Wednesday, April 10, 2013

অগ্নিযুগের বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর শতবছরের গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লবী অধ্যায়ের অবসান



চলে গেলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথী ও চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী পরলোক গমন করেছেন। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।বিপ্লবী বিনোদন বিহারী চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। তার প্রয়াণের খবরে সবার মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।

১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এই অগ্নিপুরুষ। গত ১০ জানুয়ারি ছিল তাঁর ১০৪ তম জন্মদিন। চট্টগ্রামকে আঁকড়ে থাকা এই মানুষটির শেষ ইচ্ছা ছিল তার প্রিয় স্থানেই যেন তাঁর শেষকৃত্য হয়।

শতবছরের আগুনঝরা দিন

বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী জন্মেছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। পিতা কামিনী চৌধুরী একজন আদর্শবান আইনজীবী ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বদেশি এবং ব্রিটিশবিরোধী প্রথম অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ফটিকছড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন সভা সমিতিতে তিনি যেতেন, সঙ্গে নিয়ে যেতেন শিশুপুত্র বিনোদকে। ১৯২৯ সালে বিনোদ চৌধুরী প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং রায়বাহাদুর বৃত্তিলাভ করেন।

বিনোদ চৌধুরীর লেখাপড়ার মতো দেশপ্রেমে প্রথম হাতেখড়ি হয় ফটিকছড়ি বোর্ড স্কুলে পড়ার সময় পিতার কাছে। বিপ্লবী জীবন শুরুর পর একে একে পরিচয় হয় সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার, মধুসূদন দত্ত, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী, অর্ধেন্দু গুহ, গণেশ ঘোষ, নির্মল সেনসহ অনেকের সঙ্গে। বিপ্লব সম্পর্কিত অনেক বই পড়ে ফেলেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকাকালে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের লড়াইয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ঘটনার পর বিপ্লবীরা নিকটবর্তী পাহাড়ে অবস্থান নেন।

২২ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কার্যত স্বাধীন ছিল। মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নেন। ইংরেজ সৈন্যরা পাহাড় ঘিরে ফেলে। ৫৪ জন বিপ্লবী মাস্টারদার নেতৃত্বে ও লোকনাথ বলের সেনাপতিত্বে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন। লোকনাথ বল যুদ্ধের একটা ছক তৈরি করেন, পাহাড়ের তিন দিকে কে কোথায় অবস্থান নেবেন, কীভাবে যুদ্ধ করবেন-সব বুঝিয়ে দেন। শত্রুপক্ষ যেন পাহাড়ে উঠতে না পারে সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন। সে অনুযায়ী যুদ্ধ চলে। ইতিমধ্যে বারোজন বিপ্লবী শহীদ হন, বিনোদ বিহারী চৌধুরী সহ আহত হন কয়েকজন। গুলি তার গলার একদিকে ঢুকে বেরিয়ে গেছে অন্যদিকে। রক্তক্ষরণের ফলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। অভুক্ত বিপ্লবীরা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে বিপ্লবীদের জালালাবাদ পাহাড়ের অবস্থান ত্যাগ করতে হয়। আহত, রক্তাক্ত বিনোদ চৌধুরী পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিয়ে অতি কষ্টে এসে পৌঁছান কুমিরার এক আত্মীয় বাড়িতে। এখানে গোপনীয়ভাবে তার চিকিৎসা চলে। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এদিকে এসে পড়ে নতুন বিপদ। গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতায় সেখানে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। আত্মীয় বাড়ির লোকেরা শংকিত হন। তারা সিদ্ধান্ত নেন বিনোদ চৌধুরীকে সরিয়ে নিতে হবে। তাকে বউ সাজতে হয়, লাল পাড়ের শাড়ি, হাতে শাঁখা ও চুড়ি পরে বউ সেজে বাড়ি থেকে বের হন, পৌঁছে যান শহরের চাক্তাই। পথে পুলিশের সামনে পড়তে হয় দুবার। ওদিকে বিনোদ বিহারীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পাঁচশ টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়।
বাবার পরামর্শে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। মামার সঙ্গে রওয়ানা হন ভারতের মধ্যপ্রদেশের চিন্ডুয়ারা জেলার জুনার দিয়া কয়লা খনিতে। পরিচয় গোপন করে কয়লা খনিতে দিনে এক টাকা মাইনেতে একটা চাকরিও জুটে গেল বিনোদ বিহারী চৌধুরীর। সকাল-বিকাল যারা কয়লা খনিতে যাওয়া-আসা করতেন তাদের নাম, সময় নির্দিষ্ট ফরমে লিখে রাখাই তার কাজ। মধ্যপ্রদেশ থেকে পালিয়ে চাকরির সন্ধানে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়ান বিনোদ চৌধুরী। ঝাড়খন্ডেও ছিলেন কিছুদিন। অতঃপর চলে আসেন ঢাকায়। এক ব্যক্তির আশ্রয়ে থাকতেন তাঁতিবাজারের তিনতলা এক বাড়ির নিচতলায়। কয়েকদিন ছিলেন কার্জন হল ও ফরিদপুরে। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের কারো কারো সঙ্গে তার যোগাযোগ শুরু হয়, এমনকি মাস্টারদার সঙ্গেও। তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন আর পিয়নের চাকরির জন্য ঘুরবেন না, তার কাজ চট্টগ্রামে। তার মতে, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানী চট্টগ্রাম।

