Friday, March 1, 2013

শহীদ তাজুল শ্রমিক আন্দোলনের অগ্নি মশাল’




ঢাকা: “শহীদ তাজুল ইসলাম ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের অগ্নি মশাল। তার নির্মোহ আত্মত্যাগই তা প্রমাণ করেছে। তাই আজকের এ দিনটিতে সব শ্রমজীবী মানুষের নতুন করে শপথ নেওয়ার দিন। তার দেখানো পথ ধরেই সকলকে শোষণ মুক্তির পথে এগুতে হবে।”
স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের শহীদ কমরেড তাজুল ইসলামের ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শুক্রবার সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আজ সারা দেশে যে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব শুরু হয়েছে, এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর জন্যও শহীদ তাজুল আমাদের স্মরণীয়। এজন্য শ্রমিকশ্রেণীকে আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।”
দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার লক্ষ্যে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে পুরানা পল্টনের মুক্তিভবনের নীচে অস্থায়ী শহীদ বেদি নির্মাণ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে কমরেড তাজুলের প্রতিকৃতিতে পুস্পমাল্য অর্পণ করা হয়।
এসময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সিপিবি সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ, তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এস এম শুভ প্রমুখ। সমাবেশ পরিচালনা করেন জিলানী শুভ ও কে এম রহুল আমীন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা এসময় অস্থায়ী বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
উল্লেখ্য, তাজুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর ১৯৭৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ অনুযায়ী শ্রমিক আন্দোলন সংঘটিত করার পথ বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ দেশব্যাপী আহুত শিল্প ধর্মঘট ও হরতালের সমর্থনে আগের মধ্যরাতে আদমজী জুটমিল এলাকায় কমরেড তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে শ্রমিকরা প্রচার মিছিল বের করলে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের হামলায় কমরেড তাজুল ইসলামসহ কয়েকজন শ্রমিক মারাত্মক আহত হন। ভোরবেলা গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পর তার মৃত্যু হয়।

Thursday, February 28, 2013

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় একাত্তরে সামান্য তাবিজ বিক্রেতা বর্তমানে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্মান্তর করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে তাকে সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রায় ঘোষণার পর পরই এ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এই রায় ‘ঐতিহাসিক’। অন্যায় করে যে পার পায় না এ রায়ের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হলো। এ রায়ের মাধ্যমে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির কষ্ট দেশ কিছুটা হলেও ভুলতে পারবে, ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দন্ডাদেশের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে।


১২টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলো থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগের মধ্যে ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬, ১৯ অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয়েছে। অন্য ছয়টি অভিযোগে আলাদা করে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি। অন্যদিকে ১২টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সাঈদীকে সেই সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। বাকি ১২টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়াত সেগুলো থেকে তাঁকে খালাস দেয়া হয়েছে। দুটিতে ফাঁসি দেয়া হলেও অন্যগুলোতে কোন সাজা দেয়া হয়নি। এ ঘটনায় আসামিপক্ষ আপীল করলে যদি ২টি অভিযোগ থেকে খালাস পান সে ক্ষেত্রে তিনি কি মুক্ত হবেন।
এ প্রসঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, যেহেতু ২টিতে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন, অন্য ৬টিতে দোষী সাব্যস্ত হলেও কোন সাজা দেয়া হয়নি। সাঈদীকে মুক্ত হতে হলে ৮টি অভিযোগ থেকেই মুক্ত হতে হবে। যেহেতু ২টিতে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। সে কারণে অন্যগুলোতে কোন সাজা দেয়া হয়নি।
অন্যদিকে প্রধান সমন্বয়কারী এমকে রহমান বলেছেন, ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ২টিতে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। ধরে নেয়া যায় অন্য ৬টিতেও মৃত্যুদন্ড- সমান অপরাধ। এগুলো সুপ্রীমকোর্ট ঠিক করবে।


এদিকে সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধের মামলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আপীল করব। কারণ উনি (সাঈদী) নির্দোষ। উনার বেকসুর খালাস পাওয়ার কথা ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে মিথ্যা সাক্ষী উপস্থাপন করে এই রায় পেয়েছে। রায় ঘোষণার উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। প্রধান গেট ছাড়ায় মূল ভবনের তিন বার চেকিং করে সাংবাদিক আইনজীবী ও পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ॥ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ট্রাইব্যুনাল অঙ্গনে সাংবাদিক, আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। সকাল ১১টা ১০ মিনিটের সময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে এজলাস কক্ষে আনা হয়। ১১টা ১১ মিনিটে ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার জন্য চেয়ারম্যানসহ অন্য দু’বিচারপতি আসন গ্রহণ করেন। শুরুতেই চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর বলেন, এটি ১২০ পৃষ্ঠার রায়। তবে আমরা রায়ের ৫৬ পৃষ্ঠার সারাংশ পড়ব।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর বলেন, ‘আমরা রায়ের আগে দুটি কথা বলতে চাই। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পরিচয় দেয়ার কোন দরকার নেই। ওনার ওয়াজ শোনার জন্য হাজার মানুষ যান। ওনার বর্তমান নাম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। উনি শুধু প্রখ্যাত মাওলানা নন, উনি দুবারের এমপি। জামায়াতের নায়েবে আমির। কিন্তু আমরা তাঁকে নায়েবে আমির কিংবা সাংসদ হিসেবে বিচার করছি না। আমরা আজ থেকে ৪২ বছর পূর্বে সংঘটিত অপরাধের বিচার করছি। ওই সময় সাঈদী ছিলেন ৩০ বছরের যুবক। তিনি ছিলেন বিবাহিত, এক সন্তানের জনক। পিরোজপুরে সাউদখালীতে বাড়ি। তখন তিনি কোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পিরোজপুরের শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি আলেম পাস। উর্দুতে ভাল কথা বলতে পারতেন। তাই পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে তাঁর ভাল যোগাযোগ তৈরি হয়। আমাদের বিচার করতে হবে, তিনি সে সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না। আমরা সেই ৩০ বছরের যুবকের বিচার করছি। বর্তমানের সাঈদীর বিচার করছি না, যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে গ্রামের নিরীহ লোক ও সাধারণ মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে ২৮ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৭ জন।
রায় পড়া শুরু ॥ সাঈদীর বিরুদ্ধে রায়ের ৫৬ পৃষ্ঠার সারাংশ পড়া শুরু হয় সকাল ১১টা ২০ মিনিটে। পিনপতন নীরবতার মধ্যে বিচারপতি আনোয়ারুল হক প্রথমে রায় পড়া শুরু করেন। এর পর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সর্বশেষে চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর দুপুর ১টা ২০ মিনিটে শুরু করেন। শেষ করেন ১টা ৪৫ মিনিটে। সর্বশেষে পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে চেয়ারম্যান সাজা ঘোষণা করেন। ৮ ও ১০ এই দুটি চার্জে সাঈদীকে ফাঁসি দেয়া হয়।
চার্জ দুটিতে কী আছে ॥ মামলার রায়ে ৮ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৮ মে বেলা ৩টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তায় সদর থানার চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার ভাই মফিজ উদ্দিন এবং ইব্রাহিমসহ দুই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যান। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেনা ক্যাম্পে ফেরার পথে সাঈদীর প্ররোচনায় ইব্রাহিমকে হত্যা করে লাশ ব্রিজের কাছে ফেলে দেয়া হয়। মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
পরে সাঈদী ও অন্যদের আগুনে পারেরহাট বন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ঘটনায় সাঈদী সরাসরি অপহরণ, খুন, যন্ত্রণাদানের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩(২)(এ) ধারা অনুসারে অপরাধ।
অভিযোগ-১০-এ বলা হয়েছে, ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসব বাড়ির মালিক হলেন, চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হরেণ ঠাকুর, অনিল ম-ল, বিসা বালি, সুকাবালি, সতিশ বালা প্রমুখ। সাঈদীর ইন্ধনে তার সহযোগীরা বিসা বালিকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। বেসামরিক মানুষের বসবাসের বাড়িতে আগুন দেয়া নিপীড়নের শামিল। সাঈদী এ ঘটনায় বাড়িঘর পোড়ানো, বিসা বালিকে হত্যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, যা আইনের ৩(২)(এ) ধারায় অপরাধ।
অন্য ৬টিও প্রমাণিত ॥ এ দুটি বাদে আরও ছয়টি অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সেই চার্জগুলো হচ্ছে, ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগ। চেয়ারম্যান রায়ে বলেন, ২টি অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় এসব অপরাধে নতুন সাজা দেয়ার প্রয়োজন নেই।
কী আছে ঐ অভিযোগে ॥ অভিযোগ-৬-এ বলা হয়েছে, ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে একদল শান্তি কমিটির সদস্য পিরোজপুর সদরের পারেরহাটে গিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের ওই এলাকায় স্বাগত জানান। মুকুন্দ লাল সাহার দোকান থেকে বাইশ সের স্বর্ণ ও রৌপ্য লুট করেন সাঈদী।
অভিযোগ-৭-এ বলা হয়, সাঈদী তার সশস্ত্র সাঙ্গোপাঙ্গ ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সদর থানার ভাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে হানা দেন। পরে তিনি তাঁকে আটক করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন, যারা তাঁকে নির্যাতন করে।
অভিযোগ-১১* সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ইন্দুরকানি থানার টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে সাঈদী তার বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করেন।
অভিযোগ-১৪ *
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় যায়। মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামী ঘর থেকে বের হতে পারেননি। তখন সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকাররা তাঁকে ধর্ষণ করে।
অভিযোগ-১৬ *
সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্ন রানী ও কমলা রানীকে ধরে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
অভিযোগ-১৯ *
সাঈদী প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর করে তাদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হতো।
যেগুলো প্রমাণিত হয়নি ॥ ১২টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে সেই সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। অভিযোগগুলো হলো, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ১৯।
প্রথম মামলা॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম মামলা হয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাসল গঠন করা হয়। ২০১০ সালের ২৯ জুন তাঁকে ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় সাঈদীর বিরুদ্ধে বিচার কাজ। অবশেষে ২০১৩ সালের ২৯ জুন উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষামাণ (সিএভিতে) রাখেন। বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়। বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল-১ এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষনা করে।
তৃতীয় রায় ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২-এ ৯টি মামলার মধ্যে এটি তৃতীয় রায়। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদকে মৃত্যুদ- ও কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন। এখন আরও ৬টি মামলা বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। মামলাগুলো হলো জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আব্দুল আলীম।
আমি সন্তুষ্ট ॥ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার প্রসিকিউশনপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন আমরা সাঈদীর বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছি। আদালত পূর্ণাঙ্গভাবে পর্যালোচনা করে এ রায় দিয়েছে। আমরা আটটি অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তবে আমাদের ধারণা ছিল, ১৯টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে। তারপরও এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রায় ঘোষণার সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম, প্রধান সমন্বয়ক (এ্যার্টনি জেনারেল পদমর্যাদায়) এম কে রহমান, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মমতাজ উদ্দিন ফকির, চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, প্রসিকিউটর হায়দার আলী, প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম, প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান, প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল, প্রসিকিউটর নুর জাহান মুক্তা, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আনোয়ার হোসেনসহ সিনিয়র আইনজীবিগণ। ডিফেন্স পক্ষের সিনিয়র কোন আইনজীবী এজলাস কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না। তবে জুনিয়র আইনজীবী সাজ্জাদ আলী চৌধুরীসহ চার জুনিয়র ডিফেন্স আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
এ্যাম্বুলেন্সে সাঈদী ॥ কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে ঢকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি এ্যাম্বুলেন্সে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। আগে দুটি ও পিছনে একটি পুলিশ ভ্যান পাহারা দিয়ে তাঁকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। জামায়াতে ইসলামী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকায় ট্রাইব্যুনালে আরও বাড়তি নিরাপত্তা নেয়া হয়।
চুপ চুপ তুই রাজাকার ॥ রায় ঘোষণার পর ডকে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দাঁড়িয়ে যান এবং বলতে থাকেন, ‘আপনারা বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে রায় দেননি। আপনারা শাহবাগের কিছুসংখ্যক নাস্তিক ও ব্লগারদের...’ এ সময় এজলাস কক্ষে উপস্থিত অনেকে ‘ তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, চুপ কর্’ বলে তীব্র ধিক্কার দিতে থাকেন। পরে পুলিশ তাঁকে আসামীর কাঠগড়া থেকে নামিয়ে হাজতখানায় নিয়ে যায়।

