Tuesday, November 19, 2013

মহান স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই জননী সাহসিকা!- সুমি খান



সকল অপশাসন, দুঃশাসন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদী মিছিলের নেতৃত্বে  ছিলেন জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল!বাংলাদেশে  মানবাধিকার ,নারী জাগরণ, নারী অধিকার আদায় ও নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অতুলনীয় সুফিয়া কামালের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা!!


সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে  বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলনের মিছিল

আজ ২০ নভেম্বর।কবি,বুদ্ধিজীবী,সমাজনেত্রী,নারী ব্যক্তিত্ব এবং নারী জাগরণের পথিকৃৎ কবি বেগম সুফিয়া কামালের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।১৯৯৯ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়।  তিনি তীব্র ঘৃণা করতেন রাজাকার,আলবদর, আল শামসদের।আমৃত্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন।নিজ মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে স্থিরচিত্তে যিনি নয় মাসে নয়টি কাঁথা সেলাই করেন অখণ্ড মনযোগে , তিনি কি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেয় চেতনা ও মূল্যবান অর্জনকেই ঐতিহ্যের সুতোয় গেঁথে নেন না? এই সুফিয়া কামালই একক অনন্য।১৯৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত ব্রাত্যজনের কাছে সেবায় ও দরদে যিনি চিহ্নিত হয়েছিলেন 'মা-ফাতেমা' হিসেবে-তিনিই মুক্তিযুদ্ধে সন্তানদের পাঠিয়ে কাঁথায় স্বপ্ন বুনে 'মা-সাহসিকা' হয়ে উঠেছিলেন।এই সুফিয়া কামাল অনন্য দ্বিতীয় রহিত।তার মতো আর নয় কেউ।বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অংশের ভূগোলকে তিনি ব্যাপ্ত করে রাখবেন নিজস্ব দ্যুতিতে, অনিঃশেষ মায়ামমতা ও বিপুল বৈভবে।
 বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে নির্মম হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা র পর  জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজাকার পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে শ্লোগান মুখর ঝাঁঝাঁলো মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন জননী সাহসিকা। তখন জিয়াউর রহমান তার পেটোয়া লাঠিয়াল  বাহিনী দিয়ে ও তাকে ঠেকাতে না পেরে ক্ষুদ্ধ প্রশ্ন করেছিলেন," এই অশিক্ষিতা মহিলার এতো শক্তি কি করে? এতো লোক কি করে তাকে মানে?"  শুনে স্মিতভাষী বেগম সুফিয়া কামাল মৃদু হেসেছিলেন শুধু, কোন মন্তব্য করেন নি! একই ভাবে স্বৈরাচারী বিশ্ববেহায়া এরশাদের তখ্ত ও কেঁপেছিলো জননী সাহসিকার দৃপ্ত সংগ্রাম আর আন্দোলনের প্রখর তাপে!

তিনি  ছিলেন এক বিশাল শক্তির প্রতীক।এই সমাজ সম্পৃক্ততায় তিনি হয়ে উঠেছেন আরো বড় মাপের মানুষ। বিপুল মানুষের সঙ্গে আত্মিক  সংযোগ এবং বিপুলতর নিঃসহায় জনের জন্য গভীরতর ভালোবাসা ও নিরন্তর উদ্বেগই সুফিয়া কামালকে অসামান্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে।এই সামগ্রিক উচ্চতা সমকালীন বাংলাদেশে আর কেউ অর্জন করেননি।সে জন্যই তিনি সমকালীন বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শত প্রতিকুলতা তাকে দমাতে পারেনি।



সুফিয়া কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে।
সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি।তার বাবা সৈয়দ আবদুল বারি ছিলেন উকিল।মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান।মাত্র বারো বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৩ সালে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিবাহ হয়।তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বাস করেও নিজস্ব চেষ্টায় এবং মায়ের স্নেহ ও পরিচর্যায় তিনি স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত হন।বিয়ের পর তিনি জাকজমকপূর্ণ পোশাক পরা বন্ধ করে তাতের শাড়ি পরা শুরু করেন। এ সময় তিনি নারী কল্যাণমূলক সংগঠন মাতৃমঙ্গল-এ যোগ দেন।

১৯২৩ সালে সুফিয়া কামাল রচনা করেন তার প্রথম গল্প সৈনিক বধূ যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা বাসন্তী প্রকাশিত হয়।

১৯২৯ সালে সুফিয়া কামাল যোগ দেন বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলামে। এখানে নারী শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারসহ নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। বেগম রোকেয়ার আদর্শ সুফিয়াকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৩১ সালে সুফিয়া কামাল মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ইন্ডিয়ান মহিলা ফেডারেশনের সদস্য নির্বাচিত হন।



কাজী নজরুল ইসলামের পাশে সুফিয়া কামাল

১৯৩৩-৪১ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি তার সাহিত্য চর্চাও চলতে থাকে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তার সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটি।এর ভূমিকা লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটির প্রশংসা করেন।১৯৪৭-এ সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হলে তিনি তার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন কবি-সম্পাদক সুফিয়া কামাল ...

''মুসলিম সমাজ আজ এক কঠোর দায়িত্ব গ্রহণের সম্মুখীন। অর্জিত স্বাধীনতা, সম্মান ও গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে হলে কেবল পুরুষেরই নয়, মুসলিম নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে। তার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ নারীসমাজকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সেই স্বাধীন সার্বভৌম আদর্শ রাষ্ট্রের সত্যিকার দাবিদার হতে পারে সগৌরবে।এর জন্য চাই আমাদের মানসিক প্রসার, আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি আর জীবন সম্পর্কে এক স্থির ধারণা।’''

১৯৩২ সালে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ১৯৩৩-১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন।১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ান।পরের বছর তিনি কলকাতায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন।

মহীয়সী নারী, জননী সাহসিকা, সমাজের মুক্তির পথ রচয়িতাদের অন্যতম পথিকৃৎ সুফিয়া কামাল অকুতোভয়ে বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, মানব মুক্তি, নারী মুক্তি, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে, নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সব সময়ই ছিলেন সামনের সারিতে।১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি আয়োজিত ‘শান্তি মিছিলে’ সুফিয়া কামাল সম্মুখভাবেই ছিলেন।

১৯৪৭ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন।এ সময় সুফিয়া সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন।তিনি যেসব সংগঠন প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা করেন তার মধ্যে আছে, বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি, দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থা।

তিনি ছায়ানট, কচিকাঁচার মেলা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।তার দুই মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে আগরতলায় হসপিটাল স্থাপন করেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), একাত্তরের ডায়েরী, মোর যাদুদের সমাধি পরে, একালে আমাদের কাল, মায়া কাজল (১৯৫১),কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) ইত্যাদি।২০০২ সালে বাংলা একডেমী সুফিয়া কামালের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে।

সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কার 'তঘমা-ই-ইমতিয়াজ' লাভ করেন।কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন।এ ছাড়াও তিনি বাংলা একডেমী পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস ক্রেস্ট (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) লাভ করেন।

জীবন যে কত বড় এবং তা যে সাধনায়, ত্যাগে, সদিচ্ছায়, শ্রমে, অঙ্গীকারে কত সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে  মানবতার কল্যাণে, দেশের কল্যাণে উৎসর্গ করা  যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বেগম  সুফিয়া কামাল। 
যে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে তার জন্ম সেখান থেকে তিনি শুধু উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে বেরিয়ে আসেননি,  দুঃসহ নিগড়ে আবদ্ধ বাঙালি মুসলমান নারী সমাজকে তিনি জাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন-  শৃঙ্খলমুক্ত জীবনে আহ্বান করেছেন  তথাকথিত সমাজ সংস্কারের নিগড়ে শৃঙ্খলিত অগণিত নারী -পুরুষকে!

রক্ষণশীল ও আভিজাত্যের বৃত্ত ভেঙেই তিনি সাহসী - দৃঢ় পদচারণা শুরু করেছিলেন।বৃত্ত যিনি ভাঙতে পারেন তিনি আরো বৃত্ত ভাঙার জন্য প্রস্তুতি নেন।সুফিয়া কামালও তাই করেছেন আমৃত্যু। অশুভ, অসুন্দর অকল্যাণের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ উজ্জীবিত করেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আজ তোমার মহা প্রয়াণের দিনে  তোমার মহান স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা  জানাই  জননী সাহসিকা!

স্মৃতির সেফটিপিন : অপরাহ্ণ সুসমিতো


---------------------

মুসলিম হলে তিনদিন ব্যাপী রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন হবে । আমাদের সবার খুব উৎসাহ । গৌতম বলল : বেগম সুফিয়া কামাল আসবেন ।

আমার আগ্রহ গেল বেড়ে ।

এর আগে বেগম সুফিয়া কামালকে কখনো দেখিনি । পরিকল্পনা হলো রাতে আমি,মনজু মিলে নাসিমের চকবাজারের ডেরায় থাকবো । যেদিন সম্মেলন শুরু হবে সেদিন থেকে শুরু বাস মালিক সমিতির ধর্মঘট শুরু হয়ে গেল । কি জ্বালা ! সেদিন আবার সাপ্তাহিক ছুটি ।
হল থেকে চট্টগ্রাম শহরে যাই কি করে ? মনজু,আমি হলে থাকি । গৌতম,নাসিম শহরে । ওদের কোনো সমস্যা নেই ।

ওরা তো ঠিকঠাক চলে আসবে । আমরা ?

উদ্বোধন সন্ধ্যায় । সকাল থেকে ভাবনা মাথায় ।

নাস্তা করতে এলাম সকাল সকাল রব ভাইয়ের দোকানে । চা খেতে খেতে ভাবছিলাম কি করা যায় ? বিধানদা এসে তখন হাজির । রোদ বাড়ছে,আস্তে আস্তে সবার ঘুম ভাঙ্গছে । অনেকেই নাস্তা করতে বেরুচ্ছে । বিধানদাকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ লাল,উস্কুখুস্কু ।

কিন্তু মনে হলো মেজাজ শরীফ চনমনে । বিধানদা রসায়নের ছাত্র,আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র । খুব দিল দরাজ মানুষ । জুয়া খেলে জেতায় তার সুনাম সর্বজনবিদিত । অনুমানে ঢিল ছুঁড়লাম । “কি বিধানদা কাল তো হেভী জিতলেন” ।
বিধানদা শিশুর মতো হাসি দিলেন ।

বুঝে গেলাম ঢিল লেগেছে । বিধানদা এলাহী নাস্তার অর্ডার করলেন । আরো নিশ্চিত হওয়া গেল যে তার পকেটের স্বাস্থ্য ভালো । বিধানদার আবার গান বাজনায় আগ্রহ আছে । কথায় কথায় জানালাম আজ সন্ধ্যায় তো রবীন্দ্র সম্মেলন মুসলিম হলে কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট । বাস চলছে না ।

বিধানদা গম্ভীর হয়ে শুধু বললেন

: কুছতা ভাবিয়ো না । তোমারে সন্ধ্যা বেলায় টেক্সীতে করিয়া লইয়া যাইমু নে । ( বিধানদা সুনামগঞ্জের ছেলে )

আমার অন্তরে শান্তিনিকেতনের সুশীতল বাতাসের ঢেউ খেলে গেল । হলের চারপাশটা মূহুর্তে ভালো হয়ে গেল । ক্যাম্পাসের রোদ,ছুটির সকাল চনমনে হয়ে উঠলো ।

সন্ধ্যাবেলা ট্যাক্সী করে বিধানদা,মনজু আর আমি মুসলিম হলে এসে হাজির । ওখানে গিয়ে রেজা স্যার,হোসাইন কবীর,শিলু,দীনা,রুমানা,নাসিম,গৌতম,সুজিতকে আবিস্কার করলাম ।
আমার অপেক্ষা কখন বেগম সুফিয়া কামালকে দেখবো ।

কিছুক্ষণ পর দেখি আনিসুজ্জামান স্যার বেগম সুফিয়া কামালকে হাত ধরে ধরে নিয়ে আসছেন । লোকজনের ভীড় জমে গেছে । আমি মুগ্ধ চোখে সাঁঝের মায়ার কবি সুফিয়া কামালকে দেখতে থাকি । নীল পাড়ের শাদা সুতি শাড়ি । চোখে খুব পাওয়ারের চশমা । মূহুর্তেই ভালো লেগে যায়,আপনা থেকেই শ্রদ্ধা জাগে । সুজিত দৌঁড়ে গিয়ে এক ফাঁকে অটোগ্রাফ নিয়ে আসে ।
অটোগ্রাফ পেয়ে সুজিত তো মহা খুশী । অটোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে দেখি বেগম সুফিয়া কামালের কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা ।

ওমা নিজেই নিজের নামের বানান ভুল করেছেন । কামালের জায়গায় কমাল লিখেছেন ।

সম্মেলন শুরু হলো । হল ভর্তি লোকজন । সারা বাংলাদেশ থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত পিপাসু মানুষ । আমরা দলবল এক সাথে বসতে পারলাম না । কে কোথায় ছিটকে পড়লো কে জানে । সুজিত অটোগ্রাফের পৃষ্ঠাটা আমার কাছ থেকে নিতে ভুলে গেল ।

খুলনা থেকে আসা ছেলে মেয়েরা মঞ্চে পারফর্ম করছে । আমার বুক পকেটে অটোগ্রাফের পৃষ্ঠাটা । একটু পর পর পকেটে হাত দিয়ে দেখি কাগজটা আছে কি না । কি রকম যে এক অনুভূতি !

শ্রদ্ধেয়া বেগম সুফিয়া কামাল বেঁচে নেই । আনিসুজ্জামান স্যার এখনো আছেন মাথার উপর ছাতা হয়ে ।

সুজিত এখন আর বাংলাদেশে নেই । বাবরী মসজিদ নিয়ে তুমুল দাঙ্গার পর সুজিতদের কুমিল্লার বাড়ি থেকে ওদের উচ্ছেদ করা হয়েছে । বন্ধুরা বয়সী ঈগল পাখির থাবা চোখের কোণে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে ।

যায় দিন তুমুল বর্ষার মতো ।

অটোগ্রাফটা আমার কাছে স্মৃতির সেপটিপিন হয়েই পড়ে থাকলো, টাটকা এখনো ।

সুফিয়া কামাল মানে বাংলাদেশের ছোঁয়া বুকে- কবির সুমন


আজ ২০ই নভেম্বর। বেগম সুফিয়া কামালের মৃত্যুদিবস।

বেগম সুফিয়া কামালের দর্শন আমি জীবনে প্রথম পাই ১৯৯৬ সালে; আমার প্রথম সঙ্গীত সফরে বাংলাদেশে – যখন আমি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের জন্য তহবিল তুলতে গিয়েছিলাম। তাঁর কথা আমি আগে শুনেছি, পড়েছি, খুব বেশি পড়ার সুযোগ পাই নি। পশ্চিম বঙ্গের ক’জন আর অন্নদা শংকর রায়ের মতো বেগম সুফিয়া কামালের খবর রাখেন? ক’টা লেখা বেরিয়েছে তাঁর উপর? কিছুই না। আমার বাংলাদেশের বন্ধুরা যখন নিয়ে গেলে তাঁর বাড়িতে আমার একটা প্রথম উদ্ঘাটন হলো যে আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিন সাক্ষাৎ আমার মা। আমি দ্বিতীয় বার এক মায়ের দর্শন পেলা। আমার প্রথম মা উমা চট্টোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় মা বেগম সুফিয়া কামাল। আমার ভাবতে গর্ব হয় আমার গর্ভধারিনী মা উমা চট্টোপাধ্যায়কে শুনিয়েছিলাম তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বেঁচে থাক… ’

মাটিতে পায়ের কাছে বসে পড়লাম। কোনোদিন তাঁকে আগে দেখি নি। তিনি আমায় আদর করছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর আমিও তাঁকে আদর করছি। আমিও…! ছেলেরা যেমন মায়ের সাথে করে। আমি তাঁর গাল টিপে দিচ্ছিলাম। অতো মিষ্টি একজন মানুষ যে হতে পারে আমার জানা ছিলো না। ঠিক আমি নিজের মাকে যেভাবে আদর করতাম সেভাবে আমি খালাম্মাকে আদর করেছি। বেগম সুফিয় কামাল আমাদের খালাম্মা, মাসী মা। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি হলেন ‘নানী’।

আমার কান্না এসে যাচ্ছে। এই একজন মানুষের কথা ভাবলে আমার কান্না পাই।

তারপর আমি যে গানটি লিখেছিলাম সেটি আমি লিখি নি আসলে – সময় লিখিয়ে নিয়েছে; আমার আসল যে বাঙালি-চেতনা, মানবচেতনা সেটা লিখিয়ে নিয়েছে। যে বাঙালি আজ বড়ো কম দেখি পশ্চিম বঙ্গে, যে বাঙালিকে বাঙালিয়ানা প্রমাণ করতে হয় ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে।

না, আমি সে বাঙালি না। আমি একটা অন্য বাঙালি; যার দেশ একটা জায়গায় না। বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন সারা পৃথিবীর মানুষ।

তার উপর গানটি লিখে আমি প্রথম গেয়েছিলাম বাংলাদেশেই। ১৯৯৮ বাংলাদেশে আমার দ্বিতীয় সঙ্গীত সফরে, মিরপুর স্টেডিয়ামে।

ঐ তো লক্ষ ছেলেমেয়ে
নাতিনাতনি দামাল
সবুজ দ্বীপের মত মাঝখানে
সুফিয়া কামাল

এক একটা দেশ থাকে মানচিত্রেই শুধু রাখা
কারুর নয়নে থাকে স্বদেশের ছবিখানি আঁকা
আমি সেই স্বদেশের ছবি দেখি আপনার মুখে
সুফিয়া কামাল মানে বাংলাদেশের ছোঁয়া বুকে।

মাটিতে পায়ের কাছে বসেছি ধুলোর মত আমি
পৃথিবীকে চুমু খায় গানে গানে আমার বোকামি
বোকারাই গান লেখে, গান বাঁধে, গান গেয়ে মরে
এবার মরলে আমি জন্মাব আপনার ঘরে।