বিপ্লবী বিনোদ চৌধুরী চট্টগ্রামে ফিরলেন বটে, তবে তার প্রিয় মাস্টারদার সান্নিধ্যে নয়, নিক্ষিপ্ত হন জেলে। সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা নিজেও ১৯৩৩-এর ২ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয়ে যান। বিপ্লবীদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে ব্রিটিশ সৈন্যরা। একে একে ধরা পড়তে লাগলেন বিপ্লবীরা। সঙ্গে সঙ্গেই বিচার কাজ শুরু হয়। এ বছর ১৪ আগস্ট সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হয়, নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের কারাগারের একই ফাঁসি মঞ্চে সর্বাধিনায়ক মাস্টারদার সঙ্গে বিপ্লবী তারকেশ্বরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তার আগে একই কারাগারে ভিন্ন সেলে বন্দী বিনোদ বিহারী চৌধুরী আরেক বিপ্লবীর অনুরোধে মাষ্টার 'দা কে গান শোনাতে হয়। বিনোদ বিহারী চৌধুরী গেয়ে উঠেছিলেন, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে , তবে একলা চলো রে...."

বিনোদ বিহারী চৌধুরী ১৯৩৩-এর জুন মাসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও পাঁচ বছর চট্টগ্রাম জেল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি ও বহরমপুর জেল এবং দেউলি বন্দীশিবিরে কারাজীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৩৮ সালের শেষদিকে কারাগার থেকে মুক্তি পান। এক বছরের মাথায় ব্রিটিশ সরকার তাকে এক বছর গৃহবন্দী করে রাখে। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকেই জেল-দ্বীপান্তর থেকে ছাড়া পেয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেও বিনোদ বিহারী চৌধুরী কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি এ সময় চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সহসম্পাদক ছিলেন। এ সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তুতিকালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। ১৯৪১ থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেল, ঢাকা জেল এবং হিজলি ও খোকশা বন্দীশিবিরে আটক থাকার পর ১৯৪৫-এর শেষ দিকে ছাড়া পান। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় এক বছর চট্টগ্রাম কারাগারে বিনা বিচারে তাকে কাটাতে হয়। জেলখানা, বন্দীশিবির ও গৃহবন্দী অবস্থায় জীবনের বারোটি বছর অতিবাহিত করেন বিপ্লবী বিনোদ চৌধুরী।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় অনেকের মতো বিনোদ চৌধুরী দেশত্যাগ করেননি। তিনি পাকিস্তানে কংগ্রেস দল প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। ১৯৪৮ সালের পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের নির্বাচনে কংগ্রেস দলীয় প্রার্থী হিসেবে জয় লাভ করেন। সে সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য আসন নির্ধারিত ছিল ও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের (একাত্তরে শহীদ) নেতৃত্বে বিনোদ চৌধুরী প্রমুখ নেতা আন্দোলন করেন প্রচলিত ধর্মীয় ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের পরিবর্তে যুক্ত নির্বাচন আদায়ের জন্যে। বিনোদ চৌধুরী ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৮ সালে আইউব খান সামরিক আইন জারি করে রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করলে বিনোদ চৌধুরী রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দু’শ মাইল পথ পায়ে হেঁটে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের মিজোরাম দিয়ে কলকাতায় উপস্থিত হন। রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়ে তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টারে পাঠান এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভারত সরকারের সহায়তায় বহু সংখ্যক প্রাইমারি স্কুল খুলেন।
কোলকাতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান নিয়ে থাকবার সুযোগ ছেড়ে মাষ্টার'দার দীক্ষা অনুসরণ করে যে মাতৃভূমির জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন , সেই মাতৃভূমিতেই ফিরে এলেন আবার । নিয়েজিত করলেন দেশ গড়ার কাজে।
নামমাত্র সম্মানীতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। দুই পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ২৮ বছর বয়সে কোলকাতায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বড় ছেলে ক্যন্সার আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি মারা যায়। কয়েক বছর আগে তার স্ত্রী বিভা চৌধুরী এ মারা যান। এতো শোক সয়ে ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সকলকে প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করতেন এই বিপ্লবী। বড় ছেলে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি মারা যান। পুত্রবধু উপালি চৌধুরী এবং একমাত্র নাতি সোমশ্রভ্র চৌধুরী কোলকাতাতেই থাকেন।বড় পুত্রের শেষকৃত্যে কোলকাতা গিয়ে আর চট্টগ্রামের মাটিতে ফিরতে পারলেন না এই মহান বিপ্লবী। তার মহাপ্রয়ানে আমরা শোকাহত। এ মহান বিপ্লবীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

No comments:

Post a Comment