Saturday, May 4, 2013

১০৪তম জন্মদিবসে সেলাম বীরকন্যা প্রীতিলতা :২২ বছরের অগ্নিঝরা জীবনের বীরোচিত অধ্যায়-সুমি খান

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার  এর আজ ১০৪ তম জন্মদিন। ১৯১১ সালের ৫  মে চট্টগ্রামে তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ বিরোধী  আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা প্রীতিলতা এক সফল অভিযানের মাধ্যমে ইউরোপীয়ান ক্লাব  আক্রমনের পর গুলিবিদ্ধ হলে দলীয় নীতি অনুযায়ী পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে  আত্মাহুতি দেন ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর । ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতার জন্মদিবসে সূর্যবার্তা ২৪.কম এর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
"কি করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে? ঁআর কেঁদোনা মা। যাবার আগে আর একবার তুমি আমায় স্বপ্নে দেখা দিও। আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইবো।" মায়ের কাছে এই ছিল প্রীতিলতার শেষ চিঠি। ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাঈ ছিল তাঁর আদর্শ। তার নামে কন্যার নাম রাণী রাখেন প্রীতিলতার মা।
মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাষ্টারদা লিখেছেন “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, এর জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলামনা। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, Sincerity শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইলো।  মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম..."
প্রীতিলতার বাড়িতে এক আলাপচারিতা প্রসঙ্গে বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ১৯৩০ সালে লিখেছেন, “কথা হচ্ছিল, পাঁঠা কাটতে পারব কি না। আমি বলেছিলাম, ‘নিশ্চয় পারব, আমার মোটেই ভয় করে না’। প্রীতি উত্তর দিয়েছিল ‘ভয়ের প্রশ্ন না, কিন্তু আমি পারব না নিরীহ একটা জীবকে হত্যা করতে’।একজন তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল ‘কী, দেশের স্বাধীনতার জন্যও তুমি অহিংস উপায়ে সংগ্রাম করতে চাও?’ আমার মনে পড়ে প্রীতির স্পষ্ট জবাব, ‘স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও পারব, প্রাণ নিতে মোটেই মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারব না।’”
"কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হবো । সেই সময়ে ঝাঁসীর রানীর জীবনী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা 'অকুতোভয় বিপ্লবী' হিসাবে দেখা শুরু করলাম।" এভাবেই স্বপ্নের কথা লিখেছেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ।
চট্টগ্রামের ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছিল প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১৮ সালে তিনি এ স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলেন। সেই শিক্ষকের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। স্কুলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত ।
১৯২৬ সালে তিনি সংস্কৃতকলা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অঙ্কের নম্বর খারাপ ছিল বলে তিনি বৃত্তি পেলেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বন্ধের সময় তিনি নাটক লিখেন এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক চৌকি দিয়ে তৈরী মঞ্চে পরিবেশন করেন। পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার সময়টাতে তাঁর বাড়িতে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারনে বিয়ে তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের, পটিয়ার ধলঘাটে বীরকন্যা প্রীতিলতা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ২০০৫ সনের ২২ শে ফেব্রুয়ারী প্রতিষ্ঠিত প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তির স্থিরচিত্র।
আই.এ. বা উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন প্রীতিলতা । এ কলেজ়ের ছাত্রী নিবাসের মাসিক থাকা খাওয়ার খরচ ছিল ১০ টাকা । এর মধ্যে কলেজের বেতন ও হয়ে যেত। এ কারনে অল্প বেতনের চাকুরে জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে আই.এ. পড়তে ঢাকায় পাঠান।
১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত ভাবে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বিএ পড়তে যান। বেথুন কলেজে মেয়েদের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক ও তৈরী হয়েছিল।
কোলকাতার বানারসী ঘোষ স্ট্রীটের হোস্টেলের ছাদে বসে প্রীতিলতার বাশীঁ বাজানো উপভোগ করত কলেজের মেয়েরা। প্রীতিলতার বি.এ. তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় তিনি ক্লাসে সবার চাইতে ভাল ফলাফল করতেন।  তিনি দর্শনে অনার্স করতে চেয়েছিলেন ।বিপ্পবের সাথে যুক্ত হবার কারনে তাঁর অনার্স পরীক্ষা আর দেয়া হয়নি। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন।
কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে তাঁদেরকে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
প্রীতিলতার সার্টিফিকেট


ঊষা'দি এবং পূর্ণেন্দু'দা
প্রীতিলতা তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩-সালের ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস এর মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে। এ ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন  বিপ্লবীদের আস্তানায় পুলিশ হানা দেয়। পুলিশের সাথে সম্মুখযুদ্ধের পর গ্রেফতার হন মাস্টার'দা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাঁদের বিরুদ্ধে রেলওয়ে ডাকাতি মামলা দায়ের করা হয় । এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
ডা. খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রী প্রীতিলতা তার প্রিয় শিক্ষক ঊষাদির সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই মামলার ব্যাপারে বিস্তারিত অনেক কিছু জানতে পারেন। ঊষা'দি “ঝাঁসীর রাণী” বইটি পড়তে দেন প্রীতিলতা কে। ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাইয়ের জীবনী  প্রীতির মনে গভীর রেখাপাত করে।
১৯২৪ সালে 'বেঙ্গল অর্ডিনান্স' নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের অনেক নেতা ও সদস্য এই আইনে আটক হয়েছিল। তখন বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্র আর যুবকদেরকে অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হতো। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রীতিলতার নিকটাত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন তিনি দশম শ্রেনীর ছাত্রী। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়েন “দেশের কথা”, “বাঘা যতীন”, “ক্ষুদিরাম” আর “কানাইলাল”।
এই সমস্ত গ্রন্থ প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। প্রীতিলতা তাঁর দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কোন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিলো।
লীলা রায় ও দীপালী সঙ্ঘ
ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন “শ্রীসংঘ” নামে একটি বিপ্লবী সংঘঠন ছিল। এই দলটি প্পকাশ্যে লাঠিখেলা, কুস্তি, ডনবৈঠক, মুষ্টিযুদ্ধশিক্ষা ইত্যাদির জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব তৈরী করেছিল। ঢাকায় শ্রীসংঘের “দীপালী সঙ্ঘ” নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। লীলা নাগ (বিয়ের পর লীলা রায়) এর নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করত। গোপনে তাঁরা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ ও করত।
ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমা'দির মাধ্যমে লীলা রায়ের সাথে প্রীতিলতার পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের অনুপ্রেরণায় দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন “আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে নিজেকে গডে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি”।
১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীরা চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের জেলা সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন, যুব সম্মেলন ইত্যাদি আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নারী সম্মেলন করবার কোন পরিকল্পনা তখনও ছিলো না ।র্ণেন্দু দস্তিদারের বিপুল উৎসাহের জন্যই সূর্য সেন নারী সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দেন।মহিলা কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে এবং তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন। তাঁদের দুজনের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সূর্য সেনের অধীনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাঁদের ফিরে যেতে হয়। ১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আই.এ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। এটি “চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ” নামে পরিচয় লাভ করে। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবীদলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। প্রীতিলতা লিখেছিলেন “পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯শে এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐ সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। কিন্তু ঐ বীরত্বপুর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম”।
ক্যাবলা'দা এবং গুণু পিসি
১৯৩০ সালে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে আসেন। দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। যুব বিদ্রোহের পর তিনি মধ্য কলকাতায় বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসির (গুণু পিসি) বাসায় আশ্রয় নেন। প্রীতিলতা ঐ বাসায় গিয়ে দাদার সঙ্গে প্রায় দেখা করতেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে মনোরঞ্জন রায় (ক্যাবলা’দা নামে পরিচিত) নারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ করেন। যুব বিদ্রোহের পর পুলিশের হাতে গ্রেফতার এবং কারাগারে বন্দী নেতাদের সাথে আত্মগোপনে থাকা সূর্য সেনের সাথে বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগ হত। তাঁরা তখন আরো হামলার পরিকল্পনা করছিল। সূর্য সেন প্রেসিডেন্সী কলেজের কেমিষ্ট্রির ছাত্র মনোরঞ্জন রায়কে গান-কটন এবং বোমা তৈরীর নির্দেশ দেন। তিনি এসব সংগ্রহ করে পলাতক বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা গুণু পিসির বাসায় রাখতেন।
প্রীতিলতার ভিটেবাড়ির ধ্বংসাবশেষ
এ বাসায় বসে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, রেণুকা রায়, কমলা চ্যাটার্জী প্রমুখ বহু গোপন বৈঠক করেন এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর মাষ্টারদার প্রেরিত ইস্তেহার সাইক্লোষ্টাইলে ছাপিয়ে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বিতরন করেন।
মনোরঞ্জন রায়ের সাথে প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্তের পরিচয়ের পর তিনি বুঝতে পারেন যে এই মেয়ে দুটিই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লবী কাজ করতে সক্ষম হবে। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশের নজরদারী এড়িয়ে মনোরঞ্জন রায় কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম এসে সূর্য সেনের হাতে গান-কটন এবং বোমা তুলে দেন। এসময় তিনি জেলে থাকা বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে চিঠির আদান প্রদান এবং কলকাতা থেকে বিস্ফোরক বহন করে আনার বিপদ সম্পর্কে মাষ্টারদার দৃষ্টি আকর্ষন করেন। শহর আর গ্রামের যুবক বয়সীরা পুলিশের চোখে সবচেয়ে বড় সন্দেহভাজন। এ অবস্থায় সূর্য সেন নারী বিপ্লবীদের এসব কাজের দায়িত্ব দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কারন তখনো গোয়েন্দা বিভাগ মেয়েদের সন্দেহ করতো না। মাষ্টারদার অনুমতি পাওয়ার পর নারীদের বিপ্লবের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করা হয়।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মুখোমুখি প্রীতিলতা
চট্টগ্রামে সূর্য সেনের কাছে বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফেরত আসার একদিন পরেই ২৪ নভেম্বর মনোরঞ্জন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সে সময়ে টি জে ক্রেগ বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে নতুন দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তাঁকে হত্যা করার জন্য মাষ্টার’দা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে মনোনীত করলেন।
পরিকল্পনা অনু্যায়ী ১৯৩০ সালের দোসরা ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে তাঁরা রিভলবার নিয়ে আক্রমণ চালায় । কিন্তু ভুল করে তাঁরা মিঃ ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এস ডি ও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনই পুলিশ বোমা আর রিভলবার সহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে। সেই সময়ের কিছু বোমা কলকাতা থেকে মনোরঞ্জন রায় চট্টগ্রামে নিয়ে যান।
তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক হবার কারণে কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্বাসনদন্ড দেয়া হয়।
আলিপুর জেলের ফাঁসির সেলে মৃত্যুদন্ডের প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণের সাথে চট্টগ্রাম থেকে  আত্নীয়দের মধ্যে কেউ দেখা করতে আসা সম্ভব ছিল না। এ খবর জানার পর মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতার কাছে লেখা এক চিঠিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। মনোরঞ্জন রায়ের মা হিজলী জেলে ছেলের সাথে দেখা করতে গেলে গোপনে তিনি প্রীতিলতাকে লেখা চিঠিটা তাঁর হাতে দেন। গুনু পিসির উপদেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা মৃত্যুপ্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার জন্য আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে “অমিতা দাস” ছদ্মনামে “কাজিন” পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করেন।
জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে তিনি প্রায় চল্লিশবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন। এ সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন “তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচল ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদী মন এবং প্রগাঢ় উপলব্ধি বোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশী কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।” ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসী হয়। এ ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে।
প্রীতিলতার ভাষায় “রামকৃষ্ণদা'র ফাঁসীর পর বিপ্লবী কর্মকান্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।”
দীর্ঘপ্রতীক্ষিত সময়ের অবসানঃ মাষ্টারদা'র সাথে সাক্ষাত
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসীর পর আরো প্রায় নয় মাসের মতো প্রীতিলতাকে কলকাতায় থেকে যেতে হয় বি.এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বাড়িতে এসে দেখেন তাঁর পিতার চাকরি নেই। সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে বিশিষ্ট দানশীল ব্যাক্তিত্ব অপর্ণাচরণ দে’র সহযোগিতায় তখন নন্দনকাননে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, (বর্তমানে অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়)। তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন।
স্কুলে যাওয়া, প্রাইভেট পড়ানো এবং মা'কে সাংসারিক কাজে সাহায্য করে প্রীতিলতার দিন কাটছিল।
কিন্তু তিনি লিখেছেন, “১৯৩২ সালে বি এ পরীক্ষার পর 'মাষ্টারদা'র সাথে দেখা করবোই ' এই প্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম ।” বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা তিনি কল্পনা দত্তকে বলেন। প্রীতিলতা কলকাতা থেকে আসার এক বছর আগে থেকেই কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলী হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বিএস সি ক্লাসে ভর্তি হন। সেসময়ে প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সাথে মাষ্টারদা'র দেখা হয়।
১৯৩১ সালে এই গোপন সাক্ষাতের সময় আত্মগোপনে থাকা মাষ্টারদা'র সাথে ছিলেন বিপ্লবী নির্মল সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী এবং কালীকিংকর দে। মাষ্টার'দা ঐ সাক্ষাতের সময় কল্পনা দত্তের কাছ থেকে প্রীতিলতা সম্পর্কিত খোঁজ খবর জানতে চান। এরমধ্যে একবার মাষ্টারদা'র সংগঠন চালানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু অর্থের প্রয়োজন দেখা দিল।
প্রীতিলতার বাবা সংসারের খরচ চালানোর জন্য মাসিক বেতনের পুরো টাকাটা প্রীতিলতার হাতে দিতেন। তিনি ঐ টাকাটা সংগঠনের কাজে দিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু তা নিতে কল্পনা দত্ত আপত্তি করেন। প্রীতিলতা কেঁদে বলেন “গরিব দেখে আমাদের টাকা নিতে চান না? আমি যে নিষ্ঠাবান কর্মী হতে পারবো, তার প্রমাণ করার সুযোগও কি আমায় দেবেন না?”
প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহের কারনে কল্পনা দত্ত একদিন রাতে গ্রামের এক ছোট্ট কুটিরে তাঁর সাথে নির্মল সেনের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে সেই সাক্ষাতে নির্মল সেন পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে, সেটা প্রীতিলতার কাছে জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন “টান আছে। কিন্তু duty to family-কে duty to country-র কাছে বলি দিতে পারবো ।”
যুব বিদ্রোহের পর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়া সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে মাষ্টার'দা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কারনে প্রীতিলতার সাথে সে রাতে তাঁর দেখা হয়নি। প্রীতিলতার সাথে এই সাক্ষাতের কথা বলতে গিয়ে মাষ্টারদা লিখেছেন “অল্প কয়েকদিন পরেই নির্মলবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হতেই নির্মলবাবু আমায় বললো, " আমি রাণীকে (প্রীতিলতার ডাক নাম) কথা দিয়েছি আপনার সঙ্গে দেখা করাব, সে এক সপ্তাহের জন্য যে কোন জায়গায় আসতে রাজ়ী আছে।" রামকৃষ্ণের সঙ্গে সে ফাঁসীর আগে দেখা করেছে শুনেই তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হয়েছিল। তার দেখা করার ব্যাকুলতা শুনে রাজী হলাম এবং কয়েকদিনের মধ্যে (মে মাসের শেষের দিকে) তাকে আনার ব্যবস্থা করলাম”।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে তার দেখা হও্য়ার ইতিবৃত্ত, রামকৃষ্ণের প্রতি তার শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রীতিলতা প্রায় দু'ঘন্টার মতো মাষ্টারদা'র সাথে কথা বলেন। মাষ্টারদা আরো লিখেছেন “তার action করার আগ্রহ সে পরিষ্কার ভাবেই জানাল। বসে বসে যে মেয়েদের organise করা, organisation চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই বলে”।
তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাডিতে অবস্থানকালে আগ্নেয়াস্ত্র triggering এবং targeting এর উপর প্রীতিলতা প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন।
বিপ্লবী কর্মকান্ড -ধলঘাটে সংঘর্ষ
ধলঘাট সংঘর্ষের স্থানে নিহত বিপ্লবীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ


পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নির্মিত শহীদ মিনারের গায়ে মার্বেল পাথরের স্মৃতিফলক।## এই ছবিটি চট্টগ্রাম এর পটিয়া থানার ধলঘাটে অবস্থিত ১৯৭০ সালে নির্মিত প্রীতিলতা ও অর্ধেন্দু দস্তিদার স্মরনে শহীদ মিনার এর স্থিরচিত্র । অর্ধেন্দু দস্তিদারের বড় ভাই পূর্ণেন্দু দস্তিদার এই শহীদ মিনার নির্মান করেন। এটি প্রীতিলতার জন্মস্থানের সন্মূখে নির্মান করা হয়। এই ছবিটি ধারন করার সময় শহীদ মিনারটিতে অবহেলা ও অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।