আপনার ঘর মানে ঘর আর বাইরের মিল
ভাষার থালায় ভাত খেতে বসে অপার নিখিল
কারা ভাত কেড়ে নেয় সাবধান সামাল সামাল
ভাত মানে ভাষা আর খালাম্মা সুফিয়া কামাল।
আজ ২০ই নভেম্বর। বেগম সুফিয়া কামালের মৃত্যুদিবস।

বেগম সুফিয়া কামালের দর্শন আমি জীবনে প্রথম পাই ১৯৯৬ সালে; আমার প্রথম সঙ্গীত সফরে বাংলাদেশে – যখন আমি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের জন্য তহবিল তুলতে গিয়েছিলাম। তাঁর কথা আমি আগে শুনেছি, পড়েছি, খুব বেশি পড়ার সুযোগ পাই নি। পশ্চিম বঙ্গের ক’জন আর অন্নদা শংকর রায়ের মতো বেগম সুফিয়া কামালের খবর রাখেন? ক’টা লেখা বেরিয়েছে তাঁর উপর? কিছুই না। আমার বাংলাদেশের বন্ধুরা যখন নিয়ে গেলে তাঁর বাড়িতে আমার একটা প্রথম উদ্ঘাটন হলো যে আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিন সাক্ষাৎ আমার মা। আমি দ্বিতীয় বার এক মায়ের দর্শন পেলা। আমার প্রথম মা উমা চট্টোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় মা বেগম সুফিয়া কামাল। আমার ভাবতে গর্ব হয় আমার গর্ভধারিনী মা উমা চট্টোপাধ্যায়কে শুনিয়েছিলাম তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বেঁচে থাক… ’

মাটিতে পায়ের কাছে বসে পড়লাম। কোনোদিন তাঁকে আগে দেখি নি। তিনি আমায় আদর করছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর আমিও তাঁকে আদর করছি। আমিও…! ছেলেরা যেমন মায়ের সাথে করে। আমি তাঁর গাল টিপে দিচ্ছিলাম। অতো মিষ্টি একজন মানুষ যে হতে পারে আমার জানা ছিলো না। ঠিক আমি নিজের মাকে যেভাবে আদর করতাম সেভাবে আমি খালাম্মাকে আদর করেছি। বেগম সুফিয় কামাল আমাদের খালাম্মা, মাসী মা। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি হলেন ‘নানী’।

আমার কান্না এসে যাচ্ছে। এই একজন মানুষের কথা ভাবলে আমার কান্না পাই।

তারপর আমি যে গানটি লিখেছিলাম সেটি আমি লিখি নি আসলে – সময় লিখিয়ে নিয়েছে; আমার আসল যে বাঙালি-চেতনা, মানবচেতনা সেটা লিখিয়ে নিয়েছে। যে বাঙালি আজ বড়ো কম দেখি পশ্চিম বঙ্গে, যে বাঙালিকে বাঙালিয়ানা প্রমাণ করতে হয় ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে।

না, আমি সে বাঙালি না। আমি একটা অন্য বাঙালি; যার দেশ একটা জায়গায় না। বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন সারা পৃথিবীর মানুষ।

তার উপর গানটি লিখে আমি প্রথম গেয়েছিলাম বাংলাদেশেই। ১৯৯৮ বাংলাদেশে আমার দ্বিতীয় সঙ্গীত সফরে, মিরপুর স্টেডিয়ামে।

ঐ তো লক্ষ ছেলেমেয়ে
নাতিনাতনি দামাল
সবুজ দ্বীপের মত মাঝখানে
সুফিয়া কামাল

এক একটা দেশ থাকে মানচিত্রেই শুধু রাখা
কারুর নয়নে থাকে স্বদেশের ছবিখানি আঁকা
আমি সেই স্বদেশের ছবি দেখি আপনার মুখে
সুফিয়া কামাল মানে বাংলাদেশের ছোঁয়া বুকে।

মাটিতে পায়ের কাছে বসেছি ধুলোর মত আমি
পৃথিবীকে চুমু খায় গানে গানে আমার বোকামি
বোকারাই গান লেখে, গান বাঁধে, গান গেয়ে মরে
এবার মরলে আমি জন্মাব আপনার ঘরে।

আপনার ঘর মানে ঘর আর বাইরের মিল
ভাষার থালায় ভাত খেতে বসে অপার নিখিল
কারা ভাত কেড়ে নেয় সাবধান সামাল সামাল
ভাত মানে ভাষা আর খালাম্মা সুফিয়া কামাল।

জামাতের টাকার গুন - মিনা ফারাহ’র ডিগবাজি


হায়রে, জামাতের টাকার কি গুন!লাউ হয়ে যায় বেগুন!!!
Article of মিনা ফারাহ, January 23, 2011 in Bangla Blog, Politics:
http://minafarah.com/?p=30

আমিও চাই দ্রুত বিচার হোক। মুক্তিযুদ্ধে আমারও আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে। আমার নিজের বাড়িটিই ছিল কামারুজ্জামানের আলবদর হেডকোয়ার্টার, যেখানে বসে পাকিস্তানীদের সঙ্গে কামারুজ্জামান মানুষ হত্যার নীল নকশা তৈরি করতো। নয় মাস পরে ফিরে এসে দেখি, মেঝেতে রক্ত মাখা। তাদের তৈরি জেলখানা। যমটুপি। অস্ত্র। দড়ি। গর্ত। গণহত্যার নীল নকশা তৈরি শেষে কার্যকর হতো সেরিপুলে। কামারুজ্জামানের বিষয়ে আমি বহু আগে থেকেই জাগরণের কাজটি করে আসছি। যারা আমার বাড়িতে তার হয়ে কাজ করেছে, পরবর্তীতে সাক্ষী দিয়েছে, টিভিতে বহুবার প্রচার হয়েছে শেরপুরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে রাজাকার মোহন মুন্সির মুখে কামরুজ্জামানের কুকর্মের কাহিনী।

জোট এবং তাদের বিচারের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে লবি করছে বর্তমান বিরোধীদল। যেহেতু নিউইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রায় ২৮ বছর আছি, একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে নিয়ত দেখছি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি প্রবাসেও কতোটা শক্তিশালী। গেল একমাসে বাচ্চু রাজাকার, সাঈদী, কামারুজ্জামানের মুক্তির দাবিতে বিশাল মিটিং-লবি হয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টেও তারা গেছে। ফান্ডিং করেছে নিউইয়র্কের চেনা ব্যক্তিত্বরা। এতোবড় মিটিং, লবি খোদ ঢাকায় হয়েছে কি-না সন্দেহ। নিউইয়র্কের অধিকাংশ বাংলা মিডিয়া এদের অন্যতম সমর্থক। গণতন্ত্র থাকলে এর চর্চাও যে কতোটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে, নিউইয়র্ক শহরে বসে সেই অভিজ্ঞতায় প্রায় সারাক্ষণই টইটুম্বুর আমি।

নয়া দিগন্তের সাথে মিনা ফারাহর সাক্ষাৎকার (18.3.13) প্রশ্ন আকারে এখানে তুলে ধরা হলো।
http://www.dailynayadiganta.com/new/?p=142034

প্রশ্ন : যুদ্ধাপরাধ বিচারে আপনি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু আপনি সাক্ষ্য দেননি। কেন?

মিনা ফারাহ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১০ এপ্রিল আমরা পরিবারের সবাই ভারত চলে যাই। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত থেকে বাড়ি ফিরে আসি। আসার পর শুনি আমাদের বাড়িতে ক্যাম্প করা হয়েছিল; কিন্তু আমি এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। কাউকে দেখিওনি। কারো নামও আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না। আমার কাছে তদন্ত কর্মকর্তা গিয়েছিলেন। আমি বলেছি আমি যা শুনেছি তাই বলতে পারব। আমি নিজে কিছু দেখিনি এবং শোনা কথার বাইরে কিছু জানিও না। তারা আমার শোনা কথাই রেকর্ড করল। কিন্তু পরে আমি জানতে পারলাম আমি যা বলেছি তার সাথে তদন্ত কর্মকর্তার লিখিত জবানবন্দীর মিল নেই। এরপর আপনাদের নয়া দিগন্তেই একটি প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে আমি আমাকে সাক্ষী হিসেবে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেই।

অ্যানরেন্ডের স্কুল বনাম জিম জোন্সের দরগা
সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৩, ০১:৩২ অপরাহ্ন

মিনা ফারাহ
ইদানীং বাংলা খবর দেখলে আগে নিশ্চিত হতে হয়, এটা মিসর নাকি বাংলাদেশ?পানির ড্রাম লুকিয়ে রেখে ঢেলে দিচ্ছে পেট্রল। মানুষের পশুবৃত্তিকে উসকে দিচ্ছে রাজনীতিবিদেরা। হয়েছে ক্যান্সারÑ চলছে কালাজ্বরের চিকিৎসা!
রাজনীতিবিদদের রাজনীতিহীনতায় দেশটি প্রায় কলোনি। প্রতিবেশী দেশ বন্ধু হয়, আপনজন হয় না। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘হাসিনাজি আমাদের আপনজন, মনে হয় তিনি এই বাংলারই মেয়ে।’ সাম্রাজ্যবাদীদের কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে ভারত, যেভাবে পশ্চিমারা সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করছে মধ্যপ্রাচ্য ও
আফ্রিকায়। যাদের দায়িত্ব সার্বভৌমত্ব রা করা তারাই তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী। জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনের সময় ২০ মিনিটের মিটিং কেন্দ্র করে নয়া দিগন্তে যে কথা আগেই লিখেছিলাম, সেটাই সত্য হলো। ‘জঙ্গিবাদ প্রশ্নে মনমোহনকে বুঝিয়েছেন হাসিনা, ওবামাকে ম্যানেজ করলেন মনমোহন।’ এভাবেই সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান কায়েম করছে ভারত।
সম্ভবত মার্কিনিরা চায়, খালেদা। ভারত চায়, হাসিনা। কোনপর্যায়ে নামিয়েছি দেশটাকে! মতার নাম ইয়াবা। ১/১১-এর রিহ্যাব সেন্টার থেকে বেরহয়েই রাজনীতিবিদেরা ফিরে গেছেন যার যার ইয়াবা আস্তানায়। ইয়াবা কেউ খায় না, ইয়াবাই তাকে খায়। সর্বত্রই ‘ঐশী’র কালোছায়া। ’৭৫-এর স্বৈরাচার ভুলে গেছি। আবার বাকশাল প্রত্যাবর্তনে তবুও নীরব মানুষ।অ্যাক্টিভিজমের ভিত্তিতে লেখাটি পর্যাপ্ত নমনীয় নয় বলে দুঃখিত।

Sunday, November 10, 2013

৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের আক্রমণ -সুমি খান


২০১৩-এর ৬ এপ্রিল ও ৫ মে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার শাপলা চত্বরে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামক কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের বিশাল সমাবেশ এবং তাদের ১৩ দফা দাবি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অস্তিত্বকে প্রচ- চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবি ঘোষণা করে সরকারকে এক মাসের কম সময়ের ভেতরে তা মেনে নেয়ার জন্য যেভাবে আল্টিমেটাম দিয়েছে অতীতে কোন রাজনৈতিক দলকে এ ধরনের কর্মসূচী ঘোষণা করতে দেখা যায়নি।
সরকার তাদের দাবি নির্ধারিত সময়ের ভেতর মেনে না নেয়ায় ৫ মে হেফাজতে ইসলাম পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকা অবরোধের নামে রাজধানীর প্রধান মসজিদ বায়তুল মোকাররমকে ঘিরে প্রায় চার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যে তা-ব ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করেছে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তার দ্বিতীয় নজির নেই। এই দিন তারা জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সহযোগিতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। ৫ মের মহাতা-বের পর হেফাজতের গ্রেফতারকৃত নেতাদের স্বীকারোক্তি এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে দেশবাসী প্রায় অজানা এক জঙ্গী মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সরকার উৎখাতের এই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার কথা জেনে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী রাজধানী ঢাকা সহ বাংলাদেশের যে কোন স্থানে সমাবেশ করতে হলে পুলিশের অনুমতি প্রয়োজন। হেফাজতে ইসলামকে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কতিপয় শর্তে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল, যার ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ছিল সমাবেশস্থলে কোন উচ্ছৃঙ্খল কর্মকা- করা যাবে না, কোন ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও মানহানিকর কোন বক্তব্য প্রদান করা যাবে না এবং সন্ধ্যা ছয়টার আগে সমাবেশ শেষ করে সভাস্থল ত্যাগ করতে হবে। হেফাজত এর কোনটাই মানেনি।
বেলা দুটোর দিকে হেফাজতের সমাবেশ আরম্ভ হওয়ার পরপরই মতিঝিল ও বায়তুল মোকাররমের চতুর্দিকে ভাংচুর, পুলিশের উপর হামলা এবং সংঘর্ষের ঘটনা কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকীয় রূপ ধারণ করে। বায়তুল মোকাররমের চারপাশে ছোট ছোট ফুটপাথ ব্যবসায়ী ও হকারদের দোকানে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই হামলা ও অগ্নিসংযোগ থেকে যানবাহন, সরকারের বিভিন্ন দফতর, ব্যাংক, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, কর্তব্যরত সাংবাদিক ও পুলিশ, গণমাধ্যমের স্টিকারযুক্ত গাড়ি, এমনকি সড়কদ্বীপের বৃক্ষরাজি ও রেলিং কিছুই রেহাই পায়নি। সন্ধ্যায় মাগরেবের আজানের সময় বায়তুল মোকাররমের চারপাশে আগুনের লেলিহান শিখার আড়ালে ঢাকা পড়েছিল গোটা মসজিদ। শোনা যাচ্ছিল গরিব হকারদের আর্তনাদ, যারা বিক্রি করত পবিত্র কোরান ও হাদিসসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ, জায়নামাজ, আতর, টুপি ও তসবিহ। টেলিভিশনে এসব দৃশ্য দেখে সেদিন ঢাকাবাসীসহ গোটা দেশবাসীর মনে হয়েছিল গৃহযুদ্ধকবলিত বৈরুত বা দামাস্কের কোন দৃশ্য দেখানো হচ্ছে।
এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞের জ্বলন্ত অগ্নিকু-ে ঘৃতাহুতি বর্ষণ করেছিল বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এক যুদ্ধংদেহী আহ্বান। এর এক দিন আগে তিনি ৪ মে’র জনসভায় ৪৮ ঘণ্টার ভেতর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়ার জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন, যা ৫ মে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরই খালেদা জিয়া তাঁর নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীসহ ঢাকাবাসীদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ থেকে বার বার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল সমাবেশের কার্যক্রম চলতে থাকবে এবং হেফাজতপ্রধান আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী কিছুক্ষণের ভেতরই আসবেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে এসে সকাল থেকে রাজধানীর লালবাগ মাদ্রাসায় অবস্থান গ্রহণ করলেও সমাবেশে আসেননি।
প্রধান নেতার অনুপস্থিতিতে হেফাজতের অন্যান্য নেতারা মহাজোট সরকার, ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ ও ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র নেতৃবৃন্দসহ দেশেবরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের নাম উল্লেখ করে উত্তেজনাপূর্ণ ও উষ্কানিমূলক ভাষণ দেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বহু কর্মী ‘শহীদ’ হয়েছে এরকম গুজব রটনার পর হেফাজত ও জামায়াতের কর্মীরা আরও মারমুখী হয়ে ওঠে।
সরকার উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতাদের লাগাতার অবস্থানের ঘোষণা এবং শেষ রাতে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গভীর রাতে শক্তি প্রয়োগ করে হেফাজতের কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয়। রাতের অন্ধকারে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য তারা বিকট শব্দের সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপসহ শটগান ও জলকামান ব্যবহার করে। আল্লামা শফীর মহাসমাবেশে এ ধরনের পরিস্থিতি যে ঘটতে পারে গ্রাম থেকে আসা মাদ্রাসার ছাত্রদের সে সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। আতঙ্কিত হয়ে তারা প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিগি¦দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দ্রুত সভাস্থল ছেড়ে চলে যায়।
৫ মে শাপলা চত্বর মুক্ত অভিযানে আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী রাইফেল, বন্দুক বা ঐ জাতীয় কোন অস্ত্র ব্যবহার করেনি। তবে শটগানের রবার বুলেটে এবং টিয়ার গ্যাসের শেল-এর আঘাতে জামায়াত-হেফাজতের কয়েক শ’ কর্মীসহ বহু নিরীহ পথচারীও আহত হয়েছে। পরদিন এলাকায় ফিরে যাওয়ার সময় হেফাজত-জামায়াতের কর্মীরা পথে পথে তা-ব এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলা অব্যাহত রাখে, যার ফলে নিহতের সংখ্যাও বেড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহের ৫ মে’র শেষ রাতের অভিযান সংক্ষিপ্ততম সময়ের ভেতর সমাপ্ত হয় এবং হেফাজত-জামায়াত-বিএনপির সরকার উৎখাতের পরিকল্পনাও ভ-ুল হয়ে যায়। পুলিশ পরদিন হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে গ্রেফতার করে এবং হেফাজতপ্রধান অতিবৃদ্ধ আল্লামা শফীকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় হেফাজত-জামায়াত-বিএনপির নেতারা ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁরা দাবি করেন ৫ মে গভীর রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ ভাঙতে গিয়ে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজেবি হাজার হাজার আলেম ও হেফাজতকর্মীকে হত্যা করেছে এবং লাশ গুম করেছে।
ঢাকার জাতীয় দৈনিকসমূহে ৫ ও ৬ মের ঘটনায় নিহতদের সংবাদে সর্বাধিক ২৯ জনের কথা বলা হলেও হেফাজত ও জামায়াত কখন নিহতের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার, কখনও আড়াই হাজার বলে দাবি করেছে এবং হাইতির ভূমিকম্পে নিহতদের ছবিকে শাপলা চত্বরে নিহত দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে। এরপর ‘অধিকার’ নামক একটি এনজিও নিহতের সংখ্যা প্রথমে ২০০ জন, পরে নির্দিষ্টভাবে ৬১ জন দাবি করে এ নিয়ে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক প্রচার চালায়। সরকারী কর্তৃপক্ষ ‘অধিকার’-এর কাছে নিহতদের ঠিকানাসহ নাম চাইলে তারা তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ‘অধিকার’ দাবি করেছে নিহতদের তালিকা হেফাজতে ইসলাম তাদের দিয়েছে। অথচ হেফাজতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা এ ধরনের কোন তালিকা ‘অধিকার’কে দেয়নি।
হেফাজতে ইসলামের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘লিখনী’র সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে সংগঠনের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনÑ ‘এটা তাদের (অধিকার) নিজস্ব অনুসন্ধান। তারা কিভাবে অনুসন্ধান করেছে, কাদের নিহত হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে সে ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই। হেফাজত থেকে তাদের কোন তথ্য দেয়া হয়নি।’
‘লিখনী’র পক্ষ থেকে হেফাজতের মহাসচিবকে এ বিষয়ে আরও প্রশ্ন করা হয়Ñ ‘দেশের অনেক প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রচার করেছে ও প্রমাণ দিচ্ছে ‘অধিকার’-এর রিপোর্টের অধিকাংশ ব্যক্তিই ভুয়া বা অজ্ঞাতপরিচয়। এর দ্বারা তো হেফাজতের ব্যাপারেও জনগণ মিথ্যা ধারণা পেতে পারে।’ জবাবে জুনায়েদ বাবুনগরী বলেনÑ ‘এটা আমাদের তালিকা নয়। এ তালিকা আমরা দেইনি এবং এ তালিকার কোন তথ্যের সঙ্গে আমরা জড়িতও নই। সত্য জানাটা বাংলাদেশের তৌহিদী জনতার মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমরা যদি এখন শহীদদের বা আহতদের তালিকা প্রকাশ করি তবে তাদের পরিবার আওয়ামী সরকারের পেটোয়াবাহিনী এবং দলীয় সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হবে। বাংলাদেশের এমন অনেক মাদ্রাসা আছে যেখানে অনেক ছাত্র-শিক্ষক আহত-নিহত হয়েছেন, কিন্তু তাদের পরিবার আজ জীবনের ভয়ে তাদের নাম প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছেন না। আমাদের কাছে এমন তথ্যও আছে, নিহতদের পরিবারকে র‌্যাব-পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা তাদের বাড়ি গিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে এসেছে। আর হেফাজতের ঘটনায় কেবল আলেম-ওলামাই নন, অনেক সাধারণ মুসলমানও নিহত হয়েছে। কিন্তু সে তথ্য এখন প্রকাশ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’১
১. লিখনী, ১ অক্টোবর ২০১৩

