Tuesday, April 1, 2014

গোলমেলে মন, গোঁজামিলের রাজনীতি- মুনতাসীর মামুন


আজকাল দেখি সবাই রেগে আছেন। সবাই কোন না কোন কারণে ক্ষুব্ধ। গ্রীষ্ম বাড়ছে। জানি না, গ্রীষ্মের উত্তাপ আবার সবার মধ্যে সঞ্চারিত হবে কিনা। তবে, একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় এই ক্রোধের ভিত্তি কোন না কোনভাবে জামায়াতে ইসলাম। উপজেলা নির্বাচন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় আরও দুটি ইস্যু নিয়ে কথাবার্তা চালাচালি হচ্ছে। সেখানেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইস্যু হচ্ছে জামায়াত।

মন্ত্রীরা পরস্পরকে এবং একত্রে ‘বুদ্ধিজীবী’দের সমালোচনা করছেন। এখানে ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে তাঁরা সংবাদপত্রের কলামিস্ট, লেখক, অধ্যাপকদের চিহ্নিত করছেন। আবার অন্যদিকে ‘বুদ্ধিজীবী’রাও নীতি নির্ধারকদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে ও বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সমালোচনা করছেন। বিএনপি-জামায়াত-কমিউনিস্ট পার্টি আবার জোট সরকারের সমালোচনা করছে। একদিকে থেকে এসব তর্কবিতর্ক খারাপ না। গণতান্ত্রিক বোধ যে আমাদের তীব্র হচ্ছে তারই প্রমাণ। তর্কাতর্কি হচ্ছে বটে তবে বিএনপি- জামায়াত আমলের মতো ‘বুদ্ধিজীবী’দের আক্রান্ত হতে হচ্ছে না। এটি আশার বিষয়। এদেশের ‘বুদ্ধিজীবীরা’ সংখ্যালঘুদের চেয়ে সংখ্যালঘু। বিএনপি-জামায়াত আমলে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন তাদের প্রাক্তন মন্ত্রী ও নেতারা গ্রেফতার হচ্ছেন। এসব গ্রেফতারের কারণ কতটা যথার্থ সে সব বিষয়ে যাব না। সব মামলাই বিচারধীন। কখনও কী বলে ফেঁসে যাই। আর এমনিতেই আদালতের হাত লম্বা।

প্রথমে ধরা যাক, জাতীয় সঙ্গীতের কথা। দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য বর্তমান সরকারের দুটি প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। দুটি প্রচেষ্টায়ই সেনাবাহিনীর উদ্যোগ লক্ষণীয়। সরকারী-বেসরকারী যে কোন উদ্যোগই হোক সেখানে ভরসা করতে হচ্ছে সেনাবাহিনীর ওপর। সিভিল প্রশাসন আর জনগণ এখন আর ক্ষমতাধর নয়, কারও ভরসাস্থলও নয়। রাজনৈতিক দল যারা সিভিল সমাজের প্রতিনিধি জনগণ তাদের কাছে প্রিয় জনসভা ও ভোটের সময়।

প্রথম উদ্যোগটি ছিল মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট সবচেয়ে বড় পতাকা। যদিও আমি দেশপ্রেম শব্দটির উল্লেখ করেছি কিন্তু যাঁরা এটি প্রযোজনা করেছেন তাঁরা বলেছেন, এটি গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্থান পাওয়ার জন্যই করা। তাঁরা সফল হয়েছেন। তবে, তাঁরা যদি বলতেন সেটি মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, দেশপ্রেমের আবেগ সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য, তাহলে বিষয়টি আরও গ্রহণযোগ্য হতো। মনে রাখা উচিত একটি বেসরকারী কোম্পানি বিজ্ঞাপনের কারণেই এ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিল। তবুও প্রয়াসটি অভিনন্দনযোগ্য। কারণ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে, এমনকি আমাদের মাঝেও তা আবেগের সৃষ্টি করেছিল। উদ্যোগটি বেসরকারী ছিল বলে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হয়নি।
এবার সরকার গ্রহণ করেছে। লাখোকণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার। এই প্রস্তাবটিও অভিনব। এর সঙ্গেও দেশপ্রেমের আবেগটি জড়িত। কিন্তু, মুশকিল হলো, প্রথমে বলা এবং তারপরও বলা হয়েছে হয়েছিল, এটিও করা হচ্ছে গিনেস বুক অব রেকর্ডসের জন্য। মাঝে মাঝে তখন এও বলা হয়েছে, সংস্কৃতিমন্ত্রীই বলেছেন দেশপ্রেমের আবেগ সৃষ্টির জন্যই লাখো মানুষকে একত্রিত করা হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় সঙ্গীত হাওয়ার জন্য। অবশ্য এটিও গিনেস বুক অব রেকর্ডসে উঠবে।

