Sunday, November 10, 2013

রাজনীতি-সংস্কৃতির শেকড়ের নিবিড় বন্ধনে আমার শৈশব- সুমি খান



কেমন ছিল আমার শৈশব?
ফিরে যাই স্বর্ণালী অতীতে। যে অতীত জুড়ে আমার ফ্রেন্ড, ফিলসফার এন্ড গাইড আমার বাবা সাইফুদ্দিন খানের সার্বক্ষণিক সঙ্গ এবং অবাধ স্বাধীনতা। তার পাশাপাশি মা নূরজাহান খানের অপত্য স্নেহের অন্য পিঠেই ছিল কড়া শাসন ।আর আমাদের স্কুল - বীরকন্যা প্রীতিলতার কর্মস্থল অপর্ণা চরণ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মহীয়সী নারী প্রণতি সেনের কঠিন নিয়ম কানুন শৃঙ্খলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আমাদের কৈশোর পর্যন্ত।
সব মিলে আমাদের পারিপার্শ্বিকতা শিশুদের জন্যে অনেক বেশী যত্নশীল ছিল-যা এখন দেখা যায় না। তখন কি তাই বলে বখাটেপনা ছিল না? ছিল, তবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন অনেক। যা এখন দেখা যায় না।
আমার বাবা -মা দু'জনেই ব্যাংকার। আবার দু'জনেই মুক্তিযোদ্ধা, আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথ কাঁপানো মিছিলের চেনা মুখ। চিন্তা চেতনায় অসাম্প্রদায়িক। পরিবারে বাম শীর্ষ রাজনীতিকদের নিত্যআনাগোনা। অনেক বিপ্লবী আর আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিকের গোপন আশ্রয় ছিল আমাদের বাড়ী। মা ভীষণ কর্মঠ এবং অতিথি পরায়ন।
অন্য অনেকের মতো আমিও যৌথপরিবার -একক পরিবার মিলিয়ে অনেকের শাসন-বারণ আদর- ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছি। সেই শাসন আদর কেবল রক্তের সম্পর্কের গুরুজনেরা করেন নি।
আত্মার সম্পর্কের আত্মীয়দের নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি শৈশবে।যারা এই দেশ এই মাটির সাহসী সন্তান-যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন এই দেশ মাটির জন্যে। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব পূর্ণেন্দু কানুনগো। ধবধবে সাদা চুলের প্রচন্ড মেধাবী এবং ত্যাগী এই রাজনীতিকের নির্ভুল সুস্পষ্ট উচ্চারণে বাচন ভঙ্গী আর প্রখর ব্যক্তিত্ব ছিল ঈর্ষণীয় ।
আম্মু অফিস থেকে দুপুরে বাসায় এসে সবসময়ে দেখতেন আমরা দুই ভাই-বোন (তখনো ছোটভাইয়ের জন্ম হয়নি) ধুলোবালি মেখে উঠোনে খেলছি। আমাদের গোসল করানো, খাওয়ানো সেরে আম্মু আবার অফিসে চলে যেতেন।
হঠাৎ একদিন দেখলেন, আমরা দু'জন পরিপাটি , পরিচ্ছন্ন জামা গায়ে সেলিম চাচ্চুর কোলে বসে গল্প শুনছি। পূর্ণেন্দু কানুনগো আন্ডারগ্রাউন্ডে 'সেলিম'সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন । আমরা বড়ো হয়েও তাকে 'সেলিম চাচ্চু' বলেই জানতাম। চাচ্চু আমাদের এতোটাই আপন করে নিয়েছিলেন, তিনি বাসা থেকে বেরুবার সময়ে নাকি বলতেন , আমি তার পিছুটান।
ঈদের ছুটিতে চারটি সাম্পানে করে পরিবারের শহরবাসীরা হৈ হৈ করে কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে বরউঠানের বাড়িতে যাওয়ার মুহুর্ত গুলো ছিল অন্যরকম উত্তেজনা আর আনন্দের।
আমাদের বাপ্পু সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠক ডা. কামাল এ খানের অভিভাকত্বে পরিবারের সবার সাথে গান বাজনা করে ঈদের ছুটির চার/পাঁচটি দিন পার করতাম।