‘অধিকার’-এর এই বিতর্কিত তালিকা দেশে ও বিদেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। সরকার ‘অধিকার’-এর সচিব ও নির্বাহী প্রধান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট আদিলুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে।
নিহতের প্রকৃত সংখ্যা জানার জন্য গণকমিশনের তদন্তকর্মীরা হেফাজতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। হেফাজতের সদর দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁরা ঘটনার আড়াই মাস পরও নিহতের তালিকা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। এই তালিকা প্রস্তুত করার জন্য হেফাজতে ইসলাম ১০০১ সদস্যের একটি কমিটি করেছে। ৬ আগস্ট হেফাজতের পক্ষ থেকে গণকমিশনের তদন্তকর্মীদের ই-মেইলে ৫ মে শাপলা চত্বরে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’-এর নিহতদের তালিকা পাঠানো হয়েছে। পাঁচ পৃষ্ঠার এই তালিকায় ৫ মে শাপলা চত্বরে ‘শাহাদতবরণকারী’ ৭৯ জনের নাম রয়েছে।
হেফাজতের এই তালিকায় যেহেতু সর্বোচ্চ সংখ্যক ‘নিহত’ ব্যক্তির নাম রয়েছে এটিকে ভিত্তি করে গণকমিশন এতে বর্ণিত নিহতদের ঠিকানা অনুযায়ী কক্সবাজার থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করে। হেফাজতের তালিকার প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে ১৪ জনের নাম দু’বার বা তিন বার লেখা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যালোচনায় আরও দেখা গিয়েছে, হেফাজতের আক্রমণে নিহত, হৃদরোগে মৃত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তা, ৬ মে ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে ও চট্টগ্রামে নিহতদের নামও হেফাজতের তালিকায় রয়েছে। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর গণকমিশনের তদন্তকর্মীরা হেফাজতের তালিকার ৫৬ জনের ঠিকানায় গিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। অনুসন্ধানে হেফাজতের নিহতের তালিকায় ৫ জনকে জীবিত পাওয়া গিয়েছে। যে সব ব্যক্তির নাম দুই বা তিনবার আছে ভিন্ন ভিন্ন ঠিকানায়, তদন্তকর্মীরা জানতে পেরেছেন এক ব্যক্তিকে একাধিক ঠিকানায় উল্লেখ করে তালিকার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ৩ জনের ঠিকানায় গিয়ে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি, পরিবারের পক্ষ থেকে নিখোঁজ বলা হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে হেফাজতের তালিকায় বর্ণিত ৭৯ জনের ভেতর ৩৪ জনের মৃত্যু সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। নিহতের নাম হেফাজতের তালিকায় নেই, অথচ পুলিশের তালিকায় আছে এরকম ৪ ব্যক্তির ঠিকানায়ও কমিশনের কর্মীরা গিয়েছে। এ ছাড়া একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সূত্রে এমন নিহতের সন্ধানও পাওয়া গেছে যার নাম হেফাজত, অধিকার বা পুলিশÑ কারও তালিকায় নেই।
সংবাদপত্র, হেফাজতে ইসলামের তালিকা, ‘অধিকার’-এর তালিকা এবং পুলিশের সদর দফতর থেকে প্রাপ্ত তালিকা পর্যালোচনা করে এবং মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে গণকমিশন ৫ ও ৬ মের সংঘর্ষে রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে মোট ৩৯ জন নিহতের সন্ধান পেয়েছে। এদের ভেতর ২০ জনের কবর শনাক্ত করা হয়েছে, বাকিদের কোথায় দাফন করা হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যরা জানেন না। গণকমিশনের তালিকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিহত ৬ জনের নাম যুক্ত করা হয়নি।
হেফাজত ও ‘অধিকার’-এর তালিকা পর্যালোচনা করে এবং প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের জবানবন্দি থেকে গণকমিশন এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেÑ ৫ মে শেষ রাতে শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খালা-রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে হেফাজতের বা জামায়াতের কোন কর্মী নিহত হয়নি। সেই রাতে একজন পুলিশ হেফাজতের আক্রমণে আহত হয়ে পরে মৃত্যুবরণ করেছেন। গণকমিশন এ বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ৫ জন সাংবাদিকের জবানবন্দী গ্রহণ করেছে।
পুলিশের সদর দফতরের চূড়ান্ত তালিকায় আমরা দেখেছি ৫ ও ৬ তারিখের সংঘর্ষে হেফাজতের কর্মী-সমর্থক নিহত ১১, অন্যান্য ১১ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৬ জন সদস্য রয়েছেন। জানুয়ারি ২০১৩ থেকে অক্টোবর ২০১৩ পর্যন্ত সহিংসতা ও নাশকতারোধে পুলিশের মোট ১২ জন সদস্য নিহত, গুরুতর আহত ১৯১ জন এবং সাধারণ আহতের সংখ্যা ১৭৬৭ জন।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ও সাপ্তাহিকে পরবর্তী কয়েকদিন যাবৎ ৫ মের ঘটনা সম্পর্কে যে সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে হেফাজতকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসী জ্ঞাত হলেও এই ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন দিক রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক অনালোচিত সংগঠন কিভাবে রাজধানী পর্যন্ত এসে এহেন নারকীয় তা-ব ঘটাতে পারে, তাদের শক্তির উৎস কি, কারা তাদের মদদদাতা এবং আরও নির্দিষ্টভাবে ৫ মে গভীর রাতে শাপলা চত্বরে কি ঘটেছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শেষ রাতের অভিযানে কতজন নিহত হয়েছেÑ এরকম বহু প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। হেফাজতের উত্থান ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের বিষয়টি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে যুক্ত সেহেতু দেশবাসীর অধিকার রয়েছে অমীমাংসিত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর জানার।
এই ঘটনার পর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র পক্ষ থেকে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছিল এ বিষয়ে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন এবং শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য। সরকারের অনাগ্রহ লক্ষ্য করে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে ১ জুন (২০১৩) একটি গণকমিশন গঠন করা হয়। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের দ্বারা গঠিত ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’-এর সদস্যরা হচ্ছেনÑ বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম (চেয়্যারম্যান), অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাংবাদিক কামাল লোহানী, লেখক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অজয় রায়, শিক্ষাবিদ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, এ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক আবুল বারকাত, সাংবাদিক শামীম আখতার, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ ও লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির (সদস্য সচিব)।
মাঠপর্যায়ে তদন্ত এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য কমিশন একটি সচিবালয় গঠন করে।
(৭-এর পৃষ্ঠার পর)
সচিবালয়ের সদস্যদের ভেতর বিভিন্ন দৈনিক ও টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিক এবং নির্মূল কমিটির কেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সহ একসময়ে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও ‘হরকত-উল- জিহাদ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন কিছু ব্যক্তিকেও নিযুক্ত করা হয়Ñ যাঁরা বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত। হেফাজতে ইসলাম যেহেতু মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন এবং তাদের অনেক দলিলপত্র আরবী ও উর্দুতে লেখা সে কারণে মাদ্রাসা পড়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাঁচজনকে কমিশনের তদন্ত এবং বিভিন্ন দলিলপত্র সংগ্রহে সহযোগিতার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। জামায়াত, হেফাজত ও অন্যান্য জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের তথ্য সংগ্রহ করার সময় এদের অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। হেফাজতের কয়েকজন কর্মী, যাঁরা আমাদের তদন্তে সহযোগিতা করেছেন, তাঁরা তাঁদের নাম গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বানচালের পাশাপাশি বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্র বানাবার জন্য জামায়াতে ইসলামী গত বছরের সেপ্টেম্বর (২০১২) মাস থেকে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়ে উপর হামলা অব্যাহত রেখেছে। জামায়াত মনে করে সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক, ওদের দেশ থেকে বিতাড়ন করতে হবে এবং সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে নির্বাচনের সময় ভোটদান থেকে বিরত রাখতে হবে। ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও পরে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর জামায়াত-বিএনপি সন্ত্রাসীদের নজিরবিহীন নির্যাতনের কারণে প্রায় তিন লক্ষ হিন্দুকে একরকম শূন্য হাতে রাতের অন্ধকারে পৈত্রিক ভিটা ত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ ও ২০১১ সালে সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রাদয়ের উপর কিছু বিক্ষিপ্ত হামলা হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে জামায়াতের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা অনুযায়ী যে ভয়াবহ হামলা হয়েছে তা নিরীহ বৌদ্ধ সম্প্রদায় শুধু নয়, সমগ্র জাতিকে স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালেও তাদের উপর এরকম হামলা হয়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল তখন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস অব্যাহত থাকার প্রধান কারণ ছিল সরকারীভাবে এসব ঘটনার অস্বীকৃতি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন মহাজোটের আমলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরকারি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা যুক্ত থাকলেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যেহেতু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হয়নি সেজন্য সরকার অস্বীকারও করেনি। রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার পরদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী উপদ্রুত এলাকায় গিয়েছেন এবং প্রশাসনের যেসব ব্যক্তির নিস্ক্রিয়তা বা সহযোগিতার কারণে হামলাকারীরা সাহসী হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে কমিশনের তদন্ত প্রতীয়মান হয়েছে যে সব সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বা তাদের সমর্থকরা জড়িত তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছাত্রলীগের কর্মীদের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যামামলা দায়ের করা হলেও রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী যারা যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১৩-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে, যেদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা, গণহত্যাকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার রায়ে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। সেদিন রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। এই হামলার সময় তারা অসহায় হিন্দুদের বলেছে, ‘তোদের সাক্ষীর কারণে সাঈদী হুজুরের ফাঁসি হয়েছে। বাংলাদেশে কোন হিন্দু থাকতে পারবে না।’
বাংলাদেশে মৌলবাদী তা-ব ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার লক্ষ্য অভিন্ন, কুশীলবও অভিন্ন। দুইয়েরই আক্রমণের লক্ষ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান, সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, নারী, উন্নয়নকর্মী, প্রগতিবাদী রাজনীতি, বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা এবং সবার উপরে মানবতা। গণকমিশনের অনুসন্ধানে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিন্নœ কারণ, লক্ষ্য এবং কুশীলবদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিথ্যাচার। জামায়াত ও হেফাজতের রাজনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে মিথ্যাচার। এক মিথ্যা শত মিথ্যার জন্ম দেয়। নাৎসি নেতা গোয়েবলস্-এর মতো এরা বিশ্বাস করে এক মিথ্যা শতবার বললে তা সত্যে রূপান্তরিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদী মিথ্যাচারের সমর্থনে লিখেছেন, ‘বাস্তব জীবনে এমন কিছু চাহিদা রয়েছে যেগুলোর খাতিরে মিথ্যা বলা শুধু জায়েজই নয়, ওয়াজেব।’২
২.আবুল আলা মওদুদী, মাসিক তরজুমানুল কোরআন, ৫০ তম খ-, দ্বিতীয় সংখ্যা, শাবান ১৩৭৭ হিজারি, পৃ: ১১৮

গণকমিশনের শ্বেতপত্রে জামায়াত-হেফাজতের এই মিথ্যাচারের প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রের বস্তুনিষ্ঠার প্রয়োজনে হেফাজতে ইসলামের বক্তব্যসমূহ যতদূর সম্ভব তাদের মূল দলিল থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে ১৩ দফার বিশ্লেষণের জন্য তাদের কোন উর্ধতন নেতার সাক্ষাতকার চাওয়া হয়েছিল। কমিশনের সঙ্গে কারা যুক্ত আছেন জানতে পেরে হেফাজতের কোন নেতা সাক্ষাতকার প্রদানে সম্মত হননি। তবে ১৩ দফার ব্যাখ্যা সম্পর্কে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক প্রকাশিত সংগঠনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওঃ নূর হোছাইন কাসেমী ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওঃ জুনায়েদ আল-হাবীবের লেখা “১৩ দফা দাবি : সরকারের অবস্থান ও পর্যালোচনা” শীর্ষক পুস্তিকাটি (প্রকাশকাল : এপ্রিল ২০১৩) নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হেফাজত নেতা কমিশনকে দিয়েছেন, যা কোন পরিবর্তন ও সম্পাদনা ছাড়া শ্বেতপত্রে সংকলিত হয়েছে। একই ভাবে হেফাজতপ্রধান মাওলানা শাহ আহমদ শফী এবং হেফাজতের অন্যান্য নেতার বক্তব্যও তাদের লেখা পুস্তক/পুস্তিকা এবং ওয়াজের সিডি/ভিসিডি থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম এবং এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দলের বক্তব্যের ক্ষেত্রেও যতদূর সম্ভব সংগঠনগুলোর নিজস্ব প্রকাশনা ব্যবহার করা হয়েছে। শ্বেতপত্রের দ্বিতীয় খ-ে কমিশন কর্তৃক সংগৃহীত ও ব্যবহৃত এসব প্রকাশনার তালিকা প্রদান করা হয়েছে। শ্বেতপত্রের তথ্যের জন্য আমরা হেফাজত প্রভাবিত এক হাজারেরও বেশি মাদ্রাসায় তদন্ত করেছি, ছাত্র ও শিক্ষকদের বক্তব্য নথিবদ্ধ করেছি।
হেফাজতের নেতাদের বক্তব্য ও বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে জানার দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা। এ ক্ষেত্রে কোন দৈনিকের বিশেষ কোন সংবাদ সম্পর্কে হেফাজতের ভিন্নমত থাকলে তাও শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনের তথ্যের তৃতীয় উৎস পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের এতদসংক্রান্ত রেকর্ড যার কিছু দৈনিক পত্রিকায়ও বেরিয়েছে। সকল তথ্য একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করা হয়েছে। তথ্যের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠার ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কমিশনের অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর বাংলাদেশের মূল সংবিধান, বাঙালীর পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস, বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং বিজ্ঞানমনস্কতা। গণকমিশন মনে করে এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
হেফাজতে ইসলামের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার হলেও গণকমিশনের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে সরকারের একটি অংশ হেফাজতের নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা, এই দলের নেতাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামসহ সমমনা মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং কর্মপন্থা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত নন। সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনেকে বিশ্বাস করেন হেফাজত মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং চরিত্রগতভাবে জামায়াতবিরোধী। কমিশনের অনুসন্ধানে এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও হেফাজতের জামায়াত ও জঙ্গী সম্পৃক্ততার বহু তথ্য ও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও একসময় জামায়াতবিরোধী ছিল। এখন বিএনপির পক্ষে জামায়াতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে গিয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন সম্ভব নয়, একইভাবে হেফাজতও পরিচালিত হচ্ছে জামায়াতের দ্বারা। হেফাজত ও জামায়াতের আন্তর্জাতিক মুরুব্বি, অর্থের উৎস ও মদদদাতা অভিন্ন। বর্তমান শ্বেতপত্রে এসব বিষয়ে বহু তথ্য ও প্রমাণ রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলে হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকা-ের শানে নজুল বোঝা সম্ভব হবে না। এ কারণে জামায়াত হেফাজতেকে ব্রাকেটবন্দী করা হয়েছে।
দুই
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯-এর জানুয়ারিতে সরকার গঠন করেছে। মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ আরম্ভ হলেও ১৯৭৩-এর আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে ২০১০-এর ২৫ মার্চ। প্রথম পর্যায়ে যাদের গ্রেফতার ও বিচার আরম্ভ হয়েছে তাদের দশ জনের ভেতর আটজন জামায়াতে ইসলামীর এবং দুইজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
আইসিটি গঠনের আগে থেকেই এই বিচার বিলম্বিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করবার জন্য জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা দেশে ও বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা আরম্ভ করেছে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জামায়াতের শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলী ২৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে ‘ক্যাসেডি এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস’ নামক এক লবিং ফার্মকে এক বছরের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন সেখানে সরকারি মহলে জামায়াতের পক্ষে তদবিরের জন্য।৩
৩.বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা অনলাইন, ২৩ আগস্ট ২০১২