গিনেস বুক অব রেকর্ডস একটি কোম্পানি। নিছক ব্যবসার জন্য গিনেস বুক অব রেকর্ডসের সৃষ্টি। এবং এই কোম্পানি ব্যবসা সফল। কয়টা কেঁচো খেলো, কে কয়টা হ্যামবার্গার খেলো, কোন শেফ সবচেয়ে বড় চকলেট কেকটি বানালেন, এক পায়ে কে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল প্রধানত এগুলোই রেকর্ডসের উপজীব্য। প্রায় ৪৫০০টি ‘রেকর্ড’ স্থান পেয়েছে সেখানে। দেশপ্রেম নিয়ে এ ধরনের রেকর্ড বুকে রেকর্ড সৃষ্টি করার খুব একটা দরকার ছিল না। সরকারের তো নয়ই। কোন কোম্পানির কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কিছু প্রমাণের দরকার নেই। সরকারের তো নেই-ই। কিন্তু তবুও বলব, দুটি প্রচেষ্টাই অভিনন্দন যোগ্য। এ দুটি বিষয় দিয়ে কিন্তু তরুণ ও বয়স্কদের ঐক্যবদ্ধ করা যায়। আবেগের সৃষ্টি করা যায় যা এ মুহূর্তেও প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে ইস্যু যেখানে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতি। এ দুটি ইস্যুতে অন্য ধরনের বক্তব্যও রাখা যেতে পারে।

পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লাখ শহীদের সঙ্গে জড়িত। যখন একটি শিশু বড় হয়ে ওঠে, মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিশ লাখ শহীদের কথা না জানলেও একটি বিষয় বোঝে জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত তার পরিচয় বহন করে। বিদেশে যখন কোন অনুষ্ঠানে, ভবনে জাতীয় পতাকা দেখি বা জাতীয় সঙ্গীত শুনি তখন জামায়াতে ইসলামের ক্যাডার ছাড়া সবার হৃদয়ই- আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে। জাতীয় পতাকাটা সবাই চিনি, সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত, মনে রাখাও সহজ। জাতীয় পতাকার নিয়মকানুনও আছে যা আমরা অধিকাংশই মানি না। যেমন, ১৬ ডিসেম্বর গাড়িতে, রিক্সায় জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। নিয়মকানুন মানলে তা সম্ভব নয়। কিন্তু, বিজয়ের আনন্দে পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। ক্রিকেটে জিতলে জাতীয় পতাকা নিয়ে বেরোই।

অন্যদিকে, জাতীয় সঙ্গীত যে অধিকাংশ মানুষ পুরোপুরি জানে না সেটি আমি নিশ্চিত। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এ লাইন দুটি জানি, তারপর অধিকাংশ লাইনই আর মনে পড়ে না। শুদ্ধ সুরেও গাই না। কোন অনুষ্ঠানে কত লাইন গাওয়া হবে তারও নিয়ম আছে। অনেক অনুষ্ঠানে দেখি সেটাও মানা হয় না। তাই সবাই মিলে লাখোকণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াটা একটি বিশুদ্ধ আনন্দ তো বটেই।