দেলু ওরফে দেইল্লা ওরফে দেলোয়ার হোসেন শিকদার-মূল ব্যবসা ছিল তাবিজ বিক্রি


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে স্থানীয় মক্তব ও মাদ্রাসায় আসা-যাওয়ার কারণে আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন দেলু ওরফে দেইল্লা ওরফে দেলোয়ার হোসেন শিকদার। একাত্তরে শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকাকালে পিরোজপুর জেলার পারেরহাট বাজারে প্রথমে ছোলামুড়ি বিক্রি শুরু করেন দেলু। কিছুদিন পর ভায়রা ভাইয়ের মুদি দোকানে বসলেও আড়ালে তাঁর মূল ব্যবসা ছিল তাবিজ বিক্রি। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে যান। পরে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের সংগঠিত করে এলাকায় শুরু করেন হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণসহ জঘন্যতম মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ। ওই সময়েই 'দেইল্লা রাজাকার' নামে পরিচিতি লাভ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীনের পর ছারছীনা মাদ্রাসায় ভর্তি হন দেইল্লা। সেখানে কিছুদিন থাকার পর জামায়াতের ছাত্ররাজনীতি করার কারণে ওই মাদ্রাসা থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। পরে বারইপাড়া মাদ্রাসা থেকে মোস্তফা দেলোয়ার হোসেন নামে দাখিল এবং পরে নাম পরিবর্তন করে আবার আবু নাঈম মো. দেলোয়ার হোসাইন নামে আলিম পাস করেন।
পরবর্র্তী সময়ে দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি না নিলেও নামের সঙ্গে আল্লামা টাইটেল ব্যবহার করে 'আল্লামা মাওলানা' পরিচয়ে আবির্ভূত হন। ওয়াজ করে বেড়ান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ওই সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। পরে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও চলে তাঁর এই কার্যক্রম। কালক্রমে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পেয়ে যান। এই সময়েই মা-বাবার দেওয়া দেলোয়ার হোসেন শিকদার, এলাকার সেই দেইল্লা রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে ব্যাপক পরিচিতি পান।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, একাত্তরের অপরাধ ঢাকতেই দাখিল ও আলিম পরীক্ষা এবং পরবর্তী সময়ে ধর্ম প্রচারের নামে জামায়াতের রাজনীতির প্রচারণার সময় জন্মতারিখ পাল্টানোসহ ভিন্ন নামে আত্মপ্রকাশ করেন দেইল্লা রাজাকার। এসব অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠিত উপকমিটি।
দাখিল পরীক্ষা অনুযায়ী সাঈদীর জন্মতারিখ ১৯৪৭ সালের ১ মার্চ হলেও নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী সাঈদীর জন্ম ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার তৎকালীন ইন্দুরকানীর (বর্তমানে জিয়ানগর উপজেলা) সাউথখালী গ্রামে। তাঁর বাবা মরহুম ইউসুফ আলী শিকদার। পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে- এমন আশঙ্কায় আবার ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর দাখিল ও আলিম পাসের সনদে নিজের নাম ও বয়স পরিবর্তন করান সাঈদী।
জানা গেছে, আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী এবং বাকপটু ছিলেন সাঈদী। তাঁর এই পারদর্শিতাকে ব্যবহার করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তিনি সখ্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। এ কারণে তিনি রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হতে সক্ষম হন। তাঁর নেতৃত্বে এবং সহযোগিতায় পিরোজপুরের পারেরহাট বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে।
বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান জানান, এলাকার মানুষের কাছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পরিচিতি পান মূলত আশির দশকের শুরু থেকে। তখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় তিনি 'ওয়াজ মাহফিল' নামে পরিচিত ধর্মীয় সমাবেশগুলোতে একজন সুবক্তা হিসেবে হাজির হতে শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে প্রথম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নিজ এলাকায় এক ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেন। ওই মাহফিলের পর এলাকাবাসী তাঁকে চেনে।
সাঈদীর মামলার বাদী জিয়ানগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাহাবুবুল আলম হাওলাদার জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে সাঈদী পারেরহাটে তাঁর ভায়রা ভাইয়ের সঙ্গে মুদি দোকানের ব্যবসা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে দেলোয়ার শিকদার ও তাঁর বড় ভাই এনায়েত শিকদার পিরোজপুরের সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাস্তায় চিলা শিকদারের বাড়িতে থাকতেন। তখন তাঁকে তেমন কেউ চিনত না। কিন্তু আশির দশকে ওয়াজ নসিহত শুরু এবং পরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ব্যাপক পরিচিতি পান সাঈদী।

Wednesday, February 27, 2013

জামায়াত-ই-ইসলামি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সিরাজুল হক গ্রেপ্তার


জামায়াত-ই-ইসলামি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সিরাজুল হককে আজ বুধবার পেশোয়ারের দির এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
‘ডন নিজউ’-এর খবরে বলা হয়, কয়েক বছর আগে পাকিস্তানের আদিবাসী অধ্যুষিত বাজৌর এলাকায় উগ্রপন্থী তালেবান ও অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর তত্পরতার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যখন অভিযান চালাচ্ছিল, তখন সিরাজুল হকের নেতৃত্বে জামায়াত-ই-ইসলামি সে অভিযান বন্ধের দাবি জানিয়ে সভা-সমাবেশ করেছিলেন। এসব রাজনৈতিক তত্পরতায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে আজ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০০৮ সালের ২২ নভেম্বরে জামায়াত-ই-ইসলামি বাজৌর, সোয়াত ও ওয়াজিরিস্তানে সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করে এবং অভিযান বন্ধের দাবিতে দির এলাকার তিমারগারায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছিল। সিরাজুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জামায়াত-ই-ইসলামির বাজৌর শাখার প্রধান সরদার খান ও জানদুল এলাকার প্রধান ইজাজুল মুলক আফকারি বক্তব্য দেন। সমাবেশের পর কয়েক ঘণ্টার জন্য জামায়াত-ই-ইসলামির কর্মীরা মুন্দা-বাজৌর সড়ক অবরোধ করে রাখেন।

Sunday, February 24, 2013

ঘরে ফেরা নেই যুদ্ধটা চলবেই :সৈয়দ শামসুল হক



লেখার টেবিলে মগ্ন হয়ে আছি, কখনো আর কখনো ল্যাপটপে
অক্ষরগুলো শব্দগুলো বাক্যগুলো করোটির ভেতরে সরবে
যে ফেটে পড়ছে, তার লিপি কী দ্রুতই না গড়ে উঠছে,
আর ওদিকে ওরা ওই তরুণেরা পায়ে পায়ে যে এসে জুটছে
শাহবাগ সড়ক মোহনায়_ এও তো এক কবিতাই!
খাতার শাদা পৃষ্ঠায় ল্যাপটপের দুধ শাদা পর্দায় তাকাই!
কবিতা কবিতা আজ, আমাকে লিখিয়ে নিচ্ছে নতুন একটা দিন_
কতদিন পরে! আর কত দিনের না পরেই রক্তের ঋণ
শোধ করতে ওরা_ গ্রথিত হচ্ছে পঙক্তির পর পঙক্তিতে
বাংলা মায়ের সবুজ আঁচলে ফের লাল সূর্য ফিরে এনে দিতে।
ফিরে এনে দিতে সত্যের উজ্জ্বলতা_ যা ছিলো অমাবস্যা ঢাকা_
কত দীর্ঘ রাত ছিলো বাংলাদেশ নামে একটি দেশের জেগে থাকা
ওই ওদেরই জন্যে। আর আমার কবিতাও_ একাত্তর থেকে!
আজ এই ল্যাপটপের পর্দায় বা খাতায় পাতায় আমার হাত লেখে
যে কবিতা, আজ তারচেয়েও এক মেধাবী কবিতা লেখা হয়ে যাচ্ছে
ওদেরই একের পর এক সমাগমে_ যেন শব্দের পর শব্দ পাচ্ছে
একটি কবিতার পঙক্তির শরীর। আমি লেখা ছেড়ে রাজপথে এবার।
ওদের কবিতাটিই তো আজ আমার_ আমাদের_ কণ্ঠে তুলে নেবার_
আর সেই কবিতাটির শিরোনাম লাল সবুজ অক্ষরে এই_
পতাকা যারা পোড়ায়_ তাদের ক্ষমা নেই_ নেই!
যতদিন না বাংলার মাটি হয় দালাল-ঘাতক মুক্ত_ ঘরে ফেরা নেই!
যতক্ষণ না মায়ের বুকে দুধ ফিরে দিতে না পারি_ যুদ্ধটা চলবেই...

Tuesday, February 12, 2013

অবশেষে মুখ খুললেন ওসামার হত্যাকারী মার্কিন কমান্ডো


মার্কিন নেভি সিল কমান্ডো দলের যে সদস্য পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন, তিনি এবার গোপনীয়তা ভেঙে তাঁদের অভিযানের বর্ণনা দিয়েছেন। এক মার্কিন সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, ওই রাতে ওসামাকে পরপর তিনবার গুলি করা হয়েছিল। এ ছাড়া বর্তমানে বেকার অবস্থায় একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তিনি যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন, তারও বর্ণনা দেন ওই মার্কিন কমান্ডো।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত ‘এস্কয়ার’ নামের সাময়িকীতে ওই কমান্ডোর সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হয়। এ সাক্ষাত্কারে নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে না চাইলেও ২০১১ সালের মে মাসের ওই দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা দেন তিনি। পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথাও বলেন ওই কমান্ডো।
বিন লাদেনকে হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সে সময় লাদেনকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল এবং আমার ধারণার চেয়ে তিনি ছিলেন লম্বা।’ যখন কমান্ডোরা অ্যাবোটাবাদের বাড়িটির তিনতলায় পৌঁছেন, তখন লাদেন তাঁর ছোট স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কমান্ডোদের দেখে তিনি তাঁকে সামনে ঠেলে দেন। ওসামার পাশে একটি একে-৪৭ রাইফেল ছিল। কমান্ডো বলেন, ‘আমি ঠিক জানি না, তাঁকে (লাদেনের স্ত্রী) আগে থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া ছিল কি না এবং তাঁকে সামনে এগিয়ে দিয়ে দুজনে শহীদ হয়ে যাওয়ার মতো কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা। ওসামার হাতের কাছেই ছিল অস্ত্রটি আর আমাদের জন্য তিনি ছিলেন হুমকি। তাই আমি দ্রুত তাঁর মাথায় গুলি করি, যাতে তিনি আত্মহত্যার সুযোগ না পান।’
কমান্ডো আরও বলেন, ‘ওই সময় আমি তাঁর কপালে পরপর দুবার গুলি করি। দ্বিতীয়বারে তিনি তাঁর বিছানার সামনে লুটিয়ে পড়েন। এরপর আমি তাঁকে আবার গুলি করি। সে সময় তিনি নিশ্চল হয়ে পড়েছিলেন। জিহ্বা বেরিয়ে গিয়েছিল তাঁর।’
‘এস্কয়ার’ ম্যাগাজিনে ‘দ্য ম্যান হু কিল্ড ওসামা বিন লাদেন ... ইজ স্ক্রুড’ শিরোনামে প্রকাশিত সাক্ষাত্কারে কমান্ডোকে ‘দ্য শ্যুটার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নেভি সিলের এ সদস্যকে পেনশন, স্বাস্থ্যবিমা ও পরিবারের নিরাপত্তাবঞ্চিত এক ‘বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

Friday, February 1, 2013

সোভিয়েত ভেটো ছাড়া বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হতে পারত না :মহিউদ্দিন আহমদ



একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে এক শক্ত অবস্থান প্রকাশ্যেই নেয় এবং এই প্রকাশ্য অবস্থানটি আমাদের বিজয় পর্যন্ত প্রবলভাবেই অব্যাহত থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক রাশিয়া সফরের আগে-পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নন্দিত অবস্থান এবং তার মূল্যায়ন আমাদের পত্রপত্রিকা এবং টিভির খবর বা টকশোগুলোতে যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয় না। শুরুতেই একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। ’৭১-এর সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আর নেই বটে, তবে রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৩টি অঙ্গরাষ্ট্রের মধ্যে প্রথম থেকেই সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ছিল; সাইজ এবং ঐতিহাসিক মান মর্যাদায়ও ১৩টি অঙ্গরাষ্ট্রের মধ্যে শীর্ষে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাশিয়াকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সাকসেসর’ রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছে দুনিয়ার অন্যসব দেশ। জাতিসংঘেও এই ‘সাকসেসর’ রাষ্ট্র রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের জায়গায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই ভেটো ক্ষমতার অধিকারী; ভেটো ক্ষমতার অধিকারী অন্য ৪টি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের মতোই। অবলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সব দায়দেনার দায়িত্বও এখন এই রাশিয়ার। বস্তুত ১৯১৭ সালে যে বিপ্লবের মাধ্যমে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্তন, তাও তো শুরু হয়েছিল সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানীতে। সুতরাং ’৭১-এর সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের যে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছিল তার প্রায় সবটুকু কৃতিত্ব রাশিয়াকেই দেয়া যেতে পারে, জানানো যেতে পারে আমাদের কৃতজ্ঞতাও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান রাশিয়ার জনগণ, সরকার ও নেতৃবৃন্দকে তাঁর এই সাম্প্রতিক সফরকালে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যথার্থ কাজটিই করেছেন।
॥ দুই ॥
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। আর তার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে, ৩রা এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে এই বার্তাটি পাঠান :
The report that the talks in Dhaka had been broken off and the military administration had found it possible to resort to extreme measures and used armed forces against the poulation of East Pakistan was met with great alarm in the Soviet Union.
The Soviet people cannot but be concerned by the numerous casualties, by the sufferings and provations that such a development of events brings to the people of pakistan. Concern is also caused in the Soviet Union by the arrests and persecution of M. (Sheikh Mujibur) Rahman and other politicians who had received such convincing support by the overwhelming majority of the population of East Pakistan at the recent General Election...
“... continuation of repressive measures and bloodshed in East Pakistan, will undoubtedly, only make the solution of the problems more difficult and may do great harm to the vital interests of the entire people of Pakistan.
``We consider it our duty to address you...with and insistent appeal for the adoption of the most urgent measures to stop the bloodshed and repressions against the population in East Pakistan and for turning to methods of a peaceful political settlement.”
(তর্জমা : ঢাকায় রাজনৈতিক আলোচনা ভেঙ্গে গেছে এবং তারপর সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজনের ওপর কঠোর সব ব্যবস্থা ব্যবহার করছে, খবর শুনে সোভিয়েত ইউনিয়ন শঙ্কিত বোধ করছে।
এতসব আহত-নিহত, কষ্ট-যন্ত্রণার খবরে সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষগণ উদ্বিগ্ন। সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য রাজনীতিবিদরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজন থেকে সাধারণ নির্বাচনে যে বিশাল সমর্থন পেয়েছেন, তাদের গ্রেফতার এবং নির্যাতনের খবরে সোভিয়েট ইউনিয়ন উদ্বিগ্ন।
....পূর্ব পাকিস্তানে এমন রক্তপাত এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চলতে থাকলে সমস্যার সমাধান আরও কঠিন হয়ে পড়বে এবং পাকিস্তানের সকল মানুষের জন্যও তা দারুণ ক্ষতিকর হবে।
এই অবস্থায় আপনাকে এই কথাগুলো বলা আমাদের দায়িত্ব মনে করি। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজনের ওপর এখন যে নিপীড়ন, রক্তপাত চলছে তা দ্রুত বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের পথ গ্রহণ করতে আপনার কাছে আবেদন করছি।)
এখানে লক্ষ্য করার বিষয়গুলো হচ্ছে, (১) আমাদের মুজিবনগর সরকার তখনও গঠিত হয়নি, তার ৭ দিন আগেই সোভিয়েট ইউনিয়নের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে এই বার্তা; (২) পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিপুল-বিশাল বিজয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; (৩) পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজনের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালানোর কথা বলা হচ্ছে এই বার্তায়; (৪) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারে সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বার্তায়; (৫) মিলিটারি দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে পরামর্শ দিচ্ছেন সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট। বলতেই হয়, যে কোন কূটনৈতিক বিবেচনাতেই এটি একটি কঠোর বার্তা। কঠোর বার্তা আরও এই কারণে যে, এটি তখনকার দিনের দুটো ‘সুপার পাওয়ার’-এর একটির শীর্ষ পর্যায় থেকে পাঠানো হয়েছিল।
এমন একটি ‘সুপার পাওয়ার’-এর এই বার্তাটি তাৎক্ষণিকভাবে দুনিয়ার অন্য ‘সুপার পাওয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও একটি বার্তা ছিল। বার্তা ছিল মাও সে-তুংয়ের চীনের জন্যও।
আর অবশ্যই ভারত এই বার্তাটি দেখে বাংলাদেশের প্রতি তার নীতি এবং করণীয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিল, সাহস বেড়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের, মুক্তিযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আমাদের নেতা নেত্রীদের।
এই বার্তাটির মাধ্যমে সোভিয়েত সরকার পাকিস্তান এবং তার জেনারেলদের আরও বেইজ্জত করেছিল অন্য একভাবে। বার্তাটি ইয়াহিয়া খানের হাতে পৌঁছানোর আগেই সোভিয়েত সরকার বার্তাটি তাদের সংবাদ সংস্থা ‘তাস’-এর মাধ্যমে ‘রিলিজ’ করে দেয়। এর ফলে ইয়াহিয়া খান বার্তাটি পড়ার আগেই দুনিয়ার মানুষজনের কাছে এটি পৌঁছে যায়।
॥ তিন ॥
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে কোন ফরেন মিনিস্টার ছিল না। ফরেন সেক্রেটারি সুলতান এম খান একই সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনেক দায়িত্বও তখন পালন করেছেন। ভারতের ভুপালে জন্ম, এই সুলতান এম খান ফরেন সেক্রেটারী হওয়ার আগে-পরে কানাডা,চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,জাপান এবং আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম কেরিয়ার ফরেন সার্ভিস থেকে ফরেন সেক্রেটারী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল এই মানুষটির ওপর তখন কেমন সব গুরুতর ঝড়ঝাপটা গেছে তার বর্ণনা আছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘মেমোরি এ্যান্ড রিফ্লেকশনস অব অ্যা পাকিস্তানী ডিপ্লোম্যাট’ বইটিতে।
সমস্যা, সঙ্কট গুরুতর, তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হচ্ছে, আক্রমণ হামলাও চলছে, লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, দুনিয়ার বিভিন্ন রাজধানীতে এবং নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতর, জেনেভার শরণার্থী হাইকমিশনারের দফতরে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে, জোরালো হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বিভিন্ন দেশ সফর করছেন, ’৭১-এর জুন মাসে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার গোপন সফরে যান পিকিংয়ে, ইসলামাবাদ থেকে। তার আগে তিনি নতুন দিল্লী সফর করেছেন। নতুন দিল্লী সফর শেষে ইসলামাবাদ গিয়ে ভারতের ‘হকিশ্্, মুড’, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, পূর্ব পাকিস্তানের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট এবং ‘রিফ্যুজি’ সমস্যার সমাধানের কথাবার্তা শুনে এসেছেন বলে ইসলামাবাদে ‘ওয়ার্নিং’ জানিয়ে আসেন। কিন্তু সুলতান খান বলেছেন তাঁর বইতে, ইয়াহিয়া খান গ্রাহ্যই করলেন না হেনরি কিসিঞ্জারের সতর্ক বার্তা। বরং তিনি পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার ক্ষমতায়, তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস দেখাতে থাকলেন। ইতোমধ্যে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তিও সম্পাদিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি সামরিক সাহায্য নিয়ে আসার আগে, ভারতের বড় প্রতিবেশী, মাও সে-তুংয়ের চীন যেন ভারতের বিরুদ্ধে উত্তর সীমান্তে কোন সামরিক চাপ সৃষ্টি করতে না পারে, তা প্রতিহত করতেই ভারতের এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। ভারতের উত্তর সীমান্তে চীন যদি সৈন্য সামন্ত জড়ো করতে থাকে, তাহলে ভারতের সাহায্যে এই চুক্তির আওতায় সোভিয়েত ইউনিয়নও চীনের উত্তর সীমান্তে সৈন্য জড়ো করবে, এমন একটি ধারণা তখন কূটনীতিক মহলে প্রবল ছিল। বস্তুত, চীনকে ‘নিউট্রালাইজ’ করার জন্যই এই চুক্তিটি তখন জরুরী ছিল।
তো সোভিয়েত ইউনিয়নকে তার পাকিস্তানবিরোধী এমন প্রকাশ্য অবস্থান থেকে সরিয়ে আনাটা, সরিয়ে আনা সম্ভব না হলে অন্তত নমনীয় করা যায় কিনা তা দেখতে সুলতান খান মস্কো সফরের সিদ্ধান্ত নিলেন ইয়াহিয়া খানের অনুমোদন নিয়েই। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেলেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান সফরের আগে প্রত্যাশিত সাক্ষাৎকারটি দেন না, ফরেন সেক্রেটারি সুলতান খানকে। এই প্রসঙ্গে সুলতান খানের দুরবস্থার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এইভাবে তার বইতে-
I requested a meeting with the president. but his military secretary kept telling me that the President was extremely busy and I seriously thought of postponing my trip. Finally, one day before my departure for Moscow, the President phoned and said that he was aware that I wished to see him and asked what I wanted to discuss with him. I explained that I had to get his approval for the brief for my visit. to Moscow, and also seek advice and guidance on some important issues of our domestic policies, as these were bound to come up in Moscow. The President’s response was, ‘You know what my views and plans are. I don’t think your visit will achieve much, but go ahead and do your best. You have my Support,’ No emissary could have had a more open-ended brief, but I was left with a feeling that the President did not fully appreciate the purpose and significance of my visit to Moscow, or the Soviet capability of doing damage to Pakistan, especially after the conclusion of the Indo-Soviet treaty.’
(তর্জমা : প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম তার নির্দেশ পরামর্শ নিতে। কিন্তু তার মিলিটারি সেক্রেটারি আমাকে জানালেন প্রেসিডেন্ট খুবই ব্যস্ত। এক পর্যায়ে ভেবেছিলাম, সফর স্থগিত করে দেব কিনা। আমার রওনা হওয়ার আগের দিন, প্রেসিডেন্ট আমাকে টেলিফোন করে বললেন, আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছ, তো তুমি আমার সঙ্গে কি আলোচনা করবে? আমি বললাম, আমি যে মস্কো যাচ্ছি, আমরা যে ‘ব্রিফ’ তৈরী করেছি, তাতে তো আপনার অনুমোদন লাগবে; আর আপনার যদি বিশেষ কোন আদেশ নির্দেশ থাকে। প্রেসিডেন্ট জবাবে বললেন, তুমি তো আমার অবস্থান জান; আমার মনে হয় না তোমার এই সফরে কিছু অর্জন করতে পারবে। তবুও যেতে চাইছ, যাও, দেখো কি করতে পার। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এমন কথাবার্তার পর সুলতান খানের মন্তব্য, কোন কূটনীতিবিদকেই এমন অসীম ক্ষমতা দেয়া হয় না; কিন্তু আমি তা পেলাম। কিন্তু তাতে আমার এই ধারণাটাও হলো যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার এই সফরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রেসিডেন্ট ঠিক বুঝতে পারেননি। তিনি বুঝতে পারেননি, সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কেমন ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির পর)
॥ চার ॥
১৯৭১-এর ৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে ফরেন সেক্রেটারি সুলতান খান দেখা করেন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে মস্কোতে; সাথে ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জামশেদ মার্কার। (আমার মতো যাদের বয়স ৭০-এর আশপাশে তারা এই নামটির সঙ্গে পরিচিত থাকার কথা। ওমর কোরেশী-জামশেদ মার্কার টিম তখন ক্রিকেট কমেন্টেটর হিসেবে পাকিস্তানে মশহুর ছিলেন। ১৯৬৮তেই বোধ হয় তিনি প্রথম ঘানা গেলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তারপর কূটনীতিবিদের জীবন, আট দশটি দেশে রাষ্ট্রদূত থাকার পর জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি ১৯৯১-৯তে, আমি তখন নিউইয়র্কে আমাদের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে উপ স্থায়ী প্রতিনিধি। পার্সি সম্প্রদায়ের এই মানুষটি বাংলাদেশের খবর জানতে চাইতেন, আমাকে স্নেহ করতেন, সম্মান জানাতেন। নিউইয়র্কের কূটনৈতিক মহলে জনপ্রিয় ছিলেন) গ্রোমিকোর সঙ্গে এই সাক্ষাতকালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সুলতান খান কি বলবেন, কি বলেছেন তা আমাদের মোটামুটি জানা আছে। কিন্তু সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো কি বলেছিলেন তাদের দু’জনকে সেদিন, সুলতান খানের আলোচ্য বইয়ের ‘ভিজিট টু মস্কো এন্ড টকস্ উইথ ফরেন মিনিস্টার গ্রোমিকো’ চ্যাপ্টারটির ২৫ পৃষ্ঠায় অনেকটুকু জায়গা জুড়েই তার উৎকৃষ্ট বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা আছে। সুলতান খান যেদিন আলোচনার যে নোট নিয়েছিলেন তার অনেকটুকুই এই চ্যাপ্টারে তিনি উদ্ধৃত করেছেন। তার সবটুকু যদি তুলে দিতে পারতাম আমি তৃপ্তি পেতাম। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তাই কিছু অংশমাত্র। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে গ্রোমিকো সেদিন কি বলেছিলেন, সেই প্যারাটি নিচে উদ্ধৃত করছি :
In the U.S.S.R and other countries, people believe with anxiety and concern that the well known Mujibur Rahman will be brought to court. Irrespective of your attitude, hardly anyone would deny his importance as a leader, or his caliber, irrespective of one’s political sympathies or antipathies. We knew very little of him. It was only later that his character as a leader became important. This deep concern runs parallel to the humanitarian argument, and has an objective basis. In the present tense situation, to take any steps against Mujibur Rahman would create new difficulties for the solution of the problem. I would like to say that a severe sentence on Mujibur Rahman would be denounced by both the Soviet people and world public opinion. How do you view the situation? It is neither the right approach, nor will it be useful to you. I am talking straightforwardly and not resorting to diplomatic subtleties.’
(বাংলা তর্জমা : মুজিবুর রহমানের মতো একজন স্বনামধন্য মানুষকে আদালতে তোলা হবে এই খবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং দুনিয়ার অন্যান্য দেশ উদ্বিগ্ন এবং বিচলিত। আপনারা যাই বলুন না কেন, নেতা হিসেবে তাঁর গুরুত্ব, রাজনৈতিক পছন্দ অপছন্দ যার যা-ই থাকুক না কেন, তাঁর যোগ্যতা তো-কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমরা শুরুতে তাঁর কথা কমই জানতাম। কিন্তু নেতা হিসেবে তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী আমরা পরেই জানলাম; তাঁর গুরুত্বও তখন জানলাম। এমন উত্তেজনাকর সময়ে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিলে তা তো সমস্যার সমাধান আরও জটিল করে তুলবে। আমরা বলতে চাই যে, মুজিবুর রহমানকে কোন কঠোর শাস্তি দিলে তার নিন্দা জানাবে সোভিয়েত জনগণ, দুনিয়ার মানুষজন।
এমন ব্যবস্থা গ্রহণ ঠিক হবে না, আপনাদের জন্য উপকারীও হবে না। আমি আপনাদের সঙ্গে সোজাসাপটা কথাই বলছি, আমি কূটনীতির সূক্ষ্ম ভাষায় কথা বলছি না।)
রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পরামর্শ দেন আন্দ্রে গ্রোমিকো। তিনি শরণার্থীদের সংখ্যা ৮০ লাখে উল্লেখ করে সুলতান খানদের প্রশ্ন করেন, জাতিসংঘের অর্ধেক সদস্য রাষ্ট্রের জনসংখ্যা তো ৮০ লাখ নয়!!
(পাঁচ)
গ্রোমিকো সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে যেমন কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন, ভদ্র কূটনৈতিক ভাষায় পাকিস্তানকে যেমন ‘ড্রেসিং ডাউন’ দিয়েছিলেন তার বেশি অন্য কোন দেশ তখন দিতে পারত বলে মনে হয় না।
কিন্তু সুলতান খান দেশে ফিরে এসে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে যে রিপোর্ট দিলেন তার প্রতিক্রিয়ায় ইয়াহিয়া খান কি লিখলেন তার উল্লেখ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতাকে কিভাবে ইয়াহিয়া খান অবমূল্যায়ন করেছেন, তার বর্ণনা সুলতান খান এমনভাবেই দিয়েছেন; মস্কো সফরের মূল্যায়নও তিনি করেছেন এখানে :
The President’s observation on my lengthy submission reads : “I am glad this visit has at least restated our position.”
It confirmed the view I had before going to Moscow that Yahya Khan was not particularly interested in what the Soviet Union might or might not do with regard to East Pakistan developments. Unfortunately, he seriously underestimated their capability for inflicting damage, and over-estimated the U.S. willingness and ability to restrain India and help Pakistan.
It was the most difficult situation I had faced in the 31 years of my diplomatic career. The accusations of `repression and bloodshed’ by Gromyko had jarred on my ears, and I had defended the interests of Pakistan as best I could, but, knowing that was true, I felt morally at a disadvantage. On the question of refugees, too, our position was weak. Allowing for the fact that there were not 8 million of them, as claimed by India, how does one justify even two million, as we claimed, leaving their homes and hearths to seek shelter in India? It was like Bhutto (in his interview with Oriana Fallaci) saying that during the night of 25th March, 1971, only 50,000, and not a 1,00,000, people were killed in Dhaka. Even in World Wars I and II, there is no record of 50,000 people being killed in battle in a day or night_ leaving out the atomic holocaust of Hiroshima and Nagasaki. And we were not battling an alien enemy, but undertaking a “pacifying” campaign in our own country. How does one explain to oneself, or to well informed representatives of other countries, that we killed 50,000 of our own people in one night in order to bring peace and discipline in the country? What is more, repression became a normal feature after 25th March 1971, and Yahya Khan, as President and Commander-in-Chief, was aware of it, but helpless to stop it.
My defence of our policies in Moscow, where detailed information was available, had little effect on Gromyko. My talks with him fell into the category of a “free and full exchange of views,” which, in diplomatic language, means an unpleasant and tough session. The Soviets had made up their minds that the only solution to the problem faced by Pakistan was the transfer of power to the elected representatives, i.e., to Sheikh Mujib, with all its implications, which by then meant nothing less than the creation of Bangladesh.
মস্কো সফরকালে পাকিস্তানের এই পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খান ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে যেসব যথার্থ প্রশ্নের সম্মুখীন হন এবং এসব প্রশ্নের জবাবে যেসব কথা বলেছিলেন, তার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর নিজের মনেই সন্দেহ সংশয় ছিলো। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেছেন ভারতীয়রা তখন বলছিলেন আট মিলিয়ন,-আশি লাখ শরনার্থী তখন ভারতের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন তা বিশ্বাসও করেছিল কিন্তু আমরা (মানে সুলতান খানরা) বলছিলাম, আট মিলিয়ন-আশি লাখ নয়। প্রকৃত সংখ্যা দুই মিলিয়ন-বিশ লাখ। তো বিশ লাখ লোকই বা কেন তাদের নিজ দেশ ছেড়ে ভিন্ন এক অজানা দেশে আশ্রয় নিতে যাবে? এর জবাব কি?
তারপর ১৯৭২এ, সারা দুনিয়াখ্যাত ইটালীর সাংবাদিক ওরিয়ানা ফারাসীকে যা বললেন, ‘৭১এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে এক লাখ নয় পঞ্চাশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল। তো আনবিক বোমা হামলায় জাপানের হিরোসিমা এবং নাগাসাকি শহর দুটি ছাড়া দুনিয়ার আর কোথায় একদিনে পঞ্চাশ হাজার লোক মারা হয়েছিলো? প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও কি একদিনে এত লোককে মার হয়েছিল? তাও আবার নিজ দেশের লোককে? শান্তি শৃংখলা রক্ষার নামে?
সুলতান খান তারপর বলছেন তাঁর এই সফরে গ্রোমিকোর উপর কোন ‘আছর’ পড়েনি। তারা ইতোমধ্যেই ঠিক করে নিয়েছিল,নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, মানে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে,এবং তার অর্থ হলো বাংলাদেশ সৃষ্টি।

