Sunday, October 20, 2013

রাজাকারপ্রেমী খালেদা জিয়ার হিন্দুপ্রীতি - ভূতের মুখে রামনাম:শাহরিয়ার কবির


আমার বাড়িতে আর অফিসে রোজ এক ডজন দৈনিক পত্রিকা আসে। কিছু সৌজন্য সংখ্যা, কিছু কিনতে হয়। সবার আগে যে পত্রিকাটি হাতে তুলে নিই, সেটি জনকণ্ঠ। এই পত্রিকাটির প্রতি দুর্বলতা প্রধানত তোয়াব খানের কারণে। মুক্তিযুদ্ধের পর দৈনিক বাংলা এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যখন সাংবাদিকতায় হাতেখড়িÑ সম্পাদক তোয়াব ভাই শিখিয়েছেন আধুনিক সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকের নৈতিক, সামাজিক দায় ও অঙ্গীকার কাকে বলে। ২০ বছর পর এই দায় ও অঙ্গীকারের কারণেই খালেদা জিয়ার সরকার বিনা নোটিসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে আমাকে বরখাস্ত করেছিল।
এরপর তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশেরও চেষ্টা করেছিলাম। খালেদা জিয়ার রোষানলের ভয়ে কোন মালিক আমাকে নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাননি। এমন এক সময় ছিল তখন কোন পত্রিকা আমার লেখা ছাপতেও আগ্রহী ছিল না। তোয়াব ভাই জনকণ্ঠে যোগ দেয়ার পর তাঁরই কারণে এই পত্রিকার প্রতি আমার আগ্রহ। জনকণ্ঠের সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ ও উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিভু নিভু মশালটি তাঁরা যেভাবে জ্বালিয়ে রেখেছেন, সেই আলো মুক্তিযুদ্ধোত্তর নতুন প্রজন্মকে এখনও পথ দেখাচ্ছে, আলোকিত করছে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ার সাহস যোগাচ্ছে।
এর জন্য জনকণ্ঠকে মাসুলও কম দিতে হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলেই সম্ভবত ১৯৯৫ সালে তোয়াব ভাই, বোরহান ভাই ও শামসুদ্দিন ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছিল মৌলবাদীদের ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে লেখার জন্য। সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ সেবার পালিয়ে গিয়ে গ্রেফতার এড়ালেও ২০০৭ সালে ঠিকই তাঁকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল এবং ২২ মাস বিনা বিচারে কারানির্যাতনও ভোগ করতে হয়েছিল।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা, নির্যাতন ও গণগ্রেফতারসহ সারা দেশে সন্ত্রাসের যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিলÑ মনে হয়েছিল গোটা বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য না করা পর্যন্ত এর অবসান ঘটবে না। জনকণ্ঠে তখন ধারাবাহিকভাবে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে লিখেছি। এসব লেখার জন্যই ক্ষমতায় আসার পর পরই খালেদা-নিজামীদের সরকার আমাকে গ্রেফতার করেছিল। দেশে ও বিদেশে এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদও হয়েছিল। ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ যখন এই গ্রেফতারের নিন্দা করে আমাকে ‘কারাবন্দী বিবেক’বলেছিল। সেদিন জনকণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল সেটি। কারাগারে এক তরুণ বন্দী কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে জনকণ্ঠের সেই সংখ্যাটি এনে লুকিয়ে আমাকে দিয়েছিল। জনকণ্ঠ তখন কারাগারেও নিষিদ্ধ। খালেদা-নিজামীদের নির্মম কারাগারের দুঃসহ পরিবেশে জনকণ্ঠের সেই সংবাদ পড়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি।