এখন এটিই প্রশ্ন । ছেলে বেলায়, প্রতিটি স্কুলে ‘অ্যাসেম্বলি’ বলে একটি কথা চালু ছিল। চট্টগ্রামের মতো মফস্বলে গত শতকের ষাটের দশকে স্কুল শুরু হওয়ার আগে সব ছাত্ররা মিলিত হতাম। তখনকার পাকিস্তানী পতাকা উঠানো হতো এবং আমরা এক সঙ্গে গাইতাম ‘পাক সার জমিন শাদ বাদ।’ এটি কি খুব খারাপ প্রথা ছিল? বিন্দুমাত্র না। গত কয়েক দশক আমরা এই সাধারণ দাবিটি করে আসছিলাম যে, বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে মাদ্রাসা ও ইংরেজী স্কুলগুলোতে পতাকা ওঠানো ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বাধ্যতামূলক করা হোক। করা হয়নি। আজ লাখো কণ্ঠে গান গাওয়া হবে, বিশ্বরেকর্ড হবে। সবাই মিলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে এবং তারপর যেই কী সেই। অথচ, স্কুলের বিষয়টি বা সেই মৌল কাজটির প্রভাব হতো সুদূর প্রসারী এবং এতে কোন পয়সা খরচ হতো না।

লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার ক্ষেত্রে বিতর্ক আরো উসকে দিয়েছেন সরকারের দুই মন্ত্রী। প্রকাশ্য বাকযুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হলেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ইসলামী ব্যাংকের অনুদানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া অনুচিত। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ ধরনের কোন অনুদান সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। কিন্তু বিডি নিউজ ২৪ডটকম জানাল, ‘ব্যাংকের (ইসলামী) এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান বলেন, লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত আয়োজনের জন্য ১৪ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিন কোটি টাকা অনুদানের চেক তুলে দেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটিডের ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফা আনোয়ার। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী ও জ্বালানি উপদেষ্টা। সংস্কৃতিমন্ত্রী পরে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুদানের চেক দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তহবিলের টাকা কোন খাতে ব্যয় হবে সেটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ঠিক করে না। তবে, তার জানা মতে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে এই খাতে টাকা আসেনি। আরো পরে তিনি জানান, ইসলামী ব্যাংক তো বেআইনী নয়। তার সব কটি যুক্তিই সঠিক।


 কিন্তু সঠিক যুক্তির পরও কথা থাকে যা লিখেছেন স্বদেশ রায়। তিনি লিখেছেন- “বাস্তবে এই আপোসের টনিকটি শুধু আজ নয়, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তো আর বেআইনী ছিলেন না, যে কারণে কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংও তাঁর সঙ্গে খাল কাটতে গিয়েছিলেন। এ সব স্বেচ্ছাসেবী কাজে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন সব সময়ই ভাল তাই তারা সেদিন ভালই খাল কেটেছিল। আর সেই খাল দিয়ে যে সব কুমির এসেছে এই যেমন জামায়াতে ইসলামী এরা তো বেআইনী নয়। আইন অনুযায়ী তো তারা রাজনীতি করছে। খালেদা জিয়ার বিএনপি, সেও তো বেআইনী নয়। আইন অনুযায়ী তারা রাজনীতি করছে। তাই জামায়ত-বিএনপি নরহত্যা, নারী হত্যা, শিশু হত্যাÑ সর্বোপরি গণহত্যা করলেও তাদের সঙ্গে আপোস চলে। কারণ, তারা তো বেআইনী নয়।

তবে এইটুকু সত্য মনে হয় এখন মনে রাখার সময় এসেছে যে, ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ছিনতাই করার পরে অনেক কিছু আইনী কাঠামোর ভিতর ঢুকানো হয়েছে। যা কোনক্রমে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে না। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের উষ্ণতার সঙ্গে, সাড়ে ছয় লাখ মা-বোনের আব্রু হারানোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মানুষ জামায়াত-বিএনপির হাতে জীবন দিয়েও এই সরকারকে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে কেউ যেন মনে না করেন মানুষ তাদের ক্ষমতায় পাঠায়নি। মানুষ তাদের পক্ষে ছিল বলেই কিন্তু নির্বাচনের পরের দিনই বিএনপি-জামায়াতের তা-ব ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে। আর এই মানুষ স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষ। এই মানুষ যারা গণজাগরণ মঞ্চে সারাদেশে এক হয়েছিল সেই মানুষ” [জনকণ্ঠ : ২৪.০৩.২০১৪]। 


