Sunday, October 20, 2013

রাজাকারপ্রেমী খালেদা জিয়ার হিন্দুপ্রীতি - ভূতের মুখে রামনাম:শাহরিয়ার কবির


আমার বাড়িতে আর অফিসে রোজ এক ডজন দৈনিক পত্রিকা আসে। কিছু সৌজন্য সংখ্যা, কিছু কিনতে হয়। সবার আগে যে পত্রিকাটি হাতে তুলে নিই, সেটি জনকণ্ঠ। এই পত্রিকাটির প্রতি দুর্বলতা প্রধানত তোয়াব খানের কারণে। মুক্তিযুদ্ধের পর দৈনিক বাংলা এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যখন সাংবাদিকতায় হাতেখড়িÑ সম্পাদক তোয়াব ভাই শিখিয়েছেন আধুনিক সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকের নৈতিক, সামাজিক দায় ও অঙ্গীকার কাকে বলে। ২০ বছর পর এই দায় ও অঙ্গীকারের কারণেই খালেদা জিয়ার সরকার বিনা নোটিসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে আমাকে বরখাস্ত করেছিল।
এরপর তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশেরও চেষ্টা করেছিলাম। খালেদা জিয়ার রোষানলের ভয়ে কোন মালিক আমাকে নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাননি। এমন এক সময় ছিল তখন কোন পত্রিকা আমার লেখা ছাপতেও আগ্রহী ছিল না। তোয়াব ভাই জনকণ্ঠে যোগ দেয়ার পর তাঁরই কারণে এই পত্রিকার প্রতি আমার আগ্রহ। জনকণ্ঠের সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ ও উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিভু নিভু মশালটি তাঁরা যেভাবে জ্বালিয়ে রেখেছেন, সেই আলো মুক্তিযুদ্ধোত্তর নতুন প্রজন্মকে এখনও পথ দেখাচ্ছে, আলোকিত করছে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ার সাহস যোগাচ্ছে।
এর জন্য জনকণ্ঠকে মাসুলও কম দিতে হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলেই সম্ভবত ১৯৯৫ সালে তোয়াব ভাই, বোরহান ভাই ও শামসুদ্দিন ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছিল মৌলবাদীদের ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে লেখার জন্য। সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ সেবার পালিয়ে গিয়ে গ্রেফতার এড়ালেও ২০০৭ সালে ঠিকই তাঁকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল এবং ২২ মাস বিনা বিচারে কারানির্যাতনও ভোগ করতে হয়েছিল।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা, নির্যাতন ও গণগ্রেফতারসহ সারা দেশে সন্ত্রাসের যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিলÑ মনে হয়েছিল গোটা বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য না করা পর্যন্ত এর অবসান ঘটবে না। জনকণ্ঠে তখন ধারাবাহিকভাবে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে লিখেছি। এসব লেখার জন্যই ক্ষমতায় আসার পর পরই খালেদা-নিজামীদের সরকার আমাকে গ্রেফতার করেছিল। দেশে ও বিদেশে এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদও হয়েছিল। ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ যখন এই গ্রেফতারের নিন্দা করে আমাকে ‘কারাবন্দী বিবেক’বলেছিল। সেদিন জনকণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল সেটি। কারাগারে এক তরুণ বন্দী কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে জনকণ্ঠের সেই সংখ্যাটি এনে লুকিয়ে আমাকে দিয়েছিল। জনকণ্ঠ তখন কারাগারেও নিষিদ্ধ। খালেদা-নিজামীদের নির্মম কারাগারের দুঃসহ পরিবেশে জনকণ্ঠের সেই সংবাদ পড়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি।

দু’ বছর পরে ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ তাদের ঘোষিত কারাবন্দী বিবেকদের নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিল, যাদের তালিকায় নেলসন মেন্ডেলার মতো মহাজনদের পাশে আমার মতো অভাজনও ছিল। এ্যামনেস্টির প্রশ্নকর্তা জানতে চেয়েছিলেন আমি কখন কিভাবে জেনেছিলাম তারা যে আমাকে ‘কারাবন্দী বিবেক’ ঘোষণা করেছেন। আমি জনকণ্ঠের সেই সংবাদ শিরোনামের কথা বলেছিলাম।
খালেদা-নিজামীদের দুঃশাসনের অন্যতম বলী জনকণ্ঠ যখন টিকে থাকার জন্য হাঁসফাঁস করছে, যখন মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে এবং সরকারের রোষানলের কারণে নামীদামী সাংবাদিকরা অন্য কাগজে চলে যাচ্ছেন, যখন নিয়মিত লেখকদের সম্মানী দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে তখনও জনকণ্ঠ ছেড়ে চলে যাইনি। আমার বন্ধু মুনতাসীর মামুন, কলাম লিখিয়ে হিসেবে খ্যাতি, তাঁর গবেষক-ঐতিহাসিকের খ্যাতিকে ম্লান করে দিয়েছে, সেটাও জনকণ্ঠেরই কারণে। মাঝখানে মামুন অভিমান করে দু’বছর জনকণ্ঠে লেখেননি। পাঠকদের চাপের কারণে আবার ওঁকে জনকণ্ঠে ফিরে আসতে হয়েছে। ২০০২ সালে আমার সঙ্গে মুনতাসীর মামুনকে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে ময়মনসিংহের সিনেমা হলের বোমা হামলার কথা বলেছিল খালেদা-নিজামীদের সরকার- পাগলেও তা বিশ্বাস করেনি। মামুনকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল জনকণ্ঠে লেখার কারণে।
জনকণ্ঠে যেদিন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর মুনতাসীর মামুনের লেখা ছাপা হয় অন্য সব খবর পড়ার আগে তাদের লেখা পড়ি। গাফ্ফার ভাইকে বলা হয় না বটে, মামুনকে ফোন করে বলি কোন বিষয়টি আমার ভাল লেগেছে। ভুল কিছু থাকলে শুধরেও দিই। গতকাল ও আজ মামুন পর পর দুটো লেখা লিখেছেন জনকণ্ঠে। গতকাল ১৯ অক্টোবর মামুনের লেখার শিরোনাম ছিল ‘এ দেশে কি সত্যিকারের বাঙালীরা বাস করে না’? বিষয় ছিল ইটালিতে এরিক প্রাইবেক নামের এক নাৎসি যুদ্ধাপরাধী মারা গেছে, কোথাও তার কবর হচ্ছে না। ইটালির মানুষ তাকে তাদের দেশে কবর দিতে দেবে না। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল আর্জেন্টিনা থেকে, সেখানেও তার কবর হবে না- সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে দেশের সরকার। যুদ্ধাপরাধীর লাশ পড়ে আছে মর্গে, কেউ বলছে তাকে পুড়িয়ে ছাই করে এমন জায়গায় ফেলা হোক কেউ যাতে জানতে না পারে। কারণ কোথাও তার কবর হলে নব্য নাৎসিরা সেখানে মিলিত হয়ে ফুল দেয়ার সুযোগ পাবে। এরপর মামুন প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশে যে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে, তাদের অনেকের ফাঁসিও হবে, তাদের কবর কোথায় হবে? তার লেখায় গোলাম আযমদের মানবতাবিরোধী অপরাধের নৃশংসতার কিছু উল্লেখ করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের প্রতি যথারীতি বিদ্রুপাত্মক কিছু মন্তব্যও করেছেন। মামুন লিখেছেন‘গোলাম আযমদেরও মৃত্যু হবে। তখন কি হবে? যেহেতু যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষের সরকার, সেহেতু তাদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। জেনারেল জিয়া/এরশাদ/খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলে এ প্রশ্ন উঠত না। তারা পারলে এদের কবরে স্মৃতিসৌধ তৈরি করতে কসুর করবেন না।
আমেরিকা এ সব বিবেচনা করে বিন লাদেনের মৃতদেহ পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। বিন লাদেন এখন বিস্মৃত। কিন্তু, তার মরদেহ পাকিস্তানে থাকলে এখন আজমীরের মতো মাজার শরিফ বানিয়ে ফেলা হতো। আমাদের রাজাকার ও রাজাকারপন্থী পার্টিগুলো কিন্তু এখন থেকেই প্ল্যান ছকে রেখেছে, নবীনগরে গোলাম আযমের মাজার হবে, পিরোজপুরে সাঈদীর আর সাঁথিয়ায় নিজামীর। রাউজানে সাকার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ হবে। যাতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে যুদ্ধাপরাধ কোন বিষয় বলে পরিগণিত না হয়। এবং এক দশক পর হজরত শাহ গোলাম আযম পাকিস্তানীর নামে উরস হবে। যেভাবে জিয়াউর রহমানের কবর মাজারে পরিণত করা হয়েছে। এবং এখন খবরের কাগজ ও টিভি প্রতিবেদনে একে মাজার বলেও উল্লেখ করা হয়, যদিও তা শরিয়তবিরোধী। এগুলো হতে পারে, বাংলাদেশী তো। গোলাম আযমের প্রকাশ্য সমর্থনকারী যদি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তাহলে সাকার স্মৃতিস্তম্ভ হতে দোষ কি! আর যাই হোক আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত মওলানাদের আর যাই থাকুক ভ্যাটিকানের মওলানাদের মতো সাহস আর ধর্মবোধ নেই। তারা যে এরিকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অস্বীকৃতি জানিয়েছে তার কারণ নৈতিকতা, ধর্মবোধ ও মানবতা এবং সভ্যতা বোধ। একটা উপায় হতে পারে, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আলাদা ছোট গোরস্তান।’
মামুনের লেখা পড়ে বিশিষ্ট আলেম, সম্মিলিত ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসানকে ফোন করেছিলাম। তিনি জানালেন, ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বরে এ নিয়ে তিনি মুক্তাঙ্গনে গণসমাবেশ করেছেন এবং পবিত্র কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও গণহত্যাকারীরা আল্লাহ ও রসুলের দুষমন। তাদের জানাজাও পড়া যাবে না, কোন গোরস্তানে কবরও দেয়া যাবে না। মামুনের সঙ্গে তিনি একমতÑ ওদের জন্য নির্দিষ্ট গোরস্তান থাকতে হবে। তাঁর মতে খুলনার ডাকাতিয়া বিল রাজাকারদের গোরস্তানের উপযুক্ত স্থান। মওলানা জিয়াউল হাসান আরও জানালেন, মহানবীর (সা) এক দুষমন, গণহত্যাকারী আবু জেহেলের কবরকে গণশৌচাগারে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

১৯৯৭-এর ৪ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ যুদ্ধাপরাধী এসএ সোলায়মানের লাশ মিরপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের গোরস্তানে দাফন করতে দেয়নি। সোলায়মান যদিও এখানে আগে থেকে জমি কিনে রেখেছিলেন তারপরও নির্মূল কমিটির ২৪ ঘণ্টা অবরোধ অবস্থানের কারণে যুদ্ধাপরাধী সোলায়মানকে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করতে হয়েছে। নির্মূল কমিটির সেই অবরোধ কর্মসূচীতে বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ হাসান ইমাম, গণআদালতের অন্যতম বিচারক ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরীসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিলেন।

জনকণ্ঠে ২০ অক্টোবর মুনতাসীর মামুনের লেখার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানী জারজদের রাজনীতিও মানতে হবে?’ এ লেখার শুরুতে মামুন চিলির আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অতীতে পিনোচেটের সরকারের নির্যাতনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, গণস্মৃতি বলি কিংবা ‘কালেকটিভ মেমরি’ বলি একে সব সময় জাগ্রত রাখতে হয়, নাহলে মানুষ অতীত ভুলে যায়। মামুন খালেদা জিয়ার রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী-জামায়াতপ্রেমের উল্লেখ করেছেন। খালেদা জিয়ার জামায়াত ও রাজাকার প্রেমের বোধগম্য কারণ আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর পুত্র হায়দার ফারুক জানিয়েছেন, যেহেতু জামায়াত ও খালেদার অর্থের উৎস ও গডফাদার অভিন্ন সেহেতু খালেদার পক্ষে কখনও জামায়াত বা জামায়াতের দোসরদের সঙ্গ পরিহার করা সম্ভব নয়।

বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে যে ১৯৭১ বা ২০০১-এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এ বিষয়ে মুনতাসীর মামুন তাঁর কলামে লিখেছেন, আমরা যারা ভুক্তভোগী ভাবতে গেলেও আতঙ্কবোধ করি। ২০০৬ সালে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জমানায় প্রথম ১৫০০ দিনের সংখ্যালঘু নির্যাতনের শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিলাম। প্রায় তিন হাজার পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রে ধারাবাহিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিলÑ এসব নজিরবিহীন নৃশংস নির্যাতনের ঘটনার অস্বীকৃতি। প্রথম থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী এসব নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার করে বলেছেন, ‘পত্রিকায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন সম্পর্কে অতিরঞ্জিত সংবাদ ছাপা হচ্ছে।
পত্রিকায় যা ছাপা হয়েছে তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অসত্য ও ভিত্তিহীন, কারণ পত্রিকার সংবাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের পাঠানো রিপোর্টের কোন মিল নেই।’ (জনকণ্ঠ, ১৮ অক্টোবর ২০০১)
খালেদা-নিজামীদের জোট সরকারের নীতি ও লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে ‘হিন্দুশূন্য’ এবং ‘আওয়ামী লীগশূন্য’ করা। জেলা প্রশাসকদের কি ক্ষমতা ছিল জোট সরকারের এই নীতি ও লক্ষ্যের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবেদন প্রদানের? আমরা প্রথম থেকেই বলেছিলাম সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। খালেদা-নিজামীদের জোট সরকার কিভাবে সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়েছে, প্ররোচিত করেছে, আশ্রয় দিয়েছে এর বহু বিবরণ নির্মূল কমিটির শ্বেতপত্রে রয়েছে।
তখনকার বহুল আলোচিত ঘটনা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা শীলকে গণধর্ষণের প্রতিবেদন যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় তখন স্থানীয় প্রশাসন সাংবাদিকদের ওপর খড়গহস্ত হয়েছিল। ঘটনা ঘটেছিল ২০০১-এর ৮ অক্টোবর, পত্রিকায় এসেছে ১৬ অক্টোবরে। স্থানীয় সাংবাদিকদের অনুরোধে নির্মূল কমিটির প্রতিনিধি দল ১৯ অক্টোবর উল্লাপাড়া গিয়ে পূর্ণিমা ও তার পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দী রেকর্ড করেন। ২০ অক্টোবর পূর্ণিমাকে ঢাকায় এনে সংবাদ সম্মেলনে এই নৃশংস নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরা হয়। পূর্ণিমার মা বাসনা রাণী যখন কান্নাভরা গলায় নির্যাতনের বিবরণ দিচ্ছিলেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকেই সেদিন অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, এটি সম্পূর্ণ সাজানো ঘটনা। পরে আদালতে প্রমাণ হয়েছে এটি কোন সাজানো ঘটনা ছিল না। পূর্ণিমার ধর্ষণকারীরা সাজা পেয়েছে।নির্মূল কমিটির শ্বেতপত্রে খালেদা নিজামীদের সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রথম ১৫০০ দিনে ২৭৮৬টি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ২০০১-এর এই অক্টোবর মাসে আমাদের শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৩৬০টি ঘটনা ঘটেছিল। বর্তমান সরকারের আমলে গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদনে এর দ্বিগুণের বেশি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এসব নির্যাতনের জন্য দায়ী খালেদা জিয়ার সরকারকে কখনও কোথাও জবাবদিহি করতে হয়নি। যারা এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রধান কুশিলব তাদের বিচার হয়নি। হয়নি বলেই সংখ্যালঘু নির্যাতন বাংলাদেশে এখনও বন্ধ হয়নি।
২০ অক্টোবর জনকণ্ঠে মুনতাসীর মামুনের কলাম শেষ করে প্রথম পাতায় দেখি দারুণ চমকপ্রদ এক সংবাদ, যার শিরোনাম ‘সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত এলে প্রতিহত করব ॥ খালেদা জিয়া’।
আগের দিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি গ্রুপের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় ২০০১-২০০৬ সালের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এই অভাবনীয় উক্তি পড়ে অনেক বাংলা প্রবাদ এবং প্রবাদসম বাক্য মনে পড়লÑ যার ভেতর বহুল প্রচলিতটি হচ্ছে ‘ভূতের মুখে রামনাম’! আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য থেকে ‘একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে!’
যে খালেদা জিয়ার জমানায় পিতা ও স্বামীকে বেঁধে রেখে তার চোখের সামনে মা ও মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে যার জমানায় এক অসহায় হিন্দু মা আগত ধর্ষকদের জোড়হাতে মিনতি করছেনÑ ‘বাবারা তোমরা একজন একজন করে আসো, আমার মেয়েটা খুব ছোট’, সেই খালেদা জিয়া বলছেন, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত এলে প্রতিহত করব!’ প্রাচীন বাংলা নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তিটি নিশ্চয় পাঠকদের মনে আছেÑ ‘কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!’
আজ ২০ অক্টোবর। বারো বছর আগে এই দিন সকালে সিরাজগঞ্জ থেকে বিএনপির সন্ত্রাসীদের হাতে ধর্ষিতা পূর্ণিমা সপরিবারে এসে উঠেছিল আমার বাড়িতে। বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে পূর্ণিমার মা তাদের গোটা পরিবারের উপর নির্যাতনের বিবরণ দেবেন। সন্ত্রাসীরা পূর্ণিমার উপর পাশবিক নির্যাতন করে ক্ষান্ত হয়নি, বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। পূর্ণিমা এবং তার মার পরনে শতচ্ছিন্ন কাপড়। পূর্ণিমার বয়সী আমার কিশোরী কন্যা মুমু আর স্ত্রী ডানাকে বললাম ওদের পরার মতো কিছু কাপড় দিতে। একটু পরে মুমু আমার কাছে এসে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল, বাবা, তুমি দেখেছ পূর্ণিমাকে ওরা কী করেছে? আমি জানি না কী করেছে। পূর্ণিমার তখন কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। আমার মেয়ে পূর্ণিমাকে জামা পরাতে গিয়ে দেখেছে ওর সারা শরীরে খালেদা জিয়ার হিংস্র্র হায়েনাদের কামড়ের দাগ, গায়ের মাংস খুবলে নিয়েছে। মুমুর কান্না শুনে মনে হয়েছিল ওর ওপর যদি এমন অত্যাচার হতো আমি কী করতাম। পূর্ণিমাকে ডেকে বলেছি, এখন থেকে মুমুর মতো তুমিও আমার মেয়ে।

আমার পিতৃদায় মোচন করেছে নির্মূল কমিটির সহযোদ্ধারা। শেখ হাসিনা পূর্ণিমার পরিবারকে জমি দিয়েছেন, অর্থ সাহায্য করেছেন। খালেদা-নিজামীদের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত, নিহত, সম্পদহারা বহু পরিবারকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও সাহায্য করেছেন। এসব সাহায্যের কথা কখনও তিনি গণমাধ্যমকে জানাননি।

আজ খবরের কাগজে যখন দেখি হাজার হাজার হিন্দুনারী ধর্ষকদের গডমাদার খালেদা জিয়া বলছেন, ‘সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত এলে প্রতিহত করব’, তখন তাকে সবিনয়ে বলতে চাই তিনি ও তাঁর মন্ত্রীরা তখন যদি এসব ঘটনাকে ‘অতিরঞ্জিত’ ও ‘বানোয়াট’ সংবাদ না বলতেন, যদি প্রতিহত করার উদ্যোগ নিতেন, তাহলে পূর্ণিমাদের মতো হাজার হাজার মেয়ে হামলা ও নির্যাতন থেকে বেঁচে যেত, তিন লক্ষাধিক হিন্দুকে দেশ ছাড়তে হতো না। হিন্দুদের সমর্থন পেতে হলে খালেদা জিয়াকে সবার আগে পূর্ণিমাদের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।
জনকণ্ঠের খালেদা জিয়ার খবরে দেখলাম, তাঁকে বরণ করার সময় আগত হিন্দু নারীরা উলুধ্বনি দিয়েছেন। ধারণা করতে পারি এই উলুধ্বনি নিশ্চয় খালেদা জিয়ার কানে গলানো সিসা ঢেলে দিয়েছিল। কারণ ’৯১ সাল থেকে শুনছি নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদা জিয়ার একটি প্রিয় বাক্য হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে মসজিদে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে। মনে হয়, শুভেচ্ছা বিনিময়ে আগত হিন্দু নারীরা এভাবেই উলুধ্বনি দিয়ে খালেদা জিয়ার হিন্দুবিদ্বেষের জবাব দিয়েছেন।

জামায়াত ও আইএসআইপ্রেমী খালেদা জিয়া যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন তখন প্রমথনাথ বিশীর সরস গল্পের সেই বাক্যটি মনে পড়ে ‘বাঘে যখন ঘাস খায়, ডাক্তার যখন ভগবানের নাম নেয়, তখন বুঝতে হবে সর্বনাশের আর বাকি নেই।’ হিন্দু সম্প্রদায়ের যে নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েছিলেন তাঁদের দায় আমরা বুঝি। কদিন আগে কাগজে দেখেছি ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের একটি দল নরেন্দ্র মোদীর জন্য ভোট চাইছেন। ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্ভবত এমন পরিস্থিতির কথা ভেবেই লিখেছিলেন, ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।

২০ অক্টোবর ২০১৩।

ওদের অপপ্রচার, আমাদের জবাব! - ডা : মুহাম্মদ আলী মানিক



বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের নিকট রাজনীতি আর জনপ্রিয়তায় ধরাশায়ী হয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই একটি স্বার্থান্বেষী মহল বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে ৷ মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদের সাথে এই মিথ্যাচারে হাত মেলায় চীন সমর্থক বাম পন্থীরা। পরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজাদারি জাসদও এতে সামিল হয়! টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত মাওলানা ভাসানীর "হক কথা" এই অপপ্রচারে মুখ্য ভুমিকা পালন করেছিল সেই সময়, তার পরেই ছিল জাসদের "গণকণ্ঠ" আর ইংরেজি "হলিডে" পত্রিকা ৷ এখানে উল্লেখযোগ্য যে হক কথা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ইরফানুল বারি নামে টাঙ্গাইলের কুখ্যাত এক রাজাকার! স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে সেই লাগামহীন অপপ্রচার সাধারণ মানুষদের কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করেছিল! স্বাধীনতার এত বছর পরও সেই মহলটি একই স্টাইলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দল বদল হয়ে সেই মহলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি-জামাত চক্র! মিথ্যাচারে যদি কোনো "নোবেল পুরস্কার" থাকতো , তাহলে বিএনপি-জামাত চক্র নিঃসন্দেহে তা পেয়ে যেত ! নিচে সেই কুখ্যাত লাগামহীন অপপ্রচারের কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো:

এক . রক্ষিবাহিনী নাকি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা গঠিত ছিল, যা ‘হক কথা’ই বেশি প্রচার করেছিল৷ `৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর একজন ভারতীয়কেও খুঁজে পাওয়া যায়নি রক্ষিবাহিনিতে! উল্টো সেই দিন পুরো বাহিনিকেই বাংলাদেশ আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো৷ যদি রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা নৈতিকতার দিক থেকে এতই খারাপ হত, তা হলেতো বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মত প্রতিষ্ঠানে তাদের অন্তর্ভূক্ত করা হতোনা!

