Tuesday, April 23, 2013

কারাগারে নিরীহ সুব্রত অধিকারী: পথ চেয়ে আছে মা- ছেলে কবে মুক্ত হবে?





দুই তারিখ সারাটা রাত নির্ঘুম আমরা সবাই । মোবাইলের ওপাশে সেই পুরাতন ভোঁতা কণ্ঠস্বর । আপনার ডায়েল কৃত নাম্বারটি ………।।

রাত বাড়ছে সাথে সাথে ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে । ক্রমেই মনে হচ্ছিল ও বুঝি আর বেঁচে নেই ।
তিন তারিখ সকালে ডিবির ব্রিফিং থেকে জানতে পারলাম সুব্রত অধিকারী শুভ কে গ্রেফতার করা হয়েছে ।

নিজ চোখে দেখলাম মিডিয়ার সামনে দাগী আসামীর মত হাজির করা হয়েছে তাকে । তার সাথে জব্দকৃত অস্ত্র হিসেবে দেখিয়েছে মডেম আর ল্যাপটপ । তার অপরাধ সে ধর্ম ‘অবমাননা ‘ করেছে ।
প্রচণ্ড লজ্জা পেলাম । সুব্রত অধিকারী আসলে কে , সে আসলে কি লিখেছে ? সেই প্রশ্নের উত্তর না জেনেই তাকে একটা নোংরা মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হল ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র সুব্রত। সদা হাসিখুশি আর সবার জন্য নিবেদিতপ্রান এই ছেলেটির একটা চমৎকার গুণ -নিজের আচরন , জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দিয়ে সবার মন জয় করে নেয়া। ক্যান্সার আক্রান্ত বাচ্চাদের জন্য সুব্রত প্রতি তিন মাস পর পর রক্ত দিত । ওজন কম হওয়ায় ডাক্তার তার রক্ত নিতে চাইতো না ।কিন্তু নাছোড় বান্দা ছেলেটা , সুন্দর যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতো, এই রক্ত একটা বাচ্চার জীবন বাঁচাবে। তাই তার নিজের ক্ষতির চেয়ে বাচ্চার জীবন বেশি জরুরী । গত শীতে নিজের হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ১২টা সোয়েটার কিনে দিয়েছিল পথ শিশুদের । অথচ নিজের সোয়াটার ছিল না, পরে বন্ধুর গিফট করা সস্তা জ্যাকেটা দিয়ে পুরো শীতটাই পার করেছে সে।
নিছক বিনোদনের মধ্যম হিসেবে ফেইসবুকে তার বিচরন শুরু হয় ২০০৮ থেকে । দুই লাইন কবিতা কিংবা বানী কিংবা সারা দিন কেমন গেল এসব নিয়ে স্ট্যাটাস দিত । ২০১২ থেকে সে সমাজ সচেতনতা মূলক স্ট্যাটাস দেয়া শুরু করে , তার একটা স্ট্যাটাস এ লেখা ছিল ,

“ধর্ষণ ঠেকাতে স্প্রে! ( ভারত )
সত্যি এটি পুরুষের জন্য খুবই লজ্জার। একটি রাষ্ট্রে পুরুষ কতোটা হিংস্র ও নোংরা হলে মেয়েরা স্প্রে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটা যদি বাঙলাদেশেও হয় তাহলে দেখা যাবে মেয়েরা ডান হাতে ছেলেদের বা বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাই (HI) বলছে আর বাম হাতে ব্যাগের মধ্যে স্প্রে ধরে আছে। পুরুষ হও বা মানুষ হও যাই হও না কেন পশু হইও না। পৃথিবীর শুরু থেকেই এই ধর্ষণ শব্দটি ও কর্মটি পুরুষের সাথে মিশে আছে। যু্দ্ধক্ষেত্রে হোক আর সামাজিকক্ষেত্রে হোক ধর্ষণ তার রক্তে মিশে গেছে ” ।

তার খুব ক্ষোভের একটা যায়গা ছিল জামাতের ভণ্ডামি । সে মনে প্রানে চাইত যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক । দেশ থেকে জামাত নামক ভণ্ড দলটা নির্মূল হোক । সে লিখেছে ,

“সাতক্ষীরার একটি গ্রামে জামাত-শিবিরের বেজন্মরা কয়েকদিন আগে হিন্দুদের গ্রামে হামলা করে। গর্ভবতী এক মহিলার পেটে তারা লাথি দিয়ে আঘাত করে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঐ মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এই বেজন্মরাই আমাদের সমাজে ধর্মের রক্ষক হিসেবে পরিচিত। তারাই কে মুসলিম কে নাস্তিক তার সার্টিফিকেট দেয়।