ইনু বললেন, ‘টাকা ফেরত দেয়া উচিত।’ নূর বললেন, ‘টাকা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেয়নি।’ প্রশ্ন হলো, টাকা নেয়া হলো কেন? যতদূর মনে আছে, আমাদের হাসিখুশি সরল অর্থমন্ত্রী এই ঘটনার আগে বলেছিলেন, ঠাট্টা করে যে, টি২০ ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার আয়োজনের জন্য অনেক টাকা লাগবে। ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ জানানো হয় তারা যেন প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দান করেন। মন্ত্রী এটিকে ‘চাঁদাবজি’ বলে উল্লেখ করেন। ঠাট্টা করে বললেও বিষয়টি তো সত্য। প্রাইভেট ব্যাংককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ব্যবসা করার জন্য। 

কিছুদিন পর পর এভাবে টাকা চাইলে তারা তো বলতে পারে কোন আইনে লেখা আছে যে টাকা দিতে হবে। কিন্তু ব্যাংক তো সামাজিক খাতে ব্যয় করবেই। সেখান থেকেই টাকা দিতে বলা হয়। কিন্তু কোন ব্যাংকের সেই খাতের টাকা শেষ হয়ে গেলে তারা এই টাকা দেবে কোত্থেকে? সেটিও বিবেচনায় নেয়া উচিত।

ইসলামী ব্যাংকের টাকা সরকার জেনে শুনে নিয়েছে এবং এর যে এ রকম প্রতিঘাত হবে তা বোধহয় কর্তা ব্যক্তিরা ভাবেননি, আগেও নিয়েছে। প্রশ্ন হলো, ইনু কি বিষয়টি জানতেন না? দুই মন্ত্রী ময়লা কাপড় বাইরে কাচাকাচি করলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না। একটি সামান্য প্রশ্ন মনে আসছে, কেবিনেট মিটিংয়ে তিনি বা তারা প্রশ্নটি কেন তুললেন না। সেখানেই তো বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে পারত।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। কয়েকদিন আগে আমরা কয়েকজন ইয়াঙ্গুন গিয়েছিলাম। সেখানে জাতীয় জাদুঘরে গেছি। পুরনো কয়েকটি ছবিতে দেখলাম, রাজা বসে আছেন সিংহাসনে [যখন মিয়ানমারে রাজা ছিলেন]। 

সামনে এক দল অমাত্য। তারা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার ভঙ্গিতে বসে আছেন। একজন মন্তব্য করলেন, ঠিক আমাদের মন্ত্রীদের মতো! সবার অট্ট হাসিতে রক্ষী পর্যন্ত সচকিত হয়ে উঠলেন। 

এই লেখা শেষ করার সময় খবর পেলাম, সরকার ইসলামী ব্যাংকের টাকা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ায় ব্যয় করবে না। ব্যাংক টাকাটা ফেরত নিতে পারে বা অন্য খাতে দিতে পারে। সরকার আরও জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক বিধিবদ্ধ ব্যাংক। অর্থাৎ, এ বিষয়ে মানুষজন ক্ষুব্ধ তাই এ খাতে টাকা নেয়া যাবে না। অন্য খাতে আপত্তি নেই। এ প্রসঙ্গে স্বদেশ রায়ের বাক্য আগেই উল্লেখ করেছি। একই প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন, ইসলামী ব্যাংক “দীর্ঘ দিন যাবত সন্ত্রাস অর্থ যোগান দিয়ে আসছে। এখানে ‘টাকা আমারও দরকার জগৎ শেঠ’ এই নীতিতে শরীর ও মনপ্রাণ ডুবিয়ে আপোস করার সুযোগ নেই। সে আপোস যদি সরকার করতেও চায় তা হলে সরকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারবে। এবং বাংলাদেশের শেষ আশ্রয়স্থল শেখ হাসিনাকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের সঙ্গে গত তিন মাসে বার বারই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।” আমাদের অনেকের বক্তব্যই তা। কিন্তু শেখ হাসিনাই তো সরকার।


সরকার যে টাকা ফেরত দেয়ার ঘোষণা দিল সে জন্য শেখ হাসিকে ধন্যবাদ। তিনি অনুধাবন করেছেন, এর জন্য মানুষের শুব্ধ আবেগকে আহত করা হবে। সরকারের এ কাজ করা ঠিক হবে না। জনমতকে প্রাধান্য দেয়া গণতান্ত্রিক সরকারের মূল কাজ। কাজটি তিনি করেছেন এ জন্য আমরা খুশি। সব সময় যদি তা করতেন!