আমার মা আমাদেরকে শৈশবে বই মেলায় নিয়ে যেতেন।আশি থেকে নব্বই য়ের মধ্যে দেশে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হতো, আন্তর্জাতিক বই মেলা হতো-যেখানে রাশিয়ান , ভারতীয় বই খুব অল্প দামে পাওয়া যেতো। কর্মজীবী মা আমার, প্রচুর বই কিনে দিতেন। রুশদেশের উপকথা , মালাকাইটের ঝাঁপি, ঠাকুরমার ঝুলি । আরো থাকতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম , সুকুমার রায়, সত্যজিত রায়ের সমৃদ্ধ শিশুসাহিত্যের নানান লেখা সহ নানান দেশের উপকথা, রূপকথা।
রাতের বেলা ঘুমানোর সময়ে বাবা আর মা সেই গল্প গুলো শুনাতেন। , যা শিশু কিশোরদের মনে সৃষ্টিশীল চিন্তার বিকাশ ঘটাতো। মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের 'গুপি গাইন বাঘা বাইন', 'গুপি বাঘা ফিরে এলো' , 'হিরক রাজার দেশে', 'আগন্তুক' এই ছবিগুলো মানবিক অনুভুতি এবং সমাজ প্রগতির চিন্তা নিয়ে ভাবাতে শিখিয়েছিল আমাদেরকে সেই কৈশোরেই। তাছাড়া এদেশেও নির্মিত হয়েছিলো সত্য সাহার ছুটির ঘন্টা, বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, যার ধারাবাহিকতা পরে আর আমরা পাইনি। বর্তমান প্রজন্ম বঞ্চিত হয়েছে সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র থেকে যেকারণে একটি বন্ধ্যা সময় অতিক্রম করছে তারা, যার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে।
চট্টগ্রাম মুসলিম হলের মঞ্চে সেই কৈশোরেই দেখেছি নুরলদিনের সারাজীবন , দেওয়ান গাজীর কিসসা। বাপ্পুর বাসায় এসেছেন ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দোপাধ্যায়। ভাষাবিদ হরলাল রায়ের ছাত্রী ছিলেন আমার মা। তার অন্তরে সারাক্ষণ রবীন্দ্রনাথ । মায়ের পছন্দের কারণে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা ক্যাসেটে শুনতাম আর গীতবিতান খুলে পড়ে পড়ে গাইতাম। কৈশোরেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো এই চারটা নৃত্যনাট্য । এখনো তার কিছুটা মনে আছে। খেলাঘর, উদীচী র সাথে রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমার শৈশব কৈশোরের স্বর্ণালী স্মৃতি।
বাবা তার কৈশোরেই ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে জেল-জুলুম মিটিং মিছিল ছিল তার নিত্য সঙ্গী। দেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের সাথে ও তার সম্পৃক্ততা ছিল অনেক ।
লালদীঘির মাঠে সমাবেশ হলেই আমাদের বাসায় ভাত খেতেন বাম রাজনীতিকেরা। তাদের কে কাছে থেকে দেখেছি আড্ডা আর হৈচৈ করে আনন্দময় সময় কাটাতে।
বাবার হাত ধরে লালদীঘির মাঠে রাজনৈতিক নেতাদের জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনতাম। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন দিবস , প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারী, ১৪ ডিসেম্বর , ১৬ ডিসেম্বর রাত ১২টা ০১ মিনিটে শহীদমিনারে ফুল দিতে যাওয়া সহ প্রতিটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিন পালন ছিল গুরু দায়িত্বের মতো।
বেগম সুফিয়া কামালের হাত ধরে রাজপথে নেমেছেন আমার মা। ব্যাংকিং এর পাশাপাশি আমার মা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।
মা য়ের শাসনের কথা মনে হতে এখনো অনেক ভয় লাগে। যতোই আন্দোলন সংগ্রাম আমাদের তিন ভাইবোনকে কখনো মাত্রাছাড়া স্বাধীনতা ভোগ করতে দেন নি। নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে আমাদের স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিতেন পড়ালেখার।