কিন্তু এতো হায়নার মাঝেও কিছু মানুষ দেখে প্রাণ ফিরে পাই । শত অন্ধকারেও আশার আলো দেখি।

এই নিউজটা দিল হিমেল ভাই। সাতক্ষীরার প্রতিনিধি তাকে এই সংবাদ জানায়।

তার পকেটে ৩২০০ টাকা ছিল পুরাটাই সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে দিয়ে দিয়েছে। ঐ সময় উপস্থিত তিন জনের কাছ থেকেই প্রায় দশ হাজার টাকা উঠেছে। আপাদত জরুরী ভিত্তিতে এই সামান্য টাকা গুলো পাঠানো হল। অর্থের আরো প্রয়োজন হতে পারে। আশা করি আমরা সবাই সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেব।

জামাতের বেজন্মরা ঐ মায়ের পেটেই শুধু লাথি দেয় নি, লাথি দিয়েছে আমাদের মাতৃভূমির পেটে। এই বেজন্মরা হয় এই দেশে থাকবে না হয় আমরা। পাকিস্তানি গেলমানদের জায়গা এই দেশে না। পাকিস্তানের গেলমান পাকিস্তানে ফিরে যা” ।

তার দেশাত্মবোধ ছিল প্রচণ্ড প্রবল । একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাস্তায় পরে থাকা একটা পতাকা দেখে সে ধুলো ঝেড়ে মাথায় বেঁধে নিয়েছিল । বলেছিল , “ মায়ের আঁচল ধুলোয় লুটাবে কেন , এর জায়গা তো মাথায়” । তার ব্লগের ৯০ ভাগ লেখাই দেশ কে নিয়ে , সে ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর সাক্ষাতকার নিয়েছিল । মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক মামার দেশ প্রেমের প্রতিটি অক্ষর সে লিখছে ব্লগে । সে লিখেছে জামাতের নিপীড়ন , একাত্তরে সংগ্রাম পত্রিকার ভূমিকা আসলেই কি ছিল তাই নিয়ে ।
তার চেতনা এর শাণিত যে সে বার বার প্রতিবাদী হয়েছে , আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নামে মিথ্যাচার নিয়ে । একবার ফেইসবুকে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নাম নিয়ে কোন বর্বর একটা নোংরা আইডি খুলেছিল । শুভ সঙ্গে সঙ্গে তার তীব্র প্রতিবাদ করেছে । সে লিখেছে ,

“বাঙালি কতোটা নোংরা তার জন্য বাঙালির বেডরুমে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাঙালির ফেসবুই যথেষ্ট। শেখ হাসিনার নামে একটা নোংরা একাউন্ট দেখলাম। মাথা এডিট করে লাগানো ওখানে। একই জিনিস খালেদা জিয়ার হোক তা চাই না। এমন নোংরামীই মাধ্যমেই আমরা আমাদের পরিচয় জানান দিচ্ছি”

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে একটা চমৎকার পোষ্ট দিয়েছিল ব্লগে। ও মনে প্রানে বিশ্বাস করত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি ।
শুভ ধার্মিকদের শ্রদ্ধা করত । তার মুসলিম বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে সব সময় সালাম দিত । সে কোন দিন কাউকে ধর্ম নিয়ে একটা বাজে কথা বলেনি । বরং সে লিখেছে ,
“টুপি দেখলেই জামাত নয় , ধার্মিক দেখলেই ঘৃণা নয়” ।

মসজিদে আগুন দিল যখন জামাত শিবিরের সন্ত্রাসীরা , তখন শুভ খুব কষ্ট পেয়েছিল । সে লিখেছিল ,

“মসজিদের ভেতরে আগুন দেওয়া, নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের মারা, অস্ত্র নিয়ে মসজিদে প্রবেশ, মসজিদে মারামারি, রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য মসজিদ ব্যবহার, ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়া, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, ধর্মের নামে মানুষ খুন ইত্যাদি করেও জামাত-শিবির একটি ইসলামিক দল।”