১৯৩২ সাল--চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দুই বছর অতিক্রম হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত এবং অনেকেই গেপ্তার হয়েছেন। এই বছরগুলোতে আক্রমণের নানা পরিকল্পনার পরেও শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীরা নুতন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারে নাই। এসব পরিকল্পনার মূলে ছিলেন মাষ্টার'দা এবং নির্মল সেন। এই দুজন আত্মগোপণকারী বিপ্লবী তখনো গ্রাম থেকে গ্রামে বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই আশ্রয়স্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়ি।
পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রাম ছিল বিপ্লবীদের অতি শক্তিশালী গোপন আস্তানা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এবং জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকে এই গ্রামে ছিলো মিলিটারি ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে সেনারা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপনরত বিপ্লবীদের ধরার চেষ্টা করত। সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ছিল ঐ ক্যাম্প থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। বিপ্লবীদের কাছে ঐ বাড়ির গোপন নাম ছিল “আশ্রম”।
বিধবা সাবিত্রী দেবী এক ছেলে এবং বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে ঐ বাড়িতে থাকতেন। বিপ্লবীদের কাছে তিনি ছিলেন “সাবিত্রী মাসিমা”।
এই আশ্রমে বসে সূর্য সেন এবং নির্মল সেন অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সাক্ষাত করতেন এবং আলোচনা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন। অনেক সময় এই বাড়িতেই তাঁরা দেশ বিদেশের বিপ্লবীদের লেখা বই পড়ে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখে সময় কাটাতেন।
১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড় বৃষ্টির দিনে মাষ্টারদা'র পাঠানো এক ব্যক্তি প্রীতিলতাকে 'আশ্রমে' নিয়ে আসেন। প্রীতিলতা তাঁর মা'কে সীতাকুন্ড যাবার কথা বলে চলে এসেছেন। মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন ছাড়া ঐ বাড়িতে তখন 'ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলা'র পলাতক আসামী তরুন বিপ্লবী অপূর্ব সেন (ভোলা) অবস্থান করছিলেন।
১৩ জুন সন্ধ্যায় সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোগীদের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প জানতে পারে। এর আগে মে মাসেই ইংরেজ প্রশাসন মাষ্টারদা এবং নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে ১০,০০০ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন। ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন খবরটা জানার পর ঐ বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পুরস্কার এবং পদোন্নতির লোভে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, সাতজন সিপাহী, একজন হাবিলদার এবং দুজন কনষ্টেবল নিয়ে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ঐ বাড়িতে উপস্থিত হন। তার একটু আগেই মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতা দোতলা বাড়িটার নীচতলার রান্নাঘরে ভাত খেতে বসেছিলেন। জ্বরের কারনে নির্মল সেন এবং ভোলা রাতের খাবার না খেয়ে উপরের ঘরে শুয়েছিলেন। মাষ্টারদা'র সাথে খেতে বসে অস্বস্তি বোধ করায় প্রীতিলতা দৌড়ে উপরে চলে যান। প্রীতিলতার লজ্জা দেখে নির্মল সেন খুব হাসছিলেন। এমন সময় মাষ্টারদা ঘরের ভিতরের মই বেয়ে দোতলায় উঠে বলেন “নির্মলবাবু, পুলিশ এসেছে”।
প্রীতিলতাকে নিচে নেমে মেয়েদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন মাষ্টার'দা ।
ততোক্ষনে সিপাহী এবং কনষ্টেবলরা ঘর ঘিরে ফেলেছে। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের একতলায় থাকা সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে মেয়েকে দেখতে পান।
“ঘরে আর কে আছে?” এ প্রশ্ন করে কোন উত্তর না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয় পুলিশ । এসময় ঘরের উপরের তলায় পায়ের আওয়াজের শব্দ হয় । ক্যাপ্টেন ক্যামেরন হাতে রিভলবার নিয়ে ঘরের বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের দুই গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মৃত্যুবরন করেন। গুলির শব্দ পাওয়ার পর পুলিশ চারিদিক থেকে প্রচন্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটা গুলি এসে নির্মল সেনের বুকে লাগে এবং প্রচুর রক্তক্ষরনে তাঁর মৃত্যু হয়।
টাকা পয়সা এবং কাগজপত্র গুছিয়ে প্রীতিলতা এবং অপুর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাষ্টার'দা অন্ধকারের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এ সময়ে আমের শুকনো পাতায় পা পড়ার শব্দ পেয়ে আশেপাশে থাকা সিপাহীদের চালানো গুলিতে সবার আগে হাঁটতে থাকা অপুর্ব সেন মারা যান । মাষ্টারদা আর প্রীতিলতা সেই রাতে কচুরিপানাভরা পুকুরে সাঁতার কেটে আর কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। মণিলাল সেই বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিলেন।
মাষ্টারদা'র জন্য রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরন লিখে ধলঘাটে এনেছিলেন প্রীতিলতা। সেই পান্ডুলিপি পুকুরের মধ্যে হারিয়ে গেলো। তাঁদেরকে নিরাপদ কোন আশ্রয়ে নিয়ে যেতে বলেন মাষ্টারদা। মণিলাল দত্ত তাদেরকে ধলঘাট হতে ছয় কিলোমিটার দূরে পাহাড়, জঙ্গল এবং নদীর কাছাঁকাছি একটা গ্রাম জৈষ্ট্যপুরায় নিয়ে যেতে মনস্থির করেন। পুলিশ হানা দিলে পাহাড় এবং জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা যাবে অথবা নদী পার হয়ে অন্য আশ্রয়ে যাওয়া যাবে।
অনেক প্রতিকূল পথ অতিক্রমের পর তাঁরা জৈষ্ট্যপুরা গ্রামে বিপ্লবীদের আরেকটা গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছান। ঐ গুপ্ত আস্তানাটি বিপ্লবীদের কাছে “কুটির” নামে পরিচিত ছিল।  কুটিরে তখন আত্মগোপণে ছিলেন সুশীল দে, কালীকিংকর দে এবং মহেন্দ্র চৌধুরী। সূর্য সেন পরের দিন প্রীতিলতাকে বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে সূর্য সেনের নির্দেশে মণিলাল প্রীতিলতার বাসায় পুলিশের নজরদারী আছে কিনা তা জানতে শহরে যান। “সব কিছু ঠিক আছে” জানার পর প্রীতিলতাকে বাড়ি গিয়ে স্কুল শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।
"চট্টগ্রামে সৈন্য ও বিপ্লবীদের সংঘর্য" শিরোনামে ধলঘাট সংঘর্ষের খবর ১৫ জুন ,১৯৩২  দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ঃ
"এইমাত্র সংবাদ আসিয়াছে যে, গতরাত্রে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার নিকটে বিপ্লবী ও সৈন্যদের এক সংঘর্য হইয়া গিয়াছে। ফলে গুর্খা বাহিনীর ক্যাপ্টেন ক্যামেরন ও দুইজন বিপ্লবী নিহত হইয়াছেন। বিপ্লবীদের নিকট দুইটি রিভলবার ও গুলি ইত্যাদি পাওয়া গিয়াছে। নিহত বিপ্লবীদের একজনকে নির্মল সেন বলিয়া সনাক্ত করা হইয়াছে।"
আত্মগোপন
ধলঘাট সংঘর্ষের সে রাতেই গোলাগুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের মৃত্যুর পর পুলিশের এস. আই মনোরঞ্জন বোস পটিয়ার মিলিটারী ক্যাম্পে গিয়ে আরো ত্রিশজন সৈন্য এবং একটা লুইস গান নিয়ে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে ফিরে আসেন। লুইস গানের গুলিবর্ষণে বাড়িটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সেনাধ্যক্ষ মেজর গর্ডন দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে। সাবিত্রী দেবী এবং তাঁর পুত্র কণ্যাকে বিপ্লবীদের আশ্রয় দেবার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। কণ্যা স্নেহলতার জবানবন্দিতে আরো তিন যুবক—দীনেশ দাশগুপ্ত, অজিত বিশ্বাস, এবং মনীন্দ্র দাশকে আটক করা হয়। পরবর্তীকালে সাবিত্রী দেবী, তাঁর পুত্র রামকৃষ্ণ, এবং এই তিন যুবককে বিপ্লবীদের আশ্রয় এবং সহায়তা করার দায়ে চার বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। ঘরে তল্লাশী চালিয়ে  রিভলবার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের দুইটা ছবি, পাশাপাশি দুইটা মেয়ের ছবি (যার মধ্যে একজন  প্রীতিলতা) সহ কিছু চিঠি এবং দুইটা বইয়ের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। ধলঘাটে ছবি পাওয়ার পর ১৯শে জুন প্রীতিলতার বাসায় গিয়ে প্রীতিলতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ।২২ জুন এস.আই শৈলেন্দ্র সেনগুপ্ত এর নেতৃত্বে একটি দল ঐ বাড়িতে আরেক দফা তল্লাশি চালায়।
তাঁর নির্দেশে আশে পাশের সব জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়। জঙ্গল এবং আশেপাশের পুকুরে তল্লাশীতে অনেক কাগজপত্র উদ্ধার করা হয় যা থেকে প্রমাণিত হয় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর আত্মগোপনে থেকে ও বিপ্লবীরা তাঁদের আদর্শের সাথে অভিন্ন বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়া এবং সামরিক প্রশিক্ষন চালিয়ে যাচ্ছিল। তল্লাশি অভিযানে কাজিন পরিচয় দিয়ে অমিতা দাশের (প্রীতিলতার) আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাতের হাতে লেখা একটা বিবরন পাওয়া যায়। ঐ হাতের লেখার সাথে মেলানোর জন্য ৩০ জুন প্রীতিলতার বাসা থেকে পুলিশ তাঁর গানের একটা বই নিয়ে যায়। মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন।
৫ জুলাই মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রীতিলতা আত্মগোপন করেন । ছাত্রী পড়ানোর কথা বলে তিনি বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। পিতা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার অনেক খোঁজ খবর করেও কন্যার কোন সন্ধান পাননি। ব্যর্থ হয়ে যখন থানায় খবরটা জানানো হল, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর যোগেন গুপ্ত আরেক নারী বিপ্লবী কল্পনা দত্তের বাড়িতে যান ।
কল্পনা দত্ত সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন “আমাদের বাসায় এসে গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর  প্রীতিলতা সম্পর্কে বলেন, " এতো শান্তশিষ্ট নম্র মেয়ে ও, এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! ভাবতেও পারি না তার ভিতর এত কিছু আছে! আমাদের খুব ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়ে গেল।”
চট্টগ্রাম শহরের গোপন আস্তানায় কিছু দিন কাটিয়ে প্রীতিলতা পড়ৈকড়া গ্রামের রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিপ্লবীদের আরেক গোপন আস্তানা এই বাড়িটার সাংকেতিক নাম ছিল “কুন্তলা”। এই বাড়িতে তখন আত্মগোপনে ছিলেন মাষ্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার।
প্রীতিলতার আত্মগোপনের খবর ১৩ জুলাই ১৯৩২ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
“চট্টগ্রামের পলাতকা” শিরোনামের এই সংবাদে লেখা হয় “চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতি ওয়াদ্দাদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত”।
প্রীতিলতাকে ধরার জন্য বেঙ্গল পুলিশের সি আই ডি কর্তৃক প্রকাশিত ছবিসহ নোটিশটি ছিল এরকম-"Waddadar, whose photographs are published above. Photograph No.1 was taken 2 years ago when Miss Prithi was a student of the Dacca Eden Intermediate College and photograph No. 2 (sitting postures), which is a more recent one, was found at the time of search of one Apurba Sen alias Bhola (since deceased), in connection with Dhalghat shooting affray at Chittagong.
A Special “look-out” should be kept for her and when traced, the I.B., C.I.D., Bengal, Calcutta, should be informed by wire. A close, though unobtrusive, surveillance should at the same time be kept on her movements.
Description—Miss Prithi Waddadar, daughter of Jagabandhu Waddadar (Baidya by caste), of Dhalghat, Patiya and Jamalkhana, Chittagong town: age 20/21 (looks younger than her age); dark; medium build; short; ugly in appearance."
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ


ইউরোপিয়ান ক্লাবের সম্মুখের স্মৃতিফলক।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু 'গুড ফ্রাইডে' র কারনে সেদিনের ঐ পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড় ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা ব্যাতীত এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ঐ ক্লাবের ধারে কাছে যেতে পারতো না। ক্লাবের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”।
সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো।
আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য নুতনভাবে পরিকল্পনা শুরু করে। চট্টগ্রাম শহরের কাছে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে ঐ ক্লাবেরই একজন বেয়ারা যোগেশ মজুমদারের বাড়িতে বিপ্লবীরা আশ্রয় পেলেন।
১৯৩২ সালের ১০ আগষ্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।
১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয়ান ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন মাষ্টার'দা। এই অভিযানের দায়িত্ব নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলে মনস্থির করেছিলেন তিনি। কিন্তু নির্ধারিত তারিখের সাতদিন আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত । এ পরিস্থিতিতে ইউরোপীয়ান ক্লাব অভিযানে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর।
২৪ সেপ্টেম, ১৯৩২, প্রীতিলতা মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী পরলেন। চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রাবার সোলের জুতা।
ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোষাক পরানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তীর পোষাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরা ছিলেন মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন ।
বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেয়া তাঁর গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ) ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখান। এর পরেই ক্লাবে আক্রমণ শুরু হয়।
সেদিন ছিল শনিবার। প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল।
তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায এবং রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারনে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করেন।
একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ এবং সাত জন মহিলা আহত হয়।
পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তাঁর রিভলবারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন।
ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে অংশ নেয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করেন । পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে পরবর্তীতে প্রীতিলতাকে সনাক্ত করে পুলিশ । তাঁর মৃতদেহ তল্লাশীর পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, বিভলবারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না । পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল প্রীতিলতার মৃত্যুর কারণ।
প্রীতিলতার মৃত্যুর পর বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারী লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো একটা রিপোর্টে লেখেনঃ
"Pritilata had been closely associated with, if not actually the mistress of, the terrorist Biswas who was hanged for the murder of Inspector Tarini Mukherjee, and some reports indicate that she was the wife of Nirmal Sen who was killed while attempting to evade arrest of Dhalghat, where Captain Cameron fell."




প্রীতিলতার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের বিপন্ন অবস্থা নিয়ে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, “প্রীতির বাবা শোকে দুঃখে পাগলের মত হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রীতির মা গর্ব করে বলতেন, ‘আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে'।
তাঁদের দুঃখের পরিসীমা ছিল না, তবু তিনি সে দুঃখকে দুঃখ মনে করেননি। ধাত্রীর কাজ নিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে নিয়েছেন, আজো তাঁদের সেভাবে চলছে। প্রীতির বাবা প্রীতির দুঃখ ভুলতে পারেননি। আমাকে দেখলেই তাঁর প্রীতির কথা মনে পড়ে যায়, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন”।
মায়ের কাছে প্রীতিলতার শেষ পত্র
মাগো,
তুমি আমায় ডাকছিলে? আমার যেন মনে হলো তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলি আমার নাম ধরে ডাকছো, আর তোমার অশ্রু-জলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে। মা, সত্যিই কি তুমি এত কাঁদছো? আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না—তুমি আমায় ডেকে ডেকে হয়্ররান হয়ে চলে গেলে।
স্বপ্নে একবার তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম—তুমি তোমার আদরের মেয়ের আবদার রক্ষা করতে এসেছিলে! কিন্তু মা, আমি তোমার সঙ্গে একটি কথাও বললাম না। দু'চোখ মেলে কেবল তোমার অশ্রুজলই দেখলাম। তোমার চোখের জল মোছাতে এতটুকু চেষ্টা করলাম না।
মা, আমায় তুমি ক্ষমা করো—তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম। তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে। তোমাকে দুঃখ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়। আমি স্বদেশ-জননীর চোখের জল মোছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ কর, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পুর্ণ হবে না।
একটিবার তোমায় দেখে যেতে পারলাম না! সেজন্য আমার হৃদয়কে ভুল বুঝোনা তুমি। তোমার কথা আমি এক মুহুর্তের জন্যও ভুলিনি মা। প্রতিনিয়তই তোমার আশির্বাদ প্রার্থনা করি।
আমার অভাব যে তোমাকে পাগল করে তুলেছে, তা আমি জানি। মাগো, আমি শুনেছি, তুমি ঘরের দরজায় বসে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছো—“ওগো তোমরা আমার রাণীশূন্য রাজ্য দেখে যাও”।
তোমার সেই ছবি আমার চোখের ওপর দিনরাত ভাসছে। তোমার এই কথাগুলো আমার হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কান্নার সুর তোলে।
মাগো, তুমি অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য-স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না?
কি করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!
তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?
আর কেঁদোনা মা। যাবার আগে আর একবার তুমি আমায় স্বপ্নে দেখা দিও। আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইবো।
আমি যে তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে এসেছি মা। ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসি। তুমি আদর করে আমাকে বুকে টেনে নিতে চাইছো, আমি তোমার হাত ছিনিয়ে চলে এসেছি। খাবারের থালা নিয়ে আমায় কত সাধাসাধিই না করেছো—আমি পিছন ফিরে চলে গেছি।
না, আর পারছি না। ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আর আমাত উপায় নেই। আমি তোমাকে দুদিন ধরে সমানে কাঁদিয়েছি। তোমার ক্রন্দন আমাকে এতটুকু টলাতে পারেনি।
কি আশ্চর্য মা! তোমার রাণী এত নিষ্ঠুর হতে পারলো কি করে? ক্ষমা করো মা; আমায় তুমি ক্ষমা করো!
(আত্মাহুতির আগের রাতে প্রীতিলতা মায়ের উদ্দেশে এই চিঠিটি লিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুবরণের পর মাষ্টার'দা এই পত্রটি প্রীতিলতার মায়ের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ।)

Saturday, April 27, 2013

কেন মদিনা সনদ রাষ্ট্রীয় সংবিধান হতে পারে না : হাসান মাহমুদ

কেন মদিনা সনদ রাষ্ট্রীয় সংবিধান হতে পারে না

হাসান মাহমুদ১৮ইএপ্রিল ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)