পশ্চিমে অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তি ও সংগঠন ভাড়া করা যায় সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে দেন-দরবারের জন্য। যুক্তরাজ্যে এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশেও জামায়াত কয়েকজন জাঁদরেল আইনজীবী, আইনপ্রণেতা ও কিছু সংস্থাকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে একই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করেছে।
প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্যই দেশের ভেতরে জামায়াত ও বিএনপি নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে, যার প্রধান অভিব্যক্তি হচ্ছে ফ্যাসিবাদী কায়দায় হত্যা ও সন্ত্রাস। জামায়াতে ইসলামী আদর্শগতভাবে হিটলার ও মুসোলিনির নাৎসি ও ফ্যাসিবাদে বিশ্বাস করে, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্যÑ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে কোন ধরনের সন্ত্রাস, হত্যা, নৈরাজ্য, অন্তর্ঘাত ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-কে ধর্ম বা কোন মতবাদের নামে বৈধতা প্রদান। ১৯৭১-এ যাবতীয় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে জামায়াত বৈধতা প্রদান করেছিল ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার দোহাই দিয়ে।
ইসলামের দোহাই দিয়ে জিহাদের নামে বলপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের তত্ত্ব দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলন করেছিলেন মাওলানা আবুল আলা মওদুদী। এই তত্ত্ব বাস্তবায়নের জন্য তিনি ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামী। সেই সময় জামায়াতের গঠনতন্ত্র পড়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদসহ অনেক আলেম ওলামারা মওদুদীকে এ ধরনের রাজনৈতিক দল গঠন থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা সফল হননি। পশ্চিমের গণতন্ত্রকে মওদুদী ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে খারিজ করে আদর্শ হিসেবে অনুকরণীয় মনে করতেন নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদকে। মওদুদী লিখেছেনÑ ‘আজ আপনাদের সামনে জার্মানী ও ইটালীর দৃষ্টান্ত মওজুদ রয়েছে। হিটলার ও মুসেলিনী যে বিরাট শক্তি অর্জন করেছে, সমগ্র বিশ্বে তা স্বীকৃত। কিন্তু এই সফলতার কারণ জানা আছে কি? সেই দুটো বস্তু, অর্থাৎ বিশ্বাস ও নির্দেশের প্রতি আনুগত্য। নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট দল কখনও এত শক্তি ও সফলতা অর্জন করতে পারত না, যদি না তারা নিজেদের নীতির প্রতি অটল বিশ্বাস রাখত এবং নিজেদের নেতৃবৃন্দের কঠোর অনুগত না হতো।’৪
৪.আবুল আলা মওদুদী, সিয়াশী কাশমকাশ, ৩য় খন্ড, ১৬৩ পৃষ্ঠা, উদ্ধৃতঃ মওলানা আবদুল আউয়াল, জামাতের আসল চেহারা, ঢাকা, ১৯৭০

নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে মওদুদী আরও লিখেছেন ‘যেসব জামায়াত কোন শক্তিশালী আদর্শ ও সজীব সামগ্রিক (ইজতেমায়ী) দর্শন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তারা সব সময়ই লঘিষ্ঠ হয়। এবং সংখ্যালঘিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন করে থাকে। মুসোলিনীর পার্টির সদস্য হলো মাত্র চার লাখ। এবং রোমে মার্চ করার সময় ছিল মাত্র তিন লাখ। কিন্তু এই সংখ্যালঘিষ্ঠরা সাড়ে চার কোটি ইটালীয়র উপর ছেয়ে গেছে। এই অবস্থা জার্মানীর নাজী পার্টিরও। একটি মজবুত ও সুসংহত দল শুধু বিশ্বাস ও শৃঙ্খলার জোরে ক্ষমতায় আসতে পারে। তার সদস্যসংখ্যা দেশের অধিবাসীদের প্রতি হাজারে একজন হোক না কেন।’৫
৫. প্রাগুক্ত

জামায়াতে ইসলামীর অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যখনই এই দলটি কোণঠাসা হয়, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তখনই তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আশ্রয় গ্রহণ করে এবং অন্য সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আত্মরক্ষার পথ খোঁজে। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তার দল মুসলিম লীগের কঠোর সমালোচক ছিলেন মওদুদী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাজনীতিতে নিজের দুর্বল অবস্থান শক্ত করবার জন্য মওদুদী আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিরীহ আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়কে, যাঁরা কাদিয়ানী নামেও পরিচিত। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে জামায়াতে ইসলামী সমমনা আরও আটটি মৌলবাদী সংগঠন এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘মজলিস-ই-আমল’ (সংগ্রাম কমিটি) গঠন করে, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন অবস্থান থেকে তাদের বিতাড়ন।’৬
৬. জবঢ়ড়ৎঃ ড়ভ ঃযব ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ওহয়ঁরৎু ঃড় রহয়ঁরৎব রহঃড় ঃযব চঁহলধন উরংঃঁৎনধহপবং ড়ভ ১৯৫৩, খধযড়ৎব, ১৯৫৪, পৃ. ৭৮-৭৯

এই উদ্দেশ্যে মওদুদী ‘কাদিয়ানী মাসালা’(কাদিয়ানী সমস্যা) নামে উত্তেজক ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। মওদুদী লিখেছেনÑ ‘পাকিস্তানের সকল দীনী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে এক বাক্যে দাবী করা হইয়াছে যে, এই ‘কাদিয়ানী বিষফোঁড়াটি’কে অবিলম্বে কাটিয়া পাকিস্তানের মুসলমান সমাজদেহ ব্যাধিমুক্ত করা হউক এবং স্যার জাফরুল্লা খানকে মন্ত্রীপদ হইতে অপসারিত করা হউক।’৭
৭. সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, কাদিয়ানী সমস্যা, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৩

মওদুদীর এই বিষফোঁড়া অপসারণের পরিণতি হচ্ছে পাকিস্তানের ইতিহাসে বহুল আলোচিত ও নিন্দিত কাদিয়ানী দাঙ্গা। এই দাঙ্গায় কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ নিহত ও আহত হয়েছিলেন। দাঙ্গা থামানোর জন্য লাহোরে সামরিক আইন জারি করে সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছিল। এই দাঙ্গার প্রধান হোতা মওদুদীকে তখন সামরিক আদালতে বিচার করে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছিল, যা পরে সৌদি বাদশাহর বিশেষ অনুরোধে রদ করা হয়।
‘মজলিস-ই-আমল’ গঠনের মূল উদ্যোক্তা জামায়াত হলেও এর নেতৃত্বে মওদুদী বা জামায়াতের শীর্ষ কোন নেতা ছিলেন না। কেন্দ্রীয় কমিটিতে জামায়াতের দুজন মধ্যম সারির নেতা ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত জামায়াতের ষাট বছরের জঙ্গী কর্মকা- পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই দলটি সব সময় অন্য সংগঠনের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের শিকার ঘায়েল করতে চেয়েছে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার ব��

রাজনীতি-সংস্কৃতির শেকড়ের নিবিড় বন্ধনে আমার শৈশব- সুমি খান



কেমন ছিল আমার শৈশব?
ফিরে যাই স্বর্ণালী অতীতে। যে অতীত জুড়ে আমার ফ্রেন্ড, ফিলসফার এন্ড গাইড আমার বাবা সাইফুদ্দিন খানের সার্বক্ষণিক সঙ্গ এবং অবাধ স্বাধীনতা। তার পাশাপাশি মা নূরজাহান খানের অপত্য স্নেহের অন্য পিঠেই ছিল কড়া শাসন ।আর আমাদের স্কুল - বীরকন্যা প্রীতিলতার কর্মস্থল অপর্ণা চরণ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মহীয়সী নারী প্রণতি সেনের কঠিন নিয়ম কানুন শৃঙ্খলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আমাদের কৈশোর পর্যন্ত।
সব মিলে আমাদের পারিপার্শ্বিকতা শিশুদের জন্যে অনেক বেশী যত্নশীল ছিল-যা এখন দেখা যায় না। তখন কি তাই বলে বখাটেপনা ছিল না? ছিল, তবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন অনেক। যা এখন দেখা যায় না।
আমার বাবা -মা দু'জনেই ব্যাংকার। আবার দু'জনেই মুক্তিযোদ্ধা, আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথ কাঁপানো মিছিলের চেনা মুখ। চিন্তা চেতনায় অসাম্প্রদায়িক। পরিবারে বাম শীর্ষ রাজনীতিকদের নিত্যআনাগোনা। অনেক বিপ্লবী আর আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিকের গোপন আশ্রয় ছিল আমাদের বাড়ী। মা ভীষণ কর্মঠ এবং অতিথি পরায়ন।
অন্য অনেকের মতো আমিও যৌথপরিবার -একক পরিবার মিলিয়ে অনেকের শাসন-বারণ আদর- ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছি। সেই শাসন আদর কেবল রক্তের সম্পর্কের গুরুজনেরা করেন নি।
আত্মার সম্পর্কের আত্মীয়দের নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি শৈশবে।যারা এই দেশ এই মাটির সাহসী সন্তান-যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন এই দেশ মাটির জন্যে। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব পূর্ণেন্দু কানুনগো। ধবধবে সাদা চুলের প্রচন্ড মেধাবী এবং ত্যাগী এই রাজনীতিকের নির্ভুল সুস্পষ্ট উচ্চারণে বাচন ভঙ্গী আর প্রখর ব্যক্তিত্ব ছিল ঈর্ষণীয় ।
আম্মু অফিস থেকে দুপুরে বাসায় এসে সবসময়ে দেখতেন আমরা দুই ভাই-বোন (তখনো ছোটভাইয়ের জন্ম হয়নি) ধুলোবালি মেখে উঠোনে খেলছি। আমাদের গোসল করানো, খাওয়ানো সেরে আম্মু আবার অফিসে চলে যেতেন।
হঠাৎ একদিন দেখলেন, আমরা দু'জন পরিপাটি , পরিচ্ছন্ন জামা গায়ে সেলিম চাচ্চুর কোলে বসে গল্প শুনছি। পূর্ণেন্দু কানুনগো আন্ডারগ্রাউন্ডে 'সেলিম'সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন । আমরা বড়ো হয়েও তাকে 'সেলিম চাচ্চু' বলেই জানতাম। চাচ্চু আমাদের এতোটাই আপন করে নিয়েছিলেন, তিনি বাসা থেকে বেরুবার সময়ে নাকি বলতেন , আমি তার পিছুটান।
ঈদের ছুটিতে চারটি সাম্পানে করে পরিবারের শহরবাসীরা হৈ হৈ করে কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে বরউঠানের বাড়িতে যাওয়ার মুহুর্ত গুলো ছিল অন্যরকম উত্তেজনা আর আনন্দের।
আমাদের বাপ্পু সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠক ডা. কামাল এ খানের অভিভাকত্বে পরিবারের সবার সাথে গান বাজনা করে ঈদের ছুটির চার/পাঁচটি দিন পার করতাম।
আমার মা আমাদেরকে শৈশবে বই মেলায় নিয়ে যেতেন।আশি থেকে নব্বই য়ের মধ্যে দেশে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হতো, আন্তর্জাতিক বই মেলা হতো-যেখানে রাশিয়ান , ভারতীয় বই খুব অল্প দামে পাওয়া যেতো। কর্মজীবী মা আমার, প্রচুর বই কিনে দিতেন। রুশদেশের উপকথা , মালাকাইটের ঝাঁপি, ঠাকুরমার ঝুলি । আরো থাকতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম , সুকুমার রায়, সত্যজিত রায়ের সমৃদ্ধ শিশুসাহিত্যের নানান লেখা সহ নানান দেশের উপকথা, রূপকথা।
রাতের বেলা ঘুমানোর সময়ে বাবা আর মা সেই গল্প গুলো শুনাতেন। , যা শিশু কিশোরদের মনে সৃষ্টিশীল চিন্তার বিকাশ ঘটাতো। মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের 'গুপি গাইন বাঘা বাইন', 'গুপি বাঘা ফিরে এলো' , 'হিরক রাজার দেশে', 'আগন্তুক' এই ছবিগুলো মানবিক অনুভুতি এবং সমাজ প্রগতির চিন্তা নিয়ে ভাবাতে শিখিয়েছিল আমাদেরকে সেই কৈশোরেই। তাছাড়া এদেশেও নির্মিত হয়েছিলো সত্য সাহার ছুটির ঘন্টা, বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, যার ধারাবাহিকতা পরে আর আমরা পাইনি। বর্তমান প্রজন্ম বঞ্চিত হয়েছে সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র থেকে যেকারণে একটি বন্ধ্যা সময় অতিক্রম করছে তারা, যার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে।
চট্টগ্রাম মুসলিম হলের মঞ্চে সেই কৈশোরেই দেখেছি নুরলদিনের সারাজীবন , দেওয়ান গাজীর কিসসা। বাপ্পুর বাসায় এসেছেন ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দোপাধ্যায়। ভাষাবিদ হরলাল রায়ের ছাত্রী ছিলেন আমার মা। তার অন্তরে সারাক্ষণ রবীন্দ্রনাথ । মায়ের পছন্দের কারণে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা ক্যাসেটে শুনতাম আর গীতবিতান খুলে পড়ে পড়ে গাইতাম। কৈশোরেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো এই চারটা নৃত্যনাট্য । এখনো তার কিছুটা মনে আছে। খেলাঘর, উদীচী র সাথে রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমার শৈশব কৈশোরের স্বর্ণালী স্মৃতি।
বাবা তার কৈশোরেই ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে জেল-জুলুম মিটিং মিছিল ছিল তার নিত্য সঙ্গী। দেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের সাথে ও তার সম্পৃক্ততা ছিল অনেক ।
লালদীঘির মাঠে সমাবেশ হলেই আমাদের বাসায় ভাত খেতেন বাম রাজনীতিকেরা। তাদের কে কাছে থেকে দেখেছি আড্ডা আর হৈচৈ করে আনন্দময় সময় কাটাতে।
বাবার হাত ধরে লালদীঘির মাঠে রাজনৈতিক নেতাদের জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনতাম। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন দিবস , প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারী, ১৪ ডিসেম্বর , ১৬ ডিসেম্বর রাত ১২টা ০১ মিনিটে শহীদমিনারে ফুল দিতে যাওয়া সহ প্রতিটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিন পালন ছিল গুরু দায়িত্বের মতো।
বেগম সুফিয়া কামালের হাত ধরে রাজপথে নেমেছেন আমার মা। ব্যাংকিং এর পাশাপাশি আমার মা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।
মা য়ের শাসনের কথা মনে হতে এখনো অনেক ভয় লাগে। যতোই আন্দোলন সংগ্রাম আমাদের তিন ভাইবোনকে কখনো মাত্রাছাড়া স্বাধীনতা ভোগ করতে দেন নি। নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে আমাদের স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিতেন পড়ালেখার।
আমরা এতো মার খেয়েছি মায়ের! একটা ঘটনা মনে পড়ছে ।নারী নির্যাতন বিরোধী আইনের উপর একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে কোলকাতা গিয়েছিলেন মা। আমার ছোট ভাই তখন চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। স্কুল থেকে বেরিয়ে ভিডিও গেম খেলতে চলে যেতো বন্ধুদের সাথে। আম্মু কোলকাতা থেকে এসে স্কুলে চেক করতে গিয়েই বিষয়টা জেনে গেলো। সাথে সাথে লালদীঘির পাড়ে জেলাপরিষদ মার্কেটে ঐ ভিডিও গেমের দোকানে কোতোয়ালী থানার পুলিশ নিয়ে রেইড দিলো আমার মা। স্কুলের পাশে ভিডিও গেমের দোকান বন্ধ হয়ে গেলো। সবার সামনে আমার ভাইয়ের কানে ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাসায় এনে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পিটা দিলেন মা। সে কী কঠিন শাসন!! একই সাথে বন্ধুর মতো অনেক আপন ও ছিলেন আমার মা। এখনো মায়ের সাথে আমাদের তিন ভাইবোনের ই গভীর বন্ধুত্ব।
আমি এখন মা হিসেবে চিন্তা করি, আমরা কি পারছি সন্তানদের এভাবে আদর অথবা শাসন করতে?
মনে পড়ছে ঐশীর কথা। একজন রিপোর্টার হিসেবে অভিভাবক হন্তা ঐশীর বিষয়টি অনেক কাছে দেখেছি। বিষয়টি সমাজগবেষক দের শুধু নয় সাধারণ বাবা-মা দের জন্যে ও অনেক উদ্বেগ এবং ভাবনার বিষয়।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সাথে অনেকবার কথা বলেছি। সদ্যকৈশোরোত্তীর্ণ ঐশী পুলিশ পরিবারের সন্তান , তার পরিবারের সম্পদ, ঐশ্বর্য অনেকের টার্গেট। তাই ঐশীকে সমর্থন করতে গিয়ে অনেক সত্য গোপন করা হচ্ছে । অনেকের প্রশ্ন ঐশীর মা কর্মজীবি ছিলেন না। কৈশোরে পা দিতে না দিতেই উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলো ঐশী- এতে মা কি তার দায় এড়াতে পারবেন? ঐশীর সাথে তাদের গৃহপরিচারিকা ছোট্ট সুমী ও কারাবন্দী; যে পুরো ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। নিরীহ নিরপরাধ একটি গ্রাম্য সাধারণ কিশোরী। আশা করছি তাকে মুক্ত করে নিতে পারবে তার পরিবার। তবে এই দুই কিশোরী এবং ঐশীর ছোটভাই য়ের যে ভয়ংকর মানসিক চাপ , তা আদৌ কতোটা কাটবে- তা সময় ই বলে দেবে।
আরেকটি আলোচিত হত্যাকান্ডের কথা মনে পড়ছে। যেখানে সত্য এখনো অনুদ্ঘাটিত অথবা চেপে যাওয়া হচ্ছে । এখানেও একটি শিশুর জীবন সংকটময়।
সন্তানকে নিজের সবকিছুর সাথে একাত্ম করে ফেলার যে দৃষ্টান্ত আমার বাবা-মা দেখিয়েছেন , আমাদের সব পরিবারে যদি তার চর্চা হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই শৈশব-কৈশোরে শূন্যতার সংকটে ভুগবে না কিশোর কিশোরী। ড্রাগ কে নি:সঙ্গতার সঙ্গী করে নেবে না। বাবা-মা, চাচা-খালা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, বন্ধু-স্বজনের সাথে একাত্মতা অনেক জরুরী।
আমাদের সমাজটা যতো বেশী একাকী , আত্মকেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছে , আমরা ততো বেশী সংকটময় ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতি, রাজনীতির শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা সন্তানদের অনিশ্চিত নিঃসঙ্গ দিকনিশাহীন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি । যা ভয়ংকর আত্মঘাতী। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরী।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
sumikhan29bdj@gmail.com

