Friday, April 12, 2013

শতবর্ষী আলোকবর্তিকা বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে


শতবর্ষী আলোকবর্তিকাসম বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়েছে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। শহীদ মিনারে ঢাকার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিনোদবিহারী চৌধুরীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় বিউগলে বিদায়ের করুণ সুর বাজানো হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ রাখা হবে বিকেল চারটা পর্যন্ত।
আজ শুক্রবার দুপুরে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ কলকাতা থেকে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয়। দুপুর ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শিখর বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ গ্রহণ করেন।প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম বিষয়ক বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল এ কথা জানান।
চারটার পরে বিনোদবিহারীর মরদেহ রাখা হবে চট্টগ্রামের যাত্রামোহন সেন মিলনায়তনে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষমূর্তির পাদদেশে। সেখান থেকে সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। রাতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী বিনোদবিহারীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে নগরের অভয়মিত্র শ্মশানে।
গত বুধবার রাতে ১০৩ বছর বয়সে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী কলকাতার ফর্টিজ হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি শেষ ইচ্ছায় বাংলাদেশে তাঁকে সমাহিত করার কথা জানিয়ে গেছেন বলে জানান তাঁর ছেলে সৌমশুভ্র চৌধুরী।
জীবন ও কর্ম:
বিনোদবিহারী চৌধুরীর জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। তাঁর মা শ্রীমতী রমা রানী চৌধুরী। পিতা কামিনীকুমার চৌধুরী। ১৯২৯ সালে পি সি সেন সারোয়াতলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রায়বাহাদুর বৃত্তি পান।
১৯২৭ সালে ১৬ বছর বয়সে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী দল যুগান্তরে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী থাকাকালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ‘ভারতীয় সাধারণতন্ত্র বাহিনীর’ সদস্য হিসেবে অংশ নেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিনোদবিহারী অন্য চার সহযোদ্ধার সঙ্গে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগার দখল প্রচেষ্টায় অংশ নেন। দখলের পর তাঁরা দেশীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সূর্য সেনকে রাষ্ট্রপতি করে ‘অস্থায়ী গণতন্ত্রী বিপ্লবী সরকারের’ ঘোষণা দেন। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল জালালাবাদ যুদ্ধেও অংশ নেন বিনোদবিহারী। ওই যুদ্ধে তাঁর গলায় গুলিবিদ্ধ হয়। ব্রিটিশ সরকারকে তাঁকে জীবিত বা মৃত ধরতে পাঁচ শ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
বিনোদবিহারী ১৯৩৩ সালে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। ভারতের রাজপুতনার দেউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশন পেয়ে বিএ পাস করেন। ১৯৩৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর আবার তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। প্রায় এক বছর গৃহবন্দী থাকাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ইংরেজিতে এমএ ও বিএল (আইন) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বিনোদবিহারী চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পাঞ্চজন্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। এ সময় তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় বিনোদবিহারী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
১৯৪৮ সালে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান আইন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের বদলে যুক্ত নির্বাচনের আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান দেশের সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিনোদবিহারী অবসরে যান। ১৯৬৯ সালে স্বৈরশাসনবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

শুরুতে সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় যোগ দিলেও পরে তাতে আর যুক্ত থাকেননি। শেষ জীবনে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন শিক্ষকতাকে। প্রায় শতবর্ষ বয়স পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের মোমিন সড়কের বাসায় তিনি ছাত্রদের পড়িয়েছেন।
দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পর নানা সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান-পতন টলাতে পারেনি মহান এই বিপ্লবীকে। ১৯৬৮ সালে তাঁর দুই ছেলে সুবীর চৌধুরী, বিবেকানন্দ চৌধুরী কলকাতায় স্থায়ী হন। কিন্তু এই বিপ্লবী সস্ত্রীক বাংলাদেশে থেকে যান। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর হারান ৭০ বছরের দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী বিভারানী চৌধুরীকে। বিনোদবিহারীর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে মোমিন সড়কের বাসাতেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিনোদবিহারী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তবে দেশের সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অধিকারভিত্তিক আন্দোলনে ছিলেন অগ্রবর্তী সৈনিক। স্বৈরাচারবিরোধী, জঙ্গিবাদবিরোধী ও সামাজিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এই অগ্নিপুরুষ।
২০০০ সালে বিনোদবিহারী স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ গুণীজন সম্মাননা, ১৯৯৮ সালে ভোরের কাগজ সম্মাননা, শহীদ নতুনচন্দ্র স্মৃতিপদক।

No comments:

Post a Comment