এ নিবন্ধে মদিনা সনদের ধারাগুলো অনুবাদ করে দিচ্ছি। ওগুলো গোত্রীয় সমাজ, অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধ আর শান্তিচুক্তি, রক্তমূল্য নিয়ে খুনীকে রেহাই দেয়া, মুক্তিপণ নিয়ে যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দেয়া ইত্যাদির ওপরে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ সমাজে বিশেষ উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল। এখন দাসপ্রথা কিংবা জিজিয়া করের মত ওটা ইচ্ছে করলেও প্রয়োগ করা অসম্ভব। দেশে ইন্টারনেটের মত অনিয়ন্ত্রিত সুত্র থেকে কপি-পেষ্ট করে বা সামান্য যোগ-বিয়োগ করে মফিনা সনদ নিয়ে অজস্র লেখালেখি কথাবার্তা হচ্ছে অথচ সুত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য ও সংঘাত আছে। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিপজ্জনকভাবে জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছে।

আদিতে সনদটি আলাদাভাবে সংরক্ষণ করেছেন আবু উবাইদ ও ইবনে হিশাম/ইবনে ইসহাক। আমি ড: হামিদুল্লাহ লিখিত বিখ্যাত বই -"দি ফার্স্ট রিটেন কন্সটিটিউশন অফ দি ওয়ার্ল্ড" (পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান) থেকে অনুবাদ করছি, ধারাগুলো প্রধানত: ইবন হিশাম/ইবন ইশাকের দলিল থেকে নেয়া হয়েছে। অনুবাদে সামান্য হেরফের হয়ই তাছাড়া ও দুটোর মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে; আবু উবাইদ-এর দলিলে অনেকগুলো ধারা কম। আমরা নি:সন্দেহ নই আবু উবাইদ-এর ধারাগুলোতে আরো ধারা যোগ করা হয়েছে, নাকি সীরাত-এর ধারাগুলো থেকে কিছু মুছে দেয়া হয়েছে। তবু এ অনুবাদে মূল বক্তব্য কিছুটা পরিস্কার হবে আশা করি। দু'এক জায়গায় কিছুটা অস্পষ্ট রয়ে গেল, সেটা ওই দুই সূত্রের তফাতের কারণে। ধারাগুলোতে "বিশ্বাসী" শব্দে কখন ইহুদী আর কখন মুসলমান বোঝানো হয়েছে তা বাক্য থেকে বুঝে নিতে হবে।"গঠনতন্ত্র" ও "সংবিধান" সমার্থক শব্দ, রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর মূল দলিল। ধারাগুলো হল:-

১. ইহা আল্লাহ'র রসুল মুহম্মদের পক্ষ হইতে - যাহারা কুরাইশদের মধ্যে বিশ্বাসী ও আল্লাহ'র প্রতি আত্মসমর্পণকারী, - এবং মদীনাবাসী ও যাহারা তাহাদের অধীনস্ত বা তাহাদের সহিত যুদ্ধে যোগদান করিবে, (এই দুই পক্ষের - লেখক) তাহাদের মধ্যে ব্যবস্থাপনার জন্য ।

২.তাহারা সকলে মিলিয়া পৃথিবীর অন্যদের হইতে আলাদা একটি উম্মা।

৩.কুরাইশ হইতে আগত মুহাজিরেরা তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে, যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে ও যৌথভাবে মুক্তিপণ দিয়া তাহাদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে মুসলিমদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

৪. এবং বনি আউফ গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের- লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

৫. এবং বনি হারিথ গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের-লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

৬.এবং বনি সাইদা গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের- লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

৭. এবং বনি জুশাম গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের- লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

৮. এবং বনি নাজার গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের- লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

৯. এবং বনি আমর বিন আওফ গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের- লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

১০. এবং বনি নাবিথ গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের- লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

১১. এবং বনি আল আওস গোত্র তাহাদের বিজয়ের দায়িত্বে থাকিবে ও আগে যাহা বলা হইয়াছে সেইভাবে যৌথভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করিবে। (গোত্রের- লেখক) উপদলগুলি নিজেরা মুক্তিপণ দিয়া নিজেদের বন্দীদিগকে ছাড়াইয়া আনিবে যাহাতে বিশ্বাসীদের পারস্পরিক ক্রিয়াকর্ম ন্যায়ের ভিত্তিতে হইতে পারে।

১২ক । বিশ্বাসীগণ নিশ্চয়ই কাহাকেও ঋণের চাপে পর্যুদস্ত রাখিবে না -রক্তমূল্য ও মুক্তিপণের ব্যাপারে তাহারা ন্যায় রক্ষা করিয়া চলিবে।

১২খ। কোনো বিশ্বাসীই অন্য বিশ্বাসীর মক্কেলের সহিত (অন্যায়-লেখক)চুক্তিবদ্ধ হইবে না।

১৩.বিশ্বাসীরা নিশ্চয়ই বিদ্রোহী, ডাকাত, প্রতিজ্ঞার খেয়ানতকারী,বিশ্বাসীদের মধ্যে নষ্টামী সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইবে। এই ধরণের কেহ যদি তাহাদের পুত্রও হয় তবুও তাহার বিরুদ্ধে তাহারা দাঁড়াইবে একত্রে।

১৪.কোনো কাফেরকে খুন করার বদলা নিবার জন্য কোনো মুসলিম কোনো মুসলিমকে খুন করিবে না - কোনো মুস্লোমের বিরুদ্ধে কোনো কাফিরকে সাহায্যও করিবে না।

১৫. আল্লাহ'র প্রতিরক্ষা এক। কাহাকেও রক্ষা করিয়া কোনো বিশ্বাসী সকলকে দায়বদ্ধ করিতে পারে (এটা অস্পষ্ট - লেখক)। পৃথিবীর সকলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসীরা নিশ্চয়ই ভাই।

১৬. ইহুদীদের মধ্য হইতে যাহারা আমাদের অনুগত হইবে তাহারা সাম্য ও সাহায্য পাইবে। তাহারা অত্যাচারিত হইবে না কিংবা তাহাদের বিরুদ্ধে কাহাকেও সাহায্য করা হইবে না।

১৭. নিশ্চয়ই বিশ্বাসীদের শান্তি এক। আল্লাহ'র পথে কোনো যুদ্ধ হইলে কোনো বিশ্বাসী অন্য বিশ্বাসীরা ব্যতীত (শত্রুর সহিত) শান্তি স্থাপন করিবে না যদি না সেই শান্তি সকলের প্রতি সমান ও বাধ্যতামূলক হয়।

১৮.নিশ্চয়ই আমাদের যোদ্ধাদিগকে প্রতিস্থাপন করা হইবে (অর্থাৎ একদল যুদ্ধ করে আসবে অন্যদল যুদ্ধে যাবে - লেখক)।

১৯. আল্লাহ'র পথে (নিজেদের কারো- লেখক)রক্তপাত হইলে নিশ্চয়ই সকল বিশ্বাসী ঐক্যবদ্ধ হইয়া প্রতিশোধ লইবে।

২০ক । নিশ্চয়ই ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসীরা শ্রেষ্ঠ ও সরলতম নেতৃত্বের (গাইডেন্স-এর) অনুসারী।

২০খ। এই বিষয়ে কোনো মুশরিক কোনো কুরাইশের জীবন ও সম্পত্তিকে প্রতিরক্ষা দিতে পারিবে না এবং মুসলমানদের পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইবে না।

২১. যদি কেহ কোনো মুসলিমকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে এবং তাহা প্রমাণিত হয়,তবে প্রতিশোধ হিসাবে তাহাকে হত্যা করা হইবে, যদি না নিহতের উত্তরাধীকারীরা (রক্তমূল্যে)রাজী হয়। এবং নিশ্চয়ই এই বিষয়ে সকল বিশ্বাসী ঐক্যবদ্ধ হইবে, অন্য কিছুই তাহাদের জন্য বৈধ হইবে না।

২২. এই দলিলে (সহিফা-তে) যাহা কিছু আছে তাহা যেইসব বিশ্বাসীরা গ্রহণ করিয়াছে এবং আল্লাহ ও কেয়ামতে বিশ্বাস করিয়াছে, তাহাদের জন্য কোনো খুনীকে রক্ষা করা বৈধ হইবে না। খুনীকে কেহ সাহায্য করিলে ও আশ্রয় দিলে কেয়ামতের দিনে আল্লাহ'র অভিশাপ ও ক্রোধ তাহার উপর পড়িবে - এবং তাহার কাছ হইতে কোনো প্রতিদান গ্রহণ করা হইবে না।
২৩. যদি তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হয় তবে আল্লাহ ও মুহম্মদের সিদ্ধান্ত জারী হইবে।

২৪. এবং নিশ্চয়ই ইহুদীরা বিশ্বাসীদের সহিত একত্রে যুদ্ধ করিলে নিজেদের খরচ বহন করিবে।

২৫। (এই ধারাটি অস্পষ্ট - লেখক)।
এবং নিশ্চয়ই বনি আউফ গোত্রের ইহুদীরা ও বিশ্বাসীরা একত্রে একটি উম্মা হিসাবে গণ্য হইবে। কারণ তাহারা তাহাদের ধর্মে এবং মুসলিমেরা তাহাদের ধর্মে - একটি গোত্রের প্রকৃত সদস্য। কিন্তু কেহ চুক্তিভঙ্গ বা অত্যাচার করিলে সে তাহার নিজের ও তাহার পরিবারের উপর অত্যাচার করিল।

২৬. নিশ্চয়ই বনি নাজ্জার গোত্রের ইহুদীরা বনি আউফ গোত্রের ইহুদীদের মতই অধিকার পাইবে।

২৮. নিশ্চয়ই বনি আল হারিথ গোত্রের ইহুদীরা বনি আউফ গোত্রের ইহুদীদের মতই অধিকার পাইবে।

২৮. নিশ্চয়ই বনি সাইদা গোত্রের ইহুদীরা বনি আউফ গোত্রের ইহুদীদের মতই অধিকার পাইবে।


২৯. নিশ্চয়ই বনি জুসান গোত্রের ইহুদীরা বনি আউফ গোত্রের ইহুদীদের মতই অধিকার পাইবে।

৩০. নিশ্চয়ই বনি আল আউস গোত্রের ইহুদীরা বনি আউফ গোত্রের ইহুদীদের মতই অধিকার পাইবে।

৩১. নিশ্চয়ই বনি তালাবা গোত্রের ইহুদীরা বনি আউফ গোত্রের ইহুদীদের মতই অধিকার পাইবে। কিন্তু কেহ চুক্তিভঙ্গ বা অত্যাচার করিলে সে তাহার নিজের ও তাহার পরিবারের উপর অত্যাচার করিল।

৩২. এবং জাফনা (গোত্র- লেখক) নিশ্চয়ই তালাবাহ গোত্রেরই অংশ - তাহাদের মতই।

৩৩. নিশ্চয়ই বনি আশ শুতাইবা গোত্র বনি আউফ গোত্রের ইহুদীদের মতই অধিকার পাইবে। সকলে (চুক্তি - লেখক) মানিয়া চলিবে, কেহই ভঙ্গ করিতে পারিবে না।

৩৪. নিশ্চয়ই তালাবাহ গোত্রের উপদলগুলি প্রধান দলের সমান অধিকার পাইবে।


৩৫.নিশ্চয়ই ইহুদীদের সকল উপদলগুলি প্রধান দলের সমান অধিকার পাইবে।

৩৬ক। এবং নিশ্চয়ই তাহাদের কেহই মুহম্মদের অনুমতি ব্যতীত কোনো যুদ্ধে যাইতে পারিবে না।

৩৬খ। কেহ জখম হইলে তাহার বদলা নিবার ব্যাপারে কেহই বাধা দিতে পারিবে না। হত্যার জন্য হত্যাকারী নিজে ও নিজের পরিবারসহ দায়ী থাকিবে - অন্যথায় অবিচার হইবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাহাদের সহিত আছেন যাহারা এইগুলি অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলে।

৩৭ক। এবং নিশ্চয়ই ইহুদীরা বহন করিবে তাহাদের (যুদ্ধের) খরচ ও মুসলিমরা বহন করিবে তাহাদের খরচ। তাহারা একত্রে যুদ্ধ করিবে তাহাদের বিরুদ্ধে যাহারা এই দলিলের (সহিফা'র) যাহারা অংশীদার তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ইহাদের পরস্পরের সহিত পরামর্শ করিবে ও পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছা রাখিবে। সকলে (চুক্তি) রক্ষা করিবে,কেহই লংঘন করিবে না।

৩৭খ। নিশ্চয়ই কেহই বন্ধুদের প্রতি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিবে না এবং অত্যাচারিতকে সাহায্য করা হইবে।


৩৮. এবং নিশ্চয়ই ইহুদীরা বিশ্বাসীদের সহিত একত্রে যুদ্ধ করিলে নিজেদের খরচ বহন করিবে-(হুবহু ধারা ২৪-লেখক)


৩৯. এবং নিশ্চয়ই এই দলিলে (সহিফা-য়)অংশগ্রহণকারীদের জন্য মদীনার উপত্যকা সংরক্ষিত এলাকা।


৪০. এবং নিশ্চয়ই যাহাকে প্রতিরক্ষা দেওয়া হইয়াছে তাহাকে আদি প্রতিরক্ষিত ব্যক্তির মতই গণনা করা হইবে (এটুকু অস্পষ্ট - লেখক)।
তাহার কোনো ক্ষতি করা হইবে না এবং সে-ও চুক্তি লংঘন করিবে না।


৪১. এখানকার আদি অধিবাসীদের অনুমতি ব্যতীত কাহাকেও আশ্রয় দেওয়া যাইবে না।


৪২. এবং নিশ্চয়ই এই দলিলে (সহিফা-য়)অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যদি ঝগড়া বা হত্যা সংঘটিত হয়, যাহা হইতে সমস্যার উদ্ভব হইতে পারে, তাহা আল্লাহ এবং আল্লাহ'র রসুল মুহম্মদের (আল্লাহ তাঁহাকে পছন্দ ও রক্ষা করুন) কাছে আনা হইবে। এই দলিলকেযাহারা অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলে আল্লাহ তাহাদের রক্ষাকর্তা।


৪৩. এবং নিশ্চয়ই কোনো প্রতিরক্ষা দেওয়া হইবে না কুরাইশদিগকে এবং তাহাদের সাহায্যকারী দিগকে।


৪৪.এবং নিশ্চয়ই মদীনাকে আক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে তাহারা (মুসলিম ও ইহুদীরা) পরস্পরকে সাহায্য করিবে।

৪৫ক। (এটা আবু উবাইদ থেকে নেয়া হল কারণ ইবন হিশাম/ইবন ইশাকের ভাষা অস্পষ্ট- লেখক) যদি মুসলিমরা তাহাদের কোনো বন্ধু-গোত্রের সহিত ইহুদীদেরকে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানায় তবে ইহুদীরা তাহা করিবে। অপরপক্ষে ইহুদীরাও যদি একই আহ্বান করে তবে মুসলিমদের উপর তাহা বাধ্যতামূলক হইবে, যুদ্ধরত(মুসলিমদের বিরুদ্ধে- লেখক) কোনো গোত্র ব্যতীত।

৪৫খ। প্রতি দলের দায়িত্বে থাকিবে (শহরের?) যে অংশ তাহাদের মুখোমুখী।

৪৬। এই দলিলের (সহিফা'র) লংঘন না করিয়া অন্যান্য শরিকদের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করিলে দলিলের অংশীদার হিসাবে আল আউস গোত্রের ও তাহাদের উপদলের ইহুদীরা একই অধিকার পাইবে। অন্যায়কারীরা নিজের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই পায় না এবং নিশ্চয়ই এই দলিলকে যাহারা অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলে আল্লাহ তাহাদের রক্ষাকর্তা।

৪৭। এবং নিশ্চয়ই এই দলিল (কিতাব) কোনো অত্যাচারী বা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীকে রক্ষা করিবে না। যে কেহ (যুদ্ধে) যাইবে তাহাকে নিরাপত্তা দেওয়া হইবে;যে মদীনাতে রহিয়া যাইবে তাহাকে নিরাপত্তা দেওয়া হইবে; দেওয়া হইবে না শুধুমাত্র অত্যাচারী বা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীকে।

এবং নিশ্চয়ই এই দলিলকে যাহারা অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলে আল্লাহ তাহাদের রক্ষাকর্তা,মুহম্মদের মতই, আল্লাহ তাঁহাকে পছন্দ ও রক্ষা করুন।

***********************************************

ধারাগুলো পড়লেন। এখন বলুন, রাষ্ট্রীয় সংবিধান তো দুরের কথা, এই শান্তিচুক্তি কি বাস্তবে কোনভাবেই প্রয়োগ করা সম্ভব?