॥ পাঁচ ॥
১৯৭১-এর ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে-ভারত-পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব আনে তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় প্রস্তাব এনেছিল আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিওন এবং সোমালিয়া ৫ ডিসেম্বর। এই প্রস্তাবেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। তৃতীয় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থান করা হয়েছিল ‘৭১-এর ১৩ ডিসেম্বর। এই প্রস্তাবটিও ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু এই প্রস্তাবেও ভেটো প্রয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরপর তিন তিনটি ভেটো প্রয়োগ করে পাকিস্তানের দোস্তদের যুদ্ধবিতির প্রস্তাবগুলো বাতিল করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র ১০ দিনে। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের যে কোন একটি তখন গৃহীত হলে যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে হতো তাৎক্ষণিকভাবে, ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীও তাহলে ঢাকার দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারত না, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে হতো না জেনালে নিয়াজীকে। তারা তাহলে আরও সময় পেত। এই পর্যায়ে অবশ্য অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে যখন এমন তৎপরতা চলছে, তখন বঙ্গোপসাগরেও ‘গানবেটড ডিপ্লোম্যাসি’ নতুন মাত্রা পায়। মার্কিন সপ্তম নৌবহর দ্রুত এগুতে থাকে বাংলাদেশের দিকে। সন্দ্বিপ, হাতিয়া, ভোলার কোথাও যদি কোন একটি জায়গায় সেদিন তারা নোঙ্গর ফেলতে পারত, তাহলে তারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে দরকষাকষিও শুরু করতে পারত। কিন্তু এই সপ্তম নৌবহরকে অনুসরণ করতে থাকে সোভিয়েত নৌবাহিনীর একটি ‘ ফ্লোটিলাও’। মনে আছে লন্ডনে তখন আমাদের অনেকেরই হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। একটুর জন্য, জন্য কি তাহলে আমাদের বিজয়টা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যাবে? কিন্তু মার্কিন নৌবাহিনী নোঙ্গর ফেলার আগেই ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী।
নিউইয়র্কে সোভিয়েত রাষ্ট্রতদূত জ্যাকব মালিক তখন নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে তখন বলেছিলেন, চৌধুরী ভয় পেয়ো না; মার্কিন নৌবাহিনীর পেছনে পেছনে আমরাও আছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানে তারা কি করলে আমরা কি করব।
লক্ষ্য করার বিষয়, এই সোভিয়েত ইউনিয়ন, এই আন্দ্রে গোমিকোরাই ১৯৬৫-এর সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষে ১৯৬৬-এর জানুয়ারিতে তাসখন্দ চুক্তির আয়োজন করেছিল। তাদের তখন মনে হয়েছিল, ভারতের পক্ষে এতদিনের অনুসৃত নীতি থেকে পাকিস্তানের দিকে একটু সরে আসছে; কিন্তু সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার সরাসরি অবস্থান নিল ভারত এবং বাংলাদেশের পক্ষে মাত্র ৬ বছর পর।
সুলতান খান তাঁর বইতে আরও উল্লেখ করেছেন, ১৯৬৯ এ সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, তোমরা একই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের বন্ধু হতে পারবে না; তোমাদের যে কোন একটিকে পছন্দ করে নিতে হবে। চীন তখন দক্ষিণ এশিয়ায় কেমন উত্তেজনা সৃষ্টি করে চলেছে, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, তাও উল্লেখ করেছিলেন গ্রোমিকো।
সোভিয়েত ইউনিয়নকে অবমূল্যায়ন করে কেমন খেসারত দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান, তার বারবার উল্লেখ করেছেন সুলতান খান। কোন পরাশক্তিকে অবমূল্যায়ন করা, চটানো, খোঁচানো আমাদেরও উচিত নয়। পছন্দ করি বা না করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন অসীম ক্ষমতা রাখে ক্ষতি করার, বিশেষ করে আমাদের মতো দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোর। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নও নেই; নেই আর কোন পরাশক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন দুনিয়ার অনেক জায়গাতেই যা চাইছে, তা করছে; যা চাইছে, তা ঘটাচ্ছে।
॥ ছয় ॥
এ লেখার শেষে আমোদ ও একই সঙ্গে ক্ষোভের কয়েকটি কথার উল্লেখ করি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন তো ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত আমাদের পক্ষে তিন তিনটি ভেটো দিল। আমাদের বিজয় এবং স্বাধীনতাকে এই ভেটোগুলো ত্বরান্বিতও করল।
কিন্তু আমরাও যে মাত্র ৮ মাসের মাথায় ভেটো খেলাম! মানে, আমাদের বিরুদ্ধেও যে ভেটো প্রয়োগ করা হলো!! এই ভেটোটি প্রয়োগ করেছিল চীন, বিএনপি-জামায়াতীদের ‘পরীক্ষিত বন্ধু’!! আমরা যখন ১৯৭২-এর ২৫ আগস্ট জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য দরখাস্ত করলাম। ভারত, সোভিয়েট ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং যুগোসøাভিয়া আমাদের সদস্যপদের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে, তাতে ভেটো দেয় আমাদের এই ‘পরীক্ষিত’ বন্ধু’; আর তাতে আমাদের সদস্যপদ প্রাপ্তি পিছিয়ে যায় আরও দুই বছর। আমাদের জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য যখন ১৯৭৪-এর ১৭ সেপ্টেম্বর আবার প্রস্তাব উঠানো হয়, তখন পরীক্ষিত বন্ধু আর ভেটো দেয়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের স্বীকৃতি দিল, ১৯৭২-এর ২৫ জানুয়ারি ১২ নম্বর দেশ হিসেবে, প্রথম পরাশক্তি হিসেবে। ’৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারত প্রথম দেশ এবং ৭ ডিসেম্বর ভুটান দ্বিতীয় দেশের পর। পূর্ব জার্মানি, নেপাল, বার্মাসহ আরও কতগুলো দেশ জানুয়ারির প্রথমদিকে আমাদের স্বীকৃতি দেয় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে। চীন দেয় ১৯৭৫-এর ৩১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর, সর্বশেষ ১২২ নম্বর দেশ হিসাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ এর ৪ এপ্রিল।
গত ১৪ জানুয়ারি আমাদের ‘শিউলীতলা’য় আমাদের লন্ডন ৭১-এর ‘ফকির সমিতি’র (একাত্তরে যুক্তরাজ্যে ‘স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি’র কনভেনর এ. জেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুর মেয়ে মনীষার ভাষায় ‘বেগারস ব্রিগেড’-এর) এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে মঞ্জু এবং আমাদের এক সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ’৭১-এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন, মাও সে তুং-এর বন্দনা করে লেখা এক স্মারক লন্ডনের চীনা দূতাবাস তখন গ্রহণ করার জন্য দরজাটাও খোলেনি। জনাব খায়রুল হক তখন লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ছিলেন।
’৭১-এর ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সদ্য খুঁজে পাওয়া ‘দোস্ত’ চীন, এই দেশগুলোর ভূমিকাগুলোর তুলনা করতে বিস্মৃতপরায়ণ বাংলাদেশীদের অনুরোধ করি।
‘শিউলীতলা’, উত্তরা, ঢাকা;
বৃহস্পতিবার ২৪ জানুয়ারি, ২০১৩
Mohiudduahmed 1944@yahoo.com

