Wednesday, April 2, 2014

অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ!-মারুফ রসূল

বুধবার, ২ এপ্রিল ২০১৪, ১৯ চৈত্র ১৪২০
জানি না এখনও খবরটি জাতীয় গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কি না। দেশে নানা বিতর্ক চলছে, এসবের ফাঁকে এই খবরটি চাপা পড়ে গেলেও আশ্চর্য হব না। তবে নাগরিক হিসেবে, একজন ব্লগার হিসেবে নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারব না। ঠিক যেমন পারিনি এর আগে, যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গ্রেফতার করা হয়েছিল চারজন ব্লগারকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আবার। এবার সেই কালো আইন ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হলো দুই ব্লগারকে। তাঁদের দুজনই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। গত ৩০ মার্চ তাদের গ্রেফতার করে চট্টগ্রামের চকবাজার থানার পুলিশ। এজাহার থেকে জানা যায়, তাঁদের দুজনের মধ্যে একজনের নাম রায়হান রাহী এবং অন্যজন উল্লাস দাস। এজাহারে দুজনেরই বয়স উল্লেখ করা হয়েছে আঠারো। চট্টগ্রামের ব্লগারদের ব্লগ ও ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, রায়হান রাহী এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আগামী ০৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী সে। যখন রায়হানের বন্ধুরা পরীক্ষার জন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন রায়হানকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে অগণতান্ত্রিক ৫৭ ধারার আর তার পরিবারকে পোহাতে হচ্ছে আদালত আর থানা-হাজতের ঝক্কি ঝামেলা। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য বোধ করি আর কোন পরীক্ষার্থীর নেই, আর কোন পরিবারের নেই।
রায়হান রাহী ইস্টিশন ব্লগে ব্লগিং করতেন। তাঁর ব্লগ ও ফেসবুক ঘেঁটে এমন কিছুই পাওয়া যায় না, যে কারণে তাঁকে ৫৭ ধারায় আটক করতে হবে। তবে আটকের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়- এর পেছনের কারণগুলো। ইস্টিশনে প্রকাশিত রাহীর সহব্লগারদের লেখা থেকে জানা যায়, রাহী তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে কলেজে যায় এইচএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনার জন্য। সেখানে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী। শিবিরের জঘন্য কীটেরা রাহী ও তাঁর বন্ধু উল্লাসের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। এরপর পুলিশ আসে এবং তাঁদের সেখান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ব্লগপোস্টটি থেকে জানা যায়, থানায় আগে থেকেই রাহীর নামে ত্রিশ পৃষ্ঠার মতো নথিপত্র জমা দেয়া ছিল, যেখানে মূলত জামায়াত-শিবিরের ফেসবুক পেজ (যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক সম্বন্ধে নানা কটূক্তি করা হয় এবং যে পেজটি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ) বাঁশেরকেল্লার বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ ও স্বাধীনতাবিরোধী পোস্টে রাহীর তীব্র প্রতিবাদের অক্ষরমালা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সেখানে ছিল ফারাবী নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিকৃত মস্তিষ্কের শিক্ষার্থীর (ব্লগার রাজীব হায়দারকে যখন জামায়াত-শিবির হত্যা করে তখন শহীদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়িয়েছিলেন যে ইমাম, তাঁকে হত্যার হুমকিদাতা) বিভিন্ন সাইকোপ্যাথেটিক বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র ও শাণিত প্রতিবাদ। এরপর থানায় নিয়ে ৫৭ ধারায় তার নামে মামলা করে চকবাজার থানার এসআই শিবেন বিশ্বাস। 
পুরো ঘটনাটিতে দুটো বিষয় লক্ষ্যণীয়। এক, রায়হান রাহী ও তাঁর বন্ধু উল্লাস দাসকে প্রথমে শিবিরের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে। বেধড়ক মারধর করে। দুই, পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে আক্রান্ত দুই ব্লগারকে আটক করে এবং তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করে। তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়াল? শিবিরের সন্ত্রাসীদের এতই দাপট যে, তারা সাধারণ নাগরিকের জীবননাশের অপতৎপরতা চালিয়েও পুলিশের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে চলে, আর আটক হয়, মামলার শিকার হয় অসহায় দুই ব্লগার! যে ব্লগার বাঙলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান রক্ষার্থে নিরন্তর যুক্তির লড়াই করে গেল স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার হলো! সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র তোমার পুলিশ প্রশাসন! কী বিচিত্র তোমার আইন!
॥ দুই ॥
মামলার এজাহারটি ভাল করে পাঠ করে স্পষ্ট কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। পুলিশ বলছে, সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং সেখান থেকে দুই ব্লগারকে (পুলিশের ভাষায় আসামি, অভিযোগ প্রমাণের আগেই!) ‘উত্তেজিত জনতার কবল হইতে উদ্ধার করিয়া উপস্থিত জনসাধারণকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারি.. ..’- অর্থাৎ পুলিশ স্পটেই কাজ সেরেছেন। পুলিশের ভাষায়, উত্তেজিত জনতা হলো শিবিরের সন্ত্রাসীরা। তাদের মাঝখানে দুজন ব্লগারকে রেখে পুলিশ কি ব্লগারদের কোন বক্তব্য শুনতে পেরেছিল? না কি একতরফা শিবিরের সন্ত্রাসীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে আসে? যদি শেষ পর্যন্ত থানাতেই নিয়ে আসে, তবে কেন রায়হান রাহীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন স্পটে সকলের সামনে খোলা হলো? পুলিশ এ কাজটি করতে পারে কেবল তখনই, যখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকবে আসামির বিরুদ্ধে এবং পুলিশ প্রশাসনের কাছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকবে। কেবল মোবাইল ফোন খুলে দেখা পর্যন্তই শেষ নয়, সকলের সামনে রায়হান রাহীর ফেসবুকের ইনবক্সের মেসেজ পড়ে শোনানো হয়। সে মেসেজের উল্লেখও রয়েছে এজাহারে। এখন প্রশ্ন হলো, ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নয়, উপরন্তু তারা সন্ত্রাসীÑ যাদের হাতে নিরাপদ নয় রাহী, উল্লাসসহ মুক্তমনের ব্লগারগণ। সেই সন্ত্রাসীদের সামনে পুলিশ সদস্যরা কিভাবে একজনের (পুলিশী ভাষায় আসামি) ব্যক্তিগত তথ্যের উন্মোচন ঘটায়? এটা কি পুলিশের আইন লঙ্ঘন নয়? ইনবক্স একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর একান্ত ব্যক্তিগত প্লাটফর্ম। ফেসবুকের ‘স্টেটমেন্ট অব রাইটস এন্ড রেসপনসিবিলিটিস’- এর ‘প্রটেক্টিং আদার পিপলস রাইটস’ অংশে সুস্পষ্টভাবে অন্য কোন ব্যবহারকারীর তথ্য গোপন রাখার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশ সে নির্দেশনা অবমাননা করেছে, কারণ এজাহারেই উল্লেখ আছে- ‘... ইনবক্সের মন্তব্যগুলো উপস্থিত জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করিলে দেখা যায়...।’ 
এ পর্যায়ে এজাহারে ফারাবী সাফিউর রহমানের নাম আসে এজাহারে। এই ফারাবিই হলো সেই সাইকোপ্যাথেটিক রোগী, যার কাজই হলো ফেসবুকে বা ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল ও মুক্তমনের ব্লগারদের নানাবিধ হুমকি দেয়া এমনকি প্রকাশ্যে তাদের প্রাণনাশের ঘোষণা দানকারী। এই ফারাবিই শহীদ ব্লগার রাজীব হায়দারের জানাজা পড়িয়েছিলেন যে ইমাম, তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এ কারণে সে গ্রেফতারও হয়েছিল। সম্প্রতি সুলেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত গ্রন্থ সম্বন্ধেও সে নানাবিধ কটূক্তি করে যাচ্ছে এবং নানাভাবে লেখক অভিজিৎ রায়কে হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। এজাহারে ফারাবির সঙ্গে রাহীর কথোপকথনের উল্লেখ দেখানো হয়। এই ফারাবি ফেসবুকে ও ব্লগে নানা অকথ্য ভাষায় অন্য ধর্ম সম্বন্ধে কটূক্তি করে থাকে। অন্য ধর্ম অবমাননা করে থাকে, কিন্তু হায়, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ৫৭ ধারা দেখাতে পারে না। এই ফারাবির সঙ্গে রাহীর যে কথোপকথন দেখা গেছে, তা থেকে সহব্লগারদের অনেকের কাছেই এটি স্পষ্ট যে, ফারাবির বানোয়াট ও উদ্ভট তথ্যের জবাব দেয়াটাই রাহীর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফারাবি সেগুলো চালান করেছে, যা নয়, তার চেয়েও গুরুতরভাবে উপস্থাপন করেছে থানায়। শিবিরের সন্ত্রাসী এই বিকৃত মস্তিষ্কের ফারাবি পুরো ঘটনার কুপ্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। বলাই বাহুল্য, ফেসবুকের ‘স্টেটমেন্ট অব রাইটস এন্ড রেসপনসিবিলিটিস’- এর ধারা ফারাবিও অমান্য করেছে এবং ব্যক্তির তথ্যের যে গোপনীয়তা, তাও লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে, রাষ্ট্র ধর্মের চোখ দিয়ে দেখছে না।