Wednesday, November 6, 2013

জনমত যাচাই ॥ স্টার -আলোর ষড়যন্ত্রের যবনিকার অন্তরালে- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী



স্টিভেন্স কলিন্স লন্ডনের একজন মধ্যবয়সী শিশু সাহিত্যিক। শিশু ও কিশোরদের জন্য তিনি লেখেন। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক নানাধরনের মজার লেখা লেখেন। অনেকটা আমাদের ড. জাফর ইকবালের মতো। ড. ইকবাল কিশোরদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও যেমন বড়দের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক কলাম লেখেন স্টিভেন্স কলিন্সও তেমনি বড়দের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয়েও লেখালেখি করেন। তবে ড. জাফর ইকবাল বাংলাদেশে যতটা জনপ্রিয়, স্টিভেন্স কলিন্স বিলেতে এখনও ততটা বিখ্যাত নন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় অধুনালুপ্ত ইনার লন্ডন এডুকেশনাল অথরিটিতে (ওখঊঅ) কাজ করার সময়।
কলিন্সের নামটি এখানে এ জন্যই উল্লেখ করলাম যে, ইলিয়াতে একসঙ্গে চাকরি করার সময় তিনি আমাকে মজার মজার বই পড়তে দিতেন। এগুলো সবই কূটনীতি এবং কূটষড়যন্ত্রে দক্ষ ইউরোপের বিখ্যাত ও কুখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কে লেখা। অনেক বিস্ময়কর তথ্য, অজানা কথা এদের সম্পর্কে বইগুলোতে পেয়েছি। যাদের নিয়ে এ বইগুলো লেখা তাঁরা হলেন- বিসমার্ক, মেকিয়াভেলি, রাশপুটিন, কুইসলিং, গোয়েবলস, কিসিঞ্জার প্রমুখ।
জার্মানির নাৎসি নায়ক গোয়েবলস সম্পর্কে লেখা একটি বইয়ে এমন তথ্য পেয়েছি, যা আমার আগে জানা ছিল না। তাঁকে ‘অসত্য প্রচারণা’র গুরু বলেই এতকাল আমরা জানতাম। কিন্তু জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজেও তিনি যে নানারকম কৌশলের আবিষ্কর্তা, তা জানতাম না। ইউরোপে নির্বাচনের আগে বা কোন বড়রকম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থাটি তখন মাত্র উদ্ভাবিত হয়েছে এবং মূলত সংবাদমাধ্যম তা ব্যবস্থা করছে। গোয়েবলস সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য এ ব্যবস্থাটিকেও নাৎসি দলের নির্বাচন জয়ে ব্যবহারের কৌশল হিসেবে কাজে লাগান।
হিটলারের নাৎসি পার্টির অবস্থা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে একেবারেই ভাল ছিল না। এই দলের পেছনে জনসমর্থন মোটেই ছিল না। হিটলার ও নাৎসি পার্টি কোনদিন ক্ষমতায় যাবে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করত না। নাৎসি দলকে তখন একমাত্র সাহায্য যোগাত আমেরিকা। রাশিয়ায় তখন কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল। সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। ধনবাদী আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব কমিউনিস্ট জুজুর নামে ভীত। সাম্যবাদী বিপ্লব বুঝি ইউরোপ-আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
এই বিপ্লব ঠেকা দেয়ার জন্য আমেরিকার অর্থে ও সাহায্যে ইতালি ও জার্মানিতে দুই প্রাক্তন সোস্যালিস্ট নেতা মুসোলিনী ও হিটলার ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। জন্ম হয় বিশ্ব শতকের হিংস্র ফ্যাসিবাদের। পরবর্তীকালে কমিউনিজম ঠেকানোর জন্য আমেরিকা যেমন ইসলামিক টেরোরিজমের এবং তালেবানদের জন্ম দিয়েছিল, গত শতকের কুড়ির দশকে তেমনি কমিউনিজমকে ঠেকানোর জন্য ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল।
আমেরিকার অনুসরণ করেছিল ব্রিটেনের ধনিক-বণিক এলিট ক্লাসও। ইউরোপে তখন ফ্যাসিবাদের উত্থানের পর্ব শুরু হয়েছে। সেদিক থেকে জনগণের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজের এলিট শিক্ষকরা পর্যন্ত স্লোগান তোলেন- লাল বা কমিউনিস্ট হওয়ার চাইতে মৃত্যু হওয়া ভাল।
লন্ডনের ‘টাইমস’, ‘ডেইলি মেইল’সহ বড় বড় দৈনিকগুলো কমিউনিজমের ভীতি প্রচার করে ফ্যাসিবাদের জয়গান গাওয়া শুরু করেছিল।
এতকিছু করার পরও ইতালি বা জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট দলগুলো তেমন জনসমর্থন পায়নি। সোস্যালিস্ট ও কমিউনিস্ট দল ছিল প্রভাবশালী দল। কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল প্রচ- বিবাদ। এ সময় হিন্ডেনবার্গ ছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর। বাংলাদেশের বর্তমান দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতোই জার্মানিতে তখন একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ চলছে। বর্তমান বাংলাদেশের মতোই সুবিধাবাদী এলিট ক্লাস ও বুদ্ধিজীবীরা হিন্ডেনবার্গ সরকারের নিত্য সমালোচনা এবং নাৎসি দলকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দানে ছিল ব্যস্ত। ক্ষমতায় আসার আগেই হিটলারের নাৎসি দলের ব্রাউন শার্ট বাহিনীর ক্যাডাররা জনজীবনে সন্ত্রাসের দ্বারা ভীতি সৃষ্টি শুরু করে। দুটি নিরপেক্ষ বহুল প্রচারিত দৈনিক হিটলারের ভার্সাই চুক্তিবিরোধী আন্দোলনে সমর্থনদানের নামে কার্যত নাৎসি দলকে সমর্থন দেয়া শুরু করে এক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকার দুটি ‘নিরপেক্ষ’ মিডিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সমর্থনদানের নামে বিএনপিকে সমর্থন দান লক্ষ্য করার মতো।
তার পরও প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপে ফ্যাসিবাদ তেমন জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি। হিটলারের নাৎসি পার্টি ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবে এমন সম্ভাবনা ছিল কম। যদিও জার্মানির সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার বড় অংশ, মিলিটারি ও সিভিল ব্যুরোক্র্যাসির একটি শক্তিশালী মহল হিটলারকে ক্ষমতায় আনার জন্য চ্যান্সেলর হিন্ডেনবার্গের ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে চলছিল (এ সম্পর্কে অভিসন্ধিৎসু পাঠক বিখ্যাত মার্কিন লেখক লুই ফিশারের ‘ফল অব দ্য থার্ড রাইখ’ নামক বিখ্যাত নিবন্ধটি সংগ্রহক করে পড়ে দেখতে পারেন)।
সন্ত্রাস, মিথ্যা প্রচার এবং ইহুদীবিদ্বেষ ছড়িয়েও (বাংলাদেশে বর্তমানে যেমন সন্ত্রাস, মিথ্যা প্রচার ও ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়) নাৎসি পার্টির জনসমর্থন বাড়াতে না পেরে হিটলার তাঁর প্রচার উপদেষ্টা গোয়েবলসকে একদিন ডেকে পাঠান। লন্ডনের স্টিভেন্স কলিন্সের কাছ থেকে পাওয়া বইটিতে এই কাহিনীটি আমি পেয়েছি। গোপন বৈঠকে গোয়েবলসকে হিটলার জিজ্ঞাসা করলেন, আসন্ন নির্বাচনে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতাও দেখাতে না পারলে তো চ্যান্সেলর হিন্ডেনবার্গ আমাকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য ডাকবেন না। ভোটদাতাদের মনে সন্ত্রাস সৃষ্টির সঙ্গে, সেনাকর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের পূর্ণ সমর্থন পেলেই ব্রাউন শার্টের ক্যাডাররা ভোটের বাক্স নাৎসি দলের পক্ষে ভোটে ভরিয়ে ফেলতে পারবে। এটা করার উপায় কী?
গোয়েবলস বলেছেন, ‘আমাদের সমর্থন ও সাহায্যদানের ব্যাপারে জেনারেল এবং সুশীল সমাজের একটা অংশের মধ্যে এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। এটা দূর করতে পারে ব্রিটিশ ও আমেরিকান সরকারের চাপ। এই চাপ তাঁরা যাতে সৃষ্টি করেন, সেজন্য আমি একটি উপায় উদ্ভাবন করেছি।’ হিটলার জিজ্ঞাসা করলেন, সে উপায়টা কী? গোয়েবলস বললেন, ‘কমিউনিজম বিশ্ব জয় করে ফেলবে এই ভয়ে সারা ধনবাদী পশ্চিমা জগত এখন কম্পিত। এই ভয়টা তাদের মনে আরও বাড়িয়ে দিতে হবে।’
গোয়েবলস হিটলারকে জানালেন, তিনি জার্মানির কয়েকটি বড় মিডিয়াকেই হাত করেছেন। তাঁরা অত্যন্ত কৌশলের সাহায্যে জার্মানিতে জনমত সমীক্ষা চালাবে এবং তার ফল প্রকাশ করবে। আজ একটি কাগজ তা করবে, দুই দিন পর তা আরেকটি কাগজ করবে। তাদের জনমত সমীক্ষার ফল হবে একই ধরনের। অর্থাৎ তাতে বলা হবে, জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে জার্মানিতে নির্বাচন হলে জার্মান সোস্যালিস্ট অথবা কমিউনিস্ট পার্টি বিপুল ভোটে জয়ী হবে। তাহলে গোটা ইউরোপে কমিউনিজমের প্রভাব ছড়াবে। ক্যাপিটালিজম হুমকির সম্মুখীন হবে। এ অবস্থা একমাত্র ঠেকাতে পারে জার্মানির ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট পার্টি (নাৎসি)।
কিন্তু তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ইউরোপ-আমেরিকার শক্তিশালী দেশগুলোর সহযোগিতার অভাবে এখনও শক্তি অর্জন করতে পারছে না।
হিটলারকে গোয়েবলস অভয় দিয়েছিলেন, এ জনমত যাচাইয়ের ফলসহ জার্মানিতে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ভীতিটি লন্ডন ও ওয়াশিংটনের মনে ঢুকিয়ে দিতে পারলে তারা অবশ্যই জার্মান সিভিল এ্যান্ড মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসি এবং এলিট ক্লাসের ওপর অধিক চাপ সৃষ্টি করবে। তারা যাতে নাৎসি দলকে বৈধ-অবৈধ যে কোন পন্থায় ক্ষমতা দখলে সাহায্য যোগায়। কুড়ির দশকে গোয়েবলসের এ কৌশল সফল হয়েছিল। জার্মানিতে মিডিয়ায় আগামী নির্বাচনে সোস্যালিস্ট অথবা কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় যাওয়ার ষোলোআনা সম্ভাবনা সম্পর্কে এমনভাবে জনমত যাচাইয়ের ফল প্রকাশ করা শুরু হয়েছিল যে, লন্ডন ও ওয়াশিংটনের এস্টাবলিস্টমেন্টে এবং অভিজাত সুশীল সমাজে আরও বেশি কমিউনিস্ট জুজুর ভয় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা ‘বেটার ডেড দ্যান রেড’ স্লোগান তুলে কার্যত ইউরোপে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিতে থাকেন। সেই ইতিহাস আগেই তুলে ধরেছি। ইতিহাসের কী বিচিত্র বিধান! গত শতকের গোড়ার দিকে কমিউনিজম ঠেকানোর জন্য এ্যাংলো আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ইউরোপে ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল। পশ্চিমা গণতন্ত্র পরে সেই ফ্যাসিবাদের দ্বারাই আক্রান্ত হয়। গত শতকেরই শেষদিকে পশ্চিমা ধনতন্ত্র বিশেষ করে আমেরিকা কমিউনিজম ঠৈকানোর নামে ‘ইসলামী টেরোরিজমের’ জন্ম দেয়। এখন সেই টেরোরিজমের সঙ্গেই আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধরত এবং আমেরিকা তাতে ক্রমশ হতবল এবং তার অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে।
এবার একুশ শতকের বাংলাদেশের ২০১৩ সালে ফিরে আসি। আগামী নির্বাচনের অনুষ্ঠান যথাসময়ে হতে যাচ্ছে কিনা, বিএনপি ও তার ১৮ দলীয় জোট তাতে যোগ দেবে কিনা, তা এখনও বিতর্কের বিষয় কিন্তু নিরপেক্ষতার ভেকধারী দুটি পত্রিকা ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টার’ অতি কাছাকাছি সময়ে দুটি জনমত যাচাইয়ের ফল প্রকাশ করে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে যে, জনমত বিপুলভাবে বিএনপির পক্ষে। সুতরাং নির্বাচনে বিএনপির জয় অনিবার্য। ‘প্রথম আলোতে’ আওয়ামী লীগের পক্ষে জনসমর্থনের যে হার দেখানো হয়েছিল, ‘ডেইলি স্টারে’ তা আরও বিরাটভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জরিপ কতটা সঠিক অথবা সঠিক নয়, সে বিতর্কে আমি যাব না। এটা একটি গড়পড়তা হিসাব গোয়েবলস হিটলারকে বুঝিয়েছিলেন, ওই সময় জার্মানির বিভিন্ন এলাকায় জনমত ছিল বিভিন্ন ধরনের। ভার্সাই চুক্তির ফলে দুর্ভিক্ষগ্রস্ত এলাকায় নাৎসি দলের জনপ্রিয়তা ছিল। আবার কোন কোন এলাকায় কমিউনিস্ট ও সোস্যালিস্টসহ অন্যান্য দলের জনপ্রিয়তা ছিল। গোয়েবলসের নির্দেশে কয়েকটি মিডিয়া এই বিভিন্ন এলাকার জনমত সমীক্ষাকে গড়পড়তা হিসাবে ফেলে দেখান, নির্বাচনে কমিউনিস্টদের বিরাট জয় হবে। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ও আমেরিকান সরকারের মনে ভয় ঢোকানো। এই গড়পড়তা হিসাবের একটা গল্প এখানে বলি- পাঠকদের এই গল্পটি জানা।
তিন পন্ডিত সাঁতার জানেন না, গেছেন একটি খাল পার হতে। গিয়ে দেখেন এক চাষীও খালের পাড়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। পন্ডিতরা বললেন, তুমি খাল পার হচ্ছো না কেন? চাষী জানান, সে সাঁতার জানে না। খালের পানি কোথাও গভীর কোথাও অগভীর। গভীর পানিতে পড়লে সে ডুবে মরবে। পন্ডিতরা জানতে চাইলেন, পানির গভীরতা কী রকম। চাষী বললেন, কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও কোমর সমান, কোথাও মাথা ডুবে যাবে।পন্ডিতরা তখনি পানির গভীরতার গড়পড়তা হিসাব করতে বললেন। হিসাব কষে দেখলেন, গড়পড়তা পানির গভীরতা হাঁটু সমান। তাঁরা চাষীকে বললেন, দূর বোকা মূর্খ, তুই গড়পড়তা হিসাব জানিস না; তাই খাল না পেরিয়ে বসে আছিস। এই দ্যাখ আমরা কিভাবে খাল পার হই। পন্ডিতেরা মালকোচা মেরে খালে নামেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর পানিতে ডুবে মারা যান।

সম্প্রতি প্রকাশিত ডেইলি স্টারের নির্বাচনসংক্রান্ত জনমত যাচাইয়ের ফলটি লক্ষ্য করলেও দেখা যাবে, জনমত গ্রহণের জন্য জামায়াতের প্রধান্যমূলক এলাকাগুলো বেছে নেয়া হয়েছে এবং ‘আপনি কাকে ভোট দেবেন’ এই প্রশ্ন না করে ‘নির্বাচনে কারা জয়ী হবে’ এই ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছে। উত্তরদাতা এখন বাজারে যে জনরব- ‘বিএনপি জয়ী হবে’ তার প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি কোন দলকে ভোট দেবেন জিজ্ঞাসা করা হলে তাকে হয়ত ভাবতে হতো।
তবু এই জনমত যাচাইয়ের ফল নিয়ে আমি বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু দেশের বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে দুটি পত্রিকায় এই ঘন ঘন সমীক্ষা প্রকাশ কেন সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছি। যবনিকার অন্তরালে আসল ঘটনা কী? সাংবাদিকতা পেশার আড়ালে মাহফুজ আনাম তাঁর দোসর মতিউর রহমানের মতো ‘কনস্পিয়েটর’ চরিত্রের নন, তাঁকে আমার কাছে কনফিউজড চরিত্রের লোক মনে হয়। তথাপি তাদের এই যুক্ত উদ্যোগের লক্ষ্যটা কী? বিএনপিকে নির্বাচনে জেতানো? আমি যতদূর জানতে পেরেছি, তা মোটেই নয়। এর পেছনে আরও গভীর উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, যা বলার জন্য জনমত-সমীক্ষাসংক্রান্ত গোয়েবলসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পুরনো ইতিহাস আগে তুলে ধরেছি। বর্তমান বাংলাদেশেও সেই একই ধরনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে ‘আলো-স্টারের’ জনমত সমীক্ষার খেলায় ।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে পোলারাইজেশন ঘটেছে দুটি স্পষ্ট ধারায়। এক ধারায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, যাকে বলা হয় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শিবির। অন্য ধারায় রয়েছে মুখে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধিতা না করলেও এই আদর্শের বিরোধী শিবির। প্রথম শিবিরটিতে রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। অন্য শিবিরটিতে রয়েছে বিএনপির নেতৃত্ব।

