Thursday, November 21, 2013

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃত নায়ক ড. কিসিঞ্জার এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো




বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিজ হাতে হত্যা করেছিল মোহাম্মদী বেগ, তার অর্থ এই নয়, মোহাম্মদী বেগই সিরাজ হত্যার আসল ব্যক্তি। ঠিক তেমনি ডালিম, ফারুক, রশীদ, মেজর নূর বঙ্গবন্ধু হত্যা-নাটকের মূল চরিত্র নয়। সিরাজ হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তির প্রতিনিধি লর্ড ক্লাইভ। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল মার্কিন প্রতিনিধি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কিসিঞ্জার এবং তার দোসর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরা দুজনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিলেন।মাহমুদুল বাসার চলছে শোকাবহ আগস্ট মাস। আর ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে, সপরিজনে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকা-ের অন্যতম একটি ১৫ আগস্টের হত্যাকা-। বাংলাদেশের একদল বিভ্রান্ত সেনাসদস্য এই হত্যা সংঘটিত করেছে। এরা ছিল ক্রীড়নক। দেশি-বিদেশি শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারী একটি চক্র এই হত্যার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নিজ হাতে হত্যা করেছিল মোহাম্মদী বেগ, তার অর্থ এই নয়, মোহাম্মদী বেগই সিরাজ হত্যার আসল ব্যক্তি। ঠিক তেমনি ডালিম, ফারুক, রশীদ, মেজর নূর বঙ্গবন্ধু হত্যা-নাটকের মূল চরিত্র নয়। সিরাজ হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তির প্রতিনিধি লর্ড ক্লাইভ। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল মার্কিন প্রতিনিধি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কিসিঞ্জার এবং তার দোসর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরা দুজনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ১৯৭১ সালে পরাজিত হয়েছিলেন। 
খুব অপমানিত হয়েছিলেন এরা। একটা অপমানিত বোধ থেকে কিসিঞ্জার ও ভুট্টো বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধুকে বাঁকা নজরে দেখতেন খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান। এর প্রমাণ ইতিহাসে আছে। দুজনই ছিলেন ক্ষমতালিপ্সুু, উচ্চাভিলাষী এবং ষড়যন্ত্রকারী, এর প্রমাণও ইতিহাসে আছে।
মোশতাক চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে, তারপর মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারে নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তুমুল প্রতিবাদের মুখে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর কলকাতা গিয়ে তিনি ড. আনিসুজ্জামানের কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ড. আনিসুজ্জামানের 'আমার একাত্তর' বইতে তা লেখা আছে। ১৯৭১ সালে খন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার যে চক্রান্ত করেছিলেন, এর সঙ্গে জিয়াউর রহমানও জড়িত ছিলেন।
মোশতাক এবং জিয়া দু'জনই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন। একজন রাজনৈতিক অঙ্গনে বসে, অন্যজন সেনাবাহিনীর পরিম-লে বসে। যতদিন বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন, ততদিন দু'জনই বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে নিখুঁত অভিনয় করেছেন। যাতে আঘাতটা ভেতর থেকে করতে পারেন।
ড. ওয়াজেদের বই পড়ে জানা যায় যে, মোশতাকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রবল তর্ক হয়েছে বাকশাল গঠন নিয়ে। তারপরও মোশতাক, তাজউদ্দীন, জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের মতো মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেননি। জিয়া বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তার 'ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা' গ্রন্থে বলেছেন, জিয়াউর রহমান ভবনে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে জিয়াউর রহমান নতজানু হয়ে বঙ্গবন্ধুকে খোশামোদ করে কথা বলতেন। খামাখা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতেন, 'আগে আমার বুকে গুলি লাগবে, তারপর বঙ্গবন্ধুর বুকে লাগবে'। (অধ্যাপক আবু সাইয়িদ- বঙ্গন্ধু হত্যাকা- ফ্যাক্টস্ অ্যান্ড ডকুমেন্টস্)। অর্থাৎ জিয়া জানতেন বঙ্গবন্ধুর বুক টার্গেট করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা জিয়ার সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। তারা জিয়ার কাছে বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের প্রস্তাব করেন। জিয়া বলেন, 'আমি এ সবে থাকতে পারি না, তোমরা জুনিয়ররা এ সব করলে করতে পারো'। অর্থাৎ তোমরা এগিয়ে যাও; আমি আছি পেছনে।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক, দার্শনিক ও অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান একটি বই লিখেছেন, নাম "শতাব্দীর স্মৃতি"। সেখানে স্মৃতিচারণায় সাইদুর রহমান বলেছেন যে, ১৯৭৪ সালে তার ভাইরার বাসায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়। জিয়া তার কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাংঘাতিক ক্ষোভ প্রকাশ করেন ও বিষোদগার করেন।