॥ তিন ॥
রাহীর সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। হাতে যে সময় আছে, আর তাঁর উপর দিয়ে যে মানসিক চাপ যাচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠে পরীক্ষা দেয়াটা তাঁর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জটা কেবল তাঁর জন্যই নয়, আমাদের জন্যও। যে ব্লগার স্বাধীনতার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ব্লগিং করেছে, যুক্তির লড়াই করেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে পরাজিত করতে, তাঁদের মিথ্যাচারের জবাব দিতে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রাক্কালে তাঁকে বহন করতে হচ্ছে ৫৭ ধারার অভিশাপ। যে দেশে প্রতিদিন প্রতিরাত কুচক্রী মহল বিকৃত করছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর সরকার কেবল বক্তৃতার মাঝেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে, যে দেশে ইতিহাস বিকৃতিকারীদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না ৫৭ ধারা, যে দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের পরেও হেঁটে বেড়ায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা, অথচ প্রচলিত আইনের ধারায় তারা আটক হয় না, সে দেশে রাহীর মতো একজন ব্লগার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারবে না? তাঁকে হেরে যেতে হবে? একটা বছর নষ্ট হবে তাঁর মূল্যবান জীবন থেকে? আর যারা নির্বিকারে এখনও ‘বাঁশেরকেল্লা’ চালিয়ে যাচ্ছে, অপমান করছে আমার মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতাকে, অপমান করছে জাতির পিতাকে- প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায়, সেই নরপশুরা কি না ঘুরে বেড়াবে? আইনের এই তবে বিচার? এটা কি? ট্র্যাজেডি? না কি আলোহীন ভবিষ্যতে অচেনা এক বাংলাদেশের এপিটাফ? 
লেখক : ব্লগার ও কথাসাহিত্যিক

No comments:

Post a Comment