আওয়ামী লীগের জন্ম গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে। বিএনপির জন্ম সেনা ছাউনিতে। প্রতিষ্ঠাতাও একজন সেনা শাসক। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সেনা শাসন প্রবর্তনের জন্য সেনা শাসকরা সমর্থন খুঁজতে বাধ্য হয়েছিলেন ’৭১-এর পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি, ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি এবং এককালে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত একদল বিভ্রান্ত বামদের কাছ থেকে। এদের সম্মিলনেই বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে অভ্যুদয়।

গোড়ার দিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধী অথচ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক অথবা তাতে অংশগ্রহণ করেছেন এমন কিছু নেতাকর্মী বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং কেউ কেউ এখনও আছেন। কিন্তু জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানে মুসলিম লীগ যেমন সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক ও কট্টর রক্ষণশীল নেতৃত্বের হাতে চলে যায়, বাংলাদেশে তেমনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি ধীরে ধীরে তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রবীণ নেতা ও কর্মীরা দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত জনগণের কাছে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বিএনপির ভেতরে আশ্রয় নেয়। ড্রাক্যুলার কামড়ে যেমন জীবিত মানুষ ড্রাকুলা হয়ে যায়, তেমনি জামায়াতের বাহুবন্ধনে বিএনপি ধীরে ধীরে ড্রাকুলা হয়ে যায়। বিএনপির এই চরিত্র বিচ্যুতি সম্পূর্ণ হয় তারেক রহমান সাবালক হয়ে কার্যত বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর। তিনি প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত একই পরিবারের লোক।’ ফলে তারেকের ইচ্ছায় ও মদদে বিএনপিকে জামায়াত সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলে। দেশের রাজনৈতিক পোলারাইজেশন সম্পূর্ণ হয়। বিএনপিতে ধীরে ধীরে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শের বিরোধী গোত্রগুলো সম্মিলিত হয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুসারী অধিকাংশ ডান ও বাম রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির এই পোলারাইজেশনটা স্পষ্ট ছিল। এই দুই শিবিরের মধ্যে বিরোধ ও সংঘাতও কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এই বিরোধ দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাধারণ বিরোধ নয় যে, তা দুপক্ষ সংলাপে বসলেই মীমাংসা হয়ে যাবে। এজন্য এই দুই শিবিরের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি সূত্র আবিষ্কৃত এবং দুই শিবির কর্তৃক তা স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই সূত্রটি এখনও আবিষ্কৃত না হওয়ায় সংঘাত ক্রমশ হিংসাত্মক চরিত্র ধারণ করছে।

ভারতে জন্ম নেয়া জামায়াত সৌদি আরব ও আমেরিকার মদদপুষ্ট একটি উগ্র এবং সন্ত্রাসী ধর্মান্ধ দল। ১৯৭১ সালে তারা বাংলাদেশে বিদেশী হানাদারদের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ করে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা করে। স্বাধীন বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দন্ডের মুখোমুখি হয়ে ফ্যাসিবাদী কায়দায় নির্মম সন্ত্রাস, রক্তপাত, হত্যাকা- দ্বারা গণতান্ত্রিক শিবিরকে ধ্বংস করতে চাইছে। বিএনপির গণতান্ত্রিক পরিচয়কে তারা কভার হিসেবে ব্যবহার করছে। জামায়াতের এই কার্যকলাপে বিএনপি সহজে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে এখন ইচ্ছুক পার্টনার।

এটা একাত্তরের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট সংঘাত, এটা দুইটি রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে সাধারণ মতপার্থক্য কিংবা কেবল ক্ষমতার হাতবদলের লড়াই নয়। এটা সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের লড়াই। একাত্তরে এই প্রতিবিপ্লবী গণবিরোধী শক্তি গণহত্যায় শরিক হয়েছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানের পদানত রাখার জন্য, বর্তমানে তারা একই হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বা তালেবান রাষ্ট্র বানানোর জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে বিএনপি এখন এই অসুর শিবিরের নেতা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তার গণতান্ত্রিক চরিত্রের সব ত্রুটিবিচ্যুতি, স্খলন পতন নিয়ে অসুর বিনাশের অসাম্প্রদায়িক শিবিরের নেতা।

দেশের রাজনীতির এই স্পষ্ট বিভাজনটি এখনও সাধারণ দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। তার কারণ বিএনপি-জামায়াতের প্রচারযন্ত্রের ক্রমাগত গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচার। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই মিথ্যা প্রচার শুরু হয়েছিল। বলা হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র, ভারতের দালালেরা এই ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।’ কিন্তু এই মিথ্যা প্রচার হালে পানি পায়নি। কারণ, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া কর্মীরা ছিলেন তখন অত্যন্ত সজাগ ও সক্রিয়। কিছু ভাড়াটে ও দালাল বুদ্ধিজীবী ছাড়া সকলেই মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার জবাব দেন এবং অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশের ভেতরে সক্রিয় এই বুদ্ধিজীবীদের হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের দোসর জামায়াত দুই দফায় (মার্চ ও ডিসেম্বর ’৭১) নির্মমভাবে হত্যা করে।
এই পাইকারি বুদ্ধিজীবী হত্যার ফলে বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি ও উদারচিন্তার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা এখন পর্যন্ত দূর হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তর নব্য বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গড়ে ওঠে। স্বাধীনতাপরবর্তী যে নতুন নতুন সামাজিক ও আর্থিক সুযোগ সুবিধা লাভের দরজা খুলে যায়, তার বদৌলতে এই নতুন এলিট ক্লাস বা সুশীল সমাজ তৈরি হয় এবং তাদের একটা বড় অংশ সহজেই ভিজিলেজ্ড ক্লাস হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে নীতিবর্জিত চরম সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠে। এরাই এখন দেশের মিডিয়া, টেলিভিশনের টকশো ইত্যাদি দখল করে আছে এবং সাধারণ মানুষকে চরমভাবে বিভ্রান্ত করে চলেছে।

দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের শিবিরের যে দ্বন্দ্ব সংঘাতের রাজনীতি, এক্ষেত্রে এই বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরের বুদ্ধিজীবীদের মতো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতেন এবং দেশের মানুষকে এই অপশক্তির দ্বারা সৃষ্ট বিভ্রান্তির কুয়াশা থেকে মুক্ত করে একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার বাংলার ভবিষ্যত রক্ষা করতে পারতেন। এজন্য তাদের আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়াবার কোন দরকার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের শত্রু ও মিত্রদের মধ্যে আজ যে রাজনীতির পোলারাইজেশন, তাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তারা দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে পারতেন।
তারা তা করেননি। তারা দেশী-বিদেশী নানা সুযোগসুবিধা, আর্থিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির লোভে নিরপেক্ষতার একটি মুখোশে নিজেদের ঢেকে দেশের দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির মাঝখানে যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন তা প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য ক্ষতিকারক এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার জন্য চৌদ্দ আনা দায়ী। এখন আমেরিকাই বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। তার হাতেই সর্বপ্রকার খ্যাতি, সুযোগসুবিধা ও অর্থনৈতিক প্রাপ্তির স্বর্গরাজ্যের চাবিকাঠি। মেফিস্টোফিলিস ও ফার্ডসেটর কাহিনীর মতো আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এই অংশটি অন্য আরও পাঁচটা উন্নয়নশীল দেশের মতো এই মহাপরাক্রমশালী বিশ্ব ধনবাদ ও নব্য সাম্রাজ্যবাদের কাছে নিজেদের বিবেক বিক্রি করে বসে আছেন।
অনুন্নত ও দরিদ্র বিশ্বের মানুষ সহজেই কমিউনিজম ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ঝোঁকে। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর নির্বাচিত সরকারগুলোও সহজে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ ও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে পরাশক্তির আজ্ঞাবহ হতে চায় না। সেজন্য বড় বড় নন গবর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন (এনজিও) এবং দারিদ্র্য বিমোচনের নামে মাইক্রোক্রেডিট সিস্টেম বা ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তন। প্রমাণিত হয়েছে, বহু দেশেই বড় বড় এনজিও হচ্ছে নির্বাচিত সরকারের পাল্টা আরেকটি সরকার। তারা বিদেশী অর্থ ও সাহায্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাহায্যদাতা দেশগুলো কোন দেশের নির্বাচিত সরকারকে দুর্নীতিপরায়ণ, ব্যর্থ সরকার আখ্যা দিয়ে এনজিওগুলোকেই দেশের ও গরিবের ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখায়। এসব এনজিওর দেশীপ্রধানদের নাইটহুড, নোবেল পুরস্কারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত করে তাকে দেশের মানুষের কাছে পরম সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি করে তোলার চেষ্টা হয়।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোন দলেরই নির্বাচিত সরকারকে পশ্চিমা ধনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পছন্দ নয়। আওয়ামী লীগ এক সময় সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে এবং তার একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা ছিল এবং এখনও ছিঁটেফোঁটা রয়ে গেছে। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতিতে আল কায়দা, তালেবানদের প্রভাব রয়েছে বলে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা ভয় করে। যতদিন তাদের এই ভয় ছিল না, ততদিন তারা (আমেরিকা) জামায়াতকে ‘আধুনিক গণতান্ত্রিক মুসলিম রাজনৈতিক দল’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় রাখতে চেয়েছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ২০০১ সালের নির্বাচনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ্যান মেরি পিটার্সের নির্লজ্জ, প্রকাশ্য ভূমিকা স্মরণ করা যেতে পারে। এই পশ্চিমা অভিভাবকদের নির্দেশেই বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজটি, তাদের মুখপত্র একাধিক মিডিয়া বিএনপি-জামায়াতকে নির্বাচনে জয়ী করার জন্য প্রথমে প্রচ্ছন্নভাবে, তারপর প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করে। ঢাকার ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম সহসা আবিষ্কার করেন, ‘বাংলাদেশে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনর্প্রবর্তক।’
মাহফুজ আনাম লেখাপড়া জানা লোক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও স্বাধীন সার্বভৌম পার্লামেন্টের সংজ্ঞা কিভাবে দেয়া হয়েছে তা তিনি জানেন না তা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। যে পার্লামেন্টে বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে না; জাতীয় বাজেট ভোটাভুটির ভিত্তিতে পাস হয় না; পাস করেন সর্বক্ষমতাসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট, তাকে কি বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং সেই পার্লামেন্টকে কি সার্বভৌমত্বের অধিকারী পার্লামেন্ট বলা হয়? যদি বলা যায়, তাহলে আইয়ুবের আমলে কি পাকিস্তানে বহুদলীয় সরকার ও স্বাধীন সার্বভৌম পার্লামেন্ট ছিল? পাকিস্তানে আইয়ুবের শাসনামলকে তাহলে কেন সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসনামল বলা হয়? তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনই বা কেন করতে হয়েছিল?


একদিকে মাহফুজ আনামের ভূমিকা, অন্যদিকে ২০০১ সালেই সদ্য প্রকাশিত প্রথম আলোর সম্পাদক হিসেবে মতিউর রহমানের ভূমিকাটি স্পষ্ট হতে থাকে। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির মধ্যে যে রাজনীতির পোলারাইজেশন ঘটছে এবং আওয়ামী লীগ তার সব ভুলত্রুটি, পতন স্খলন সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবিরের নেতা এই সত্যটি থেকে দেশবাসীর চোখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে একই দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে বিএনপির তালপ্রমাণ অপরাধকে আওয়ামী লীগের তিলপ্রমাণ অপরাধের সমান করে দেখাতে থাকেন এবং প্রচার করতে থাকেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরোধ কেবল ক্ষমতা দখলের বিরোধ এবং দুজনই একই চরিত্রের নেত্রী। এই প্রচারণার আড়ালে মতিউর রহমানের সমর্থনের পাল্লাটা ছিল বিএনপির দিকেই। এখনও আছে।

২০০১ সালের এই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই পরিবর্তিত। ভারত-আমেরিকা মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। টেরোরিজম দমনে তা ইসলামিক হোক আর আঞ্চলিক হোক, দুটি দেশই জোটবদ্ধ। আমেরিকায় ওবামা প্রশাসন আগের প্রশাসনের মতো বাংলাদেশের বিএনপি-জামায়াত জোটের ওপর সুপ্রসন্ন নয়; অবশ্য বিরূপও নয়। তবে তালেবান ও আফগান জঙ্গীদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক বুঝতে পেরে জামায়াত সম্পর্কে তাদের আগের মোহ নেই। জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বিএনপি সম্পর্কেও ওবামা প্রশাসন সন্দিহান। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজেনা সাহেব তাঁর নিয়োগ কর্তাদের এই সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য চেষ্টা তদবির করছেন। কিন্তু এখনও পেরে উঠছেন না।

মৌলবাদী সন্ত্রাসের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কটি বুঝে ওঠার পরেই তাদের আবার ক্ষমতায় বসানোর জন্য ওয়াশিংটন আগের মতো উৎস্যুক নয়। তার ওপর আবার নতুন মিত্র ভারতের চাপ আছে। তাই আওয়ামী লীগ তাদের পছন্দের দল না হওয়া সত্ত্বেও তাদের ক্ষমতায় থাকাটাকে আমেরিকা সমর্থন দিয়েছে, হয়ত এখনও দিচ্ছে।
তার আগে তারা চেষ্টা করেছিল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলকেই ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে মাইনাস টু ফর্মুলা অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর সহায়তায় একটি অনির্বাচিত সিভিল সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে। ফলে বাংলাদেশের কথিত সুশীল সমাজে, বিগ এনজিওগুলোতে, ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ এতদিনের ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। নোবেল পুরস্কার গলায় ড. ইউনূস নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে এগিয়ে আসেন। দেশী-বিদেশী শক্তিশালী মহলের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তবে প্রচেষ্টাটি পরিত্যক্তও হয়নি।

২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে নিয়ে আমাদের এই সুশীল সমাজ, বিগ এনজিও ও তাদের ক্রোড়াশ্রিত মিডিয়া আবার নতুন আশায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা জানে, ওয়াশিংটনের কাছে আওয়ামী লীগ পছন্দের দল নয়। তবু দেশটি জঙ্গীবাদের কবলে যাবে এই ভয়ে ওয়াশিংটন-দিল্লী দুই শক্তিই আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চাইছে। বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে তাদের মনে এখনও প্রচন্ড ভয় -তারা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ প্রশ্রয় পাবে। এখন কিভাবে তাদের এই মনোভাব বদল করে বাংলাদেশের কথিত সুশীল সমাজের বহুদিনের স্বপ্ন অনির্বাচিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা দ্বারা তারা ক্ষমতায় যেতে পারেন এবং সেজন্য ওয়াশিংটন ও দিল্লীর সমর্থন ও সাহায্য আদায় করতে পারেন সেটাই তাদের একমাত্র ভাবনা।

তাদের এই উদ্দেশ্যটি পূরণের জন্য বাংলাদেশে ‘আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে জনসমর্থন হারিয়েছে’ এবং ‘বিএনপির জনসমর্থন হু হু করে বাড়ছে’ এই প্রচার। এই লক্ষ্যেই ঘন ঘন জনমত সমীক্ষার ফল প্রচার করা হচ্ছে। যাতে বিদেশী বড় শক্তিগুলো ভয় পায় যে, আওয়ামী লীগের বদলে এবার বিএনপি (কোলে বসে জামায়াত) ক্ষমতায় আসবেই এবং বাংলাদেশেও জঙ্গীবাদের অভ্যুত্থান ঘটবে। এই আশঙ্কা প্রতিরোধের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এখনই যুদ্ধের মাঠ থেকে সরিয়ে অনির্বাচিত একটি সরকার দেশটিতে ক্ষমতায় বসানো দরকার।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে জার্মানির গোয়েবলসও এভাবে নাৎসিদের ক্ষমতায় আনার জন্য কমিউনিস্টদের নির্বাচন জয়ের ভয় দেখিয়ে ব্রিটেন ও আমেরিকার সমর্থন তাদের দিকে টেনে এনেছিল এবং এই ভয় দেখানোর কাজে সাজানো জনমত সমীক্ষাকে কাজে লাগিয়েছিল। আমাদের কথিত সুশীল সমাজ অবশ্য নাৎসি দল নয়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন, জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে বিদেশী শক্তির স্বার্থে ও তাদের সমর্থনে ক্ষমতায় যাওয়া।
তবে এভাবে একটি এনজিও-নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠা দ্বারা তারা ক্ষমতায় যেতে না পারলে নির্বাচনে বিএনপির দিকেই তাদের সমর্থন থাকবে। ড. ইউনূস ইতোমধ্যেই সে পথ তাদের দেখিয়েছেন। কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এই এলিট ক্লাসের স্বার্থ সুবিধা যতটা রক্ষা পায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তা রক্ষা পায় না। নীতি ও আদর্শ এই সুশীল সমাজ থেকে বহুদিন আগে বিদায় নিয়েছে।

Monday, November 4, 2013

Daily Times - Leading News Resource of Pakistan - Bangladesh War Crime Tribunal: a forum for Pakistan bashing?