দু’ বছর পরে ‘এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ তাদের ঘোষিত কারাবন্দী বিবেকদের নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিল, যাদের তালিকায় নেলসন মেন্ডেলার মতো মহাজনদের পাশে আমার মতো অভাজনও ছিল। এ্যামনেস্টির প্রশ্নকর্তা জানতে চেয়েছিলেন আমি কখন কিভাবে জেনেছিলাম তারা যে আমাকে ‘কারাবন্দী বিবেক’ ঘোষণা করেছেন। আমি জনকণ্ঠের সেই সংবাদ শিরোনামের কথা বলেছিলাম।
খালেদা-নিজামীদের দুঃশাসনের অন্যতম বলী জনকণ্ঠ যখন টিকে থাকার জন্য হাঁসফাঁস করছে, যখন মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে এবং সরকারের রোষানলের কারণে নামীদামী সাংবাদিকরা অন্য কাগজে চলে যাচ্ছেন, যখন নিয়মিত লেখকদের সম্মানী দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে তখনও জনকণ্ঠ ছেড়ে চলে যাইনি। আমার বন্ধু মুনতাসীর মামুন, কলাম লিখিয়ে হিসেবে খ্যাতি, তাঁর গবেষক-ঐতিহাসিকের খ্যাতিকে ম্লান করে দিয়েছে, সেটাও জনকণ্ঠেরই কারণে। মাঝখানে মামুন অভিমান করে দু’বছর জনকণ্ঠে লেখেননি। পাঠকদের চাপের কারণে আবার ওঁকে জনকণ্ঠে ফিরে আসতে হয়েছে। ২০০২ সালে আমার সঙ্গে মুনতাসীর মামুনকে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে ময়মনসিংহের সিনেমা হলের বোমা হামলার কথা বলেছিল খালেদা-নিজামীদের সরকার- পাগলেও তা বিশ্বাস করেনি। মামুনকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল জনকণ্ঠে লেখার কারণে।
জনকণ্ঠে যেদিন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর মুনতাসীর মামুনের লেখা ছাপা হয় অন্য সব খবর পড়ার আগে তাদের লেখা পড়ি। গাফ্ফার ভাইকে বলা হয় না বটে, মামুনকে ফোন করে বলি কোন বিষয়টি আমার ভাল লেগেছে। ভুল কিছু থাকলে শুধরেও দিই। গতকাল ও আজ মামুন পর পর দুটো লেখা লিখেছেন জনকণ্ঠে। গতকাল ১৯ অক্টোবর মামুনের লেখার শিরোনাম ছিল ‘এ দেশে কি সত্যিকারের বাঙালীরা বাস করে না’? বিষয় ছিল ইটালিতে এরিক প্রাইবেক নামের এক নাৎসি যুদ্ধাপরাধী মারা গেছে, কোথাও তার কবর হচ্ছে না। ইটালির মানুষ তাকে তাদের দেশে কবর দিতে দেবে না। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল আর্জেন্টিনা থেকে, সেখানেও তার কবর হবে না- সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে দেশের সরকার। যুদ্ধাপরাধীর লাশ পড়ে আছে মর্গে, কেউ বলছে তাকে পুড়িয়ে ছাই করে এমন জায়গায় ফেলা হোক কেউ যাতে জানতে না পারে। কারণ কোথাও তার কবর হলে নব্য নাৎসিরা সেখানে মিলিত হয়ে ফুল দেয়ার সুযোগ পাবে। এরপর মামুন প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশে যে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে, তাদের অনেকের ফাঁসিও হবে, তাদের কবর কোথায় হবে? তার লেখায় গোলাম আযমদের মানবতাবিরোধী অপরাধের নৃশংসতার কিছু উল্লেখ করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের প্রতি যথারীতি বিদ্রুপাত্মক কিছু মন্তব্যও করেছেন। মামুন লিখেছেন‘গোলাম আযমদেরও মৃত্যু হবে। তখন কি হবে? যেহেতু যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষের সরকার, সেহেতু তাদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। জেনারেল জিয়া/এরশাদ/খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলে এ প্রশ্ন উঠত না। তারা পারলে এদের কবরে স্মৃতিসৌধ তৈরি করতে কসুর করবেন না।
আমেরিকা এ সব বিবেচনা করে বিন লাদেনের মৃতদেহ পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। বিন লাদেন এখন বিস্মৃত। কিন্তু, তার মরদেহ পাকিস্তানে থাকলে এখন আজমীরের মতো মাজার শরিফ বানিয়ে ফেলা হতো। আমাদের রাজাকার ও রাজাকারপন্থী পার্টিগুলো কিন্তু এখন থেকেই প্ল্যান ছকে রেখেছে, নবীনগরে গোলাম আযমের মাজার হবে, পিরোজপুরে সাঈদীর আর সাঁথিয়ায় নিজামীর। রাউজানে সাকার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ হবে। যাতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে যুদ্ধাপরাধ কোন বিষয় বলে পরিগণিত না হয়। এবং এক দশক পর হজরত শাহ গোলাম আযম পাকিস্তানীর নামে উরস হবে। যেভাবে জিয়াউর রহমানের কবর মাজারে পরিণত করা হয়েছে। এবং এখন খবরের কাগজ ও টিভি প্রতিবেদনে একে মাজার বলেও উল্লেখ করা হয়, যদিও তা শরিয়তবিরোধী। এগুলো হতে পারে, বাংলাদেশী তো। গোলাম আযমের প্রকাশ্য সমর্থনকারী যদি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তাহলে সাকার স্মৃতিস্তম্ভ হতে দোষ কি! আর যাই হোক আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত মওলানাদের আর যাই থাকুক ভ্যাটিকানের মওলানাদের মতো সাহস আর ধর্মবোধ নেই। তারা যে এরিকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অস্বীকৃতি জানিয়েছে তার কারণ নৈতিকতা, ধর্মবোধ ও মানবতা এবং সভ্যতা বোধ। একটা উপায় হতে পারে, যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আলাদা ছোট গোরস্তান।’
মামুনের লেখা পড়ে বিশিষ্ট আলেম, সম্মিলিত ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসানকে ফোন করেছিলাম। তিনি জানালেন, ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বরে এ নিয়ে তিনি মুক্তাঙ্গনে গণসমাবেশ করেছেন এবং পবিত্র কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও গণহত্যাকারীরা আল্লাহ ও রসুলের দুষমন। তাদের জানাজাও পড়া যাবে না, কোন গোরস্তানে কবরও দেয়া যাবে না। মামুনের সঙ্গে তিনি একমতÑ ওদের জন্য নির্দিষ্ট গোরস্তান থাকতে হবে। তাঁর মতে খুলনার ডাকাতিয়া বিল রাজাকারদের গোরস্তানের উপযুক্ত স্থান। মওলানা জিয়াউল হাসান আরও জানালেন, মহানবীর (সা) এক দুষমন, গণহত্যাকারী আবু জেহেলের কবরকে গণশৌচাগারে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

