Tuesday, November 19, 2013

মহান স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই জননী সাহসিকা!- সুমি খান



সকল অপশাসন, দুঃশাসন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদী মিছিলের নেতৃত্বে  ছিলেন জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল!বাংলাদেশে  মানবাধিকার ,নারী জাগরণ, নারী অধিকার আদায় ও নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অতুলনীয় সুফিয়া কামালের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা!!


সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে  বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলনের মিছিল

আজ ২০ নভেম্বর।কবি,বুদ্ধিজীবী,সমাজনেত্রী,নারী ব্যক্তিত্ব এবং নারী জাগরণের পথিকৃৎ কবি বেগম সুফিয়া কামালের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।১৯৯৯ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়।  তিনি তীব্র ঘৃণা করতেন রাজাকার,আলবদর, আল শামসদের।আমৃত্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন।নিজ মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে স্থিরচিত্তে যিনি নয় মাসে নয়টি কাঁথা সেলাই করেন অখণ্ড মনযোগে , তিনি কি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেয় চেতনা ও মূল্যবান অর্জনকেই ঐতিহ্যের সুতোয় গেঁথে নেন না? এই সুফিয়া কামালই একক অনন্য।১৯৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত ব্রাত্যজনের কাছে সেবায় ও দরদে যিনি চিহ্নিত হয়েছিলেন 'মা-ফাতেমা' হিসেবে-তিনিই মুক্তিযুদ্ধে সন্তানদের পাঠিয়ে কাঁথায় স্বপ্ন বুনে 'মা-সাহসিকা' হয়ে উঠেছিলেন।এই সুফিয়া কামাল অনন্য দ্বিতীয় রহিত।তার মতো আর নয় কেউ।বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অংশের ভূগোলকে তিনি ব্যাপ্ত করে রাখবেন নিজস্ব দ্যুতিতে, অনিঃশেষ মায়ামমতা ও বিপুল বৈভবে।
 বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে নির্মম হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা র পর  জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজাকার পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে শ্লোগান মুখর ঝাঁঝাঁলো মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন জননী সাহসিকা। তখন জিয়াউর রহমান তার পেটোয়া লাঠিয়াল  বাহিনী দিয়ে ও তাকে ঠেকাতে না পেরে ক্ষুদ্ধ প্রশ্ন করেছিলেন," এই অশিক্ষিতা মহিলার এতো শক্তি কি করে? এতো লোক কি করে তাকে মানে?"  শুনে স্মিতভাষী বেগম সুফিয়া কামাল মৃদু হেসেছিলেন শুধু, কোন মন্তব্য করেন নি! একই ভাবে স্বৈরাচারী বিশ্ববেহায়া এরশাদের তখ্ত ও কেঁপেছিলো জননী সাহসিকার দৃপ্ত সংগ্রাম আর আন্দোলনের প্রখর তাপে!

তিনি  ছিলেন এক বিশাল শক্তির প্রতীক।এই সমাজ সম্পৃক্ততায় তিনি হয়ে উঠেছেন আরো বড় মাপের মানুষ। বিপুল মানুষের সঙ্গে আত্মিক  সংযোগ এবং বিপুলতর নিঃসহায় জনের জন্য গভীরতর ভালোবাসা ও নিরন্তর উদ্বেগই সুফিয়া কামালকে অসামান্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে।এই সামগ্রিক উচ্চতা সমকালীন বাংলাদেশে আর কেউ অর্জন করেননি।সে জন্যই তিনি সমকালীন বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শত প্রতিকুলতা তাকে দমাতে পারেনি।



সুফিয়া কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে।
সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি।তার বাবা সৈয়দ আবদুল বারি ছিলেন উকিল।মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান।মাত্র বারো বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৩ সালে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিবাহ হয়।তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বাস করেও নিজস্ব চেষ্টায় এবং মায়ের স্নেহ ও পরিচর্যায় তিনি স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত হন।বিয়ের পর তিনি জাকজমকপূর্ণ পোশাক পরা বন্ধ করে তাতের শাড়ি পরা শুরু করেন। এ সময় তিনি নারী কল্যাণমূলক সংগঠন মাতৃমঙ্গল-এ যোগ দেন।