দুই. রক্ষীবাহিনীর হাতে নাকি ত্রিশ হাজার জাসদ কর্মী নিহত হয়েছিলো! কিন্তু `৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর একটি পরিবারও নিহতদের তালিকা চেয়ে এগিয়ে আসেনি বা বিচার চায়নি! (অনেকটা শাপলা চত্তরের মত মিথ্যাপ্রচার) !

তিন. বিএনপি আর তার মিত্ররা দাবি করে জিয়া নাকি `৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর বহু দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে! ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু ১৮টি রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে গঠন করেছিলেন যুগোপযোগী "বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ", তাই `৭৫ পট পরিবর্তনের পর সেই ১৮টি দলের কর্মকাণ্ডের মাথ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত থাকার কথা ৷ অথচ সামরিক শাসক জিয়া `৭৫ এর নভেম্বরে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ চার বছর পর দেশে তথাকথিত বহু দলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করে ! এই চার বছর জিয়া ভয় , ক্ষমতা আর টাকার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন দল ভেঙ্গে , "দল ছুটদের " নিয়ে সামরিক ছাওনিতে গঠন করে "বিএনপি" ! আর দলের প্রতিকটিও হাইজ্যাক করা হয় ভাসানী ন্যাপ থেকে ! ক্যান্টনমেনটে বন্দুকের নলে দল গঠন করে জিয়া তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের লেবাসে আসলে "এক দলীয় স্বৈরশাসন" প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মগ্ন ছিলেন ৷ তার অকাল জীবনাবসান না হলে মিসর-লিবিয়া-সিরিয়ার মত বাংলাদেশকেও এক দলীয় স্বৈরশাসকের যাতাকলে নিস্পেষিত হতে হতো! তাই বিএনপি ও তার মিত্রদের বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গলাবাজি একটা মিথ্যা প্রচারণা ছাড়া আর কিছু নয় !

চার. বিএনপির নেতৃত্বাধীন স্বাধিনতাবিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে অপপ্রচার করে আসছিলো যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশ নাকি ভারতের করদ রাজ্যে পরিনত হয়ে যাবে আর দেশে নাকি ইসলাম ধর্ম থাকবে না , মসজিদে নাকি আযানের পরিবর্তে উলুধ্বনি হবে! এত সব অপপ্রচারের পরও আওয়ামী লীগ দুই দুইবার ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু তার কিছুই হয়নি ! উল্টো বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই ভারতের তাবেদারি করেছে , এমনকি খালেদা জিয়া ভারত সফরের সময় পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে আলোচনা করতে নাকি ভুলে গিয়েছিলেন! আসলে বিএনপি "ক্ষমতায় থাকলে ভারত তোষণ আর বিরোধী দলে থাকলে ভারত দোষন" এ বিশ্বাসী !

পাচ. ফারাক্কা বাঁধ নিয়েও কম অপপ্রচার হয়নি! আওয়ামী বিরোধীরা এতদিন বলে এসেছে যে ফারাক্কার জন্য নাকি বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাবে! কিন্তু আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুভূমির বদলে সবুজ বিপ্লব ঘটে গেছে! ফারাক্কা বাঁধের ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে আবাদী জমির সীমানা বেড়ে গেছে, প্রলয়ংকরী বন্যা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, বাম্পার ফলন হয়েছে আর মঙ্গাও দূর হয়ে গেছে!

ছয়. দুর্নীতি নিয়েও কম অপপ্রচার হচ্ছে না! খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব হিসাবে মোসাদ্দেক আলী ফালু আর হারিস চৌধুরী যে ভাবে "আঙ্গুল ভুলে কলা গাছ" হয়েছেন, শেখ হাসিনার কোনো একান্ত সচিবের বেলায় তার কিছুই হয়নি ৷ তা ছাড়া বাংলাদেশের ধনী লোকদের তালিকা করলে দেখা যাবে যে তাদের ৭০% বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত, যাদের বেশির ভাগ দুর্নীতি করে ধনী হয়েছে ! দুর্নীতিতে বিএনপি পর পর তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর আওয়ামী লীগ সেই কালিমা থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দিয়ে দেশকে ৪০ নম্বরে নিয়ে এসেছিলো !
সাত. বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নাকি বস্তাভর্তি টাকার বিনিময়ে, ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় এসেছে! বিএনপি-জামাত গত নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই এই মিথ্যাচার করে আসছে৷ মইন -ফখরুদ্দিন গং যদি বিএনপিকে ইচ্ছে করেই হারাতো, তা হলেতো খালেদা জিয়া পাচ পাঁচটি আসনে জিততে পারতেননা! জে : মইন এর ভাই সহ তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুভাকাংখী ফেরদৌস কোরেশী, মান্নান ভুইয়া, বদরুদ্দোজারা সহজেই জিতে যেতেন যদি সত্যি কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকতো! নির্বাচনে "গো হারা" হয়ে "নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা" র মতই যুক্তি দেখাচ্ছে বিএনপি !

আরো অনেক কিছু নিয়েই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত মিথ্যাচার করে আসছে, সরকার বিরোধী আন্দোলনে কোনো ইস্যু না পেয়ে গলাবাজি আর অপপ্রচারই তাদের একমাত্র অস্ত্র এখন! কিন্তু আগামী দিনের নেতা ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রপথিক সজীব ওয়াজেদ জয়ের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে বিরোধীদলের লাগামহীন অপপ্রচারে ভাটা পরেছে! বিলবোর্ড , সামাজিক মিডিয়া আর টিভি টক-শোতে বর্তমান সরকারের অভূতপূর্ব সফলতার সচিত্র প্রতিবেদনে বিএনপি-জামাত এখন দিশেহারা !

সহ-সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ

তুই যে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলি-মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমান


সূর্যের সমস্ত আলো:
ভজন পূজন সাধন আরাধনা/সমস্ত থাক পড়ে।/রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে/কেন আছিস ওরে।/অন্ধকারে লুকিয়ে আপন-মনে/ কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,/নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে-/দেবতা নাই ঘরে।/তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে/করছে চাষা চাষ-পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,/খাটছে বার মাস। আমি নিশ্চিত পূজন রবি ঠাকুরের এই কবিতা পড়েছিল। না হয় এতোটা কর্মবীর হওয়ার কথা নয় । ভালোবাসত ও কাজ করতে ।সৃষ্টিশীল সব চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করতো।
আমি যখন চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করছিলাম তখন ও সবে কোর্টে যাওয়া –আসা শুরু করেছে। হুটহাট ছুটে আসতো আমার কাছে। বলতো –“স্যার , বাবা নাই তো তাই অস্থির লাগলে আপনার কাছে ছুটে আসি”।
ওর বাবা একজন প্রয়াত আইনজীবী। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। খুব সুনাম ছিল উনার। নিজেও একই পেশাতে এসেছে বলে বাবার পরিচয়টা দিতে ও সংকোচ করত। অসম্মান করে নয়। ওর আত্মমর্যাদাবোধের কারণে।
নিজের পরিচয়েই ও বড় হতে চাইতো। আমার চেম্বারে আসলে না বলা পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকতো। বসার পরও চোখ তুলে তাকাত না । মাথা নীচু করে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে থাকতো। ওর মা’র কুশল জিগ্যেস করলেই খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। ঐ সময় সূর্যের সমস্ত আলো ওর চেহারায় দেখতে পেতাম। মা আর মানব-কল্যাণ ছাড়া অন্য কোন বিষয় ও আমার সাথে কমই শেয়ার করত।
ভালোলাগার আবেশ:
মানুষ ভালোবাসত । তাই অনেক পরিচিত জনের স্বার্থপরতা ও ও অকৃতজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করলে ও তা মনের মধ্যে গেঁথে রাখতো না। কিংবা আমাদের অনেকের মত সেটাতে পড়ে থাকতো না বুঁদ হয়ে। বরং যাঁরা ভালোবাসা দেখাতো কিংবা স্নেহ করতো তাঁদের কথা আমাকে বলতো প্রাণ খুলে ।
বলতো, “স্যার , আমিও মানুষকে নিয়ে আপনার মত আশাবাদী। এই যে স্যার, শংকর আংকেল আছেন না , উনি আমার বাবার জুনিয়র ছিলেন । আমার বাবার আদরের কথা উনার মনে আছে। প্রত্যেক সেমিস্টারের শুরুতে উনি নিজেই ফোন করেন, ‘বাবা ,তুমি সেমিস্টার ফি দিয়েছ?’ নিজের সন্তানের মত খোজ খবর রাখেন”।
সিনিয়রের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। ভাবি-“গাম্ভীর্যের শক্ত খোলসের মধ্যে কত মহত্ব-ঔদার্য যে লুকিয়ে থাকে!”
নিজেকে খুব হীন-নীচ মনে হয়। হঠাৎ করে বলতো, “স্যার , আপনার অনেক মুল্যবান সময় নিয়ে নিলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে প্রণাম করতো পরম ভক্তি নিয়ে । ও চলে যেত ।আমি তাকিয়ে থাকতাম । ওর বিনয়-ভরা অথচ আত্মবিশ্বাসী হেঁটে যাওয়া বড়ই ভালো লাগতো ।
সূর্য ডুবে গেলে পশ্চিম আকাশে লাল আভা বিরাজ করে অনেকক্ষণ। পূজনের প্রতিটি প্রস্থানের পরও সেরূপ ভালোলাগার আবেশ হৃদয়ে লেগে থাকতো। কোন কোন ছাত্রের বেলায় সেরূপ হয় । সব ছাত্র-ছাত্রী সমান। তারপরও কারো কারো বিশেষ স্বকীয়তা আমার মত নগণ্য মানুষের সূক্ষ্মতম অনুভুতির গভীরে চলে যায় । মানুষ হিসেবে এটা আমার দুর্বলতা। এটা আমার ত্রুটি ।

লজ্জায় ভিসি স্যারের সাথে দেখা করিনি:
একবার এমন হল যে , অনেক দিন পুজনের সাথে দেখা নেই। হঠাৎ করে দেখা হল। কোন অনুষ্ঠানে । নাকি প্রিমিয়ার ল স্কুলে! ঠিক মনে করতে পারছি না । আমি জিগ্যেস করলে জানায়, “স্যার ,সিনিয়রের সাথে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে।” আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ও বলল, “ আমার সিনিয়র তো অ্যাডভোকেট হেনা স্যার।”এটা আমার জানা ছিল না । ও বলে চলে, “ উনার পেশাদারিত্ব অসাধারণ। অনেক জানেন। উনার কাছ থেকে প্রচুর শিখছি”।

কোথাও একবার দেখা হলে ও আমাকে বলল, “ স্যার ,আমার দুর্ভাগ্য যে আমি মাস্টার্সে আপনার ক্লাস করতে পারছি না”।
জানতে চাইলাম, “ কেন কেন?” বলল, “ স্যার , আপনাকে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না ।সংকোচ লাগছে”।
পরে আমার পীড়াপীড়িতে বলল, “ আমি প্রিমিয়ারে মাস্টার্স করছি না। অন্য ভার্সিটিতে করব। ওখানে টিউশান ফি কিছুটা ছাড় পাচ্ছি।”
আমি জিগ্যেস করলাম, “ ওখানে কি ভর্তি কমপ্লিট?” ও বলল, “ না । স্যার”।
বললাম, “আমি ভিসি স্যারের সাথে কথা বলবো। আমি বলার আগে অন্য কোথাও ভর্তি হওয়া যাবে না ”।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ড. অনুপম সেন স্যারের সাথে ওর ব্যাপারে কথা বললাম।
স্যার বললেন, “ না- না এটা হতে পারে না । টাকার অভাবে আমাদের ছাত্র অন্য কোথাও চলে যাবে –তা মেনে নেয়া যায় না । ওর জন্য আমি টিউশান ফি ছাড়ের ব্যবস্থা করবো। তুমি ওকে আমার সাথে দেখা করতে বল”।
স্যারের সিদ্ধান্ত ওকে জানানোর জন্যে ফোন করলাম।ফোন বন্ধ। পাওয়া গেল না ।
ওদের ব্যাচের কোন একজনের মাধ্যমে আমি মেসেজও পাঠালাম। কিন্তু কোন রেসপন্স নেই। বেশ কয়েক দিন ধরে কোন খবর নেই ওর । শেষে একদিন দেখা হল। হালকা করে বকা দিলাম । মাথা নীচু করে মিটিমিটি হেসে জবাব দিল,“স্যার , আমি আপনার মেসেজটা পেয়েছিলাম। লজ্জায় ভিসি স্যারের সাথে দেখা করিনি”।
বললাম, “ বাবার মত এই মানুষটার কাছে লজ্জা পাওয়ার কী আছে?” ও নিরুত্তর।
পূজনের পূজন:
আমি বদলি হয়ে নোয়াখালী চলে গেলাম। ওখান থেকে খাগড়াছড়ি। অনেকদিন পূজনের সাথে দেখা নেই । কথা নেই । এক সন্ধ্যায় ওর ফোন পেলাম। ঐ সময় কোন এক কাজে আমি প্রিমিয়ার ল স্কুলে ছিলাম। ল ক্যাম্পাস তখনো প্রবর্তক মোড়ে। পূজনের উচ্ছ্বাসিত গলা চিনতে অসুবিধা হল না । ও জানাল , “ স্যার , বি.এস. আর. এম – এ আমার একটি চাকরি হয়েছে। আপনাকে না জানিয়ে রেফারী হিসেবে আপনার নাম দিয়েছি। ওঁরা কিছুক্ষণ পর আপনার কাছে ফোন করবেন”।
ও অনুভব করেছিল – আমাকে না জানিয়ে রেফারী হিসেবে আমার নাম উল্লেখ করার অধিকার আমি তাকে দিয়েছি।
ওর সাথে কথা বলার পর বি. এস. আর. এম অফিস থেকে এক ভদ্রলোক ফোন করলেন। তাঁকে যা জানালাম তার মর্ম হল - পূজন আমার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ,ওকে পেলে আপনাদের জন্য ভালো হবে। কথা শেষ করে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। মুনাজাতের পর কম্পিউটারে বসে কাজ করছিলাম। কারো উপস্থিতি আমার মনোযোগ কেড়ে নিল। দেখলাম- পূজন পা ছুঁয়ে কদমবুচি করার জন্য হাত এগিয়ে দিয়েছে । আমি হাত ধরে পেললাম । ও খুব আবেগী গলায় বলল- “স্যার , আজকের মত করতে দেন। না হয় আমি মনে কষ্ট পাব”।
এই হল পূজনের পূজন ।