অথচ প্রজাতন্ত্রের সেবক হয়ে জাতির পিতার বিরুদ্ধে এবং সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে এমন ক্রুদ্ধতা প্রকাশ করতে পারেন না। জিয়ার সৎ সাহস থাকলে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারতেন।
জিয়ার কুটিল চেহারা চেনার জন্য নিরন্তর গবেষণা করা উচিত। আমার বন্ধু সাংবাদিক স্বদেশ রায় একবার বলেছিলেন যে, তিনি 'মেজর জেনারেল গণতন্ত্র' নাম দিয়ে জিয়াউর রহমানের ওপর বই লিখবেন। লিখেছেন কিনা জানি না।
মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম প্রণীত 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে', সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের গ্রন্থের ভাষায় ইতিহাসের তিনি একজন খলনায়ক। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উস্কানি দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সেনা অভ্যন্তরে ফারুক ও রশীদের ডিফেন্স দিয়েছিলেন। তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া গড়ে ওঠার বিপক্ষে তিনি জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া জিয়া সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লবিং করে ১৫ আগস্ট হত্যাকা-ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিলেন।
জিয়া ও মোশতাক দুজনই মতলববাজ ও সম্প্রদায়িক। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তারা বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেননি। তাই দেখা গেল, জিয়া ১৫ আগস্ট সকালে নির্বিকারভাবে, উৎফুল্ল মনে সেভ করতে বসেছেন। খবর এলো রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বললেন, সো হোয়াট। ওইদিন তিনি সেনাছাউনিতে গিয়ে খুনি ফারুককে বললেন, ঋধবঁয়ব পড়সব ঃড় সব ধহফ শরংং সব, ুড়ঁ যধাব ফড়হব ধ মৎবধঃ লড়ন, (বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টস)।
জিয়া ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন তার পুরস্কার দিতে বঙ্গবন্ধু কার্পণ্য করেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না। তাই তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান না বানিয়ে জেনারেল সফিউল্লাহকে বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে তেমন আমল দিতেন না। একবার বলেছিলেন, আমাদের জিয়া বড় মুক্তিযোদ্ধা, কেবল আমার বিরুদ্ধে একটু আধটু ষড়যন্ত্র করে। অর্থাৎ জিয়ার চোখের ভাষা বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, তাই গুরুত্ব দিতেন না। এই ক্ষোভ জিয়ার মনে সাপের বিষের মতো কাজ করেছিল।
বঙ্গবন্ধু গবেষক, লন্ডন প্রবাসী লেখক আবদুল মতিন বিজয় দিবসের পর ও বঙ্গবন্ধু বইতে দেখিয়েছেন, কেন জেনারেল ওসমানী জিয়াকে গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের হস্তক্ষেপে তার মীমাংসা হয়। আবদুল মতিন আরো জানিয়েছেন যে, জিয়া ভারতের কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে ভারত সরকার এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছেন।
ধূর্ত, চতুর, উচ্চাভিলাষী জিয়া জেনারেল সফিউল্লাহর দৌর্বল্যেরও সুযোগ নেন। '৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে তিনি হজরত মাবিয়া ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো দক্ষতার সঙ্গে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগান। কিছুদিন আগে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন একটি কলামে বলেছেন, দেশে এখন ৫০ ভাগ পাকিস্তান সমর্থিত লোকজন আছে।
এই কৃতিত্ব জিয়াউর রহমানের। পাকিস্তান সমর্থিত লোকজন, আমলা-আর্মি ও এলিটদের নিয়ে তিনি দল গঠন করেছেন। তিনি যেভাবে ১৯৭১ সালের ম্যান্ডেট পরিবর্তন করেছেন তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করে সম্ভব ছিল না। তার রাজত্বে ফারুক-রশীদরা ফ্রিডম পার্টি নাম দিয়ে দল গঠন করে কুড়াল মার্কা নিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে রাজনীতি করেছে। এই আস্কারা জিয়াউর রহমান দিয়েছেন। এখনো তার স্ত্রী এবং তার দল যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করে যাচ্ছেন।
অনেকে বলেন, দুই নেত্রীর সমঝোতার দরকার। বেগম জিয়া যদি ১৫ আগস্টের মতো জাতীয় শোক দিবসে কাল্পনিক জন্মদিন পালন করেন তাহলে সমঝোতা হবে কেমন করে? এই আদর্শিক সংঘাত সহজে মিটবে বলে মনে হয় না। ১৯৭৮ সালে এক কলামে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু হত্যার পালের গোদা। গবেষকদের উচিত শুধু চোখের পানি না ফেলে এই পথে আরো গবেষণা করা।

মাহমুদুল বাসার: প্রাবন্ধিক, গবেষক

No comments:

Post a Comment