না, সম্ভব নয়।

*************************************************************

লেখক ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য,- দ্বীন রিসার্চ সেন্টার হল্যাণ্ড-এর রিসার্চএসোসিয়েট, - মুসলিমস ফেসিং টুমরো'র জেনারেল সেক্রেটারী, - ফ্রিমুসলিমস কোয়ালিশন-এর ক্যানাডা প্রতিনিধি, - আমেরিকান ইসলামিক লিডারশীপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং খুলনা'র “সম্মিলিত নারীশক্তি”র উপদেষ্টা। শারিয়ার ওপরে বই "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি" ও আন্তর্জাতিক প্রশংসিত ডকু-মুভি "হিল্লা", "নারী" ও "শারিয়াপ্রহেলিকা" - লণ্ডন ও টরন্টো'র স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষাক্লাসে দেখানো হয়

Thursday, April 25, 2013

অভিমানে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে চান সাজেদা চৌধুরী



রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। গতকাল রবিবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় রাজনৈতিক সহকর্মীদের সামনে তিনি বলেছেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পাড়ি দিয়ে এখন তিনি ক্লান্ত ও অসুস্থ। তাই রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে চান তিনি। সভায় উপস্থিত একাধিক নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে সংসদীয় দলের ওই সভায় দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার কষ্টে সাজেদা চৌধুরী রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে সহকর্মীদের কাছে বিদায় চাইলেন।
সাজেদা চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করার পর থেকেই সাজেদা চৌধুরী পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করতে থাকেন। এ নিয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে জোর লবিংও চালিয়ে যান তিনি। সাজেদার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও পরিবেশন করা হয়।
সূত্র জানায়, সংসদীয় দলের সভায় শুরুতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, দলের জন্য তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা তুলে ধরেন। শেষে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাম প্রস্তাব করার জন্য সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব, গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা তুলে ধরে একজনের নাম প্রস্তাব করার পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের নাম প্রস্তাব করেন। একে একে অন্য শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রস্তাব সমর্থন করেন। এক পর্যায়ে মাইক্রোফোন নিয়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, 'দলের প্রতি বিশ্বস্ততা, ত্যাগ-তিতিক্ষা দায়িত্বশীলতার কিছু কথা আমারও বলতে হয়। দীর্ঘদিন এ দলের সঙ্গে কাজ করে চলেছি। বিভিন্ন দুঃসময়ে বড় বড় নেতারা দলের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেনি। সেই দুঃসময়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি। দলের প্রয়োজনে লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আজ আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ও অসুস্থ।' আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি আরো বলেন, 'আমি রাজনীতি থেকে বিদায় চাই। আমাকে বিদায় দিন।'
রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন প্রসঙ্গে সাজেদা বলেন, 'যেহেতু রাষ্ট্রপতি হিসেবে দল হামিদকে সমর্থন জানিয়েছে, আমিও সমর্থন জানাই।'
পরে সাজেদা চৌধুরীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরে তাঁর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান তোফায়েল আহমেদ। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, সাজেদা চৌধুরীর বক্তৃতার সময় উপস্থিত নেতারা বিরক্তি প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাজেদা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শারীরিকভাবে আমি অসুস্থ। কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে চাই।' সূত্র : কালের কণ্ঠ

Tuesday, April 23, 2013

কারাগারে নিরীহ সুব্রত অধিকারী: পথ চেয়ে আছে মা- ছেলে কবে মুক্ত হবে?





দুই তারিখ সারাটা রাত নির্ঘুম আমরা সবাই । মোবাইলের ওপাশে সেই পুরাতন ভোঁতা কণ্ঠস্বর । আপনার ডায়েল কৃত নাম্বারটি ………।।

রাত বাড়ছে সাথে সাথে ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে । ক্রমেই মনে হচ্ছিল ও বুঝি আর বেঁচে নেই ।
তিন তারিখ সকালে ডিবির ব্রিফিং থেকে জানতে পারলাম সুব্রত অধিকারী শুভ কে গ্রেফতার করা হয়েছে ।

নিজ চোখে দেখলাম মিডিয়ার সামনে দাগী আসামীর মত হাজির করা হয়েছে তাকে । তার সাথে জব্দকৃত অস্ত্র হিসেবে দেখিয়েছে মডেম আর ল্যাপটপ । তার অপরাধ সে ধর্ম ‘অবমাননা ‘ করেছে ।
প্রচণ্ড লজ্জা পেলাম । সুব্রত অধিকারী আসলে কে , সে আসলে কি লিখেছে ? সেই প্রশ্নের উত্তর না জেনেই তাকে একটা নোংরা মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হল ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র সুব্রত। সদা হাসিখুশি আর সবার জন্য নিবেদিতপ্রান এই ছেলেটির একটা চমৎকার গুণ -নিজের আচরন , জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দিয়ে সবার মন জয় করে নেয়া। ক্যান্সার আক্রান্ত বাচ্চাদের জন্য সুব্রত প্রতি তিন মাস পর পর রক্ত দিত । ওজন কম হওয়ায় ডাক্তার তার রক্ত নিতে চাইতো না ।কিন্তু নাছোড় বান্দা ছেলেটা , সুন্দর যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতো, এই রক্ত একটা বাচ্চার জীবন বাঁচাবে। তাই তার নিজের ক্ষতির চেয়ে বাচ্চার জীবন বেশি জরুরী । গত শীতে নিজের হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ১২টা সোয়েটার কিনে দিয়েছিল পথ শিশুদের । অথচ নিজের সোয়াটার ছিল না, পরে বন্ধুর গিফট করা সস্তা জ্যাকেটা দিয়ে পুরো শীতটাই পার করেছে সে।
নিছক বিনোদনের মধ্যম হিসেবে ফেইসবুকে তার বিচরন শুরু হয় ২০০৮ থেকে । দুই লাইন কবিতা কিংবা বানী কিংবা সারা দিন কেমন গেল এসব নিয়ে স্ট্যাটাস দিত । ২০১২ থেকে সে সমাজ সচেতনতা মূলক স্ট্যাটাস দেয়া শুরু করে , তার একটা স্ট্যাটাস এ লেখা ছিল ,

“ধর্ষণ ঠেকাতে স্প্রে! ( ভারত )
সত্যি এটি পুরুষের জন্য খুবই লজ্জার। একটি রাষ্ট্রে পুরুষ কতোটা হিংস্র ও নোংরা হলে মেয়েরা স্প্রে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটা যদি বাঙলাদেশেও হয় তাহলে দেখা যাবে মেয়েরা ডান হাতে ছেলেদের বা বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাই (HI) বলছে আর বাম হাতে ব্যাগের মধ্যে স্প্রে ধরে আছে। পুরুষ হও বা মানুষ হও যাই হও না কেন পশু হইও না। পৃথিবীর শুরু থেকেই এই ধর্ষণ শব্দটি ও কর্মটি পুরুষের সাথে মিশে আছে। যু্দ্ধক্ষেত্রে হোক আর সামাজিকক্ষেত্রে হোক ধর্ষণ তার রক্তে মিশে গেছে ” ।

তার খুব ক্ষোভের একটা যায়গা ছিল জামাতের ভণ্ডামি । সে মনে প্রানে চাইত যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক । দেশ থেকে জামাত নামক ভণ্ড দলটা নির্মূল হোক । সে লিখেছে ,

“সাতক্ষীরার একটি গ্রামে জামাত-শিবিরের বেজন্মরা কয়েকদিন আগে হিন্দুদের গ্রামে হামলা করে। গর্ভবতী এক মহিলার পেটে তারা লাথি দিয়ে আঘাত করে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঐ মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এই বেজন্মরাই আমাদের সমাজে ধর্মের রক্ষক হিসেবে পরিচিত। তারাই কে মুসলিম কে নাস্তিক তার সার্টিফিকেট দেয়।

কিন্তু এতো হায়নার মাঝেও কিছু মানুষ দেখে প্রাণ ফিরে পাই । শত অন্ধকারেও আশার আলো দেখি।

এই নিউজটা দিল হিমেল ভাই। সাতক্ষীরার প্রতিনিধি তাকে এই সংবাদ জানায়।

তার পকেটে ৩২০০ টাকা ছিল পুরাটাই সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে দিয়ে দিয়েছে। ঐ সময় উপস্থিত তিন জনের কাছ থেকেই প্রায় দশ হাজার টাকা উঠেছে। আপাদত জরুরী ভিত্তিতে এই সামান্য টাকা গুলো পাঠানো হল। অর্থের আরো প্রয়োজন হতে পারে। আশা করি আমরা সবাই সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেব।

জামাতের বেজন্মরা ঐ মায়ের পেটেই শুধু লাথি দেয় নি, লাথি দিয়েছে আমাদের মাতৃভূমির পেটে। এই বেজন্মরা হয় এই দেশে থাকবে না হয় আমরা। পাকিস্তানি গেলমানদের জায়গা এই দেশে না। পাকিস্তানের গেলমান পাকিস্তানে ফিরে যা” ।

তার দেশাত্মবোধ ছিল প্রচণ্ড প্রবল । একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাস্তায় পরে থাকা একটা পতাকা দেখে সে ধুলো ঝেড়ে মাথায় বেঁধে নিয়েছিল । বলেছিল , “ মায়ের আঁচল ধুলোয় লুটাবে কেন , এর জায়গা তো মাথায়” । তার ব্লগের ৯০ ভাগ লেখাই দেশ কে নিয়ে , সে ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর সাক্ষাতকার নিয়েছিল । মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক মামার দেশ প্রেমের প্রতিটি অক্ষর সে লিখছে ব্লগে । সে লিখেছে জামাতের নিপীড়ন , একাত্তরে সংগ্রাম পত্রিকার ভূমিকা আসলেই কি ছিল তাই নিয়ে ।
তার চেতনা এর শাণিত যে সে বার বার প্রতিবাদী হয়েছে , আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নামে মিথ্যাচার নিয়ে । একবার ফেইসবুকে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নাম নিয়ে কোন বর্বর একটা নোংরা আইডি খুলেছিল । শুভ সঙ্গে সঙ্গে তার তীব্র প্রতিবাদ করেছে । সে লিখেছে ,

“বাঙালি কতোটা নোংরা তার জন্য বাঙালির বেডরুমে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাঙালির ফেসবুই যথেষ্ট। শেখ হাসিনার নামে একটা নোংরা একাউন্ট দেখলাম। মাথা এডিট করে লাগানো ওখানে। একই জিনিস খালেদা জিয়ার হোক তা চাই না। এমন নোংরামীই মাধ্যমেই আমরা আমাদের পরিচয় জানান দিচ্ছি”

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে একটা চমৎকার পোষ্ট দিয়েছিল ব্লগে। ও মনে প্রানে বিশ্বাস করত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি ।
শুভ ধার্মিকদের শ্রদ্ধা করত । তার মুসলিম বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে সব সময় সালাম দিত । সে কোন দিন কাউকে ধর্ম নিয়ে একটা বাজে কথা বলেনি । বরং সে লিখেছে ,
“টুপি দেখলেই জামাত নয় , ধার্মিক দেখলেই ঘৃণা নয়” ।

মসজিদে আগুন দিল যখন জামাত শিবিরের সন্ত্রাসীরা , তখন শুভ খুব কষ্ট পেয়েছিল । সে লিখেছিল ,

“মসজিদের ভেতরে আগুন দেওয়া, নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের মারা, অস্ত্র নিয়ে মসজিদে প্রবেশ, মসজিদে মারামারি, রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য মসজিদ ব্যবহার, ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়া, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, ধর্মের নামে মানুষ খুন ইত্যাদি করেও জামাত-শিবির একটি ইসলামিক দল।”

এই অল্প বয়সী ছেলেটা তার এক বছরের ব্লগিং জীবনে মাত্র ২৫-৩০টা লেখা দিয়েছে । তার প্রতিটি লেখাই ছিল তার বোধের প্রকাশ । জীবন সম্পর্কে সে তার ছোট্টা জীবনে ধারণা এখনো এতটা গভীর হয়নি কিন্তু তার জানার চেষ্টা আছে শত ভাগ । ব্লগে তার আইডি সুব্রত শুভ , লালু কসাই , আজাদ । অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ায় বন্ধুরা মজা করে ওকে ডাকে লালু কসাই। তাই সে তার ব্লগ নাম এটাই দিয়েছিল ।
তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সারমর্ম করলে এমন দাঁড়ায় ,

১/ ” সুব্রত শুভ বাংলাদেশ নাস্তিক কমিউনিটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত”

২/ “সুব্রত শুভর” সাথে আসিফ মহিউদ্দিন, শর্মি আমিনদের মতো ইসলামবিদ্বেষীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে

৩/ “সুব্রত শুভ” হিন্দু নির্যাতনের দোহাই দিয়ে প্রায়ই মুসলিমদের ধর্মীয় বিষে কটু মন্তব্য করে যা সাম্প্রদায়িক অস্হিতিশীলতার সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ।

কার ফেইসবুক বন্ধু ভিন্ন বিশ্বাসের হওয়া অপরাধ এই কথাটা কোন আইনে আছে আমার জানা নেই । যদি থেকে থাকে তাহলে আমরা সবাই অপরাধী । সুব্রত শুভ এর ফ্রেন্ড লিস্ট এ তথাকথিত কয়েকজন নাস্তিক (যদিও ইসলাম ধর্ম মতে কাউকে “নাস্তিক” বলার আগে অনেক কিছু ভেবে চিনতে বলতে হয়।) আছে বলে তাঁর উপর মামলাটি করা হয়েছে । তাহলে বাংলাদেশর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধীনে মাষ্টার্স এর শেষ পর্বে মুসলিম দর্শনে যে বা যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাঁদের কে ও নাস্তিক বলা যায়। কেননা আরজ আলী মাতব্বর তো একজন ইসলাম বিরোধী ছিলেন। তাই আশা করছি অচিরেই বর্তমান সরকার ঐ ব্যাক্তিদের (মাষ্টার্স এর মুসলিম দর্শনে যে বা যারা আরজ আলী মাতব্বর এর দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেছেন) খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ ।
মসজিদ, মন্দির পোড়াবার খবর যখন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হল তখন সকল ধর্মের মানুষ প্রতিবাদ করেছিল , শুভ তাদের ব্যতিক্রম নয় । সে লিখেছিল ,
“”যে দেশে যে ধর্মের মানুষ বেশী সেই দেশে ঐ ধর্ম নিয়ে কথা বললে বা সমালোচনা করলে; বেশি সংখ্যক মানুষ যখন আঘাত পায় তখন তাকে ধর্মানুভূতি বলে। কিন্তু অন্য ধর্মের মূর্তি ভাঙলে , মসজিদ ভাঙলে বা ঐ ধর্ম নিয়ে খোঁচালেও ধর্মানুভূতিতে আঘাত আসে না। ইহাই ধর্মানুভূতির অনুভূতি।”

তার এই ছোট্ট জীবনে শুধু দেশ কে দেশের মানুষ কে ভালবাসার জন্যই কি আজ তার এমন পরিণতি ? সাত দিনের রিমান্ড, এখন জেল হাজত আর কদিন পরে কি মিথ্যা অপরাধে দায়ী দেখিয়ে তার শাস্তি হয়ে যাবে ?
যে মুসলিম ভাইদের মসজিদ পোড়াবার প্রতিবাদ সে করেছে , যে হিন্দু ভাইদের মন্দির ভাঙ্গার প্রতিবাদ সে করেছে আজ তাকে তারাই কি ভালবেসে মুক্ত করে আনবে না ? যে প্রধানমন্ত্রী কে সে মায়ের সম্মান দিয়েছে তিনি কি ওর পাশে দাঁড়াবেন না ?
ও প্রকৃত ধার্মিকদের শ্রদ্ধা করত , সম্মান করতো, আজ তারা কি ওর পাশে দাঁড়াবে না ?
আমাদের দেশে একটা মিথ্যা মামলা দেয়া অনেক সহজ । আমরা সবাই তা জানি । কিন্তু সত্যের জয় চিরকাল হয়েছে । শুভর মায়ের অশ্রু, হাজার হাজার মানুষের ভালবাসা , ওকে ফিরিয়ে আনবে এই আমাদের প্রত্যাশা । http://khoborbangla.com/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%B9-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4-%E0%A6%85%E0%A6%A7/

Friday, April 12, 2013

শতবর্ষী আলোকবর্তিকা বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে


শতবর্ষী আলোকবর্তিকাসম বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়েছে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। শহীদ মিনারে ঢাকার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিনোদবিহারী চৌধুরীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় বিউগলে বিদায়ের করুণ সুর বাজানো হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ রাখা হবে বিকেল চারটা পর্যন্ত।
আজ শুক্রবার দুপুরে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ কলকাতা থেকে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয়। দুপুর ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শিখর বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ গ্রহণ করেন।প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম বিষয়ক বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল এ কথা জানান।
চারটার পরে বিনোদবিহারীর মরদেহ রাখা হবে চট্টগ্রামের যাত্রামোহন সেন মিলনায়তনে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষমূর্তির পাদদেশে। সেখান থেকে সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। রাতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী বিনোদবিহারীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে নগরের অভয়মিত্র শ্মশানে।
গত বুধবার রাতে ১০৩ বছর বয়সে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী কলকাতার ফর্টিজ হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি শেষ ইচ্ছায় বাংলাদেশে তাঁকে সমাহিত করার কথা জানিয়ে গেছেন বলে জানান তাঁর ছেলে সৌমশুভ্র চৌধুরী।
জীবন ও কর্ম:
বিনোদবিহারী চৌধুরীর জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। তাঁর মা শ্রীমতী রমা রানী চৌধুরী। পিতা কামিনীকুমার চৌধুরী। ১৯২৯ সালে পি সি সেন সারোয়াতলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রায়বাহাদুর বৃত্তি পান।
১৯২৭ সালে ১৬ বছর বয়সে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী দল যুগান্তরে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী থাকাকালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ‘ভারতীয় সাধারণতন্ত্র বাহিনীর’ সদস্য হিসেবে অংশ নেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিনোদবিহারী অন্য চার সহযোদ্ধার সঙ্গে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগার দখল প্রচেষ্টায় অংশ নেন। দখলের পর তাঁরা দেশীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সূর্য সেনকে রাষ্ট্রপতি করে ‘অস্থায়ী গণতন্ত্রী বিপ্লবী সরকারের’ ঘোষণা দেন। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল জালালাবাদ যুদ্ধেও অংশ নেন বিনোদবিহারী। ওই যুদ্ধে তাঁর গলায় গুলিবিদ্ধ হয়। ব্রিটিশ সরকারকে তাঁকে জীবিত বা মৃত ধরতে পাঁচ শ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
বিনোদবিহারী ১৯৩৩ সালে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। ভারতের রাজপুতনার দেউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশন পেয়ে বিএ পাস করেন। ১৯৩৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর আবার তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। প্রায় এক বছর গৃহবন্দী থাকাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ইংরেজিতে এমএ ও বিএল (আইন) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বিনোদবিহারী চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পাঞ্চজন্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। এ সময় তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় বিনোদবিহারী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
১৯৪৮ সালে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান আইন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের বদলে যুক্ত নির্বাচনের আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান দেশের সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিনোদবিহারী অবসরে যান। ১৯৬৯ সালে স্বৈরশাসনবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