গত রমযানের কোন একদিন । নগরীর একটি হোটেলে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের ইফতার পার্টি। ওরা দাওয়াত করেছে। আমি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি, ঠিক সেই সময় পূজনের ফোন। ও বলল, “ স্যার ,আপনি আসবেন শুনে আমিও ইফতার পার্টিতে চলে এসেছি। অনেকদিন পর আপনার সাথে দেখা হবে”।
ওর কথা শুনে ইফতার মাহফিলে যাওয়ার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। হোটেলের সামনে গিয়ে দেখলাম –পূজন আমাকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের প্রিয় ছাত্র পূজন আর নেই:
আমার মোবাইল নষ্ট । সেটা জানিয়ে পরশু ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছি । গতকাল ভোরে গ্রামে যাওয়ার আগে সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিয়েছি ফেসবুকে। ঈদের নামাজ পড়ে কোরবানি সেরে মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের কবর জেয়ারত করে শহরের দিকে রওনা দিলাম।
রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। বিশেষ করে চাতরী চৌমুহনীতে। যানজটের তেমন উল্লেখযোগ্য কারণ চোখে পড়ল না। যানজট ছাড়ানোর জন্য স্থানীয় কিছুলোক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু মনে হল উনারা নিজেরাই যানজটের অন্যতম একটি কারণ। বিকেল পাঁচটায় রওনা দিয়ে শহরে পৌঁছতে প্রায় নয়টা বেজে গেল।
সেন স্যার আর ইফতেখার স্যারকে মিস করছিলাম। সেন স্যারকে ফোন করে পেলাম। স্যারকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালাম দেরীতে হলেও। স্যারের সাথে কুশল বিনিময়ের পর স্যার স্নেহভরে বললেন, “ তুমি খুব ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়”।
স্যারের সাথে কথা শেষ করে ইফতেখার স্যারকে ট্রাই করলাম। কোন ভাবে ঢুকতে পারলাম না স্যারের ফোনে। আব্বা আর জাকিয়ার সাথে টুকটাক কথা বলে ঘুমাতে গেলাম।
ফজর আযানের সময় ঘুম ভাঙ্গল। নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।জাকিয়ার কণ্ঠ কানে এল-“এই তুমি চাচাকে সকালে নাস্তার দাওয়াত দিয়েছ। উনি এসেছেন। আর তুমি ঘুমিয়ে রয়েছ”।
মনে পড়লো –চাচা শ্বশুর মাস্টার মেরিনার আজিজ সাহেবকে কাল রাতে দাওয়াত দিয়েছিলাম। সাগরে উনার বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এজন্য আমরা উনাকে সিন্দাবাদ চাচা ডাকি।
চটজলদি বিছানা ছাড়লাম।মুখ-হাত ধুয়ে নাস্তার টেবিলে বসলাম।দুঃস্বপ্নের কারণে মনটা খচখচ করছে।নাস্তা ভালো লাগছিল না।চাচা-শ্বশুর থাকায় ভদ্রতার খাতিরে কোন রকমে উনার সাথে সময় পার করছিলাম । নাস্তা করা শেষ হলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ল্যাপটপ ওপেন করলাম।
ফেসবুকে ঢুকলাম। প্রথম নটিফিকেশনটায় ক্লিক করলাম। এটা ল স্কুলের শিক্ষক প্রিয় ছোটভাই রাজীবের পোস্ট। ওখানে লেখা আছে- “আমাদের প্রিয় ছাত্র পূজন আর নেই”।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল । আমার দু’চোখে অশ্রু অঝোর ধারায় বইতে থাকল। জাকিয়া বলল- কি হল? আব্বা বললেন, “ ও ফুত কি অইয়ে?” আমি অনেকক্ষণ ওদের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়েছিলাম। আব্বা আর জাকিয়া কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়লেন। অনিচ্ছা সত্বেও দুঃসংবাদটা বললাম । উভয়ের হৃদয় থেকে হাহাকার ঝরে পড়লো। ওর বাবার নাম বলায় আব্বা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। উনি নাকি চিনতেন ওর বাবাকে। জাকিয়ার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে । ও উঠে অন্য রুমে চলে গেল।
শোয়েবদের তীব্র যন্ত্রনা ও ট্র্যাজিক হিরো সঞ্জয় গান্ধী
আমি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে চ্যাট অপশনে চোখ রাখলাম। আরেক প্রিয় ছাত্র শোয়েবকে দেখলাম অনলাইনে আছে। টেক্সট পাঠানোর সাথে সাথে রিপ্লাই পেলাম। ও নাকি পূজনদের গ্রামে । এক পর্যায়ে শোয়েব লিখল, “তীব্র যন্ত্রনা”।
আব্বার মোবাইল নাম্বারটা ওকে দিলাম। শোয়েব ফোন করলে জানতে পারলাম- দাহ-অনুষ্ঠান প্রস্তুত। শোয়েবকে প্রশ্ন করলাম –“এতো তাড়াতাড়ি?” শোয়েব বলল, “ স্যার , ওর শরীর খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। লাংসে পানি ঢুকে গিয়েছিল”।
তাই শেষবার দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করলাম।
পূজনের ওয়ালে চোখ বুলাতে থাকলাম। সবকিছু আগের মতোই আছে। প্রোফাইল ছবিতে ছোটবেলার পূজন হাসছে। অসাধারণ নিষ্পাপ হাসি। কাভারের ছবিতে কনভোকেশনের পোশাকে দুই হাত মেলে দাঁড়ানো আমাদের পূজন।যেন স্রষ্টার কাছে বিশাল মুনাজাত-“হে প্রভু! আমি অনেক ভালো কাজ করতে চাই”।
ওর ওয়ালে চোখ রাখলেই শুনা যাবে দুঃখমাখা অশ্রুপতনের বিকট বিকট শব্দ। বিভিন্ন গ্রুপ ও ফ্রেন্ডের ওয়াল ভিজে যাচ্ছে অশ্রুর বন্যায়।এই বন্যার প্রবাহমান পানি রক্তের চেয়েও লাল। ঘুরে ফিরে পূজনের ওয়ালেই চলে আসি বার বার। সারাটা দিন এভাবেই কাটল। আবারও চোখ বুলাই । ওর ছবিগুলি বারংবার দেখছি । সারা দিন কতবার যে দেখেছি। দেখা শেষ হয় না । কত ভঙ্গীতে কত রকম পোশাকে ছবি তুলেছে ও। কোন কোন ছবি দেখে আজ কিছুটা অস্বস্থিবোধ করেছি, যে ছবিগুলো দেখে আমি আগে আনন্দ পেতাম। আমাদের সদা-পরিপাটি ছাত্রটির সপ্রতিভ স্টাইল আমার কাছে বড়ই মনোমুগ্ধকর ছিল। কোন কোন ছবি দেখে মনে হত –ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছোটছেলে ট্র্যাজিক হিরো ড্যাশিং পলিটিশিয়ান সঞ্জয় গান্ধী আমার দিকে তাকিয়ে স্মার্ট ভঙ্গীতে হাসছে।
সঞ্জয় গান্ধী উচ্চশিক্ষিত ছিল না। লেখাপড়ায় ছিল অমনোযোগী কিন্তু আমাদের পূজন তো ছিল ব্যতিক্রম। এলএলএম করার উদগ্র বাসনা নিয়ে ও প্রিমিয়ার ল স্কুলে ফিরে এসেছিল । কিন্তু জীবনের শেষ পরিণতিতে কেন এমন কষ্টদায়ক মিল! টিউশান ফি ওয়েভার লাগবে কিনা জিগ্যেসও করেছিলাম। ও মিষ্টি হেসে কিছুটা দুষ্টুমি করে বলেছিল, “স্যার , চাকরি করছি না”।
এমনই ছিল আমাদের পূজন। শিক্ষক হিসেবে অনেক সম্ভাবনা দেখতে পেতাম ওর মধ্যে।কিন্তু মহান সৃষ্টিকর্তা আমার মত তুচ্ছ মানুষ ও নগণ্য শিক্ষককে নিয়তি দেখার ক্ষমতা তো দেননি । অনেক বড় হতে পারতো। নিদেনপক্ষে দেশসেরা আইনজীবী । মহাপ্রভু হয়তো আরও ভালো কিছু দেওয়ার জন্য তাকে নিয়ে গেছেন। কিন্তু এই অবুঝ মনতো বুঝতে চায় না। ওর ভাইহারা বোন আর একমাত্র সন্তানহারা মাকে কী বুঝাব ?
পুনশ্চ-কেবলই তোর জন্য:
আমি সব ছাত্র-ছাত্রীর মত পূজনকেও ‘আপনি’ করে বলতাম।
পূজন তুমি তো প্রায়ই অনুযোগ করতে-“ স্যার, আমাকে আপনি করে বললে লজ্জা লাগে।পর পর মনে হয়। আমি কি স্যার এতই দূরের? প্লিজ স্যার ,আমাকে তুই বলে ডাকবেন।” আমি বলতাম, “আমার অন্য ছাত্ররা বলবে আপনাকে বেশি আদর করি। অন্ততঃ সম্বোধনের ক্ষেত্রে আমি বৈষম্য এড়িয়ে সাম্য বজায় রাখতে চাই”।
তুমি বলতে, “স্যার , এটা আমি আদায় করবই”।
হ্যাঁ –রে পূজন! তুই আদায় করেছিস। কিন্তু তুই যে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলি; তার কি হবে? বল্‌বল্‌! চুপ করে থাকিস না ।
লেখক: সচিব (যুগ্ম জেলা জজ) ভূমি কমিশন,খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লামায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলছে প্রকাশ্যে- প্রশাসন নির্বিকার!


চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলা বান্রদরবানের লামা উপজেলায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গি প্রশিক্ষণের অভিযোগ করেছে স্থানিয় জনগণ।!নির্বিকার উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উপজেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সংগঠনটির প্রশিক্ষণ ও প্রচার কার্যক্রম বন্ধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি।
২০১০ সাল থেকে লামা কোর্ট জামে মসজিদের খতিব সিহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে লামায় আফগান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার তদারকিতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। এলাকার ধর্মভীরু তরুণ ও যুবকদেরকে মোবাইল মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বাংলাদেশের আমীর (বর্তমানে কারাগারে আটক) জসিম উদ্দিন আর রাহমানি’র দেয়া বিভিন্ন সময়কার জেহাদি বক্তব্য সরবরাহ করা হয়। দেয়া হয় বিভিন্ন বই-পুস্তক।
এসব বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা সালাহ উদ্দিন, ইসলামী ঐক্যজোট,গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নেতা-নেত্রী ও আলেমদেরকে ' কাফের' বলে ঘোষণা দেয়া বক্তব্য শুনে ও বই পড়ে তরুণরা সংগঠনটির সাথে পরিচয় করায়। পরে পাঠানো হয় জসিম উদ্দিন আর রাহমানির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ঢাকার মোহাম্মদপুরের মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। এখানে প্রায় ৬ মাস থেকে ১ বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। কোট জামে মসজিদের খতিব মাওলানা সিহাব উদ্দিন দায়িত্ব নিয়ে লামায় যায়। মসজিদের খতিবের দায়িত্ব নেবার পাশাপাশি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন।
মসজিদের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন্ন দোকানে কর্মরত অল্প শিক্ষিত তরুণদেরকে একত্রিত করে একটি বাসায় নিয়মিত বৈঠক করে আসছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।,এ ব্যাপারে বাধা দিতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। লামার বেশ কয়েকজন আলেম বলেন, এখানে যে শুধু জঙ্গি প্রশিক্ষণ চালানো হচ্ছে তা নয়, মুসল্লিদের মধ্যে বিভিন্ন আকিদা নিয়ে মতবিরোধও সৃষ্টি করা হচ্ছে। স্কুলগামী ছাত্র, তরুণ ও বিভিন্ন পেশার যুবকদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কোর্ট জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে, এ ধরণের কর্মকান্ডের সত্যতা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পাকিস্তানী জারজদের রাজনীতিও মানতে হবে? -মুনতাসীর মামুন


নাথান থর্নবার্গ চিলির সান্তিয়াগো থেকে সাপ্তাহিক টাইম পত্রিকার জন্য একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। চিলিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন। সেখানে একজন প্রার্থী মিশেল বাখেলেত। বয়স ৬২। আগেও তিনি চিলির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মাঝখানে জাতিসংঘের মহিলা সম্পর্কিত বিষয়ে নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। ৬২ বছরের এই মহিলার বাবা ছিলেন এক সময় চিলির বিমানবাহিনীর একজন জেনারেল। পিনোচেট ক্ষমতা দখল করলে তাঁকে হত্যা করা হয়।
সান্তিয়াগো থেকে খানিকটা দূরে তালাগান্তে নামক ছোট এক শহরের টাউন স্কোয়ারে মিশেলের নির্বাচনী সভা। তিনি বলছিলেন কোন অপর পক্ষ [প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁর ছেলেবেলার বান্ধবী, যার বাবাও ছিলেন এয়ারফোর্সের জেনারেল। এবং রটনা আছে তাঁর বাবাই মিশেলের বাবাকে নিপীড়ন করে হত্যা করেন]-কে কী কী কারণে ভোট দেয়া উচিত নয়। কারণ, মিশেলকে বলতে হলো না, নিচ থেকে একজন চিৎকার করে বললেন, ‘তাদের কোন স্মৃতি নেই।’
এই স্মৃতি এখন চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি ইস্যু। সেই স্মৃতি ইস্যুটি কী? ৪০ বছর আগে, ১৯৭৩ সালে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যা করে জেনারেল পিনোচেট ক্ষমতা দখল করে নেন। আমেরিকার সাহায্যে আলেন্দে চিলির অধিবাসীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন যা কহতব্য নয়। আধুনিক ইতিহাসে তা ‘ডার্টি ওয়ার’ নামে খ্যাত। ঐ সময় সরকারী হিসেবে হত্যা করা হয়েছে ৩,২০০ জন, ২৯,০০০ জনকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং নির্বাসনে গেছেন দু’ লাখ। পাবলো নেরুদাকে সে সময় নানা হেনস্থা করা হয় এবং সেই সময় তিনি মারাও যান। ঐ স্মৃতি চিলির লেখকরা, সাংবাদিকরা অমর করে রেখেছেন। ইসাবেলা আলেন্দের উপন্যাস সে সময়ের দুর্দান্ত দলিল। পিনোচেট এক সময় তাড়িত হয়, তাকে কাঠগড়ায়ও দাঁড় করানো হয়। কিন্তু স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ায় তার বিচার সম্পন্ন হয়নি। এরপর চিলিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চলছে। সেনা কর্মকর্তাদের বিচার হচ্ছে। তার ঢেউ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলেও লেগেছে।
এ বছর আবারও নির্বাচনে স্মৃতি কেন ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে? কেননা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ইভালিন ম্যার্থেইর ওপর আলেন্দের ছায়া। সেই ছায়ায় বড় হয়ে ওঠা কাউকে চিলির বাসিন্দারা গ্রহণ করতে রাজি নন। যদিও ইভালিন ঐ সব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন এবং বলছেন এ কারণে জান্তার কৃতকর্মের জন্য তাঁর ক্ষমা চাওয়ারও কারণ নেই।
পিনোচেট যা করেছিলেন, আমাদের এখানে জেনারেল জিয়া তার চেয়ে ভয়ঙ্কর কা- করেছেন। পিনোচেট সেনাবাহিনী ও সিভিলিয়ান মিলে মাত্র ৩২০০ জন হত্যা করেছিলেন। জিয়া, বিভিন্ন বিবরণ অনুসারে এর চেয়ে বেশি সেনা হত্যা করেছিলেন। আমাদের সেনাদের মানস গঠন এমন ছিল যে, তাঁরা এরপরও জিয়াকে অবতার মনে করতেন। কিন্তু যে অপরাধে সবচেয়ে বেশি অপরাধী জিয়া সে কারণে তাঁর বিচার হয়নি, হওয়া উচিত ছিল। হয়ত এক সময় হবেও। তিনি ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দল ও রাজাকার-আলবদরদের ক্ষমতায় এনেছিলেন। এবং নামডাকঅলা আলবদর রাজাকারদের মন্ত্রী, স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ ৩০ লাখ হত্যাকারীর ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন। এটি কম গুরুতর অপরাধ নয়। দেশদ্রোহমূলক অপরাধ। তাঁর কারখানা থেকে বাংলাদেশে নও মুসলিমদের মতো নও রাজাকারদের উৎপাদন করা শুরু করলেন। রাজাকার ফ্যাক্টরির উৎপাদন বেড়েছে এবং তাদের জন্য বাংলাদেশে বাজার পেয়েছে এ কথা স্বীকার না করার অর্থ বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। যারা জিয়াকে ১৯৭৫ সালের পর সমর্থন করেছেন তাদের মুক্তিযোদ্ধা না বলাটা শ্রেয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা একটি প্রত্যয় যাকে খ-িতভাবে শুধু ১৯৭১ সালের ৮/৯ মাসের ঘটনায় বিচার করা যাবে না। জিয়াউর রহমানই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও লাঞ্ছিতদের স্মৃতি অবলোপনের কাজটি শুরু করেন। এ কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন নিশানই পাকিস্তান প্রাপ্ত জেনারেল এরশাদ। স্বৈরাচারী এই বৃদ্ধ এখনও রাজনীতির মাঠ দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। এরপর জেনারেলপতœী ও যুদ্ধাপরাধীদের সময়। এই সময় ঠিক কতজনকে খুন, গ্রেফতার এবং নিপীড়ন করা হয়েছে তা জানা যাবে না। এদের দোসর তখনকার সেনাপতি [নাম ভুলে গেছি] সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে ৪৯ জনকে হত্যা করে যার বিচার হয়নি। এই জেনারেলকে নিয়ে কিছু মানবাধিকার কর্মীর তিন উদ্দিনের সময় নাচানাচি সবার চোখে পড়েছে। শেখ হাসিনার সম্পাদনায় বেশ কয়েক বছর আগে দু’খ-ে একটি বই বেরিয়েছিলÑ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নমুনা।’ এর দু’খ-ে ৮০০ পাতায় বিএনপি-জামায়াত আমলে যেসব হত্যা করা হয়েছিল তার বিবরণ আছে। শেখ হাসিনা সম্পাদনা করেছেন দেখে তা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কারণ, প্রতিটি ভুক্তি ডকুমেন্টেড, চিত্রের সংখ্যাও কম নয়। প্রতি পাতায় গড়ে ৪টি এন্ট্রি থাকলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩,২০০।
একেবারে পিনোচেটের রাজত্বকালের সমান।
আমাদের দেশেও নির্বাচন আসন্ন [যদি হয়]।
শেখ হাসিনা প্রতিটি ভাষণে খালেদা-নিজামীদের অত্যাচারের কথা, যুদ্ধাপরাধীদের কথা তুলে ধরছেন। অনেকে বলছেন, এসব বকওয়াজ আর কত? তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি, দুর্নীতি-মামলার দাবি যদি বকওয়াজ না হয়, এটি বকওয়াজ হবে কেন? এই প্রচারের কারণ, পুরনো ডানপন্থী শক্তিশালী এস্টাবলিশমেন্ট চায় না এসব প্রসঙ্গ আবার আলোচনায় আসুক।
চিলিতে এই স্মৃতির প্রসঙ্গ আবার আসছে কেন?
কারণ, বিভিন্ন সরকার ও নাগরিকরা নিহতদের সমাধি, স্মৃতিচিহ্ন অক্ষুন্ন রেখেছেন। নিপীড়ন কেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ করেছেন। মানুষ এবং পর্যটকরা নিয়ত সেখানে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, চিলির টিভিতে ‘প্রহিবিটেড ইমেজ’ বা ‘নিষিদ্ধ চিত্র’ নামে একটি সিরিজ দেখানো হচ্ছে। পিনোশের ও সেনাবাহিনীর ডার্টি ওয়ারের অনেক অজানা ফুটেজ পাওয়া গেছে, যা মানুষকে আবার ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ফলে এস্টাবপন্থী ডানে-রা খানিকটা বিপদে আছে।

আমাদের এখানে কী হচ্ছে? জিয়াউর রহমান ও তাঁর উত্তরসূরিদের কথা দূরে থাকুক যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেই এস্টাবলিশমেন্ট একটি শক্তি তৈরি করেছে। এবং টাকা কিভাবে আদর্শ বদলে দেয় তার নমুনা হরদম পাওয়া যাচ্ছে। এক সময় ডেভিড বার্গম্যানকে আমরা সমর্থন করেছি, তাঁর প্রচার করেছি যেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তিনি একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন। সেই ডেভিড এখন নিয়ত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে লিখছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিতদের পত্র-পত্রিকা তা ছাপছে। কয়েকদিন আগেও ডেভিড ডেইলি স্টারে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে লেখার সুযোগ পেয়েছেন। যদ্দুর মনে পড়ে তিনি কাদের মোল্লার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিচার প্রক্রিয়ায় দু’একটি ত্রুটি থাকতেও পারে সে জন্য কাদের মোল্লা মুক্তি পেতে পারে না, কোন অনুকম্পা পেতে পারে না। কারণ, কাদের মোল্লা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেনÑ এটি তো সত্য। ডেভিড যে চারজনের ওপর তাঁর ডকুমেন্টারি করেছিলেন তার মধ্যে আশারাফ-মঈনুদ্দিন ছাড়া বাকিরা ‘নামি’ কোন যুদ্ধাপরাধী নয়। তাদের খুনী হিসেবে তুলে ধরে তখন তিনি আফসোস করেছেন তাঁদের বিচার হচ্ছে না বলে। তাঁরা খুনী হলে কাদের মোল্লা নন? বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটি ধরে যদি কাদের মোল্লা ছাড়া পান তা’হলে তা হবে ন্যাচারাল জাস্টিসের বিরুদ্ধে। আজ পর্যন্ত যে সব যুদ্ধাপরাধীকে হত্যা করা যায়নি, তাদের বিচার হয়েছে এবং প্রক্রিয়াগত ত্রুটি আছে কি না আছে সেগুলো বিচার না করে প্রত্যেকের দন্ড দেয়া হয়েছে এবং আশ্চর্য, বার্গম্যান হচ্ছেন ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাই, যেই কামাল হোসেন যিনি ১৯৭৩ সালের আইনের একজন প্রণেতা।
এ প্রসঙ্গে আরেকজন ব্রিটিশ জুলিয়ান ফ্রানসিসের কথা ধরা যাক। তাঁকে বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দিয়েছে। ডেভিডের প্রবন্ধ পড়ে তিনি সেই ডেইলি স্টারেই লিখেছেন [লেখাটি ছাপা হয়েছে নিশ্চয় স্টারের নিরপেক্ষতা তুলে ধরার জন্য], ‘যে একজন বাংলাদেশের জন্ম দেখেছে, তার যাছে এটি কষ্টের এবং অসুবিধাজনক এটা বুঝতে যে, অনেক বাঙালী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। হ্যাঁ, ন্যায্য বিচার হতে হবে। [ডেভিডের ভাষা] অনেকে এখন গণহত্যা হয়েছে বলেও মানতে চান না। কেউ যখন এসব কথা আমাকে বলেন বা এসব কথা পড়ি তখন আমি শুধু ক্রুদ্ধ নয়, খুব অবাক হই।’ আমাদের স্মৃতিহীনতা যে আমাদের একটা বড় অংশকে অসভ্য করে তুলেছে সেটিই এ মন্তব্যে স্পষ্ট। বিদেশী ও সভ্য মানুষ দেখে জুলিয়ান আমাদের সেই অংশটিকে জারজ বা হারামজাদা বলেননি।
এ প্রসঙ্গে জুলিয়ান লেখেন, ১৯৭১ সালে শরণার্থী ক্যাম্পে তিনি ১০ বছরের এক বালিকার মুখোমুখি হলেন। সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। বালিকাটি নিষ্কম্পস্বরে বলছিল, আমার বাবা-মা, পাঁচ ভাই ও এক বোনকে হত্যা করেছে পাকিস্তানী সেনারা। আমি এখন কী কবর? এ প্রশ্ন তার মতো ছিল আরও অনেকের। জুলিয়ান লিখেছেন, ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয় তরুণদের ভালভাবে জানা উচিত।
শুধু জানা নয়, প্রত্যাখ্যান করা উচিত। যারা এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে নানা তর্ক করেন তাদেরও প্রত্যাখ্যান করা উচিত। রাজনীতির নামে তারা ঐসব স্মৃতিকে মুছে দিতে চায়।

