Tuesday, November 19, 2013

স্মৃতির সেফটিপিন : অপরাহ্ণ সুসমিতো


---------------------

মুসলিম হলে তিনদিন ব্যাপী রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন হবে । আমাদের সবার খুব উৎসাহ । গৌতম বলল : বেগম সুফিয়া কামাল আসবেন ।

আমার আগ্রহ গেল বেড়ে ।

এর আগে বেগম সুফিয়া কামালকে কখনো দেখিনি । পরিকল্পনা হলো রাতে আমি,মনজু মিলে নাসিমের চকবাজারের ডেরায় থাকবো । যেদিন সম্মেলন শুরু হবে সেদিন থেকে শুরু বাস মালিক সমিতির ধর্মঘট শুরু হয়ে গেল । কি জ্বালা ! সেদিন আবার সাপ্তাহিক ছুটি ।
হল থেকে চট্টগ্রাম শহরে যাই কি করে ? মনজু,আমি হলে থাকি । গৌতম,নাসিম শহরে । ওদের কোনো সমস্যা নেই ।

ওরা তো ঠিকঠাক চলে আসবে । আমরা ?

উদ্বোধন সন্ধ্যায় । সকাল থেকে ভাবনা মাথায় ।

নাস্তা করতে এলাম সকাল সকাল রব ভাইয়ের দোকানে । চা খেতে খেতে ভাবছিলাম কি করা যায় ? বিধানদা এসে তখন হাজির । রোদ বাড়ছে,আস্তে আস্তে সবার ঘুম ভাঙ্গছে । অনেকেই নাস্তা করতে বেরুচ্ছে । বিধানদাকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ লাল,উস্কুখুস্কু ।

কিন্তু মনে হলো মেজাজ শরীফ চনমনে । বিধানদা রসায়নের ছাত্র,আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র । খুব দিল দরাজ মানুষ । জুয়া খেলে জেতায় তার সুনাম সর্বজনবিদিত । অনুমানে ঢিল ছুঁড়লাম । “কি বিধানদা কাল তো হেভী জিতলেন” ।
বিধানদা শিশুর মতো হাসি দিলেন ।

বুঝে গেলাম ঢিল লেগেছে । বিধানদা এলাহী নাস্তার অর্ডার করলেন । আরো নিশ্চিত হওয়া গেল যে তার পকেটের স্বাস্থ্য ভালো । বিধানদার আবার গান বাজনায় আগ্রহ আছে । কথায় কথায় জানালাম আজ সন্ধ্যায় তো রবীন্দ্র সম্মেলন মুসলিম হলে কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট । বাস চলছে না ।

বিধানদা গম্ভীর হয়ে শুধু বললেন

: কুছতা ভাবিয়ো না । তোমারে সন্ধ্যা বেলায় টেক্সীতে করিয়া লইয়া যাইমু নে । ( বিধানদা সুনামগঞ্জের ছেলে )

আমার অন্তরে শান্তিনিকেতনের সুশীতল বাতাসের ঢেউ খেলে গেল । হলের চারপাশটা মূহুর্তে ভালো হয়ে গেল । ক্যাম্পাসের রোদ,ছুটির সকাল চনমনে হয়ে উঠলো ।

সন্ধ্যাবেলা ট্যাক্সী করে বিধানদা,মনজু আর আমি মুসলিম হলে এসে হাজির । ওখানে গিয়ে রেজা স্যার,হোসাইন কবীর,শিলু,দীনা,রুমানা,নাসিম,গৌতম,সুজিতকে আবিস্কার করলাম ।
আমার অপেক্ষা কখন বেগম সুফিয়া কামালকে দেখবো ।

কিছুক্ষণ পর দেখি আনিসুজ্জামান স্যার বেগম সুফিয়া কামালকে হাত ধরে ধরে নিয়ে আসছেন । লোকজনের ভীড় জমে গেছে । আমি মুগ্ধ চোখে সাঁঝের মায়ার কবি সুফিয়া কামালকে দেখতে থাকি । নীল পাড়ের শাদা সুতি শাড়ি । চোখে খুব পাওয়ারের চশমা । মূহুর্তেই ভালো লেগে যায়,আপনা থেকেই শ্রদ্ধা জাগে । সুজিত দৌঁড়ে গিয়ে এক ফাঁকে অটোগ্রাফ নিয়ে আসে ।
অটোগ্রাফ পেয়ে সুজিত তো মহা খুশী । অটোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে দেখি বেগম সুফিয়া কামালের কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা ।

ওমা নিজেই নিজের নামের বানান ভুল করেছেন । কামালের জায়গায় কমাল লিখেছেন ।

সম্মেলন শুরু হলো । হল ভর্তি লোকজন । সারা বাংলাদেশ থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত পিপাসু মানুষ । আমরা দলবল এক সাথে বসতে পারলাম না । কে কোথায় ছিটকে পড়লো কে জানে । সুজিত অটোগ্রাফের পৃষ্ঠাটা আমার কাছ থেকে নিতে ভুলে গেল ।

খুলনা থেকে আসা ছেলে মেয়েরা মঞ্চে পারফর্ম করছে । আমার বুক পকেটে অটোগ্রাফের পৃষ্ঠাটা । একটু পর পর পকেটে হাত দিয়ে দেখি কাগজটা আছে কি না । কি রকম যে এক অনুভূতি !

শ্রদ্ধেয়া বেগম সুফিয়া কামাল বেঁচে নেই । আনিসুজ্জামান স্যার এখনো আছেন মাথার উপর ছাতা হয়ে ।

সুজিত এখন আর বাংলাদেশে নেই । বাবরী মসজিদ নিয়ে তুমুল দাঙ্গার পর সুজিতদের কুমিল্লার বাড়ি থেকে ওদের উচ্ছেদ করা হয়েছে । বন্ধুরা বয়সী ঈগল পাখির থাবা চোখের কোণে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে ।

যায় দিন তুমুল বর্ষার মতো ।

অটোগ্রাফটা আমার কাছে স্মৃতির সেপটিপিন হয়েই পড়ে থাকলো, টাটকা এখনো ।

2 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. ভালো খবর! গল্পের এই সুজিত এখন বাংলাদেশেই আছে। একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছে। ভারতে গিয়ে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আবার দেশে ফিরেছে বহুদিন পর। বিয়ে করেছে - সংসারী হয়েছে এই অনাথ। যে মাটিতে জন্ম তাঁর সে মাটিই তাকে কোলে নিয়েছে অতি আদরে। রেখেছে সযতনে - শত হলেও এ মাটিরই সন্তানতো !! কতো বিচিত্র এই পৃথিবী, আর এর মানুষগুলো!!

    ReplyDelete