১৯২৩ সালে সুফিয়া কামাল রচনা করেন তার প্রথম গল্প সৈনিক বধূ যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা বাসন্তী প্রকাশিত হয়।

১৯২৯ সালে সুফিয়া কামাল যোগ দেন বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলামে। এখানে নারী শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারসহ নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। বেগম রোকেয়ার আদর্শ সুফিয়াকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৩১ সালে সুফিয়া কামাল মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ইন্ডিয়ান মহিলা ফেডারেশনের সদস্য নির্বাচিত হন।



কাজী নজরুল ইসলামের পাশে সুফিয়া কামাল

১৯৩৩-৪১ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি তার সাহিত্য চর্চাও চলতে থাকে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তার সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটি।এর ভূমিকা লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটির প্রশংসা করেন।১৯৪৭-এ সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হলে তিনি তার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন কবি-সম্পাদক সুফিয়া কামাল ...

''মুসলিম সমাজ আজ এক কঠোর দায়িত্ব গ্রহণের সম্মুখীন। অর্জিত স্বাধীনতা, সম্মান ও গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে হলে কেবল পুরুষেরই নয়, মুসলিম নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে। তার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ নারীসমাজকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সেই স্বাধীন সার্বভৌম আদর্শ রাষ্ট্রের সত্যিকার দাবিদার হতে পারে সগৌরবে।এর জন্য চাই আমাদের মানসিক প্রসার, আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি আর জীবন সম্পর্কে এক স্থির ধারণা।’''

১৯৩২ সালে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ১৯৩৩-১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন।১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ান।পরের বছর তিনি কলকাতায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন।

মহীয়সী নারী, জননী সাহসিকা, সমাজের মুক্তির পথ রচয়িতাদের অন্যতম পথিকৃৎ সুফিয়া কামাল অকুতোভয়ে বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, মানব মুক্তি, নারী মুক্তি, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে, নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সব সময়ই ছিলেন সামনের সারিতে।১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি আয়োজিত ‘শান্তি মিছিলে’ সুফিয়া কামাল সম্মুখভাবেই ছিলেন।

১৯৪৭ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন।এ সময় সুফিয়া সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন।তিনি যেসব সংগঠন প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা করেন তার মধ্যে আছে, বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি, দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থা।

তিনি ছায়ানট, কচিকাঁচার মেলা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।তার দুই মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে আগরতলায় হসপিটাল স্থাপন করেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), একাত্তরের ডায়েরী, মোর যাদুদের সমাধি পরে, একালে আমাদের কাল, মায়া কাজল (১৯৫১),কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) ইত্যাদি।২০০২ সালে বাংলা একডেমী সুফিয়া কামালের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে।

সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কার 'তঘমা-ই-ইমতিয়াজ' লাভ করেন।কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন।এ ছাড়াও তিনি বাংলা একডেমী পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস ক্রেস্ট (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) লাভ করেন।

জীবন যে কত বড় এবং তা যে সাধনায়, ত্যাগে, সদিচ্ছায়, শ্রমে, অঙ্গীকারে কত সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে  মানবতার কল্যাণে, দেশের কল্যাণে উৎসর্গ করা  যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বেগম  সুফিয়া কামাল। 
যে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে তার জন্ম সেখান থেকে তিনি শুধু উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে বেরিয়ে আসেননি,  দুঃসহ নিগড়ে আবদ্ধ বাঙালি মুসলমান নারী সমাজকে তিনি জাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন-  শৃঙ্খলমুক্ত জীবনে আহ্বান করেছেন  তথাকথিত সমাজ সংস্কারের নিগড়ে শৃঙ্খলিত অগণিত নারী -পুরুষকে!

রক্ষণশীল ও আভিজাত্যের বৃত্ত ভেঙেই তিনি সাহসী - দৃঢ় পদচারণা শুরু করেছিলেন।বৃত্ত যিনি ভাঙতে পারেন তিনি আরো বৃত্ত ভাঙার জন্য প্রস্তুতি নেন।সুফিয়া কামালও তাই করেছেন আমৃত্যু। অশুভ, অসুন্দর অকল্যাণের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ উজ্জীবিত করেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আজ তোমার মহা প্রয়াণের দিনে  তোমার মহান স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা  জানাই  জননী সাহসিকা!

No comments:

Post a Comment