১৯৯৭-এর ৪ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ যুদ্ধাপরাধী এসএ সোলায়মানের লাশ মিরপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের গোরস্তানে দাফন করতে দেয়নি। সোলায়মান যদিও এখানে আগে থেকে জমি কিনে রেখেছিলেন তারপরও নির্মূল কমিটির ২৪ ঘণ্টা অবরোধ অবস্থানের কারণে যুদ্ধাপরাধী সোলায়মানকে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করতে হয়েছে। নির্মূল কমিটির সেই অবরোধ কর্মসূচীতে বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ হাসান ইমাম, গণআদালতের অন্যতম বিচারক ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরীসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিলেন।

জনকণ্ঠে ২০ অক্টোবর মুনতাসীর মামুনের লেখার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানী জারজদের রাজনীতিও মানতে হবে?’ এ লেখার শুরুতে মামুন চিলির আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অতীতে পিনোচেটের সরকারের নির্যাতনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, গণস্মৃতি বলি কিংবা ‘কালেকটিভ মেমরি’ বলি একে সব সময় জাগ্রত রাখতে হয়, নাহলে মানুষ অতীত ভুলে যায়। মামুন খালেদা জিয়ার রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী-জামায়াতপ্রেমের উল্লেখ করেছেন। খালেদা জিয়ার জামায়াত ও রাজাকার প্রেমের বোধগম্য কারণ আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর পুত্র হায়দার ফারুক জানিয়েছেন, যেহেতু জামায়াত ও খালেদার অর্থের উৎস ও গডফাদার অভিন্ন সেহেতু খালেদার পক্ষে কখনও জামায়াত বা জামায়াতের দোসরদের সঙ্গ পরিহার করা সম্ভব নয়।

বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে যে ১৯৭১ বা ২০০১-এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এ বিষয়ে মুনতাসীর মামুন তাঁর কলামে লিখেছেন, আমরা যারা ভুক্তভোগী ভাবতে গেলেও আতঙ্কবোধ করি। ২০০৬ সালে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জমানায় প্রথম ১৫০০ দিনের সংখ্যালঘু নির্যাতনের শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিলাম। প্রায় তিন হাজার পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রে ধারাবাহিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিলÑ এসব নজিরবিহীন নৃশংস নির্যাতনের ঘটনার অস্বীকৃতি। প্রথম থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী এসব নির্যাতনের ঘটনা অস্বীকার করে বলেছেন, ‘পত্রিকায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন সম্পর্কে অতিরঞ্জিত সংবাদ ছাপা হচ্ছে।
পত্রিকায় যা ছাপা হয়েছে তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অসত্য ও ভিত্তিহীন, কারণ পত্রিকার সংবাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের পাঠানো রিপোর্টের কোন মিল নেই।’ (জনকণ্ঠ, ১৮ অক্টোবর ২০০১)
খালেদা-নিজামীদের জোট সরকারের নীতি ও লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে ‘হিন্দুশূন্য’ এবং ‘আওয়ামী লীগশূন্য’ করা। জেলা প্রশাসকদের কি ক্ষমতা ছিল জোট সরকারের এই নীতি ও লক্ষ্যের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবেদন প্রদানের? আমরা প্রথম থেকেই বলেছিলাম সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। খালেদা-নিজামীদের জোট সরকার কিভাবে সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়েছে, প্ররোচিত করেছে, আশ্রয় দিয়েছে এর বহু বিবরণ নির্মূল কমিটির শ্বেতপত্রে রয়েছে।
তখনকার বহুল আলোচিত ঘটনা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা শীলকে গণধর্ষণের প্রতিবেদন যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় তখন স্থানীয় প্রশাসন সাংবাদিকদের ওপর খড়গহস্ত হয়েছিল। ঘটনা ঘটেছিল ২০০১-এর ৮ অক্টোবর, পত্রিকায় এসেছে ১৬ অক্টোবরে। স্থানীয় সাংবাদিকদের অনুরোধে নির্মূল কমিটির প্রতিনিধি দল ১৯ অক্টোবর উল্লাপাড়া গিয়ে পূর্ণিমা ও তার পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দী রেকর্ড করেন। ২০ অক্টোবর পূর্ণিমাকে ঢাকায় এনে সংবাদ সম্মেলনে এই নৃশংস নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরা হয়। পূর্ণিমার মা বাসনা রাণী যখন কান্নাভরা গলায় নির্যাতনের বিবরণ দিচ্ছিলেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকেই সেদিন অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, এটি সম্পূর্ণ সাজানো ঘটনা। পরে আদালতে প্রমাণ হয়েছে এটি কোন সাজানো ঘটনা ছিল না। পূর্ণিমার ধর্ষণকারীরা সাজা পেয়েছে।নির্মূল কমিটির শ্বেতপত্রে খালেদা নিজামীদের সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রথম ১৫০০ দিনে ২৭৮৬টি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ২০০১-এর এই অক্টোবর মাসে আমাদের শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৩৬০টি ঘটনা ঘটেছিল। বর্তমান সরকারের আমলে গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদনে এর দ্বিগুণের বেশি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এসব নির্যাতনের জন্য দায়ী খালেদা জিয়ার সরকারকে কখনও কোথাও জবাবদিহি করতে হয়নি। যারা এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রধান কুশিলব তাদের বিচার হয়নি। হয়নি বলেই সংখ্যালঘু নির্যাতন বাংলাদেশে এখনও বন্ধ হয়নি।
২০ অক্টোবর জনকণ্ঠে মুনতাসীর মামুনের কলাম শেষ করে প্রথম পাতায় দেখি দারুণ চমকপ্রদ এক সংবাদ, যার শিরোনাম ‘সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত এলে প্রতিহত করব ॥ খালেদা জিয়া’।
আগের দিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি গ্রুপের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় ২০০১-২০০৬ সালের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এই অভাবনীয় উক্তি পড়ে অনেক বাংলা প্রবাদ এবং প্রবাদসম বাক্য মনে পড়লÑ যার ভেতর বহুল প্রচলিতটি হচ্ছে ‘ভূতের মুখে রামনাম’! আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য থেকে ‘একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে!’
যে খালেদা জিয়ার জমানায় পিতা ও স্বামীকে বেঁধে রেখে তার চোখের সামনে মা ও মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে যার জমানায় এক অসহায় হিন্দু মা আগত ধর্ষকদের জোড়হাতে মিনতি করছেনÑ ‘বাবারা তোমরা একজন একজন করে আসো, আমার মেয়েটা খুব ছোট’, সেই খালেদা জিয়া বলছেন, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত এলে প্রতিহত করব!’ প্রাচীন বাংলা নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তিটি নিশ্চয় পাঠকদের মনে আছেÑ ‘কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!’
আজ ২০ অক্টোবর। বারো বছর আগে এই দিন সকালে সিরাজগঞ্জ থেকে বিএনপির সন্ত্রাসীদের হাতে ধর্ষিতা পূর্ণিমা সপরিবারে এসে উঠেছিল আমার বাড়িতে। বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে পূর্ণিমার মা তাদের গোটা পরিবারের উপর নির্যাতনের বিবরণ দেবেন। সন্ত্রাসীরা পূর্ণিমার উপর পাশবিক নির্যাতন করে ক্ষান্ত হয়নি, বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। পূর্ণিমা এবং তার মার পরনে শতচ্ছিন্ন কাপড়। পূর্ণিমার বয়সী আমার কিশোরী কন্যা মুমু আর স্ত্রী ডানাকে বললাম ওদের পরার মতো কিছু কাপড় দিতে। একটু পরে মুমু আমার কাছে এসে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল, বাবা, তুমি দেখেছ পূর্ণিমাকে ওরা কী করেছে? আমি জানি না কী করেছে। পূর্ণিমার তখন কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। আমার মেয়ে পূর্ণিমাকে জামা পরাতে গিয়ে দেখেছে ওর সারা শরীরে খালেদা জিয়ার হিংস্র্র হায়েনাদের কামড়ের দাগ, গায়ের মাংস খুবলে নিয়েছে। মুমুর কান্না শুনে মনে হয়েছিল ওর ওপর যদি এমন অত্যাচার হতো আমি কী করতাম। পূর্ণিমাকে ডেকে বলেছি, এখন থেকে মুমুর মতো তুমিও আমার মেয়ে।