Wednesday, January 30, 2013

রাশিয়া হতে অস্ত্র ক্রয় নিয়ে অহেতুক দড়ি টানাটানি :প্রফেসর আবদুল মান্নান



Saturday, January 26, 2013

রাশিয়ায় তিন দিনের সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। তার এই সফর নিয়ে আলোচনা সমালোচনা তর্ক বিতর্ক এখনো পত্র পত্রিকায় চলছে, চায়ের টেবিলও বাদ যাচ্ছে না । প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত বিরতি দিয়ে বিদেশ সফর করেন, কিন্তু অতীতে কখনো তার অন্য কোন সফর নিয়ে এতো কথাবার্তা হয়েছে বলে মনে হয়না যেমনটি তার রাশিয়া সফর নিয়ে হচ্ছে । ১৯৭২ সনের পর এটি বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের রাশিয়ায় এটি দ্বিতীয় দ্বিপাক্ষিক সফর, যদিও শেখ হাাসিনা ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে টাইগার সামিটে যোগ দিতে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ সফরে গিয়েছিলেন । ১৯৭২ সনে ১ হতে ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাশিয়া সফর করেছিলেন । যদিও সে সফরটি ছিল অনেকটা একটি নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি বন্ধু প্রতিম দেশে প্রথম সফর-তথাপি সেই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশ সমূহ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি । একাত্তরে আমদের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক পরিম-লে রাশিয়া (তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন) অসামান্য অবদান রেখেছিল । ১৯৭১ এর ৩ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত করার জন্য যখন চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয় তখন পাকিস্তানের বন্ধুরা সেই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনটি পৃথক যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব আনে যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে ভেস্তে যায় । যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব যদি গৃহীত হতো তা হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল । নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বেও সামরিক ভারসাম্য নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক হয়েছে সত্য কিন্তু এখনো পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যে কয়েকটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে তার মধ্যে রাশিয়া সব চেয়ে শক্তিশালী এবং জাতি সংঘে তার ভেটো প্রয়োগ ক্ষমতা অটুট রয়েছে । অন্যদিকে একবিংশ শতকে যে কটি দেশ প্রথম দিকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে বলা হচ্ছে তার মধ্যে রাশিয়া অন্যতম । রাশিয়ার বর্তমান গড় উৎপাদনের পরিমাণ আনুমানিক ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ১৪ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটিতে বাংলাদেশের মতো একটি উদিয়মান অর্থনীতির দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করার অপার সম্ভাবন রয়ে গেছে ।
বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরের মাঝখানে প্রায় এক চল্লিশ বছর পার হয়েছে । এই একচল্লিশ বছরে রাশিয়ার সাথে আমাদের বন্ধুত্বের বেশ খানিকটা চিড় ধরেছে এবং ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার বেশ কয়েকজন কূটনীতিককে এই দেশ হতে বহিস্কারও করেছে । পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া আমাদের নতুন রাষ্ট্রদূত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং সে সময় আমাদের একটি বাণিজ্য মিশনের রাশিয়া সফর বাতিল করেছিল । অন্য কোন দেশের সাথে বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটি পূর্বে কখনো ঘটেনি অথচ এই রাশিয়া (সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন) বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ছিল একটি অসাধারণ বন্ধুপ্রতিম দেশ । এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তিন দিনের রাশিয়া সফর বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য একটি বড় ধরণের অর্জন বলতে হবে । কারো কারো মতে হঠাৎ করে বাংলাদেশের এই ‘রাশিয়া অভিযান’ তার সাথে অন্যান্য বন্ধু প্রতিম দেশগুলির সাথে বিরাজমান সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে । এই অন্যান্য দেশ বলতে সাধারণত আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে বুঝিয়ে থাকি । এমনটি ঘটার কোন কারণ নেই । কারণ বর্তমান রাশিয়া আর সত্তর আশির দশকের ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগের ভøাদিমির লেনিন প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন মিল নেই । বর্তমান রাশিয়া সার্বিক অর্থেই একটি বাজার অর্থনীতির দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই চায় রাশিয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নয়ন হোক । বাংলাদেশ রাশিয়া হতে চার বৎসরে যে এক বিলিয়ন ডলারের (আট হাজার কোটি টাকা) অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে তা নিয়ে বিভিন্ন জনে নানা প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করছেন । কেউ কেউ জেনে করছেন আর কেউ কেউ না জেনে ঢালাও মন্তব্য করছেন । কারো মতে রাশিয়ার অস্ত্র নি¤œ মানের আবার অন্যরা বলেন রাশিয়া বাংলাদেশকে বোকা বানিয়ে তাদের পুরানো অস্ত্র গছিয়ে দেবে । এই সব মন্তব্য যারা করেন তাদের এই বিষয়ে সঠিক তথ্যের প্রচ- ঘাটতি রয়েছে অথচ আন্তর্জাতিক অস্ত্রবাজার সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য ইন্টারনেট টিপলেই নানা তা সহজে পাওয়া যায় ।
রাশিয়া হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানি কারক দেশ (২৪%) । তার উপরে আছে শুধু যুক্তরাষ্ট্র (৩০%) । আবার সেই যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়া হতে সামরিক হেলিকপ্টার ক্রয় করে । ২০১১ সালে পেন্টাগন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রশোবোরনএক্সপোর্ট (জড়ংড়নড়ৎড়হবীঢ়ড়ৎঃ) হতে ৪১১ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২১টি এম-আই ১৭ হেলিকপ্টার ক্রয় করেছে । পেন্টাগন এটি স্বীকার করেছে আফগানিস্তানের মতো দূর্গম এলাকায় চলাচলের জন্য এই ধরনের হেলিকপ্টারের কোন বিকল্প নেই । যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ফ্র্যাঙ্ক কেন্ডাল গত বছর ২৭ জুলাই এই বিবৃতিতে বলেছেন ‘এই মুহুর্তে পেন্টাগন এম-আই ১৭ এর কোন ভাল বিকল্প খুঁজে পায়নি ।’ বাংলাদেশ অস্ত্রক্রয়ের যে চুক্তি করেছে তা এই মডেলের আরো উন্নত সংষ্করণ, এম-আই ১৭১ । শুধু রাশিয়া নয় বাংলাদেশ যদি অন্য কোন দেশের সাথে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করে তাহলে সেই অস্ত্র সংযোজনের প্রতিটি পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বহিনীর প্রকৌশলীরা পর্যবেক্ষণ করেন । তারা ছাড়পত্র দিলেই অস্ত্র সংযোজন কাজ শুরু হয় । এমনটি চলে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে । আর যদি বংলাদেশ কোন দেশ হতে পুরানো অস্ত্র ক্রয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় তা হলে অন্য কথা । সাধারণত যুদ্ধ জাহাজ ক্রয়ে অনেক সময় পুরনো জাহাজ ক্রয় করা হতে পারে । নতুন যুদ্ধজাহাজের আন্তর্জাতিক মূল্য অনেক বেশী । খুশির খবর বাংলাদেশ এখন নিজেই যুদ্ধজাহাজ তৈরী করা শুরু করেছে । রাশিয়া হতে অস্ত্র ক্রয়ে চীন নাখোশ হওয়ার কোন কারণ নেই কারণ চীন বাংলাদেশ সসস্ত্র বাহিনীর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। এই কিছুদিন আগে বাংলাদেশ চীন হতে ক্রয় করা ৪৪ টি ট্যাংক তার সাঁজোয়া বাহিনীতে সংযোজন করেছে । তবে চীনের সাথে সব সময় সব চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করেনা । বিগত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ ১১৭ মিলিয়ন ডলার ব্যায়ে চীন হতে ১৬ট এফ-৭ জঙ্গী বিমান ক্রয়ের চুক্তি করেছিল । চুক্তি সইয়ের একমাসের মাথায় বাংলাদেশকে কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হয় যদিও সে বিমানের কোন চালান তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি । এই বছর চীনকে তার এই বিমান ক্রয় বাবদ শেষ কিস্তি পরিশোধ করতে হবে । অন্যদিকে রাশিয়া হতে যে সমরাস্ত্র ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে তার প্রথম কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০১৮ সাল হতে এবং দশ বছরে বিশ কিস্তিতে তা পরিশোধ করতে হবে আর ক্রয় শেষ করতে হবে ২০১৭ সালের মধ্যে । কী কী অস্ত্র বা সরঞ্জাম বাংলাদেশ রাশিয়া হতে খরিদ করবে তার তালিকা বাংলাদেশে প্রস্তুত করবে । যেকোন মুহুর্তে বাংলাদেশ এই চুক্তি হতে বের হয়ে আসতে পারবে তবে তার জন্য তাকে ০.৭৫% সাভিস চার্জ দিতে হবে ।
যুক্তারাষ্ট্র হতে বাংলাদেশে তেমন কোন সমরাস্ত্র ক্রয় করেনা । তবে অতীতে জেনারেটর, ভারি উদ্ধার যান, পরিবহণ বিমান, ভ্রাম্যমান পানি শোধনাগার ক্রয় করেছে । পরিবহনের জন্য গাড়ী এসেছে জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি, জাপান আর কোরিয়া হতে । যুক্তরাজ্য হতে ক্রয় করেছে শব্দের দূরত্ব নির্ণয় যন্ত্রপাতি । বর্তমানে রাশিয়া হতে যে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের চুক্তি হয়েছে তার মাধ্য আছে এপিসি। ট্যাঙ্কের মতো দেখতে । ভিতরে দশ থেকে বার জন সৈনিক বসতে পারে । এমন যান বর্তমানে পুলিশেরও আছে । হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী রকেট, পন্টুন ব্রীজ, যা অনেক সময় রীলিফ কাজে ব্যবহার করা হয় । মোদ্দা কথা এই গুলির সবই সেনা বাহিনীকে গতিশীল করবে । কোনটিই আক্রমণাত্মক সরঞ্জাম নয় । এই তালিকা ইতোমধ্যে সামরিক কতৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করেছে । আর যেহেতু রাশিয়ার সাথে চুক্তিটি হয়েছে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে এবং সব সরবরাহই করা হবে রাশিয়ার রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান হতে সেহেতু এখানে কোন মধ্যস্বত্বভোগী নেই এবং কমিশন বাণিজ্যের কোন সুযোগও নেই । কেউ কেউ এই প্রশ্নও তুলেছেন এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে সামররিক সরঞ্জাম না কিনে তা কী শিক্ষা বা স্বাস্থ খাতে ব্যবহার করা যেত না ? অবশ্যই ভাল এবং এটি আদর্শ প্রস্তাব । তবে বাস্তবে যেহেতু এই অর্থ রাশিয়া হতে নির্দিষ্ট খাতের জন্য ঋণ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে তা অন্য কোন খাতে ব্যবহার করা যাবে না । আর এই অর্থটি যাবে সামরিক বাজেট হতে । এই সব ক্রয়ের জন্য বাড়তি কোন বরাদ্দ নেই । শুনতে খারাপ লাগলেও দাতা গোষ্ঠি বা ঋণ সহায়তা দেশগুলি যত সহজে মূলধনী যন্ত্রপাতি বা সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য অর্থ সাহায্য করতে চায় অথবা ঋণ দেয় তত সহজে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে দিতে চায়না । শেখ হাসিনার পূর্ববর্তি সরকারের আমলে আমি তৎকালিন যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দপ্তরে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শাটল ট্রেন চলাচল উন্নয়ন করার জন্য দেন দরবার করতে । তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন তার জন্য কোন বাজেট বরাদ্দ নেই । তার অফিস কক্ষে বেশ বড় বড় অনেকগুলি নব নির্মিত রেল সেতুর ছবি ছিল । তাকে বলি এর একটার অর্থ দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেনের বেশ উন্নতি ঘটানো সম্ভব । তিনি জানালেন এগুলি সবই বিদেশী সহায়তায় নির্মিত, আর তারা তাদের ভাষায় কোন অলাভজনক প্রকল্পের জন্য তেমন অর্থ যোগান দেয় না ।
চীন হতে বাংলাদেশ নিয়মিত সামিরক সরঞ্জাম ও অস্ত্র ক্রয় করে । তা নিয়ে তেমন কোন আলোচনা সমালোচনা হয়না; যেমনটি রাশিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে । মাঝে মঝে এই সব সমালোচনা বেশ কৌতুকউদ্দিপক । যেমন চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন বিএনপি নেতা সেদিন টেলিভিশনের এক টকশোতে বলছিলেন তার নেতা জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশ সেনা বাহিনীকে প্রথম আধুনিকায়ন করেছেন । তার কাছ হতে জানা গেল একবার পাঁচত্তরের পনেরই অগাষ্টের পর জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হ্উাজে অবস্থান কালে সেনা সদস্যরা পতাকা নামানোর সময় তিনি আবিষ্কার করলেন স্যালুটের সময় সেনা বাহিনীর বুটের আওয়াজ নেই । পরে তাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন তাদের পায়ে কাপড়ের জুতা । সম্পূর্ণ একটি ঢাহা অসত্য তথ্য । প্রথমে পতাকা নামানোর কাজটি ঐতিহাসিক ভাবে পুলিশের কাজ । সেনা বাহিনীর নয় । সেনা নিবাসের অভ্যন্তরে হলে তা অন্য কথা । দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত জিয়া সেনা বাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন । এই পদটি বঙ্গবন্ধু জিয়ার জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন । বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এই পদটি বিলুপ্ত করা হয় । বঙ্গবন্ধু জিয়াকে পূত্রবত ¯েœহ করতেন । তো একজন সেনা উপ-প্রধানকে কেন এতো দেরীতে আবিষ্কার করতে হবে সেনা বাহিনী কাপড়রে জুতা পরে তাদের ডিউটি করছেন ? বাস্তবে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কখনো কাপড়ের জুতা পরে ডিউটি করেনি । মুক্তিযুদ্ধের পর আমার কম পক্ষে ডজন খানেক বন্ধু সেনা বাহিনীতে থেকে গিয়েছিলেন । সেদিন তিনি আরো প্রশ্ন করলেন কার জন্য এত সব ট্যাঙ্ক ক্রয় ? আমাদের তিন দিকে মিত্রদেশ ভারত । দক্ষীণে বঙ্গোপসাগর । ট্যাঙ্কগুলি কী আমরা বঙ্গোপসাগরে চালাবো ? উনি ক্রয় তালিকায় ট্যাঙ্ক কোথায় পেলেন তা বুঝা গেলনা । আর ট্যাঙ্ক থাকলেও অসুবিধা কী ? কোন দেশতো বর্তমানে অন্যদেশ আক্রমন করার জন্য সমারাস্ত্র ক্রয় করে না । নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য এই সবের প্রয়োজন হয় । বাংলাদেশ তার প্রথম ট্যাঙ্ক সংগ্রহ করেছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে, মিশর হতে । তাও রাশিয়ায় প্রস্তুতকৃত । সেই ট্যাঙ্ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ।
সসস্ত্র বাহিনী এবং প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন রাশিয়ার সাথে চুক্তির আওতায় যে অস্ত্রগুলি সংগ্রহ করা হবে তা মূলতঃ জাতিসংঘ শান্তি রক্ষাবাহিনীতে ব্যবহারের জন্য । একজন সৈনিকের জুতা হতে শুরু করে পানির ট্যাঙ্ক, আসবাব পত্র, তাবু, ট্যাঙ্ক অথবা গাড়ী যাই আমাদের শান্তিরক্ষা বাহিনী তাদের কাজে ব্যবহার করে তার প্রত্যেকটিরই ভাড়া দেয় জাতিসংঘ । যেমন ১৯৯৯ সনে সাড়ে চাড় লক্ষ ডলার দিয়ে যে এপিসি বাংলাদেশ সেনা বাহিনী চীন হতে ক্রয় করেছে তার মাসিক ভাড়া আট হাজা ডলার । পাঁচ বছরে প্রতিটি এপিসির দাম উঠে এসেছে আর এপিসি গুলিও বাংলাদেশের রয়ে গেছে । শান্তি রক্ষা মিশনে একটি যুদ্ধ বিমান উড়লে ঘন্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ হতে আড়াই হাজার ডলার ভাড়া পায় । আনুমানিক তিন বছরে এর মূল্য উঠে আসে । দেশে ফেরার সময় এই বিমান আমরা দেশে নিয়ে আসি । বর্তমান সরকারের আমলে মায়ানমারের সাথে আমাদের সমুদ্র সীমানা চিহ্নিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরের এক বিশাল এলাকা জুড়ে তার সার্বভৌমত্ব কায়েম করেছে । ইতোমধ্যে কক্সবাজারে বিমান বাহিনীর জন্য একটি নতুন ঘাঁটি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে । বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান বর্তমানে কৌশলগত দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এই সবের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে অবশ্যই একটি আধুনিক সসস্ত্রবাহিনী গড়ে তুলতে হবে । কোন দল ক্ষমতায় থাকলো তা তেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নয় । এই কথাগুলি কোন টকশোতে তেমন একটা কেউ বলেন না । সরকারের টকশো সমালোচকরা হয় অজ্ঞতা কারণে এই সব তথ্য সাধারণ মানুষকে পরিবেশন করেন না অথবা জেনে শুনে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেন ।
রাশিয়া হতে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি নিয়ে সসস্ত্র বাহিনী ছাড়াও খোদ প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন । এটিও একটি অভূতপূর্ব ঘটনা । একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এমনটিই হওয়া উচিৎ । এটি ঠিক যে অনেক সময় রাষ্ট্রিয় নিরাপত্তার কারণে অনেক তথ্য জনগনের সামনে তুলে ধরা যায় না । তবে যতটুকু করা সম্ভব ততটুকু কখনো করা হয় না । সে সব তথ্য ভিন্ন দেশের প্রকাশিত তথ্যেও সূত্র ধরে জনগনকে জানতে হয় । তবে প্রধানমন্ত্রী বা সসস্ত্র বাহিনী যতই বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দিক না কেন ব্যরিস্টার মওদুদ-তরিকুল ইসলাম গং এই সব নিয়ে আরো কিছুদিন অপরাজনীতি করতেই থাকবেন । তবে এতে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ক্ষতিগ্রহস্থ হওয়া উচিৎ নয় । বঙ্গবন্ধু একটি আধুনিক সেনা বাহিনীর গোড়া পত্তন করেছিলেন । এটি এখন বিশ্বে একটি সম্মানিত সেনা বাহিনী । তবে এই সেনা বাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু আর জিয়া নিহত হয়েছেন । তাদেরকে কিছু ক্ষমতা লোভী কর্মকর্তা দেশের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা জবর দখল করার জন্য ব্যবহার করেছেন । এদেও কারণেই এক এগারোর পর একটি অসাংবিধানিক সরকার জোর করে দুই বছর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল কে রেখেছিল। দেশের মানুষ আশা করে আগামীতে তেমন কোন ক্ষমতা লোভি গোষ্ঠির হাতে তারা আর কখনো ব্যবহৃত হবেন না।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। জানুয়ারী ২৫, ২০১৩

