। বিবৃতিতে জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের সহায়তা ‘আইসিসি ওয়ার্ল্ড টোয়েন্টি-২০ বাংলাদেশ ২০১৪’ তে দিতে পারেন অথবা কোথাও নাও দিতে পারেন। ইসলামী ব্যাংক আইনগতভাবে একটি নিবন্ধিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তারা এ দেশে তাদের কার্যক্রম আইনগতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
এখানেই আমাদের দুর্ভাগ্য! ইসলামী ব্যাংক থেকে অনুদান নিতেই হবে?
১৯৭৫ সালে তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল্লাহ বিন খতিব এবং তার স্ত্রীর মাধ্যমে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে ইসলামী ব্যাংক! এর প্রধান নিয়ন্ত্রক যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি একাত্তরের ঘাতক মীর কাশেম আলীর নাম ইসলামী ব্যাংক তাদের পরিচালনা বোর্ড থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক জার্নালে মীর কাশেমের বিস্তারিত জালিয়াতি এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে অর্থায়নে সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসার পর ইবনে সিনার ওয়েবসাইট থেকেও সরানো হয়েছে মীর কাশেম আলীর নাম। তবে সত্য কখনো গোপন রাখা যায় না। জঙ্গীবাদে অর্থায়ন এবং প্রধান মদদদাতা হিসেবে আন্তর্জাতিক জার্নালে মীর কাশেমকে ‘সৌদি বেক্ড টাইকুন’ হিসেবে উল্লেখ করে লেখা হয়েছে -১৯৭০ সাল থেকে ৪০ বছর সৌদি ‘মানি-ম্যান’ হিসেবে বাংলাদেশে ওয়াহাবী মদদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন মীর কাশেম আলী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনীর অন্যতম প্রধান সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন ও হত্যার সংগঠক মীর কাশেম আলী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হতেই সৌদি আরবে পালিয়ে যান। নাম এবং বিস্তারিত উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে মানিলন্ডারিং করার জন্য মীর কাশেম আলী বাংলাদেশে প্রথম ‘শরিয়া ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন- যা কখনও অডিটের তালিকায় আসেনি। মীর কাশেম আলী ইসলামিক ব্যাংক ফাউন্ডেশনের (আইবিএফ) প্রধান। আইবিএফ-এর ইসলামী ব্যাংক এ্যাকাউন্টে বিদেশী অনুদানের বিপুল অর্থ জমা হতো। যা থেকে জামায়াত শিবির এবং অন্য জঙ্গী সংগঠনগুলো পরিচালনা করা হতো। রিপোর্টে এমন তথ্যও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক তাদের কর্পোরেট যাকাতের ৮% জঙ্গীদের হাতে তুলে দেয়। ব্যাংকের নিজস্ব তথ্য মতে, বছরে ১২শ’ কোটি টাকা আয় করে ইসলামী ব্যাংক। শুধু তাই নয়, ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতের মেরুদ- হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয় এর সঙ্গে বাংলাদেশের আরও ১৪টি ব্যাংক জামায়াতের মালিকানায় চলছে। পাশাপাশি ফার ইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সসহ বেশ কিছু বীমা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে জামায়াত। আরো বিস্তারিত পরবর্তীতে লেখা যাবে।
তবে মূল কথা হচ্ছে, এই টাকার শতভাগ দাবিদার বাংলাদেশের মানুষ। তার আগে জামায়াতের জঙ্গী অর্থায়ন এবং অস্বচ্ছ অর্থের উৎস নজরদারি এবং সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সঙ্গে তুলে আনা জরুরী।

যাদের নাম আছে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডার হিসেবে। ৬৩% শতাংশ শেয়ারহোল্ডার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), জেপি মরগ্যান চেস, দুবাই ইসলামী ব্যাংক, কুয়েত ফিন্যান্স হাউস, লুক্সেমবার্গ ইসলামী ব্যাংক এবং কুয়েতের তিন মন্ত্রী। প্রথম পরিচালক অধ্যাপক আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুল জাহির। তিনি জামায়াত পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপনা এবং পরিচালনার সঙ্গে গভীরবভাবে সম্পৃক্ত। ইবনে সিনা হাসপাতাল, মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রীর পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় মানারাতের সিন্ডিকেট সদস্য এবং অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবু নাসের। ফুয়াদ আল খাতেব ফাউন্ডেশনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। নামে বেনামে পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দাতা সংগঠনগুলোর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন, যেসব সংগঠন আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গীবাদের অর্থের উৎস হিসেবে চিহ্নিত। ইবনে সিনা হাসপাতালের পরিচালক। আরো আছেন ইউসুফ আব্দুল্লাহ আল-রাজী, ড. আবদুল হামিদ ফুয়াদ আল খতিব, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইস্কান্দার আলী খান, মো. আবুল হোসেন, ড. আরিফ সোলায়মান, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল জাহমা। এদের পরিচয় বিস্তারিত তুলে আনলে যে কেউ বলবে, নিরাপত্তার প্রশ্নে অন্তত স্বাধীন বাংলাদেশে কোনভাবেই এদের ব্যবসা করতে দেয়ার বিন্দুমাত্র যৌক্তিকতাও নেই। তবু এরা অবলীলায় ব্যবসা করে মানুষকে শোষণ করছে এবং লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠানের জন্য অনুদান দেবার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে পারছে। 

তবে দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এবং সুশীল সমাজ এই ঘাতক শ্রেণীর পক্ষে মত দেন অবলীলায়। সংবাদ মাধ্যমগুলো ও বড় অঙ্কের বিজ্ঞাপনী সহায়তা পান। এ আমাদের দুর্ভাগ্য।
তবু আশার কথা সত্যেন সেনের প্রতিষ্ঠিত উদীচী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ অনেক সংগঠন এবং শহীদ পরিবার এবং মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় সঙ্গীতের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নের নিন্দা এবং প্রতিবাদ করে অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই শক্তিতেই আমরা এগিয়ে এসেছি এতটা পথ; যাব আরও অনেক পথ।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। তাই বলে ইসলামী ব্যাংকের অর্থ কি নিতেই হবে? আমাদের দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের দু’জন অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত এবং ড. আতিউর রহমান আছেন সরকারের নীতিনির্ধারণী কমিটিগুলোতে। দীর্ঘদিন একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন গবেষণামূলক কর্মকা- এবং রাজপথে জামায়াতবিরোধী সুস্পষ্ট সক্রিয় অবস্থান তাদের। তাদের লেখা থেকেই আমরা বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের আর্থিক অবস্থান এবং এর উৎস সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পেয়েছি। আমার খুব সরল প্রশ্ন, ৫ বছর সময় পেয়েছে বর্তমান সরকার। এর আগে ১৯৯৬ সালে ও ৫ বছর সময় পেয়েছিলেন। আগামীতে কতদিন সময় পাবেন আমরা জানি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজাকারমুক্ত সংসদের সাংবিধানিক স্থায়িত্ব ত্যাশা করি। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত জামায়াতের অর্থের সকল উৎস সরকারকে বন্ধ করতে হবে। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হোক। জঙ্গীবাদ দমনে জঙ্গী মদদ দাতাদের তালিকা করে তাদের প্রত্যেকের আর্থিক লেনদেন সরকারের নজরদারিতে আনতে সরকারের সুচিন্তিত এবং সংগঠিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে, জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থেই তা জরুরীভাবে করতে হবে।

sumikhan29bdj@gmail.com

No comments:

Post a Comment