এই অল্প বয়সী ছেলেটা তার এক বছরের ব্লগিং জীবনে মাত্র ২৫-৩০টা লেখা দিয়েছে । তার প্রতিটি লেখাই ছিল তার বোধের প্রকাশ । জীবন সম্পর্কে সে তার ছোট্টা জীবনে ধারণা এখনো এতটা গভীর হয়নি কিন্তু তার জানার চেষ্টা আছে শত ভাগ । ব্লগে তার আইডি সুব্রত শুভ , লালু কসাই , আজাদ । অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ায় বন্ধুরা মজা করে ওকে ডাকে লালু কসাই। তাই সে তার ব্লগ নাম এটাই দিয়েছিল ।
তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সারমর্ম করলে এমন দাঁড়ায় ,

১/ ” সুব্রত শুভ বাংলাদেশ নাস্তিক কমিউনিটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত”

২/ “সুব্রত শুভর” সাথে আসিফ মহিউদ্দিন, শর্মি আমিনদের মতো ইসলামবিদ্বেষীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে

৩/ “সুব্রত শুভ” হিন্দু নির্যাতনের দোহাই দিয়ে প্রায়ই মুসলিমদের ধর্মীয় বিষে কটু মন্তব্য করে যা সাম্প্রদায়িক অস্হিতিশীলতার সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ।

কার ফেইসবুক বন্ধু ভিন্ন বিশ্বাসের হওয়া অপরাধ এই কথাটা কোন আইনে আছে আমার জানা নেই । যদি থেকে থাকে তাহলে আমরা সবাই অপরাধী । সুব্রত শুভ এর ফ্রেন্ড লিস্ট এ তথাকথিত কয়েকজন নাস্তিক (যদিও ইসলাম ধর্ম মতে কাউকে “নাস্তিক” বলার আগে অনেক কিছু ভেবে চিনতে বলতে হয়।) আছে বলে তাঁর উপর মামলাটি করা হয়েছে । তাহলে বাংলাদেশর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধীনে মাষ্টার্স এর শেষ পর্বে মুসলিম দর্শনে যে বা যারা আরজ আলী মাতুব্বর এর দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাঁদের কে ও নাস্তিক বলা যায়। কেননা আরজ আলী মাতব্বর তো একজন ইসলাম বিরোধী ছিলেন। তাই আশা করছি অচিরেই বর্তমান সরকার ঐ ব্যাক্তিদের (মাষ্টার্স এর মুসলিম দর্শনে যে বা যারা আরজ আলী মাতব্বর এর দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেছেন) খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ ।
মসজিদ, মন্দির পোড়াবার খবর যখন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হল তখন সকল ধর্মের মানুষ প্রতিবাদ করেছিল , শুভ তাদের ব্যতিক্রম নয় । সে লিখেছিল ,
“”যে দেশে যে ধর্মের মানুষ বেশী সেই দেশে ঐ ধর্ম নিয়ে কথা বললে বা সমালোচনা করলে; বেশি সংখ্যক মানুষ যখন আঘাত পায় তখন তাকে ধর্মানুভূতি বলে। কিন্তু অন্য ধর্মের মূর্তি ভাঙলে , মসজিদ ভাঙলে বা ঐ ধর্ম নিয়ে খোঁচালেও ধর্মানুভূতিতে আঘাত আসে না। ইহাই ধর্মানুভূতির অনুভূতি।”

তার এই ছোট্ট জীবনে শুধু দেশ কে দেশের মানুষ কে ভালবাসার জন্যই কি আজ তার এমন পরিণতি ? সাত দিনের রিমান্ড, এখন জেল হাজত আর কদিন পরে কি মিথ্যা অপরাধে দায়ী দেখিয়ে তার শাস্তি হয়ে যাবে ?
যে মুসলিম ভাইদের মসজিদ পোড়াবার প্রতিবাদ সে করেছে , যে হিন্দু ভাইদের মন্দির ভাঙ্গার প্রতিবাদ সে করেছে আজ তাকে তারাই কি ভালবেসে মুক্ত করে আনবে না ? যে প্রধানমন্ত্রী কে সে মায়ের সম্মান দিয়েছে তিনি কি ওর পাশে দাঁড়াবেন না ?
ও প্রকৃত ধার্মিকদের শ্রদ্ধা করত , সম্মান করতো, আজ তারা কি ওর পাশে দাঁড়াবে না ?
আমাদের দেশে একটা মিথ্যা মামলা দেয়া অনেক সহজ । আমরা সবাই তা জানি । কিন্তু সত্যের জয় চিরকাল হয়েছে । শুভর মায়ের অশ্রু, হাজার হাজার মানুষের ভালবাসা , ওকে ফিরিয়ে আনবে এই আমাদের প্রত্যাশা । http://khoborbangla.com/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%B9-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4-%E0%A6%85%E0%A6%A7/

No comments:

Post a Comment