শুরুতে সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় যোগ দিলেও পরে তাতে আর যুক্ত থাকেননি। শেষ জীবনে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন শিক্ষকতাকে। প্রায় শতবর্ষ বয়স পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের মোমিন সড়কের বাসায় তিনি ছাত্রদের পড়িয়েছেন।
দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পর নানা সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান-পতন টলাতে পারেনি মহান এই বিপ্লবীকে। ১৯৬৮ সালে তাঁর দুই ছেলে সুবীর চৌধুরী, বিবেকানন্দ চৌধুরী কলকাতায় স্থায়ী হন। কিন্তু এই বিপ্লবী সস্ত্রীক বাংলাদেশে থেকে যান। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর হারান ৭০ বছরের দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী বিভারানী চৌধুরীকে। বিনোদবিহারীর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে মোমিন সড়কের বাসাতেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিনোদবিহারী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তবে দেশের সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অধিকারভিত্তিক আন্দোলনে ছিলেন অগ্রবর্তী সৈনিক। স্বৈরাচারবিরোধী, জঙ্গিবাদবিরোধী ও সামাজিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এই অগ্নিপুরুষ।
২০০০ সালে বিনোদবিহারী স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ গুণীজন সম্মাননা, ১৯৯৮ সালে ভোরের কাগজ সম্মাননা, শহীদ নতুনচন্দ্র স্মৃতিপদক।

Wednesday, April 10, 2013

অগ্নিযুগের বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর শতবছরের গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লবী অধ্যায়ের অবসান



চলে গেলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথী ও চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী পরলোক গমন করেছেন। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।বিপ্লবী বিনোদন বিহারী চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। তার প্রয়াণের খবরে সবার মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।

১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এই অগ্নিপুরুষ। গত ১০ জানুয়ারি ছিল তাঁর ১০৪ তম জন্মদিন। চট্টগ্রামকে আঁকড়ে থাকা এই মানুষটির শেষ ইচ্ছা ছিল তার প্রিয় স্থানেই যেন তাঁর শেষকৃত্য হয়।

শতবছরের আগুনঝরা দিন

বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী জন্মেছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। পিতা কামিনী চৌধুরী একজন আদর্শবান আইনজীবী ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বদেশি এবং ব্রিটিশবিরোধী প্রথম অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ফটিকছড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন সভা সমিতিতে তিনি যেতেন, সঙ্গে নিয়ে যেতেন শিশুপুত্র বিনোদকে। ১৯২৯ সালে বিনোদ চৌধুরী প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং রায়বাহাদুর বৃত্তিলাভ করেন।

বিনোদ চৌধুরীর লেখাপড়ার মতো দেশপ্রেমে প্রথম হাতেখড়ি হয় ফটিকছড়ি বোর্ড স্কুলে পড়ার সময় পিতার কাছে। বিপ্লবী জীবন শুরুর পর একে একে পরিচয় হয় সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার, মধুসূদন দত্ত, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী, অর্ধেন্দু গুহ, গণেশ ঘোষ, নির্মল সেনসহ অনেকের সঙ্গে। বিপ্লব সম্পর্কিত অনেক বই পড়ে ফেলেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকাকালে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের লড়াইয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ঘটনার পর বিপ্লবীরা নিকটবর্তী পাহাড়ে অবস্থান নেন।

২২ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কার্যত স্বাধীন ছিল। মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নেন। ইংরেজ সৈন্যরা পাহাড় ঘিরে ফেলে। ৫৪ জন বিপ্লবী মাস্টারদার নেতৃত্বে ও লোকনাথ বলের সেনাপতিত্বে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন। লোকনাথ বল যুদ্ধের একটা ছক তৈরি করেন, পাহাড়ের তিন দিকে কে কোথায় অবস্থান নেবেন, কীভাবে যুদ্ধ করবেন-সব বুঝিয়ে দেন। শত্রুপক্ষ যেন পাহাড়ে উঠতে না পারে সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন। সে অনুযায়ী যুদ্ধ চলে। ইতিমধ্যে বারোজন বিপ্লবী শহীদ হন, বিনোদ বিহারী চৌধুরী সহ আহত হন কয়েকজন। গুলি তার গলার একদিকে ঢুকে বেরিয়ে গেছে অন্যদিকে। রক্তক্ষরণের ফলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। অভুক্ত বিপ্লবীরা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে বিপ্লবীদের জালালাবাদ পাহাড়ের অবস্থান ত্যাগ করতে হয়। আহত, রক্তাক্ত বিনোদ চৌধুরী পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিয়ে অতি কষ্টে এসে পৌঁছান কুমিরার এক আত্মীয় বাড়িতে। এখানে গোপনীয়ভাবে তার চিকিৎসা চলে। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এদিকে এসে পড়ে নতুন বিপদ। গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতায় সেখানে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। আত্মীয় বাড়ির লোকেরা শংকিত হন। তারা সিদ্ধান্ত নেন বিনোদ চৌধুরীকে সরিয়ে নিতে হবে। তাকে বউ সাজতে হয়, লাল পাড়ের শাড়ি, হাতে শাঁখা ও চুড়ি পরে বউ সেজে বাড়ি থেকে বের হন, পৌঁছে যান শহরের চাক্তাই। পথে পুলিশের সামনে পড়তে হয় দুবার। ওদিকে বিনোদ বিহারীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পাঁচশ টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়।
বাবার পরামর্শে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। মামার সঙ্গে রওয়ানা হন ভারতের মধ্যপ্রদেশের চিন্ডুয়ারা জেলার জুনার দিয়া কয়লা খনিতে। পরিচয় গোপন করে কয়লা খনিতে দিনে এক টাকা মাইনেতে একটা চাকরিও জুটে গেল বিনোদ বিহারী চৌধুরীর। সকাল-বিকাল যারা কয়লা খনিতে যাওয়া-আসা করতেন তাদের নাম, সময় নির্দিষ্ট ফরমে লিখে রাখাই তার কাজ। মধ্যপ্রদেশ থেকে পালিয়ে চাকরির সন্ধানে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়ান বিনোদ চৌধুরী। ঝাড়খন্ডেও ছিলেন কিছুদিন। অতঃপর চলে আসেন ঢাকায়। এক ব্যক্তির আশ্রয়ে থাকতেন তাঁতিবাজারের তিনতলা এক বাড়ির নিচতলায়। কয়েকদিন ছিলেন কার্জন হল ও ফরিদপুরে। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের কারো কারো সঙ্গে তার যোগাযোগ শুরু হয়, এমনকি মাস্টারদার সঙ্গেও। তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন আর পিয়নের চাকরির জন্য ঘুরবেন না, তার কাজ চট্টগ্রামে। তার মতে, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী চট্টগ্রাম।

বিপ্লবী বিনোদ চৌধুরী চট্টগ্রামে ফিরলেন বটে, তবে তার প্রিয় মাস্টারদার সান্নিধ্যে নয়, নিক্ষিপ্ত হন জেলে। সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা নিজেও ১৯৩৩-এর ২ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয়ে যান। বিপ্লবীদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে ব্রিটিশ সৈন্যরা। একে একে ধরা পড়তে লাগলেন বিপ্লবীরা। সঙ্গে সঙ্গেই বিচার কাজ শুরু হয়। এ বছর ১৪ আগস্ট সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হয়, নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের কারাগারের একই ফাঁসি মঞ্চে সর্বাধিনায়ক মাস্টারদার সঙ্গে বিপ্লবী তারকেশ্বরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তার আগে একই কারাগারে ভিন্ন সেলে বন্দী বিনোদ বিহারী চৌধুরী আরেক বিপ্লবীর অনুরোধে মাষ্টার 'দা কে গান শোনাতে হয়। বিনোদ বিহারী চৌধুরী গেয়ে উঠেছিলেন, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে , তবে একলা চলো রে...."

বিনোদ বিহারী চৌধুরী ১৯৩৩-এর জুন মাসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও পাঁচ বছর চট্টগ্রাম জেল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি ও বহরমপুর জেল এবং দেউলি বন্দীশিবিরে কারাজীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৩৮ সালের শেষদিকে কারাগার থেকে মুক্তি পান। এক বছরের মাথায় ব্রিটিশ সরকার তাকে এক বছর গৃহবন্দী করে রাখে। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকেই জেল-দ্বীপান্তর থেকে ছাড়া পেয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেও বিনোদ বিহারী চৌধুরী কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি এ সময় চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সহসম্পাদক ছিলেন। এ সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তুতিকালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। ১৯৪১ থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেল, ঢাকা জেল এবং হিজলি ও খোকশা বন্দীশিবিরে আটক থাকার পর ১৯৪৫-এর শেষ দিকে ছাড়া পান। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় এক বছর চট্টগ্রাম কারাগারে বিনা বিচারে তাকে কাটাতে হয়। জেলখানা, বন্দীশিবির ও গৃহবন্দী অবস্থায় জীবনের বারোটি বছর অতিবাহিত করেন বিপ্লবী বিনোদ চৌধুরী।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় অনেকের মতো বিনোদ চৌধুরী দেশত্যাগ করেননি। তিনি পাকিস্তানে কংগ্রেস দল প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। ১৯৪৮ সালের পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের নির্বাচনে কংগ্রেস দলীয় প্রার্থী হিসেবে জয় লাভ করেন। সে সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য আসন নির্ধারিত ছিল ও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের (একাত্তরে শহীদ) নেতৃত্বে বিনোদ চৌধুরী প্রমুখ নেতা আন্দোলন করেন প্রচলিত ধর্মীয় ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের পরিবর্তে যুক্ত নির্বাচন আদায়ের জন্যে। বিনোদ চৌধুরী ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৮ সালে আইউব খান সামরিক আইন জারি করে রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করলে বিনোদ চৌধুরী রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দু’শ মাইল পথ পায়ে হেঁটে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের মিজোরাম দিয়ে কলকাতায় উপস্থিত হন। রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়ে তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টারে পাঠান এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভারত সরকারের সহায়তায় বহু সংখ্যক প্রাইমারি স্কুল খুলেন।
কোলকাতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান নিয়ে থাকবার সুযোগ ছেড়ে মাষ্টার'দার দীক্ষা অনুসরণ করে যে মাতৃভূমির জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন , সেই মাতৃভূমিতেই ফিরে এলেন আবার । নিয়েজিত করলেন দেশ গড়ার কাজে।
নামমাত্র সম্মানীতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। দুই পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ২৮ বছর বয়সে কোলকাতায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বড় ছেলে ক্যন্সার আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি মারা যায়। কয়েক বছর আগে তার স্ত্রী বিভা চৌধুরী এ মারা যান। এতো শোক সয়ে ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সকলকে প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করতেন এই বিপ্লবী। বড় ছেলে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি মারা যান। পুত্রবধু উপালি চৌধুরী এবং একমাত্র নাতি সোমশ্রভ্র চৌধুরী কোলকাতাতেই থাকেন।বড় পুত্রের শেষকৃত্যে কোলকাতা গিয়ে আর চট্টগ্রামের মাটিতে ফিরতে পারলেন না এই মহান বিপ্লবী। তার মহাপ্রয়ানে আমরা শোকাহত। এ মহান বিপ্লবীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

“তরুণ সমাজ যেন অসাম্পদায়িক, চরিত্রবান এবং স্বদেশানুরাগী হয়ে দেশের কল্যাণে আত্মনিবেদন করে ”-১০৩ বছরে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী




(ছবি র ক্যাপশন- ২০০৮ সালে তার রোগমুক্তি কামনা করে আমাদের সময়ে প্রকাশিত কলাম পড়ছেন। ছবি- সুমি খান)
সুমি খান: “অহিংস সত্যম শ্রেয়ং শৌচ সংযম সেবচ । এই ছোট্ট কথা টি বাংলাদেশের ই এক মনীষী মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর। তিনি বৈষ্ঞব ছিলেন । আমেরিকায় এক সভায় যোগ দিয়ে এই কথাটি বলেছিলেন। যা আমেরিকাবাসীকে মুগ্ধ করে। আমাকেও মুগ্ধ করে। এই কথাটি মনে মনে উচ্চারণ করে আমি মানসিক শক্তি আনার চেষ্টা করি। আজ আমার ১০৩ তম জন্মদিনে দৈনিক আমাদের সময়ের মাধ্যমে আমার তরুণ ভাইবোন দের বলি , এই গুণ গুলো যদি মানুষের থাকে তবে আমরা নিজেদের সত্যিকার মানুষ বলে প্রমাণ করতে পারি।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। আমাদের তরুণ সমাজ যেন অসাম্প্রদায়িক, চরিত্রবান এবং স্বদেশানুরাগী হয়ে দেশের কল্যাণে আত্মনিবেদন করে।এই তাদের কাছে আমার একমাত্র নিবেদন।
মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোগী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী আজ ১০৩ বছরে পদার্পন করলেন।সকাল আটটা থেকে তার বাসায় অনুরাগী ভক্তরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় শুভেচ্ছা জানাবেন।
১৯০৯ সালের ১০ জানুয়ারী বোয়ালখালীর উত্তরভূর্ষী গ্রামে জন্ম নেন। ফটিকছড়ি করোনেশন স্কুলের মেধাবী ছাত্র রামকৃষ্ঞ বিশ্বাসের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হন। ১৯২৭ সালে বিপ্লবে দীক্ষা নিয়ে মাস্টারদা সূর্যসেনের গোপন বিপ্লবী দল যুগান্তরে যোগ দেন এই বিপ্লবী।১৮ এপ্রিল ১৯৩০ অস্ত্রগার লুঠ অভিযানে মাস্টারদার সাথে অংশ নেন। ২১ এপ্রিল ১৯৩০ জালালাবাদ যুদ্ধের সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
ব্যক্তিজীবনে তার স্ত্রী বিভা চৌধুরী বীর কন্যা প্রীতিলতার কর্মস্থল চট্টগ্রামের অপর্ণা চরণ গার্লস হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ২০০৯ সালে মারা যান। দুই ছেলে সুবীর চৌধুরী ও বিবেকানন্দ চৌধুরী। সুবীর চৌধুরী ৩০ বছর বয়সে কোলকাতায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। আরেক ছেলে বিবেকানন্দ কোলকাতায় এক ব্যাংকে চাকরী করেন।তার স্ত্রী উপালী চৌধুরী সহ চট্টগ্রামে এসেছেন বাবার জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাতে।বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর নাতি সোমশুভ্র চৌধুরী আর্কিটেক্ট ।কোলকাতার এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
অধ্যাপিকা ড. রীতা দত্ত বলেন , বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী তার একমাত্র পুত্র, নাতির মায়া এবং কোলকাতার নিশ্চিন্ত জীবনের হাতছানি ত্যাগ করে নিজ ভূমি চট্টগ্রামে থেকে গিয়ে এই বিপ্লবী যে দেশপ্রেম প্রদর্শন করেছেন তা যেন আমাদের নতুন প্রজন্ম অনুসরণ করে।
এই বিপ্লবীর পুত্র বিবেকানন্দ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, “আমার বাবার এদেশে থেকে যাওয়ার পেছনে একটি ইতিহাস আছে।তাই বাবাকে আমাদের কাছে নিতে কখনো জোর করিনি।দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের একটি শপথ ছিল যে যেখানে আছে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে থেকে যাওয়া।অনেক কমিউনিষ্টের জন্যেও এই শপথ রক্ষা সম্ভব হয়নি। এই যাওয়াটা অযৌক্তিক ও নয়।
আজীবন নির্লোভ নি:স্বার্থ এবং ত্যাগী এই বিপ্লবী ' স্বাধীনতা পদক 'এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া অনুদানের সব টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন এই বিপ্লবী। এর মধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটিকে তিন লাখ টাকা এবং অন্যান্য অনুদান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছেন মাস্টারদা সূর্যসেন স্মারক বক্তৃতার জন্যে। সেই অনুদান এখনো ছাত্রদের হাতে দেয়া হয়নি বলে হতাশা প্রকাশ করলেন মহান এই বিপ্লবী। #### সুমি খান/ ০৯/০১/১২

Monday, April 8, 2013

ইসলামের সব অনুষঙ্গেই মিথ্যা, কুফরী ও জঘন্য সমালোচলার জাল বিস্তার করেছে মওদুদী


মওদুদী
(কৈফিয়ত: আমি জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের ভাইদের কোনরুপ হেয় বা খাটো করার উদ্দেশে মাওলানা মওদুদীর উক্তিগুলো এখানে তুলে ধরিনি। আমি জানি, তারা এগুলো সম্পর্কে কমই জানেন অথবা তাদের জানতে দেওয়া হয়না। কেউ যদি জেনেও ফেলেন এবং বড়দের নিকট প্রকাশ করেন, তাদের এমন বোঝান হয় যে এগুলো সব শত্রুদের ষড়যন্ত্র। আবার এমনটিও বলা হয়- আমরা তো আর মাওলানা মওদুদীকে অনুসরন করিনা বা তার সব কথা মানিও না। কিন্তু একথা গ্রহনযোগ্য নয়, কারন জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের পাঠ্যসূচিতে মাওলানা মওদুদী লিখিত প্রায় সব পুস্তকই রয়েছে। উত্তম খাবারের সাথে যেমন সুক্ষ পরিমাণ বিষাক্ত খাবার গ্রহন করলে বাহ্যিকভাবে তার প্রভাব তেমন অনুভূত হয়না এবং ধীরে ধীরে ঐ বিষাক্ত খাবার সহনীয় হয়ে যায় তেমনি মাওলানা মওদুদীর ত্রুটিযুক্ত কথা ও কাজগুলোকেও জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের ভাইয়েরা একসময় তাদের আক্বীদায় পরিনত করেন। ‘তাফহীমুল কোরআন’কে আলেম সমাজ নিষিদ্ধের দাবী করায় বর্তমান সংস্করনগুলো থেকে কিছু আপত্তিকর কথা বাদ দেওয়া হয়েছে যদিও এতটুকুই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া মাওলানা মওদুদী জীবিত থাকাকালীন বা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অদ্যাবধি কোন ভুল স্বীকার করে তওবা করা হয়নি। তাই মুসলিম ভাইদের ঈমানের হেফাজতের জন্য এগুলো তুলে ধরা আমার জন্য অপরিহার্য ছিল।)