আরেকটি অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ও সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও তোফায়েল আহমদ ছিলেন। মিজানুর বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী একটি গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে... ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে অক্টোবর ও নবেম্বরে যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, মানুষের নিরাপত্তা যেভাবে বিঘিœত হয়েছে –তার নিরাপত্তা করতে বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। দুই মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেনÑ ‘সরকারের কাছের ও প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর কাছে বলতে চাই, আমরা মানবাধিকার কমিশন থেকে যখন ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি, তখন দেখেছি সংখ্যালঘু বাড়িতে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হাতেগোনা কয়েকজকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে কয়েক শ’ বা কয়েক হাজার।’ তিনি বলেন, এটা দোষীদের খুঁজে বের করার জন্য নয়, ব্যবসা করার জন্য এভাবে মামলা করা হয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে এ ধরনের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। 

পরে মিজানুর রহমানের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, হামলার সঙ্গে কারা জড়িত, এটা সবার কাছে স্পষ্ট। এখানে একজন বক্তব্য দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু যারা সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেন না। কেন বললেন না? কারণ এরা হলেন সেই শক্তির ধারক। এরা তাদের খরচ যোগান। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে শুধু মাঠ গরম করা যায়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মিজানুর রহমানের সমালোচনা করে বলেন, ‘এখানে একজন মন্ত্রীদের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করলেন না। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবীদের পার্থক্য রয়েছে। তারা স্পষ্ট করে কথা বলেন না। যেটা প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেই যায়।’[ প্রথম আলো : ২২-০৩-১৪]

বোঝা যায় যে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কথায় তারা দু’জনই খুবই রুষ্ট। কিন্তু কারণটি কি? তাদের উক্তি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, আওয়ামী লীগ [নেতৃবৃন্দ] কিভাবে বাইরের জগৎটি দেখে, কেন তার বিস্তৃতি ঘটছে না যেভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে বিএনপি-জামায়াতের।


প্রথমেই ড. মিজানের ব্যাপারটি দেখা যাক। মানবাধিকার কমিশনকে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। দাতাদের ও দেশীয় মানবাধিকার কর্মীদের চাপে এটি গঠন করতে হয়েছে। কোন সরকারই এ ধরনের কমিশন গঠনে ও কার্যকর করতে আগ্রহী হবে না। চাপে পড়ে এটি করা হয়েছে এবং যা ছিল তাই আছে। এর চেয়ে পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের অবস্থা অনেক ভালো। ড. মিজানের বলতে গেলে কোন কাজ নেই, মাঝে মাঝে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দেয়া ছাড়া। 

তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন মন্ত্রীদের সামনে তার কোন অংশটি ভুল?
১.নির্বাচনের আগে কি সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের দলন করা হয়নি?
২. নির্বাচনের পর কি একই ঘটনা ঘটেনি?
৩. পুলিশ কি প্রায় ক্ষেত্রে শ’ থেকে হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি করেনি?
৪. এবং এগুলোর কি খানিকটা বাণিজ্যকরণ হয়নি?
এর কোনটি অসত্য? 

ড. মিজান বলেছেন-
৫. এসব কর্মকান্ড  করেছে স্বাধীনতা বিরোধীরা? এটি কি ভুল? এবং এ কারণে তিনি মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্র দলিতদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র/সরকার সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। এটি আমার থেকে মন্ত্রীদ্বয় ভাল জানেন। তাঁরা নিজেরাই কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার বয়ান করেছেন। তাঁরা হয়ত সরকার ব্যর্থ হয়েছে তা বলেননি। না বলার কারণ তাঁরা এখন মন্ত্রী, আমরা অবশ্য এও লক্ষ্য করেছি, ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে অনেকে এমপি থাকা অবস্থায় সরকার সমালোচনায় মুখর ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর সবাই সবকিছু দার্শনিক দৃষ্টিতে অবলোকন করছেন। ড. মিজান তো আওয়ামী লীগের ক্যাডার নন। এই সরকারের আমলে কাউেেক কোন পদে দিল কি ধরে নিতে হবে তাকে কিনে ফেলা হয়েছে? একজন মন্ত্রী যা বলতে পারেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তা বলতে পারেন না। এই মর্যাদাবোধটুকু তাকে না দিলে মানবাধিকার কমিশন লুপ্ত করে দেখাই শ্রেয়।