Daily Times - Leading News Resource of Pakistan - Bangladesh War Crime Tribunal: a forum for Pakistan bashing?

বাংলাদেশে সেই সব পাকিস্তানীরা -প্রফেসর আবদুল মান্নান




ইমরান খান, বিশ্বনন্দিত পাকিস্তানের ক্রিকেটার । যে ক্রিকেটকে ভালবাসে সে ইমরান খানকে ভাল না বেসে পারবে না । বর্তমানে সেই ইমরান খান পাকিস্তানের একজন উদীয়মান রাজনীতিবিদ । তেহরিখ-ই-ইনসাফ নামে একটি দল করেছিলেন বেশ আগে। পাকিস্তানে এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে তার এই দল গড়ার পিছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএর প্রত্যক্ষ মদদ ছিল । তালেবানদের সাথে তার সখ্যতা এখন ওপেন সিক্রেট । তাদের সাথে সমঝোতা করে তার দল খাইবার-পাখতুন খাওয়ায় সরকার গঠন করেছে । তার দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান খাকওয়ানি, যিনি আগে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন, তার একটি লেখা গত ২৫ অক্টোবর পাকিস্তান হতে প্রকাশিত ডেইলি টাইমস পত্রিকায় ‘Millions of Pakistan Supporters in Bangladesh-especially in the BNP’ (বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানি সমর্থক-বিশেষ করে বিএনপিতে) শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে । খাকওয়ানি পাকিস্তান রাজনীতিতে বেশ একটি পরিচিত নাম এবং নিয়মিত বিভিন্ন টিভি টকশোতে অংশ গ্রহণ করেন এবং তালেবানদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন ।
সম্প্রতি প্রকাশিত খাকওয়ানির লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার । তার মতে যারা এই বিচারের সমর্থন করেন তারা এই বিষয়ে তাদের একপেশে বক্তব্য উত্থাপন করেন এবং ইদানিং দেখা যাচ্ছে তা হতে গণমাধ্যমও বাদ যাচ্ছে না । তিনি এই ব্যাপারে সম্প্রতি ডেইলি ষ্টার পত্রিকায় একটি মন্তব্য প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন যা এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি । ডেইলি স্টার তা প্রকাশ করবে কী না তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার কারণ তাদের নিজস্ব একটি সম্পাদকীয় নীতিমালা আছে (মন্তব্য এই লেখকের) ।
পত্রিকাটি সম্প্রতি আগামী নির্বাচন নিয়ে এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায় একটি জরিপের ফলাফল ছেপেছে যাতে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে । তা নিয়ে বিভিন্ন টকশোতে কিছু লোকজন রাতের ঘুমও হারাম করে ফেলছে । কিন্তু ডেইলি ষ্টার এই কথাটি চেপে গেছে যে এশিয়া ফাউন্ডেশন সারা বিশ্বে নিন্দিত যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র অর্থায়নে পরিচালিত একটি অঙ্গ সংগঠন । সিআইএ দেশে দেশে তাদের নাযায়েজ কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে অসুবিধা মনে করলে এশিয়া ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থাকে কাজে লাগায় । ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে সামনের নির্বাচনে যাতে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে না পারে তার জন্য সিআইএ ইতোমধ্যে তাদের চাকা সচল করে ফেলেছে । এই সম্পর্কে আওয়ামী লীগ কতটুকু সতর্ক বা ওয়াকিবহাল তা আমার সন্দেহ আছে । এই জরিপ সম্পর্কে আগামীতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইলো । ফিরে আসি খাকওয়ানির লেখায় ।
খাকওয়ানির মতে যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে । তার মতে এই ব্যাপারে ইসলামাবাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের দূতাবাস আত্মরক্ষা মূলক ভূমিকা পালন করছে । গত ৪২ বছরে বাংলাদেশ সুযোগ পেলেই পাকিস্তানকে ধোলাই (bashing) করে । এর জন্য তারা কিছু দিনকে বেছে নেয় । এর মধ্যে আছে একুশে ফেব্রুয়ারী, শেখ মুজিবের জন্ম দিন (মার্চ ১৭), ২৫ মার্চ (বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমন), ২৬ মার্চ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস), ১৫ আগষ্ট (শেখ মুজিবের হত্যা ও জাতীয় শোক দিবস), ১৬ ডিসেম্বর (ঢাকার পতন ও পাকিস্তান সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পন) ।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনেক সমর্থক আছে, বিশেষ করে বিএনপিতে । অন্যান্য স্বাধীনচেতা মানুষও পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং কাউকে না কাউকে এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে যাতে মানুষ মুদ্রার অন্যপিঠও দেখতে পায় । খাকওয়ানি লিখেছেন এই সব বিষয় নিয়ে তার পক্ষে কথা বলা তেমন একটা সহজ নয় কারণ তিনি একজন পাকিস্তানি এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক বন্ধু । তিনি লিখেছেন ‘আমি সে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থকদের দৃষ্টিভঙ্গির সম্মান করি কারণ তারা সেই দেশের সম্মানিত নাগরিক কিন্তু আমি প্রার্থনা করবো আমার দৃষ্টিভঙ্গিগুলি তারা গুরুত্ব সহকারে নেবেন ।’ তিনি স্বীকার করেছেন অতীতে পাকিস্তানি শাসকরা তাদের নিজস্ব জনগণের উপর অনেক অবিচার করেছে । তিনি প্রশ্ন রেখেছেন এই সব অবিচার কী কোন ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক সৃষ্ট নাকি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় যন্ত্র দেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ? তিনি তার দ্বিতীয় প্রশ্নে জানতে চেয়েছেন পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশের শাসকবর্গ (সামরিক ও বেসামরিক) দেশটিকে কী ভাবে শাসন করেছে? রাষ্ট্রের সম্পদের সুষম বন্টন কী বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে ? মানুষের দারিদ্র কী কমেছে ? বাংলাদেশের জনগণের প্রতি খাকওয়ানি শেষ প্রশ্ন রেখে জানতে চেয়েছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে দ-িত দশজন ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলালে বাংলাদেশের হিসেব অনুযায়ী যে লক্ষ লক্ষ শোকার্ত মানুষ ও একাত্তরে শহিদ (শব্দটি আমার) মানুষ আছে বলে বলা হচ্ছে তারা কী তৃপ্ত হবেন বা শান্তি পাবেন? তিনি এই ঘাতকদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন আওয়ামী লীগের কী উচিৎ হবে না তাদের জন্য একটি নিরপেক্ষ বিচারের ব্যবস্থা করা ?
খাকওয়ানি তার পারিবারিক বন্ধু সাকাচৌর দন্ডে ভীষণ ব্যথিত হয়েছেন এবং তার বিচারের স্বচ্ছতা ও প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন তার বিরুদ্ধে যে সকল সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে তার সবটাই ছিল বানোয়াট । তার মতে পাকিস্তান হতে যদি সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সে দেশে যাওয়ার সুযোগ থাকতো তা হলে সাকাচৌ সুবিচার পেত । তিনি বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিচারপতি শামিম হাসনাইনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন তাকে অন্যায় ভাবে এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে দেয়া হয়নি । বাস্তবে কথাটা সত্য নয় কারণ রেওয়াজ, আইন অনুযায়ী তার সরাসরি সাক্ষ্য দেয়ার সুযোগ থাকার কথা নয় । সাকাচৌ সম্পর্কে খাকওয়ানি ভূয়সি প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন শেখ হাসিনা তাকে তার একজন শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করেন বলে তাকে একাত্তরে গণহত্যা পরিচালনা করার অপরাধে অন্যায়ভাবে এই বিচারের মুখোমুখি করেছেন । তার পিতা শেখ মুজিব, যিনি বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধে’ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কখনো এই ধরণের বিচারের কথা চিন্তা করেন নি । সেই দেশের প্রতিষ্ঠাতারা অনেক বেশী দূরদর্শী ছিলেন এবং তারা যে ধরণের দেশ গড়বেন বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা গড়ার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন । খাকওয়ানির শেষ কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগ এই সব করে দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্ত করেছে এবং সেই বিভক্তিটা ৪২ বছর পর আরো প্রকট হয়েছে ।
খাকওয়ানির প্রতিবেদন সম্পর্কে কয়েকটি কথা । বিএনপিতে যে পাকিস্তানি সমর্থক আছে তা এখন কোন গোপন বিষয় নয় । তাঁর এই মন্তব্যটি একশত ভাগ সত্য । আমার এক অগ্রজ বলেন বাংলাদেশের জনসংখ্যা দশকোটি । জানতে চাই বাকি ছয়কোটির কী হলো? তার সোজা উত্তর তারা সকলে পাকিস্তানি । তার মন্তব্যটা একটু রূঢ় হলেও বাস্তব সত্য । পাঠক নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন হরতাল নামক নৈরাজ্যের দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে চরম সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তারা কারা? দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের জন্য দীর্ঘ চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছে । এই যাত্রায় শেখ হাসিনা আর তার দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে এই বহু প্রতীক্ষিত বিচার কাজটি শুরু করতে । সামনের নির্বাচনে জয় পরাজয় জনগণ নির্ধারণ করবেন কিন্তু শেখ হাসিনা আর তার দলকে ইতিহাস মনে রাখবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যটি শুরু করার জন্য । সাকাচৌ খাকওয়ানির পারিবারিক বন্ধু হতে পারেন কিন্তু সাকার একাত্তরের অপরাধের জন্য তার একবার নয় একশত বার ফাঁসি হওয়া উচিৎ ছিল । শেখ মুজিব এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান নি কথাটি মোটেও সত্য নয় । তিনি ১৯৭২ সনে দালাল আইন করেছিলেন এবং এই আইনের অধীনে কয়েক হাজার অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল যার মধ্যে সাকার বাবা ফকাও ছিলেন । এই আইনে কয়েক হাজার অপরাধীদের বিচার চলছিল । অনেকের সাজাও হয়েছিল । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সনের ৩১ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়া সেই আইন বাতিল করে সকল ঘাতক দালালদের মুক্তি দিয়েছিলেন । ১৯৭৩ সনে বঙ্গবন্ধু সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করেছিলেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করার জন্য । কিন্তু বিচার কাজ শুরু করার পূর্বেই পাকিস্তানি এজেন্টরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল । জিয়া সেই ঘাতকদের পুরষ্কৃত করেছিলেন । বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিভাজন তা ১৯৭৫ সালের পরই সৃষ্টি হয়েছিল তাতে শেখ হাসিনার কোন অবদান নেই । বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে হাজার গুন ভাল আছে এটি সারা বিশ্বে স্বীকৃত । তা খাকওয়ানি আর তার দলের মতে যারা এদেশে পাকিস্তানের সমর্থক তাদের চোখে না পরারই কথা । এই দেশের মানুষ আরো ভাল থাকতো যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করতো । তবে খাকওয়ানিকে ধন্যবাদ এদেশে পাকিস্তানি সমর্থকদের পুনরায় সনাক্ত করার জন্য।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। নভেম্বর ৪, ২০১৩
সূত্র : কমিউনিটি নিউজ, জাপান

পাকিনেতা ইসহাক খান খাকওয়ানী বললেন -বিএনপি পাকিস্তান প্রেমী , সাকা নিরপরাধ : সুমি খান


“বাংলাদেশের লাখো লাখো মানুষ পাকিস্তান ভালোবাসে । বিএনপি তার মধ্যে প্রধান। একাত্তরে সালে সাকা চৌধুরী লাহোরে ছিলেন, কোন অপরাধ করেন নি” - গত ২৫ অক্টোবর পাকিস্তান ডেইলি নিউজে প্রকাশিত লেখাটিতে এভাবেই ঘাতকদের পক্ষে সাফাই গাইলেন একাত্তরের ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক বন্ধু ইসহাক খান খাকওয়ানী। তিনি পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী এবং প্রভাবশালী হেভিওয়েট রাজনীতিক।
‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ ‘এর প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বজয়ী ক্রিকেটার ইমরান খান । জনশ্রুতি আছে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএস আই য়ের নির্দেশনায় তিনি দলটি গঠন করেছেন। এই দলের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান খাকওয়ানী সম্প্রতি বাংলাদেশের পাকিপ্রেমীদের ভালোবাসার টানে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে একটি আত্মকথন লিখেছেন। বিপুল সম্পদশালী জমিদার পরিবারের সন্তান ইসহাক খান খাকওয়ানী পাকিস্তানের তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ এবং রেলওয়ে মন্ত্রী ছিলেন। আফগানিস্তানের নানগড় এলাকার উপজাতি খোগওয়ানি গোত্রভুক্ত ‘খাকওয়ানি’ জমিদার পরিবারের সন্তান ইসহাক পেশায় ইঞ্জিনীয়ার। মীর মর্তুজা ভুট্টোর সাথে ১৯৯৪ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দেবার মাধ্যমে রাজনীতিতে তার অভিষেক। ২০০২ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগে যোগ দেন। ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল পোলোর আ্যাম্বেসেডর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। প্রশ্ন আসতে পারে, এই সম্পদশালী ব্যক্তিটি রাজনীতিতে তার অবস্থান দৃঢ় থেকে দৃঢ় করার জন্যেই কি আইএসইইয়ের বার্তাবাহকের কাজ করছেন?
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গণহত্যা , ধর্ষণ , বুদ্ধিজীবিহত্যা এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যারা অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের প্রতি ‘দায়িত্ব’ পালন করেছেন,পাকি সরকারের বেতনভুক্ত সেই ঘাতকদের বিচারপ্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই গাত্রদাহের সৃষ্টি করেছে পাকিদের। এর বাইরে থাকতে পারেন নি খাকওয়ানী । নিরপেক্ষতা দেখাতে লেখায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে সম্মান করার ভান করেছেন তার লেখার একটি লাইনে, যা হাস্যকর বটে!
তিনি এক দিকে স্বীকার করেছেন বালুচিস্তানসহ ৫টি প্রদেশের পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য এবং অপশাসনে বিদ্রোহ করছে স্খানীয় জনগণ। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রতি এ দেশের মানুষের প্রতি স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলনের নৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করলেন ইসহাক খান খাগওয়ানী। স্বাধীন বাংলাদেশে বৈষম্যের প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। একাত্তর পূর্ব পরিস্থিতি নিয়ে তুলনা করেছেন পরাধীন জাতির সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার । একে ‘পাকি ঔদ্ধত্য’ না বলে পারা যায় না!
একাত্তরের ঘাতকদের প্রত্যক্ষ ভাবে সমর্থন দিয়ে তিনি একাত্তরের গণহত্যা , ধর্ষন সহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কে নির্লজ্জ সমর্থন দিয়েছেন। বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপির সাথে তার একাত্মতা প্রমাণ করে ঘাতকদের পক্ষে তাদের এক এবং অভিন্ন শক্ত অবস্থান!
পারিবারিক বন্ধু সাকা চৌধুরীকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে গিয়ে ইসহাক খান তার লেখার শেষ দিকে এসে স্বীকার করলেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সংগঠক।তবে ইসহাক খানের দাবিমতে বঙ্গবন্ধু নাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ই চান নি! তিনি একদিকে একাত্তরে সাকা চৌধুরীর অপরাধ অস্বীকার করলেন, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না চাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর উদারতা বলে উল্লেখ করলেন! স্ববিরোধিতা একেই বলে।
ইসহাক খান বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সম্পাদকদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আক্ষেপ করেছেন ডেইলী ষ্টারের সম্পাদকের কাছে পাঠানোর পর ও তার লেখা এখনো প্রকাশ হয়নি বলে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালৈর প্রতিটি রায়ের সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ এবং গণমাধ্যম পাকিস্তান কে ধুয়ে ফেলে- এটাও তার ক্ষোভের কারণ। এর পর ও তার আশাবাদ মুদ্রার অন্যপিঠ দেখে। তার গভীর পর্যবেক্ষণ বলে, মুদ্রার অন্যপিঠ হচ্ছে বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি এবং সাধারন অনেক মানুষ মানসিক ভাবে এখনো পাকিস্তানের পক্ষেই অবস্থান করছে। তার আশাবাদ , তার পারিবারিক বন্ধু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতি আওয়ামী লীগ এবং তার অনুসারীরা অনুকম্পা দেখাবে। এবং এটা বাংলাদেশের বর্তমান বিরোধী দল এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের ‘পাকিপ্রেম’ ভালো লাগার নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত ।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সশরীরে উপস্থিত থেকে বর্বর নির্যাতন করে হত্যা করেছেন অনেক নিরীহ মানুষ কে । সা কা চৌধুরীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে দানবীর শিক্ষানুরাগী সমাজহিতৈষী নূতন চন্দ্র সিংহ কে। প্রত্যক্ষদর্শী সালাহউদ্দিন আহমেদ সা কা চৌধুরীর টর্চার সেলে বন্দী ছিলেন। তার অত্যাচারেরর শিকার। প্রাণে বেঁচে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক ১৮ বছর বয়সে ফকা-সাকার বর্বর নির্যাতনে নিহত হন একাত্তরে। প্রত্যক্ষদর্শী তার বোন জোহরা বেগম। তিনি জাতীয় আর্টির সাবেক সাংসদ হারুণ অর রশীদের স্ত্রী। জ্যোৎস্নাবালা র সামনে সাকা চৌ দাঁড়িয়ে থেকে নির্দেশ দিয়ে জ্রোৎস্নাবালার স্বামী, ভাশুর সহ তার পরিবারের ২৮ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে । জ্যোৎস্নাবালা কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে কুঁজো হয়ে বেঁচে ছিলেন ২০১২ সাল পর্যন্ত। তার ইন্টারভিউ আছে। আদালতে অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। আপনি এই নিরীহ সাধারণ মানুষ গুলোর চোখের জল , স্বজন হারানোর বেদনা, গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রনা,সাকা চৌধুরীর বর্বর নির্যাতনে নিহত দের স্বজন অথবা আহত দের কান্না এবং তথ্য প্রমাণ সহ আদালতে সাক্ষ্যপ্রদান ইসহাক খানের কানে পৌঁছেনি । যারা হত্যাকারীর পক্ষে অবস্থান নেন, তাদের কানে কোন মানবিক বাণী পৌঁছাবে না – এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই সাকা চৌধুরীর সহপাঠী কোন এক বিচারপতি শামীমের দাবি ই তার কাছে মূখ্য হয়ে উঠেছে। এ যেন চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী! এরকম ভয়ংকর খুনির পক্ষ নিলে ধর্মেও সইবে না।পাকিদের আবারো জানিয়ে দেবে এদেশের মানুষ -বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে তিরিশ লাখ বাঙ্গালীর ঘাতক জারজদের কখনো ক্ষমা করবে না।
Sumikhan29bdj@gmail.com

