Thursday, February 28, 2013

দেলু ওরফে দেইল্লা ওরফে দেলোয়ার হোসেন শিকদার-মূল ব্যবসা ছিল তাবিজ বিক্রি


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে স্থানীয় মক্তব ও মাদ্রাসায় আসা-যাওয়ার কারণে আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন দেলু ওরফে দেইল্লা ওরফে দেলোয়ার হোসেন শিকদার। একাত্তরে শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকাকালে পিরোজপুর জেলার পারেরহাট বাজারে প্রথমে ছোলামুড়ি বিক্রি শুরু করেন দেলু। কিছুদিন পর ভায়রা ভাইয়ের মুদি দোকানে বসলেও আড়ালে তাঁর মূল ব্যবসা ছিল তাবিজ বিক্রি। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে যান। পরে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের সংগঠিত করে এলাকায় শুরু করেন হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণসহ জঘন্যতম মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ। ওই সময়েই 'দেইল্লা রাজাকার' নামে পরিচিতি লাভ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীনের পর ছারছীনা মাদ্রাসায় ভর্তি হন দেইল্লা। সেখানে কিছুদিন থাকার পর জামায়াতের ছাত্ররাজনীতি করার কারণে ওই মাদ্রাসা থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। পরে বারইপাড়া মাদ্রাসা থেকে মোস্তফা দেলোয়ার হোসেন নামে দাখিল এবং পরে নাম পরিবর্তন করে আবার আবু নাঈম মো. দেলোয়ার হোসাইন নামে আলিম পাস করেন।
পরবর্র্তী সময়ে দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি না নিলেও নামের সঙ্গে আল্লামা টাইটেল ব্যবহার করে 'আল্লামা মাওলানা' পরিচয়ে আবির্ভূত হন। ওয়াজ করে বেড়ান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ওই সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। পরে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও চলে তাঁর এই কার্যক্রম। কালক্রমে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পেয়ে যান। এই সময়েই মা-বাবার দেওয়া দেলোয়ার হোসেন শিকদার, এলাকার সেই দেইল্লা রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে ব্যাপক পরিচিতি পান।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, একাত্তরের অপরাধ ঢাকতেই দাখিল ও আলিম পরীক্ষা এবং পরবর্তী সময়ে ধর্ম প্রচারের নামে জামায়াতের রাজনীতির প্রচারণার সময় জন্মতারিখ পাল্টানোসহ ভিন্ন নামে আত্মপ্রকাশ করেন দেইল্লা রাজাকার। এসব অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠিত উপকমিটি।
দাখিল পরীক্ষা অনুযায়ী সাঈদীর জন্মতারিখ ১৯৪৭ সালের ১ মার্চ হলেও নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী সাঈদীর জন্ম ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার তৎকালীন ইন্দুরকানীর (বর্তমানে জিয়ানগর উপজেলা) সাউথখালী গ্রামে। তাঁর বাবা মরহুম ইউসুফ আলী শিকদার। পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে- এমন আশঙ্কায় আবার ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর দাখিল ও আলিম পাসের সনদে নিজের নাম ও বয়স পরিবর্তন করান সাঈদী।
জানা গেছে, আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী এবং বাকপটু ছিলেন সাঈদী। তাঁর এই পারদর্শিতাকে ব্যবহার করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তিনি সখ্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। এ কারণে তিনি রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হতে সক্ষম হন। তাঁর নেতৃত্বে এবং সহযোগিতায় পিরোজপুরের পারেরহাট বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে।
বালিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান জানান, এলাকার মানুষের কাছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পরিচিতি পান মূলত আশির দশকের শুরু থেকে। তখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় তিনি 'ওয়াজ মাহফিল' নামে পরিচিত ধর্মীয় সমাবেশগুলোতে একজন সুবক্তা হিসেবে হাজির হতে শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে প্রথম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নিজ এলাকায় এক ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেন। ওই মাহফিলের পর এলাকাবাসী তাঁকে চেনে।
সাঈদীর মামলার বাদী জিয়ানগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাহাবুবুল আলম হাওলাদার জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে সাঈদী পারেরহাটে তাঁর ভায়রা ভাইয়ের সঙ্গে মুদি দোকানের ব্যবসা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে দেলোয়ার শিকদার ও তাঁর বড় ভাই এনায়েত শিকদার পিরোজপুরের সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাস্তায় চিলা শিকদারের বাড়িতে থাকতেন। তখন তাঁকে তেমন কেউ চিনত না। কিন্তু আশির দশকে ওয়াজ নসিহত শুরু এবং পরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ব্যাপক পরিচিতি পান সাঈদী।

No comments:

Post a Comment