কুরআন শরীফের অনেক আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক প্রথমে ঈমান আনার কথা এবং পরে আমলের কথা বলেছেন। ইসলাম বিদ্বেষী কাফির-মুশরিকরা তাই মুসলমানদের ঈমানী চেতনায় বিভেদ তৈরীর জন্য সদা সক্রিয়। আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ করেনঃ

“তারা পূর্ব থেকেই বিভেদ সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানে ছিল এবং আপনার কার্যসমূহ উলট-পালট করে দিচ্ছিল।”
(সূরা তওবা ৪৮)
এক্ষেত্রে ইসলাম বিদ্বেষী কাফির-মুশরিকরা মূলতঃ মুসলমানদের থেকেই এজেন্ট তৈরী করে। যারা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসলামী আক্বীদার মধ্যে ফিৎনা তৈরী করে। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্‌সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শান ও মানের খেলাফসহ অসংখ্য কুফরী আক্বীদার বিস্তার করেছে সে।
এরপর পাক ভারত উপমহাদেশের এ ধারার অগ্রগামী হয়েছে তথাকথিত জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী। স্বয়ং আল্লাহ পাক, তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম, মোদ্দাকথা ইসলামের সব অনুষঙ্গেই মিথ্যা, কুফরী ও জঘন্য সমালোচলার জাল বিস্তার করেছে এই মওদুদী।

তার সেই অসংখ্য কুফরী আক্বীদার মাত্র ৫টি ক্ষুদ্র প্রমাণ নিম্নরূপঃ
১) আল্লাহ পাক সম্পর্কে কুফরী আক্বীদাঃ “যে ক্ষেত্রে নর-নারীর অবাধ মেলামেশা, সেক্ষেত্রে যেনার কারণে (আল্লাহ পাকের আদেশকৃত) রজম শাস্তি প্রয়োগ করা নিঃসন্দেহে জুলুম।” (নাঊযুবিল্লাহ)
(তাফহীমাত, ২য় খন্ড, ২৮১ পৃষ্ঠা)
২) ফেরেশতা সম্পর্কে কুফরী আক্বীদাঃ “ফেরেশতা প্রায় ঐ জিনিস যাকে গ্রীক, ভারত ইত্যাদি দেশের মুশরিকরা দেবী-দেবতা স্থির করেছে।” (নাঊযুবিল্লাহ) (তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দ্বীন, ১০ পৃষ্ঠা)
৩) আম্বিয়া আলাইহিমুছ ছালাত ওয়াস সালাম সম্পর্কে কুফরী আক্বীদাঃ “নবীগণ মা’ছূম নন। প্রত্যক নবী গুনাহ করেছেন।” (নাঊযুবিল্লাহ)(তাফহীমাত, ২য় খন্ড, ৪৩ পৃষ্ঠা)
৪) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুফরী আক্বীদাঃ “মহানবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না।”(নাঊযুবিল্লাহ)(তরজমানুস্‌ সুন্নাহ, ৩য় খন্ড, ৩০৫ পৃষ্ঠা)
৫) সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম সম্পর্কে কুফরী আক্বীদাঃ “সাহাবাদিগকে সত্যের মাপকাঠি জানবে না।” (নাঊযুবিল্লাহ)
(দস্তরে জামাতে ইসলামী, ৭ পৃষ্ঠা)
উল্লেখ্য, সব মুফতী-মাওলানাদের ইজমা তথা ঐক্যমতে উপরোক্ত আক্বীদাধারী ব্যক্তি মুসলমান নয় বরং মুরতাদ। আরো উল্লেখ্য যে, মওদুদী’র মৃত্যুর পর শিয়া সম্প্রদায়ের একটি মুখপত্রে বলা হয়েছিল, “মরহুম (মওদুদী) তার ভিন্ন আঙ্গিকে শিয়া মতবাদ প্রচলনেও সহায়তা করেছেন।”
(সাপ্তাহিক শিয়া, লাহোর, ১৯৭৯ ইং, ৫৭ সংখ্যা ৪০/৪১; খোমেনী ও মওদুদী দু’ভাই, পৃষ্ঠা ১২)
বিষাক্ত বীজ থেকে যেমন সুমিষ্ঠ ফল আশা করা যায় না তেমনি ইসলামী আন্দোলন ইত্যাদি মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও মওদুদী নিজেই যে কত বিষাক্ত বীজ ছিলো তা তার উপরোক্ত কুফরী আক্বীদা থেকেই সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়। তার উপরোক্ত আক্বীদাগুলো মুসলমানদের সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপই উন্মোচন করে। আর আল্লাহ পাক বিশ্বাসঘাতকদের সম্পর্কে পবিত্র কালামে ইরশাদ ফরমান,

“আল্লাহ পাক পছন্দ করেন না তাকে, যে বিশ্বাসঘাতক পাপী হয়।” (সূরা আন্‌ নিসা ১০৮)
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী যে কারনে আলেম সমাজের নিকট প্রত্যাখ্যাত হলেন নবী-রাসুলগণের প্রতি ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি :
নবী-রাসুলগণ সকলেই মাসুম, তারা সকলেই নিষ্পাপ-এই হলো ইসলামী আকীদা। তবে জনাব আবুল আলা মওদুদী ইসলামের বদ্ধমূল এ আকীদার উপর কুঠারাঘাত করে এবং কুরআন ও সুন্নাহর চিরন্তন শিক্ষাকে পদদলিত করে আম্বিয়ায়ে কেরামের এ পূত পবিত্র জামাতের প্রতি কলংক লেপন করার উদ্দেশ্যে এমন ধৃষ্টতাপূর্ন কথা বলেছেন, যা কোন মুসলমানের পক্ষে বরদাশত করা সম্ভব নয়।

প্রসিদ্ধ নবী দাউদ (আ.) সম্পর্কে:
“হযরত দাউদ (আ.) এর কাজের মধ্যে নফস ও আভ্যন্তরীন কুপ্রবৃত্তির কিছুটা দখল ছিল। অনুরুপভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথেও তার কিছুটা সম্পর্ক ছিল। আর তা ছিল এমন ধরনের কাজ, যা হক পন্থায় শাসনকারী কোন মানুষের পক্ষেই শোভা পায়না।” [তাফহিমুল কোরআন(উর্দু):৪র্থ খন্ড, সুরা সাদ, ৩২৭পৃ. ১ম সংস্করণ, অক্টোবর ১৯৬৬ইং]
“হযরত দাউদ (আ.)ত-কালীন যুগে ইসরাঈলী সোসাইটির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে এক বিবাহিতা যুবতীর উপর আসক্ত হয়ে তাকে বিবাহ করার জন্য তার স্বামীর নিকট তালাক দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন” [তাফহিমাত ২য় খন্ড: ৪২পৃ. ২য় সংস্করণ ; নির্বাচিত রচনাবলী(বাংলা) ২য় খন্ড, ৭৩ পৃ, আধুনিক প্রকাশনী, ১ম প্রকাশ ১৯৯১ইং]
হযরত নূহ (আ.) সম্পর্কে:
“হযরত নূহ (আ.) চিন্তাধারার দিক থেকে দ্বীনের চাহিদা হতে দূরে সরে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে জাহিলিয়াতের জযবা স্থান পেয়েছিল।” [তাফহিমুল কোরআন: ২য়খন্ড, ৩৪৪পৃ. ৩য় সংস্করণ, ১৯৬৪ ইং]


হযরত মুছা (আ.) সম্পর্কে:
“নবী হওয়ার পূর্বে মুছা(আ.) দ্বারা একটি বড় গুনাহ হয়েছিল। তিনি এক ব্যাক্তিকে কতল করেছিলেন।” [রাসায়েল ও মাসায়েল, ১ম খন্ড, ৩১ পৃ.]
“মুছা(আ.) এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ অধৈর্য্যশীল বিজয়ীর মত যে তার শাসন ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত না করেই মার্চ করে সম্মুখে চলে যায় আর পিছনে ফেলে যাওয়া এলাকায় বিদ্রোহের দাবানল দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে।” [তরজমানুল কোরআন ২৯/৪-৫]
হযরত ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে:
“এখানে আর একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন নক্ষত্র দেখে বলেছিলেন, এটা আমার প্রতিপালক এবং চন্দ্র-সূর্য দেখে এগুলোকেও নিজের প্রতিপালক হিসাবে অবহিত করেন, তখন সাময়িক ভাবে হলেও কি তিনি শিরকে নিপতিত হননি?” [তাফহিমুল কোরআন ১মখন্ড, ৫৫৮ পৃ.]
হযরত ইসা (আ.) সম্পর্কে:
“হযরত ইসা (আ.) মারা গেছেন একথাও বলা যাবেনা, বরং বুঝতে হবে ব্যাপারটি অস্পষ্ট।” [তাফহিমুল কোরআন ১মখন্ড(সুরা নিসা), ৪২১ পৃ.]
হযরত ইউসুফ (আ.) সম্পর্কে:
“হযরত ইউসুফ (আ.)- ‘আমাকে মিসরের রাজকোষের পরিচালক নিয়োগ করুন’- এ কথাটি বলে শুধু অর্থমন্ত্রী হওয়ার জন্যই প্রার্থনা করেননি। কারো কারো ধারনা, বরং তিনি এ বলে ডিকটিটরীই চেয়েছিলেন মৌলিকভাবে। এরই ফলশ্রুতিতে বর্তমান ইতালীর মুসোলিনির যে মর্যাদা তিনিও এর কাছাকাছি মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন।” [তাফহীমাত : ২য় খন্ড, ১২২ পৃ. ৫ম সংস্করন এবং নির্বাচিত রচনাবলী(বাংলা) ২য় খন্ড, ১৫১ পৃ, আধুনিক প্রকাশনী, ১ম সংস্করন ১৯৯১ইং]
হযরত ইউনুস (আ.) সম্পর্কে:
“হযরত ইউনুস (আ.) থেকে রিসালাতের দায়িত্ব আদায় করার ব্যাপারে কিছু দুর্বলতা হয়ে গিয়েছিল।সম্ভবত তিনি ধৈর্যহারা হয়ে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই আপন স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন।” [তাফহিমুল কোরআন: ২য়খন্ড, সূরা ইউনুস (টিকা দ্রষ্টব্য) ৩য় সংস্করণ, ১৯৬৪ ইং]
হযরহ আদম (আ.) সম্পর্কে:
“হযরহ আদম (আ.) মানবিক দূর্বলতায় আক্রান্ত ছিলেন। তিনি শয়তানী প্রলোভন হতে সৃষ্ট তরি- জযবায় আত্মভোলা হয়ে নিজ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেন। ফলে আনুগত্যের উচ্চ শিখর হতে নাফারমানীর অতল গহ্বরে গিয়ে পড়েন।” [তাফহিমুল কোরআন(উর্দু): ৩য়খন্ড, ১২৩ পৃ.]
হযরত মুহাম্মাদ (স.) সম্পর্কে:
“আল্লাহ তা’য়ালার নিকট কাতর কন্ঠে এই আবেদন করুন, যে কাজের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়েছিল, তা সম্পন্ন করার ব্যাপারে আপনার দ্বারা যে ভুল ত্রুটি হয়েছে কিম্বা তাতে যে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে তা যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।” [তাফহিমুল কোরআন (বাংলা) ১৯শ খন্ড, ২৮০পৃ. মুদ্রনে ওরিয়েন্টাল প্রেস, ঢাকা ১৯৮০ ইং; কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা(বাংলা) ১১২পৃ. ৮ম প্রকাশ, আধুনিক প্রকাশনী:জুন ২০০২]
“মহানবী (স.) মানবিক দূর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি মানবিক দূর্বলতার বশীভূত হয়ে গুনাহ করেছিলেন।” [তরজমানুল কোরআন ৮৫ তম সংখ্যা, ২৩০পৃ.]
“মহানবী (স.) নিজে মনগড়া কথা বলেছেন এবং নিজের কথায় নিজেই সন্দেহ পোষন করেছেন।” [তরজমানুল কোরআন, রবিউল আউয়াল সংখ্যা, ১৩৬৫ হিজরী]
নবী-রাসুলগণ সকলেই মাসুম, তারা সকলেই নিষ্পাপ-এই হলো ইসলামী আকীদা। তবে জনাব আবুল আলা মওদুদী ইসলামের বদ্ধমূল এ আকীদার উপর কুঠারাঘাত করে এবং কুরআন ও সুন্নাহর চিরন্তন শিক্ষাকে পদদলিত করে আম্বিয়ায়ে কেরামের এ পূত পবিত্র জামাতের প্রতি কলংক লেপন করার উদ্দেশ্যে এমন ধৃষ্টতাপূর্ন কথা বলেছেন, যা কোন মুসলমানের পক্ষে বরদাশত করা সম্ভব নয়।

সকল নবী-রাসুল সম্পর্কে:
“ইসমত বা নিষ্পাপ হওয়াটা মুলত: নবীদের প্রকৃতিগত গুণ নয়।এখানে একটি সুক্ষ বিষয় এই যে, আল্লাহ তা’য়ালা ইচ্ছা করেই প্রত্যেক নবীর উপর থেকে কোন না কোন সময় তার হেফাজত উঠিয়ে নেন এবং তাদেরকে দু’একটি গুনাহে লিপ্ত হতে দেন। যাতে করে মানুষ যেন খোদা বলে ধারনা না করে এবং জেনে রাখে এরাও মানুষ।” [তাফহীমাত : ২য় খন্ড, ৪র্থ সংস্করন ৫৬/৫৭ পৃ. এবং নির্বাচিত রচনাবলী(বাংলা) ২য় খন্ড, ৭৪ পৃ, আধুনিক প্রকাশনী, ১ম সংস্করন অক্টোবর ১৯৯১ইং]
“বস্তুত: নবীগণ মানুষ হয়ে থাকেন এবং কোন মানুষই মু’মিনের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাপকাঠিতে সর্বদা অটল থাকতে সক্ষম হতে পারেনা। প্রায়শ:ই মানভীয় নাজুক মুহুর্তে নবীর ন্যায় শ্রেষ্ঠ মানুষও কিছুক্ষনের জন্য মানবিক দুর্বলতার সামনে পরাভূত হয়ে যান।” [তাফহিমুল কোরআন ২য় খন্ড, ৩৪৩-৩৪৪ পৃ. সংস্করন ১৯৯০ইং]

“কোন কোন নবী দ্বীনের চাহিদার উপর স্থির থাকতে পারেন নি। বরং তারা আপন মানবীয় দুর্বলতার কাছে হার মেনেছেন।” [তরজমানুল কোরআন, ৩৫ তম সংখ্যা : ৩২৭ পৃ.]

” অন্যদের কথা তো স্বতন্ত্র, প্রায়শ:ই পয়গম্বরগণও তাদের কু-প্রবৃত্তির মারাত্মক আক্রমনের সম্মুখিন হয়েছেন।” [তাফহীমাত : ২য় খন্ড, ৫ম সংস্করন ১৯৫ পৃ. এবং নির্বাচিত রচনাবলী(বাংলা) ২য় খন্ড, ২৮ পৃ, আধুনিক প্রকাশনী, ১ম সংস্করন ১৯৯১ইং]

আসুন নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কিছু কথা জেনে নেই
১.মওদুদী সাহেব বলেছেন: “প্রত্যেক নবী গুনাহ করেছেন” (তাফহীমাত: ২য় খন্ড, পৃ:৪৩)
২. হযরত মুহাম্মদ (সা.) রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন, তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। (তাফহীমুল কুরআন, সুরায়ে নসর এর তাফসীর)
৩.সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি নন এমনকি অনুকরণ-অনুসরণের যোগ্যও নন।(দস্তুরে জামাতে ইসলামী, পৃ, ০৭)
৪.হযরত আবু বকর (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব পালনে সম্পুর্ণ অযোগ্য ছিলেন। (তাজদীদ ও ইয়াহইয়ায়ে দীন: ২২,)

৫.হযরত আলী (রা.) অন্যায় কাজ করেছেন (খেলাফত ও মুলুকিয়াত: ১৪৩)
*হযরত হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. বলেছেন মওদুদী জামাত পথভ্রষ্ট; তাদের আক্বীদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পরিপন্থী।