দু’জন মন্ত্রীই বলেছেন, সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের নাম বলেননি ড. মিজান। সুতরাং তিনি তাদেরই অর্থাৎ তিনি হামলাকারীদেরই লোক। ড. মিজান পরিষ্কারভাবে বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা এর সঙ্গে যুক্ত। মন্ত্রীদ্বয় কি মনে করেন আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী? যদি না হয় তাহলে স্বাধীনতা বিরোধী কারা? এত কিছু তারা বোঝেন আর এটি বোঝেন না?

সরকারের অর্থাৎ বর্তমান সরকারের সমালোচনা করলেই একজন হয়ে যায় স্বাধীনতাবিররোধী। এই মানসিকতা সুস্থ মানসিকতা নয়। তোফায়েল আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,“আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবীদের পার্থক্য রয়েছে। তারা স্পষ্ট করে কথা বলেন না। সেটা প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেই যায়।” প্রাক্তন এক ছাত্র নেতা নূরে আলম সিদ্দিকি কয়েকদিন আগে বলেছেন, যার মর্মার্থ দাঁড়ায় কমিউনিস্টরা বাংলাদেশের সর্বনাশ করেছে। আওয়ামী লীগের সর্বনাশ হচ্ছে বেশি। 
প্রচন্ড  বিত্তশালীরা এ কথা বলতেই পারেন। আওয়ামী লীগ লুটেরাদের দলে পরিণত হোক এটি কারও কাম্য হলে তাও সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়।

মাননীয় দু’জন মন্ত্রী অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ এবং প্রভাবশালী। তোফায়েল আহমেদ তো আমরা ছাত্র থাকাকালীন আমাদের নেতাই ছিলেন। তাদের পরামর্শ বা জ্ঞান দেবার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে, একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি।
তখন তিন উদ্দিনের অন্ধকার যুগ চলছে। সামরিক তত্ত্বাবধায়ক আমল। মোহাম্মদ নাসিম জেলে। ভারতীয় হাইকমিশন এক ভোজসভার আয়োজন করেছে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সম্মানে, হোটেল র‌্যাডিসনে। অনেকের সঙ্গে আমি ও শাহরিয়ার কবিরও ছিলাম। পার্টিতে যা হয়, ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। সামরিক শাসনের যন্ত্রণার কথা যখন বলছিলাম তখন তিনি অবাক হয়ে বলছিলেন, তাই নাকি! তাই নাকি! বলেই ফেললাম, আপনি কি এই দেশের নাগরিক? যদি নাগরিক হন তাহলে কী ঘটছে আপনি জানেন না একজন রাজনীতিবিদ হয়ে? তিনি অবশ্যই ক্ষুব্ধ হলেন কিন্তু না আমরা ক্ষুব্ধ হয়নি। কারণ, আমরা জানতাম তিনি তত্ত্বাবধায়ক সামরিক কর্তাদের সমর্থক। এক পর্যায়ে আবদুর রাজ্জাককে পেলাম, তিনি তখন সংস্কারপন্থীদের নেতা। আমি তার সংস্কার পন্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দ্রুত কাজ আছে বলে, পার্টি ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর পাওয়া গেল সংস্কারপন্থীদের আরেক নেতা শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। তিনি এমন একজন রাজনীতিক যার সঙ্গে ঝগড়া করাও আনন্দদায়ক। আমাদের দু’জনকে তিনি স্নেহও করেন। আমরা সংস্কার নিয়ে তার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। বরং অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী এসে দু’একটি কড়া কথা বলছিলেন। সুরঞ্জিত দা একবার বললেন, ঠাট্টা করতাছ। বুঝবা মিয়ারা বুঝবা। তা বোঝার জন্য শাহরিয়ার কবির বলল, সুরঞ্জিত দা, পুরো বিষয়টা আমরা আপনার কাছে বুঝতে চাই। আমরা মনে করি না শেখ হাসিনা ছাড়া সংস্কার হবে বা তিনি ছাড়া আওয়ামী টিকবে। তিনিই একমাত্র নেতা যাকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সবাই জানে। সুরঞ্জিত দা নিরুপায় হয়ে বললেন, আগামীকাল বাসায় আস। পরের দিন শাহরিয়ার ফোন করে জানাল, সুরঞ্জিতদার খোঁজ করলাম, উনি কানাডা চলে গেছেন। এ রকম আরো ঘটনার পর তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমার দেখা। বললাম, ‘তোফায়েল ভাই, আপনি কি মনে করেন শেখ হাসিনাকে আপনারা বাদ দিতে চাইলে কারো পিঠের চামড়া থাকবে?’ তখন অনেকে বলাবলি করেছিল, তিনিও সংস্কারপন্থীদের সমব্যথী। তোফায়েল ভাই পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা ছাড়া কিছু করা যাবে না, আমি তাঁর পক্ষে। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ছিলেন কি ছিলেন না জানি না। তবে, প্রকাশ্যে কখনও তিনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বলেননি।