Sunday, November 3, 2013

টেলিসংলাপ নিয়ে ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ কৌশলে নেমেছে বিএনপি:আবেদ খান


আমি সেই গল্পটির সারাংশ দিয়েই শুরু করি, যে গল্পটি সম্ভবত প্রায় সবাই জানেন, কিন্তু সবাই মানেন-এমনটি বলতে পারব না। এ প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট কথা বলে রাখি। আমার একটি লেখার শুরুতে ব্যবহার করা রূপকথার সারাংশ নিয়ে কোন এক মহলের কেউ কেউ অগ্নিশর্মা হয়ে বলেছেন, আমি নাকি ওই রূপক রূপকথায় এক শীর্ষ রাজনীতিককে সরাসরি কটাক্ষ করেছি! রবীন্দ্রনাথ তাঁর অচলায়তন কাব্যনাট্যে বলেছেন, ‘কথা বলি আমরা, আর মানে তো করে ওঁরা।’ কেউ যদি ক্রোধ বা হতাশার বশে সবকিছু নিজের ঝাঁপিতে ভরেন, সেক্ষেত্রে তাঁকে এমন অজ্ঞতার জন্য অনুকম্পা ছাড়া আর কি করতে পারি? এটাও এক রাজার গল্প। রাজা তাঁর পাচককে তাঁর জন্য বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্যবস্তু রন্ধন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাচক শত পদের সুস্বাদু খাদ্য রন্ধন করল বটে, কিন্তু শত ব্যঞ্জনের প্রতিটির প্রধান উপাদান ছিল-জিহ্বা। রাজা পরম তৃপ্তি ভরে ভোজন সম্পন্ন করে পাচককে উপযুক্ত পারিতোষিক দিয়ে বললেন, ‘বেশ! আগামীকাল তুমি বিশ্বের নিকৃষ্টতম বস্তু রন্ধন করে আমাকে মধ্যাহ্নভোজে পরিবেশন করো।’
পর দিনও অন্যভাবে শত ব্যঞ্জন রন্ধন করা হলো, এবং সেই শত ব্যঞ্জনের মূল উপাদানও ছিল-জিহ্বা। রাজা বিস্মিত হয়ে পাচককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এইরূপ রন্ধনের কারণ কি?’ পাচক উত্তর দিলো-‘মহারাজ! জিহ্বা এমন একটি বস্তু যা সুন্দররূপে ব্যবহার করলে মানুষ ধন্য ধন্য করে, এবং কদর্যভাবে ব্যবহার করলে মানুষ নিন্দা করে। জিহ্বা বন্ধুকে শত্রুতে পরিণত করে, আবার শত্রুকে বন্ধুকে রূপান্তরিত করে। কেবল জিহ্বার সঠিক ব্যবহার দ্বারাই অনেক অসাধ্য কর্মসম্পাদন সম্ভব, আবার এই জিহ্বার অপব্যবহার দ্বারাই অনেক সুন্দর পরিবেশ বিষবৎ হয়ে উঠতে পারে। মহাত্মন! জিহ্বার অসুন্দর ব্যবহার মহাযুদ্ধের কারণ ঘটায়, আবার সুচারু ব্যবহার মহাযুদ্ধের অবসান ঘটায়। আর এই উপাদানটির সুব্যবহারের জন্য কোন প্রকার অর্থনাশের আশঙ্কা নেই।’
রাজা পাচকের কথায় এবং যুক্তিতে মোহিত হয়ে তাকে সহ¯্র স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করলেন।
২.
দুই নেত্রীর সাম্প্রতিক ফোনালাপে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছে। এমন কি দেশের বাইরেও গিয়ে পড়েছে এই ঝড়ের ঝাপটা। শুধু দেশের বাইরে অবস্থানকারী বাংলাদেশীরাই নন, বিভিন্ন কূটনীতিক মহলেও এই ৩৭ মিনিটের ফোনালাপ নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা চলছে। সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার হলোÑ ক) এই দুই জনই হচ্ছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকা-ের প্রধান ব্যক্তি। একজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং অপরজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। একজন এই রাষ্ট্রীয় প্রধান নির্বাহীর পদে দ্বিতীয়বার উপবেশ করেছেন এবং অন্যজন দু’বার পূর্ণমেয়াদে ও একবার অতি স্বল্প মেয়াদে এই শীর্ষ প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
খ) দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কার্যরত বিভিন্ন বিদেশী কূটনীতিক এমন একটা প্রচারণা চালিয়েছিলেন যে, দুই নেত্রীর বাক্যবিনিময় ঘটলেই বুঝি-বা সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নাগরিক সমাজের একাংশ এই নিয়ে প্রবল রব তুলেছিলেন বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে, টকশোতে এবং পত্রপত্রিকায়Ñযার ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মনে প্রচ- কৌতূহল দানা বেঁধেছিল যে, দুই নেত্রীর মধ্যে কি ধরনের কথাবার্তা হয়! কাজেই তিন-চার দিন ধরে ক্রমাগত মিডিয়ায় এই দুই নেত্রীর ফোনালাপের প্রচার মানুষের প্রত্যাশাকে শ্বাসরুদ্ধকর পর্যায়ে উন্নীত করে ফেলেছিল।
গ) আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল হরতাল-কেন্দ্রিক সহিংসতার কারণে। অর্থনৈতিক প্রবাহ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল বলে সাধারণ মানুষের আশা ছিল যদি আলোচনায় একটা কিছু বেরিয়ে আসে, তাহলে হয়ত পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে।
ঘ) মানুষের আরও আগ্রহ ছিল আরেকটি বিষয়ের দিকে, তা হলোÑমুখোমুখি অবস্থানে থাকা দুই প্রধান জোট, বিশেষ করে দুই নেত্রী অনড় অবস্থানে রয়েছেন। যদি দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা হয় এবং আলোচনার সূত্র ধরে কোন পক্ষ যদি নিজে কিঞ্চিৎ নমনীয় হয়ে অপর পক্ষকে নমনীয় হতে সাহায্য করেন, তাহলে হয়ত বা রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটতে পারে।
কিন্তু এই বাক্যবিনিময়ের ফল বরং উল্টোটাই হলো। দুই পক্ষের অনমনীয়তা বৃদ্ধির ফলে, বৃদ্ধি পেল মানুষের হতাশা এবং অনিশ্চয়তার আশঙ্কা। দুই নেত্রীর বলয় থেকে আপন-আপন দৃষ্টিকোণের আলোকে এই ফোনালাপের ব্যাখ্যা দেয়া হতে থাকল। দুই শিবিরের অনুসারী বুদ্ধিজীবীরা নিজ নিজ নেত্রীর ভূয়সী প্রশংসা এবং অপর পক্ষের নিন্দাভাষণে মুখর হয়ে মিডিয়ার মাইক্রোফোন এবং পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠা উত্তপ্ত করে ফেললেন। আর মানুষের নিরাশা ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক নিরাসক্তির দিকে ধাবিত হতে থাকল। কূটনীতি পাড়ার কূটনীতিকরা বিস্ময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি অবলোকন করলেন এবং পরিমাপ করতে শুরু করলেন আমাদের দেশের শীর্ষপর্যায়ের রাজনীতিকদের রুচিবোধ এবং শিষ্ঠাচারের মাত্রা।
৩.
কথা উঠেছে, মিডিয়ার এই সংলাপ প্রকাশের বিষয়টি বিধিসম্মত অথবা শিষ্ঠাচারবর্জিত হয়েছে কিনা। এই নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে রীতিমতো আক্রমণাত্মক যুক্তিপ্রদর্শন করা হচ্ছে। ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অতিশয় আত্মরক্ষামূলক, যা মাঝেমধ্যে আত্মসমর্পণমূলক বলে মনে হয়, তেমনভাবে বিএনপির অভিযোগের জবাব দেয়া হচ্ছে। একমাত্র তথ্যমন্ত্রী বাদে আর কাউকে যথাযথ যুক্তি দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এর স্পষ্ট উত্তর আছে এবং উত্তরটি পরিষ্কার। প্রথমত, কেন বলা হচ্ছে যে, এটা প্রধানমন্ত্রী করেছেন? যে দু’জন ফোনে কথা বলছিলেনÑতাঁরা দু’জনেই বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই পৃথকভাবে হলেও তাঁদের প্রতিটি ফোনালাপ, তা তাঁরা যেখানেই কথা বলুক না কেন, মনিটরিং নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকবেই। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এটা জানেন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর এটা বিলক্ষণ জানার কথা। বিরোধীদলের নেতারা এবং তাঁদের শুভাকাক্সিক্ষগণ যখন প্রশান্তির হাসি হেসে বলেন, তাঁদের নেত্রী সব সাফ সাফ বলে দিয়েছেন এবং দারুণভাবে জিতে গেছেন তখন তো বলতেই হয় তিনি জানতেন এই সংলাপ মনিটরিং করা হচ্ছে এবং এটা বাজারে ছড়ানো হবে। কাজেই তিনি তো তাঁর মতো করে সবকিছু পাখির বুলির মতো বলে গেছেন। তাঁদের প্রতিপক্ষ মহল যদি অভিযোগ করেন, এটা বাজারে ছাড়ার ব্যাপারেও তাঁদের অদৃশ্য হাত আছে, তা তাঁরা অস্বীকার করবেন কি করে? হ্যাঁ, ওঁরা বলতে পারেন, যে সব এজেন্সি এ কাজ করে থাকে সে সব এজেন্সির কার্যক্রম তো সরকারের নির্দেশেই পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেয় সব কিছু নির্ভর করে। অতি উত্তম। তাহলে বিডিআর বিদ্রোহের সময় যেসব ভিডিও টেপ ছড়িয়ে গেল সর্বত্র, এমন কি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানের ক্যান্টনমেন্টের দরবার হলে সেনা অফিসারদের সঙ্গে কথোপকথন যে অডিও প্রচারিত হলোÑসেটা কারা করেছিল? কেন করেছিল? এ ব্যাপারে তো বিরোধীদলের নেতারা জানতে চায়নি কিভাবে এটা প্রকাশিত ও প্রচারিত হলো ইন্টারনেটে। বরং তাঁরা এই বিষয়টিকে ধরেই তাঁদের রাজনৈতিক শত্রুতা চালিয়ে গেছেন। দ্বিতীয়ত, দুই নেত্রীর সংলাপ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কোথায়? সরকারের কঠোর সমালোচক দেশের সর্বাধিক পঠিত প্রভাবশালী দৈনিকে। ওই দৈনিকটি এমনভাবে কাটছাঁট করে সংলাপের আংশিক বিবরণ প্রকাশ করেছিল, যা বিরোধীদলীয় নেত্রীর পক্ষে যায়। এতে কি বিরোধীদলের নেতারা চাপা হাসি হাসেননি? পরে যখন একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেল পুরো কথোপকথনটি প্রচার করে বসল এবং তাতে সংলাপের পরিবর্তে রূঢ় বাক্যানল বর্ষণের ব্যাপারটি দর্শকশ্রোতাদের স্তম্ভিত করল, তখন তাঁরা অফেন্সিভ পলিসি গ্রহণ করে পুরো দায়টি উল্টো দিকে ঠেলে দিল। আর আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার একটা বদঅভ্যাস আছেÑঅন্যের কৃতিত্ব দখল করা এবং নিজেকে জাহির করার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিংবা অপ্রয়োজনীয় কথা বলা। দু-একটা টিভি চ্যানেল যখন স্বপ্রণোদিতভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংলাপের অডিও টেপ সংগ্রহ করে প্রচার করে দিল, তখন তো উচিত ছিল তাঁদের চুপ করে পরিস্থিতি অনুধাবন করে সেটা দলীয়ভাবে বিশ্লেষণ করা। কিন্তু তা না করে এর দায়িত্বটা তথ্য মন্ত্রণালয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের ঘাড়ে নিল। এর ফলে নির্বুদ্ধিতার যত প্রকার কুফল হয়, সবই তাঁকে ভোগ করতে হলো।
তৃতীয়ত, এই সংলাপের ব্যাপারে বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষনেতাই অবগত ছিলেন না। তাঁদের এমন অনেকের সঙ্গে আমার দেখা কিংবা কথা হয়েছে যাঁরা এতে শুধু হতাশ বা বিব্রতই নয়, রীতিমতো রুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁদের কারও কারও ধারণা দেশনেত্রী আর তাঁদের পরামর্শের তোয়াক্কা করেন না। সবল পরামর্শদাতার প্যানেল নিয়মিত তাঁকে পরিচালনা করছে। মূলত তিনি তাদেরই হাতে বন্দী। তারা যা বলবে, তাই করতে হবে। তারা যদি সংলাপ না চায়, তবে সংলাপ হবে না। তাঁরা যদি বলে হরতাল দিতে হবে, তবে হরতাল দেয়া হবে। তারা যদি বলে তাদের লোকজনের মুক্তির দাবি করতে হবে, তবে তাই করা হবে। একজন বিএনপি নেতা তো বলেই ফেললেন, আমরা পুতুলের সংসারের সদস্য ছাড়া আর কিছু নই। মাঝেমধ্যে যখন আমাদের নেতাদের সঙ্গে বসা হয়, তখন শুধু ওই প্যানেলের পাঠানো সিদ্ধান্তটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়।
চতুর্থত, যাঁরা স্বকর্ণে শুনেছেন কিংবা বিস্তারিত পাঠ করেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝেছেন ১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্ট সম্পর্কে কি ধরনের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞ পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, জামায়াত দীর্ঘদিন যাবৎ ১৪ ডিসেম্বর তারিখে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করত শুধু এটা দেখানোর জন্য যে, এটা তাদের কাজ নয়, আওয়ামী লীগের কাজ। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী এবং বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রাণদ-প্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীর ব্যঙ্গোক্তি ছিলÑপার্থ নামের ওই হিন্দুটাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেই বেরিয়ে যাবে কারা এবং কাদের পরিকল্পনায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে। অথচ এই নিজামীর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্তি প্রমাণিত হয়েছে চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র দিয়ে। এসব থেকেই তো বোঝা যায় ফোনালাপে উচ্চারিত নিষ্ঠুর মন্তব্যের মুসাবেদা কোন মহল থেকে করা হয়েছিল।
পঞ্চমত, সংলাপের বিষয়বস্তু নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। অনেকে এর প্রকাশ করা নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও করেছেন। একজন উচ্চপর্যায়ের নেতা বলেছেন, এটা প্রচারের ব্যাপারটি যদি আমাদের জানা থাকত তাহলে তো ম্যাডাম এভাবে কথা বলতেন না। কি দাঁড়ায় এর অর্থ? তিনি রূঢ় কথা বলবেন টেলিফোনেÑএটাই তাহলে পূর্ব নির্ধারিত ছিল? তিনি কথা বলতে দেবেন না এবং গড়গড় করে বলে যাবেনÑএটাই কি ঠিক করা ছিল? লাল টেলিফোনকে কালক্ষেপণের এবং বিষয়বস্তুকে গৌণ করার জন্য ব্যবহার করা হবেÑএটাই কি পূর্বপরিকল্পিত ছিল?
৪.
তার পরও আমার ধারণা সংলাপ হবে, আলোচনা হবে এবং ফল একটা আসবেই। জামায়াত সবকিছু মিসমার করার জন্য যত চেষ্টাই করুক না কেন, যেহেতু বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল এবং মাঠপর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীরা যেহেতু সম্ভাব্য বিজয়ের প্রত্যাশায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেহেতু তারা দীর্ঘসময়ের জন্য নির্বাচনী এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাইবে না। কারণ তাঁদের অনেকের পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেয়ার শক্তি থাকবে না। আর আমার সুস্পষ্ট অভিমত হচ্ছে সেই বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তিÑ‘তুমি অধমÑতাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’ সংলাপের দরজাটা উন্মুক্ত হোক। সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে সংলাপ যদি শুরু হয় তো হোক না। আলোচনা সিঁড়ি বেয়ে উঠুক না ওপরের দিকে। ব্লেইম গেমের কূটকৌশলটা এবার বন্ধ হোক না। মানুষকে কষ্ট দেয়ার, মানুষ মারার, গাড়ি পোড়ানোর, বৃক্ষবিনাশের এবং শিক্ষাঙ্গনগুলো অচল করার সর্বনাশা হরতাল, কলকারখানা, হাটবাজার বন্ধ করার হরতালকে বিদায় দেয়া যায় না দু’পক্ষের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে? প্রধানমন্ত্রী না হয় আরেকবার ডাকলেনই চায়ের কিংবা নৈশভোজের আমন্ত্রণে। সেখানে তো তিনি অনায়াসে দেশ-জাতি এবং গণতন্ত্রের স্বার্থের বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারবেনই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বৃহৎ যে হয় সে পায় মহত্বের অধিকার।
যেই জিহ্বা নিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম সেই জিহ্বাতেই প্রত্যাবর্তন করি। আগেই বলেছি এই জিহ্বাই অনেক সুন্দরকে অসুন্দর করে, আবার শত্রুকে মিত্রে পরিণত করে। সুবচন নির্বাসনে না দিয়ে সুবচনের অধিষ্ঠান ঘটানো হোক রাজনৈতিক পরিমন্ডলে। তাহলে রাজনীতিও বাঁচবে, রাজনীতিকও বাঁচবেন।

লেখক : সাংবাদিক