আমরা এতো মার খেয়েছি মায়ের! একটা ঘটনা মনে পড়ছে ।নারী নির্যাতন বিরোধী আইনের উপর একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে কোলকাতা গিয়েছিলেন মা। আমার ছোট ভাই তখন চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। স্কুল থেকে বেরিয়ে ভিডিও গেম খেলতে চলে যেতো বন্ধুদের সাথে। আম্মু কোলকাতা থেকে এসে স্কুলে চেক করতে গিয়েই বিষয়টা জেনে গেলো। সাথে সাথে লালদীঘির পাড়ে জেলাপরিষদ মার্কেটে ঐ ভিডিও গেমের দোকানে কোতোয়ালী থানার পুলিশ নিয়ে রেইড দিলো আমার মা। স্কুলের পাশে ভিডিও গেমের দোকান বন্ধ হয়ে গেলো। সবার সামনে আমার ভাইয়ের কানে ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাসায় এনে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পিটা দিলেন মা। সে কী কঠিন শাসন!! একই সাথে বন্ধুর মতো অনেক আপন ও ছিলেন আমার মা। এখনো মায়ের সাথে আমাদের তিন ভাইবোনের ই গভীর বন্ধুত্ব।
আমি এখন মা হিসেবে চিন্তা করি, আমরা কি পারছি সন্তানদের এভাবে আদর অথবা শাসন করতে?
মনে পড়ছে ঐশীর কথা। একজন রিপোর্টার হিসেবে অভিভাবক হন্তা ঐশীর বিষয়টি অনেক কাছে দেখেছি। বিষয়টি সমাজগবেষক দের শুধু নয় সাধারণ বাবা-মা দের জন্যে ও অনেক উদ্বেগ এবং ভাবনার বিষয়।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সাথে অনেকবার কথা বলেছি। সদ্যকৈশোরোত্তীর্ণ ঐশী পুলিশ পরিবারের সন্তান , তার পরিবারের সম্পদ, ঐশ্বর্য অনেকের টার্গেট। তাই ঐশীকে সমর্থন করতে গিয়ে অনেক সত্য গোপন করা হচ্ছে । অনেকের প্রশ্ন ঐশীর মা কর্মজীবি ছিলেন না। কৈশোরে পা দিতে না দিতেই উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলো ঐশী- এতে মা কি তার দায় এড়াতে পারবেন? ঐশীর সাথে তাদের গৃহপরিচারিকা ছোট্ট সুমী ও কারাবন্দী; যে পুরো ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। নিরীহ নিরপরাধ একটি গ্রাম্য সাধারণ কিশোরী। আশা করছি তাকে মুক্ত করে নিতে পারবে তার পরিবার। তবে এই দুই কিশোরী এবং ঐশীর ছোটভাই য়ের যে ভয়ংকর মানসিক চাপ , তা আদৌ কতোটা কাটবে- তা সময় ই বলে দেবে।
আরেকটি আলোচিত হত্যাকান্ডের কথা মনে পড়ছে। যেখানে সত্য এখনো অনুদ্ঘাটিত অথবা চেপে যাওয়া হচ্ছে । এখানেও একটি শিশুর জীবন সংকটময়।
সন্তানকে নিজের সবকিছুর সাথে একাত্ম করে ফেলার যে দৃষ্টান্ত আমার বাবা-মা দেখিয়েছেন , আমাদের সব পরিবারে যদি তার চর্চা হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই শৈশব-কৈশোরে শূন্যতার সংকটে ভুগবে না কিশোর কিশোরী। ড্রাগ কে নি:সঙ্গতার সঙ্গী করে নেবে না। বাবা-মা, চাচা-খালা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, বন্ধু-স্বজনের সাথে একাত্মতা অনেক জরুরী।
আমাদের সমাজটা যতো বেশী একাকী , আত্মকেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছে , আমরা ততো বেশী সংকটময় ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতি, রাজনীতির শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা সন্তানদের অনিশ্চিত নিঃসঙ্গ দিকনিশাহীন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি । যা ভয়ংকর আত্মঘাতী। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরী।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
sumikhan29bdj@gmail.com

No comments:

Post a Comment