বর্তমান নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু প্রধান ইস্যু নয়। অনেকে কৌশলীভাবে এটিকে মূল ইস্যু বলতে চান। এটি নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার ইস্যু। মূল ইস্যু, এখানে মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক রাজনীতি, যা মূল ধারার রাজনীতি চলবে, না বিচ্যুত ধারা, যার প্রতিভূ ১৮ দল, সেটি চলবে। যদি ক্ষমতায় না আসে ১৮ দল তবে তাদের রাজনীতির প্রভাব বহুলাংশে হ্রাস পাবে। আওয়ামী লীগবিরোধিতা থাকুক, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতি হবে বাংলাদেশভিত্তিক। পাকিস্তানী মানসের, যুদ্ধাপরাধের রাজনীতি এখানে চলতে দেয়া যাবে না।
টাকার প্রশ্ন তুলেছিলাম। টাকা এখন যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালেও পৌঁছেছে। এতে অনেকের মতিভ্রম হবে, অনেকের মতলবী চেহারাটা পরিষ্কার হবে। হচ্ছেও। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, শুনেছি কাদের সিদ্দিকী আমাদের অনেকের প্রতি লেখার মাধ্যমে লোষ্ট্র নিক্ষেপ করছেন। যার যা কাজ করবেন তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যখন শাহরিয়ার কবির, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন নিজেকেই খাটো করেন। বাচ্চু আমাকে একদিন দুঃখ করে বলেছিল, কাদের সিদ্দিকী প্রশ্ন তুলেছেন আমি আবার মুক্তিযোদ্ধা হলাম কবে, কয় নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছি? এ ধরনের প্রশ্ন ওঠালে তিনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন সে প্রশ্নও উঠবে।
মহীউদ্দীন খান আলমগীর বা আমাকে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে থেকে আমরা অন্যায় করেছি। তা’হলে সে সময় দেশে অবস্থানরত ছয় কোটিও অন্যায় করেছিল। কবি ইকবালের ভাষায় বলতে হয়, ‘আরে ভাই হাম ওফাদার নেহিতো তুভি দিলদার নেহি।’ আমি বা ছয় কোটি বাংলাদেশের প্রতি ‘অবিশ্বস্ত’ ছিলাম, আপনি [ও কি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী ছিলেন]? থাকলে, যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনকারী ১৮ দল বা তাদের চাকর-বাকরদের সঙ্গে হাঁটাহাঁটির দরকার ছিল না। তিনি কি খোঁজ নিয়েছেন কেন তার উপাধি পাল্টে মানুষজন ব্রিজোত্তম সিদ্দিকী বলে? যত অপরাধই করি ভারতেশ্বরী হোমসের মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি দখল করতে যাইনি।
স্মৃতিহীন মানুষ পরিবারেও এক সময় বোঝা হয়ে ওঠে, ঘনিষ্ঠরাও তখন তার আশু মৃত্যু কামনা করে। যাঁরা ১৯৭১ ও ২০০১-৭ সালের স্মৃতি ভুলে যাবেন রাজনীতির স্বার্থে, রাজনীতিতে এক সময় তাঁরাও বোঝা হয়ে উঠবেন। আপাতত হয়ত স্বার্থ উদ্ধার হবে। মনে রাখা দরকার, জামায়াত গত তিন বছরে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পেয়ে যা করেছে, ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষের একটা বড় অংশকে হয় মরণপণ যুদ্ধ করতে হবে, নয় দেশ ত্যাগ বা মৃত্যুবরণ করতে হবে। মওদুদীপুত্র জামায়াতকে জারজ বলতে দ্বিধা করেন না আর পাকিস্তানের জারজ তাদের বন্ধু বলে ডাকতে দ্বিধা করে না।
সামনের বন্ধুর পথ মানি। ১৯৭১ ও ২০০১-৭ সালেও তাই ছিল। কিন্তু স্রেফ আদর্শ ও বিশ্বাসের জোর থাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা জিততে পারেনি। স্মৃতিও টাটকা ছিল। এ প্রসঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর কয়েকটি মন্তব্য স্মর্তব্য। লিখেছিলেন তিনি, ‘এই নশ্বর দুনিয়ায় সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়, সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে, বেঁচে থাকে কেবল ভাবনা, আদর্শ এবং স্বপ্ন।... যে ধারণার জন্য কোনও ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত থাকে। সহস্র জীবনের মধ্য দিয়েই সেই ধারণার বারংবার পুনর্জন্ম হয়। [আর] ‘এই ভাবেই ভাবনা, আদর্শ ও স্বপ্ন এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়ে চলে...এ জগতে ত্যাগ ও ক্লেশ স্বীকার ছাড়া কোনও আদর্শ পূর্ণতা পায়নি।’ মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন কি এই মন্তব্যের উদাহরণ নয়?

এ দেশে কি সত্যিকারের বাঙালীরা বসবাস করে না? -মুনতাসীর মামুন


এরিক প্রাইবেক জার্মান। নাজি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এরিক ইতালির রোমে। ১৯৪৩ সালে রোমের আর্ডিটাইনে নাজি বাহিনী গণহত্যা চালায়। ৩৩৫ জন নিহত হয়, তার মধ্যে ৭৫ জন ছিলেন ইহুদী। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে এরিক ধরা পড়েন। কিন্তু ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দীদের শিবির থেকে পালাতে সক্ষম হন। এক ক্যাথলিক বিশপ তাঁকে ভ্যাটিকানের একটি ভ্রমণপাস দেন। আরও অনেকের মতো এরিক পালিয়ে যান আর্জেন্টিনায়।
লসএঞ্জেলেসের সাইমন ওয়েজেনথাল সেন্টার গত কয়েক দশক ধরে নাজি যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করছে। যুদ্ধ শেষের ৫০ বছর পর ১৯৯৪ সালে সাইমন ওয়েজেনথাল সেন্টার আর্জেন্টিনায় এরিকের খোঁজ পায়। তাঁকে গ্রেফতার করে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য ১৯৯৬ সালে ইতালি পাঠানো হয়। এরিকের বয়স তখন ৮৩।
বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয় এরিক। তবে তাঁর বয়স ও অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে তাঁকে তাঁর আইনজীবীর বাসায় গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
যুদ্ধাপরাধী এরিক এখন ১০০ বছর বয়সে মারা গেছেন। যেহেতু এরিক ক্যাথলিক, সেহেতু গির্জায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হওয়ার কথা। আর ভ্যাটিকান তো ক্যাথলিকদের সদর দফতর। কিন্তু, ভ্যাটিকান এখন বলছে, তারা গির্জায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতে দেবে না। চার্চ সাধারণত এরকম সিদ্ধান্ত নেয় না। ইতালিতে চার্চের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ কেউ করেনি।
এরিকের আইনজীবী পাওলো গিয়াচিনি ঘোষণা করেছেন, ঠিক আছে, এরিকের মরদেহ আর্জেন্টিনায় পাঠানো হবে। সেখানে তাঁর স্ত্রীর পাশে তাঁকে সমাহিত করা হবে। আর্জেন্টিনায় এরিক প্রায় ৫০ বছর বসবাস করেছেন। এখন আর্জেন্টিনার সরকার বলছে, না, যুদ্ধাপরাধীর মরদেহ আর্জেন্টিনায় আনা যাবে না।
গিয়াচিনি বলছেন, এরিকের সন্তানরা চান ক্যাথলিক মতে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হোক। তাদের বাবা ছিলেন ক্যাথলিক, তাঁকে তো সম্মান দেখান উচিত। গিয়াচিনির দাবি, ক্যাথলিক মতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এরিকের অধিকার। ওয়েজেনথাল সেন্টার বলছে, এই যুদ্ধাপরাধীর মৃতদেহ জার্মানিতে পাঠানো হোক। সেখানে তাঁকে দাহ করা যেতে পারে। হিটলারের মরদেহও দাহ করা হয়েছিল। কারণ, নাজিদের কোন চিহ্ন পৃথিবীতে রাখা যাবে না।
যুদ্ধাপরাধীদেরও দু’একজন ভক্ত থাকে। যেখানে এরিক মারা গেছেন সেখানে তারা ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিল। তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। ইউরোপে নিউ-নাজিদের রাজনীতির কোন অধিকার নেই।
এরিককৃত গণহত্যায় নিহত একজনের আত্মীয় বলছেন, ওই লোকটির মনে কোন করুণা ছিল না। সবচেয়ে ভাল হয় তাঁকে দাহ করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া এবং সেই ছাই কোথায় ছড়ানো হয়েছে তাও যেন গোপন থাকে। তাঁকে ভুলে যেতে হবে। তাঁর কথা কখনও উচ্চারণ করা যাবে না। রোমে তাঁকে সমাহিত করার অর্থ, নাজিবাদের চিহ্ন রাখা এবং নিউ-নাজিদের ‘শ্রদ্ধা’ জানানোর স্থান হবে সেটি। এটি হতে পারে না।
আরেকজন, যার শ্বশুর সেই গণহত্যায় নিহত হয়েছেন, বলেছেন, এই শহর কিভাবে তাঁর শত্রুর দেহকে আশ্রয় দেবে? এই ধরনের জঘন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল তো কোন শহর হতে পারে না।
১০০ বছরের যুদ্ধাপরাধী এরিক প্রাইবেকের মরদেহ এখন রোমের একটি মর্গে পড়ে আছে।এরিক ছিলেন সামান্য একজন নাজি অফিসার। উচ্চমার্গের কেউ নয়। তাঁর আজ এ পরিণতি।
গোলাম আযম বাংলাদেশের একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দন্ডিত হয়েছেন। তাঁর বয়স এরিকের থেকে কম। গোলাম আযম এ দেশে ৩০ লাখ মানুষের হত্যা, প্রায় ৬ লাখ নারী নির্যাতন, অগণতি মানুষকে আহত, এক কোটিরও বেশি মানুষের বাস্তুত্যাগের জন্য দায়ী। এরিক পালিয়েছিলেন আর্জেন্টিনায়, গোলাম আযম পালিয়েছিলেন সৌদি আরবে। এরিককে আশ্রয় দিয়েছিল আর্জেন্টিনার সামরিক শাসকরা। গোলাম আযমকে পরে আশ্রয় দিয়েছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। সামরিক শাসকদের আমলে আর্জেন্টিনায় সুখেই ছিলেন এরিক, তারা থাকলে আর্জেন্টিনায়ই সমাহিত হতেন। কিন্তু, আর্জেন্টিনায় এখন গণতান্ত্রিক শাসন। যুদ্ধাপরাধীর স্থান সেখানে নেই। গোলাম আযম জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের আমলে শুধু সুখে-শান্তিতে নয়, রাজনীতি করে বাংলাদেশের নাজি পার্টি জামায়াতকে শক্তিশালীও করেছেন। প্রকাশ্যে, দম্ভভরে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তার গণবিচার করায় জেনারেল জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া এত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, গণআদালতের ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করেছিলেন। জেনারেল-পতœীরা জেনারেলদের মতোই হয়, আচরণ করে, যারা এটি ভুলে যায় তারা মূর্খ এবং বেকুব দুটোই।
শেখ হাসিনার আমল সামরিক আমল নয়। তাই যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার হয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে; তারপরই আর কিছু ঠিক নেই। এই ঠিক না থাকাটা প্রমাণ করে আমরা বাংলাদেশকে এখনও সম্পূর্ণভাবে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করতে পারিনি; আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি আছে, আমাদের মনের গহীন গভীরে এখনও পাকিস্তানীদের প্রতি মোহ জমা আছে, বঙ্গবন্ধুর বদলে কায়েদে আযমকে জাতির পিতা বলতে পারলে আমাদের কণ্ঠ খুলে যাবে, বাইরে বেশ মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা ভাব, ভেতরে হেজাবি [হেফাজত+জামায়াত+ বিএনপি]দের জন্য প্রীতি, হাড়ে হারামজাদা বলতে পারছি না, অনেকে ক্ষুব্ধ হবেন ভেবে, এই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশীদের অবস্থা।
গোলাম আযমকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়নি করুণা করে। বিচারকরা করুণার আধার। যে বৃদ্ধদের/বৃদ্ধাদের গোলাম আযমের সহযোগিতায় হত্যা করা হয়েছিল তারা অবশ্য পাকিস্তানী গোলামের করুণা পায়নি। গোলাম আযমকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে বাড়ির চেয়ে ভাল অবস্থায় রাখা হয়েছে। বাড়িতে এত ভালবাসা ও যতœ এ বয়সে তিনি পেতেন কিনা সন্দেহ। ২৪ ঘণ্টা ডাক্তারি সেবা। বাড়ি থেকে প্রেরিত খাবার। প্রতিদিন ১৬টি খবরের কাগজ। শাহরিয়ার কবির এক প্রবন্ধে লিখেছেন, তাঁকে যখন জেলে নেয় এই গোলাম আযম ও খালেদার সরকার, তখন তাঁকে বিন্দুমাত্র করুণা করা হয়নি। পাকিস্তানী গোলামরা সানন্দে ঈদ করে, যুদ্ধাপরাধী হলেও। আসলে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী হওয়া খারাপ কিছু না !
এরিক কতজনকে হত্যা করেছে আর আবদুল আলীম? মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের চামড়া ছিলে নুন মাখাতেন আলীম। বাঘের খাঁচায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঢুকিয়েছেন। গর্ভবতী হত্যায় সাহায্য করেছেন বলেও শুনেছি। সেই আবদুল আলীমকেও মৃত্যুদ- দেয়া হয়নি তার বাতের ব্যথার কারণে। তিনিও বহাল তবিয়তে আছেন গোলাম আযমের মতো হাসপাতালে। তাঁকে কি সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা আমরা এখনও জানতে পারিনি। আলীম ছিলেন বিএনপির মন্ত্রী।
আমাদের মিডিয়া যারা এত শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা করা যাবে না। মোবাইল কোম্পানির মতো। তারা যা খুশি করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর প্রসাদধন্য মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা, প্রধানমন্ত্রীর করুণায় টিভি চ্যানেল পাওয়া ব্যক্তিত্বরা, বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু বলে যারা যখন তখন ডুকরে ওঠেন সেইসব মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবিদার টিভির কর্তাব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে টিভিতে দেখিয়ে এসেছেন গোলাম আযম, আলীম বা কখনও কখনও সা.কা. চৌধুরী অশক্ত, নিজামী কারও কাঁধে ভর দেয়া ছাড়া সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না, হাত নেড়ে তাঁদের অভিনন্দন ও ভি-চিহ্ন দেখানোÑধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে এবং আংশিক সফল হয়েছে যে, গোলাম আযমরা বৃদ্ধ, তারা অশক্ত, তাদের নিয়ে এত টানা হেঁচড়া কেন। তাঁরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকতে পারেন, হয়ত করেছেন ভুলবশত এখন জামায়াত করেন, করতেই পারেন তাতে দোষের কি, তারা তো আওয়ামী লীগ করেন না। আলীম মুক্তিযোদ্ধাদের চামড়া তুলে লবণ মাখিয়েছেন, মাখাতেই পারেন কারণ তারা তো ছিল আওয়ামীপন্থী, পাকিস্তানপন্থী নয়। পরে তিনি তো বিএনপি করেছেন। তাতে দোষ স্খলন হয় না? আমাদের অনেকের প্রতিবাদ সত্ত্বেও প্রতিটি চ্যানেলের সম্পাদক-মালিকরা এ কাজগুলো করেছেন। ইচ্ছে করেই করেছেন নিরপেক্ষতার নামে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে দেশপ্রেমের কারণে মিডিয়া এ ধরনের আচরণ করে না। টিভি/খবরের কাগজে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিভিন্ন আখ্যান, কর্মকা- প্রচার করেছে, কিন্তু কোন প্রতিবেদন কি দেখানো হয়েছে বা ছাপা হয়েছে এ বিষয়ে যে, দ-িত হওয়ার পরও গোলাম আযম বা আলীম কি আরামে আছে ? বেআইনীভাবে [আইন দেখিয়ে] যে সুবিধা পাচ্ছে বা এতদিন দেয়া হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের তা কেউ প্রচার করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এতদিনের সৃষ্ট ‘সমবেদনা’ যদি নষ্ট হযে যায় !
যুদ্ধাপরাধী এরিক এমন কোন নামকরা যুদ্ধাপরাধী নয়, অথচ কোন দেশে তাঁকে সমাহিত করতে দেয়া হচ্ছে না। কেননা, এইসব দেশের জনগণের দাবিÑ এদের দাহ করে মর্ত্যে যে এরা ছিল সে চিহ্ন মুছে ফেলা হোক। বাংলাদেশের মানুষ ও শাসকদের এখন একথা ভাবার সময় এসেছে। বিচারের রায়ের কপি পাওয়া যায়নি এ অজুহাতে সরকার হয়ত গোলাম আযমদের রায় কার্যকর করবে না। সরকারের ভেতর হেজাবিদের প্রতি সহানুভূতিশীলরা, অনেকের মতে, চাচ্ছেন যে, রায় কার্যকর না হোক। নির্বাচনের আগে এসব ঝামেলায় না যাওয়া ভাল। অন্যদিকে, আমজনতা মনে করে রায় কার্যকর করলে ভোটাধিক্যের সৃষ্টি হতে পারে। এ বিতর্কে নাই বা গেলাম। জীবনে একমাত্র সত্য মৃত্যু। এবং যে কোন সময় যে কোনখানে মৃত্যু। এই যে আমি, এখন এ লেখা লিখছি, লেখাটি ছাপা হলো কি না তা নাও দেখে যেতে পারি। গোলাম আযমদেরও মৃত্যু হবে। তখন কি হবে? যেহেতু যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষের সরকার, সেহেতু তাদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। জেনারেল জিয়া/এরশাদ/খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলে এ প্রশ্ন উঠত না। তারা পারলে এদের কবরে স্মৃতিসৌধ তৈরি করতে কসুর করবেন না। আমেরিকা এ সব বিবেচনা করে বিন লাদেনের মৃতদেহ পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। বিন লাদেন এখন বিস্মৃত। কিন্তু, তার মরদেহ পাকিস্তানে থাকলে এখন আজমীরের মতো মাজার শরিফ বানিয়ে ফেলা হতো। আমাদের রাজাকার ও রাজাকারপন্থী পার্টিগুলো কিন্তু এখন থেকেই প্ল্যান ছকে রেখেছে, নবীনগরে গোলাম আযমের মাজার হবে, পিরোজপুরে সাঈদীর আর সাঁথিয়ায় নিজামীর। রাউজানে সাকার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ হবে। যাতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে যুদ্ধাপরাধ কোন বিষয় বলে পরিগণিত না হয়। এবং এক দশক পর হজরত শাহ গোলাম আযম পাকিস্তানীর নামে উরস হবে। যেভাবে জিয়াউর রহমানের কবর মাজারে পরিণত করা হয়েছে। এবং এখন খবরের কাগজ ও টিভি প্রতিবেদনে একে মাজার বলেও উল্লেখ করা হয় যদিও তা শরিয়তবিরোধী। এ গুলো হতে পারে, বাংলাদেশী তো। গোলাম আযমের প্রকাশ্য সমর্থনকারী যদি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তাহলে সাকার স্মৃতিস্তম্ভ হতে দোষ কি ! আর যাই হোক আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত মওলানাদের আর যাই থাকুক ভ্যাটিকানের মওলানাদের মতো সাহস আর ধর্মবোধ নেই। তারা যে এরিকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অস্বীকৃতি জানিয়েছে তার কারণ নৈতিকতা, ধর্মবোধ ও মানবতা এবং সভ্যতা বোধ। একটা উপায় হতে পারে, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আলাদা ছোট গোরস্তান।
নিউ নাজিদের যাতে রবরবা না হয় সে কারণে এরিককে সমাহিত করতে কেউ রাজি নন। কারণ নিউ নাজিরা সেটিকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জায়গা করে ফেলবে। আমাদের এখানেও আছে নিউ নাজিরা, যারা একত্রে ১৮ দল হিসেবে পরিচিত। এদের প্রধান বিএনপি, যার নেতারা প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের দ-ের বিরোধিতা করছেন। এদের নব্য রাজাকার সংক্ষেপে রাজাকারের দল বলা যেতে পারে। গণতন্ত্রের নামে মিডিয়া এই রাজাকারদের সমর্থন করছে, রাজনীতিবিদরা করছেন, সাধারণ মানুষ করছেন, সরকারও করছে [এর প্রমাণ গোলাম আযমদের সুবিধা দেয়া। বলা হয় সৌদি আরবের ভয়ে সরকার এ কাজ করছে। সৌদিরা শক্তিশালীকে বাবা ডাকে, একটু নরম হলে পায়ের নিচে রাখতে চায়। সৌদিদের কখনও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতে শুনেছেন?] ইতালিতে ফ্যাসিবাদের জন্ম। সেই ইতালির মানুষরা কিন্তু ফ্যাসিবাদকে শুধু ছুঁড়ে ফেলা নয়, তার চিহ্নও রাখতে চায় না। আমরা জামায়াতকে রাখতে চাই, বিএনপিকে রাখতে চাই। বিএনপি যেন নির্বাচনে যায় সে জন্য সাধ্যসাধনা করি।