এখন আমার প্রশ্ন, আওয়ামী লীগের একটি অংশ তো শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল। আপনারা কি কখনও তাদের সমালোচনা করেছিলেন? সেই সময়কার পত্রপত্রিকা খুঁজে দেখুন। যারা প্রতিনিয়ত সামরিকবাদের বিরোধিতা করে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, স্বদেশ রায়, আবেদ খান ছাড়া আরও অনেকের নাম পারেন। জেলে গেছেন প্রায় আট দশজন শিক্ষক। আওয়ামী লীগের কয়জন সামরিকবাদ বা সংস্কারপন্থীদের রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।’ এই ড. মিজানও তখন বক্তৃতা বিবৃতিতে আমরা যা বলেছি তাই বলেছেন। আওয়ামী লীগের একাংশ তখন প্রায় নিশ্চিত শেখ হাসিনাকে যেতে হচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায় আর এই ‘বুদ্ধিজীবী’রাই রুখে দাঁড়িয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ছয় বছরে যাদের পুরস্কৃত করেছেন বিভিন্নভাবে তাদের অনেকে তখন বিদেশে কাটিয়েছেন, পালিয়ে গেছেন, নীরবে থেকেছেন। তখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কে কি বলেছিলেন যদি জানতে চান, বলবেন, বড়সড় একটি লেখায় তা জানান যাবে। আচ্ছা প্রিয় তোফায়েল ভাই, নাসিম ভাই, কয়েকজন এক সময় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে জুতা বানাবেন, যাদের আমরা সুমেকার বলি, তাদের অনেককে আপনারা মন্ত্রী/সাংসদ বানাননি? এক সঙ্গে ক্ষমতা উপভোগ করেননি? তখন তো কাউকে সামান্য প্রতিবাদ করতেও দেখিনি। 


বঙ্গবন্ধু খুনের পর খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কি কোন বুদ্ধিজীবী গিয়েছিলেন? সমর্থন করেছিলেন? নাকি, আওয়ামী লীগের নেতারা তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন? তাদের কয়জনকে আপনারা সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন? দুর্নীতি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজির সঙ্গে কতজন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ নেতা, ছাত্র নেতা জড়িত? আর পুরনো কমিউনিস্টদের কয়জন? মাত্র একজন আবদুল মান্নান খান। আপনারা কয়জন, হ্যা, জনাব তোফায়েল আহমেদ ও জনাব নাসিম, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জামায়াত নেতৃবৃন্দের নাম করে সমালোচনা করে বিরোধিতা করে ছিলেন? তাই বলি হিসাবের খাতা খুলতে চান আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা আদর্শের প্রশ্নে, খুলুন, আমরা খুশি হব।

এই পুরো নিবন্ধ, তাতে দেখবেন, অন্তিমে জামায়াত ইস্যুকে কেন্দ্র করেই সব বিতর্ক বা অভিযোগ। কিন্তু, এই জামায়াতের ক্ষেত্রে শুধু আওয়ামী লীগ নেতারাই নয়, অন্যরাই পরিষ্কার স্পষ্ট স্ট্যান্ড নেননি। হ্যা আমাদের অনেকেও নিইনি। কিন্তু কথা বলতে ভালবাসি।