এই বইগুলো দেখুন-
১. ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) -জাস্টিস তাকী উসমানী (রশীদ কল্যান ট্রাস্ট)
২. মাওলানা মওদূদীর সাথে আমার সাহচার্যের ইতিবৃত্ত – মাওলানা মনজুর নোমানী (রহঃ) (ঐ)
৩. মওদূদী সাহেব ও ইসলাম -মুফতি রশীদ আহমাদ লুধীয়ানভী (রঃ) (দারুল উলুম লাইব্রেরী-৩৭,নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার)
৪. মওদূদীর চিন্তাধারা ও মওদূদী মতবাদ -ইজহারে হক ফাউন্ডেশান; প্রাপ্তিস্থানঃ (দারুল উলুম লাইব্রেরী-৩৭,নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার)
৫. ফিতনায়ে মওদুদীয়াত – মাওলানা যাকারিয়া (রহ.)
৬. ভুল সংশোধন -মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)
৭. সতর্কবাণী -মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)
৮. হক্ব বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব- আল্লামা আহমাদ শফী, হাটহাজারী।
৯. ঈমান ও আক্বীদা -ইসলামিক রিসার্স সেন্টার, বসুন্ধরা।
১০. ফতোয়ায়ে দারুল উলূম (আংশিক)
১১. ইসলামি আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ -মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন(১১/১, বাংলাবাজার, ঢাকা)
১২. আহসানুল ফতোয়া
যাদের সত্য যাচাইয়ের প্রয়োজন তারা ইচ্ছে করলেই তা করতে পারেন।
লক্ষ্য করুন এবং বিবেচনা করুন :—-
১. মুজাদ্দিদ ও ইমাম মাহদী হওয়ার দাবি মিস্টার মওদুদীর
মিস্টার মওদুদীর বক্তব্য শুনে নদভী সাহেব মিস্টার মওদুদীকে সম্বোধন করে পুনঃ লিখলেন, ‘আপনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যে জাওয়াব দিয়েছেন, তাতে একথা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, আপনি মুজাদ্দিদে কামিল বা ইমাম মাহদী হওয়ার দাবিকে অস্বীকার করেন না।’ (ইজাহে ফতওয়া, ৮৪ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদীর অভিপ্রায় ছিলো, দুর্ভাগ্যবশত মুজাদ্দিদরূপে নিজেকে জাহির করার সুযোগ না পেলেও পরবর্তীকালে তার রেখে যাওয়া জামাতে ইসলামীর পালিত শিষ্যগণ তার মুজাদ্দিদরূপে জাহির হওয়ার স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করবেন। তাই তো দেখতে পেলাম, মিস্টার মওদুদীর ইন্তেকালের পরপরই জামাতের গোপন নেতা মাও. দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এক সভায় মিস্টার মওদুদীকে মুজাদ্দিদ বলে ঘোষণা দিয়ে ফেললেন। তার বক্তৃতার ক্যাসেট এখনও আমাদের নিকট বিদ্যমান।
মিস্টার মওদুদী শুধু মুজাদ্দিদ ও ইমাম মাহদী হিসেবে জাহির হওয়ার স্বপ্নই দেখেনি, বরং একজন খোদমোখতার বা স্বয়ংসম্পন্ন মুজতাহিদ হওয়ারও আকাঙ্খা করেছিলো। এদিকেই ইঙ্গিত দিয়ে সে বললো, ‘পূর্ববর্তী মুজতাহিদগণের কার্যবলীতে যে এজতেহাদী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, বর্তমান যুগে সে শক্তি যথেষ্ট নয়। বরং বর্তমানে তাজদীদী খেদমত আঞ্জাম দেয়ার জন্য এক নতুন এজতেহাদী শক্তির প্রয়োজন। তাই বর্তমান পরিসি’তিতে এমন এক স্বয়ংসম্পন্ন মুজতাহেদের প্রয়োজন, যিনি পূর্ববর্তী মুজতাহিদগণের ইলম ও পথের অনুসারী হবেন না। যদিও ফায়দা অন্বেষণ তিনি প্রত্যেকের থেকেই করবেন। (তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দ্বীন)
২. ইসলামী চাল-চলন সম্পর্কে মিস্টার মওদুদীর বক্তব্য
ইসলাম ধর্ম বলে, ইসলামী পোশাক-পরিচ্ছদ-প্রকৃতি চাল-চলন ইত্যাদি গ্রহণ করবে। এসব ব্যাপারে বিধর্মীদের অনুকরণ করবে না। (এমদাদুল মুফতিয়ীন, ২য় খণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, পোশাক পরিচ্ছদ, চাল-চলন, আকৃতি-প্রকৃতি চুল কার্টিং ইত্যাদির ব্যাপারে বিধর্মীদের অনুকরণ করাতে দোষ নেই। (নাঊযুবিল্লাহ) (তরজুমানুল কুরআন, ছফর সংখ্যা, ১৩৬৯ হিজরী)
৩. দাড়ি রাখা সম্পর্কে মিস্টার মওদুদীর বক্তব্য
ইসলাম ধর্ম বলে, এক মুষ্টি পরিমাণ দাড়ি রাখা ওয়াজিব। কেটে ছেঁটে এর কম করা হারাম। (বুখারী শরীফ, ৭৫ পৃষ্ঠা, মুসলিম শরীফ, ১২৯ পৃষ্ঠা, আবু দাউদ শরীফ ২২১ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, দাড়ি কাটা ছাঁটা জায়িয। কেটে ছেঁটে এক মুষ্টির কম হলেও ক্ষতি নেই। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পরিমাণ দাড়ি রেখেছেন সে পরিমাণ দাড়ি রাখাকে সুন্নত বলা এবং এর অনুসরণে জোর দেয়া আমার মতে মারাত্মক অন্যায়। (নাউযুবিল্লাহ) (রাছায়েল মাছায়েল, ১ম খণ্ড, ২৪৭ পৃষ্ঠা)
৪. সুন্নত সম্পর্কে মিস্টার মওদুদীর বক্তব্য
ইসলাম ধর্ম বলে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদত, আখলাক ও স্বভাব-চরিত্র আমাদের অনুকরণের জন্য উত্তম নমুনা বা সুন্নত। (বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, ১০৮৪)
মিস্টার মওদুদী বলে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদত, আখলাককে সুন্নত বলা এবং তা অনুসরণে জোর দেয়া আমার মতে সাংঘাতিক ধরনের বিদয়াত ও মারাত্মক ধর্ম বিগড়ন। (নাউযুবিল্লাহ) (রাছায়েল মাছায়েল, ২৪৮ পৃষ্ঠা)
৫.সিনেমা সম্পর্কে মওদুদীর বক্তব্য
ইসলাম ধর্ম বলে, সিনেমা দেখা নাজায়িয ও হারাম। (কিফায়াতুল মুফতিয়ীন, ২য় খণ্ড, ১৭৬ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, প্রকৃতরূপে সিনেমা দেখা জায়িয। (নাঊযুবিল্লাহ) (রাছায়েল মাছায়েল, ২য় খণ্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা)
৬. নামায, রোযা ইত্যাদি সম্পর্কে মিস্টার মওদুদীর বক্তব্য
ইসলাম ধর্ম বলে, দ্বীনের আসল মকছুদ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি কায়েম করা। ইসলামী হুকমত উক্ত মকছুদ অর্জনে সহায়ক। (শরহুল আকায়েদ, ৩০৪ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, দ্বীনের আসল মকছুদ ইসলামী হুকুমত। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি সমস্ত ইবাদতই উক্ত মকছুদ অর্জনের মাধ্যম। (নাঊযুবিল্লাহ) (আকাবেরে উম্মত কী নজরমে, ৬৪ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদীর উপরোক্ত মন্তব্যের ফল এই দাঁড়ায় যে, ইসলামী হুকুমত অর্জিত হলে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদতের কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু মকছুদ অর্জিত হলে মাধ্যমের আর প্রয়োজন থাকে না। (নাঊযুবিল্লাহ)

৭.যাকাত সম্পর্কে মওদুদীর বক্তব্য-
ইসলাম ধর্ম বলে, যাকাত আদায়ের জন্য তামলীকে ফকীর (দরিদ্রকে মালিক বানানো) জরুরী। (মাকছুত, ২য় খণ্ড, ২০২ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, যাকাত আদায়ের জন্য তামলীকে ফকীর জরুরী নয়। (নাঊযুবিল্লাহ) (তরজুমানুল কুরআন, যিলহজ্জ সংখ্যা, ১৩৭৫ হিজরী)
৮. যাকাতের টাকা সম্পর্কে মিস্টার মওদুদীর বক্তব্য
ইসলাম ধর্ম বলে, মসজিদ, কূপ, পুকুর ইত্যাদি প্রভৃতির নির্মাণ কার্যে যাকাতের টাকা ব্যবহার করা জায়িয নেই। (কিফায়াতুল মুফতী, ৪র্থ খণ্ড, ২৮১ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, মসজিদ, কূপ, পুকুর প্রভৃতির নির্মাণ কার্যে যাকাতের টাকা ব্যবহার করা জায়িয। (নাঊযুবিল্লাহ) (তরজুমানুল কুরআন, যিলহজ্জ সংখ্যা, ১৩৭৫ সংখ্যা)

৯.যাকাতের মাল হতে আপন ভাতা গ্রহণ সম্পর্কে মিস্টার মওদুদীর বক্তব্যইসলাম ধর্ম বলে, ইসলামী হুকুমতের পক্ষ হতে ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায়ের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তিই কেবল যাকাতের মাল হতে আপন ভাতা পাওয়া যোগ্য। (আহছানুল ফতওয়া, ৪র্থ খণ্ড, ২৮৫ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, ইসলামী হুকুমতের নির্ধারণ ছাড়াই যদি কোন ব্যক্তি, দল বা জামায়াত যাকাত আদায়, গণনা ও বণ্টনের জন্য দাঁড়ায় তবে সেও আপন ভাতা যাকাতের মাল হতে গ্রহণ করতে পারবে। (নাঊযুবিল্লাহ) (রাছায়েল মাছায়েল, ২য় খণ্ড, ২৪২ পৃষ্ঠা)
১০.সাহরী সম্পর্কে মিস্টার মওদুদীর বক্তব্য
ইসলাম ধর্ম বলে, সাহরীর শেষ সীমা সুবহে সাদিক। সুবহে সাদিক হওয়ার পর পানাহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (তিরমিযী শরীফ, ১২৫ পৃষ্ঠা)
মিস্টার মওদুদী বলে, সাহরীর জন্য এমন কোন শেষ সীমা নির্দিষ্ট নেই, যার কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট এদিক ওদিক হলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (নাঊযুবিল্লাহ) (তাফহীমুল কুরআন, ১ম খন্ড, ১৪৬ পৃষ্ঠা)
মুখে এক আর অন্তরে আরেক। ইসলামের পরিভাষায় এদের বলা হয় মুনাফিক। মুনাফিক যে কারণে দো-দেল বা দো-যবান হয় তার পিছনে মূল কাজ করে স্বার্থগত প্রবণতা তথা দুনিয়ার লিপ্সা। এ লিপ্সা হতে পারে প্রভাব প্রতিপত্তির, হতে পারে অর্থের, হতে পারে রাজনৈতিক ক্ষমতার। সারা জীবন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলে, নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বলে, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া শিরক বলে আজ নিজামী-সাঈদী গং সেসব কাজই সমর্থন করছে। পাশাপাশি মদের দাম কমানোসহ মদের কারখানার অনুমতি দিলেও বা আমেরিকা-আফগানিস্তানসহ ইরাক আক্রমণ করলেও সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা পালন করে গেছে, ইসলামের নাম ভাঙিয়ে আকাশ ফাটানো শ্লোগানধারী বর্ণচোরা ঐ মহলটি। তবে যে কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বর্ণচোরা ঐ মহলটি জন্মগতভাবেই পেয়েছে গিরগিটির ন্যায় ঘন ঘন রং বদলানোর প্রবণতা তথা মুনাফিকী খাছলত।
হাদীছ শরীফ-এ মুনাফিকদের চারটি খাছলত বর্ণনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে দু’টি হলো- ১. কথা বললে মিথ্যা বলা, ২. ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করা।
হাদীছ শরীফ-এর এ ভাষ্য অনুযায়ী তথাকথিত জামাতে ইসলামীর জন্মদাতা মওদুদী কোন্ পর্যায়ের মুনাফিকরূপে সাব্যস্ত হন তা বিচারের জন্য পাঠকের নিকট নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে মওদুদীর পরস্পর বিরোধী মন্তব্য ও বক্তব্য (প্রথম পর্যায়ে ইসলামী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার প্রচেষ্টায় নারী নেতৃত্বের বিপক্ষে এবং পরবর্তিতে তথাকথিত ইসলামী দলের ভিত্তিতে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পাবার লোভে নারী নেতৃত্ব সমর্থনের পক্ষে) যা চরম নির্লজ্জতার, বেহায়াপনার ও নগ্ন স্বার্থবাদিতার জ্বলন্ত প্রমাণ এখানে পেশ করা গেলো-

নারী ও আইন পরিষদঃ
মাওলানা মওদুদী মাসিক তরজুমানুল কোরআন ১৯৫২ সালে আগস্ট সংখ্যায় পাকিস্তানের জন্য কতিপয় সাংবিধানিক প্রস্তাব পেশ করে। উক্ত প্রস্তাবগুলোর বিরুদ্ধে কোন কোন মহল থেকে যে সব অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তার উত্তর সে তরজুমানুল কোরআনের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রদান করে। তন্মধ্যে একটি অভিযোগ ছিল, ‘কোন নারীর আইন পরিষদ সদস্য হওয়া উচিত নয়’ তার এই প্রস্তাবের উপর। এর উত্তরে মাওলানা মওদুদী যা কিছু লিখেছে, তা মাসিক আল ফুরকানেও ১৯৫২ সালে লিপিবদ্ধ হয়। যার বিবরণ নিম্নরূপ:
প্রথম পর্যায় (যখন মাওঃ মওদুদীর ইসলামী দলের প্রতিষ্ঠা পাবার পথে প্রচেষ্ট)
একটি অভিযোগ আমার এই প্রস্তাবের উপর উত্থাপন করা হয় যে, “কোন নারীর আইন পরিষদ সদস্যা হওয়া উচিত নয়।” এ প্রসঙ্গে আমার নিকট প্রশ্ন করা হয় যে, সেটা কোন্ ইসলামী নীতি, যেটা নারীদেরকে সদস্যা হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে?
কুরআন-হাদীছের সেই নির্দেশ কোনটি, যেটা আইন পরিষদের সদস্যপদ পুরুষদের জন্যই রিজার্ভ বলে সাব্যস্ত করে? উক্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের আগে, এটা জরুরী মনে করি, যে আইন পরিষদের সদস্য পদের জন্য নারীদের নিয়ে আলোচনা চলছে, তার সঠিক ধরন ও স্বরূপ পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা।
উক্ত পরিষদসমূহের নাম ‘আইন পরিষদ’ রাখার কারণে এ ভুল ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে যে, উক্ত পরিষদসমূহের কাজ কেবল আইন তৈরি করা। এ ভুল ধারণা পোষণ করে মানুষ যখন দেখতে পায় যে, ছাহাবায়ে কেরামের যুগে মুসলিম নারীগণও আইন-বিষয়ক মাসয়ালার আলাপ-আলোচনা, গবেষণা, মত প্রকাশ সবকিছু করতেন এবং অনেক সময় স্বয়ং ‘খলীফা’ তাঁদের মতামত জেনে নিয়ে সে অনুসারে কাজও করতেন তখন তারা আশ্চর্যান্বিত হয় যে, বর্তমানে ইসলামী নীতিমালার নাম নিয়ে এ ধরনের ‘পরিষদে’ নারীদের অংশগ্রহণকে কিভাবে গলদ বলা যেতে পারে। কিন্তু, আসল ঘটনা হলো এই যে, বর্তমান যুগে যে সব পরিষদ উক্ত নামে আখ্যায়িত হয়, সেসবের কাজ কেবল আইন তৈরি করা নয়।
বরং বাস্তব ক্ষেত্রে উক্ত পরিষদই সমগ্র দেশের প্রশাসন ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে, মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে দেয়, আইন- শৃঙ্খলার যাবতীয় নীতি নির্ধারণ করে, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়াদি নির্ধারণ করে এবং যুদ্ধ, শান্তি ও চুক্তি সন্ধি সবকিছুর চাবিকাঠি তারই হাতে থাকে।
এ হিসেবে উক্ত পরিষদের স্থান কেবল একজন আইনজ্ঞ ও মুফতির স্থান বিশেষ নয়, বরং সমগ্র দেশের নেতৃত্বেরই বিশেষ স্থান। কোরআন মানুষের জীবনে এ বিশেষ স্থান ও দায়িত্ব কাকে দিয়ে থাকে এবং কাকে দেয়না, তা একবার পাঠ করে দেখুন।
মহান আল্লাহ পাক ‘সূরা নিসা’-এর ৩৪ নম্বর আয়াত শরীফ-এ বলেন,
“পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল। এজন্য যে, আল্লাহ পাক একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেক্কার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ পাক যা রক্ষণীয় করেছেন, লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হিফাযত করে।”
মহান আল্লাহ পাক উক্ত আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় ‘কওয়ামিয়্যাত’ বা ‘কর্তৃত্বের’ গুরু দায়িত্ব ও জিম্মাদারী পুরুষকেই প্রদান করেছেন এবং নেক্কার নারীদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের বিষয় বর্ণনা করেছেন,
১. তারা যেন আনুগত্যপরায়ণা হয় এবং
২. পুরুষদের অনুপসি’তে সে সব বস্তুকে হিফাযত করে যেগুলোকে মহান আল্লাহ পাক হিফাযত করতে চান।
আপনি হয়তো বলবেন যে, এটা তো পারিবারিক জীবনের জন্য বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন প্রসঙ্গে তো বলা হয়নি। কিন্তু, এখানে জেনে রাখা দরকার যে,
প্রথমতঃ ‘পুরুষগণ নারীদের সরদার বা নেতা’ এটা সাধারণ ভাবে বলা হয়েছে। ‘ফিলবুয়ুত’ বা ‘গৃহভ্যন্তরে’ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তাই এ হুকুমকে কেবল পারিবারিক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায়না।
দ্বিতীয়তঃ আপনার একথা যদি মেনেও নেয়া যায়, তবু আমি (মওদুদী) জিজ্ঞেস করছি, যাকে পরিবার বা গৃহে নেতৃত্বের স্থান বা জিম্মাদারী প্রদান করা হয়নি বরং অধীনস্থ (অনুগতা)-এর স্থানে রাখা হয়েছে, আপনি তাকে সমস্ত গৃহের একত্রিত রূপ অর্থাৎ সমগ্র রাষ্ট্রে অধীনস্থতার পর্যায় থেকে তুলে নিয়ে নেতৃত্বের স্থানে নিয়ে যেতে চান? গৃহের নেতৃত্বের চেয়ে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব তো অনেক বড় এবং উচ্চ পর্যায়ের জিম্মাদারী। এখন আল্লাহ পাক সম্পর্কে আপনার কি এই ধারণা যে, তিনি নারীকে তো একটি গৃহের নেতা বা সরদার করছেন না, কিন্তু লাখ লাখ ঘরের একত্রিত রূপ রাষ্ট্রের তাকে নেতা করবেন?
পবিত্র কোরআন পরিষ্কার ভাষায় নারীদের কর্মপরিধি নির্ধারিত করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
“তোমরা গৃহভ্যন্তরে অবস্থান করবে, মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদের প্রদর্শন করবে না।” (সূরা আহযাব- ৪)
তারপর আপনি বলবেন যে, এ আদেশ তো নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মানিত নারীদেরকেই দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমার (মওদুদী) প্রশ্ন হলো যে, আপনার পবিত্র ধারণায় নবী পরিবারের নারীদের মধ্যে কী কোন বিশেষ দোষত্রুটি ছিল, যার কারণে পরিবারের বাইরে কোন দায়িত্ব পালনে তাঁরা অযোগ্য ছিলেন? এদিক দিয়ে অন্যান্য নারীরা কি তাঁদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলো? কুরআনের এ পর্যায়ের যাবতীয় আয়াত যদি কেবল নবী পরিবারের জন্যই অবতীর্ণ হয়, তবে কি অন্যান্য মুসলিম নারীদের ‘তাবাররুজে জাহেলীয়্যাত’ বা জাহেলীয়্যাত যুগের সাজে বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে? তাদের জন্য কি বেগানা পুরুষদের সাথে এমন ভাবে কথা বলার অনুমতি রয়েছে, যাতে তাদের অন্তরে লোভ লালসার সৃষ্টি হয়? মহান আল্লাহ পাক কী নবী পরিবার ব্যতীত অন্যান্য মুসলিম পরিবারকে ‘রিজস’ বা ‘অপবিত্রতা’ লিপ্তাবস্থায় দেখতে চান?
এবার আসুন হাদীছের দিকে।
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“যখন তোমাদের ধনী শ্রেণী কৃপণ হবে, যখন তোমাদের যাবতীয় কাজে কর্তৃত্ব তোমাদের নারীদের হাতে চলে যাবে, তখন তোমাদের জন্য পৃথিবীর উপরিভাগের চেয়ে অভ্যন্তর ভাগ অধিক কল্যাণকর হবে।” (তিরমিযী)
“হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। যখন নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এ সংবাদ পৌঁছলো যে, (ইরানী) পারস্যের জনগণ কিসরার কন্যাকে (মেয়ে) তাদের বাদশাহ মনোনীত করেছে, তখন তিনি বললেন, সে জাতি কখনো সাফল্য অর্জন করতে পারে না, যে জাতি স্বীয় কাজকর্মের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বভার একজন নারীর হাতে সোপর্দ করে।” (বুখারী ও তিরমিযী)
উপরোক্ত হাদীছ দু’টি মহান আল্লাহ পাক-এর বাণী ‘পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’- এর প্রকৃত ব্যাখ্যা বর্ণনা করে। এর দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা নারী জাতির কর্ম পরিধির বহির্ভূত বিষয়। একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকে যায়, তাহলো নারীদের কর্মপরিধি কি? এ প্রশ্নের উত্তরে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ হাদীছ শরীফটি পরিষ্কার ব্যক্ত করে যে,
“…. এবং নারী তার স্বামীর গৃহ এবং তার সন্তানদের হিফাযতকারিনী। তাদের সম্পর্কে সে জিজ্ঞাসিত হবে।” (আবূ দাউদ)