তারা যাতে জয়ী হয় সে প্রচার করি। যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকরা তো দেশপ্রেমী হতে পারে না, রাজনীতিও করতে পারে না সভ্য দেশে। এখানে পারে। এখানেই সভ্যদের সঙ্গে, দেশপ্রেমীদের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশীদের ফারাক। এখানে বীরোত্তম সিদ্দিকী হয়ে যায় ব্রীজোত্তম সিদ্দিকী।

প্রবাসে যে সব বাঙালী আছেন ১৯৭১ সালে তারা জান প্রাণ দিয়ে দেশ মুক্ত করতে চেয়েছেন। সভ্য দেশে ছিলেন, সভ্যতা তাদের স্পর্শ করেছিল; তাই খুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এখনও তারা সভ্য দেশে আছেন, তারা অন্তত ইউরোপ-আমেরিকায় এ প্রচার চালান, বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধী তো বটেই যারা তাদের সমর্থন করছে সে সব রাজনীতিক/বুদ্ধিজীবীরাও যুদ্ধাপরাধী; অতএব, তাদের ভিসা দেয়া বন্ধ হোক। ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির ল-ন শাখা এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে ব্রিটেনে সাঈদীর প্রবেশ বন্ধ করেছিল। এই প্রতিবাদ প্রচার কিন্তু কাজ দেবে। আমরা সবাই মিলে এখন যে ধারণার সৃষ্টি করছি [বিচার করেও, যুদ্ধাপরাধীর পক্ষেও এ দেশে রায় হয় বিচারের নামে] তাতে এ দেশ পৃথিবীর একমাত্র যুদ্ধাপরাধী সমর্থক দেশ হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, নৈতিকতা কোন নিরিখে যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধী সমর্থকদের রাজনীতি করতে দেয়া যায় না। তাদের পক্ষে প্রচার চালানোও যায় না। বাংলাদেশে এ ভেদরেখা মুছে ফেলা হচ্ছে যা একটি অপরাধ।

ইতালিতে এরিকের পক্ষে কোন মিডিয়া নেই, কোন বিচারক নেই, গির্জা নেই, মানুষ নেই। কারণ সে এক ‘জঘন্য প্রাণী’ যার পৃথিবীতে থাকার অধিকার নেই। এ দেশে যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে মিডিয়া আছে, বিচারক এবং বিচারকের করুণা আছে, মসজিদ আছে, মানুষও আছে।

এ দেশে গণতন্ত্রের নামে, নিরপেক্ষতার নামে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থকরা সমান স্পেস পায় তাদের বিরোধীদের সঙ্গে, সব খানে এবং এ কারণে কারও লজ্জাবোধ হয় না, ধর্মবোধ আহত হয় না। সাধারণ অপরাধী ও খুনীদের থেকেও যুদ্ধাপরাধীদের কর্মকা-কে হাল্কা করে দেখান হয়। তাদের পক্ষে বলার জন্য নানা কৌশলে টিভিতে টকশোর অনুষ্ঠান করা হয়, কাগজে নিবন্ধ ছাপা হয়। এ দেশটি কি আর বাংলাদেশ আছে? এ দেশে কি মানুষের বাচ্চারা বসবাস করে?

Saturday, October 19, 2013

কথিত নাস্তিকেরা “নাস্তিক” নন-পিনাকী ভট্টাচার্য



নাস্তিক শব্দটি বাংলা নয়, সংস্কৃত এবং বৈদিক। শব্দটি যখন বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হয়, সে সময় যারা এই শব্দটাকে বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তারা শব্দটার সঠিক অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেকারণে নাস্তিক বলতে সংস্কৃতে যা বোঝায় বাংলায় সেটা বোঝানো হয়না। বাংলায় নাস্তিককে এথিস্টের সমার্থক মনে করা হয়। এই সরলীকরণ ধর্মতত্ত্বের জন্য একটা বড় সমস্যা। কারণ সংস্কৃতে নাস্তিক মানে নিরীশ্বরবাদী নয়। বিশেষ করে নাস্তিক শব্দটি যারা আবিষ্কার করেছে তাঁদের জন্যও নাস্তিক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার অস্বস্তিকর। ধর্মতাত্ত্বিক এই জটিল সমস্যা মেটানোর জন্য প্রয়োজনে বাংলা অভিধান সংশোধন করা যেতে পারে।

হিন্দু ধর্মতত্ত্বে নাস্তিক বলতে তাঁদেরকেই বোঝায় যারা বেদের অপৌরুষেয়তায় বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ বেদকে ঐশ্বরিক গ্রন্থ মনে করে না। এর মানে এটা নয় যে নাস্তিকরা নিরীশ্বরবাদী বা ধর্মদ্রোহী। হিন্দুদের মধ্যে চার্বাক পন্থীরা ধর্ম পালন করেও নাস্তিক্যবাদের চর্চা করতে পারেন। তারা বেদের পশুঘাত, শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব মানেন না। হিন্দু ধর্মের মতে ভারতীয় দর্শনের মধ্যে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মও নাস্তিক দর্শন।

নাস্তিক শব্দটা অবশ্য প্রথমে ঘৃণা ও অবহেলা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো। কিন্তু নাস্তিক ও আস্তিকদের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা তীক্ষ্ণ বিতর্কে হিন্দু ধর্মের কঠোরতা পরিবর্তিত হয়েছে। ভারতবর্ষের অহিংসার দর্শন নাস্তিকদের অবদান। জৈন আর বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব হওয়ার ক্ষেত্রে চার্বাক নাস্তিকদের অবদান অনস্বীকার্য। নাস্তিকদের কারণেই হিন্দু ধর্ম সংস্কার এবং এর ফলে মানব জীবনের আদর্শ উচ্চতর হয়েছে। তর্কবিদ্যাও নাস্তিকদের অবদান।

এথিস্টদের নিরীশ্বরবাদী বলার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে, কারণ বৌদ্ধরা নিরীশ্বরবাদী। তবে কী বলা যায় এথিস্টদের? আমার প্রস্তাব যাদের জন্য এটা মাথা ব্যথা তারা একটু এটা নিয়ে মাথা ঘামাক।

হেফাজতে ইসলামী কি জানে যে এটা একটা বিশুদ্ধ সংস্কৃত এবং কঠোর বৈদিক শব্দ?

লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট Unmochon

আলোর জরিপে এতটা আঁধার ! জামায়াত, তোমার কী লাগে আর ? -ফেরদৌস আরেফীন



বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র উদ্যোগে একটি পেশাদার জরিপ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া সর্বশেষ রাজনৈতিক জরিপটি অনেকগুলো কারণেই বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এবং নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মতানৈক্য থেকে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার কারণে, জনমত ভিত্তিক রাজনৈতিক তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত এই জরিপটি গেল ১০ অক্টোবর দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনামে বিশাল অংশ জুড়ে ছাপা হওয়ার পর থেকে অনেকেই এটি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা-মন্তব্য করছেন, সোজা কথায় মাথা ঘামাচ্ছেন। জরিপের উদ্যোক্তা দৈনিক পত্রিকাটি তাদের এই জরিপটির স্বপক্ষে একাধিক মতামত তথা উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশের মাধ্যমে, জরিপ থেকে উঠে আসা ফলাফলগুলো আমলে নিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারলে তারা লাভবান হবে বা হতে পারবে -এমন একটি মতবাদ দেয়ারও চেষ্টা করেছে। কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল জরিপটি নিয়ে আলোচনা, টক-শো আয়োজন করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখ থেকেও এই জরিপ বিষয়ে যার-যার অবস্থান অনুযায়ী কম-বেশি বক্তব্য পাওয়া গেছে।
জরিপটি প্রকাশের পর এর খুঁটিনাটি পড়ে এবং ‘প্রথম আলো অনলাইন’ সংস্করণ থেকে মুল জরিপের ইংরেজি ভার্সনটিতে চোখ বোলানোর পর, দীর্ঘ রিপোর্টিং ক্যারিয়ারে জন্ম নেয়া ব্যাক্তিগত ‘সন্দেহপ্রবণ ও অনুসন্ধানী’ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্লেষণ করে জরিপটির গোড়াতেই অনেকগুলো বেখাপ্পা গলদ আমার চোখে পড়ে। আমি কোনো জরিপ বিশেষজ্ঞ নই, অর্থনীতি বা পরিসংখ্যানের লোকও নই। কিন্তু মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদ চর্চায় নিজেকে একজন অগ্রপথিক মনে করি। আর দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র জরিপটি তাই যুক্তির ছকে ফেলে তাতে মুক্তচিন্তার প্রয়োগের পর কিছু বিষয়ের জন্য এটিকে সোজা ভাষায় ‌উদ্দেশ্যমূলক, দূরভিসন্ধীমূলক এবং এক বা একাধিক বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টায় সুকৌশলে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে মূল্যায়ণ করা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছুই মনে করা সম্ভব হয়নি! আর, বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেনী, পেশা ও বয়সের পাঁচ হাজার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে এই জরিপ করা হয়েছে এবং যে কোনো জরিপের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য এই ‘পাঁচ হাজার’ সংখ্যাটি একটি বৃহত্ এমনকি যথেষ্ঠেরও অধিক বলে আ্যখ্যা দিয়ে, বারবারই পত্রিকাটি এই জরিপটিকে সম্পূর্ণ যৌক্তিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রায়-বাস্তবসম্মত মানের একটি জরিপ হিসেবে আখ্যা দেয়ার যে চেষ্টা করছে, তার জবাবে শুধু একটা কথাই বলতে হয়- তথ্যদাতার বিশাল সংখ্যা কিংবা তথাকথিত ‘বহুস্তরবিশিষ্ট প্রণালিবদ্ধ দৈবচয়ন নমুনায়ন ভিত্তিক’ –এরকম যত কথাই বলা হোক না কেন, জরিপের ফলাফল বলতে গেলে পুরোটাই নির্ভর করে মতামত গ্রহণের জন্য প্রস্তুতকৃত প্রশ্ন ও বিষয়াবলীর ওপরই। আর এক্ষেত্রে প্রশ্নের ধরন ও মাত্রিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র জরিপে ওই পাঁচ হাজার মানুষের মতামত গ্রহণের সময় তাদের সামনে রাখা প্রশ্ন ও বিষয়াবলী এতটাই উদ্দেশ্যমূলক, একপাক্ষিক, বিভ্রান্তিকর এবং বাস্তবতা বিবর্জিত ছিলো যে, এই জরিপের ফলাফল শেষ পর্যন্ত পুরো জাতির মনে কেবল একরাশ বিভ্রান্তি আর দোলাচলের সৃষ্টি করেছে, আর এটাই ছিলো জরিপের মূল উদ্দেশ্য।
জরিপের শুরুতেই দেখা যায়, ‘প্রথম আলো’র ছাপার ভাষায়- “এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে দেশের ৩৬.৫ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে, আর ৫০.৩ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে ভোট দিতে চান”। আবার এই জরিপেরই আরেকটি অংশে দেখা যায় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পক্ষে আছেন দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসলে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াটি নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে- সে কথা পাগলেও জানে। জরিপ থেকে উঠে আসা এই দুই তথ্য দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পক্ষে থাকা ওই ৮০ শতাংশ মানুষের ৩৬.৫ শতাংশ যদি আওয়ামী লীগে ভোট দিতে ইচ্ছুক অংশের সেই মানুষেরা হয়ে থাকেন, তাহলে বিচারের পক্ষে থাকা বাদবাকি ৪৩.৫ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়েও কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন? তারা সবাই কি এতটাই বিভ্রান্ত? নাকি জরিপ প্রতিষ্ঠানটি বেছে-বেছে কেবল বিভ্রান্ত ব্যাক্তিদের কাছ থেকেই মতামত সংগ্রহ করেছে? নাকি আবার এই সাড়ে ৪৩ শতাংশ মানুষ ভাবছেন যে বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া এরকমই চালু রাখবে? কিন্তু স্বয়ং বিএনপি-চেয়ারপার্সন যেখানে বলেছেন যে, “বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের বিচার করা হবে”, সেখানে বিএনপি ক্ষমতা পেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভদ্রলোকের মতো চালিয়ে যাবে –এটা চিন্তা করা তো একেবারেই অসম্ভব! এই জরিপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমর্থন করা মানুষের অনুপাত এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষ-বিপক্ষ মতামত নিয়ে পাওয়া অনুপাত দেখে মনে হয় যেন, এই ফলাফল দুটি জরিপের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দৈনিক ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র সেই চিরায়ত আওয়ামী-বিরোধীতা সত্ত্বেও প্রগতিশীলতার ভাব রক্ষার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষাবলম্বন করা এক অদ্ভুত-সাংঘর্ষিক মানসিকতারই বহি:প্রকাশ। ঠিক এরকম বহি:প্রকাশই ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’ দেখিয়েছিলো এ বছরের এপ্রিল মাসে, এই একই বিচার সম্পর্কিত অন্য একটি ইস্যুতে- যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে শাহাবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এবং ওই মঞ্চে ‘প্রথম আলো’র বেশ ক’জন সিনিয়র কর্তাব্যাক্তির নিয়মিত-সরব উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, সেই ‘প্রথম আলো’তেই আবার হাসনাত আবদুল হাই রচিত চরম বিতর্কিত একটি গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের গোটা বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি হীন-জঘণ্য অপচেষ্টার মাধ্যমে। অব’শ্য ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখে ‘মাফ চেয়ে’ গল্পটি ‘প্রত্যাহার’ করে নেয় পত্রিকাটি! (ছাপানো অক্ষর প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে অদ্যাবধি ধরেনি!)
এ তো গেল একটা ভন্ডামি। এবার লক্ষ্য করুন আরেকটি আরও ভয়াবহ বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস। তা হলো এই যে, জরিপটি করার সময় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে মানুষের মতামত নেয়া হলেও, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে তখন এই বিচার প্রক্রিয়া চলমান কিংবা স্থবির –এ দুই অবস্থার প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাবনা নিয়ে কোনো ধরনের মতামতই নেয়া হয়নি! অথচ পুরো জাতির সামনে এখন এটি একটি অনেক বড় প্রশ্ন! বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিচারের কি হবে, ট্রাইবুনাল থাকবে নাকি বিলুপ্ত হয়ে যাবে- এসব নিয়ে জনগণের মধ্যে যে চরম শঙ্কা-সন্দেহ-দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে, সেটি ‘প্রথম আলো’র জানা নেই- তাও কি বিশ্বাস করতে হবে! আবারও বলতে হচ্ছে, যে কোনো জরিপের ফলাফল পুরোপুরিই বিষয় আর প্রশ্নের ওপর নির্ভরশীল। প্রশ্ন না থাকলে উত্তর-অনুপাত আসবে কোথা থেকে?
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, যুদ্ধাপরাধের রায় নিয়ে বিএনপি’র নীরব ভূমিকা বিষয়েও এই জরিপে ভোট বা মতামত নেয়া হয়েছে! বিএনপি’র নীরবতা সঠিক না বেঠিক- তা নিয়ে জনগণের এত মাথাব্যাথা তো কোত্থাও দেখলাম না? তাহলে ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র এ নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কিসের? অথচ এর চেয়ে অনেক-অনেক জরুরী বিষয় বিএনপি ক্ষমতায় আসলে এই বিচার প্রক্রিয়ার ভবিষ্যত্ কি হবে- সেই প্রশ্ন বা প্রসঙ্গই নেই জরিপে? আসলে বিএনপি’র নিরবতা নিয়ে জরিপে অহেতুক টানাটানির কারণ ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’ না বললেও আমরা যে বুঝি না, তা কিন্তু নয়‍! রায় নিয়ে বিএনপি’র নীরবতার প্রসঙ্গ টেনে বিএনপিকে কিঞ্চিত বিব্রত করার মধ্য দিয়ে বন্ধুপ্রতীম জামায়াতকে একটু খুশী করাই ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’র উদ্দেশ্য? বন্ধুর খারাপ সময়ে এরকম ছোট-ছোট ‘গিফট’ মন্দ নয়! ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’কে বলতে চাই, বন্ধুকে ‘গিফট’ দেয়ার উদ্দেশ্যে, গণমানুষের প্রকৃত চিন্তাধারাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য অযাচিত-অপ্রয়োজনীয় চিন্তাকে সামনে টেনে আনার এই অপকৌশল নতুন কিছু নয়। কিন্তু এর পরিনাম কখনোই ভালো হয়নি, বরং বুমেরাং হয়েছে। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন তুঙ্গে থাকা অবস্থায় নিজের গদি বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে স্বৈরাচারী এরশাদ গণমানুষের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙার ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে সারাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগানোর যে চেষ্টা করেছিলেন- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় এরশাদের সেই সাজানো খেলায় অংশ না নিয়ে, বরং এরশাদের পালিত গুন্ডা-বাহিনীর হাত থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুদেরকে নিজেদের গৃহে আশ্রয় দিয়ে, স্বৈরাচারের ওই শেষ অপচেষ্টাটিও ভন্ডুল করে দিয়েছিলো। আর আন্দোলনের শেষদিকে স্বৈরাচারের সেই রায়ট-নাটক গণঅভ্যুত্থানের পালে যেন আরও বেশি হাওয়ার যোগানই দিয়েছিলো। ‘প্রথম আলো’তে কর্মরত পরম শ্রদ্ধাভাজন সিনিরয় সাংবাদিক ভাইদের সেই ঘটনাগুলো তো ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ডসহ মনে থাকার কথা! তবুও কেন তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ভবিষ্যত্ বিষয়ে বিএনপি’র যে সিদ্ধান্ত বা চিন্তাটি এদেশের প্রগতিশীল ও স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি মানুষের এই মুহূর্তের প্রধানতম জিজ্ঞাসা- তার বিন্দুমাত্র ধারে-কাছে না গিয়ে, শুধুই জামায়াতকে খুশি করতে বিএনপি’র নিরবতা নিয়ে অহেতুক গবেষণায় মত্ত হলেন? এই বুঝি ‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো’র নমুনা?
বিশাল আরেকটি গলদ রেখে দিয়েছেন কৌশলী ‘প্রথম আলো’।
খুব কৌশলে কাজ সারলেও গলদটি রয়েই গেছে তাদের অগোচরে। সেটি হলো এই যে, ‘প্রথম আলো’র আগের জরিপটির মতো এবারের জরিপেও জামায়াত নিষিদ্ধের বিপক্ষে নাকি মত দিয়েছেন বেশিরভাগ মানুষ! মানবতাবিরোধী অপরাধ আইন অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধের বিচার মানে শুধু কিছু ব্যাক্তির বিচার করাই নয়, বরং অপরাধের সঙ্গে জড়িত সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনা। মাত্র আট মাস আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ আইনের সর্বশেষ সংশোধনটি আশা করি ‘প্রথম আলো’র বিজ্ঞতম সাংবাদিকবৃন্দ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাননি! আর তাঁরা নিশ্চই এটাও ভোলেননি যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল একাধিক আসামীর রায় ঘোষণার সময় জামায়াতে-ইসলামী নামের রাজনৈতিক সংগঠনটিকেও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ও সংশ্লিষ্ট বলে কঠোর ভাষায় মন্তব্যও করেছেন। কিন্তু ‘প্রথম আলো’র আগেরটি এবং এবারেরটি- এই দু’টো জরিপেই জামায়াত নিষিদ্ধ করা বিষয়ে মানুষের মতামত নেয়া হলেও, জামায়াত নিষিদ্ধের চেয়েও অনেক বেশি জরুরী এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়- যুদ্ধাপরাধের দায়ে মানবতাবিরোধী অপকর্মে জড়িত সংগঠন হিসেবে জামায়াতে-ইসলামীকে বিচারের মুখোমুখী করা নিয়ে কোনো মতামতই নেয়া হয়নি! এর কারণ কি হতে পারে? পাঠক, কষ্ট করে খুঁজতে হবে না, আমিই বলে দিচ্ছি- গত কয়েক মাসে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ‘প্রথম আলো’র সংবাদ আর উপ-সম্পাদকীয়গুলো নেড়েচেড়ে দেখলে জামায়াতে-ইসলামীকে বিচারের মুখোমুখী করার প্রতি তেমন কোনো তাগাদাই চোখে পড়ে না। আবারও সেই একই ‘এরশাদীয়’ অপকৌশল! জামায়াতে-ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা বিষয়ে ‘প্রথম আলো’র জরিপে এই বিভ্রান্তিকর ‘হ্যাঁ-না’ ভোটাভুটির ফলাফল প্রকৃত অর্থে এই দাঁড়ালো যে- জামায়াত নিষিদ্ধের বিপক্ষে মত দেয়া যে ৭০ শতাংশ মানুষের কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে-ইসলামীর বিচার চান, কিংবা জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এই জরিপ করা সময় যেভাবে প্রশ্নটি করা হয়েছে- ঠিক সেভাবে সরাসরি সরকারের নির্বাহী আদেশে দলটিকে নিষিদ্ধ না করে বরং মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মাটিতে ওই দলটির রাজনীতি করার অধিকার চিরদিনের জন্য তুলে নেয়ার পক্ষে কতজনের মত আছে, অথবা উচ্চ-আদালতের রায়ে যে উপায়ে জামায়াতে-ইসলামীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো- সেরকম পদ্ধতি অবলম্বনে কিছু একটা সিদ্ধান্তে যাওয়া ওই ৭০ শতাংশ মানুষের মধ্যে কতজন আশা করছেন – এসবের প্রশ্নের একটিরও উত্তরও জানার ‍সুযোগ পাওয়া গেল না এই জরিপ থেকে। উপরন্তু, জনগণের যে বিশাল অংশটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে-ইসলামীর বিচার আশা করেন এবং যাদের তীব্র দাবির প্রেক্ষিতে আইনটি সংশোধন করে ব্যাক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো- তাদের সবাইকে সুকৌশলে খাটো করার এক নষ্ট-খেলা হয়ে গেলো এই জরিপের আড়ালে! ‘প্রথম আলো’ কি মনে করে যে, তারা যেটিকে প্রশ্ন কিংবা ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করে সেটির ওপর মতামত সংগ্রহের মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে অনুপাত গুনে ছাপিয়ে দেবেন, সেটাকেই আমাদের ইস্যু হিসেবে মেনে নিতে হবে? আর অধিকাংশ জনগণের মগজে যেটি আসলেই ইস্যু হয়ে বসে আছে, সেটির কোনো খবরই থাকবে না? এমনটা মনে করলে সামনে চরম ধরা খেতে হবে, অতীতে যারা এমনটা ভেবেছে- প্রত্যেকে ধরা খেয়েছে, মনে করে দেখুন।
জরিপ ব্যবহার করে জামায়াত নিয়ে ধোঁয়া ছড়ানোর এখানেই শেষ নয়। জরিপের একটি অংশে মতামত নেয়া হয়েছে- যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের পর জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে, যার বিপক্ষে ৮৬ শতাংশ এবং পক্ষে ১৩ শতাংশ মানুষ মত দিয়েছেন। এই সমীকরণ হয়তো বোকার মতো আমিও সাত-পাঁচ না বুঝে মেনেই নিতাম, যদি না চতুর ‘প্রথম আলো’ বিএনপি, আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টির পাশাপাশি নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার পরও এবারের জরিপে জামায়াতে-ইসলামীর জনসমর্থন বিচারের বোকামিটুকু না করতো। করেছে, বেশ করেছে, আমি সূত্র পেয়ে গিয়েছি! জরিপের হিসাব অনুসারে, দলীয় সমর্থনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী’র সমর্থক যদি মাত্র ২.৯ শতাংশই হয়ে থাকেন, তাহলে জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন- এমন মানুষের সংখ্যা কেমন করে ১৩ শতাংশ হয়? জামায়াত সমর্থনকারী ২.৯ শতাংশ বাদে জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সমর্থন করা বাকি ১০.১ শতাংশ মানুষ কারা? তারা কি বিএনপিকে সমর্থন দেয়া সেই ৫০.৩ শতাংশের অংশ? কিন্তু এটা তো বাস্তবে হওয়ার কথা নয়! তাই যদি হবে, তাহলে তো একের পর এক জামায়াত নেতাদের রায় ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে বিএনপি’র কিছুটা হলেও অংশগ্রহণ দেখা যাওয়ার কথা ছিলো! কিন্তু তা তো মোটেও দেখা যায়নি, বরং ক্ষমতার জোটসঙ্গী হয়েও রায়ের ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে এবং হরতালে কোনো ধরনের সমর্থন ঘোষণা না দিয়ে, জামায়াতে-ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি’র দীর্ঘ-প্রেমময় সম্পর্কটি অনেকটা যেন বিচ্ছেদেই রূপ নিয়েছে। হায় রে প্রগতিশীল ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’... জামায়াতের পিঠ-বাঁচাতে আর জামায়াতের কাছে ভালো সাজতে এতটাই বুদ্ধিব্যায়!
সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে নয়, বরং দেশের একজন ক্ষুদ্র নাগরিক এবং বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিন নগদ টাকায় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার একজন নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে ‘‌‌‌‌‌‌প্রথম আলো’ কর্তৃপক্ষের কাছে আমি জানতে চাই- রাষ্ট্রের বা জনগণের ক্ষতি হয় ‌এমন যে কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান অবলম্বন করা কি প্রতিটি গণমাধ্যমের জন্য আবশ্যক নয়? যদি তাই হবে, তবে জামায়াতে ইসলামীর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি জরিপে স্থান দিয়ে এর পক্ষ-বিপক্ষ যাচাইয়ে আপনাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? যদি আরও বেশি মানুষ কিংবা ধরা যাক বেশিরভাগ মানুষই কোনো বিশেষ কারণে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষে মতামত প্রদান করতো, তাহলে কি আপনারা এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিক ও বৈধ হিসেবে আখ্যা দিয়ে দিতেন? অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানুষের মতামত জানার বা নেয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে, জামায়াতে-ইসলামীর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষ-বিপক্ষ অনুসন্ধানে উদ্যোগী হয়ে আপনারা কী বোঝাতে চাইলেন? দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্যই কি শুধু এটা করা? নাকি জামায়াতের হরতালে বিএনপি’র সমর্থন-অংশগ্রহণ না থাকায় জামায়াত প্রশ্নে বিএনপিকে খাটো করার এটিও আরেকটি অপকৌশল? অথবা নাকি জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মতো একটা জঘণ্য বিষয়ের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণ-চেষ্টার দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে এদেশের জনগণের মধ্যে বেড়ে ওঠা অন্য কোনো বিপরীত চিন্তাধারাকে উপহাস করার উদ্দেশ্যও লুকায়িত আছে এর মধ্যে? মাননীয় ‘প্রথম আলো’, তবে কি শেষ পর্যন্ত আপনারা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে উপহাসে মেতে উঠলেন? জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষ-বিপক্ষ অনুসন্ধানের প্রকৃত কারণটির ব্যাখ্যা ‘প্রথম আলো’র কাছ থেকে না পেলে এগুলোই কারণ হিসেবে বুঝে নিতে হবে আমাদের।
পাঠক, এবার বলুন দেখি, যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জামায়াতে-ইসলামীর রাজনীতি বিষয়ে ‘প্রথম আলো’র সাম্প্রতিক এই জরিপে এই যে এতগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্যের কথা এতক্ষণ ধরে জানালাম -এর একটিও কি আদতেই জরিপে উঠে এসেছে? নাকি খুব কৌশলের সাথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উঠিয়ে আনা হয়েছে? রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে-ইসলামীর যেখানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করারই কোনো বৈধতা নেই, সেখানে দলটির জনসমর্থন যাচাই, দলটিকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের কৌশলী প্রয়োগে এটিকে নিষিদ্ধের বিপক্ষে একটি বড় সংখ্যা দাঁড় করানো এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে বিচারের আওতায় আনার গণদাবি থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা, বিএনপি’র প্রতি সমর্থন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করা- একই সঙ্গে এরকম দুটি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বিষয়ের পক্ষে দুটো বড় সংখ্যা প্রদর্শনের মাধ্যমে, প্রকৃতপক্ষে এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তিকর চিন্তা ছড়ানো অপপ্রয়াস, জামায়াতের ক্ষুদ্র সমর্থন সত্ত্বেও তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পক্ষে সমর্থকের চেয়ে চার-গুনেরও বেশি মানুষের মতামত প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে জামায়াতকে ধ্বংসযজ্ঞে ইন্ধন যোগানো –এভাবে একটি মাত্র জরিপ-প্রক্রিয়ার ভেতরে দেশের সবচেয়ে ঘৃণ্য সংগঠন জামায়াতে-ইসলামীকে একইসাথে এতগুলো সুযোগ-সুবিধা পাঁচ বছর ক্ষমতার সঙ্গী বানিয়ে বিএনপিও দিতে পেরেছিলো কিনা সন্দেহ! ‘প্রথম আলো’র মতো জামায়াতের এমন ঘনিষ্ট বন্ধু আর কে আছে? জামায়াত, তোমার কি লাগে আর?
চিন্তা করুন পাঠক- কতটা হাস্যকর হলে এটা সম্ভব যে, জামায়াত আর যুদ্ধাপরাধী নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর খেলায় মত্ত থাকার ফলে চলমান সময়ে জনমনে শঙ্কা ছড়ানো অত্যন্ত জরুরী বেশ অনেকগুলো প্রসঙ্গ জরিপে টানাই হয়নি! এর মধ্যে হেফাজতে ইসলাম, নির্বাচনে ধর্মের অপব্যবহার, মহাজোট সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক –এমন অনেকগুলো বিষয় জরিপে পুরোপুরি অনুপস্থিত! আবার, রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে জনমত যাচাই করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই জরিপে, ড. ইউনুস প্রসঙ্গে মানুষের মতামত ঠিকই নেয়া হয়েছে, এবং সেটিও একপাক্ষিক মতামত। জরিপে ড. ইউনুসের বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে একটি অনুপাত খুঁজে বের করা হলেও, বিভিন্ন বিষয়ে সার্বিকভাবে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো এক বা একাধিক বিষয়ে ড. ইউনুসের ভূমিকা-বক্তব্য-কীর্তি নিয়ে কোনো মত প্রকাশের সুযোগ জরিপে না থাকায়, ড. ইউনুসের ভূমিকা-বক্তব্য-কীর্তি বিষয়ে মানুষের মত বা চিন্তার অনুপাত জানার কোনো সুযোগই নেই। তবে কি ‘ড. ইউনুস সমস্ত ভালো-মন্দের উর্দ্ধে’ ধরে নিয়েই এই জরিপ চালানো হয়েছে?
আসলে সত্যি কথা হলো- ৩০০ আসনে ভিন্ন-ভিন্ন প্রার্থী নির্ভর নির্বাচনী ব্যবস্থায় দুই বা ততোধিক দলের জনপ্রিয়তা এবং ভূমিকা নিয়ে জরিপ করার গুরুত্ব খুব একটা বেশি নয়। নির্বাচন এলে জনগণ দল-বিবেচনায় কতটুকু, আর প্রার্থী-বিবেচনায় কতটুকু সিদ্ধান্ত নেন, তা এই জরিপ করার সময় বিবেচনাই করা হয়নি। বরং জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কোনো একটি বিশেষ মহলের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি ধাপ হিসেবে বিবেচনায় নিলে, এই ধাপটি সফল করার প্রাণপন চেষ্টাই শুধু করা হয়েছে।
‘প্রথম আলো’র এরকম ভূমিকায় আমার কিংবা দেশের মানুষের বিন্দুমাত্র বিচলিত বা চিন্তিত হওয়ার কোনই কারণ নেই, কেননা ‘প্রথম আলো’ যে গোষ্ঠী বা মহলের হয়ে এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে- তারা ‘প্রথম আলো’কে না পেলে অন্য কাউকে দিয়ে এটা করাতোই, ‘প্রথম আলো’ এক্ষেত্রে একটি ‘মধ্য-স্বত্ত্বভোগী এজেন্সি’ ছাড়া আর তেমন কিছুই নয়, যে এজেন্সিটি এখন ওই গোষ্ঠী বা মহল দ্বারা পরিচালিত।
বরং এর চেয়ে অনেক বড় চিন্তার বিষয় হলো জরিপটি প্রকাশের পরদিন এটিকে নিয়ে ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত একটি উপ-সম্পাদকীয়, যার লেখক ছিলেন বিশিষ্ট গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক সবার পরম শ্রদ্ধার ব্যাক্তি সৈয়দ আবুল মকসুদ। তাঁর এই উপ-সম্পাদকীয় নিয়ে আমাদের চিন্তিত-বিচলিত হওয়ার কারণ এই যে, ওই জরিপের মাধ্যমে জামায়াতে-ইসলামী এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে হীন অপচেষ্টাগুলো করা হয়েছে, সেই সবগুলো অপচেষ্টার বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি কলামই যে যথেষ্ট, যা সুচতুর-ধুর্ত ‘প্রথম আলো’ খুব ভালোমতো জানে এবং বোঝে। কিন্তু জাতির বিবেকের ভূমিকায় দৃশ্যমান শুভ্র-পোশাকের যে নীতিবাদ-সত্-ত্যাগী-স্পষ্টবাদী প্রিয় মানুষটি –সেই সৈয়দ আবুল মকসুদ কি কিছুই বোঝেন না? আর তাই শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের এই দুর্ভাগা জাতির বিবেক নিয়েই বিচলিত-চিন্তিত-শঙ্কিত হয়ে পড়ি, আমরা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাই, আমরা নীরবে চোখের জল মুছতে-মুছতে কোলাহলপূর্ণ শাহবাগ প্রজন্ম চত্তরের এক কোনে একাকীত্বের নিদর্শন হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাংলাদেশের অনেক সন্ধিক্ষণের নিরব-সাক্ষী ওই লম্বা তালগাছটার দিকে তাকিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশের এককীত্ব অনুভব করি, বাংলাদেশের জন্য মন খারাপ করি, আর তারপর সেই তালগাছটাকেই জড়িয়ে ধরে বলি, ‘কে বলেছে তুমি একা বাংলাদেশ? এই যে আমরা আছি তো!’
‘প্রথম আলো’, আপানাকে বলছি, শুনতে পাচ্ছেন? কান পেতে মন দিয়ে শুনে নিন... আপনার থাকার কোনই প্রয়োজন নেই, আপনি থাকুন আপনার প্রিয় এজেন্ডা-বন্ধুদেরকে নিয়ে, বাংলাদেশের জন্য আমরা এরকম পিঁপড়া কিংবা মাছি অথবা প্রজাপতির মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাগল প্রেমিক ছিলাম, আছি, থাকবো।

ফেরদৌস আরেফীন,এডিটরিয়ার কোঅর্ডিনেটর, সময় টিভি
arefin78@gmail.com

Friday, October 18, 2013

আমি কেন উপাচার্য হতে পারলাম না! - রাজীব মীর



ঢাকা: শীতের নরম রোদ । বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ে লিকলিকে সাপের মত বয়ে চলা পথ। বন্ধুর সে পথে বগা লেকে অভিযাত্রা। সতেরো জনের পারিবারিক ট্যুরে আমিই একমাত্র বহিরাগত সদস্য। চাঁন্দের গাড়ি দু’টি। আমি যে গাড়িতে সেখানে একজনকে একা পিছনের সিটে বসতে হবে,বসলামও। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করার আগেই ড্রাইভারের পাশের সিট আমার সাথে শেয়ার করলেন তিনি,পাছে আমি বিপন্ন বোধ করি। ভালো লাগায় চোখে পানি চলে এসেছিলো । কী অদ্ভুত এবং সূক্ষ্ম তাঁর মনোদৃষ্টি। বগা লেকের সে ভ্রমণও ছিল কঠিন এবং দুর্গম। পথ চলতে চলতে পরিবারের মধ্যেও ছোট ছোট বিষয়ে একজন মানুষ কতটা গণতান্ত্রিক হতে পারেন, অবলোকন করে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম।পাহাড়ের চূড়া,নদীর তীর,সমুদ্রসৈকত, হাওড়ের নৌকায় তার গোটা পরিবারের সহযাত্রী হয়েছি বহুবার। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড.মো. আনোয়ার হোসেন। বছর কয়েক আগেকার কথা। তার সাথে তখনও আমার পরিচয় হয়নি। অথচ টিভিতে একদিন পুলিশ বেষ্টিত তার কঠিন কষ্টকর মুখাবয়ব দেখে রক্তকণিকাগুলো অস্থির হয়ে উঠেছিলো। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সেনা সদস্যদের অপ্রীতিকর ঘটনার সময় তিনি ছাত্রদের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়ায় কারা নির্যাতনের শিকার হন। এ অবস্থান নেয়াটা অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ ছিল নিঃসন্দেহে।

ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রপ্রেমি শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি আমাদের বুকের মাঝেও স্থান করে নিয়েছিলেন। সেই সময়ের অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এবং সে যাত্রায় মূলত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা পুনঃ বেগবান হয়েছিলো। মনে পড়ে, গত বিএনপি শাসনামলে শামসুন্নাহার হলের ভেতর ছাত্রীদের উপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রকাশকালে পুলিশ তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিলো।

এতো সেদিনের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের উষালগ্নে মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী যার গোটা পরিবার, দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যে পরিবারের কাছে ঋণী, স্বাধীনতার সোনালী স্বপন যার হৃদয়ে অঙ্কিত, যার ভ্রাতা বুক উঁচু করে মৃত্যুকে পরাজিত করেছেন।বলেছেন,‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় কিছু নেই,’।

দেশ নিয়ে লড়বার জন্য যার স্বার্থচিন্তা কাজ করেনি, দেশকে গড়বার জন্য যার লাভালাভের বাসনা জাগেনি– তারই বিরুদ্ধে আজ মহা অভিযোগ, ‘আপনি সরুন’। তার অসততা রয়েছে,পক্ষপাত রয়েছে, তিনি প্রতিশ্রুতি রাখেন না’- যারা এ অভিযোগ এনেছেন পদাধিকার বলে তারা অনেক সম্মানিত, যোগ্য, জ্ঞানী এবং সম-সম্প্রদায়েরই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

দীর্ঘদিন থেকে তারা তাই এই ব্যক্তির উপাচার্য পদকে বিপদে ফেলতে গোষ্ঠীগত ভাবে আত্ননিয়োগ করেছেন, ঘেরাও,অবস্হান ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর দিনের রুটিন কাজ আর রাতের স্বাভাবিক ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। কিন্তু যেখানকার কথা বলছি, সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এর আগের উপাচার্যকেও একই অবস্হার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো এবং সরে যেতে হয়েছিলো। তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগের কমতি ছিলো না। সারা বছর আন্দোলনের জন্য পরিচিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ এ পদ এবং অবস্থানের জন্য লাগসই ভেবে ড.শরীফ এনামুলের স্থলে প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনে এখানে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু ড. শরীফ এনামুল কবীরের মত সুর্নিদ্দিষ্ট কোন অভিযোগ ব্যতিরেকে পুনরায় এখানে কিছু শিক্ষক কর্তৃক উপাচার্য খেদাও আন্দোলন শুরু হলো।

অধ্যাপক আনোয়ারের আত্নসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রখর, তিনি একদিন হুট করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বসলেন। ব্যস,আর যায় কোথা! জাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা তাকে দিনরাত আটকে রাখলো, ছাড়বে না। অভূতপূর্ব সে শিক্ষার্থীপ্রিয়তা ও অফিস অবরুদ্ধতা ।

সরকারের বিশেষ অনুরোধে অনেকক্ষণ গোঁ ধরে থাকবার পর অবশেষে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা থেকে সরে আসলেন, স্বচক্ষে দেখেছি।

অল্প কিছুদিন যেতেই আবার গতানুগতিক একই আন্দোলন,সম্মানিত শিক্ষকগণের। কিছু অভিযোগ আছে, তারা দাবি প্রকাশ করলেন। উপাচার্য অস্বীকার করলেন না, দেখবেন বলে কথা দিলেন, কিন্তু তারা সেটি মানতে নারাজ, মাননীয় উপাচার্যকে দেখে নেয়ার হুমকি দিলেন এই বলে যে, ‘উপাচার্য হটো’। উপাচার্যের বিপক্ষে অভিযোগসমূহ সত্য হতেও পারে এটা আমরা খালি চোখে ভাবছিলাম কিন্তু অভিযোগের প্রকৃতির সাথে উপাচার্যের পদত্যাগের অনমনীয় দাবি কেন যেন অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হলো এবং উপাচার্য মহোদয়ের একটা জাতীয় দৈনিকের কলাম তা আরও স্পষ্ট করলো যে ‘ডাল মে কুচ কালা হে!’