আমার পিতৃদায় মোচন করেছে নির্মূল কমিটির সহযোদ্ধারা। শেখ হাসিনা পূর্ণিমার পরিবারকে জমি দিয়েছেন, অর্থ সাহায্য করেছেন। খালেদা-নিজামীদের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত, নিহত, সম্পদহারা বহু পরিবারকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও সাহায্য করেছেন। এসব সাহায্যের কথা কখনও তিনি গণমাধ্যমকে জানাননি।

আজ খবরের কাগজে যখন দেখি হাজার হাজার হিন্দুনারী ধর্ষকদের গডমাদার খালেদা জিয়া বলছেন, ‘সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত এলে প্রতিহত করব’, তখন তাকে সবিনয়ে বলতে চাই তিনি ও তাঁর মন্ত্রীরা তখন যদি এসব ঘটনাকে ‘অতিরঞ্জিত’ ও ‘বানোয়াট’ সংবাদ না বলতেন, যদি প্রতিহত করার উদ্যোগ নিতেন, তাহলে পূর্ণিমাদের মতো হাজার হাজার মেয়ে হামলা ও নির্যাতন থেকে বেঁচে যেত, তিন লক্ষাধিক হিন্দুকে দেশ ছাড়তে হতো না। হিন্দুদের সমর্থন পেতে হলে খালেদা জিয়াকে সবার আগে পূর্ণিমাদের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।
জনকণ্ঠের খালেদা জিয়ার খবরে দেখলাম, তাঁকে বরণ করার সময় আগত হিন্দু নারীরা উলুধ্বনি দিয়েছেন। ধারণা করতে পারি এই উলুধ্বনি নিশ্চয় খালেদা জিয়ার কানে গলানো সিসা ঢেলে দিয়েছিল। কারণ ’৯১ সাল থেকে শুনছি নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদা জিয়ার একটি প্রিয় বাক্য হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে মসজিদে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে। মনে হয়, শুভেচ্ছা বিনিময়ে আগত হিন্দু নারীরা এভাবেই উলুধ্বনি দিয়ে খালেদা জিয়ার হিন্দুবিদ্বেষের জবাব দিয়েছেন।

জামায়াত ও আইএসআইপ্রেমী খালেদা জিয়া যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন তখন প্রমথনাথ বিশীর সরস গল্পের সেই বাক্যটি মনে পড়ে ‘বাঘে যখন ঘাস খায়, ডাক্তার যখন ভগবানের নাম নেয়, তখন বুঝতে হবে সর্বনাশের আর বাকি নেই।’ হিন্দু সম্প্রদায়ের যে নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েছিলেন তাঁদের দায় আমরা বুঝি। কদিন আগে কাগজে দেখেছি ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের একটি দল নরেন্দ্র মোদীর জন্য ভোট চাইছেন। ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্ভবত এমন পরিস্থিতির কথা ভেবেই লিখেছিলেন, ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।

২০ অক্টোবর ২০১৩।

No comments:

Post a Comment