Sunday, January 27, 2013

রক্ষীদের দুষ্কৃতী-যোগের অভিযোগ ;পাচারে মদত বিএসএফেরই, রিপোর্ট ডিজি-র



জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা
সীমান্তে নজরদারির দায়িত্ব যাদের, তাদের মদতেই চলছে পাচার! অন্তত রাজ্য পুলিশ-প্রধানের তেমনই অভিযোগ।
মুর্শিদাবাদ সীমান্ত থেকে আসা নথিপত্র-সহ রিপোর্ট পাঠিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় সরকারকে বলেছেন, বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের সঙ্গে যোগসাজশে এ দেশে অনুপ্রবেশে প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-র একাংশ। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠানো ডিজি’র রিপোর্টের সুপারিশ, সরকার এখনই বিষয়টি নিয়ে বিএসএফ-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুক। নচেৎ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত-এলাকা ক্রমেই মানুষ-মাদক-গরু পাচারের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠবে বলে ডিজি তাঁর রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ডিজি-র ‘বিস্ফোরক’ রিপোর্টটি পেয়ে মহাকরণের কর্তারা বিএসএফ-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। যে হেতু পুলিশের রিপোর্টে সরাসরি বিএসএফের বেশ কয়েক জন অফিসারের নাম করে অনুপ্রবেশে মদতদানের অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাই স্বরাষ্ট্র দফতর এ ব্যাপারে কড়া মনোভাব নিচ্ছে বলেই দফতর-সূত্রের খবর। “গুরুতর অভিযোগ। বিএসএফ-কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, মুর্শিদাবাদ সীমান্তে রক্ষকই ভক্ষক হয়ে উঠেছে।” মন্তব্য এক স্বরাষ্ট্র-কর্তার।
স্বরাষ্ট্র দফতরের খবর: গত ৭ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর সেখানকার সীমান্ত-এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিজি-কে একটি রিপোর্ট দেন। তাতে বলা হয়েছে, সীমান্তে এখন বিএসএফের একাংশই মানুষ পাচারে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে, যে জন্য বিএসএফের কেউ কেউ বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের সঙ্গে সংশ্রব রাখতেও কসুর করছেন না। এসপি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজশাহি জেলার সমাজবিরোধী মহম্মদ সইদুল ইসলামের সঙ্গে বিএসএফের কিছু অফিসারের যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। এসপি’র বক্তব্য: বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি)-এর গোদাবাড়ি আউটপোস্ট এলাকায় সক্রিয় সইদুল চর-আসারিয়াদহ, সাহেবনগর প্রভৃতি পয়েন্ট হয়ে রাজশাহি করিডর দিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে লোক ঢোকায়। বিএসএফের বেশ কিছু অফিসারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সইদুল এই কারবার চালিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করে এসপি’র রিপোর্টে অভিযোগ, এ ভাবে দু’পক্ষের যোগাযোগের মাধ্যমেই লাগাতার অনুপ্রবেশ চলছে। নিজের দাবির সমর্থনে তথ্যও পেশ করেছেন মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার। কী রকম?
এসপি জানিয়েছেন, গত ১৮ নভেম্বর রানিনগর থানা-এলাকায় বেশ কয়েক জন বাংলাদেশিকে পুলিশ পাকড়াও করে। তাঁরা এ দেশে ঢুকেছিলেন বিএসএফের ১৩০ নম্বর ব্যাটালিয়নের আওতাধীন কিছু এলাকা দিয়ে, মূলত কাহাড়পাড়া আয়রন ব্রিজ ধরে। এসপি’র দাবি: জেরার মুখে ধৃতেরা বলেন, বিএসএফের ইন্সপেক্টর শিবরাম শিবাজিরাও ভোঁসলে ও মুর্শিদাবাদ এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএসএফের ডিআইজি-সদর তাঁদের অনুপ্রবেশের কথা জানেন। পাশাপাশি সইদুলের সঙ্গে ওই সব অফিসারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কথা জানিয়ে ধৃতেরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘বোঝাপড়ার’ মারফতই তাঁরা এ দেশে ঢুকেছেন। এসপি জানান, পুলিশ অনুপ্রবেশকারী ওই দলটিকে গ্রেফতার করে তাঁদের থেকে আরও তথ্য পেয়েছে। পুলিশ সব খতিয়ে দেখছে।
মুর্শিদাবাদের পুলিশ-কর্তার রিপোর্টে বলা হয়েছে, মুর্শিদাবাদের সীমান্ত এখন অনুপ্রবেশের খোলা ময়দান হয়ে গিয়েছে। বিশেষত ভগবানগোলা, যেখানে বিএসএফের ১৫১ নম্বর ব্যাটালিয়ন মোতায়েন। এসপি’র রিপোর্ট মোতাবেক, ভগবানগোলা, লালগোলা, চর-লবণগোলার ৭ থেকে ১০ নম্বর পয়েন্ট দিয়ে মানুষ-মাদক-গরু অবাধে পাচার হচ্ছে, এমনকী আইরমারিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিতে কাঁটাতারের বেড়া খোলা রাখা হয়েছে। পুলিশের অভিযোগ: বিএসএফ সব জেনেশুনেও চুপ, কারণ তাদের একাংশই এই কাজের মদতদাতা। মুর্শিদাবাদের ১৫১ এবং ১৩০ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধীনস্থ এলাকা দিয়েই সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে জেলা পুলিশ মহাকরণকে জানিয়েছে।
৭ ডিসেম্বর এসপি’র ওই রিপোর্ট পেয়ে তা ১০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠিয়েছেন ডিজি। স্বরাষ্ট্র-সচিবকে তিনি লিখেছেন, বিএসএফের বিরুদ্ধে ওঠা এ হেন মারাত্মক অভিযোগ নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্ট স্তরে আলোচনা করুক, প্রয়োজনে তদন্ত হোক। ডিজি-র রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র দফতরও বিএসএফ-কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা চেয়েছে বলে মহাকরণের খবর। বিএসএফের কী বক্তব্য?
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের এডিজি বংশীধর শর্মা বলেন, “মহাকরণ থেকে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। এক আইজি পদমর্যাদার অফিসারকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। কাজ চলছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে বাহিনীর এক মুখপাত্রের দাবি, “বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, বিএসএফ সীমান্তে মাদক ও গরু পাচার রুখতে কড়া মনোভাব নিলেই পুলিশ অসুবিধায় পড়ে যায়। যে সব অফিসার কড়া মনোভাব দেখান, তাঁদের বিরুদ্ধে জেলা পুলিশের একটা অংশ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। দেখা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও তেমন কিছু ঘটেছে কি না।”

Friday, December 7, 2012

তোমরা যারা শিবির করো: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমি আমার অফিসে যাচ্ছি, তখন বারান্দায় আমার দুজন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলো, তারা আমাকে কিছু বলল না কিন্তু তাদের দেখে আমার মনে হলো, তারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও?’ তারা মাথা নাড়ল, একজন কুণ্ঠিতভাবে আমার হাতে দুটি বই তুলে দিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনাকে এই বই দুটি দিতে এসেছি।’ আমি বই দুটি নিলাম। বিজ্ঞানের ওপর চমৎকার দুটি বই, হাতে নিয়ে বললাম, ‘থ্যাংকু। সুন্দর পাবলিকেশন্স।’ তারপর বই দুটি খুললাম, ভেতরে লেখা ইসলামী ছাত্রশিবির।
মুহূর্তে আমার সারা শরীর শক্ত হয়ে গেল। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহ হয়ে এই দেশে যে ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সে জন্য আমি তাদের কখনো ক্ষমা করিনি। আমি জেনেশুনে কখনো কোনো জামায়াতে ইসলামীর নেতার সঙ্গে হাত মেলাইনি। আমার যে আপনজনেরা মুক্তিযুদ্ধে মারা গিয়েছে, তাদের সম্মান দেখানোর জন্য এটি আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমেরিকান এম্বাসির এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যখন আবিষ্কার করেছি, সেখানে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরও ডাকা হয়েছে, আমি সেখান থেকে উঠে চলে এসেছিলাম। আমি আমার এই বিশ্বাসের কথা কখনো গোপন রাখিনি। কাজেই এই দুজন ছাত্র সেটা জানে না, তা হতে পারে না।
আমি ছাত্রদের বই দুটি ফেরত দিয়ে অত্যন্ত কঠিন গলায় বললাম, ‘জামায়াতে ইসলামীকে আমি কোন চোখে দেখি, তোমরা জানো না? তোমরা সেই দলের মানুষ হয়ে তোমাদের সংগঠনের বই আমাকে উপহার দিতে এসেছ? তোমরা আমাকে চেনো না?’
ছাত্র দুটির চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বদর বাহিনীর প্রধান হয়ে নিজামী আর মুজাহিদ কী করেছে, তাদের মনে করিয়ে দিলাম। গোলাম আযম যুদ্ধের সময় কী করেছে এবং বাংলাদেশের জন্মের পরও কীভাবে তারা বিরোধিতা করেছে, সেই কথা বললাম। আমার মতো শিক্ষকেরা জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের তৈরি বদর বাহিনীর হাতে কীভাবে মারা গিয়েছে, সেই ঘটনাগুলো বলে তাদের কাছে জানতে চাইলাম, কম বয়সী তরুণ হওয়ার পরও তারা কেমন করে যুদ্ধাপরাধীদের একটা সংগঠনের সদস্য হতে পারল?
একজন ছাত্র দুর্বল গলায় বলল, ‘স্যার, আমরা তো জামায়াতে ইসলামী করি না। আমরা ছাত্রশিবির করি।’
অনেক দিন আগের কথা, জামায়াতে ইসলামী আর ছাত্রশিবিরের মধ্যে পার্থক্যটুকু নিয়ে আমি তাদের কী বলেছিলাম, আমার এখন মনে নেই। শুধু মনে আছে, ছাত্র দুটি মাথা নিচু করে আমার কাছ থেকে ফিরে গিয়েছিল।
নানা কারণে এই ঘটনার কথা আমি ভুলতে পারি না। আমি ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য লেখালেখি করি। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা একটি নতুন বাংলাদেশের সন্তান এবং তারা বড় হয়ে আমাদের দেশটাকে পাল্টে দেবে। আমি যখন সেই কথাটা তাদের বলি, আমার ধারণা, তারা আমার কথা বিশ্বাস করে। তাই তাদের অনেকেই আমার কাছে উৎসাহের কথা, অনুপ্রেরণা কিংবা স্বপ্নের কথা শুনতে আসে। শিবিরের এই দুটি ছেলে নিশ্চয়ই ভেবেছিল, তাদের এই চমৎকার বই দুটি আমাকে মুগ্ধ করবে, আমি উৎসাহসূচক কিছু বলব। অন্য দশজন তরুণের মতো তারাও এক ধরনের দাবি নিয়ে আমার কাছে এসেছিল, কিন্তু আমি তাদের আশা পূরণ করতে পারিনি। আমার ভয়ংকর রকমের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে তারা নিশ্চয়ই হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল—কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।
আমি তাদের কথাগুলোও ভুলতে পারি না। তারা আমাকে বলেছিল যে তারা জামায়াতে ইসলামী করে না, তারা শিবির করে। তাহলে তারা কি সত্যিই বিশ্বাস করে যে তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে ভিন্ন? ১৯৭১ সালে এই দেশে জামায়াতে ইসলামী যে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড করেছে, যে অমানুষিক নির্যাতন করেছে, যে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড করেছে, সেগুলো তাদের কোনোভাবে স্পর্শ করে না?
এই দুজন ছাত্র ছাড়া আর কখনোই কোনো জামায়াত বা শিবিরকর্মী আমার কাছে কথা বলতে আসেনি, তাই আমি কোনো দিন হয়তো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাব না।