ওখানকার শিক্ষকগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন শিক্ষককে তাদের মাথার উপর চাইবেন না, এটা তাদের অহংবোধে লাগে যে, হয়তো তারা বাইরে অযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন। লাগতে পারে, মেনে নিচ্ছি । কিন্তু সেটা তো অধ্যাপক আনোয়ারের সীমাবদ্ধতা বা দোষ নয়। সরকার তাকে একটি বিশেষ পরিস্থিতির বিষয় বিবেচনা করে সেখানে যেতে অনুরোধ করেছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ধারাবাহিক ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিকে সঙ্গ দেয়ার ক্ষমতাসমপন্ন প্রখর প্রগতিশীল এবং অত্যন্ত যোগ্য একজন সংবেদনশীল শিক্ষককে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। ওখানকার শিক্ষকগণ অনেকেই উপাচার্য পদলোভী হবেন, এটা স্বাভাবিক। সে যোগ্যতা তাদের কারও কারও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সৃজনশীলতাও থাকতে হবে তো, সেটা তাদের আন্দোলনে নেই, প্রকাশেও নেই; বড় একঘেয়ে মনে হচ্ছে। বরং উপাচার্য সেক্ষেত্রে অনেক সৃজনশীল, সস্ত্রীক মাদুর পেতে বসে গেছেন পাল্টা আন্দোলনে।

এর আগে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের লাগানো পদত্যাগের দাবি সম্বলিত ব্যানার বাতাসে ছিঁড়ে নিচে পড়ার পর তারা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই যথাস্থানে টানিয়ে দিয়েছেন, ভাবা যায়!

চলতি সংবাদ এই যে, উভয়পক্ষ মুখোমুখি বসে আছেন,সমাধান নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ পড়াশুনা, সেটি এখন বন্ধ। চলছে, শিক্ষকদের আন্দোলন। তারা শুধু পদত্যাগ চান, কোনও ক্লাস কিংবা পরীক্ষা নয়। কিন্তু অবাক বিষয় হলো আন্দোলন বলতে সেখানে যাদেরকে বোঝানো হয়, সেই আনু মুহাম্মদ, মানস চৌধুরী, নাসিম আকতার হোসাইন কেউই এ উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনে নেই। তারা এ আন্দোলনকে যৌক্তিক ভাবছেন না ,সম্পৃক্তও হচ্ছেন না !

আমি নিজে অধ্যাপক আনোয়ারের সাথে পরিচিত হই আশৈশব কৌতূহল বশে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার একবার এক্সটারনাল মেম্বার হিসেবে গেলেন। প্রাণ রসায়নের সেই সময়ের চেয়ারপার্সন জনাব মু. গোলাম কবীর আমাকে এ দুর্লভ ব্যক্তির সাথে পরিচয়ের সুযোগ করে দেন । বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও আমার দু’একটি কবিতা তার মনে ধরে এবং ক্রমে আমি তার পরিবারের আপনজন হয়ে উঠি। ভরা পূর্ণিমায় আমার ডাক পড়ে,একসাথে পূর্ণিমা দেখি,গান গাই,গান শুনি।

বিশেষ কোন ভালো লাগার দিনে বাঁশিওয়ালা আসে, বাঁশি বাজে। গোটা পরিবার একসাথে উপভোগ করে। তাদের পারিবারিক বন্ধন তো অন্য রকম। ভাইবোনদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ঈর্ষণীয় রকমের ভালো। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই তারা ভীষণ রোমান্টিক, অকল্পনীয়। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়ে যার অগাধ দখল, তার মুখে কবিতা,গান, চিত্রকলার দারুণ সব অভিব্যক্তি। সুন্দর বাচনভঙ্গি, স্পষ্ট উচ্চারণ আর তার দৃঢ় বাক্যপ্রয়োগ শুনে মন্ত্রমোহিত হতে হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে তার ভাষণ ছিলো অতুলনীয়, অত্যন্ত উদ্দীপক। সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত সরল হাসিখুশি এ প্রাণবান মানুষ আজ সম্মানাক্রান্ত। একা লড়ছেন। বাংলার বীর কর্ণেল তাহেরকে যখন ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হয়, তখনও তিনি জেলের ভিতর একা দাঁড়িয়েছিলেন। আজও।

কিন্তু স্বাধীন দেশে এটা তো হওয়ার কথা নয়। শরীফ এনামূল কবীর, আনোয়ার…এর পরে কে? যারা আন্দোলন করছেন, তারা কি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শী শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে চাচ্ছেন? যদি না চান তবে তাদের আন্দোলন কি দল নিরপেক্ষ উপাচার্য চেয়ে? তাদের দাবির সারাৎসার কিন্তু অস্পষ্ট। ইতিহাস তো বলে বাংলাদেশের সব সঙ্কটে অধ্যাপক আনোয়ার মিছিলের সর্বাগ্রে ছিলেন,কখনও পিছপা হননি। দেশের জন্য পারিবারিক আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তেই বা তার মত আর কয়জনের আছে? উপাচার্য ভুল করতে পারেন না,করেননি বা করছেন না,এটা বলছি না। বলছি ত্যাগের ইতিহাস তো তার রক্তে, সেখানে যদি ছোট কোন ভুল থেকেও থাকে, প্রতিবাদ হবে না কেন ,অবশ্যই হবে। কিন্তু তাই বলে একবারে সরে যেতে হবে, এ দাবি খুব একটা জনগ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি? কে আসবেন ওনার জায়গায়! ইতিহাসের আত্মত্যাগীকেই মেনে নিচ্ছেন না! কাকে মানবেন, কার আত্মত্যাগ তার সাথে তুলনীয়? যদি যোগ্যতার কথা আসে, অধ্যাপক আনোয়ারের সমান যোগ্য হয়তো কেউ থাকতে পারেন,আত্মত্যাগী কয়জন আছেন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত উপাচার্যের বন্ধ্যাত্বের সংস্কৃতির অবসানও তো তারই অবদান! তিনিই তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সময়ের প্রথম নির্বাচিত উপাচার্য। আমরা কি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিনের মত কাউকে চাচ্ছি, যিনি দেশ তো দূরের কথা, নিজের সমর্থিত দলের জন্যও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন? নাকি এটা নিখাদ মন খারাপের আন্দোলন,আমি কেন উপাচার্য হতে পারলাম না! উপাচার্য হিসেবে উনি থাকবেন অথবা থাকতে পারবেন কি না জানি না, কিন্তু পদত্যাগের দাবির বিরুদ্ধে ওনার অবিচল অবস্থান তার দীর্ঘ সংগ্রামী সত্যের কথাই শুধু জানান দেয়। পালিয়ে আসা কোন বিপ্লবীর কাজ হতে পারে না, উনি এটা করবেনও না- আমি নিশ্চিত। উপাচার্য পদ ছেড়ে দিলেই উনি সম্মানিত আর ধরে রাখলে এটা উনাকে ছোট করবে, উচ্চতার পরিধি এভাবে অনুধাবনযোগ্য নয়।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দেশ,বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধার দেশ। অতএব, মুক্তিযোদ্ধা ড. আনোয়ার হোসেন আপনাকে বলছি, লড়াই করা আপনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব, স্যার! দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সচেতন শিক্ষার্থী ও অগণিত মানুষের জন্য অতীতের মত এখনও সত্যের হাল ধরে রাখুন, ছাড়বেন না! প্লিজ।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Sunday, October 13, 2013

ষড়যন্ত্রের রাজনীতির থলের বেড়ালটি বেরিয়ে আসছে - আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী



প্রবীণ এক বাম নেতার এই সাক্ষাতকারটি প্রথমে আমার চোখে পড়েনি। কোন প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাতকারটি বেরোয়নি। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে বেরিয়েছে, যেটি সচরাচর আমার চোখে পড়ে না। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনে সাক্ষাতকারটি পড়লাম। দৈনিকটির ৫ অক্টোবরের সংখ্যায় তা বেরিয়েছে। ছোট সাক্ষাতকার। তবু আমার জন্য খুবই আগ্রহোদ্দীপক। কারণ, তিনি আমার কলেজ জীবনের খুবই প্রিয় শিক্ষক। পরবর্তীকালে তিনি হন দেশের এক সময়ের বৃহত্তম বাম গণতান্ত্রিক সংগঠন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এখন বিরানব্বই বছর বয়স। তাঁকে এখন বলা চলে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পিতামহ। তাঁকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি।
ন্যাপের সেই সুদিন এখন আর নেই। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এখনও দলের সভাপতি আছেন বটে, বয়সাধিক্যে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবু এই বয়সেও তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনা ও পরামর্শ দ্বারা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। তাঁর কথা কেউ শুনছে কী শুনছে না, তার পরোয়া করছেন না। তিনি এখনও আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি বাতিঘর। ৫ অক্টোবর ঢাকার বহুল প্রচারিত দৈনিকটিতে আলাপচারিতা বিভাগে প্রকাশিত তাঁর দেয়া সাক্ষাতকারটিতেও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে তাঁর প্রকৃত সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। এ জন্যই সাক্ষাতকারটি আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি।
এই সাক্ষাতকারটি পড়তে গিয়ে আমি এমন একটি তথ্যের মুখোমুখি হয়েছি, যা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো নব্বই-উর্ধ প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার মুখ থেকে বের না হলে আমার পক্ষেও বিশ্বাস করা সহজ হতো না। এ কথা অস্বীকার করব না, আমি ড. কামাল হোসেন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কঠোর সমালোচক। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনের। কারণ, তিনি এক সময় বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুই তাঁকে হাত ধরে টেনে এনে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন। পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে তিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতির অবশ্যই সমালোচনা, এমনকি বিরোধিতাও করতে পারেন। কিন্তু হাসিনার প্রতি ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী চক্রান্তের শিবিরে গিয়ে সরাসরি যোগ দিতে পারেন, এটা আমার কাছেও ছিল অকল্পনীয়।
ঢাকার দৈনিকটির ৫ অক্টোবরের সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আলাপচারিতায়’ দেশের বয়োবৃদ্ধ প্রবীণতম নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেছেন, ‘আমি যে রাজনীতি করি, তা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নয়। এটি সরল রাজনীতি। আমি ষড়যন্ত্রের মধ্যে নেই। ড. কামাল হোসেন এসেছিলেন আমার কাছে জাতীয় সরকারের রূপরেখা নিয়ে। আমার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মধ্যে নেই। আমি রাজি হইনি। আমার রাজনীতির অর্থ হচ্ছে সত্য কথা বলা, সড়ক দিয়ে হাঁটা এবং ডাল দিয়ে খাবার খাওয়া। ড. কামাল হোসেন ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রধান হিসেবে কাজ করতে ইচ্ছুক। সে কারণে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন।’
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের ‘আলাপচারিতায়’ এই বক্তব্যটি দেশের অনেক মানুষের কাছে ড. কামাল ও ড. ইউনূস জুটির বর্তমান কার্যকলাপ ও আচার-আচরণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেবে। আমি নিজেও দীর্ঘদিন যাবত এই জুটির কার্যকলাপ ও বক্তৃতা-বিবৃতির সমালোচনা করলেও সবসময় ভেবেছি, এরা শেখ হাসিনার প্রতি প্রচ- বিরাগবশত দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের যে ক্ষতি করছেন, তা হয়ত নিজেরাও উপলব্ধি করছেন না। কিন্তু তাঁরা যে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত গোঁ চরিতার্থ করার জন্য সরাসরি ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে যোগ দিতে এবং এতটা নিচে নেমে যেতে পারেন, তা কল্পনাও করিনি। আওয়ামী লীগ রাজনীতির একটা বড় দুর্ভাগ্য, এই রাজনীতিতে এক মোশতাকের তিরোভাব না ঘটতেই আরেক মোশতাকের আবির্ভাব হয়।
একটি তথাকথিত ‘জাতীয় সরকারের রূপরেখা’ পকেটে নিয়ে ড. কামাল হোসেন দেশে যা করে বেড়াচ্ছেন, তা যে ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি’ এটা বুঝতে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো রাজনীতির বটবৃক্ষের কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ড. কামাল হোসেনকে বলে দিয়েছেন, ‘আমি ষড়যন্ত্রের মধ্যে নেই’ এবং তাদের ষড়যন্ত্রে দোয়া (সমর্থন) দিতেও রাজি নন। শুধু অধ্যাপক মোজাফ্ফর নন, ড. কামাল হোসেন নাকি তাঁর জাতীয় সরকারের রূপরেখা (যে সরকারে তিনি কিংবা ড. ইউনূস প্রধান হবেন) নিয়ে দেশের আরও কয়েকটি ডান এবং বাম গণতান্ত্রিক দলের নেতার দরজায় গিয়ে দোয়া লাভের জন্য ধর্ণা দিয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই একবাক্যে না বলে দিয়েছেন।
শেষপর্যন্ত তিনি সম্ভবতঃ তাঁরই মতো জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত কয়েকজন নেতাকে তাঁর বিতর্কিত রাজনীতিতে সঙ্গী করতে পেরেছেন। এরা হলেন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ। এদের অধিকাংশই সচরাচর নির্বাচনে জেতেন না। কারও কারও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। ড. কামাল হোসেনকে বঙ্গবন্ধু একবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদে জিতিয়ে এনেছিলেন। তারপর আর কোনও নির্বাচনে জেতেননি। শেখ হাসিনা তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছিলেন। সেখানেও বিএনপির বিচারপতি সাত্তারের কাছে হেরেছেন। গত নির্বাচনে তাঁর গণফোরামের প্রার্থীদের কারও জামানত রক্ষা পায়নি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রেকর্ড তো অনুরূপ উজ্জ্বল। তেজারতিতে তিনি দক্ষ। তবুও রাজনীতিতে ঢোকার খুব শখ। কিন্তু রাজনৈতিক মূলধন কিছুই নেই। ছাত্রজীবন থেকে বাংলাদেশের কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনের ত্রিসীমানায় তিনি ছিলেন না। গরিবের নামে ব্যবসা করে নিজে বিরাট ধনী হয়েছেন। গরিবের বাড়িতে ভুলেও যান না। তাঁর জেট সেট লাইফ। রাজারাজরাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের তিনি বিশ্বস্ত অনুচর।
ফলে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের প্রভুরা তাঁকে খুশি হয়ে অর্ধেক নোবেল পুরস্কার দিয়েছে এবং এখনও বড় বড় পুরস্কার দিচ্ছে। অর্ধেক নোবেলজয়ী হওয়ার পর আনন্দের এভারেস্ট চূড়ায় উঠে ওই নোবেল পুরস্কারকে মূলধন করে তিনি নূতন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। এই দল গঠনের এক মাসের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর দল শেষপর্যন্ত ‘কাকতাড়ুয়ার দল’ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি রাজনীতি করার আগেই জনগণ কর্র্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাজনীতি ছাড়েন।
রাজনীতির সদর দরজা দিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারেন না, তাঁরা পেছনের দরজা দিয়ে সেই ক্ষমতায় যেতে চাইবেন, তা আর এমন কী বিস্ময়ের ব্যাপার। তবে কামাল হোসেনদের ক্ষেত্রে বিস্ময়ের কথা এই যে, তাঁরা গণতন্ত্র, সুশাসন, স্বচ্ছ রাজনীতি এ সবের কথা বড় বেশি বলেন। গণতন্ত্র, সুশাসন ও স্বচ্ছ রাজনীতির পথ তো হচ্ছে জনগণের কাছে যাওয়া, স্বচ্ছ, বাস্তব ও সুস্থ কর্মসূচীর মাধ্যমে তাদের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার ম্যান্ডেট চাওয়া। সে জন্যে নির্বাচনে যাওয়া।
ড. কামাল হোসেনরা গণতন্ত্রের এই সদর দরজা দিয়ে না হেঁটে কেন পেছনের দরজা খুঁজছেন এবং তথাকথিত জাতীয় সরকারের একটি রূপরেখা (যেটি আসলে ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা) পকেটে নিয়ে একশ্রেণীর প্রবীণ-নবীন রাজনীতিক নেতার বাড়িতে ধর্ণা দিয়ে তাদের দোয়া চেয়ে বেড়াচ্ছেন? জনগণ কর্তৃক বার বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই জাতীয় সরকার নামক একটি অনির্বাচিত সরকার গঠন দ্বারা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ভূতটি ড. কামাল হোসেনদের মাথায় চেপেছে।
মজার ব্যাপার এই যে, মাত্র গত ২৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার) বরিশালে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘...এবার দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে ছাড়ব।’ এটা খুবই ভাল কথা। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে যদি কামাল হোসেন সাহেবরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে পারেন, তাহলে তো বলব, তাঁরা গণতন্ত্রের পথেই হাঁটছেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও জাতীয় সরকার তো এক কথা নয়।
ড. কামাল হোসেনরা কোনটি চান? যদি সত্যিই তাঁরা বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সমর্থন করেন, তাহলে এই দাবি আদায়ের জন্য বিএনপি চলতি মাসেই যে আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে, সে আন্দোলনে যোগ দিন। তা না করে পর্দার আড়ালে আবার জাতীয় সরকারের খেলা খেলছেন কেন? জনগণের কাছে না গিয়ে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো প্রবীণ নেতাদের দরজায় গিয়ে গোপন ধর্ণা দিচ্ছেন কেন? আবার জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে নিজে কিংবা ড. ইউনূসের সেই অনির্বাচিত জাতীয় সরকারের প্রধান হওয়ার আগাম ইচ্ছা ব্যক্ত করছেন কেন?
ড. কামাল হোসেন ও ড. ইউনূসের জুটির নেতৃত্বে চালিত তথাকথিত সুশীল সমাজের মনস্তত্ত্বটা বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জনগণের আস্থা তাদের ওপর নেই, জনগণ কখনই তাদের ভোট দেবে না এবং নির্বাচন এলে যত খারাপ বা মন্দ হোক আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকেই তারা ভোট দেবে। দেশের মানুষ এই দল দুটিকে বোঝে। এই দুই দলের নেতারা যত অপরিশীলিত ভাষায় বক্তৃতা দেন, তার অর্থ তারা বোঝে। আর ড. কামাল হোসেন বা ড. ইউনূস সাহেবরা গণতন্ত্রের অভিধান থেকে যে সব ভাল ভাল কথা বেছে নিয়ে জনগণের নাগালের বাইরের এভারেস্ট চূড়া থেকে কথা বলেন, তার অর্থ তারা বোঝে না। সে সব কথায় আস্থা স্থাপনও করে না।
অনির্বাচিত জাতীয় সরকার গঠন ড. কামাল হোসেনের বহুদিনের একটি পেট থিয়োরি। বার বার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়ে এবং জনগণকর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রবল রাজনৈতিক হতাশা থেকে সম্ভবতঃ তাঁর মনে এই থিয়োরিটির জন্ম। বহুকাল আগে তিনি তাঁর ‘সুশীল সমাজ’ দ্বারা এই থিয়োরিটি একবার জনসমক্ষে এনেছিলেন। দেশের মানুষ এই গণঅধিকার বর্জিত সরকারের থিয়োরি গ্রহণ করেনি। তখন এক বাম রাজনীতিক প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘গু মড়াবৎহসবহঃ, মড়ড়ফ ড়ৎ নধফ, রং নবঃঃবৎ ঃযধহ ঁহবষবপঃবফ মড়ড়ফ মড়াবৎহসবহঃ’ (আমার সরকার, ভালোমন্দ যা-ই হোক, অনির্বাচিত ভালো সরকারের চাইতে ভালো)।
নিজের পছন্দের, নিজের ভোটাধিকার দ্বারা গঠিত সরকার মন্দ হলেও জনগণ সেই সরকারই চায়। অন্যের পছন্দের এবং অন্যদের ইচ্ছায় গঠিত সরকার ভালো হলেও জনগণ তা পছন্দ করে না। এটা গণতন্ত্রের ইতিহাসের আদি সত্য।
ড. কামাল হোসেনদের অনেক বিদ্যাবুদ্ধি। কিন্তু এই সত্যটা তাঁরা বোঝেন না। আর বোঝেন না বলে জনগণের কাছে পৌঁছতেও পারেন না। এদিকে, ক্ষমতায় যাওয়ার অদম্য লিপ্সা তাদের তাড়িত করে বেড়ায়। তখন ক্ষমতার লোভে বিদেশী সাহায্য ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে তাঁরা দেশ এবং গণতন্ত্রের সমূহ সর্বনাশ করেন। আমার আশঙ্কা, ড. কামাল হোসেনদের বর্তমান ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দেশের জন্য এক অকল্যাণকর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে।
ঢাকার বহুল প্রচারিত দৈনিকটিতে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের আলাপচারিতার বক্তব্য পাঠের আগেই আমার এক লেখায় ড. কামাল হোসেন ও ড. ইউনূসের বর্তমান কার্যকলাপ সম্পর্কে আমার সন্দেহের কথা প্রকাশ করেছিলাম। লিখেছিলাম, বাংলাদেশে কারজাই অথবা জারদারি মার্কা একটি সরকার অনির্বাচিত জাতীয় সরকার হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য যে তৎপরতা চলছে, সেটি সফল করার লক্ষ্যে এই সুশীল চক্রের এক নেতা ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্র নেতাদের দরবারে তাদের সাহায্য ও সমর্থনের আশায় ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে, অন্য নেতা দেশের ভেতরে সেই জাতীয় সরকারের নীলনক্সায় রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাইরে তাঁরা দেখাচ্ছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে সমর্থন দানের জন্যই দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা করছেন।
এরা হয়ত ভাবতে পারেননি, দেশের বাম রাজনীতির এক বটবৃক্ষ নেতা এমন সোজা সরল ভাষায় তাদের গোপন তৎপরতার কথা ফাঁস করে দেবেন এবং তাকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আখ্যা দেবেন। ড. কামাল হোসেন জানেন কিনা জানি না, তিনি রাজনীতির রেসের মাঠে পরাজিত ও প্রত্যাখ্যাত ঘোড়ায় পরিণত হয়েছেন। বিদেশীরা তাঁকে নিয়ে খেলতে পারে, কিন্তু ক্ষমতায় বসাবে না। তিনি এখন তাদের বাতিল ও ব্যর্থ নেতাদের তালিকায় আছেন। তিনি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী থেকে কাদের সিদ্দিকী পর্যন্ত যাদের সঙ্গে জুটিয়েছেন তাঁরাও এই তালিকাভুক্ত নেতা। এই দলে নতুন মুখ ড. ইউনূসের। কিন্তু মাটিতে তাঁর পা নেই। তিনি শাখামৃগের মতন। শাখামৃগের ওপর কেউ নির্ভর করে না। তাকে কলা দেখিয়ে ব্যবহার করে মাত্র।