জনাব তোফায়েল আহমেদ ও জনাব নাসিম নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রভাবশালী। আমাদের প্রশ্ন, ২০০১-০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত সংঘটিত সহিংসতার বিরুদ্ধে শাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্ট দেয়ার পরও জোট সরকার কেন তা প্রকাশ করেনি? ঐ সব সহিংস ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? এইসব মামলা তো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হওয়া উচিত। যারা এসব ঘটিয়েছে তাদের নাম কমিশনে আছে এবং আমরাও উল্লেখ করেছি। [আওয়ামী লীগ নেতারা জামায়াত-বিএনপির ক’জন নেতার কথা বলেছেন?] তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো না কেন? তত্ত্বাবধায়ক সামরিক আমলে সেনাবাহিনীর যে সব অফিসার গন্ডি   ছাড়িয়ে অত্যাচার করেছে ও অর্থ আত্মসাত করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হলো না কেন? নির্বাচনে আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াতের যারা সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? জামায়াত রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তো আমরা গত তিন দশক ধরে করছি। নিষিদ্ধ করছেন না কেন? ইসলামী ব্যাংক তো টাকা পাচার ও জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত, ব্যবস্থা নেননি কেন? আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীরা এখন জামায়াতের বিরুদ্ধে কিছু কিছু কথা বলেন, তাহলে ইসলামী ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতা কেন নেন?’ 

যে সব চ্যানেলকে আপনারা আমাদের পক্ষ মনে করেন এবং তাদের খুশি করার জন্য অনেক কিছু করেন, তাদের সংবাদ শিরোনাম থেকে অনেক কিছুর স্পন্সর ইসলামী ব্যাংক কেন? আমাদের অনেকে ইসলামী ব্যাংকে টাকা রাখেন আর জামায়াত নিষিদ্ধের কথা বলেন, তাহলে কিভাবে হবে? আওয়ামী লীগের এক ধরনের অঙ্গসংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কয়জন ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ইত্যাদিতে কাজ করেন? আওয়ামী লীগের কতজন খাতক ইসলামী ব্যাংকে? 

এসব প্রশ্ন কি বিবেচনায় আনবেন অনুগ্রহ করে? একটি প্রশ্নের জবাব মুক্তিযুদ্ধের পরে যে কেউ আপনাদের কাছে চাইতে পারে এবং উদ্ধত না হলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনারা সে প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য, তা হলো-১৯৪৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলাম এতসংখ্যক আসন পায়নি যা পেয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জামায়াত পেয়েছে ৩৩টি ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৩৩টি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি সঠিক হলে, গ্রহণযোগ্য হলে এই আমলে এত আসন কিভাবে তারা পেল? এর কারণ গোঁজামিলের রাজনীতি ও আমাদের গোলমেলে চিন্তাধারা। তা স্বীকার করতে না পারেন, ঔদ্ধত্যের বা আত্মগরিমার কারণে। যে কারণে একজন রাজনীতিবিদ সরে গেলে, সরিয়ে দেয়া হলে, সরে যেতে বাধ্য হলে, ৫০ বছরের মধ্যে বিস্মৃত হন, বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন হলেও থাকেন, থাকবেন, কারণ তাদের মধ্যে গোলমালটা কম, তফাত এখানেই। তবে, কাউকে সমালোচনা করছি না, অভিযোগও করছি না, এগুলো ভাগ্য হিসেবে আমরা মেনে নিয়েছি। বোঝা যাচ্ছে, সবাই কোন না কোন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে নানা কথা বলছেন, সরকারের নীতি নির্ধারকরাও বলছেন তাতে ইতিবাচক কোন প্রভাব ফেলছে না। নিজেদের, নিজেদের দল, নিজেদের নেতা নেত্রী গোলমেলে মন আর গোঁজামিল দিয়ে হিরো হওয়ার চেষ্টা আগে বন্ধ করুন তারপর আপনাদের সমালোচক বা ‘বুদ্ধিজীবী’দের নিন্দামন্দ করুন। সমাপ্ত
(৩০/০৩/২০১৪ -১/০৪/২০১৪) 

No comments:

Post a Comment