২.
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই দীর্ঘ জীবনে আমি সবচেয়ে বিচিত্র, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিষয় কী দেখেছি। আমি এতটুকু দ্বিধা না করে বলব, সেটি হচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। তার কারণ, যে বয়সটি হচ্ছে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার বয়স, সেই বয়সে তারা ভালোবাসে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের, যারা এই মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। যে বয়সে একজন তরুণের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা অনুপ্রাণিত হয় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাকারীদের দিয়ে। যে বয়সে তাদের স্বপ্ন দেখার কথা দেশের বড় বড় লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিককে নিয়ে, সেই বয়সে তারা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সেই সব মানুষের, যারা আলবদর বাহিনী তৈরি করে একাত্তরে এই দেশের লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী আর সাংবাদিকদের হত্যা করেছে! যে বয়সে তাদের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করার কথা, ষোলোই ডিসেম্বরে স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার কথা, পয়লা বৈশাখে রাজপথে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা যে শুধু এই অবিশ্বাস্য আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখে তা নয়, তারা এগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। যে বয়সে তাদের মুক্তচিন্তা শেখার কথা, গান গাওয়ার কথা, নাটক করার কথা, আদর্শ নিয়ে ভাবালুতায় ডুবে যাওয়ার কথা, সেই সময় তারা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আটকে রাখতে শেখে, সাম্প্রদায়িক হতে শেখে, ধর্মান্ধ হতে শেখে। যে বয়সে ছেলে আর মেয়ের ভেতর সহজ ভালো লাগা ভালোবাসা জন্ম নেওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা সেই অনুভূতিগুলোকে অশ্রদ্ধা করতে শেখে—সে জন্য তারা কত দূর যেতে পারে, সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেই ভয়ংকর কাহিনি আমি কখনো কাউকে বলতেও পারব না!
যখন এই বাংলাদেশের সব মানুষ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন ইসলামী ছাত্রশিবির নামে এই সংগঠনের হতভাগ্য তরুণদের পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই, এখনো দেশের আনাচকানাচ থেকে তাদের ধরে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। আমার খুব জানার ইচ্ছে করে যে নেতারা তাদের বুঝিয়েছে, রাস্তায় নেমে চোরাগোপ্তা হামলা করে পুলিশের গাড়ি পোড়াতে হবে, নিজের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে হবে। সেই সব নেতা কি তাদের সন্তানদেরও পথে নামিয়েছে? আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেটি ঘটেনি। আমি আগেও দেখেছি, এই নেতারা যখন তাদের কর্মী বাহিনীকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, তখন তাদের সন্তানেরা ইংরেজি মিডিয়াম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে।
আমি অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনি, কেমন করে বাংলাদেশের মতো রক্তস্নাত একটি দেশে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নৃশংস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, সেখানে একজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের ভালো না বেসে তাদের হত্যাকারীদের ভালোবাসতে পারে! আমার মনে আছে, আমি বহুকাল পরে যখন প্রথম এই দেশে ফিরে এসেছিলাম, তখন ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটা মিছিল দেখে একধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তখন লক্ষ করেছিলাম, একজন ছাত্র তার হাতের ফাইল দিয়ে নিজের মুখটি ঢেকে রেখেছে, যেন আমি তার মুখটা দেখতে না পারি। আমার সামনে এই পরিচয় দিতে তার লজ্জা কিন্তু এই মিছিল থেকে তার বের হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই—এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে?
একজন ছাত্র কেমন করে শিবির করে, তার একটি উত্তর অবশ্য আমি একবার খুঁজে পেয়েছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র একবার আমাকে একটি এসএমএস করে জানিয়েছিল যে সে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, খুব ভালো ছাত্র এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার খুব ইচ্ছে। তার বিভাগীয় প্রধান জামায়াতে ইসলামীর লোক এবং তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সে যদি শিবির না করে, তাহলে তাকে শিক্ষক হতে দেওয়া হবে না। সে জন্য সে শিবিরে যোগ দিয়েছে এবং এটি নিয়ে তার কোনো অহংকার নেই। সেই এসএমএসটিতে আমি একজন মেরুদণ্ডহীন অসহায় হতভাগা মানুষকে আবিষ্কার করেছিলাম। তার জন্য কোনো মমতা নয়, আমি করুণা অনুভব করেছিলাম। আমি ইচ্ছে করলেই সেই ছাত্রটিকে খুঁজে বের করতে পারতাম, তার নীতিহীন বিভাগীয় প্রধানের পরিচয় জানতে পারতাম কিন্তু আমি তার কিছুই করিনি—আমার রুচি হয়নি।
আমার মাঝেমধ্যে জানার ইচ্ছে করে, এ ধরনের কারণে কতজন তরুণ শিবিরে যোগ দিয়েছে—কোনো স্বপ্ন নয়, কোনো আদর্শ নয়, শুধু স্বার্থ, শুধু চাওয়া-পাওয়া। মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই, জামায়াতে ইসলামীর নাকি অনেক অর্থবিত্ত, তাদের অনেক ধরনের ব্যবসা। এই দলে যোগ দিলে নাকি তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা হল দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই হলে সিট পাওয়া যায়। তারা কলেজ দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই কলেজে ভর্তি হওয়া যায়। পত্রপত্রিকায় দেখি, পরিচিতদের কাছে শুনি, তাদের দল নাকি অত্যন্ত সংগঠিত। আদর্শ ছাড়া কিংবা ভুল আদর্শের সংগঠন কি খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে? দীর্ঘদিন মিলিটারির শাসনে থাকার কারণে মানুষ যখন বিভ্রান্ত ছিল, তখন এই দেশে জামায়াতে ইসলামীরা ইলেকশনে ৩০টার মতো সিট পেয়েছিল। (কী লজ্জা!) যখন দেশের মানুষ গণতন্ত্রের ছোঁয়া পেতে শুরু করেছে, একটু বুঝতে শুরু করেছে তখন তাদের সিটের সংখ্যা এক-দুইয়ে নেমে এসেছিল। উপায় না দেখে তখন তারা বিএনপির ঘাড়ে চড়ে বসেছে, আবার তারা গোটা ত্রিশেক সিট পেয়েছে, মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে। দেশের মানুষ যখন আবার সজাগ হয়েছে, তখন সিটের সংখ্যা আবার এক-দুইয়ে নেমে এসেছে। এখন তারা কার ঘাড়ে উঠবে। এই দেশে যদি নির্বাচন করেই শুধু ক্ষমতায় যাওয়া যায়, তাহলে তাদের জন্য কোন পথটুকু খোলা আছে। আমার খুব আশা ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশের মানুষের এত আগ্রহ, এত উত্তেজনা দেখে বিএনপি হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের এই দলটিকে পরিত্যাগ করবে—তারা করেনি। আমি খুব আশাহত হয়েছি কিন্তু তাদের ছাত্রসংগঠন আমাকে আশাহত করেনি। তারা শিবিরের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হয়নি।
আমি রাজনীতি ভালো বুঝি না, আমার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কারও গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি একটা বিষয় খুব ভালো করে জানি, এই দেশে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে আর কেউ কোনো দিন রাজনীতি করতে পারবে না। পঁচাত্তর থেকে নব্বইয়ের সেই কালো সময় আমরা পার হয়ে এসেছি, আর কেউ কখনো এই দেশের মানুষকে সেই অন্ধকার জগতে ঠেলে পাঠাতে পারবে না। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করে কেউ সুবিধে করতে পারবে না, বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বিচার করে এই গ্লানিময় অধ্যায়কে চিরদিনের মতো সমাপ্ত করে দিতে হবে।

৩.
আমার এই লেখাটি তোমরা যারা শিবির করো, তাদের জন্য। আমি জানি, এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি কাজ—আমার এই লেখাটি তোমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবে না এবং তোমরা যারা পড়ছ তারা আমার এই লেখায় বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে এর মধ্যে নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়েছ। শুধু তা-ই নয়, তোমাদের প্রিয় জায়গা—ইন্টারনেটে সম্ভবত এই লেখার বিরুদ্ধে বিশাল একটা প্রচারণা শুরু হবে। কিন্তু তবু আমার মনে হয়েছে, আমার এই কাজটুকু করা উচিত, তোমাদের কখনো যে সত্য কথাগুলো বলা হয়নি, আমার সেটা বলা উচিত।
তোমাদের কাছে আমার প্রথম যে প্রশ্ন সেটি হচ্ছে, তোমরা কি জানো আবুল আলা মওদুদী নামে যে মানুষটির চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করে জামায়াতে ইসলামী নামে রাজনৈতিক দলটি গড়ে উঠেছে, সেই মানুষটিকে মানুষ হত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল (যদিও সেটি শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি)। তোমরা কি জানো জামায়াতে ইসলামী ইসলাম প্রচারের দল নয়, এটি রাজনৈতিক দল এবং এটি সব সময় ভুল রাজনীতি করে এসেছে? এই উপমহাদেশে যখন ব্রিটিশদের বিদেয় করে পাকিস্তান সৃষ্টি করার আন্দোলন হয়েছে, তখন তারা সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। আবার যখন এই দেশে পাকিস্তান নামের দানবকে পরাস্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তখন তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে? এখন যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ করে থাকা দেশদ্রোহীদের বিচার করা হচ্ছে, তখন আবার জামায়াতে ইসলামী সেই সত্যকে অস্বীকার করে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে—সেটি ঘটেছে তোমাদের চোখের সামনে এবং তোমরা খুব ভালো করে জানো, সেখানে তোমাদের হূদয়হীনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমার ধারণা, তোমরা যারা শিবির করো, তারা সম্ভবত কখনোই খোলা মন নিয়ে এই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলো না। তোমরা সব সময়ই নিজেদের সঙ্গে নিজেরা কথা বলো, একে অন্যকে উৎসাহ দাও, একে অন্যের ওপর নির্ভর করো কিন্তু তোমাদের দলের বাইরের মানুষেরা তোমাদের সম্পর্কে কী ভাবে, কখনোই তার খোঁজ নাওনি। যদি খোঁজ নিতে, তাহলে হয়তো তোমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ছবি দেখতে পেতে। তোমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করতে, তোমাদের যেভাবে যা কিছু শেখানো হয়েছে, তার সবকিছু সত্যি নয়। তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, এই দেশের অজস্র সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে তোমাদের দলের দু-একটি পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়া অন্য কোথাও তোমাদের সম্পর্কে একটিও ভালো কথা ছাপা হয় না। কিছুদিন থেকে গাড়ি ভাঙচুর বা পুলিশকে আক্রমণ করার যে নতুন কর্মকাণ্ড শুরু করেছ, সেটি করে তোমরা যে নিজেরাই বিপদগ্রস্ত হতে শুরু করেছ, সেটা কি লক্ষ করেছ? আজ রাতেই আমি খবরে জানতে পারলাম, সাধারণ মানুষ তোমাদের ধাওয়া করছে, তোমাদের আক্রমণ করছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এটি ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকবে। তোমরা নিজেদের জন্য যে জীবন বেছে নিয়েছ, তার মধ্যে কি বিন্দুমাত্র মর্যাদা আছে? আত্মতুষ্টি আছে?
আজ থেকে কয়েক যুগ আগেও এই পৃথিবী যে রকম ছিল, এখন সেই পৃথিবী নেই। এই পৃথিবী অনেক পাল্টে গেছে। নতুন পৃথিবী তালেবান বা লস্কর-ই-তাইয়েবার পৃথিবী নয়। জামায়াতে ইসলামী বা শিবসেনার পৃথিবীও নয়। নতুন পৃথিবী হচ্ছে মুক্তচিন্তার পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক একটা পৃথিবী। এই নতুন পৃথিবীর মানুষেরা অসাধারণ, তারা একে অন্যের ধর্মকে সম্মান করতে শিখেছে, একে অন্যের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে উপভোগ করতে শিখেছে, একে অন্যের চিন্তাকে মূল্য দিতে শিখেছে। এই নতুন পৃথিবীতে মানুষে মানুষে কোনো বিভাজন নেই। দেশ-জাতির সীমারেখা পর্যন্ত ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে।
তাই এই নতুন পৃথিবীতে যখন কেউ ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিভাজন করে রাজনীতি করতে চায়, পৃথিবীর মানুষ তখন তাকে পরিত্যাগ করে। জামায়াতে ইসলামীর মতো বা শিবসেনার মতো রাজনৈতিক দল তাই হচ্ছে বাতিল হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দল—নতুন পৃথিবীতে এই দলগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
আমি জানি, যদিও আমি এই লেখাটি লিখেছি যারা শিবির করে তাদের উদ্দেশে কিন্তু তারা আসলে আমার একটি কথাও বিশ্বাস করবে না। যদি বিশ্বাস করেও ফেলে, তার পরও তাদের কিছু করার থাকবে না। এ ধরনের রাজনৈতিক দল যখন তৈরি করা হয়, তখন অনেক লোভ দেখিয়ে দলে টানা হয়। কিন্তু দলে যোগ দিয়ে যদি মোহভঙ্গও হয়, তবু তারা আর দল থেকে বের হতে পারে না। অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো এক অন্যকে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে হয়।
যারা এখনো শিবিরে যোগ দেয়নি, তারা হয়তো এই লেখাটি পড়ে একটুখানি ভাববে। যখন তাকে এই দলে যোগ দেওয়ার কথা বলবে, হয়তো তারা একটিবার চিন্তা করবে, আমাদের এই ভালোবাসার দেশটিকে যারা টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছিল, আমি কেন সেই দলে যোগ দেব? দেশকে যখন ভালোবাসার কথা, তখন কেন আমি দেশের সঙ্গে বেইমানি করব?
মাতৃভূমিকে ভালোবাসার তীব্র আনন্দ যারা উপভোগ করেনি, যারা ভবিষ্যতেও কোনো দিন অনুভব করতে পারবে না, আমি সেসব হতভাগ্য মানুষের জন্য গভীর করুণা অনুভব করি।

Monday, November 19, 2012

জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা ইদানিং সারাদেশে শক্তির মহড়া দিচ্ছে:ফ্যাসিবাদী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত:মুনতাসীর মামুন


নভেম্ভর ১৮, ২০১২
জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা ইদানিং সারাদেশে শক্তির মহড়া দিচ্ছে। পুলিশ সদস্যদের পর্যন্ত বেধড়ক পিটিয়ে ওরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। জামায়াতের এ সব কাজকর্মে আমি খুবই আনন্দিত। কারণ দলটি সবসময়ই ফ্যাসিবাদী। পাকিস্তান আমলে কাদিয়ানিদের সঙ্গে দাঙ্গা লাগিয়ে ওদের হত্যা করার জন্য জামায়াত দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। ওদের দলনেতা মওদুদীর তখন ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। সৌদী আরবের হস্তক্ষেপে ওরা বেঁচে গিয়েছিল। মওদুদী নিজেও ওভাবেই প্রাণে বেঁচেছেন। এরপর এল একাত্তর। এবারও একইভাবে ফ্যাসিবাদী ভূমিকা নিল দলটি। এ যাত্রাও ওরা বাঁচল সৌদী আরবেরই হস্তক্ষেপে।

বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এল, তার ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলেন। সবাই জানেন তিনি কীভাবে জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসিত করেছিলেন। অনেকেই বলেন, তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা,’ স্বাধীনতার ঘোষক।’ কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট যে তিনি যদি একাত্তরে সত্যিকার স্বতঃস্ফুর্ততার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যেতেন বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি যদি তাঁর সত্যিকারের ভালবাসা থাকত তবে এ দেশে জামায়াতকে পুনর্বাসিত করার কাজটা করতে পারতেন না। সবাই জানেন, ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে গোলাম আজম বাংলাদেশে আসেন। এর পরের বছর থেকে এ দেশে জামায়াতের রাজনীতি আবার শুরু হয়।

পরে তো জানা গেছে যে, জিয়া আসলে ‘পাকিস্তানপন্থী’ ছিলেন। যে ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা লিখে দিয়েছিলেন সেটি তিনি পশ্চাদপসারণ করার মুহূর্তে পাঠ করেছিলেন। এভাবে তিনি হয়ে গিয়েছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক!’