লন্ডন, ৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১৩

Monday, October 7, 2013

হেফাজতি জঙ্গী সংগঠক মুফতি ইজাহারের গ্রেনেড :টার্গেট প্রধানমন্ত্রী? -সুমি খান


১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ আগষ্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা সহ ৪৮ বার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এ দেশে। এর পর ও প্রশাসনের জঙ্গী প্রীতি দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
চট্টগ্রামের লালখানবাজারে হেফাজতের নায়েবে আমির,জমিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং নেজামে ইসলামী পার্টির সভাপতি মুফতি ইজাহারের জমিয়াতুল উলুম আল মাদ্রাসায় সোমবার সকাল পৌনে ১১টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত একজন রাতে মারা গেছে। একজনের হাতের পাঁচটি আঙ্গুল উড়ে গেছে। মাদ্রাসার ওই কক্ষটি থেকে তিনটি তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে।
রাতে তাকে তার পুত্র হারুণ ইজাহার সহ পালাতে সহায়তা করার পর থানায় মামলা করা হলো, তল্লাশী করা হলো তার কক্ষ। ১১ বোতল এসিড সহ বেশকিছু বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর পর ও মুফতি ইজাহার ও তার ছেলে বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে ‘আইপিএস’ ‘ ইউপিএস’ বিস্ফোরণ সহ নানান গল্প ফেঁদে বসলেন! পুলিশ ও নীরবে মেনে নিলেন সব! এমন অথর্ব পুলিশ কর্তাদের পুষছে কেন প্রশাসন- সেটা একটা প্রশ্ন বটে। প্রশ্ন উঠে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন কি জঙ্গী ইজাহারের কেনা ? এতোবড়ো গ্রেনেড বিষ্ফোরণের ঘটনার পর কেন তাকে সারাদিন আগলে আগলে রাখা হলো?
জঙ্গীবাদী হেফাজত নেতা মুফতি ইজাহার ‘তালেবান আফগানিস্তানের জান্নাত দেখে এলাম’শীর্ষক প্রবন্ধে ১৯৯৮ সালের অক্টোবর-নবেম্বর সংখ্যা ‘মাসিক দাওয়াত’ নামের ইসলামী পত্রিকায় নিজেই এক সময় আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে কাজ করার কথা লিখেছিলেন । নিজেই গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন আফগানিস্তান সফর ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে যোগাযোগের বিস্তারিত গল্প। র্যা ব সদর দপ্তরে ইজাহার কে আটক করে আনার পর জঙ্গী তৎপরতায় নেতৃত্বের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ইজাহার। তবু কোথায় প্রশাসনের অসহায়ত্ব? কার কাছে?
জঙ্গী তৎপরতার অভিযোগে কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছেন মুফতি ইজাহার। রাউজানের একটি গোপন আস্তানায় জঙ্গী প্রশিক্ষণের অভিযোগে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে সর্বশেষ গ্রেফতার করে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যা ব। র্যাসবের তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় চট্টগ্রামের রাউজান থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইন মামলায় মুফতি ইজাহারসহ হুজির আট প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়। আদালতে মামলার নথিতে তদন্ত কর্মকর্তা তখন উল্লেখ করেছিলেন, দেশে নাশকতামূলক কর্মকা- চালাতে হুজির প্রশিক্ষকের সহযোগিতা ও মদদ দিয়ে নগরীর লালখানবাজার আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং নেজামে ইসলামী পার্টির সভাপতি মুফতি ইজহার রাউজানে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করছে। হুজির সদস্যদের এ ক্যাম্পে রাতের আঁধারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাউজান গোদারপাড় পাহাড়ী এলাকা থেকে হুজির পাঁচ প্রশিক্ষককে গ্রেফতার করা হলে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে তাদের নির্দোষ দাবি করে মুক্তির দাবি জানান মুফতি ইজাহার। ওই দিনই লালখানবাজার মাদ্রাসা থেকে মুফতি ইজাহারকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ঢাকায় র্যা বের ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আফগানিস্তানে তৎকালীন শাসক মোল্লা ওমরসহ তালেবানি নেতা ও ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার মুল আসামী মুফতি হান্নানের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকার কথা স্বীকার করেন। আফগানিস্তানে মোল্লা ওমরের সঙ্গে তার সাক্ষাত হওয়ার কথা জানান জিজ্ঞাসাবাদে। ঘটনাস্থলে তখন মুফতি ইজাহারসহ গ্রেফতার হওয়া হুজির প্রশিক্ষকরা বিস্ফোরক তৈরি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু প্রশিক্ষকের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হুজির সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর প্রমাণও মেলে। এসবের ধারাবাহিকতায় সোমবারের বিষ্ফোরণের ঘটনা প্রমাণ করে আত্মঘাতী জঙ্গী সদস্যদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছিল বোমা তৈরির মাধ্যমে। এছাড়া মুফতি ইজহারের আরেক ছেলে মুসা বিন ইজহারও জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগে আটক হয়েছিলেন।
এসব নিয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছি, অনেক লেখা লিখি করেছি। বারবার প্রশাসন তাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে – কিন্তু কেন? কার বা কিসের প্রভাবে? সারা জাতিকে এদের জঙ্গীবাদ আর বোমাবাজের হুমকির মুখে ঠেলে বিপন্ন করবেন ই যদি, পুলিশ প্রশাসনের কি দরকার? সোমবারের এই ভয়ংকর ঘটনার পর ও বালিতে মুখ গুঁজে আছে প্রশাসন । এর ভয়াবহ পরিণতি ঠেকাতে পারবেন তো তারা?

চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী তার জনসভায় অনেক বার বলেছেন, লালখানবাজারে উগ্রবাদী এ নেতার মাদ্রাসায় জঙ্গী প্রশিক্ষণ হয়। যেখান থেকে ২০ হাজার লোক আফগানিস্তান যুদ্ধে গেছে। ফিরে আসে ১০ হাজার। ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে ও তথ্য প্রমাণ নিয়ে একই অভিযোগ বহুবার তোলা হয়েছে। দু’একবার আটক হওয়া ছাড়া অপরাধের শাস্তির কোন উদাহরণ দেখেনি সাধারণ মানুষ।
কেবল আলোচনা নয় এবার পুরোপুরি ফেঁসে গেছেন উগ্রবাদী নেতা ও তার বিতর্কিত সেই মাদ্রাসা। যেখানে বিস্ফোরণে পাঁচ ছাত্রের গুরুতর আহত , পরবর্তীতে একজনের মৃত্যু ও গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। জেগে জেগে যেন ঘুমের ভান করছেন পুলিশ প্রশাসন।
অবিলম্বে ইজাহারসহ জঙ্গী নেতাদের আটক করে হেফাজতীদের মাদ্রাসায় অভিযান শুরুর দাবি তুলেছে ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো। বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিস্ফোরক দলের তদন্তে বেরিয়ে পড়েছে আলামত। বিস্ফোরক দ্রব্যের কারণেই ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। আগামী ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে সফর করবেন। এর আগে মাদ্রাসায় এ ধরনের বিস্ফোরক পাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করেছে জঙ্গীরা তাদের হত্যাযজ্ঞ সফলে তৎপর।মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে বিস্ফোরণস্থল পরীক্ষা করে পুলিশ জানিয়েছে, সেখানে বিস্ফোরকের ‘বড় ধরনের মজুদ’ ছিল। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, বিস্ফোরণ ঘটার পর দমকল বাহিনী আগুন নিভিয়েছে। ছাইয়ের নিচে বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। তিনি নিশ্চিত হয়ে বললেন সেখানে বিস্ফোরক দ্রব্যের বড় ধরনের মজুদ ছিল। হাতে তৈরি শক্তিশালী কিছু গ্রেনেড আছে, যা বেশ বিপজ্জনক স্বীকার করে তিনি সাংবাদিক দের চাপ এড়াতে বললেন, “সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে”।


মুফতি ইজহার ও তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে জঙ্গী কর্মকান্ডের অভিযোগ সবার জানা। তবু ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকালে চট্টগ্রামের হেফাজতি ইসলাম নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা সফরকরেন অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার টিম বলটনিকফ। ২০০৯ সালে মার্কিন দুতাবাসে হামলা করার প্রস্তুতিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আটককরেছিলেন ইজাহার। তবু বিদেশী দূতাবাসের প্রতিনিধি রা বিভিন্ন সময়ে সফর করেছে এই মাদ্রাসা।নেজামে ইসলামী পার্টির এই দুই সংগঠক ১৮ দলেরও নেতা। এ কারণেই হয়তো তাদের তোয়াজ করে চলে সবাই। যে কারণে দিনে দিনে এদের অপতৎপরতা বেড়েই চলেছে, যা আমাদের দেশের জন্যেই শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়া সহ সারা বিশ্বের জন্যেই উদ্বেগজনক।
হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা জঙ্গীবাদের দায়ে অভিযুক্ত মুফতি ইজহারের মাধ্যমে সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদের মাঠে নামার খবর প্রকাশ হয়। ইজাহারের মাধ্যমে হেফাজতকে শক্তিশালী করার বিষয় নিয়ে হরকত-উল-জিহাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু নেতার বৈঠক হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। শীঘ্রই ওলামা সম্মেলনের নামে হেফাজতকে সক্রিয় করার কৌশল নিয়েছে জামায়াত। আহমদ শফী আমির থাকলেও হেফাজতকে নেতৃত্ব দেয়ার কাছে মূল দায়িত্ব পালন করছেন মুফতি ইজহারুল ইসলাম। উদ্দেশ্য যে কোন ভাবে মহাজোট শাসন কালের পরিসমাপ্তি ঘটানো। সেটা যদি সম্ভব হয় বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা কে হত্যার মধ্যে দিয়ে –তাহলে তো কেল্লাফতে!! যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাবন্দী দের পরিবার থেকে বড়ো অংকের টাকা ও তিনি নিয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক সাইট ফেসবুক এবং ওয়েব সাইটে ছবি এবং তথ্য প্রচার হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মুফতি ইজহারুল ইসলামের লালখান বাজার মাদ্রাসায় বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে আহত হাবিব (২৫) নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার গভীর রাত দুইটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এদিকে একই বিস্ফোরণে আহত নূরুন্নবী নামে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এক ছাত্রের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বিস্ফোরণের পর আহত হাবীব হালিশহর জেনারেল হাসপাতাল নামে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে গোপনে চিকিৎসা নেওয়ার সময় সোমবার দুপুরে পুলিশের হাতে আটক হয়। আর নূরুন্নবীও চিকিৎসাধীন অবস্থায় আটক হয়।
ঘটনার পর পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার বোমা বিস্ফোরক দল ঘটনাস্থলে যায়। সেখান থেকে প্রথমে সীসাযুক্ত মার্বেল ও কাচের টুকরা উদ্ধার করা হয়। কিন্তু পুলিশ সীসাযুক্ত মার্বেল পাবার পরও সেখানে বিস্ফোরকের আলামত উদ্ধারের বিষয়টি চেপে যাবার চেষ্টা করেন। পুলিশ মাদ্রাসায় গেলেও মুফতি ইজহারুল ইসলাম মূল ফটকের সঙ্গে লাগানো বৈঠকখানায় বসে দীর্ঘক্ষণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় মুফতি ইজহার দাবি করেন, ল্যাপটপের চার্জার বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটেছে। তিনি কোন ধরনের বোমা বানানোর কথা অস্বীকার করেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে মুফতি ইজহারুল ইসলামকে তার বৈঠকখানায় নামাজ পড়তে দেখা গেছে। এসময়ও তার বৈঠকখানার সামনে পুলিশের কোন নজরদারি দেখা যায়নি।ঘটনাস্থলে অবস্থান করে দেখা গেছে, পুলিশ অভিযান চালানোর জন্য ফোর্স জড়ো করতেই প্রায় আধঘণ্টা সময় পার হয়ে যায়। এর মাঝে নির্বিঘ্নে আত্মগোপনে চলে যান মুফতি ইজহার। এর আগে দুপুরেই মাদ্রাসা ছেড়ে পালিয়ে যান হারুন ইজহার।

সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে প্রায় ১০ প্লাটুন পুলিশ পুরো মাদ্রাসা ঘিরে অভিযান শুরু করে। প্রথমেই মাদ্রাসার শ্রেণীকক্ষে অভিযান শুরু করলেও বৈঠকখানার যেখানে দীর্ঘক্ষণ মুফতি ইজহারুল ইসলাম বসেছিলেন সেখানে পুলিশের কেউ যাননি।
রাত পৌনে ১০টা পর্যন্ত পুলিশ মাদ্রাসার সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে প্রতিটি ভবন, ছাত্রাবাস, মুফতি ইজহারের বাসায় অভিযান চালায়। মুফতি ইজহারের বাসা থেকে ১৮ বোতল পিউরিক এসিড জব্দ করা হয় বলে জানান নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) হারুন অর রশীদ হাজারী।

রাতে তিন ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান নাটক চালিয়েছে পুলিশ। এসময় জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বহুল আলোচিত ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মুফতি ইজহার ও তার ছেলে হারুন ইজহার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দিনভর মুফতি ইজহার মাদ্রাসার ভেতরে প্রকাশ্যে অবস্থান করলেও পুলিশ তাকে আটক কিংবা হেফাজতে নেয়ার কিংবা নজরদারিতে রাখার কোন পদক্ষেপই নেয়নি। অভিযোগ উঠেছে, দিনের আলোয় মুফতি ইজহারকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়ে রাতের আঁধারে পুলিশ তল্লাশি অভিযানের নামে নাটক করেছে।
যে পাঁচজনকে হ্যান্ডগ্রেনেড তৈরির কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করেছে-তারা হলেন মাদ্রাসার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক তফসির আহমেদ ,হেফজখানা শিক্ষা (আরবি) বিভাগের শিক্ষক মো.এছহাক, হাদিস মাধ্যামিক বিভাগের শিক্ষক আব্দুল মান্নান এবং কিতাব বিভাগ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান ও বোর্ডিং সুপার মনির হোসেন।

মাসিক ‘দাওয়াত’ নামে একটি মাসিক ইসলামী পত্রিকায় সব সময়েই মুফতি ইজাহারসহ কয়েকজন উগ্রবাদী নেতা লেখালেখি করেন। দলটির কর্মসূচীও পাওয়া যায় এখানে। সেখানে নিজেই এক সময় আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে কাজ করার কথা লিখেছিলেন উগ্রবাদী এ নেতা।
বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করার নীলনক্সা বান্তবায়নে হেফাজতকে নেতৃত্ব দেয়ার মূল দায়িত্ব পালন করছেন মুফতি ইজাহারুল ইসলাম। ইসলামের বিভ্রান্তিমূলক বাণী দিয়ে উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে সক্রিয় করা হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে। তাতে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে হরকত-উল-জিহাদ (হুজি) কানেকশনে অভিযুক্ত মুফতি ইজাহারুল ইসলাম। হেফাজতে মুফতি ইজহার বরাবরের মতো তার নেপথ্য ‘খেলায়’ মহাসচিবসহ তিন শীর্ষ নেতাকে বহিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। গত কয়েক মাস ধরেই আন্দোলনের নামে সহিংস তান্ডবে সক্রিয় মুফতি ইজাহার ও তার দুই ছেলে মুসা এবং হারুন বিন ইজাহার। পটিয়া, হাটহাজারী সহ দেশের কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশ অস্থিতিশীল করা তার টার্গেট ।
কেন তাদের এতো প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে প্রশ্ন তুলেছেন তরিকত ফেডারেশনের নেতারা। বলেছেন, হেফাজত নেতারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা লুটছে। এবার বেরিয়ে পড়েছে অপকর্ম। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য দেশবাসীতে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছে তরিকত ফেডারেশন। একই দাবি নিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসলামী ফ্রন্ট ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নেতারা। ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব ও আহলে সুন্নাতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা এমএ মতিন বলেন, ধর্ম ব্যবসায়ী জঙ্গীদের আসল চেহারা বেরিয়ে গেছে। অবিলম্বে এই জঙ্গী নেতাকে আটক করতে হবে। ওদের কওমি মাদ্রাসায় জঙ্গী প্রশিক্ষণ হয়। সরকারকে অবিলম্বে অভিযান চালাতে হবে। তিনি বলেন, আমরা বহুবার বলেছি হেফাজত নেতারা জঙ্গী। এরা একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী। একই কথা বলেছেন, সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান। তিনি বলেন, হেফাজত নেতারা ১৩ দফার নামে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেছেন। এমন দাবি দেশের সাধারণ মানুষের ও ।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের নাহয় মাথাব্যথা নেই । কিন্তু দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে শপথ করেছেন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ই একজন। তার এবং তার জনগণের স্বার্থে প্রশাসন কি দায়িত্বে তৎপর হবেন? মুফতি ইজাহার , মুসা বিন ইজাহার এবং হারুণ বিন ইজাহার কে দ্রুততার সাথে গ্রেফতার না করলে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবেন এই নিদ্রাকাতর সর্বনাশা প্রশাসন!
০৮ অক্টোবর২০১৩
Sumikhan29bdj@gmail.com