পবিত্র কুরআন শরীফ-এর বাণী ‘এবং তোমরা তোমাদের গৃহসমূহেই অবস্থান করবে’ এর সঠিক ব্যাখ্যা এটাই যা উল্লিখিত হাদীছ শরীফ দ্বারা বুঝা গেলো। এর অতিরিক্ত ব্যাখ্যায় রয়েছে সে সব হাদীছ, যেগুলোতে নারীদেরকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কাজ গৃহবহির্ভূত ফরয ও ওয়াজিব থেকেও নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে।
‘জুমুয়ার নামায জামায়াতের সাথে আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানদের অধিকার ও দায়িত্ব। কিন্তু, চার ব্যক্তি ব্যতীত: গোলাম, নারী, ছেলে-মেয়ে ও অসুস্থ ব্যক্তি।”(আবু দাউদ)

“হযরত উম্মে আতীয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদেরকে জানাযার সাথে চলতে নিষেধ করা হয়েছে।” (বুখারী)

“যদিও আমাদের মত ও দৃষ্টিভঙ্গীর পক্ষে আমাদের নিকট শক্তিশালী যৌক্তিক প্রমাণাদিও রয়েছে এবং কেউ চ্যালেঞ্জ করলে সেগুলো পেশও করতে পারে, কিন্তু প্রথমতঃ এ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়নি। দ্বিতীয়তঃ আমরা কোন মুসলমানের এ হক বা অধিকার স্বীকারও করি না যে, সে আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুস্পষ্ট আহকাম শুনার পর সেমতে আমল করার আগে এবং আমল করার জন্য শর্ত হিসেবে যুক্তি সংক্রান্ত প্রমাণাদির দাবি করবে।
কোন মুসলমান যদি সত্যিকার অর্থে সে মুসলমান হয়, তবে প্রথমে হুকুম মোতাবেক আমল করা তার দরকার এবং পরে স্বীয় মনমস্তিষ্ককে আশ্বস্ত করার জন্য যুক্তিপ্রমাণ তালাশ করতে পারে। কিন্তু সে যদি বলে, আমাকে আগে যুক্তি প্রমাণ দিয়ে মানসিকভাবে আশ্বস্ত করো, অন্যথায় আমি আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হুকুম মানবো না, তা হলে আমি তাকে মুসলমান বলেও গণ্য করবো না। তাকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান তৈরির অধিকারী হিসেবে গণ্য করা তো অনেক দূরের কথা। শরীয়তের হুকুম মতে আমল করার জন্য যে ব্যক্তি যুক্তি প্রমাণ তলব করে, তার স্থান ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত, অন্তর্ভুক্ত নয়।”

(সূত্রঃ মাওঃ মওদুদীর সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত। লেখকঃ মনজুর নোমানী)
উল্লেখ্য মাওলানা মওদুদী এ প্রবন্ধে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত করেছে যে, ইসলাম এবং ইসলামী শরীয়তে কোন নারীর জন্য আইন-পরিষদের সদস্য হওয়ার অবকাশ নেই, আর এটা ইজতেহাদী (তথা অনুমানভিত্তিক) মাসয়ালাও নয়, বরং এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুস্পষ্ট বিধান ও নির্দেশাবলী রয়েছে এবং কোন মুসলমান (সত্যিকার) মুসলমান হওয়ার জন্য এটা শর্ত যে, এ হুকুমকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া। কিন্তু এর মাত্র কয়েক বছর পর মওদুদী এক চিঠিতে যা লিখে,
মওদুদীর পরবর্তী বক্তব্য (তথাকথিত ইসলামী দলের ভিত্তিতে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পাবার লোভে নারী নেতৃত্ব সমর্থনের পক্ষে)

পত্র নং- ৮৯
শ্রদ্ধেয়,

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আপনার পত্র পেয়েছি। আমাদের মত যুলুম ও স্বৈরাচারী নীতির প্রচলন থাকা মস্তবড় গুনাহ। এর পরিবর্তনের জন্য একজন মহিলার নেতৃত্ব গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় যদি না থাকে তবে তা হবে একটি বড় বিপদকে দূর করার জন্য ছোট বিপদের সাহায্য গ্রহণ করা, যার অনুমোদন শরীয়াতে আছে। (নাঊযুবিল্লাহ)

খাকসার আবুল আলা
প্রাপক, আব্দুল হাই সাহেব, সুলতানপুর, আজমগড়, ইন্ডিয়া।
মন্তব্য: এ চিঠিতে সে বলেছে যে স্বৈরাচার পরিবর্তনের জন্য একজন মহিলার নেতৃত্ব গ্রহন ছাড়া আর কোন উপায় যদি না থাকে তবে নারী নেতৃত্ব গ্রহণের অনুমোদন শরীয়তে আছে। অথচ ১৯৫২ সালের ‘মাসিক তরজুমানুল কোরআন’ ও ‘মাসিক আল ফুরকান’ পত্রিকায় সেই লিখেছে নারী নেতৃত্ব কোন ইজতিহাদী মাসয়ালা নয়। অর্থাৎ কোন মাওলানা, কোন শাইখুল হাদীছ, কোন খতীব, কোন মুফাস্সিরে কুরআন, কোন মুফতির কিয়াস, পর্যালোচনা মতামত বা অভিমত খাটানো এখানে চলবে না। বড় খারাপ মোকাবিলায় ছোট খারাপ গ্রহণ এ জাতীয় কথা এখানে বলা চলবে না।
মওদুদীর ভাষায়: “শরীয়তের হুকুম মতে আমল করার জন্য যে ব্যক্তি যুক্তি প্রমাণ তলব করে তার স্থান ইসলাম গণ্ডীবহির্ভূত; অন্তর্ভুক্ত নয়।” অর্থাৎ মাওঃ মওদুদীর ফতওয়া অনুযায়ীই সে ইসলামের গণ্ডীবহির্ভূত। অন্তর্ভুক্ত বা মুসলমান সে নয়। বরং হাদীছ শরীফ-এর বিচারে স্পষ্ট মুনাফিকই তাকে বলা যায়।
এখানে উল্লেখ্য, ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য মিত্রোথি আর্কাইভ’ নামক বইয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “ধর্মীয় দল জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদী ছিলেন সি.আই.এ’র এজেন্ট।
ফিরআউনের কাহিনীও মওদুদীর প্রতি প্রযোজ্য হয়। একবার মানুষের ছুরতে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এসে ফিরআউনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন মনিব যদি কোনো গোলামকে তার প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি দেয় পরবর্তিতে সে গোলাম যদি উক্ত মনিবের বিরোধিতা করে তাহলে তার কি শাস্তি হওয়া উচিত? জবাবে ফিরআউন তখন দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছিল তাকে লোহিত সাগরের পানিতে চুবিয়ে মারা উচিত। আল্লাহ পাক আপন কুদরতে ফিরআউনের মুখেই তার শাস্তির কথা উল্লেখ করিয়েছিলেন। তদ্রুপ তথাকথিত ইসলামী জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর হাক্বীকত কী তা কুদরতময় আল্লাহ পাক তার হাত দিয়েই লিখিয়েছেন। এর প্রমাণ স্বরূপ নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে মওদুদীর আরো চিঠির উল্লেখ করা যায়। যেমন মওদুদী বলে:
পত্র- ৮৭, ২১শে নভেম্বর, ‘৬৪
শ্রদ্ধেয়,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আপনার চিঠি পেয়েছি। আল্লার যমীনে আল্লার আইন প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমাদের পথ থেকে বর্তমান একনায়কত্ব হটানো ছাড়া এ উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে না। এ সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সহায়তা করা ছাড়া একনায়কত্ব হটানোর আর অন্য কোনা বাস্তব পন্থা নেই। এ সময়ে যদি তৃতীয় একজন প্রার্থীকে প্রেসিডেন্টের জন্যে দাঁড় করানো হয় তবে এটা প্রকৃতপক্ষে আইয়ুব খানকে একনায়কত্বে প্রতিষ্ঠিত রাখারই প্রচেষ্টা হবে।
খাকসার আবুল আলা
প্রাপক কাযী নাসীর আহমদ সাহেব নারুওয়াল।
পত্র- ৮৮, ২১শে নভেম্বর- ‘৬৪
শ্রদ্ধেয়,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনার পেশকৃত প্রস্তাব শরীয়াতের দৃষ্টিতে ঠিক নয়। আমরা অবৈধ পন্থায় জয়কে পরাজয় এবং বৈধ উপায়ের পরাজয়কে জয় মনে করে থাকি। জাল ভোট গ্রহণ করা অথবা টাকা দিয়ে ভোট কেনা এ দেশের জন্যে এমন ধ্বংসাত্মক যেমন ক্ষতিকর একনায়কত্ব। এ পন্থায় যারা নির্বাচনে জয়লাভ করবে তাদের দ্বারা কোনো সংস্কার ও কল্যাণধর্মী কাজ হতে পারে না।

খাকসার, আবুল আলা
প্রাপক, আবু নোমান, শিয়ালকোট।
(সূত্র: মওদুদীর পত্রাবলী: আধুনিক প্রকাশনী)
মন্তব্য: ৮৮ নং চিঠিতে মওদুদী মন্তব্য করেছে আমরা অবৈধ পন্থায় জয়কে পরাজয় এবং বৈধ উপায়ের পরাজয়কে জয় মনে করে থাকি। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে ৮৭ নং প্রশ্নে উল্লিখিত “এ সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সহায়তা করা ছাড়া একনায়কত্ব হটানোর আর অন্য কোন বাস্তব পন্থা নেই।” এই বক্তব্যও পরাজয়েরই পথ।
কারণ মওদুদী নিজেই স্বীকার করেছে নারী নেতৃত্ব হারাম এটা কুরআন-সুন্নাহর দ্বারা সরাসরি ছাবেত। এর মধ্যে মানুষের ইজতিহাদ করার কিছু নেই। এটা স্পষ্ট হারাম। যে হালাল বলবে সে মুসলমানই থাকবে না। তাহলে সে হারাম পথে যদি বিজয় আসেও সে হারাম পথে আইয়ুব খান তথা একনায়কতন্ত্রকে যদি ঠেকানো যেতো তাহলেও মওদুদীর ভাষ্যানুযায়ী তা হত পরাজয়। কারণ তা হারাম পথে তথা অবৈধ পন্থায়।
আর মওদুদী নিজেও স্বীকার করেছে আমরা অবৈধ পন্থায় জয়কে পরাজয় এবং বৈধ উপায়ের পরাজয়কে জয় মনে করে থাকি। কিন্তু কার্যত মওদুদী সেই হারাম পথেই গিয়েছে এবং তার কথিত পরাজয়ের পথেই তার কবর রচিত হয়েছে এবং তার প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত জামাতে ইসলামী অদ্যাবধি সে পরাজয়ের পথে তথা হারাম পথেই রয়েছে। যা তাদের স্বীকারোক্তিতেও বিদ্যমান।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত এসোসিয়েশন অফ মাওলানা সাঈদী সাপোর্টাস- এর বিশেষ বুলেটিন ‘মূলধারার’ সাথে সাক্ষাৎকারে সাঈদী যা বলেছে,

প্রশ: আপনে সর্বদা নারী নেতৃত্ব বিরোধী বক্তব্য দিয়ে থাকেন? অথচ ৯১ এর নির্বাচনের পর নারী নেতৃত্বকে সমর্থন দিলেন কেন?

উত্তর: আমরা নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অতীতেও বক্তব্য রেখেছি। এখনো আমরা সে অবস্থান থেকে সরে যাইনি। জনগণকে সবসময়ই বুঝাচ্ছি ইসলামে নারী নেতৃত্ব স্বীকৃত নয়। নারী নেতৃত্বকে আমরা সমর্থন দেইনি।
কিন্তু পাঠক! ৯১-এ বি.এন.পির সাথে আঁতাত এবং বর্তমান জোট নেত্রীর সক্রিয় অনুসরণ-অনুকরণ তথা একাত্মতা দ্বারা সাঈদীর উপরোক্ত কথার সত্যতা কত চরম মিথ্যা তা উপলব্ধি করার ক্ষমতাও বোধ হয় সুস্থ মানুষের নেই। মূলত এহেন চশমখোর গোষ্ঠীর পক্ষেই সম্ভব ৭১-এর মত রাজাকারগিরি করা, নারী-ধর্ষণ হত্যা ও লুটতরাজের মহোৎসব করা। কারণ আসলে তো এরা ইসলাম করে না। করে ইসলামের লেবেল এঁটে স্বার্থের রাজনীতি। স্বার্থের জন্যই আজ নারী নেতৃত হারাম বলে কাল হালাল বলে।
আর এরূপ স্বার্থবাদী রাজনীতি করে বলেই দে. হো সাঈদী নিউইয়র্ক থেকে ‘৯০ সালে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক ঠিকানায়’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছে
প্রশ্ন: গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পর আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে আপনি কি বলেন?
সাঈদী (মুচকি হেসে): রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা শেষ কথা বলে কিছু নেই। (অর্থাৎ ইসলামকে এরা রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করে ইসলাম হিসেবে মানে না এবং এরা অন্যান্য দুনিয়াবী রাজনীতিবিদদের মতই) বাস্তবেও তাই হয়েছে। বেশি ক্ষমতা পাওয়ার জন্য ৯৯-এ বিএনপির সাথে আঁতাত করেছে। তাদের নিজামী বলেছে ইসলাম কায়েমের জন্য নয় বরং আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য তারা নির্বাচন করেছে। অথচ এ নির্বাচনকে তারা আখ্যা দিয়েছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। এর জন্য মাল, অর্থ-সময় সব কিছু দেয়াকে তারা জিহাদ বলে উল্লেখ করেছে।
কাজেই ধর্মের নামে এভাবে ধোঁকা প্রতারণা, মুনাফিকী আর কত দিন। হাদীছ শরীফ-এ এদেরকে যমীনের নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। এদের কাছে না যেতে এবং কাছে আসতে না দিতে বলা হয়েছে। তাহলে তারা আমাদের গুমরাহ করতে পারবে না তাও বলা হয়েছে।
তাহলে মুসলিম পাঠকগন এখন কি বলবেন?
{মূল-আবদুস সবুর}
http://www.somewhereinblog.net/blog/shakeer/29677519