এরই ফলে পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা জিয়াউর রহমান মৌলবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। একই কাজ করেছেন তার উত্তরসূরী আরেক সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ। এই দুই শাসনামলে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। আমাদের সামরিক শাসক ও সেনাবাহিনী মৌলবাদকে এ দেশের মাটিতে শেকড় গাড়তে সাহায্য করেছে সবসময়ই।

এই জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে সবাই কখনও না-কখনও কাজ করেছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দু’ভাবেই। বিএনপি, জাতীয় পার্টি তো বটেই- এমনকী আওয়ামী লীগও ওদের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখিয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে দিয়েছে তারা। এভাবে জামায়াতের উপকার হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত জামায়াতকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আজকে তারা বলছে বিধি সংশোধন না করলে জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। আগের নির্বাচন কমিশনের যারা আজ বড়-বড় কথা বলেন, তারা এ কাজ করতে পারেননি বা চাননি। নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে প্রয়াত কবীর চৌধুরীসহ আমরা ক’জন এবং সেক্টর কমাণ্ডারস ফোরামের নেতারা তখনকার নির্বাচন কমিশনকে বলেছিলাম যে বিধি অনুযায়ী এ দেশে জামায়াতের নির্বাচন করার কোনও সুযোগ নেই। ওরা মিটিমিটি হেসেছেন আমাদের কথা শুনে। তারপর অবৈধভাবে জামায়াতকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন।

আমি আজ অবাক হয়ে দেখি, এমনকী মিডিয়া পর্যন্ত জামায়াতের পক্ষে কোনো না-কোনোভাবে কাজ করছে। খুব কষ্টও পাই যখন দেখি যে, জামায়াতের নেতাদের ‘ভি-চিহ্নিত’ হাতের ছবি মিডিয়াতে প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। বিচারাধীন এই নেতাদের সবাই বয়োবৃদ্ধ। পলিশের কাঁধে ভর দিয়ে তারা আদালতে আসেন। মিডিয়াতে তাদের এ ধরনের ছবিগুলো প্রকাশিত হলে অনেকের মনে ভিন্ন অনুভূতি তৈরি হতে পারে। মনে হতে পারে যে এ বৃদ্ধদের এভাবে টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে কেন! তাদের ভি-চিহ্নিত হাতের ছবি প্রকাশ করা কি খুব জরুরি? তাতেও কি মিডিয়া ওই ঘৃণিত শক্তিকে ‘বিজয়ী’ হিসেবে তুলে ধরছে না?

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখুন। সেখানে মাদ্রাসা থেকে পাশ-করা শিক্ষার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। দাখিল-কামিল পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী ১০০ তে ১০০ বা ৯০ পেয়ে পাশ করছে। ওদিকে সাধারণ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এসএসসি-এইচএসসিতে পাচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ নম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে যেহেতু ভর্তিপরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের পাশাপাশি এসএসসি-এইচএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়, তাই ওরা পিছিয়ে পড়ছে। এখন মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদগুলোতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা বেশি হারে ভর্তি হচ্ছে। আগামীতে এদের সংখ্যা আরও বাড়বে।

আমরা বলছি, হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে হবে- নয়তো পাবলিক পরীক্ষার নম্বর বাদ দিয়ে শুধু ভর্তিপরীক্ষার ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। কীভাবে কলেজ থেকে আর মাদ্রাসা থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন সমান হতে পারে?

রাজনৈতিক কারণে বিএনপি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আওয়ামী লীগও এটা চালু রেখেছে। এটা খুব আত্মঘাতী একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সদস্য। ফলে এরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘বড় একটা মাদ্রাসা’ বানিয়ে ফেলছে। এর জন্য দায়ী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো।

দুঃখের বিষয়, এখন আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কোনো কিছু গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখতে চায় না। কর্মকর্তারা এখানে-ওখানে আলোচনায় যাওয়া আর সই-স্বাক্ষর দেওয়ার মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছেন।

এ সব নিয়ে বারবার বলা হচ্ছে। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলছি, এ সব ব্যবস্থা পাল্টান। আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নৈরাজ্য আরও বাড়লে এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর পাশাপাশি তারাও দায়ী হবেন। সৈয়দ আলী আহসান ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, ‘এ দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’ তখন তিনি সাহস করে এ কথা বলতে পেরেছিলেন। যদি তাঁর কথা শোনা হত তবে আজ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এ দশা হত না।

আমি বলব, এ বিষয়ে আদালতও আমাদের প্রতি সুবিচার করছেন না। আমরা তো আদালত কীভাবে চলবে তা বলে দিই না। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী করবে না-করবে তা বিশ্ববিদ্যালয়েরই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আদালত আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারেন না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রিকোয়ারমেন্ট আছে। সেটা বিবেচনা করা উচিত। আমরা কী বলতে চাচ্ছি সেটা ওদের শোনা উচিত। তারা কেন বলেন না যে, এক দেশে পাঁচ রকম শিক্ষা ব্যবস্থা থাকতে পারে না!

মানবাধিকারের কথা যদি বলতে হয়, জামায়াতে ইসলামীর মানবাধিকার কি আমাদের মানতে হবে? আর যদি তর্কের খাতিরে ওভাবে ধরেই নিই, তবে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কেউ-ই ভর্তি হওয়ার দাবি করতে পারে। বাছাই কেন করব আমরা?

আমাদের রাজনীতিতে-সমাজে এভাবে জামায়াত-পোষণের ফল হচ্ছে এটাই যে, এখন জামায়াত সদস্যরা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের পেটাচ্ছে। রাস্তায আহত হয়ে পড়ে থাকা পুলিশকে মারধর করছে- এ সব আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমি এ লেখার শুরুতে বলেছিলাম, জামায়াতের এ সব কাজকর্ম দেখে আমি আনন্দিত। কথাটির ব্যাখ্যা দিচ্ছি। ওদের কাজকর্ম দেখে আশা করি এখন সবাই বুঝতে পারবেন জামায়াত আসলে কী ছিল, আছে বা থাকবে। আর এটাই আমার খুশির কারণ।

এখনকার তরুণ জামায়াত-কর্মীদের দেখে চেনার উপায় নেই যে ওরা জামায়াত। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ানক বলে মনে হয়। এ যুগের বাচ্চা-জামায়াতীরা রাসুলের সুন্নত মেনে টুপি-দাঁড়ি রাখে না। ইসলামী পোশাক বা পাঞ্জাবি পরে না। তাদের অভিহিত ‘নাসারাদের’ মতো জিন্সের প্যান্ট বা শার্ট পরে। দাঁড়ি-গোঁফ কামায়। কাঁধে ব্যাগ ঝোলায়। প্রযুক্তিতেও দক্ষ ওরা। সর্বোপরি, একাত্তরের কথা জেনেও ওরা এই দলের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। তাই ওরা হবে একাত্তরের জামায়াতের চেয়েও অনেক-অনেক বেশি ভয়ানক।

দেথতে পাচ্ছি, এতদিনে নড়েচড়ে বসেছেন সবাই। জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়। আমি শুধু একটা কথাই বুঝি। যে যে ভাষা বোঝে তার সঙ্গে সে ভাষায় কথা বলতে হয়। জামায়াত যদি নাশকতাকে পলিসি হিসেবে নেয় তবে তার সঙ্গে সেভাবেই ট্রিট করতে হবে। জামায়াতীরা ভদ্র ভাষা বোঝে না।

বঙ্গবন্ধু সাহস করেছিলেন। নিষিদ্ধ করেছিলেন জামায়াতের রাজনীতি। দালাল আইনে বিচার করেছিলেন কিছু স্বাধীনতা-বিরোধীর। গোলাম আজমসহ কিছু চিহ্নিত জামায়াতী নেতা ও যুদ্ধাপরাধীর নাগরিকত্বও বাতিল করা হয়েছিল। এমন সাহস করার মতো নেতা বর্তমান আওয়ামী লীগে নেই কেন এ প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করেছেন। আমি এর উত্তরে একটা কথাই বলব, এই আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ নয়। এখানে নানা ধরনের লোক আছেন। এই নেতারা নানা সময়ে নানাভাবে সমঝোতা করেছেন, করে যাচ্ছেন। এই নেতাদের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। আর যে সমাজে সবাই দু’নম্বরী কাজে ব্যস্ত সেখানে নেতাদের কাছে বেশি কিছু আশা করা ঠিক নয়। তাদের পক্ষে বঙ্গবন্ধু বা জাতীয় চার নেতা হওয়া সম্ভব নয়।

আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তো একা সবকিছু করা সম্ভব নয়। আমরা চেয়েছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের একটা রাজনৈতিক বিচার হোক। এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করার সাহস দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা। এ জন্য আমরা মনে করি, তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।

জামায়াতের সাম্প্রতিক কার্যকলাপের পেছনে বেশ ক’টি কারণ থাকতে পারে। তারা এর মাধ্যমে কয়েকটি ‘বাণী’ দিতে চাচ্ছে। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধের বিচার জামায়াত বা বিএনপি কেউ হতে দিতে চাইবে না। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনের বিচার প্রায় শেষের পথে। ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে আমরা আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই কয়েকজনের ব্যাপারে রায় হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতের একাংশ ক্ষুব্ধ হযে উঠতে পারে।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচন আসছে। সঙ্গত কারণেই জামায়াত শক্তির মহড়া দিচ্ছে। তারা দেখাতে চাচ্ছে যে, তারা একটি শক্তি। তারা এর মাধ্যমে বোঝাতে চাচ্ছে তারা যেভাবে চাইবে সেভাবে সবকিছু হতে হবে। বলতে চাচ্ছে- চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিগুলো তাদের সমর্থন করছে। তারা তখনই নির্বাচনে অংশ নিতে চাইবে যখন তারা ভাববে যে তারা বিজয়ী হবে।

তৃতীয়ত, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন করে তারা বুঝিয়ে দিল যে, তাদের কথামতো চলতে হবে। চতুর্থত, পুলিশকে যেভাবে তারা পেটাতে পারছে তাতে সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের জন্যও এটা একটা সতর্কবার্তা।

অনেকে বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের জুটি ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি বলব, বিএনপি সবসময় জামাতের পাশে ছিল। এখনও আছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের তো খুব বেশি পার্থক্য নেই। বিএপির লোকেরা সাফারি পরেন। আর পুরনো জামায়াতীরা ইসলামী পোশাক পরেন। এই তো?

বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন। এ দলটি সবসময় বলে এসেছে যে, ভারতের সঙ্গে তারা ‘নতজানু’ পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলে না। এখন এ দল যদি ভারতের কাছে নতজানু হয়ে যায়, তাদের ভাষায়- ‘ভারতপন্থী’ বা ‘ভারতের এজেন্ট’ হয়ে ওঠে- তাতেও জামায়াতের কোনো সমস্যা নেই। মজার বিষয় হল, জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে এ সব বিষয়ে। তার লিখছে, ভারতের সঙ্গে আমাদের যে ‘মধুর সম্পর্ক’ এটা ধরে রাখতে হবে। এটা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না!

আমাদের সুশীল সমাজের লোকেরা এখন এতটাই সুশীল হয়ে গেছেন যে শুধু উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি মনে করি, একজন তখনই উপদেশ দিতে পারবেন যখন তিনি নিজে কাজটি করে ফেলবেন। অনেকেই বলছেন যে, আওযামী লীগ এটা পারল না ওটা পারল না। কিন্তু কী পারেনি সেটা তো বলছেন না। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল। তারা কী করেছে জাতি সেটা দেখেছে। অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন সে সব দিনের কথা। জামায়াত আবার তাদের এখনকার কার্যকলাপ দিয়ে বুঝিয়ে দিল, তারা কী করতে পারে। আমাদের তাই সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে হবে।

আমি মনে করি, এ পরিস্থিতিতে আমাদের সবার ভেবে দেখার সময় হয়েছে যে এ দেশে জামায়াতকে রাজনীতি করতে দেওয়া ঠিক হবে কিনা। এমনকী যারা জামায়াতকে সমর্থন দেবে, তাদেরও এ দেশে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত নয়। আমরা এদের প্রতিরোধ করব, রুখে দেব, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিত।

মুনতাসীর মামুনের জন্ম ১৯৫১ সালের ২৪ মে ঢাকার ইসলামপুরে নানার বাড়িতে। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে।
মুনতাসীর মামুনের শৈশব-কৈশর কেটেছে চট্টগ্রামের চাঁটগায়। চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাষ্ট প্রাইমারি ও হাইস্কুলে এবং চট্টগ্রাম কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৭২ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন এবং একই বিভাগ থেকে ১৯৮৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনিই প্রথম পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই দৈনিক বাংলা/বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন মুনতাসীর মামুন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন। এর পাশাপাশি ঢাকা শহরের অতীত ইতিহাস নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। এছাড়া তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউটে’ সন্মানিক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে ১৯৯৯-২০০২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। কৈশর থেকে লেখালেখির সাথে জড়িত হয়ে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় সেরা শিশু লেখক হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর অনুবাদ, চিত্র সমালোচনা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচনা করেন অনেক বই। তাঁর লেখালেখি ও গবেষনার বিষয় উনিশ, বিশ ও একুশ শতকের পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ ও ঢাকা শহর।

মুনতাসীর মামুনের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২০। গল্প, কিশোর সাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষনা, চিত্র সমালোচনা, অনুবাদ সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুনতাসীর মামুনের বিচরণ থাকলেও ইতিহাসই তার প্রধান কর্মক্ষেত্র।
উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত বইগুালো হচ্ছে:
প্রশাসনের অন্দরমহল | প্রকাশকালঃ ১৯৮৭
ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী | প্রকাশকালঃ ১৯৯৩
বাংলাদেশের রাজনীতিঃ এক দশক | প্রকাশকালঃ ১৯৯৯
১৯ শতকের ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা | সময় প্রকাশন | প্রকাশকালঃ এপ্রিল ২০০৪
১৯ শতকে পূর্ববঙ্গের মুদ্রণ ও প্রকাশনা | সময় প্রকাশন | প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০০৫
আইন, আদালত ও জনতা | অনুপম প্রকাশনী | প্রকাশকালঃ জুলাই ২০০৫
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়া | মাওলা ব্রাদার্স | প্রকাশকালঃ জানুয়ারি ২০০৬
১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যা | সূবর্ণ প্রকাশনী | প্রকাশকালঃ অক্টোবর ২০০৮
আমার ছেলেবেলা | প্রকাশকালঃ অক্টোবর ২০০৮
দুঃসময়ের দিনগুলি | প্রকাশকালঃ ২০১০
ঢাকার স্মৃতি ৯ এবং ১০ | প্রকাশকালঃ ২০১০
ঢাকার স্মৃতি ৮ | প্রকাশকালঃ ২০১০